বলি তো হাসব না, হাসি রাখতে চাই তো চেপেবস্তুত আমাদের সামাজিক ও দৈনন্দিন ঘটনা ধর্ম ও শাস্ত্রের নাগপাশে এমনই বাঁধা যে, সেখানে হাস্য রসের স্থান সঙ্কীর্ণ। আমাদের সাহিত্যেও তাই হাসিকে খেলার পর্যায়ভুক্ত করে রাখা হয়েছে। হাসিও যে উচ্চস্তরের সাহিত্য হতে পারে তা বাঙালি পাঠক অস্বীকার করে। তাই নব রসের মধ্যে এ রসটি শুধু শিশুদেরই একচেটিয়া বলে গণ্য হয়। বড়রা সব রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকতে চায়। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে সাধারণ লোকের মুখে হাসি আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। তার জন্য সত্যিকার প্রতিভার প্রয়োজন। এবং এই প্রতিভার অধিকারী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে তিনি সমগ্র বাংলাসাহিত্যকে প্লাবিত করে দিয়েছিলেন। তিনি সত্যই মনে করতেন –
কিন্তু এ ব্যাপার দেখে থেকে থেকে যেতে হয় ক্ষেপে
ও হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
কেন চটাচটি আর রেষারেষিকিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান সম্বন্ধে কিছু বলবার আগে হাস্যরস সম্বন্ধে দু-একটা কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। এ রসের প্রধান ভূমিকা হ’ল তা সত্যকে অনায়াসে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করতে পারে। প্রকৃতি, সামঞ্জস্য ও নিয়মকে তা অনায়াসে অস্বীকার করতে পারে। এই অবাস্তবতাই হাসির খোরাক হয়ে দেখা দেয়। অনেক সাহিত্যিক আবার সমাজের গলদ, ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যাকে ব্যঙ্গ করে হাসির প্রলেপ বুলিয়ে দেন।
আর গালাগালি, ভালোবাসাবাসি
আর বসে গোঁফে দাও তা –
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় ঈশ্বর গুপ্ত, ইন্দ্রনাথ রায়, ত্রৈলোক্য নাথ মুখোপাধ্যায়, কান্তকবি, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি কয়েকজনই দ্বিজেন্দ্র-পূর্ব যুগে এ রস পরিবেশন করে সার্থক হয়েছিলেন। তবে এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তাঁদের হাসির নীচে বিদ্রূপের হুলটি সোজা হয়ে থেকেছে। কিন্তু নির্মল হাসির ফোয়ারা দ্বিজেন্দ্রলাল সৃষ্টি করলেন। পরবর্তীকালে সুকুমার রায়কে বাদ দিলে, দ্বিজেন্দ্রলালকেই এ বিষয়ে অদ্বিতীয় বলা যায়।
শৈশব থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল গান বাঁধতে ও সুর দিতে পারদর্শী ছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে চাঁদ দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে গেয়ে উঠেছিলেন – ‘গগন ভূষণ তুমি জনগণমনোহারী।’ গান বেঁধেছিলেন তিনি স্বয়ং, এবং তাতে সুরটিও দিয়েছিলেন নিজে। পুত্রের এ গান শুনে তাঁর পিতৃদেব বিখ্যাত ওস্তাদ দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় পুলকিত হয়ে উঠেছিলেন এবং আশীর্বাদ করেছিলেন যে তিনি সার্থক কবিগীতিকার হবেন। পিতার এ ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরকালে প্রথম শ্রেণীর গীতিসুরকারের সম্মান দাবি করতে পেরেছিলেন।
সঙ্গীতের এই প্রতিভা এসে যোগ হল তাঁর কবিপ্রতিভার সঙ্গে। এবং এই কবিপ্রতিভা বিশেষ করে প্রকাশিত হয়েছে হাস্যরস পরিবেশনের ক্ষেত্রে। কাজেই স্বভাবতই দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানগুলি বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দাবি করতে পেরেছে। তাঁর হাসির গানগুলিকে তিনি “হাসির গান” এবং “আষাঢ়ে” নামক গ্রন্থে সঙ্কলিত করেছেন। হাসির গান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে – বিলেত থেকে ফিরে তিনি ইংরেজি গান খুব গাইতেন। কিন্তু “ইংরেজি গান প্রায় কোন বাঙালি শ্রোতারই ভাল লাগিত না। তখন বাংলায় গান রচনা করিয়া গাইতে আরম্ভ করি …এবং কতকগুলি হাসির গানও রচনা করি। এই হাসির গানগুলি অবিলম্বে অনেকের প্রিয় হয় এবং কার্যোপলক্ষে কোন নগরে যাইলেই ঐ সকল গান আমার স্বয়ং গাহিয়া শুনাইতে হইত। সেগুলি একত্রে গ্রন্থাকারে বহুদিন পর প্রকাশিত করি।”
দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানগুলিকে মোটামুটি দু-শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে -- (ক) কৌতুকসৃষ্টি (খ) বিদ্রূপ। প্রথম শ্রেণীর গানে নির্মল হাসির জোয়ার আনাই ছিল কবির লক্ষ্য। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর গান বাঁধবার সময় সমাজের গলদকে বিদ্রূপের কুঠারাঘাত করেছেন হাসির প্রলেপ দিয়ে।
ইংরেজি ‘Comic Song’ এর ধরনকে তিনি তাঁর রকমারি হাসির গানে চালু করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন – “বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া ভাষায় হাস্যরসাত্মক কবিতার অভাব পূর্ণ করিবার অভিপ্রায়ে Rev. R.A. Burham রচিত Ingoldsby Legends-এর অনুকরণে কতকগুলি কবিতা লিখিয়া ‘আষাঢ়ে’ নামে প্রকাশ করি।” (নাট্যমন্দির, শ্রাবণ ১৩১৭) তিনি শুরু করলেন ‘ননসেন্স ভার্সে’ আবোল-তাবোল রচনা করে উচ্চাঙ্গের হাস্যরূপ সৃষ্টি করতে। এখানে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে –
হো বিক্রমাদিত্য রাজার ছিল নবরত্ন ন ভাইএই হাস্যকর অসঙ্গতি কি কৌশলে কি নিপুণভাবে হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ইতরতাকে বাদ দিয়ে জীবনে কীভাবে রসদার স্ফুর্তি আনা যায় তা দ্বিজেন্দ্রকাব্যে অতি সহজে লক্ষ করা যায়। তাঁর গানগুলির প্রাণমাতানো উৎসব সহজেই প্রাণভরা হাসির খোরাক হয়ে ওঠে।
আর তানসেন ছিলেন মহাওস্তাদ – এলেন তাঁহার সভায়।
অ-অ-অর্থাৎ আসতেন নিশ্চয় তানসেন বিক্রমাদিত্যের কোর্টে –
কিন্তু দুঃখের বিষয় তখন তানসেন জন্মান নি কো মোটে।
তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি মেও- এঁও – এঁও।।
যাহোক এলেন তানসেন রাজার কাজে চ’ড়ে রেলের গাড়ি।
আর হুগলী ব্রিজ পার হয়ে উঠলেন বিক্রমাদিত্যের বাড়ি।
অ-অর্থাৎ উঠতেন নিশ্চয়য়, কিন্তু রেলপুল তখন হয়নি –
আর বিক্রমাদিত্যের ছিল অন্য রাজধানী উজ্জয়িনী।
তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি মেও- এঁও – এঁও।।
এই প্রাণমাতানো হাসির ভিতর দিয়ে তিনি মাঝে মাঝে আবার আমাদের সমাজের গলদকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করেছেন। ব্রাহ্ম, থিওসফিস্ট, নব্য হিন্দু, বিলাত ফেরতা বাঙালি সাহেব, ভণ্ড দেশহিতৈষী, রাজনৈতিক আন্দোলনকারী, বাবু, পণ্ডিত, হাকিম কেউই তাঁর ব্যঙ্গাত্মক গান থেকে বাদ যাননি। এই ব্যঙ্গের একটু পরিচয় দেওয়া যাক্। যে-সমস্ত আত্মম্ভরী নেতা তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন, কিন্তু দেখাতে চান যে তাঁরা দেশভক্ত এবং তাঁদের সব কাজের উদ্দেশ্য দেশের উন্নতি, তাঁদেরই উদ্দেশ্যেই কবির “নন্দলাল” কবিতাটির সৃষ্টি। নন্দলাল মনে করে “আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?” প্রয়োজনের সময় তার মুখেই আমরা শুনতে পাই –
…ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই ---আবার যারা স্বদেশের স্বাতন্ত্র্য ও কৃষ্টি ভুলে গিয়ে বিদেশের অন্ধ অনুকরণে আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে কবি অনায়াসে বলেছেন –
না হয় দিলাম – কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার ভেবে দেখি চারিদিক।
আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোট পরেআবার তথাকথিত সমাজ সংস্কারকদের যারা ধর্মের মুখোশ পরে থাকলেও ধর্মের ধার ধারেন না তাঁদের উদ্দেশ্যেও কবির ব্যঙ্গ শোনা যায় –
সেজেছি বিলিতি বাঁদর।
করি hoot alike the Hindoos, the Buddhists,কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যঙ্গের বিশেষত্ব এই যে তাঁর ব্যঙ্গ কাউকে আঘাত করেনি, কেউ তাতে রুষ্ট হতে পারেনি; তার কারণ তিনি নিজেকেও এর মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তিনি যে এসব ভারতবাসীদের থেকে পৃথক নন তা তিনি স্বীকার করে বলেছেন “চম্পটির দল আমরা সব”। তাঁর বিখ্যাত নন্দলাল কবিতাটি রচিত হয়েছিল ‘সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে’ উদ্দেশ্য করে। কিন্তু, তিনিই এ কবিতাটি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই সহজেই উপলব্ধি করা যায় কবি কী নিপুণভাবে, সহজভাবে মানুষের ভুলকে তুলে ধরতে পারতেন। এ সমস্ত কবিতার মধ্যে মনুষ্যত্বের একটা দীপ্ত আদর্শ ফুটে উঠেছে। এখানে শুধু তিনি সংসারকে কষাঘাতও করেন নি, এখানে সাহিত্যস্রষ্টার অর্ন্তদৃষ্টি ও শিল্প একসঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। এই ব্যঙ্গ ও শ্লেষের সঙ্গে আর একটি উপরি পাওনা আছে; তা হল কবির হৃদয়ের প্রাণঢালা দরদ। নিরপেক্ষতার তুলাদণ্ডের জন্যই বিদ্রূপকে হজম করেও পাঠক তাঁর গানের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠত। তিনি শুধুই বাঙালি পাঠককে হাসাতেই আসেন নি সেই সঙ্গে তাকে ভাবিয়ে তুলতেন।
The Mohomedans, Christian and Jews
কিন্তু ফলার ভোজে হিঁদু নই if you think
তা’লে you are an awful goose.
কবি বিভিন্নভাবে তাঁর কবিতায় এ হাস্যরস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ভাব, ভাষা এবং ছন্দ একত্রে হাসির খোরাক জুগিয়েছে। কোথাও তিনি ইংরেজি এবং বাংলা ভাষার এক অদ্ভুত খিচুড়ি রচনা করেছেন। যেমন –
It must be understoodআবার কোথাও উদ্ভট অবস্থা-বিপর্যয়, অতিরঞ্জিত পরিস্থিতি, অতিশয়োক্তির মধ্য দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। অবাস্তব রোমান্টিক ধার্মিক – তাকে তিনি শ্লেষের ভিতর দিয়ে হাসির পর্যায়ে তুলে ধরেছেন। তেমনি ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক সব বিষয় নিয়েই তিনি হাসির ফোয়ারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
যে একটু heterodox আমাদের food
কারণ, চলে মাঝে মাঝে ‘এটা’ ‘ওটা’ ‘সেটা’ যখন we choose,
কিন্তু সমাজে তা স্বীকার করি if you think
তা’লে you are an awful goose.
কবিতার মিল সৃষ্টির ক্ষেত্রেও কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন –
রচে গেছেন পুরাণ কর্ত্তা স্বয়ং ডালে খেতেন ভাংভাঙের সঙ্গে ‘সুতরাং’ শব্দটি একটি সুন্দর মিল সৃষ্টি করে। ইংরেজি শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দের মিল দিতেও কবি সিদ্ধহস্ত, যেমন –
খেতেন ভালো না হয় খেতেন পুরাণকর্ত্তা সুতরাং।
From the above দেখতে পাচ্চ বেশকবি নিজে কাব্য রচনার সময় ভাষা এবং ছন্দ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন – ‘যেরূপ বিষয় সেইরূপ ভাষা হওয়া বিধেয় মনে করি।” তাই হাসির গান রচনা করবার সময় তিনি ভাষাও ব্যবহার করেছেন সে রকমেই হাল্কা ধরনের।
যে আমরা neither fish nor flesh
আমরা curious commodities, human
Oddities denominated Baboos.
আমরা বক্তৃতায় যুঝি ও কবিতায় কাঁদি কিন্তু
কাজের সময় সব ঢুঁ ঢুঁ।
কিন্তু ছন্দের ক্ষেত্রে কবি খুব বেশি সার্থক হতে পারেন নি। কবি নিজেই তাঁর ত্রুটি স্বীকার করে বলেছেন, “এ কবিতাগুলির ভাষা অতীব অসংযত ও ছন্দোবদ্ধতা অতীব শিথিল। ইহাকে সমিল গদ্য নামেই অভিহিত করা সঙ্গত।” বস্তুত পদ্যের কাঠামোতে স্বচ্ছন্দভাবে গদ্য-উচ্চারণধর্মী স্বাভাবিক বাক্পর্ব ব্যবহার করতেই কবি চেষ্টা করেছেন। তবে এ কথা ভুললে চলবে না যে এগুলি সমস্তই গান। সুরের সঙ্গেই তাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ। কাজেই সংগীতে সুর অনায়াসেই ছন্দের শিথিলতাকে ঢেকে দিতে পারে। তবে হাসির গান চেনা করবার সময় কবি বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ ব্যবহার করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এমন কি ইংরেজি ছন্দের সুরের আমেজের প্রভাব থেকেও মুক্ত হননি। যেমন –
হ’ল কি! এ হল কি! এতো ভারি আশ্চর্যি!দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দুঃখবাদী বা অবিশ্বাসী ছিলেন না বটে কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন যে সংসারে যা কিছু করুণ তাই হাস্যকর। মানবসুলভ হাসি-কান্না পরস্পর জড়িত, এপিঠ ওপিঠ মাত্র। কিন্তু তা বলে মানবজীবনকে তিনি কখনও নিরর্থক বলে মনে করেন নি। দুনিয়ায় আনন্দকে উপলব্ধি করে তিনি বলতে পেরেছেন – ‘বাহবা দুনিয়া কি মজাদার রঙিন।’ যেমনটি চাই তেমন হয় না বটে কিন্তু তার জন্য নিরর্থক তাঁর কোন দুঃখও ছিল না। পৃথিবীর দুঃখকে স্বীকার করেও বলেছেন, “পৃথিবীতে হাস্য ও গাম্ভীর্য যেরূপ পাশাপাশি আমি সেইরূপই চিত্রিত করিতে প্রয়াসী হইয়াছি। ‘প্রেম’ যত গুরুতর গম্ভীর ব্যাপক হ’ক না কেন এর চিন্তা, কল্পনা, আবেগ ও অশ্রুবেদনার পাশে এর নানা অসঙ্গতি ও আতিশয্য কৌতুক সৃষ্টিও করে। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘বসন্ত’, ‘স্ত্রীর উমেদার’, ‘প্রেমতন্ত্র’, ‘এস এস বধূ এস’, নয়নে নয়নে রাখি’, ‘বিরহতত্ত্ব’ প্রভৃতি গানগুলি এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এখানে পরিহাসের সঙ্গে সঙ্গে উদ্দেশ্যও ফুটে উঠেছে।
বিলাত ফের্তা টানছে হুক্কা, সিগারেট খাচ্চে ভট্টার্য্যি।
হোটেল ফের্তা মুন্সেফ ডাকছেন ‘মধুসূদন কংসারি’
চট্ট চটির দোকান খুলে দস্তুরমত সংসারি!
কবি নিজে প্রগতিবাদী ছিলেন। পাশ্চাত্যের আদর্শকে তিনি গ্রহণ করলেও অনুকরণ এবং উচ্ছৃঙ্খলতাকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি। আবার সেই সঙ্গে স্বদেশের কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে স্বীকার করেন নি। তাই সে ক্ষেত্রে শোনা যায় তাঁর ব্যঙ্গ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর –
যদি চোরই হও, কি ডাকাত হও –দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে সাময়িক বিষয়গুলির মধ্যে চিরকালের মানুষের ভণ্ডামি, কপটতা এবং অসততা ধরা পড়েছে। কিন্তু শিল্পীর নিপুণ হাতের তুলি তাকে হাসির রঙে সজীব করে রেখেছে। এবং বহুদিন পর্যন্ত সহজ সরল প্রাণখোলা হাস্য কৌতুক আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে আনন্দ দান করতে পারবে আশা করি।
তো গঙ্গায় দাও গে ডুব
আর গয়া, কাশী, পুরী যাও
সে পুণ্যি হবে খুব,
আর মদ্য মাংস খাও –
বা যদি হয়ে পড় শৈব,
আর না খাও যদি বৈষ্ণব হও –
এর গুণ কত কৈব।