এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা যে রাস্তার পাশের বরফের উপর-ই বসে পড়লাম সবাই ধপাস করে। গতকাল শূন্যের নিচে চল্লিশ ডিগ্রি ছিলো। আজ তার বদলে শূন্যের মাত্র তেরো ডিগ্রি নিচে, এখানে যেটাকে গরম মনে করলে দোষের কিছু নেই। গ্রিশকা লোগুন, আমাদের পাশের দলের তত্ত্বাবধায়ক, একটা বোতামখোলা ভেড়ার চামড়ার কোট গায়ে দিয়ে হেঁটে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। গ্রিশকার হাতে একটা গাঁইতির মোটা হাতল। এখনো বয়স বেশি হয় নি গ্রিশকার, তাই মাথা গরম করার ধাতটা ওর একটু বেশি, আর অদ্ভুত ধরনের এক লাল গনগনে আভা ওর মুখটায়। ক্যাম্পের পরিচালকদের মধ্যে একজন গ্রিশকা, যদিও জায়গাটা ওর ওদের মধ্যে নিচের দিকেই। তবু মাতব্বরদের একজন হলেও, বরফে গাড়ি আটকে গেলে, মস্ত কোনো গুঁড়ি ঠেলতে হলে বা এক চাঙড়া বরফে ভরা মাটি খুঁড়তে হলে সবার সাথে কাঁধ লাগাতো ও। এসব কাজ এখানে তত্ত্বাবধায়কদের সম্মানের পক্ষে ঠিক মানানসই নয়, কিন্তু এই সহজ সত্যিটাকেই বারবার ভুলে যেত ও।
ভিনোগ্রাদভের দলটাও ফিরছিলো তখন রাস্তা বেয়ে। ওদের দলের সকলের অবস্থাও আমাদের থেকে ভালো কিছু নয়, আমাদের মতনই ওরাও একসময়কার প্রাক্তন মেয়র বা পার্টির নেতা ছিলো সবাই, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা মিলিটারির মাঝারি মাপের অফিসার ...
লোকেরা জড়োসড় হয়ে রাস্তার দুপাশ হয়ে গ্রিশকা লোগুনকে পথ ছেড়ে দিলো। কিন্তু থেমে গেল ও। ভিনোগ্রাদভের দলটা তখন কাজ করছিলো ওর জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়। ভিনোগ্রাদভ একসময় ইউক্রেনে একটা ট্রাক্টর কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলো, বকবক করা স্বভাব, লোগুনকে দেখে এগিয়ে এলো সামনে।
আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে লোগুন আর ভিনোগ্রাদভ অনেকটা দূরে ছিলো, তাই ঠিক কি কথা ওদের মধ্যে হচ্ছিলো আমরা শুনতে পাই নি, তবে শুনতে পাওয়ার বোধহয় দরকার ছিলো না। ভিনোগ্রাদভ হাত নেড়ে কিছু একটা বোঝাচ্ছিলো লোগুনকে। তারপর দেখলাম আমরা যে লোগুন গাঁইতির হাতলটা ভিনোগ্রাদভের বুকে ঠেকিয়ে একটা খোঁচা মারলো। ভিনোগ্রাদভ পড়ে গেলো মাটিতে। উঠবার আগেই লোগুন লাফিয়ে উঠে ওর হাতের লাঠি উঁচিয়ে ওকে লাথি মারতে লাগলো। ওর দলের কুড়িজনের একজনও কেউ ওকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে এলো না। লোগুন ওর টুপিটা তুললো, মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো সেটা। তারপর নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেলো সেখান থেকে। ভিনোগ্রাদভ উঠলো এমনভাবে যেন কিছুই হয় নি। ওর দলের বাকি কেউ ওকে কিছু বললো না, না কোনো সমবেদনার কথা, না কোনো রাগের। রক্তমাখা ঠোঁটটা বাঁকিয়ে একটু শুকনো হাসলো ভিনোগ্রাদভ, ‘ঐ লোগুনটার মাথায় থার্মোমিটারের পারা ভরা, মাঝে মাঝে চড়ে যায়।’
‘আমাদের এলাকার চোরেরা এরকমভাবে লাথি মারাকে নাচ বলে,’ ভাভিলভ বললো, ‘এ-ও একধরনের রাশিয়ান লোকনৃত্য আর কি!’
ভাভিলভ ছিলো আমার চেনা। আমরা একই সাথে বুতির কয়েদখানার খনির থেকে এখানে চালান হই।
‘কি বুঝছো?’ আমি ভাভিলভকে বললাম, ‘কিছু একটা করা দরকার। গতকাল অবধি কেউ আমাদের মারে নি, কিন্তু আগামীকাল তো পারে! লোগুন ভিনোগ্রাদভকে আজ যা দিলো তোমায় দিলে কি করতে তুমি?’
‘কি আর করবো, সহ্য করতাম।’ ভাভিলভ বললো।
আমি বুঝতে পারলাম, এখানে মার খাওয়াটা যে এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, সেটা নিয়ে ভাভিলভ মনে মনে প্রচুর ভেবেছে। আরো পরে অবশ্য বুঝেছিলাম, যে এখানে পুরো ব্যাপারটাই শারীরিক শক্তিনির্ভর, জোর যার মুলুক তার। লোকটা কোনো বদমাশদের নেতাই হোক, জমাদার হোক, আরদালি হোক বা অচেনা কেউ — একই নিয়ম সবার বেলা। যতক্ষণ আমার শরীরে শক্তি আছে, কেউ আমায় পেটাবে না। যেই আমি দুর্বল হয়ে পড়বো, অমনি সক্কলে পেটাবে — আরদালি, চানঘরের কর্মী, নাপিত, রাঁধুনি, জমাদার এমনকি সবচেয়ে দুর্বল কয়েদিও। প্রহরীদের শক্তি তাদের হাতের রাইফেলে। অফিসারদের শক্তি আইনে, আদালতে, বিচারসভায় আর প্রহরী আর সৈন্যবাহিনীতে। আমার চেয়ে শক্তিশালী হওয়াটা ওদের কাছে খুব সহজ একটা কাজ। কয়েদিদের শক্তি তাদের সংখ্যায়। যদি তারা দল বেঁধে থাকে, তাহলে স্রেফ একটা দুটো কথার জন্য তারা একটা মানুষের গলাও কেটে ফেলতে পারে (হ্যাঁ, একাধিকবার এমন আমি নিজে দেখেছি!)। ভরসা শুধু এই যে ডিরেক্টর, প্রহরীরা বা কোনো বড় বদমাশ আমাকে মেরে পার পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু কোনো আরদালি, জমাদার বা নাপিত পার পাবে না।
পোলান্সকি ছিলো শরীরশিক্ষার শিক্ষক। প্রচুর খাবারের প্যাকেট জোটাতো ও, কিন্তু কারুর সাথে সেসব ভাগ করে খেতো না কখনো। এই পোলান্সকি আমাকে প্রায় ধমকের সুরে বললো যে ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে কিভাবে একজন লোক এমন এক অবস্থায় নেমে যেতে পারে যেখানে তাকে মারলেও তার কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। আমি ওর সাথে একমত না হওয়াতে আরও রেগে গেলো পোলান্সকি।
মাত্র এক বছর পরে কি হাল হলো সেই পোলান্সকির। মাটি থেকে সিগারেট কুড়িয়ে নেয় আর ক্যাম্পের গোদা গোদা চোরগুলোর গোড়ালি চুলকোয় (এই গোড়ালি চুলকোনোটা আর কিছু নয়, বশ মানবার প্রতীক, জীবনটা যাতে একটু সহনীয় হয়ে ওঠে)।
পোলান্সকি যতই হোক, সৎ ছিলো। ওর গোপন যন্ত্রণাগুলোতে বরফ, মার, অনাহার, অনিদ্রা, মৃত্যু, ভয় — সবকিছুকেই ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবার মতন শক্তি ছিল।
একদিন ছুটি পেলাম আমরা। ছুটির দিনগুলোতে তালাচাবি বন্ধ করে রাখা হতো আমাদের। গালভরা একটা নাম ছিলো এর ‘ছুটির নির্জনতা’! অনেকেই এই সময়টাতে পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতো, নতুন বন্ধু বানাতো, একে অপরের সমস্যা বলে বা শুনে নির্জনতা উপভোগ করতো। আমাদের দেশের আর্টিকেল ৫৮ ধারায় আটক রাজনৈতিক কয়েদিদের কাছে এই ধরনের নির্জনতা, তা সে যতই ভয়ঙ্কর বা অপমানজনক হোক না কেন, ছিল এক ধরনের বিশ্রাম, এমন কি এক মিনিটের জন্য হলেও। কে বলতে পারবে আবার পুরোনো শরীরে ফিরতে ঠিক কতটা সময় লাগবে আমাদের, এক মিনিট, এক দিন, এক বছর নাকি একটা পুরো শতাব্দী? পুরোনো সেই নিজেকে ফিরে পাবার আশা করার সাহস কারুরই ছিলো না আর কেউ তা করতোও না।
কিন্তু সেই পোলান্সকির কথায় ফেরা যাক. সেই নির্জনতার দিনটাতে ওকে রাখা হয়েছিলো আমার পাশের বাঙ্কে।
— অনেক দিন ধরে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ভাবছি।
— কি নিয়ে?
— এই কয়েক মাস আগেও তোমাকে খুব লক্ষ্য করতাম আমি — কিভাবে তুমি হাঁটো, কিভাবে গাছের গুঁড়ির উপর দিয়ে লাফিয়ে চলো, কিভাবে পাথরে পা ঘষে ঘষে চলো, মানে কিভাবে চলার পথে খুব ছোট্টো কোনো বাধাও মস্ত বড় এক অসম্ভব বাধা হয়ে ওঠে তোমার কাছে — বুক ধড়ফড় করে, শ্বাস ওঠে জোরে জোরে, লম্বা বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। তোমাকে দেখে ভাবতাম কি গাধা, কি ফাঁকিবাজ, আর কি চালু, বদমাশ একটা।
— আর এখন? এখন বুঝেছো কিছু?
— হ্যাঁ। পরে বুঝেছি। বুঝলাম যখন দুবলা হয়ে পড়লাম নিজে। যখন সবাই আমাকে ধাক্কা দিতে লাগলো, পেটাতে লাগলো। একজন মানুষের কাছে বোধ হয় সবচেয়ে আনন্দের এই ভাবনাটা যে তার চেয়েও দুবলা কেউ একটা রয়েছে।
— কমিউনিস্ট শ্রমিক বীরদের কেন কারখানার সব গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আসতে বলা হয়? গায়ের জোরকে কেন শুভশক্তির প্রতীক ধরা হয়? অন্য কারুর চেয়ে শক্তিশালী মানে অন্য কারুর চেয়ে ভালো, সব ব্যাপারেই। অন্যরকম আর কি হতে পারে? কেউ একজন চারশ পাউন্ডের একটা চাংড়া তুলে ধরলো আর তুমি কিনা কুড়ি পাউন্ড তুলতেই হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছ! কে ভালো হলো তাহলে?
— বুঝতে পেরেছি এখন। সেই কথাটাই তো বলতে চাইছি তোমাকে।
— ধন্যবাদ, বুঝেছো বলে!
এর কিছুদিন পরেই পোলান্সকি মরলো। মরলো আমাদেরই খোঁড়া একটা গর্তে পড়ে। ওর মুখে ঘুষি মেরেছিলো জমাদার। এই জমাদার অবশ্য গ্রিশকা লোগুন নয়, আমাদের জমাদার ফিরসভ, আর্টিকেল ৫৮তে আটক এক মিলিটারি অফিসার। প্রথম মার খাওয়াটা আমার বেশ পরিষ্কার মনে আছে। রোজ দিনে রাতে শত-শতবার মার খাওয়ার শুরু সেই মার খাওয়াটা দিয়ে। সমস্ত মারের ইতিহাস মনে রাখা অসম্ভব, তবে প্রথম বারেরটা আলাদা — একেবারে আলাদা। গ্রিশকা লোগুনের ব্যবহার আর ভাভিলভের মেনে নেওয়া দেখে মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম আমি।
সেই ঠান্ডা, খিদে আর চোদ্দঘন্টা কর্মদিবসের রাজত্বে, সেই পাহাড়ি স্বর্ণখনির তুষারভরা সাদা মেঘের দুনিয়ায়, সুখ ধরা দিয়েছিলো আমার কাছে, মাত্র কিছুক্ষণের জন্য হলেও। কোনো এক পথিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো আমার দিকে। এই সাহায্য রুটি বা ওষুধ দিয়ে নয়, একটু সময় দিয়ে, একটু নিয়ম-না-মানা বিশ্রামের সুযোগ করে দিয়ে।
আমাদের সেক্টরের দশ জনের তত্ত্বাবধায়ক ছিল জুয়েভ। তখন ও আর কয়েদি নয়, তবে একসময় ও নিজেও কয়েদি ছিলো, ফলে জানতো কয়েদি হলে কেমন লাগে।
জুয়েভের চোখে কিছু একটা ছিলো — হয়তো সেটা মায়া, কাঁটার মধ্যে পড়ে ছটফট করা মানুষের জন্য।
ক্ষমতাই দুর্নীতির উৎস। মানুষের অন্তরের জন্তুটা সুযোগ পেলেই তাই শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে তার ভিতরের সেই কুৎসিত ইচ্ছেগুলোকে পূর্ণ করতে — মারতে, খুন করতে। আমি জানি না কারুর মৃত্যুদণ্ডে সই করার মধ্যে কোনো আনন্দ আছে কিনা, কিন্তু এখানেও — কোনো সন্দেহ নেই — সুপ্ত কোনো আনন্দ রয়েছে নিজের হিংস্র বাসনাগুলো আশ মিটিয়ে পূর্ণ করায়।
আমি এমন লোকেদের দেখেছি — এমন অনেককে — যারা অন্যকে গুলি করে মারবার আদেশ দিয়েছে, তারপর তাদেরও মারা হয়েছে একই ভাবে। ‘রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য আমাকে খুন করা উচিত নয়, কারণ আমিও খুন করতে পারি’ — এদের এই আর্ত চিৎকারের মধ্যে কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আমি জানি না কে বা কারা এই হত্যার আদেশগুলো দেয়। আমার কিন্তু মনে হয় এই আদেশ নিজের হাতে হত্যা করারই সমগোত্রীয়, একই মানসিক উৎস থেকে উঠে আসা, একই কুশ্রী শক্তি এদের পিছনে।
ক্ষমতাই দুর্নীতি। দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতন ক্ষমতার মাদকতায় লোককে ব্যঙ্গ করে, তাকে প্রতি পলে নিচে নামানোই একজন তত্ত্বাবধায়কের মূল কাজ।
জুয়েভ কিন্তু আমাদের মারতো অন্যদের থেকে অনেক কম। সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান।
কাজের জন্য পাহাড়ের খাঁজে ছোট্ট একটা জায়গায় সবে সেদিন জড়ো হয়েছি আমরা। চারদিক ঘেরা বলে ঠান্ডা হাওয়ার উপদ্রব এখানে কম। দস্তানাপরা হাতে মুখটা ঢেকে জুয়েভ এগিয়ে এলো, লোকেদের পাঠিয়ে দিলো খনির বিভিন্ন গর্তে। কেবল আমাকে ছাড়া।
‘একটু সাহায্য চাই আমার, তোমার কাছ থেকে,’ বললো জুয়েভ, ‘সাহায্য, হুকুম নয়। আমাকে একটা চিঠি লিখে দিতে হবে কালিনিনে। আমার জেল খাটার রেকর্ডটাকে ঠিক করার জন্য। আমি সব বুঝিয়ে বলবো তোমাকে।’
আমরা তত্ত্বাবধায়কদের জন্য রাখা ছোট্টো কুঁড়েটাতে এলাম। একটা গরম স্টোভ রাখা থাকে এখানে। অন্য সময়ে এখানে আসার অনুমতি নেই আমাদের। কোনো কয়েদি যদি একবারও গরম হাওয়া গায়ে নেবার জন্য দরজা খুলে ঢুকবার সাহস করে তাহলে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয় তার সারা শরীরে লাথি আর ঘুষির বন্যা বইয়ে।
কোনো এক জান্তব প্রতিক্রিয়ায় দরজাটা আমাদের চুম্বকের মতন টানতো। অজুহাত বানানো হতো অজস্র। 'কটা বাজে এখন?' অথবা, অন্য কোনো কাজের প্রশ্ন, 'পরের গর্তটা ডানদিকে খোঁড়া হবে না বাঁ দিকে?'
‘আগুন মিলবে একটু?’
‘জুয়েভ এখানে?’
‘দব্রিয়াকভ কোথায়?’
এই সব অজুহাতে অবশ্য ভুলতো না চালাঘরের কেউ। আক্ষরিক অর্থেই সিধে লাথি মেরে তাদের খোলা দরজা দিয়ে বরফে ফেলে দেওয়া হতো। তবু, এখানে এক মুহূর্তের জন্য গরম হাওয়া গায়ে লাগাতে পারলে কিছু লাথি মন্দ কি?
আজ অবশ্য কেউ লাথি মারলো না আমাকে। আমি বসলাম একেবারে স্টোভের গা ঘেঁষে।
‘কে এটা, সেই উকিলটা?,’ কেউ একজন উদ্ধতভাবে হিসহিসিয়ে উঠলো।
‘হ্যাঁ, পাভেল ইভানোভিচ। ওর কথাই বলা হয়েছে আমাকে।’
‘ঠিক আছে।’
শেষ কথাটা সর্দার তত্ত্বাবধায়কের, অধীনস্থদের মাঝে মাঝে একটু দয়ার চোখে দেখতে হয় সর্বত্রই।
জুয়েভের কেসটা ছিল একেবারে সাধারণ একটা গ্রাম্য সমস্যা নিয়ে। সবে গত বছর জেলের মেয়াদ শেষ হয়েছে ওর। এর শুরু মা-বাবাকে সাহায্য করবার টাকা জুগিয়ে। ওর মা-বাবাই ধরিয়ে দিয়েছিলো ওকে। ওর মেয়াদ যখন শেষ হয়ে আসছে, তখন জেলের প্রশাসকেরা ওকে পাঠিয়ে দিলেন এই কোলিমাতে। বসতি গড়বার দরকার ছিল এখানে। কড়া হাতে লোক পাঠিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার দরকার ছিলো কোলিমাতে। কয়েদিদের আগে পাঠিয়ে ওই দুর্গম, মানুষের না থাকার উপযুক্ত জায়গাটাকে অন্য সকলের বসতের উপযুক্ত করে তোলাটাই ছিলো সবচেয়ে সহজ সমাধান।
জুয়েভ উত্তর প্রান্তের এই নির্মাণ কারিগরির হাত থেকে এখন অব্যাহতি চাইছে। ও চাইছে ওর কয়েদখানার সমস্ত রেকর্ড মুছে দেওয়া হোক, সেটা যদি না-ও হয়, অন্তত ওকে মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।
লেখার কাজটা আমার পক্ষে বেশ শক্ত ছিলো, সেটা শুধু এইজন্য নয় যে আমার হাতজোড়া এর মধ্যেই বেশ রুক্ষ হয়ে গেছে বা আঙুলগুলো এমনভাবে বেঁকে গেছে যাতে কোদাল বা কুড়ুল চালাতে সুবিধা হয়, কারণটা মানসিকও। কলমটার উপরে একটা মোটা কাপড় জড়িয়ে নিলাম আমি যাতে সেটা কোদাল বা কুড়ুলের হাতলের মতন মোটা হয়। যখন মনে হলো এবার পারবো, বুঝলাম লেখা শুরু করার জন্য তৈরি আমি।
লিখতে কষ্ট হচ্ছিলো কারণ আমার মগজও ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো আমার হাত দুখানার মতন। হয়তো হাতের মতনই রক্ত গড়াচ্ছিলো সেখান থেকে। জীবনের দিকে নতুন করে তাই তাকাতে হলো আবার। সেই সব শব্দগুলো, যারা আমি ভেবেছিলাম চিরকালের মতন আমায় ছেড়ে চলে গেছে, তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে হলো এক এক করে।
ঘেমে ঘেমে আনন্দের সাথে চিঠিটা লিখতে শুরু করলাম। চালাঘরটায় বেশ গরম । ফল — শরীরে উকুনগুলোর ফের নড়াচড়া আর উৎপাত। চুলকোতেও পারছিলাম না, পাছে আবার ঠান্ডায় যেতে হয়। চাইছিলাম না আমার উদ্ধারকর্তার ঘেন্না হোক আমাকে দেখে।
সন্ধ্যার মধ্যে কালিনিনে পাঠানোর মতন একটা দরখাস্ত লিখে ফেললাম আমি। আমাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানিয়ে আমার হাতে ওর রেশনের রুটির টুকরো তুলে দিলো জুয়েভ। সঙ্গে সঙ্গে সেই রুটিটা খেয়ে ফেললাম আমি। খাবার মতন যা কিছু পাওয়া যাবে সাথে সাথে খেয়ে ফেলতে হয় এখানে, পরের দিনের জন্য জমিয়ে রাখা মূর্খামি। এর মধ্যেই আমার অভিজ্ঞতা আমায় এই শিক্ষা জুগিয়েছে।
দিন শেষ হয়ে এলো। দিন যে শেষ সেটা বোঝার একমাত্র উপায় জমাদারের ঘড়ি, কারণ এখানে সকালে, দুপুরে, বিকেলে বা মধ্যরাতে একই রকমের কুয়াশা।
আমি এবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমোতে ঘুমোতে ফের সেই স্বপ্ন দেখলাম, অসংখ্য রুটি আকাশে উড়ছে, সব বাড়ি, সব রাস্তা, পুরো পৃথিবী ভরে গেছে রুটিতে।
সকালে জুয়েভের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি, হয়তো ধোঁয়া টানার মতন কিছু একটা আমায় ও দেবে।
এবং জুয়েভ এলো।
প্রহরী আর দলের সকলের সামনে হিড়হিড় করে আমাকে টানতে টানতে অন্যদিকে নিয়ে যেতে যেতে গর্জে উঠলো: ‘শালা বেজন্মা, তুই ঠকিয়েছিস আমায়!’
গতরাতে চিঠিটা পড়েছে ও। চিঠিটা ভালো লাগে নি ওর। ওর আশেপাশের সঙ্গীরা, অন্য জমাদাররাও পড়েছে চিঠিটা। তাদেরও ভালো লাগে নি। নীরস, শুকনো চিঠি। কোনো কান্না নেই চিঠিতে। এমন চিঠি পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই। কালিনিনে ঐ ধরনের চিঠি পড়ে কারুর দরদ উথলে উঠবে না।
এই ক্যাম্প আমার মগজ পুরোপুরি শুকিয়ে দিয়েছে, এমনভাবে শুকিয়ে দিয়েছে যে কোনো সাধারণ শব্দও আর মগজ থেকে বের করতে পারছি না, সত্যি সত্যি পারছি না। এই কাজ আমার জন্য নয়। এমন নয় যে আমার ইচ্ছেশক্তি আর কোলিমা-র মধ্যে তফাৎটা খুব বিশাল কিছু একটা, এমনও নয় যে আমার মগজ খুব দুর্বল বা ক্লান্ত, এর আসল কারণ এই যে আমার মগজের যে সমস্ত ভাঁজে ভালো বা সুন্দর সব বিশেষণগুলো লুকিয়ে ছিলো, সেই জায়গাগুলো সব আজ ঘৃণার দখলে।
একবার দস্তয়ভস্কির কথা ভাবুন, ভাবুন 'মৃত্যুগৃহ' থেকে মুক্তি পাবার পর, দশ বছর ধরে উপরওয়ালাদের একের পর এক লিখে যাওয়া তাঁর সেই সব লজ্জাভরা, কান্নাভরা, বেদনাভরা চিঠিগুলোর কথা। দস্তয়ভস্কি তো স্বয়ং জারিনাকেও কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এমনকি মৃত্যুগৃহেও কোনো কোলিমা ছিল না।
ভার্লাম শালামভ (১৯০৭--১৯৮২)-কে নিয়ে দু-চারটি কথা: জারের আমল থেকেই রাশিয়াতে বিদ্রোহী লেখকদের নিয়ন্ত্রণে আনার একটি রাস্তা ছিলো সাইবেরিয়াতে নির্বাসন। পৃথিবী বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে দস্তয়ভস্কি সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। এই নির্বাসন নিয়ে তাঁর গ্রন্থ “মৃত্যুগৃহ” সাইবেরিয়ার জীবনের এক জীবন্ত দলিল। পরবর্তীকালে সোভিয়েত আমলেও বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক শাসকের রোষের শিকার হন। এঁদের মধ্যে বরিস পাস্তরনক অথবা আলেক্সান্ডার সলঝিনিৎসিনের লেখার সাথে বাঙালি যতটা পরিচিত, ভার্লাম শালামভের সাথে ততটা নয়।
ট্রটস্কিপন্থী হবার জন্য শালামভ স্ট্যালিনের রোষের শিকার হন। একাধিকবার তাঁকে নির্বাসিত করা হয় সাইবেরিয়াতে। কেমন ছিলো এই নির্বাসিতদের জীবন? শালামভের লেখা “কোলিমার কাহিনী”তে এই সাইবেরিয়ার গুলাগজীবনের একটি জীবন্ত ছবি ফুটে ওঠে। এই লেখাগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে এতে শাসকের বিরুদ্ধে কোনো ঝাঁঝ বা রাগের প্রকাশ নেই। যা আছে তা হলো কয়েদির জীবন ও শুধু মাত্র বেঁচে থাকার জন্য তার সংগ্রামের এক ভয়ানক নিস্পৃহ বর্ণনা।
শালামভের লেখা "গ্রিশকা লোগুনের থার্মোমিটার" এরকম একটি গল্প।