মন্দ মন্থরে সন্ধ্যা নামছে, মানুষ মহা আশঙ্কা জপছে মৌন মন্তরে, অজাগর গরজে সাগর ফুলছে। ‘নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি/ শত তরঙ্গে তোমা পানে উঠে ধাইয়া।’ অন্যদিকে কালচার-ইন্ডাস্ট্রি ক্রমশ পাখা বিস্তার করছে, বিশ্বায়নের সেই বিষামৃত গ্রহণ করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ, সব দেশের মানুষ—তৃতীয় থেকে প্রথম বিশ্বে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করা দরকার—কিছু কালজয়ী সৃজনশিল্পীকে। ইটালির প্রিমো লেভি (১৯১৯ - ১৯৮৭) এমন একজন। এককথায় লেভি এক ইহুদি কেমিস্ট, পার্টিপন্থী, হলোকাস্ট শিবিরপ্রত্যাগত জীবিত এক লেখক। বিশ্ব দুনিয়ায় জ্ঞান গরিমায় ইহুদিদের অবদান অসামান্য। আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ইহুদিদের। What was most striking about the German Third Reich under Hitler was the brutality with which anti-semitism was brought to its most horrendous and extreme conclusion through the murder of over five million Jews in concentration camps during world war II. (A Dictionary of Contemporary World History. Pg. 25) লেভির বন্দীজীবনের বিস্তৃত কথা তাঁর জীবনীতে আছে। আপাতত: শুধু এইটুকু জানাই--More than 6,800 Italian Jews--one-fifth of the country’s Jewish community--had perished in the Nazi Camps. Virtually every Jewish family in Italy had lost a relative or a friend to Auschwitz. (Primo Levi--Ian Thomson, Pg. 220) তিনি অনেকগুলি বই লিখেছেন, আছে উপন্যাস, গল্প সংকলন, প্রবন্ধ এবং কবিতা। টুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন কেমিস্ট্রি। দুর্ভাগ্যবশত ছিলেন একজন ইটালিয়ান ইহুদি, প্রতিরোধ আন্দোলনে যুক্ত হন ১৯৪৩-এ, তারপর গ্রেপ্তার, কারারুদ্ধতা ১৯৪৫ পর্যন্ত। কেমিস্ট হিসেবে বন্দীশিবিরে কাজ করতে করতে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান। মুক্তির পর তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হয় বেলোরাশিয়ায়, তারপর ফিরে আসা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে, ইটালিতে। সেখানে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য একটা কেমিকাল কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে কাজ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত। হলোকাস্ট শিবিরের এক মুখ্য বিবরণদাতা হিসেবে, নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আবহ তুলে ধরার অন্যতম লেখক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয়। এইসব ক্যাম্পে ইহুদি পরিচয়ে ও অন্যভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর গণহত্যা।
বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হবার বহুদিন পরেও তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত থেকে যান। ১১ এপ্রিল, ১৯৮৭ এই ইটালিয় লেখক প্রিমো লেভি তাঁর বাড়ির চারতলা থেকে নীচে পড়ে মারা যান। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তির চল্লিশ বছর পরে এই মৃত্যু আত্মহত্যা বলেই ঘোষিত। ৫ বা ৬ এপ্রিল গাইয়া সেরভাদিয়োকে লন্ডনে কথাসূত্রে জানান—যা কিছু করার করে গেছি। অভিজ্ঞতা বাড়াতে বা নব আবিষ্কারে আর ইচ্ছে নেই। স্ত্রী লুসিয়া তার স্বামীকে এমন মারাত্মক হতাশ পূর্বে দেখেননি, তার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলেন না। বিয়াংকা জিজ্ঞেস করল আউসউইতজ-এর যাতনা আবার ফিরে এল নাকি? লেভি বললেন—না, বেঁচে আছি। পারব আমার গল্প বলতে। পরের দিন সকালে ছাতা হাতে বেরুলেন চিঠি পোস্ট করতে। দুটো চিঠি—এক ডাচ চলচ্চিত্র চালককে, এক ভেনেসীয় ঔপন্যাসিককে। প্রথম জনকে বললেন, আগামী গ্রীষ্মের আগে সাক্ষাৎকার অসম্ভব, দ্বিতীয় জনকে বললেন, ফরাসী পত্রিকায় লেখা আত্মজীবন প্রসঙ্গের লেখাটির কপি পাঠাতে। এ চিঠিতে ছিল—প্রাণবন্ততা আর প্রত্যাশা। খুশ মেজাজের আড়ালে থাকছিল অভিপ্রায়। মৃত্যুর ২ দিন আগে টুরিনের এক সিনাগগকে ডাক পাঠালেন। বন্ধু ফেরেরো ফোনে মজা করে বলল—স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার নেবার জন্য কিন্তু যেতে হবে। লেভি উত্তরে কিছু বলেননি। অতি দ্রুত মানসিক আকাশ বদলে গেল। কাজিন কোলোম্বোকে লেভি জিজ্ঞেস করল প্রাপ্ত আঘাতের পর বিশ্রাম ঠিকমতো হচ্ছে তো? এল অন্তিম দিনের সকাল। সাত সকালে পরিচারিকা লেভিকে প্রাত্যহিক ইনজেকশন দিলেন। রাজনীতির মানুষ ফাসিনো তাকে ফোন করলেন সকাল ৯টা নাগাদ, ক্ষমতার পদ নিতে নারাজ লেভি। আর একটা ফোন। স্ত্রী লুসিয়া বেরুল বাজারে, তখন সাড়ে ৯টা। লেভি ফোনে ডাকলেন প্রধান রাব্বিকে। ক্যান্সার আক্রান্ত মা-কে নিয়ে লেখক বিব্রত। দশটা পাঁচে লেভি চারতলার ল্যান্ডিং-এ বেরোন আর মার্বেল সিড়ির রেলিং টপকে ঝাঁপ দেন। সাড়ে দশটায় স্ত্রী লুসিয়া বাজারফেরৎ দেখে প্রাঙ্গনে স্বামীর রক্তাপ্লুত দেহ--।
লেভির মৃত্যুতে আমেরিকার কোনো কোনো মহলে অসন্তোষ। New Yorker বলল লেভি তার পাঠকদের ঠকালেন। তবে লেভির এই আত্মহত্যা বোঝায় লেখকের জীবন আর শিল্প সমান্তরালে চলে না। লেভি বলেছিলেন—আমি আমার লেখায় নিজেকে নানাভাবে চিত্রিত করেছি—কখনো সাহসী, কখনো কাপুরুষ, কখনো ভবিষ্যভাবুক কখনো naive কিন্তু সবসময়ই থাকতে চেয়েছি সুবিন্যস্ত। তবে আমি সবসময় ভারসাম্যযুক্ত নই। ব্যালান্সের অভাবে গেছে অনেক কাল। তাঁর বন্ধুরা বলেছেন—তাঁর মরণ দিয়ে তাঁর লেখা বিচার করা উচিত নয়। এক বন্ধু বলেন—আত্মহত্যা ব্যক্তিমানুষটির কাজ। ওটাই সে বেছে নিয়েছে। আর এই পথেই সে গেছে শান্তির পথে।
কেউ বলেছে এই আত্মহত্যা দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা। এক বন্ধু বলেছে—বুকেনওয়াল্ড থেকে দেশমুক্তির বার্ষিকী উদযাপনকালে সে জীবন শেষ করে দিল। ক্ষুব্ধ আর এক বন্ধু কালক্রমে বুঝতে পারল লেভির আত্মহত্যা যথার্থ স্বাধীনতার চিৎকার। তার সব লেখায় অনুভবের নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু মৃতুবরণে সে দিল চিৎকার। এ যেন বীরব্যঞ্জকতা। আমার জীবন একান্ত আমারই, আমিই তা শেষ করে দিতে পারি। কেউ কেউ আকস্মিক সংবাদে শক পেলেন। এক কেমিস্ট হিসেবে তিনি তো জীবন শেষ করতে পারতেন বিচক্ষণতায় কোনো ড্রাগ খেয়ে, কোয়েসলারের মতো। বদলে তিনি ক্রাইম রচনার চরিত্রের মতো চলে গেলেন। এই ভয়ানক ও নাটুকে মরণে তিনি তার প্রিয়জনদের জঘন্য দৃশ্যের মুখোমুখি করলেন। নানা মুনির নানা মত, এমন মত হবে স্বাভাবিক। তবে জীবনীকার টমসনের মতে এই উড়ে আসা মরণ was both swift and lethal. পাসোলিনি হত্যার পর লেভির মৃত্যু পর্যন্ত এমন আলোড়ন ইটালিতে আগে হয়নি। সংবাদপত্রে হেড লাইন—Turin mourns the Maestro. তবে প্রধান সংবাদপত্র La Stampa তে ধর্মঘট থাকায় ফোনে ফোনে চলেছিল কৌতূহল নিবারণ, স্মৃতিবিনিময়।
সব আত্মহত্যার প্রসঙ্গে গজিয়ে ওঠে নানা ভ্রান্ত কথাবার্তা। লেভির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। কথা উঠল লেভি ভুগছিল persecution complex-এ, দেখছিল নয়া ফ্যাসিস্তদের উদ্যত বন্দুক। সিসিলির এক ঔপন্যাসিক (Gesualdo Bufalino) বললেন লেভি কয়েকদিন আগে ভারী রাত্রে দেখছিল পোলানস্কির চলচ্চিত্র The Tenant, যাতে এক ফরাসী ইহুদি চারতলার ফ্ল্যাট থেকে লাফিয়ে পড়ে পারীতে। এ হল—‘emotional contagion’. রোমান্টিক ব্যাখ্যা দিলেন—নাতালিয়া গিনসবার্গ—আউসউইৎস-এ্রর মর্মান্তিক স্মৃতি তাকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুতে। মোরাভিয়া বললেন লেভি মারা গেছে বন্দী শিবিরের রুগ্নতায়, যা মুছে যায় না। তবে লেভির ছেলে বাবার The Truce বইটা দেখিয়ে (শেষপাতা) বলেন এ মন্তব্য ভুল। ব্যাখ্যা অনেক, কিন্তু ঘটনা একটাই—মৃত্যু।
মূলত কেমিস্ট হলেও লেভি লিখেছেন কবিতা (The Collected Poems of Primo Levi, অনুবাদ ১৯৮৮)। প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনা (Other People’s Traders (অনু. ১৯৮৯), ছোটগল্প (The mirror Maker, ১৯৮৯), তাঁর একধরনের গল্প আছে The Periodic Table (অনু. ১৯৮৪) বইতে যাতে চমকপ্রদ উপভোগ্য ভঙ্গিতে গল্প, ভিত্তি পিরিয়ডিক টেবিলের ২১টি কেমিকাল উপাদান নিয়ে, যা মানুষের মেটাফর ও বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক, যেসব মানুষ ছিল বন্দী শিবিরে, তাদের নিয়ে। একটি বইতে আছে দেশ মুক্তির পর আত্মমুক্তি, সোভিয়েত রাশিয়া হয়ে ইটালি ফেরার কথা, (The Truce, অনু. ১৯৬৫) যে গল্প আবার আসে আরো গুরুত্ব নিয়ে If not now, When? (অনু. ১৯৮৫) বইতে।
তাঁর The Search for Roots বইটি একটি সংকলন যাতে আছে গল্প, কবিতা, বিজ্ঞাপন, দর্শন, ভ্রমণগল্প, লিখেছেন সুইফট, কনরাড, এলিয়ট, আর্থার ক্লার্ক আর লুক্রেসিয়াস, গিউসেপিল বেলি, ফ্রেডরিক ব্রাউন, হের্মান লাংবেইন। লেভির বিচিত্র অধ্যয়ন, বিজ্ঞানে বিপুল দখল, আউসউইৎসে টিঁকে থাকা নিয়ে, যা সর্বজনীন আবার তীব্রভাবে আত্মজৈবনিক। ক্যারোল অ্যাঙ্গিয়ার বলেন বোধকরি এটাই লেভির ভালো আত্মজীবনী (New Statesman)। লেভি দক্ষ গল্পকথক, তবে রূপকথা লেখেন নি। Moments of Reprieve বইতে বেশ কিছু মানুষের গল্প শোনান যারা ট্রাজিক পটভূমিতে (আউসউইৎস) দাঁড়িয়েছিলেন সংকল্প ও সামর্থ্য নিয়ে, যাদের প্রতিক্রিয়াই গুণ। প্রতিটি রচনার কেন্দ্রে এক একজন মানুষ যারা একটি আপেল বা একটি চিঠি নিয়ে কৌশলে উন্মোচন করে the bizarre, margined moments of reprieve. A Tranquil Star হল ১৭টি গল্পের সংকলন যাতে উন্মোচিত বিচিত্র প্রেম, নিষ্ঠুরতা, ভাগ্যের অদ্ভুত মোচড়। The Fugitive গল্পে জনৈক অফিস কর্মচারি লিখে ফেলেন এক চমৎকার কবিতা অদেখা ফলাফল নিয়ে। Magic Paint গল্পে আছে এক দল গবেষক যারা আবিষ্কৃত রঙ দিয়ে দুর্ভাগ্য থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। Gladiators গল্পটিতে আছে জনহিংসা হিমকরা উত্থান আর The Tranquil গল্পে আছে নিমগ্নভাবে তারা দেখার কথা, যাতে প্রকাশ পায় ভাষা, কল্পনা, অনন্ত সম্পর্কে মগ্নতা। সানডে টেলিগ্রাফ বলেছিল বইটি হল কল্পনার উচ্চতম নিদর্শন।
The Sixth Day বইতে আছে ২৩টি গল্প যাতে প্রকাশিত এক অদ্ভুত অথচ পরিচিত বিশ্ব, যা সুরুচিপূর্ণ আবার মজার, জীবনকে দেখা হয় নক্ষত্র দূরত্ব থেকে, একটা ফুটবল স্টেডিয়াম দেখার আগ্নেয়গিরির অগ্নিমুখ হিসেবে। লেভির বিরল উইট (Wit) এর নিদর্শন এ বইতে। কল্পনাসৃষ্ট এই জগৎ, যাতে মানব মনোজগতের সবলতা ফুটে ওঠে। মানব সঙ্কল্প, সৃষ্ট হয় ষষ্ঠ দিনে, যার উপভোগ্যতা অনিঃশেষ। পত্রিকা বলেছিল—Marvellous…. ranging from grim allegory to buoyant ingenuity, these tales encompass a wide span of moods. এর ভেতর থেকে গুরুত্ব পায় জীবনের precariousness and preciousness. বন্দীশিবির প্রত্যাগত লেখকের গল্পভাবনায় প্রাধান্য পায় মানবিকতা এবং সভ্যমনস্কতা। এসব গল্প পাঠকমনকে নিয়ে চলে অন্য-মনস্কতায়। এক গল্পে ডুপ্লিকেটিং মেশিন যেকোনো জিনিস অনেক কপি করতে পারে, এমনকি মানুষেরও, এখানে টেলিফোন নেটওয়ার্ক এমনই দক্ষ যে কে কার সঙ্গে কথা বলবে ঠিক করে দেয়, এখানে আছে বিরাট এক যন্ত্র যা ছড়িয়ে থাকা অনশনক্লিষ্ট মানুষের মধ্যে অনেক দুধ যোগান দিতে পারে। গল্পগুলি আপাতভাবে মজার, কখনও কৃষ্ণ আবহে ভবিষ্যৎবাহী কিন্তু গল্পে গল্পে জেগে থাকে পরিচিত বিশ্বে অপরিচয়ের বিস্ময়।
If this is a Man (অনু. ১৯৫৯) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। আউসউইৎস থেকে বাঁচার বিচলিত করার মতো বিবরণ, তবে লেখার ভঙ্গি বিযুক্ত, মোটের ওপর বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ, ঠিক চকিত বন্দীত্বের গল্প নয়। যদিও তিনি সর্বদাই অভিযোগপ্রবণ নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতা যা তিনি ক্যাম্পে দেখেছেন সে বিষয়ে, তবু তার আলোচনাভঙ্গি আবেগবর্জিত, যদিও বিশ্লেষণধর্মী নয়। আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস—If Not Now, When? (অনু. ১৯৮৫) এই আকর্ষণ বিস্তারী উপন্যাসে লেখক উন্মোচন করেন রুশ, পোলিশ, ইহুদি দলভুক্তদের অনন্য জীবন, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুপক্ষের ফাঁদের শিকার। এই বন্দীরা ভয়ে, ক্ষুধায়, হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো, পরস্পর সংযুক্ত, পড়ে যেতে যেতেও বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে এবং জার্মান সৈন্যদের সর্বায়ত ক্ষমতার আবহকে ভাঙতে সচেষ্ট হয়। এ উপন্যাস গতির কাহিনী, প্রতিরোধ এবং মহাকাব্যিক অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। উপন্যাস বয়নে ফুটে ওঠে লেভির লেখক স্বভাবের করুণাময়তা, যুদ্ধের আভ্যন্তর নৈতিক দোলাচল সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি। এ বই আমাদের কালের এক মাস্টারপীস। উমবের্তো একো বলেছিলেন আমি মনে করি প্রিমো লেভি ইটালিয় লেখকদের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক। ফিলিপ রথ বলেন—তিনি (লেভি) মানবঘটনা সমূহের অনুপুঙ্খ বিষয়ে গভীর স্পর্শী আর তাতে মিশেছে সর্বাপেক্ষা সুসঙ্গতি। লেভির লেখায় আছে অসহ্য স্মৃতি কিন্তু লক্ষ্য করার মতো হল তার চতুষ্পার্শ্বস্থ পৃথিবী প্রেক্ষণে আনন্দ। রথ-এর মতে তার জানা লেখকদের মধ্যে ইনিই সবচেয়ে সূক্ষ্ম অথচ শক্তিময় যাদুদক্ষ।
এই বইটির ভূমিকা থেকে (Mark Mazower) সারার্থ নিবেদন করি। টুরিনে ছিল ইহুদি ধর্মকেন্দ্র। ইহুদিরা ধর্মপ্রাণ কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইটালিয় জনগণ আর পূর্ব ইউরোপের ইড্ডিশ কালচার সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেবার ব্যাপারে লেখক আগ্রহী ছিলেন, বিস্তর অধ্যয়ন করেন এ বিষয়ে। দেখেছেন প্রাণবন্ত তরুণ জিওনিস্টদের যারা স্বাধীনতায় আগ্রহী। এ উপন্যাস নাজি মৃত্যুগ্রাম থেকে বেঁচে ফেরা একগুচ্ছ মানুষের কথা। এ উপন্যাস এক যাত্রার উপাখ্যান। অদ্ভুত ভূদৃশ্যের মধ্য দিয়ে চলে। প্রথমে অরণ্য তারপর নগর, সড়ক-- নীরবতা ও আরণ্যকতা অতিক্রমী যাত্রা। স্মৃতি এখানে উপজীব্য, মানুষগুলির চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বিনিময়। জার্মানরা এ উপন্যাসে নেপথ্যে, সঙ্গীসাথীদের মৃত্যু অন্তরালে। কিন্তু গণহত্যা জেগে ওঠে স্মৃতিতে, স্বপ্ন থেকে, বিনিময়, নীরবতা ও ভাবনায়। কখনও স্মৃতি যায় ইহুদি সমাজতন্ত্রীদের সক্রিয়তা জারের বিরুদ্ধে, মস্কোর ইহুদি থিয়েটার কর্মীদের ইউরোপ ভ্রমণ, ইড্ডিশ রঙ্গ ও ইড্ডিশ কৃত্য উল্লেখ। যুদ্ধ ও স্মৃতির সংলাপ। আর জেগে ওঠে এখানে যুদ্ধকালীন নৈতিকতা। ইহুদিদের বারংবার অস্ত্রগ্রহণ উল্লেখ করেন লেখক। এখানে গল্প অংশত পুনর্গঠিত, এক বীরব্যঞ্জক সক্রিয়তার মধ্য থেকে। তার সঙ্গে মেশে লেখকের আইডেন্টিফিকেশন। বলেছিলেন একবার—পছন্দ করি না হতাশা, কারণ তা এনে দেয় প্যারালিসিস। এবারে লেভি তার বীরদের সঙ্গে এড়িয়ে যেতে পারেন যুদ্ধের আতঙ্ক। ভিন্ন মাত্রা আসে পরিস্থিতি সম্পর্কে।
প্রিমো লেভির জীবন ছিল ব্যতিক্রমী, তাঁর লেখাও ব্যতিক্রমী। একজন কেমিস্ট, প্রতিরোধ আন্দোলনের কর্মী, মৃত্যুশিবিরে বসবাস তাঁর ব্যতিক্রমী জীবনের নিদর্শন। অন্যদিকে স্মৃতির ব্যবহার, বিজ্ঞানভাবনা ও ইহুদি মিথিকাল ভাবনার প্রয়োগ, গতির গল্প কিন্তু তার মধ্যে compassion ও গভীর অর্ন্তদৃষ্টি, সর্বায়ত যুদ্ধের বলয়ে moral dilemmas স্বভাবতই ব্যাপক পাঠকসমাজকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধি পায় স্বদেশে এবং বিদেশে। উমবের্তো একো বলেন—‘ইটালিয় লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক।’ স্বদেশীয় ক্যালাভিনো বলেন (If this is a Man)—magnificent new book এবং পরে The Truce বইটির লেখককে পুশকিন ও গোগল-এর সঙ্গে তুলনা করেন। স্বদেশে... য়ুরোপের মূল ভূখণ্ডে, তারপর আমেরিকায়, শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে লেভির প্রতি আগ্রহ জেগে ওঠে। ১৯৭৬-এর নোবেল জয়ী Saul Bellow জানান—‘আমরা সব সময়ই এরপর কোন বইটা পড়ব ভাবতে থাকি। কয়েক পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ডুবে গেলাম The Periodic Table বইটিতে, আনন্দিত চিত্তে এবং কৃতজ্ঞতায়। এ বইতে superfluous কিচ্ছু নেই, এই বইয়ের সর্বত্র রয়েছে যা একান্ত জরুরী। বইটি wonderfully pure and beautifully translated.’
আজ লেভির If this is a Man বইটি ইটালির স্কুলে স্কুলে পাঠ্য হয়েছে। হয়তো আর কোনো বইতে নাৎসী গণহত্যা এমন সরাসরি এবং এমন গভীরভাবে অনন্য আতঙ্ক ছড়ায়নি, আমাদের পরবর্তীকালীন নৈতিক ইতিহাসকে এত বিশদভাবে প্রশ্নময় করে তোলেনি। লেভির দুঃখজনক মৃত্যুতে ইউরোপীয় সাহিত্য বঞ্চিত হল এক প্রবল মানবিক ও নগরমনস্ক কন্ঠস্বর থেকে। খ্যাতি ক্রমশ প্রবর্ধিত, আজ তিনি বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সম্মানিত লেখক। মানুষের বিবেকে তার জীবন ধাক্কা দিয়েছে যথেষ্ট। Philip Roth তাঁর Operation Shylock উপন্যাসে কিছুটা কমিক অথচ যাতনাময় দৃষ্টিতে লেভি-স্মরণে তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। Arnold Wesker তার দূরদর্শনের নাটক Breakfast-এ লেভির If this is a Man থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করেছেন। Woody Allen যখন তাঁর Crime and Misdemeanors চলচ্চিত্রটি বানান তখন তাতে যে দার্শনিক চরিত্রটি (Louis Levy) আছে যিনি সুউচ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই লেভির কথা ভেবেছেন। Christopher Hitchens তাঁর নাস্তিক্য সংকলনটি লেভিকে উৎসর্গ করে লেখেন—ভ্রান্ত সান্ত্বনাকে অস্বীকার ক’রে যিনি নৈতিক তিতিক্ষা বহন করেছেন সেই মানুষটিকে। উৎসর্গে লেভির The Drowned and the Saved থেকে অবিশ্বাসীর তালিকাভুক্ত থাকার কথা বলেছেন। নিউইয়র্ক সিটিতে ২০০৩-এ স্থাপিত হয়েছে দি প্রিমো লেভি সেন্টার, যেখানে অধ্যয়ন ও চর্চা চলবে ইটালিয়ান ইহুদিদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে। এ কেন্দ্রটি লাভক্ষতি বিষয়ে অনাগ্রহী। ওয়েল্স রক ব্যান্ড প্রচারিত Gold against the Soul শীর্ষকের ২য় অ্যালবাম-এ স্বস্তিবচনে লেভির নামোল্লেখ আছে। Lavie Tidhar তাঁর A man lies Dreaming (২০১৪) উপন্যাসে দেখান মুখ্য চরিত্র Shomer (এক ইড্ডিশ সস্তা গল্পের লেখক) আউসউইৎস-এ দেখতে পান, লেভি কথা বলছেন, Ka-Tzetnik নামক লেখকের সঙ্গে হলোকাস্ট বিষয় নিয়ে লেখার কথা বলছেন। Antony Sher লেভির If this is a Man-কে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন তার Primo নাটকে, যেটি এক চরিত্রের নাটক, যেটি বি বি সি ৪-এ (U.K) দেখানো নয় ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। লেভির আউসউইৎস বিষয়ক স্মৃতিকথা (The Truce) অবলম্বনে John Turturro যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন (La Tregua) তাতে মুক্তির পর অন্যান্য নিরাশ্রয়ীদের নিয়ে দীর্ঘ জার্নির ব্যবহার করা হয়েছে।
অতএব লেভি পুনর্জীবিত। আমরা, ৩য় বিশ্বের দুর্গত মানুষ, বারে বারে অবিচার দেখে স্তম্ভিত, সামান্যতম প্রতিবাদী উচ্চারণে ঘাতকের উদ্যত অস্ত্র স্মরণ করিয়ে দেয় ‘এই তাহলে মানুষ’ উপন্যাসটি। কোনো মিল নেই, আছেও হয়তো। আজ ক্রমান্বয় আঁধারের মেটাফর আমাদের চারপাশে। বিবেকী বয়োবৃদ্ধরা কী করবেন? ‘এখন যদি নয়, তাহলে কখন?’ উপন্যাসটির নাম আমাদের মুখে মান্যতা পাবে হয়তো।