• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮২ | এপ্রিল ২০২১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • রুষ্ট ঋষিগঙ্গা : রাহুল মজুমদার

    সাম্প্রতিক ধ্বংসলীলার জন্য ঋষিগঙ্গা এখন অনেকের কাছেই চেনা নাম। এর আরেক নাম বিষ্ণু গাড। নন্দাদেবীর উত্তরী ঋষি হিমবাহ আর দক্ষিণী ঋষি হিমবাহ আর দক্ষিণী নন্দাদেবী হিমবাহের জলে পুষ্ট এই স্রোতস্বিনী রেইনি বা রিনি গ্রামের কাছে এসে ধৌলিগঙ্গায় মিশেছে। এই নদীর কিন্তু বিধ্বংসী বলে দুর্নাম ছিল না অতীতে। অন্ততঃ ২০০৯ সালে আমাদের তেমন মনে হয়নি। নভেম্বরে দেওরিয়া তাল, তুঙ্গনাথ ঘুরে ভুখ হড়তাল পথ ধরে জোশীমঠে এসেছিলাম নিছকই বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। যদিও মনের কোণে ভবিষ্য বদরী ঘুরে আসার একটা ক্ষীণ বাসনা বাসা বেঁধে ছিল। লতা গ্রামের পথে সালধার থেকে নাকি খাড়া চড়াই ভেঙে টানা উঠে যেতে হয়। আমাদের আশায় ঘটি ভরে ভরে ঠান্ডা জল পড়তে লাগল একের পর এক।

    মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব এক দিনে উঠে নেমে আসতে হবে, যা এই দুই আধবুড়োর পক্ষে অসম্ভব।

    রেইনি তো বটেই, সালধার পর্যন্তও গাড়ি চলছে না। চলছে তপোবন অবধি। সেখান থেকে বেশ খানিকটা এগোলে একটা অতি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে; স্থানীয় লোকজনের কথায় 'গরম পানি'। সেটা পেরিয়ে আরও কয়েক কিলোমিটার গেলে সালধার।

    বিছানায় গা এলানোর আগে অবধি হেড টেল চলল। মোটামুটি সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল সকালের গাড়ি ধরে তপোবনে পৌঁছে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

    ভোরের আলো সুড়সুড়ি দেওয়ামাত্র দুই মক্কেল লতার জীপস্ট্যান্ডে উপস্থিত জাব্বাজোব্বা চাপিয়ে। এই ভোরেও জীপস্ট্যান্ডে উপস্থিতির হার নেহাত কম নয়। চা-কর ভদ্রলোকের ফুটন্ত চা হাতে হাতে ঘোরা আরম্ভ হয়ে গেছে। একটা সাদাকালো বেড়াল উনুন ঘেঁষে শুয়ে। ছড়ানো বিস্কুট রুটির টুকরোর লোভে হাফ ডজন ইয়েলো বিলড্ ব্লু ম্যাগপাই চত্বর জুড়ে পোলকা নাচের আসর বসিয়েছে। সবই আছে, শুধু গাড়ির দেখা নাই রে, গাড়ির দেখা নাই। সুয্যিমামা আর সহ্য করতে না পেরে হাথী আর ঘোড়ীর মাথায় সিঁদুর মাখিয়ে দিলেন। এবার বোধহয় লজ্জা পেয়েই জীপবাবাজী আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে এসে আবির্ভূত হলো।ঝটপট সামনের সীট দু খানা (ইট্টু বাড়তি পয়সার বিনিময়ে) দখল করা গেল। বসা দাঁড়ানো ঝোলা কোনোটারই যখন আর জায়গা রইল না, গাড়ি গড়াল। আমাদের কাছে একেবারে নতুন পথ--তাই চোখ বড়বড়। ক্যামেরা হাতে। সেটা অবশ্য খুব বেশি ব্যবহার করার সুযোগ ঘটল না। একে তো ভীড়, পথও দিব্যি ঝাঁকুনিপূর্ণ আধকাঁচা। তবে, কয়েকটা বাঁকের পর কোনো আফশোস রইল না---প্রায় প্রতি বাঁকেই নন্দাদেবীর স্মিতবদন।

    ইনরা, খাঞ্চামাল, মির্গ, পায়েচোর্মি, ঢাক--- অতিসাধারণ গ্রামগুলো সবাই মাথায় নন্দাদেবীর মুকুট পরে রয়েছে। চামতোলি পেরোনোর পর গাড়ি অনেকটাই খালি হয়ে গেল। তপোবনে নেমে প্রথমেই আস্তানার খোঁজ। সেটা খুব একটা সুবিধার হলো না। এমনিতেই গোনাগুনতি ঘর, তা-ও সব বেদখল। সামনে নদীতে বাঁধ দেওয়ার কাজ চলছে---জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হবে। রেইনির লোকেরা নাকি ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে।

    মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ঠিক হল এ যাত্রা উষ্ণ প্রস্রবণ দেখে তপোবনেই খাদ্যতপস্যা সেরে ফিরতি গাড়িতেই ফেরত জোশীমঠে। এরই মধ্যে শান্ত অঞ্চলটা দু জনেরই মন কেড়ে নিয়েছে। দূরে পাহাড়ের V ফ্রেমের ফাঁকে নন্দাদেবীর উঁকি। জোরকদমে পা চালিয়ে কুরচোই-র কুচো বসতি পেরোতে দূর বাঁকে 'গরম পানি'র সধূম ইশারা। দেখলাম নিচে ঘর গড়ে গরম জলে স্নান সারার ব্যবস্থা। সেটা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখে উষ্ণ প্রস্রবণের ধার ঘেঁষে উঠে এলাম তার উৎসে। টগবগ করে ফুটছে। গন্ধকের গন্ধে মাতোয়ারা চতুর্দিক। ফুটন্ত লাভার মতো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে রাস্তা পেরিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিষ্ণু গাডের বুকে। অনেক দূরে সালধারের ইশারা। এবার তো আর ও ধার মাড়ানো হলো না। দু জনে দুটো যথাসম্ভব লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। রাজমা চাওলে (সঙ্গে স্পেশ্যাল অর্ডারে দুটো ডিমভাজা) পেট ঠান্ডা করে ফিরতি জীপে চেপে বসলাম। বেশ ফাঁকা গাড়ি। দুটো কুড়িতে শান্ত উপত্যকা ছেড়ে এগোতে লাগলাম তুলনামূলক মুখর জোশীমঠের দিকে।

    সেই শান্ত নদী আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে ফুঁসছিলই। তার ওপর বিশ্ব উষ্ণায়নের ধাক্কায় নন্দাদেবীর শরীর থেকে খসে পড়া তুষাররাশি তাকে শক্তি যোগালো। অবরোধ ভেঙে তছনছ করে দিয়ে ঋষিগঙ্গা আরেকবার মনে করিয়ে দিল, প্রকৃতির সঙ্গে জোরজবরদস্তি আত্মহত্যার সামিল। এখনও সময় আছে সাবধান হওয়ার।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবি : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments