• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | গল্প
    Share
  • বস্ত্রহরণ : মুরাদুল ইসলাম


    নিশাপুর গ্রামে এক দুপুর বেলায় সবার সামনে শামসুকে ন্যাংটা করা হলো, এবং তারে পুরা নিশাপুর গ্রাম ঘুরানো হল। উলঙ্গ অবস্থায় মাথা নিচু করে শামসু হেঁটে গেল। তার পেছনে পেছনে উৎসুক গ্রাম জনতা, তাদের নেতৃত্বে বিচারকবৃন্দ, তবারক আলি, করিম মিয়া, মুতাহার হুসেন ও আফতাব শেখ।

    শামসুর শাস্তি কী হবে এ নিয়ে মতবিরোধ হয়েছিল। গতকাল রাতে, টিনের বাড়ির সামনের বিস্তৃত উঠানের এক জায়গায় গর্ত খুঁড়ে, এতে পোড়া কাঠ, বাঁশপাতা ইত্যাদি দিয়ে আগুন ধরিয়ে বসেছিলেন বিচারকেরা। শীত পড়া শুরু হয়েছে, এমন আবহাওয়ায়, এমন ঠান্ডা ঠান্ডা রাতের বাতাসে আগুনের সামনে বসে গল্প করতে ভাল লাগে গ্রামবাসীদের।

    চা আর মুড়ি খেতে খেতে করিম মিয়া প্রসঙ্গটা তুলেন।

    শামসুরে তো কাইল একটা কিছু করা দরকার মাতবর।

    মাতবর এখানে আফতাব শেখ। তিনি মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেন।

    হ্যাঁ, করা দরকারই। কামডা করল কী!

    তবারক আলি সিগারেটে টান দিয়ে বলেন, বালা করে নাই, বালা করে নাই।

    করিম মিয়া বলেন, এখন কী করবেন ঠিক করছেন?

    আফতাব শেখরে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটি করা। তিনি বললেন, কিছু ঠিক করি নাই। তোমাদের কী মত? কী করা যায় কও তো?

    চার জনে নীরব হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

    মৃদু বাতাস বইছে।

    আফতাব শেখের চোখে পড়ল তার বাড়ির এক কোণে বেড়ে উঠা আতাফল গাছটি। ঝোপের মত হয়ে গেছে ডালপালা মেলে। অন্ধকারে দেখলে ভয় লাগে। গাছটি কেটে ফেললে ভালো হত। কিন্তু আফতাব শেখ সাহস করতে পারেন না। মরার আগে তার দাদী গুলবাহার বানু বার বার সাবধান করে গেছেন, আফতাব এই গাছে হাত দিছ না, এইখানে মারিদ থাকেন।

    আফতাব শেখ অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন।

    মুতাহার হুসেনের কথায় ঘোর ভাঙ্গল। মুতাহার হুসেন গম্ভীর গলায় বললেন, কী আর করবেন। বিচারে দুইটা চটকনা দিয়া, কান ধরাইয়া ছাইড়া দিবেন।

    প্রতিবাদ করে উঠলেন করিম মিয়া।

    না মাস্টর, তুমার এই কথা মানতে পারলাম না। শাস্তি বড় হইতে হবে। না হইলে এমন কাজ হইতে থাকব। গ্রামের ইজ্জত বইলা কিছু থাকব না আর।

    তবারক আলি বললেন, আমার প্রস্তাব হইল ওরে ন্যাংটা করাইয়া গ্রামে চক্কর দেয়াইতে হইব। এতে কেউ আর এইরকম কাজে সাহস পাইব না।

    মুতাহার হুসেন প্রতিবাদ করেন, এইটা কী কন? এইরকম দামড়া একটা পোলারে ন্যাংটা করাইয়া ঘুরাইবেন, গ্রামে মেয়েছেলেরা আছে না?

    করিম মিয়া বলেন, মেয়েছেলেরাও দেখব, সমস্যা কী? শাস্তি দেখব।

    মুতাহার হুসেনের প্রতিবাদ টিঁকল না।

    ঠিক হল শামসুরে ন্যাংটা করিয়ে গ্রাম ঘুরানো হবে। আফতাব শেখ সম্মতি দিলেন। তার কাছে প্রস্তাবটা শুরু থেকেই মন্দ লাগে নি। তাছাড়া, অন্য কিছু তার মাথায় আসছিল না। বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা আতাফল গাছটির দিকে, রাতের মৃদু বাতাসে তার পাতা দুলছিল।

    মেজো মেয়েটির কথা মনে পড়ছিল আফতাব শেখের। বড় মেয়ে ও ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ভাল ঘর দেখেই বিয়ে দিয়েছেন শেখ। কিন্তু মেজো মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারছেন না। সে অস্বাভাবিক আচরণ করে, কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো চিৎকার করে। জ্যোস্না রাতে বাইরে বেরিয়ে যেতে চায়। বেরিয়ে গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দেয়। চান্নি রাত আসলে সন্ধ্যাবেলা থেকেই বেঁধে রাখতে হয়।

    দিনের বেলায় প্রায়ই গ্রামের এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়ায়।

    এই মেয়েটার জন্য আফতাব শেখের খারাপ লাগে। তিনি দূরদূরান্তে লোক লাগিয়ে রেখেছেন, ভালো কোন কবিরাজের খোঁজ পেলেই তারা ধরে নিয়ে আসে। কয়েকদিন পর পরই বাড়িতে কবিরাজ আসেন।

    শামসুকে যখন ন্যাংটা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আফতাব শেখের বাড়ির পাশ দিয়ে, তখন শেখের মেজো মেয়ে আতাফল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। ন্যাংটা শামসুকে দেখে সে অবাক হয়ে তাকাল।

    এরপর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল, যা কেউ ঘটবে বলে ভাবে নি।

    মেয়েটি চিৎকার করে ডাক দিল, ওই শামসু ভাই, কই যান!

    এতক্ষণ শামসু মাটির দিকে চোখ রেখে হাঁটছিল। প্রথম প্রথম তার লজ্জা লাগছিল, এতসব মানুষের সামনে ন্যাংটা হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একসময় লজ্জা প্রায় চলে গেল, সে কেবল হেঁটে যাচ্ছিল, যেন এক রোবট সে, আশপাশে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই। কিন্তু শেখের মেয়েটি যখন তাকে ডাক দিল, অন্য সবার মত সেও বিস্মিত হয়ে গেল, এবং এই ডাক যেন তাকে বাস্তব দুনিয়ায় টেনে নামিয়ে আনল।

    শামসু তাকিয়ে দেখল আফতাব শেখের মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

    শামসুও হেসে ফেলল।

    এই ঘটনাটি যে আফতাব শেখের জন্য বিব্রতকর ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

    তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, শামসু, হারামজাদা, দৌড়াইয়া যা।

    শামসু এবং তার পেছনে চলতে থাকা মানুষেরা দ্রুত শেখের বাড়ি পার হয়ে গেলেও, শেখের মেয়ে আতাফল গাছের নিচ থেকে সরল না।

    সমস্ত ঘটনায় সে মজা পেয়েছে।

    তার চেয়েও বেশি মজা সে পেয়েছিল গতকাল। যখন সে শামসুর বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখেছিল শামসু মনমরা হয়ে বসে আছে।

    সে শামসুকে জিজ্ঞেস করেছিল, শামসু ভাই, আপনের বিচার কোনদিন?

    শামসু উত্তর দেয়, কাইলকা।

    মেয়ে বলে, তারা আপনারে কী করব?

    শামসু বলে, জানি না।

    এরপর শামসুর সাথে সে আরো গল্প করে। জানতে চায়, শামসু কী তা করেছে যা সে করেছে বলা হচ্ছে। তখন শামসু চারপাশে তাকায়, দেখে কেউ আছে কি না। এরপর আফতাব শেখের মেয়েকে তার ঘরে নিয়ে যায়। নিয়ে শামসু যে গল্প বলে, শেখের মেয়ে তার জীবনে এমন মজার গল্প এর আগে কখনো শুনে নি।

    আতাফল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন সে ভাবছিল শামসুর কথা, শামসুর গল্পের কথা, কীভাবে শামসু পূর্ণিমা রাতে জঙ্গলে চলে গিয়েছিল, যখন রাত গভীরে চাঁদের আলোতে পরীর দল তাদের বন্য হরিণরূপ ছেড়ে দিয়ে হয়ে গিয়েছিল অপ্সরা, তারা চক্রাকারে নেচে যাচ্ছিল অবিরাম, এবং অকস্মাৎ শামসু ঝাঁপিয়ে পড়ে, এক পরীর ঠ্যাং ঝাপটে ধরে।

    শামসু এক পরী ধরে নিয়ে এসেছিল।

    ভাবতে ভাবতে আফতাব শেখের মেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

    তার আর জ্ঞান ফেরে না।

    ঐদিন রাতেই কবিরাজের খোঁজ লাগানো হয়।

    কবিরাজ আসেন পরদিন সকালে।

    তিনি এক বৃদ্ধ লোক। কথা খুব কম বলেন। ইশারায় বললেন তাকে যেন রোগীর সামনে নিয়ে যাওয়া হয়।

    কবিরাজকে আফতাব শেখের মেয়ের শয়নকক্ষে নিয়ে যাওয়া হল।

    কবিরাজ দেখলেন মেয়েটি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।

    তিনি মেয়েটির হাত ধরে রইলেন কিছুক্ষণ।

    এরপর আফতাব শেখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, চিন্তার কিছু নাই। আপনার মেয়ে ঘুমাইয়া আছে, গভীর ঘুম তাই ভাঙতে দেরি হবে। কিন্তু ভাঙবে।

    কবিরাজ উঠানে বসে বিশ্রাম করছিলেন যাবার আগে, এবং সাথে ছিলেন আফতাব শেখ, করিম মিয়া এবং আরো দুয়েকজন, তখন খবরটি এলো।

    কালকে শামসুর পেছন পেছন যারা হেঁটেছে তাদের কয়েকজন, এবং শামসু ন্যাংটা হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। তারা আর কাপড় পরবে না বলে জানিয়েছে।

    আফতাব শেখ বলে উঠলেন, এ কোন মুসিবত!

    করিম মিয়া অবস্থা দেখে কবিরাজকে বললেন, আপনে আমাদের সাহায্য করেন, কিছু বলে দেন।

    কবিরাজ জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কী?

    করিম মিয়া বললেন, গ্রামের এক ছেলে, খারাপ ছেলে, বন থেকে হরিণ ধইরা আইনা ইয়ে করছিল আর কি, ঐ জামাই বউ যা করেন আর কি, আমরা তারে শাস্তি দেই, ন্যাংটা কইরা গ্রামে ঘুরাই, তো এখন সে এবং আরও অনেকে ন্যাংটা হইয়া ঘুরতেছে, এর প্রতিকার কী?

    কবিরাজ গম্ভীর মুখে বললেন, মানুষরে এইভাবে ন্যাংটা করা ঠিক না, এতে সে এবং অন্যেরা বুইঝা যায় ন্যাংটা হইলে কিছু হয় না। তখন তাদের আর ন্যাংটা হওয়া থেকে আটকাইবেন কেমনে!

    কবিরাজ উঠে পড়লেন। তাকে অনেক দূরে যেতে হবে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments