গড়িয়া থেকে অফিসের এক জুনিয়র কলিগের বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছিলাম। আমার স্ত্রী বিদিশার শরীরটা ভাল না থাকায় ও আসেনি। এদিকে আমাদের পুরান ড্রাইভার রাজু ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। অফিস থেকে ফিরে আর ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছিল না, পাড়ার সেন্টার থেকে একজন ড্রাইভার ডেকে নিয়েছি।
বিয়েবাড়িতে অবশ্য বেশিক্ষণ থাকিনি। উপহারটা দিয়ে চট করে দুটো খেয়ে অফিসের বাকি লোকদের সঙ্গে সৌজন্যবিনিময় করে বেরিয়ে পড়েছি। বাড়ি গিয়ে কিছু কাজ আছে। কাল দিল্লী থেকে আমাদের জি এম আসছেন, ওনার জন্য করা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনটা একটু মাজা-ঘষা করতে হবে৷
আমাদের বাড়ি সল্টলেকে। আসার সময় বাইপাসে জ্যাম পেয়েছিলাম। এখন রাত হয়েছে, হয়ত ফাঁকা থাকবে। গাড়িটা পিয়ারলেস হসপিটাল ছাড়াচ্ছে, এখন সাড়ে নটা বাজে, ফাঁকা থাকলে দশটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব। চোখ বুজে সীটে হেলান দিলাম।
এইসময় ড্রাইভার ছেলেটি হঠাৎ বলল, স্যার আপনাদের একটা অ্যাম্বাসাডর ছিল না?
ছিল তো বটেই কিন্তু সে তো প্রায় বছর দশেক আগে বিক্রি করে দিয়েছি। তারপর একটা মারুতি এস্টিম কিনেছিলাম। কিছুদিন আগে সেটাও বদলে এই ডিজায়ার-টা কিনেছি। এই লোকটি হঠাৎ জানল কী করে? হয়ত পাড়ার ছেলে, কোনভাবে রাজুর কাছে শুনে থাকবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বিস্মিত ভাবে বললাম, হ্যাঁ, সে তো অনেকদিন আগের কথা।
লোকটি আবার বলল, 'আপনি তো সেটাতেই গাড়ি চালানো শিখেছিলেন।'
এবারে কিছুটা বিরক্তি লাগছিল। আমার ড্রাইভিং শেখার স্মৃতি খুব সুখের নয়। আর এই লোকটির সেই সব পুরান কথায় কী দরকার? কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। এতে যদি বোঝে। গাড়িটা এখন রুবির মোড় ছাড়াচ্ছে। লোকটি এবার নীচু অথচ স্পষ্ট শোনা যায় এমন গলায় বলল, ‘আপনি রবিবার রবিবার সকালে ড্রাইভার রাজুকে নিয়ে সল্টলেকের ফাঁকা রাস্তায় প্র্যাকটিস করতেন।’
আমি চমকে উঠলাম। লোকটি কী বলতে চাইছে? এত সব ও জানল কী করে?
লোকটি বলেই চলল, 'সেদিনটা ছিল রবিবার। সেদিন প্রথমবার আপনি রাজুর কাছ থেকে স্টিয়ারিং হাতে নিয়েছিলেন। রাজু দিতে চায়নি, আপনি জোর করেছিলেন।'
পিছনের সীটে বসে টের পেলাম আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, এসি চলা সত্ত্বেও ঘাম হচ্ছে। ও এরপর কী বলবে তা আমি জানি।
--করুণাময়ী আইল্যান্ড পার হবার সময় টাল সামলাতে না পেরে আপনি একটি লোককে ধাক্কা দেন। লোকটি রাস্তায় পড়ে যায়। আপনি যদিও নীচে নেমে দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাজু আপনাকে আটকেছিল। চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছিল, ও চট করে সীট বদল করে স্পিড তুলে বেরিয়ে যায়। আপনিও বিপদ বুঝে আর আপত্তি করেননি।
আমার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে লাফাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কোনরকমে বললাম, আমি.... আমি ফিরে এসেছিলাম।
লোকটির গলায় যেন সামান্য হাসির শব্দ শোনা গেল। সে বলল, হ্যাঁ, গাড়ি গ্যারেজে রেখে আপনি ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে গেছিলেন। আশেপাশের দোকানদার ও অন্যান্য লোকদের সঙ্গে সন্তর্পণে কথা বলে আপনি জেনেছিলেন ওকে বিধাননগর জেনারেল হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আপনি সেখানে গিয়ে লোকটিকে খুঁজেও পেয়েছিলেন। বছর তিরিশেক বয়স, নিম্নমধ্যবিত্ত লোকটি একটি ছোট ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। ঘরে বৌ ও এক ছেলে ছিল। আপনার গাড়ি ওর পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। পা-টা সম্ভবত কেটে বাদ দিতে হয়।
গাড়িটা এখন চিংড়িহাটা ক্রসিংএ। এখান থেকে ফ্লাইওভারে উঠে ডানদিক দিয়ে আমার সল্টলেকে ঢোকার কথা। কিন্তু গাড়ি সোজা উল্টোডাঙ্গার দিকে চলেছে। লোকটি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছে?
লোকটি আবার বলতে লাগল, আপনি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে লোকটির পরিবারের হাতে চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরে ওদের সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি।
আমি জলে ডুবতে থাকা মানুষের ভঙ্গিতে দুই হাত সামনে তুলে বললাম, আমি... অফিসের দরকারি কাজে আমাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে আর ওর খোঁজ পাইনি। লোকটি হাসল। বলল, জানি। এবারে ধরুন পা কাটা পড়ায় লোকটি আর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে পারেনি। সারা জীবনের মত ওর উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছিল। হয়ত লোকটি সামান্য পুঁজি দিয়ে একটি দোকান দিয়েছিল, হয়ত যেরকম হয়, সে দোকান ধারে-দেনায় বেশিদিন চলেনি। হয়ত ওর ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
আমি নির্বাক। লোকটি আবার সামান্য হেসে বলল, একটা জীবনের দাম কি কয়েক হাজার টাকায় হয় স্যার? তবে অন্য একভাবে শোধ হতে পারে।
লোকটি হঠাৎ স্টিয়ারিং থেকে দুই হাত তুলে নিয়ে আমার মুখোমুখি ঘুরে বসল। আমার মুখের ঠিক সামনে ওর মুখ। আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠলাম। তারপর চোখের উপর একটা আলোর ঝলকানি, প্রচণ্ড একটা শব্দ... আর কিছু মনে নেই।
‘স্যার উঠুন।’
ড্রাইভারের ডাকে সম্বিৎ ফিরে এল। তাকিয়ে দেখি বাড়ির গ্যারাজের সামনে গাড়িতে বসে আছি। লোকটি আবার বলল, আপনি নেমে যান, আমি গাড়ি গ্যারাজ করে চাবি দিয়ে আসছি৷ ... তা হলে... অ্যাকসিডেন্ট?
লোকটি খুব অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের অ্যাকসিডেন্ট? আমার হাতে গাড়ি থাকলে একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগবে না স্যার, নিশ্চিন্ত থাকুন।’
দুর্বল পায়ে কোনরকমে উপরে উঠে গেলাম। স্ত্রী দরজা খুলে আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো?’
সংক্ষেপে "না" বলে জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এমনিতে ঘুম আসবে না, তাই একটা ঘুমের ওষুধ খেতে হল।
পরের দিন সকালে উঠে দেখি বেশ ঝরঝরে লাগছে। এবারে কাজ করা যেতে পারে। অফিসের কাজ তো আছেই তবে তার আগে একটা অন্য দরকারি কাজ আছে। আমার এক ক্লাসমেট শুভ্র একটা ডিটেক্টিভ এজেন্সি চালায়। ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হবে দশবছর আগে পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বিধাননগর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একটি লোককে খুঁজে বার করতে পারবে কিনা। লোকটির সঙ্গে একবার দেখা হওয়া বড় দরকার।