(আলো বদল)
সূত্রধর ১—রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পগুচ্ছ লিখেছিলেন ১৯২৬ সাল নাগাদ। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের এলাকাটা নিয়ে তাঁর কৌতূহল ছিল চিরদিনই প্রখর। জীবিত ও মৃত গল্পটিতে উনি দেখিয়েছেন কেমন করে পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে আমাদের বেঁচে থাকার উদ্ভট সমস্যা আর মৃত্যুর অতল বিপন্নতা। প্রায় একশো বছর পরে পৃথিবীর এক অদ্ভুত দুঃসময়ে আমরা বিষয়টিকে নিয়ে আবার ভাবতে বসেছি। আশা আছে যে এই নাটক সময়ের গণ্ডী পেরিয়ে আমাদের এক সমান্তরাল মানবিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। আসুন এগিয়ে যাই।
সূত্রধর ২—আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ২০২০ সালের মার্চ মাস। কলকাতা থেকে অবনীবাবু এবং সবিতাদেবী, আমেরিকার নিউ জার্সি শহরে তাঁদের ছেলে বউ, শুভেন্দু আর উষসীর কাছে বেড়াতে এসেছিলেন সে প্রায় মাস চারেক হতে চলল। এতদিনে ওঁদের ফিরে যাবার কথা, কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটে গেছে প্যানডেমিক এবং লকডাউন সুতরাং দুজনেই আপাতত এদেশে আটক। শুভেন্দু আর উষসী দুজনেই একটা টেক কোম্পানিতে চাকরি করে, ওদের আট বছরের কন্যা মৌলী দাদু-ঠাম্মার চোখের মণি। বাড়িসুদ্ধ সবাই এখন অনলাইনে, তাই রোজকার জীবন বদলে গেছে অনেকটাই। কাল রাত্তির থেকে অবনীবাবুর শরীরটা ভালো লাগছে না।
সূত্রধর ১—বাংলাদেশ, ১৯২৬ সাল। রানীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে। পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই, পতিও নাই পুত্রও নাই। একটি ভাশুরপো, শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি, সেই তাহার চক্ষের মণি। সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল, সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাহাকে মানুষ করিয়াছে। পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্রাণের টান আরও যেন বেশি হয়, কারণ, তাহার উপরে অধিকার থাকে না; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই, কেবল স্নেহের দাবি।
সূত্রধর ২—অবনীবাবুরও নিজের পরিবার বলতে সবিতা আর নিউ-জার্সির এই কজন। অবনীবাবুর বাবা-মা চলে গেছেন অনেকদিন হয়ে গেল। একমাত্র ভাই বিকাশ মুম্বাইবাসী, তার সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ নেই। দক্ষিণ কলকাতার যে পুরনো পাড়ায় ওঁদের আজন্ম বসবাস ছিল তারও খোল-নলচে বদলে গেছে অনেকদিন। আগেকার পড়শিরা সবাই উধাও, নতুন নতুন বিশাল সব ফ্ল্যাটবাড়ি আর শপিং কমপ্লেক্সের মাঝখানে ওঁদের পুরনো রং-ওঠা তিনতলা বাড়িটি প্রায় হানাবাড়ির চেহারা পেয়েছে। প্রমোটারদের প্রচুর উৎসাহ সত্ত্বেও বাড়ি বিক্রি করতে কিছুতেই রাজি হননি অবনীবাবু।
(আলো বদল)
দৃশ্য—১
সবিতা—হাজারবার বললাম ঠান্ডার মধ্যে আদিখ্যেতা করে অতক্ষণ বাইরে থেকো না। বয়সটা যে বাড়ছে সে কথা যদি মনে থাকে। নাও, ওষুধটা ধরো।
অবনী—আরে সারা দিনই তো ঘরের মধ্যে বসে বোর হচ্ছি। বিকেল বেলা একটু হাঁটতেও যাব না! আরে দূর দূর, আমরাও ছেলেবেলা পশ্চিমের শীত দেখেছি—দেওঘর, রাঁচি, বেনারস। (কাশি)
সবিতা—হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি, তোমার দৌড় আমার জানা আছে—দেওঘর, রাঁচি, বেনারস। এদিকে যে ফি-বছর কলকাতায় শীত পড়লেই হাঁপানিতে কাবু হয়ে পড়ো। সিগারেট খেয়ে খেয়ে ফুসফুসটাকে তো চায়ের ছাঁকনি বানিয়ে ফেলেছ।
অবনী—আরে ওটা ঠান্ডার জন্য নয়, ধোঁয়াশার জন্য। তাছাড়া সিগারেট খাওয়াও তো ছেড়ে দিয়েছি— (কাশি)
সবিতা—বলে বলে ছাড়িয়েছি। তাও চুরি করে পারলেই দু-টান দাও। আমি সব জানি।
অবনী—তোমার বউমা সিগারেট খায়।
সবিতা—তাতে তোমার কি? ওর অফিসে অনেক চাপ তাই একটু-আধটু খায়। আচ্ছা তোমার কি লজ্জা নেই গো, এমন নেশা যে বউমার কাছ থেকে সিগারেট চুরি করো?
অবনী—আরে না না, ও নিজেই দেয়। (কাশি)
সবিতা—ওঃ, অসহ্য এই লোকটা।
(বেরিয়ে যায়। মৌলী একদৌড়ে ঢোকে)
মৌলী—দাদুভাই, আমার অনলাইন ক্লাস একটুও ভাল্লাগে না। আমি তোমার কাছে অঙ্ক করব আর গল্প শুনব।
অবনী—তা বললে কি হয় দিদিভাই। তুমি তোমার ক্লাস শেষ করে এসো। আমার তো কোত্থাও যাবার নেই। আমি এই জানলাটার ধারে বসেই তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
(উষসী ঢোকে)
উষসী—মৌলী, গো ব্যাক টু ইয়োর ক্লাস। ভারি দুষ্টু হয়েছ।
মৌলী—আমি তো হোম স্কুলিং করছি আর দাদুভাই ইজ দি বেস্ট টিচার।
অবনী—আচ্ছা আচ্ছা আমরা বিকেল বেলা অনেক বই পড়ব আর গল্প শুনব (কাশে। কাশতে কাশতে কথা আটকে যায়) এখন তুমি তোমার অনলাইন ক্লাসে ফিরে যাও।
(মৌলী বেরিয়ে যায়। উষসী চিন্তিতভাবে তাকিয়ে আছে)
উষসী—কি হয়েছে বাবা? তোমার শরীরটা কি খারাপ লাগছে?
অবনী—আরে না না, ওই একটু ঠান্ডা লেগেছে বোধহয়। (এদিক ওদিক তাকায়) একটু বাইরে যাবো উষি, ঘরটার মধ্যে কেমন যেন স্টাফি লাগছে।
উষসী—বাইরে! বাইরে তো বিচ্ছিরি ঠান্ডা আর বৃষ্টি পড়ছে।
অবনী—না, মানে একটু টাটকা হাওয়া দরকার। (হাঁপায়) আর একটু চা।
উষসী—বাবা, বসো আমি চা এনে দিচ্ছি। জানলাটা বরং খুলে দিই একটু? এখন বৃষ্টির মধ্যে আর বাইরে বেরিয়ো না।
অবনী—ঠিক ঠিক, একটু গরম চা হলে ভালোই হয়। একটু আদাবাটা দিয়ে দেবে উষি। না না, ভুলেই গেছিলাম এখানে তো তোমাকেই সব কিছু করতে হয়। নাঃ তুমি বরং ওই গরম জল আর টি-ব্যাগটা দিয়ে দাও, আমি বানিয়ে নেব।
উষসী—(ছদ্ম রাগে) বাবা, তোমাকে এ সব কথা মা শিখিয়ে দিয়েছে তাই না?
অবনী—আরে না না, মানে আমার তো বার বার চা খাবার বদভ্যাস তাই আরকি—
উষসী—থাক বুঝেছি। এই আজকে বলে দিলাম, আমি যতক্ষণ বাড়ি আছি, চা আমি নিজের হাতে বানিয়ে এনে দেব। আদাবাটা আর মধু দিয়ে? (হেসে বেরিয়ে যায়। অবনী কি একটা বলতে গিয়ে আবার কাশতে শুরু করেন। অন্যদিক থেকে মৌলী একদৌড়ে ঢোকে।)
মৌলী—দাদু আই হ্যাভ সো মাচ হোমওয়ার্ক। প্লীজ হেল্প মি। (দাদুর কোলে উঠতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়) দাদু আর ইউ অলরাইট?
অবনী—ওই একটু ঠান্ডা লেগেছে। দিদিভাই তুমি বরং তোমার ল্যাপটপটা নিয়ে এসো।
মৌলী—(চিন্তিতভাবে দাদুর হাত আর কপাল ছুঁয়ে দেখে) দাদুভাই, আই থিংক ইউ হ্যাভ আ ফিভার। দাঁড়াও আমি বাবাকে ডেকে আনছি। ইউ নো দেয়ার ইজ দিস ন্যাস্টি ইনফেকশন অ্যারাউন্ড, তাই তো আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। আই হেট অনলাইন ক্লাসেস।
অবনী—আরে দাঁড়া দাঁড়া, বাবা এখন কাজ করছে ওকে ব্যস্ত করিস না। আমার কিছু হয়নি।
(চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অবনী মাথা ঘুরে পড়ে যান)
মৌলী—দাদুভাই! মা!
(উষসী চা নিয়ে ঢোকে, মৌলীর সঙ্গে ধাক্কা লাগে, চা চলকে পড়ে যায়)
উষসী—বাবা, কি হয়েছে। বাবা ওরকম করছ কেন? শুভ, শুভ, শুনছ। একবার এদিকে এসো প্লীজ।
শুভেন্দু (নেপথ্যে)— কি হয়েছে চেঁচাচ্ছ কেন। ইম্পর্ট্যান্ট কলে আছি।
উষসী—বাবা পড়ে গেছেন, খুব হাঁপাচ্ছেন। এখুনি এসো। মা!
(শুভেন্দু আর সবিতা দৌড়ে ঢোকেন। শুভেন্দু অবনীবাবুকে ধরে তোলে। অবনীবাবু প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছেন।)
শুভেন্দু (ভীষণ নার্ভাস গলায়)— এ কি! বাবার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তোমরা কেউ জানতে না?
সবিতা—না তো! কাল রাত্তির থেকে শুধু একটু কাশছিল। সে তো প্রায়ই কাশে।
মৌলী—দাদুভাই ইয়োর লিপস আর সো ব্লু? দাদুভাই (কেঁদে ফেলে), বাবা, ডু সামথিং।
শুভেন্দু—মউ প্লীজ গো টু ইয়োর রুম। নাউ!
সবিতা—ওগো, তুমি এরকম হাঁপাচ্ছ কেন। এমনটা তো আগে কখনো হয়নি।
শুভেন্দু—(পকেট থেকে ফোন বার করে) উষি তুমি মাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাও। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি।
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল। হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল—সময় জগতের আর-সর্বত্রই চলিতে লাগিল, কেবল সেই স্নেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইয়া গেল। পাছে পুলিসের উপদ্রব ঘটে, এইজন্য অধিক আড়ম্বর না করিয়া জমিদারের চারিজন ব্রাহ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ দাহ করিতে লইয়া গেল। রানীঘাটের শ্মশান লোকালয় হইতে বহু দূরে। পুষ্করিণীর ধারে একখানি কুটির, এবং তাহার নিকটে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ, বৃহৎ মাঠে আর-কোথাও কিছু নাই।
শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি। থমথমে মেঘ করিয়া আছে, আকাশে একটি তারা দেখা যায় না; অন্ধকার ঘরে দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। একজনের চাদরে দিয়াশলাই এবং বাতি বাঁধা ছিল। বর্ষাকালের দিয়াশলাই বহু চেষ্টাতেও জলিল না— যে লণ্ঠন সঙ্গে ছিল তাহাও নিবিয়া গেছে।
অনেক ক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একজন কহিল, “ভাই রে, এক ছিলিম তামাকের জোগাড় থাকিলে বড় সুবিধা হইত। তাড়াতাড়িতে কিছুই আনা হয় নাই।”
আবার কথাবার্তা বন্ধ হইয়া গেল। পাঁচ মিনিটকে এক ঘণ্টা বলিয়া মনে হইতে লাগিল।
কোথাও কিছু শব্দ নাই—কেবল পুষ্করিণীতীর হইতে অবিশ্রাম ঝিল্লি ও ব্যাঙের ডাক শুনা যাইতেছে। এমন সময় মনে হইল, যেন খাটটা ঈষৎ নড়িল, যেন মৃতদেহ পাশ ফিরিয়া শুইল।
সূত্রধর ২— ওদিকে মৈত্র পরিবারের অবস্থাও গুরুতর। এমার্জেন্সি লোকে লোকারণ্য, চারদিকে চরম ব্যস্ততা আর আতঙ্কের পরিবেশ। এইটুকু জানা গেছে যে অবনীবাবুর কোভিড নিউমোনিয়া হয়েছে যার ডাক্তারি নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম। তিনি হাসপাতালের কোথাও একটা ভেন্টিলেটরে রয়েছেন। বাড়ির লোকেদের একটা বিরাট কনফারেন্স রুমে মোটামুটি আটকে রাখা হয়েছে, কারো ভেতরে যাবার উপায় নেই। কনফারেন্স রুমটা এখন প্রায় ভর্তি, বাইরের মাঠে একদল লোক ক্যাম্প খাটাচ্ছে, গাউন আর মুখোসে তাদের সকলের চেহারা একরকম। সবমিলিয়ে জায়গাটা যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে। সেই যুদ্ধক্ষেত্রের এক কোনায় আচ্ছন্নের মতন বসে আছে ওরা তিনজন।
(আলো বদল)
দৃশ্য—২
শুভেন্দু—মা, উষি, তোমরা ওঠো। টেস্ট করা হয়ে গেছে, এখন আমাদের বাড়ি চলে যেতে হবে।
সবিতা—বাড়ি চলে যাব মানে? ওদিকে মানুষটার যে কোন খবরই পাওয়া গেল না!
উষসী—যেতেই হবে মা। বাবা ভেন্টিলেটরে আছে, কোভিড ইউনিটে সেখানে বাইরের কারও ঢোকা নিষেধ।
শুভেন্দু—তাছাড়া হাউসহোল্ড কনট্যাক্ট হিসাবে আমরা সকলে এখন দুসপ্তাহের জন্য হোম কোয়ারেন্টিন।
সবিতা—কি বলছিস তোরা। দুসপ্তাহ আমরা ওকে দেখতে পারব না, বাঁচল না মরল খবর পাব না?
উষসী—না, না খবর নিশ্চয়ই পাব, কিন্তু দেখতে আসতে দেবে না। শহরে এখন প্রায় মার্শাল ল, মা, আমাদের কিছু করার নেই।
সবিতা—(উদ্ভ্রান্তভাবে) তোদের কেউ জানাশোনা নেই। একটিবারের মতন যদি দেখতে পেতাম।
শুভেন্দু—মা এখন চলো। কালকে রিপোর্ট পাওয়া যাবে, হয়তো আমাদের মধ্যে সবাই ইনফেক্টেড, কিন্তু সবচেয়ে বেশি রিস্ক তোমার। আমি বাড়ি গিয়েই আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে ফোন করছি।
(তিনজনে বেরিয়ে যায়)
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— সেই বর্ষণসিক্ত শ্মশানের মধ্যখানে ওরা দুইজন রামনাম জপিতে জপিতে কাঁপিতে লাগিল। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনা গেল, এবং সাথে সাথেই বৃষ্টির ঐকতান ছিন্ন করিয়া অদূরে জঙ্গল হইতে শৃগালের বিকট চিৎকার ধ্বনিত হইয়া উঠিল। শ্বশানবন্ধুরা আতঙ্কে অস্থির এবং মুক্তকচ্ছ অবস্থায় গ্রামের অভিমুখে দৌড় লাগাইয়া দিল। প্রায় ক্রোশ-দেড়েক পথ গিয়া দেখা গেল যে তাহাদের অবশিষ্ট দুই সঙ্গী কাঠের বোঝা মাথায় লণ্ঠন হাতে ফিরিয়া আসিতেছে। কালবিলম্ব না করিয়া চারজনেই শ্মশানে সেই কুটিরে গিয়া উপস্থিত হইল। ঘরে ঢুকিয়া দেখিল মৃতদেহ নাই, শূন্য খাট পড়িয়া আছে। সন্ধান করিতে করিতে বাহিরে গিয়া দেখে কুটিরের দ্বারের কাছে খানিকটা কাদা জমিয়াছিল, তাহাতে স্ত্রীলোকের সদ্য এবং ক্ষুদ্র পদচিহ্ন।
শারদাশংকর সহজ লোক নহেন, তাঁহাকে এই ভূতের গল্প বলিলে হঠাৎ যে কোনো শুভফল পাওয়া যাইবে এমন সম্ভাবনা নাই। তখন চারজনে বিস্তর পরামর্শ করিয়া স্থির করিল যে দাহকার্য সমাধা হইয়াছে, এইরূপ খবর দেওয়াই ভালো।
সূত্রধর ২— এদিকে নিউ জার্সির বাড়িটিকে দেখে বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ওরা চারজনেই কোভিড পজিটিভ সুতরাং কড়া কোয়ারেন্টিনে, বন্ধুবান্ধব কারও আসা-যাওয়ার প্রশ্নই নেই। মৌলী আর উষসী একেবারেই সুস্থ, শুভেন্ধু গায়ে ব্যথা আর মাথার যন্ত্রণায় ভুগেছে কয়েক দিন। সবিতার কি হয়েছে বলা শক্ত কেননা সেদিন হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে যেন কোন এক ডাইনি এসে ওঁর সবটুকু এনার্জি শুষে নিয়েছে। নিজের ঘরে বিছানায় সারাদিন শুয়ে থাকেন, জোর করে না খাইয়ে দিলে খাওয়াদাওয়াও করেন না, কিন্তু জ্বরজারি কিছুই নেই। প্রথম সপ্তাহটা ওরা যেন একটানা এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছিল। আজ সোমবার, শুভেন্দু বেশ ভালো বোধ করছে, তাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে একটুখানি স্বস্তির আবহাওয়া।
(আলো বদল)
দৃশ্য—৩
মৌলী—বাবা, দাদুভাই শ্যুড বি বেটার নাউ। ক্যান উই গো সী হিম?
উষসী—নট ইয়েট সোনা। আজ দাদুভাইকে স্টেপ ডাউন ইউনিটে শিফট করার কথা। আই হোপ নেক্সট উইকের মধ্যে—
মৌলী—হি উইল কাম হোম। দেন দিদু উইল ফীল বেটার টু!
শুভেন্দু—উই সার্টেনলি হোপ সো। মউ সোনা তুমি তোমার হোমওয়ার্কগুলো এগিয়ে রাখো। আজ আমিও কাজে জয়েন করছি। উষি তুমি অলরাইট এখন?
উষসী—টাচ উড, আমি একদম ঠিক আছি। কি অদ্ভুত অসুখ রে বাবা, কেউ অসুস্থ হয় কেউ হয় না। মউ তুই যা, তোর কাজ শুরু কর। আর শোন, দিদার কাছে গিয়ে একটু বসিস।
(মৌলী বেরিয়ে যায়। উষসী হঠাৎ শুভেন্দুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ঘটনাটার আকস্মিকতায় শুভেন্দু হকচকিয়ে যায়।)
শুভেন্দু—আরে আরে, তোমার আবার কি হল? কাঁদছ কেন?
উষসী—আই অ্যাম দি কালপ্রিট। ইনফেকশনটা আমিই বাড়িতে ঢুকিয়েছি। সেদিন যদি রূপসার বেবি শাওয়ারে না যেতাম তাহলে কিচ্ছু হতো না।
শুভেন্দু—ননসেন্স উষি। তোমরা বাড়ির মধ্যেও ঢোকোনি, গাড়ি থেকেই সেলিব্রেট করেছ। আসল কালপ্রিট আমি। আমার জন্যেই বাবা হাসপাতালে।
উষসী—তার মানে? তুমি তো বাড়ি থেকে এক পা বেরোচ্ছ না।
শুভেন্দু—হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সারাদিন বাড়িতে বন্দী তার ওপর এই অসহ্য মেঘলা ওয়েদার। সেদিন তুমি যখন বেবি শাওয়ারে গেলে, আমিও প্রতীকের বাড়িতে ঢুঁ মেরেছিলাম। জাস্ট ফর আ ড্রিংক অ্যান্ড আ রাউন্ড অফ পোকার। তারপর আরেকদিনও গেছি, তোমাকে লুকিয়ে। বলেছিলাম গ্রসারি করতে আর ওষুধ আনতে যাচ্ছি।
উষসী—কে কে ছিল? দি ওল্ড গ্যাং নিশ্চয়ই। লেট মি গেস—প্রতীক, রঞ্জনা, কৌশিক, উত্তমা, বিশ্বজিৎ, তাপস আর শ্রাবণী।
শুভেন্দু—ইয়েস কিন্তু অনলি বয়েজ। মেয়েরা ছিল না। আই অ্যাম সরি উষি।
উষসী—ওদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়েছে? জানো?
শুভেন্দু—কৌশিক আর শ্রাবণী দুজনেই হাসপাতালে ছিল। কাল ওরা শ্রাবণীকে ছেড়ে দিয়েছে। কৌশিকও বেটার। বাকিরা যদ্দুর জানি ভালো আছে।
উষসী—এইসব কথা তুমি আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিলে। কিন্তু আজ হঠাৎ কনফেস করতে গেলে কেন? এতদিন বাদে আমার একটা ব্রেকডাউন হল, কাঁদলাম, সেইজন্যে? তোমরা ছেলেরা আশ্চর্য জীব বটে।
শুভেন্দু—জানি না, আসলে তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও খুব কান্না পেল। কাঁদতে পারলাম না কিন্তু কনফেস করে আরাম লাগল একটু।
(মৌলী ঢোকে। ওর দুচোখে জল)
মৌলী—মামমাম, বাবা, আই থিংক আই অ্যাম রেস্পন্সিবল।
উষসী—যাচ্চলে। তোরও কনফেশন আছে!
মৌলী—আই ব্রোক দি রুল। মি অ্যান্ড ডেরেক, উই স্পেন্ট সাম টাইম টুগেদার।
শুভেন্দু—হোয়াট! হু ইজ ডেরেক। স্পেন্ট সাম টাইম টুগেদার মানে?
(মৌলী ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। ওকে কোলের মধ্যে টেনে নেয় উষসী।)
উষসী—শুভেন্দু ডেরেক একটা সাত বছরের ছেলে, তোমার মেয়ের বন্ধু, উল্টোদিকের বাড়িতে থাকে। তোমার অবস্থা দেখো, প্রতিবেশীদের কাউকে চেনো না, সেই পুরনো দেশি গুষ্টির মধ্যে আটকে আছ। (মৌলীকে) কি করেছিস রে মা?
মৌলী—আই ওয়েন্ট টু দেয়ার বেসমেন্ট টু প্লে ভিডিও গেমস। জাস্ট ওয়ান্স। আই মেড দাদুভাই সিক।
(তিনজনেই তিনজনের দিকে তাকায়। দেখা যায় ওরা সবাই কাঁদছে কিন্তু সেই কান্না দ্রুত হাসিতে বদলে যায়।)
উষসী—ওকে লেটস ফরগিভ ইচ আদার। কাম অন, গ্রুপ হাগ।
(তিনজনে পরস্পকে জড়িয়ে ধরে। অন্যদিক থেকে নিঃশব্দে সবিতা ঢোকেন।)
সবিতা—তোরা ভালো থাক, ভালো থাক। তোদের কারো দোষ নয়। দোষ আমার। ও তো আসতে চায়নি, আমিই ওকে জোর করে এনেছি। কলকাতায় থাকলে যাই হোক, দুজনে একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু এখানে যে আমি অসহায়, এই অচেনা দেশের অন্ধকার ঠেলে আমি কিছুতেই ওর কাছে গিয়ে বসতে পারব না। ওগো তুমি আমায় ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।
(সবাই নির্বাক হয়ে সবিতার দিকে তাকিয়ে থাকে)
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— সকলেই জানেন, জীবনের যখন কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না তখন অনেক সময় জীবন প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে, এবং সময়মতো পুনর্বার মৃতবৎ দেহে তাহার কার্য আরম্ভ হয়। কাদম্বিনীও মরে নাই— হঠাৎ কী কারণে তাহার জীবনের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। যখন সে সচেতন হইয়া উঠিল, দেখিল চতুর্দিকে নিবিড় অন্ধকার। একবার ডাকিল ‘দিদি’— অন্ধকার ঘরে কেহ সাড়া দিল না। সভয়ে উঠিয়া বসিল, মনে পড়িল সেই মৃত্যুশয্যার কথা। সেই হঠাৎ বক্ষের কাছে একটি বেদনা— শ্বাসরোধের উপক্রম। তাহার পর সমস্ত কালো হইয়া আসিল— যেন একটি লেখা খাতার উপরে দোয়াতসুদ্ধ কালি গড়াইয়া পড়িল— কাদম্বিনীর সমস্ত স্মৃতি এবং চেতনা, বিশ্ব গ্রন্থের সমস্ত অক্ষর এক মুহূর্তে একাকার হইয়া গেল।
সূত্রধর ২— হাসপাতালে ভর্তি হবার ঠিক দশদিনের মাথায় অবনীবাবুর মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেল। ভালো হতে হতে হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে একদম কোমায় চলে গেলেন ভদ্রলোক। বাড়ি থেকে শুধু একজন আসতে পারবে, তাই খবরটা পাবার পরে শুভেন্দুই গেল সনাক্ত করতে। নিয়মমাফিক সব হয়ে যাবার পরে ওদের জানানো হল যে বডি ক্রিমেটরিয়ামে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে।
সূত্রধর ১— তার প্রথমে মনে হইল, যমালয় বুঝি এইরূপ চিরনির্জন এবং চিরান্ধকার। সেখানে কিছুই দেখিবার নাই, শুনিবার নাই, কাজ করিবার নাই, কেবল চিরকাল এইরূপ জাগিয়া উঠিয়া বসিয়া থাকিতে হইবে। তাহার পর যখন মুক্ত দ্বার দিয়া হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাদলার বাতাস দিল এবং বর্ষার ভেকের ডাক কানে প্রবেশ করিল, তখন এক মুহূর্তে তাহার এই স্বল্প জীবনের আশৈশব সমস্ত বর্ষার স্মৃতি ঘনীভূতভাবে তাহার মনে উদয় হইল এবং পৃথিবীর নিকটসংস্পর্শ সে অনুভব করিতে পারিল। প্রথমেই মনে হইল, বাড়ি ফিরিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু তখনি ভাবিল, ‘আমি তো বাঁচিয়া নাই, আমাকে বাড়িতে লইবে কেন। সেখানে যে অমঙ্গল হইবে। জীবরাজ্য হইতে আমি যে নির্বাসিত হইয়া আসিয়াছি আমি যে আমার প্রেতাত্মা। শারদাশংকরের আলোকিত গৃহে তাহার মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত মনে পড়িল, তাহার পরেই এই বহুদূরবর্তী জনশূন্য অন্ধকার শ্মশানের মধ্যে আপনাকে একাকিনী দেখিয়া সে জানিল, ‘আমি এই পৃথিবীর জনসমাজের আর কেহ নহি আমি অতি ভীষণ, অকল্যাণকারিণী; আমি আমার প্রেতাত্মা।’
সূত্রধর ২— অবনীবাবুর অবস্থা অনেকটা এই রকমই হয়েছিল। বডি আইডেন্টিফিকেশনের জন্য শুভেন্দুকে যখন নিয়ে আসা হয় তখন তিনি কোন লোকে ছিলেন তিনিই জানেন কিন্তু জীবনের কোনো লক্ষণ তাঁর শরীরে ছিল না। ছেলে যখন ঘাড় নেড়ে, চোখের জল সামলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল, উনি সেসব আদৌ দেখতে পাননি। কিন্তু ডেথ সার্টিকিকেট লেখা হয়ে যাবার পরে বডি মর্গে পাঠানোর সময় একটা কাণ্ড হয়ে গেছিল সেদিন। সারি সারি টেবিলের ওপরে বডিব্যাগ ক্রিমেটোরিয়ামে যাবার অপেক্ষায়। হঠাৎ একটা বীভৎস গোঙানির শব্দে চমকে উঠলো সবাই। একটা বডিব্যাগ হঠাৎ নড়তে শুরু করেছে, টেবিল থেকে পড়ে যায় আরকি। মর্গের লোকজন আঁতকে উঠে চেঁচামেচি জুড়ল, তারপর ডাক্তার, নার্স পুলিস সব মিলিয়ে সে এক মহা হট্টগোলের পরিস্থিতি। শেষ অবধি দেখা গেল কয়েকজন লোক একটা স্ট্রেচার ঠেলে মর্গ থেকে আই-সি-ইউর দিকে দৌড় দিয়েছে। মৈত্র পরিবার এসবের কিছুই জানতে পারল না। ইতিমধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে, প্লেন চলাচল সদ্য শুরু হয়েছে, ওরা চারজন কলকাতায় ফিরেছে। আসুন তবে আমরাও কলকাতায় যাই।
(আলো বদল)
দৃশ্য—৪
শুভেন্দু—অসম্ভব, এই বাড়িতে মাকে একলা রাখা যাবে না। একলা একলা এই পুরনো বাড়ি মা সামলাবে কি করে? আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি মাকে বলছি বাড়ি বিক্রিতে রাজি হয়ে যাও, অ্যাপার্টমেন্টে অন্তত প্রতিবেশীরা থাকবে। কাকামণি যা বলছে প্র্যাকটিক্যাল কথাই বলছে।
উষসী—তোমার এই কাকা-কাকিমা কোত্থেকে এসে হাজির হলেন? মনে হচ্ছে সেই বিয়ের সময় দেখেছিলাম তারপর থেকে তোমাদের কা্রও মুখে কখনো ওদের নাম অবধি শুনিনি, ফোনটোন করা তো দূরের কথা।
শুভেন্দু—বাবার সঙ্গে কাকামণির সম্পর্ক ভালো ছিল না। এই বসতবাড়ি নিয়েই ঝামেলা। আসলে বাড়িটা তো দাদুর তৈরি, উনি উইল করে নিজের স্ত্রী এবং তাঁর অবর্তমানে আমার মাকে দিয়ে গেছিলেন। ছেলেরা থাকতে পারবে কিন্তু বাড়ি বিক্রি করতে পারবে না। কাকামণির তখনও বিয়ে হয়নি।
উষসী—হোয়াট! দি ওল্ড ম্যান লেফট হিস প্রপার্টি জাস্ট টু দি উইমেন!
শুভেন্দু—ইম্প্রেসিভ, তাই না? সেই আমলে এক জাঁদরেল প্যাট্রিয়ার্ক নিজের ছেলেদের ওপরে বড়োবউমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। দাদুর জীবনের শেষ কয়েক বছরে এই পাড়ার চেহারাটা বদলাতে শুরু করে। কলকাতায় তখনও পুরোদস্তুর প্রোমোটাররাজ শুরু হয়নি কিন্তু এই এলাকায় জমির দাম হু-হু করে বাড়ছিল। দাদু আন্দাজ করেছিলেন যে ছেলেরা বাড়ি বিক্রি করে যে যার অংশ নিয়ে সরে পড়বে। কাকামণি অনেকদিন এই নিয়ে চাপাচাপি করেছে।
(বিকাশ মৈত্র, অঞ্জনা মৈত্র ও সবিতা ঢোকেন, সঙ্গে এক অপরিচিত ভদ্রলোক। মৌলী সবিতার হাত ধরে আছে।)
বিকাশ—যাক, সব ব্যবস্থা করে এলাম। ওই কালীমন্দিরের ঠাকুরমশাই, উনি বিধান দিয়েছেন মহামারীর সময় অত কিছু নিয়মকানুন নেই। আর দেরি না করে ক্রিয়াকর্মটা তাহলে সেরে ফেলা যাক। হ্যাঁ, কবে যেন ফেরার কথা তোমাদের?
অঞ্জনা (হঠাৎ উষসীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে)—ভাবতেই পারছি না দাদার মতন একজন মানুষ এইভাবে বিদেশবিভুঁইয়ে একলা চলে গেলেন! তোমাদের মনে যে কি হচ্ছে—!
সবিতা—ওদের মনে হবার কিছু তো নেই। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে উনি যেতে চাননি, আমি ওঁকে রাজি করিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর নাতনিকে নিয়ে উনি তো আনন্দেই ছিলেন। রিটায়ার করার পরে এত আনন্দে থাকতে ওঁকে কোনোদিন দেখিনি। যা হবার হয়েছে। আর ওইসব শ্রাদ্ধশান্তিতে আমার মন নেই গো এখন।
শুভেন্দু—কাকামণি, এসব ক্রিয়াকর্মে বাবা কিন্তু মোটেই বিশ্বাস করতেন না।
অঞ্জনা—সে বিশ্বাস করো আর নাই করো। এই যে আমাদের পরিবার, সমাজ, পরম্পরা এসবেরও তো একটা মূল্য আছে। কাজ তো একটা করতেই হয়। কি বলেন ক্ষেত্রীজি?
ক্ষেত্রী—জরুর, জরুর, মাজী, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। পাশের হাউজিংএ আচ্ছা খাসা কমিউনিটি হল আছে, আমি বুক করে দিয়েছি।
উষসী—(অবাক হয়ে) হাউজিং! কমিউনিটি হল। মানে?
বিকাশ—আরে এই দ্যাখো, আলাপটাই তো করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি হচ্ছেন অমরনাথ ক্ষেত্রী, মস্তবড়ো বিল্ডার। উনি একটা খুব ভালো অফার নিয়ে এসেছেন। মানে বউদির পক্ষে এতবড়ো একটা পুরনো বাড়ি মেনটেইন করা তো কম কথা নয়, আর আমরাও তো কাছাকাছি থাকি না। তাই সবাই থাকতে থাকতে একটা বন্দোবস্ত—
শুভেন্দু—বাড়ি মায়ের নামে, মা যা চাইবেন তাই হবে। এব্যপারে আমার কিছু বক্তব্য নেই।
সবিতা—শুভ, আমার মন চাইছে না। তোরা শুনলে হাসবি কিন্তু এই বাড়ির সবজায়গায় ওর ব্যবহার করা জিনিসপত্র, আমার মনে হচ্ছে সব এইভাবেই থাকুক। আমার মনে হচ্ছে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি, সকালে উঠে ঠিক ওঁর গলাটা শুনতে পাব।
অঞ্জনা—ওরকম তো মনে হবেই বউদি। (কাঁদো কাঁদো গলায়) কিন্তু যিনি গেছেন তাঁকে তো যেতে দিতেই হবে। তাই বলি, কাজটা হয়ে গেলে দেখবে, মনে শান্তি ফিরেছে।
উষসী—মা, চলো আমরা তোমার ঘরে গিয়ে একটু বসি, এক কাপ চা করে আনি তোমার জন্য। এসব বৈষয়িক কথাবার্তা ভালো লাগছে না এখন। মৌলী তুমিও আমাদের সঙ্গে এসো।
সবিতা—চলো। শুভ তুই যা ভালো মনে করিস, কর। তোকে তো আমার পাওয়ার-অফ-অ্যাটর্নি দেওয়াই আছে। আমাকে আর এসবের মধ্যে রাখিস না।
মৌলী—ঠাম্মা আই লাইক দিস হাউস।
(তিনজনে বেরিয়ে যায়)
অঞ্জনা—চা করলে আমাদের সবার জন্যই কোরো কিন্তু।
বিকাশ—ক্ষেত্রীজি বসুন। সত্যিই তো শোকের সময় এসব কথা কার ভালো লাগে বলুন। কিন্তু পৈত্রিক বাড়িটার একটা ব্যবস্থা তো করতেই হয়।
ক্ষেত্রী—শুভেন্দুবাবু আপনাকে ঠিক করে সমঝিয়ে বলছি। এই এরিয়াতে আজকাল কিছু ব্যাড এলিমেন্ট অ্যাকটিভ আছে। এল্ডারলি উইডো একলা এতবড়ো বাড়িতে থাকেন জানলে তারা ট্রাবল ক্রিয়েট করতে পারে। কিন্তু আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন, আমার তৈরি হাউজিং কমপ্লেক্সগুলো হান্ড্রেড পার্সেন্ট সেফ অ্যান্ড সিকিওর। সিনিয়র সিটিজেনদের কথা মাথায় রেখে আমরা অনেক রকমের ফেসিলিটির ব্যবস্থা করেছি। মা-জির কোনরকম অসুবিধা হবে না।
বিকাশ—দেখ শুভ, আমাদেরও তো বয়েস হয়েছে আর মুম্বাই ইজ টু এক্সপেন্সিভ। রিটায়ারমেন্টের পরে কলকাতায় ফিরতে চাই। কাছাকাছি থাকলে বউদির দেখাশুনো তো আমরাই করব। উনি বলেছেন আমাদের তিনটে ফ্ল্যাট দেবেন। ভেবে দেখ এর থেকে ভালো বন্দোবস্ত আর কি হতে পারে বল দেখি।
অঞ্জনা—তাই তো। সবাই একসাথে থাকব, ওনারও আত্মার শান্তি হবে। ঠাকুর ঠাকুর—
শুভেন্দু—দাঁড়ান দাঁড়ান, এই বাড়ি উনি কিনবেন, তারপর ভেঙে নতুন বিল্ডিং বানাবেন। ততদিন মা থাকবেন কোথায়?
ক্ষেত্রী—আরে সে নিয়ে আপনি টেনশন নেবেন না। আমার কাছে ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট আছে, কেয়ারটেকার আছে, উনি খুব আরামে থাকবেন। এসব কিন্তু ফালতু বাত নয়, সব একদম পাক্কা, এগ্রিমেন্টে লেখা থাকবে। দেখুন আপনারা সবাই বিদেশে বড়ো বড়ো কাজ করছেন, ইয়োর পেরেন্টস ডিসার্ভ দি বেস্ট। আমার এই স্মল বিজনেসের এইটাই অনলি মটো বলতে পারেন। আচ্ছা আজ তাহলে আসি, এই আমার কার্ড রইল, দরকার হলেই ফোন করবেন।
অঞ্জনা—আরে আরে, চা তো খেয়ে যান। উষসী কোথায় গেলে—
(উষসী ঢোকে)
উষসী—মা চা খেতে চাইলেন না, তাই আর বানাইনি। ঘুমিয়ে পড়েছেন। সরি (শুভেন্দুকে) একটা ফোন এসেছিল নিউইয়র্ক পুলিস ডিপার্টমেন্ট থেকে। উই নিড টু টক।
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— কাপড়ে কাদা মাখিয়া, অদ্ভুত ভাবের বশে ও রাত্রিজাগরণে পাগলের মতো হইয়া, কাদম্বিনীর যেরূপ চেহারা হইয়াছিল তাহাতে মানুষ তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইতে পারিত এবং ছেলেরা বোধ হয় দূরে পালাইয়া গিয়া তাহাকে ঢেলা মারিত। সৌভাগ্যক্রমে একটি পথিক ভদ্রলোক তাহাকে সর্বপ্রথমে এই অবস্থায় দেখিতে পায়।
সে আসিয়া কহিল, “মা, তোমাকে ভদ্রকুলবধূ বলিয়া বোধ হইতেছে, তুমি এ অবস্থায় একলা পথে কোথায় চলিয়াছ।”
কাদম্বিনী প্রথমে কোনো উত্তর না দিয়া তাকাইয়া রহিল। হঠাৎ কিছুই ভাবিয়া পাইল না। সে যে সংসারের মধ্যে আছে, তাহাকে যে ভদ্রকুলবধূর মতো দেখাইতেছে, গ্রামের পথে পথিক তাহাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে, এ-সমস্তই তাহার কাছে অভাবনীয় বলিয়া বোধ হইল।
পথিক তাহাকে পুনশ্চ কহিল, “চলো মা, আমি তোমাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিই— তোমার বাড়ি কোথায় আমাকে বলো।”
কাদম্বিনী চিন্তা করিতে লাগিল। শ্বশুরবাড়ি ফিরিবার কথা মনে স্থান দেওয়া যায় না, বাপের বাড়ি তো নাই— তখন ছেলেবেলার সই যোগমায়ার মনে পড়িল।
কাদম্বিনী ভদ্রলোকটিকে কহিল, “নিশিন্দাপুরে শ্রীপতিচরণবাবুর বাড়ি যাইব। ওঁর স্ত্রী যোগমায়া আমার সই।”
দুই সইয়ে মিলন হইল। যোগমায়া কহিল, “ওমা, আমার কী ভাগ্য। তোমার যে দর্শন পাইব এমন তো আমার মনেই ছিল না। কিন্তু, ভাই, তুমি কী করিয়া আসিলে। তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যে তোমাকে ছাড়িয়া দিল!”
কাদম্বিনী চুপ করিয়া রহিল; অবশেষে কহিল, “ভাই, শ্বশুরবাডির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না। আমাকে দাসীর মতো বাড়ির এক প্রান্তে স্থান দিয়ো, আমি তোমাদের কাজ করিয়া দিব।”
যোগমায়া কহিল, “ওমা, সে কী কথা। দাসীর মতো থাকিবে কেন। তুমি আমার সই, তুমি আমার”— ইত্যাদি ইত্যাদি।
সূত্রধর ২— মর্গ থেকে আই-সি-ইউতে যিনি ফেরত এলেন হাসপাতালের রেকর্ডে তাঁর নাম নিখিলভাই প্যাটেল। সেদিন রাত্রে উৎকট বিশৃঙ্খলার মধ্যে দুজনের কাগজপত্র সব বদলাবদলি হয়ে যায়। দুজনেই বয়স্ক ভারতীয়, চেহারার মিল থাকাই সম্ভব, তাছাড়া দিনরাত্রি মড়া পোড়াতে পোড়াতে কর্মীদের মানসিক অবস্থাও আন্দাজ করা যায়। মোদ্দা কথা ক্রিমেটোরিয়ামে ঢুকেছিলেন নিখিলভাই কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন অবনীবাবু। তারপর পাক্কা দু-হপ্তা জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে থেকে একদিন তিনি চক্ষু মেললেন।
নিখিলভাই প্যাটেল নিউ জার্সির এক বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা, বিপত্নীক এবং ডিমেনশিয়ার রুগী। পারিবারিক দিক থেকে ভদ্রলোককে মোটামুটি পরিত্যক্ত বলা যায়। ছেলে-মেয়ে থাকলেও তারা দেশের অন্যান্য জায়গায় যে যার ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত। হাসপাতালে থাকার সময় একবার হয়তো এসেছিল, তারপর বাবা নার্সিং হোমে ফেরত গেছেন জেনেই তারা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। এদিকে আমাদের অবনীবাবু দুর্বল শরীরে, উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বৃদ্ধাশ্রমে চালান হয়ে গেছেন। বউ, ছেলে, নাতনির বদলে দুই মিশকালো যমদূতের মতন চেহারার অ্যাটেন্ডেন্ট ভদ্রলোককে বগলদাবা করে শহরের অন্যপ্রান্তে আধা জেলখানার মতন এক নার্সিং হোমের ঘরে আটক করেছে।
(আলো বদল)
দৃশ্য—৫
অবনী—আমি কি সত্যিই বেঁচে আছি, না এই জায়গাটা পরলোক? অবশ্যই আমি ধোয়া তুলসীপাতা নই কিন্তু এমন কিছু খারাপ কাজও তো জীবনে করিনি। ওই একটু-আধটু মদ্যপান, পরনারীর দিকে তাকানো, কলিগদের পিছনে লাগা সেও তো অনেক দিন আগে। আচ্ছা আমার কি নরকে যাবার কথা? নাকি যুধিষ্ঠিরের মতন আমাকে আগে নরক দেখিয়ে তারপর স্বর্গে নিয়ে যাবে। উঁ! কি দুর্গন্ধ এই ঘরটায়! তাছাড়া দরজাটা বন্ধ করেই বা রেখেছে কেন, আমি কি জেলের কয়েদি নাকি?
(খাটের তলা থেকে অ্যান্টনি গোমেজ বেরিয়ে আসে)
গোমেজ—হা হা। আমরা সবাই কয়েদি। জীবনটাই তো আসলে এক বিরাট জেলখানা। হয় জেলখানা নয়তো পাগলখানা, আপনার যেটা পছন্দ।
অবনী—ওরে বাপরে। আপনি কে মশাই?
গোমেজ—না না, আসল প্রশ্নটা হচ্ছে যে আপনি কে? আপনি যদি আপনি না হন তার মানে আমার ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ড নির্ঘাৎ টেঁসে গিয়েছে, আপনি একজন নতুন পাগল। নামটা জানতে পারি?
অবনী—দেখুন আপনি পাগলছাগল যাই হোন, দয়া করে আমাকে হেল্প করুন। আমার নাম অবনীভূষণ, আমিও ইন্ডিয়ার লোক, এখানে বেড়াতে এসেছিলাম, তার পরে আর কিছু মনে নেই। এরা কেউ আমার কথা শুনছে না, জোর করে আমাকে এখানে আটকে রেখেছে। ওদিকে আমার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ, নাতনি কে কোথায় আছে কে জানে। আচ্ছা আপনার ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ডের নামটা কি ছিল বলুন তো?
গোমেজ—কেন, নাম নিয়ে আপনি কি করবেন। আর আমি জানবই বা কেমন করে। সে তো নিজেই তার নিজের নাম ভুলে গেছিল। আর এখানকার পুরনো স্টাফ সবাই পালিয়ে গেছে, অর্ধেক রোগী হাসপাতালে, যারা আছে, সব নতুন লোক। এদের কাছে আমিও পাগল, আপনিও পাগল, সবাই সমান।
অবনী—আমার তো নিজেকে ঠিক পাগল বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে আমি কি আসলে আমার নিজের ভূত। ভূত না পাগল? পাগল না ভূত? কোথাও একটা কিছু গুলিয়ে গেছে, কিছুই মনে করতে পারছি না যে।
গোমেজ—মনে করার দরকার কি বলুন তো? পাগল হলে পাগল, ভূত হলে ভূত। আরে বাবা, ও দুটোর মধ্যে তফাৎটাই বা কোথায়? দুজনেই সংসারের বাইরে, মানুষের কাছে দুজনেই বিপজ্জনক। বরং ভূত হলে কিছু বাড়তি সুবিধা আছে, তাকে আটকে রাখা যায় না। তা আপনি এক কাজ করুন।
অবনী—কাজ। কি কাজ।
গোমেজ—এই যে জানলাটা দেখছেন খুব করে দৌড়ে গিয়ে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন গে যান।
অবনী—কেন, জানলার ওপর খামোকা ঝাঁপিয়ে পড়তে যাব কেন?
গোমেজ—যদি হুস করে বাইরে চলে যান তাহলে আপনি ভূত, আর যদি কাঁচ ভেঙে পাঁচতলা থেকে পড়ে যান তাহলে আপনি পাগল। হাতে হাতে প্রমাণ। আরে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন কেন? যান।
অবনী—আজ্ঞে এখনও তো ঠিক বুঝতে পারছি না। মানে যদি খুব লাগে?
গোমেজ—ভয় করছে? তাহলে তো ব্যাপারটা গুরুতর। পাগল আর ভূত, এদের কারো লজ্জা, ঘেন্না, ভয় থাকতে নেই। সেই ব্যাটা রাজপুত্তুরের মতন আপনিও তাহলে কনফিউজড। আপনার কপালে দুঃখ আছে।
অবনী—কোন রাজপুত্তুর? কি সব পাগলের মতন কথা বলছেন আপনি?
গোমেজ—হাঃ হাঃ, পাগল তো পাগলের মতোই কথা বলবে। যেমন ভূত ভূতের মতন। কেন, ডেনমার্কের সেই ভূতে পাওয়া রাজপুত্তুরের গপ্পো শোনেননি।
Or to take arms against a sea of troubles,
And by opposing, end them? To die: to sleep;
(চেঁচিয়ে ওঠে) To die: to sleep;
But that the dread of something after death,
The undiscover'd country from whose bourn
No traveller returns, puzzles the will
And makes us rather bear those ills we have
Than fly to others that we know not of?
Thus conscience does make cowards of us all;
অবনী—গড় গড় করে হ্যামলেট আওড়াচ্ছেন আপনি কি পাগল না প্রফেসর?
গোমেজ—আরে পাগলের থেকে বড়ো প্রফেসর আর কে আছে। সে চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটাকে দেখিয়ে দেয়, বলে এসো, মনের এই ভাঙা আয়নায় চোখ রাখো। দেখবে আমি যা তুমিও তাই, শুধু আমি সৎ বলে পাগলামি মেনে নিয়েছি আর তুমি হয় ভীতু কিংবা অসৎ, তাই সুস্থতার ভান করছ! সুস্থতার অভিনয়! যান যান, সত্যের সামনে দাঁড়ানোর ইচ্ছে থাকলে এক্ষুনি ওই জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
অবনী—(কান চেপে ধরে) না না, আপনি জানেন না। আমার একটা ছোট নাতনি আছে, তাকে শুধু আর একটিবার দেখতে চাই। হ্যাঁ আমিও শুধু বাঁচার জন্য বেঁচে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম জানেন। শুধু ওই ক্ষুদে মেয়েটা, আমাকে কেমন করে যেন জীবনের মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনল। কিন্তু ওদের কোন অমঙ্গল হোক তাও তো আমি চাই না। মানে যদি ভূত বলে যদি সত্যিই কিছু থাকে, সে যদি ওদের ক্ষতি করে? না না, তার চেয়ে এই ভালো।
গোমেজ—ঠিক আছে তাহলে কটা দিন এভাবেই কাটিয়ে দিন না। জীবিত আর মৃতের মাঝামাঝি জায়গাটায়। যতদিন না ডাক আসে।
অবনী—আরে আপনি তো মহা হেঁয়ালিদার পাগল মশাই। কি বলছেন স্পষ্ট করে বলুন না।
গোমেজ—(অবনীর কানে কানে) জীবন, মৃত্যু আর ভালোবাসা—এরা সবাই ডাক পাঠায়। মানুষ যতদিন জ্যান্ত থাকে সেইসব ডাক তার কানে আসে। যে প্রেত তার কাছে কোন ডাক পৌঁছয় না। থাকুন। বুঝে যাবেন। ঠিক বুঝে যাবেন।
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— কাদম্বিনী সইয়ের বাড়িতে আসিল, কিন্তু সইয়ের সঙ্গে মিশিতে পারিল না— মাঝে মৃত্যুর ব্যবধান। কাদম্বিনী যোগমায়ার মুখের দিকে চায় এবং কী যেন ভাবে— মনে করে, ‘স্বামী এবং ঘরকন্না লইয়া ও যেন বহু দূরে আর-এক জগতে আছে। স্নেহ-মমতা এবং সমস্ত কর্তব্য লইয়া ও যেন পৃথিবীর লোক, আর আমি যেন শূন্য ছায়া। যোগমায়ারও কেমন কেমন লাগিল, কিছুই বুঝিতে পারিল না। অনিশ্চিতকে লইয়া কবিত্ব করা যায়, বীরত্ব করা যায়, পাণ্ডিত্য করা যায়, কিন্তু ঘরকন্না করা যায় না। কাদম্বিনী যতই দুর্বোধ হইয়া উঠিল যোগমায়া তাহার উপর ততই রাগ করিতে লাগিল; ভাবিল, এ কী উপদ্রব স্কন্ধের উপর চাপিল। কাদম্বিনীর আপনাকে আপনি ভয় করে। সে নিজের কাছ হইতে নিজে কিছুতেই পলাইতে পারে না। তাহার এই ভয় দেখিয়া বাড়িসুদ্ধ লোকের মনে কেমন একটা ভয় জন্মিয়া গেল। চাকরদাসীরা এবং যোগমায়াও যখন-তখন যেখানে-সেখানে ভূত দেখিতে আরম্ভ করিল।একদিন যোগমায়া আসিয়া কাদম্বিনীকে কহিল, “সই, এখানে তোমার আর থাকা ভালো দেখাইতেছে না। লোকে বলিবে কী।”
কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে যোগমায়ার মুখের দিকে তাকাইয়া কহিল, “লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী।”
যোগমায়া কথা শুনিয়া অবাক হইয়া গেল। কিঞ্চিৎ রাগিয়া কহিল, “তোমার না থাকে, আমাদের তো আছে। আমরা পরের ঘরের বধূকে কী বলিয়া আটক করিয়া রাখিব।”
কাদম্বিনী কহিল, “আমার ঘর কোথায়।”
যোগমায়া ভাবিল, ‘আ মরণ। পোড়াকপালি বলে কী।’
কাদম্বিনী ধীরে ধীরে কহিল, “আমি কি তোমাদের কেহ। আমি কি এ পৃথিবীর। তোমরা হাসিতেছ, কাঁদিতেছ, ভালোবাসিতেছ, সবাই আপন আপন লইয়া আছ, আমি তো কেবল চাহিয়া আছি। তোমরা মানুষ, আর আমি ছায়া। বুঝিতে পারি না, ভগবান আমাকে তোমাদের এই সংসারের মাঝখানে কেন রাখিয়াছেন। তোমরাও ভয় কর পাছে তোমাদের হাসিখেলার মধ্যে আমি অমঙ্গল আনি— আমিও বুঝিয়া উঠিতে পারি না, তোমাদের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?
সূত্রধর ২— অন্যদিকে আমাদের অবনীবাবু এবং তাঁর উন্মাদ বন্ধুটি মিলে কয়েক সপ্তাহ বেশ ভালোই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। অবনীবাবুর মনে ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত আইডিয়া বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল। আচ্ছা ভূত হয়েই কিছুদিন থাকলে কেমন হয়? মানুষের সঙ্গে ভূতের এমন কি-ই বা ফারাক? মানুষেরই বরং নানান অস্বস্তি, নানান অলীক, উদ্ভট দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে করে তাকে পথ চলতে হয়। অন্যদিকে ভূতেরা সেদিক দিয়ে স্বাধীন ও নিরাপদ।
গোলমাল বাঁধল যখন নিখিলভাই প্যাটেলের ছেলে বিশ্বনাথ প্যাটেল এক উকিলকে সঙ্গে করে বাবার খবর নিতে হাজির হলো। আসল কথাটা এই যে নিখিলভাই প্যাটেল ডিমেনশিয়ার রুগী হলেও তাঁর সম্পত্তির শেষ নেই, এই তল্লাটে অন্তত তিনটে পেট্রল পাম্প আর গোটাদুয়েক সস্তা হোটেল তাঁর নামে। নিখিলভাই হাসপাতালে টেঁসে গেলে কোন ঝামেলাই ছিল না কিন্তু জ্যান্ত অবস্থায় গল্পটা একটু অন্যরকম। সেইসব বিলিব্যবস্থা ঠিকঠাক করার জন্য কিছু ডাক্তারি পরীক্ষার দরকার, আর সেখানেই বেঁধে গেল গণ্ডগোল। হাসপাতাল ফেরত ব্যক্তিটি মানুষ হলে কোন মানুষ এবং ভূত হলে কার ভূত তাই নিয়ে বিরাট রহস্য পাকিয়ে উঠল, নার্সিং হোমের কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। ওঁদের ওখানেই রেখে চলুন আমরা আবার কলকাতায় ফিরে যাই।
(আলো বদল)
দৃশ্য-৬
উষসী—শুভ, নিউ ইয়র্কের একটা নার্সিং হোমে কে একজন ক্লেইম করেছে যে সে অবনীভূষণ মৈত্র, আমাদের নাম-ঠিকানাও দিয়েছে । অন্যদিকে তার পরিবার বলছে যে সে আসলে নিখিলভাই প্যাটেল এবং বদ্ধ উন্মাদ। পুলিশ জানিয়েছে যে লীগাল গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠতে পারে, তাছাড়া বাবা যদি বাবাই হন তাহলে এবং আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার। বাবা অসুস্থ, অসহায়, পেনিলেস, একটা পাগলখানায় বন্ধ হয়ে আছেন, ভাবতে পারো?
বিকাশ—দাঁড়াও, দাঁড়াও আরেকটু খবর নাও। দেখি দেখি, ওরা যে ছবিটা পাঠিয়েছে, আমায় দেখাও তো (উষসীর ফোন দেখে) আরে দূর এটা দাদার ছবি নয়। এই রোগাপটকা, দাড়িওয়ালা ভূত, নির্ঘাৎ পাগল কিংবা বদমায়েশ, দাদা হতেই পারে না।
উষসী—মাসখানেক হাসপাতালে থাকলে সবার চেহারাই বদলে যায়। চোখ দুটো আমার চেনা লাগছে। শুভ উই মাস্ট গো।
শুভেন্দু—আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে ক্ষেত্রীজি, কাকামণি আর তাদের প্ল্যান, অন্যদিকে এইসব উদ্ভট খবর। আরে, মাকে কোথায় রাখব, এইটুকু তো বলে দাও? এই বাজারে তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না পারলে মাঝখান থেকে বেমক্কা চাকরিটাই চলে যাবে। আমরা তো এখনও যে যার গ্রীন কার্ডের চক্করে ফেঁসে আছি, এইসবের মাঝখানে একলা আমি কি করতে পারি বলো?
উষসী—ঠিক তাই, সোজা কথায় আমরা সবাই অলীক। বলা যেতে পারে আমরা আসলে মানুষ নই, সবাই ভূত, অশরীরী আত্মা। কিন্তু দশ হাজার মাইল দূরে আমাদের মধ্যে একজন হয়তো মানুষের দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। তারই সন্ধানে আমি আর মৌলী নিউ জার্সিতে ফিরে যাচ্ছি। তোমরা এখানে সম্পত্তি নিয়ে যা ইচ্ছে হয় করো, সে নিয়ে আমার কিছু বলবার নেই।
অঞ্জনা—আচ্ছা কে একটা পাগল কোথায় কি বলল, তার জন্য বাবার কাজ না করে ফিরে যাবে, কেমনধারা মানুষ গো তোমরা।
(মৌলী ঢোকে। ওর হাতে একটা টুথব্রাশ)
মৌলী—মা, বাবা, আই হ্যাভ আ সলিউশন টু দিস প্রবলেম।
শুভেন্দু—কি বলছিস রে মৌ? কি সলিউশন?
মৌলী—(পকেট থেকে টুথব্রাশ বার করে) দিস ইজ দাদুভাইজ টুথব্রাশ। হিজ ডি-এন-এ ইজ রাইট হিয়ার। ম্যাচ দেম অ্যান্ড ইউ উইল নো।
উষসী—মৌলী, তুই কি বলছিস?
মৌলী—এই টুথব্রাশের মধ্যে দাদুর ডি-এন-এ আছে। যদি ম্যাচ করে যায় তাহলে নিউইয়র্কের ওই পাগল লোকটাই তোমার বাবা, আমার দাদুভাই, নাহলে নয়। আমি জানি, আমার সাইন্স টিচার বলেছে।
বিকাশ—মৌলী মা, বইতে অনেক কথা লেখে, আসল লাইফ অন্যরকম। যাকগে আমি ভেবেছিলাম তোমরা অ্যামিকেবলি ব্যাপারটা সেটল করবে। তা যদি না হয় তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকে আইনের পথে যেতে হবে। আমি আমার ভাইয়ের ডেথ সার্টিফিকেটের কপি ক্লেইম করছি, তুমি না করো দাদার শ্রাদ্ধ আমরাই করব।
মৌলী—বাবা প্লীজ, লিসন টু মামি।
শুভেন্দু—ইয়েস সোনা, আমরা ফিরে যাচ্ছি। কাকামণি, কাকিমা, যতক্ষণ অবধি এই মিস্ট্রি সলভ না হচ্ছে, আই উইল নট সাইন এনি এগ্রিমেন্ট। উষি, তুমি মেসেজটা মাকে দেখিয়েছ?
উষসী—ভয় করল শুভ। সত্যিই যদি লোকটা পাগল ইম্পোস্টার হয় তাহলে মা শুধু শুধু আরেকবার শক খাবে।
শুভেন্দু—দেখাও। ওই যে ছবির চোখের কথাটা তুমি বললে না। মাও যদি একই কথা বলে তবে আজ বিকেলেই আমরা প্লেনে উঠছি।
(তিনজনে বেরিয়ে যায়)
বিকাশ—হ্যাঁ যাও, বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে বেড়াও গে। এদিকে বাড়ি জবরদখল হয়ে গেলে তখন আমাকে দোষ দিতে এসো না। ভারি আমার এন-আর-আই এয়েছেন।
অঞ্জনা—একটা ফয়সালা না করে এ বাড়ি থেকে আমরা নড়ছি না, খেয়াল রেখো।
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— যোগমায়ার স্বামী শ্রীপতি কহিলেন, “যে স্ত্রীলোকটিকে তোমার ঘরে স্থান দিয়াছ সে তোমার সই কাদম্বিনী নহে। আমি ওর শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ লইয়াছি।”
এমন সময়ে তাঁহাদের ঘরের দ্বার খুলিয়া গেল, একটা বাদলার বাতাস আসিয়া প্রদীপটা ফস করিয়া নিবিয়া গেল। বাহিরের অন্ধকার প্রবেশ করিয়া এক মুহূর্তে সমস্ত ঘরটা আগাগোড়া ভরিয়া গেল। কাদম্বিনী একেবারে ঘরের ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন রাত্রি আড়াই প্রহর হইয়া গিয়াছে, বাহিরে অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতেছে।
কাদম্বিনী কহিল, “সই, আমি তোমার সেই কাদম্বিনী, কিন্তু এখন আমি আর বাঁচিয়া নাই। আমি মরিয়া আছি।”
যোগমায় ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন, শ্রীপতির বাক্যস্ফূর্তি হইল না।
“কিন্তু আমি মরিয়াছি ছাড়া তোমাদের কাছে আর কী অপরাধ করিয়াছি। আমার যদি ইহলোকেও স্থান নাই, পরলোকেও স্থান নাই— ওগো, আমি তবে কোথায় যাইব।” তীব্রকণ্ঠে চীৎকার করিয়া যেন এই গভীর বর্ষানিশীথে সুপ্ত বিধাতাকে জাগ্রত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ওগো, আমি তবে কোথায় যাইব।”
সূত্রধর ২— ওদিকে নিউইয়ের্কের সেই নার্সিংহোমে অবনীবাবু তাঁর নতুন বন্ধুর সঙ্গে বহাল তবিয়তেই আছেন। পুলিস, উকিল, ডাক্তার যে যখন এসেছে উনি সকলকে বলে দিয়েছেন যে মানুষ বা ভূত, এবিষয়ে সন্দেহ থাকলেও উনি অবনী মৈত্র, নিখিল প্যাটেল অবশ্যই নন। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই নার্সিং হোমে ওঁর পক্ষে থাকা মুশকিল। নিখিলভাইয়ের বাড়ির লোক মহা গোলযোগ লাগিয়েছে। কিছু কাগজপত্রে সই না করিয়ে ওরা ছাড়বে না। অবনীবাবু এইটুকু জানেন যে ওঁর পরিবার এখন কলকাতায়, তাদের খবর দেওয়া হয়েছে। এটাও জানেন যে কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য, ওঁর নিজেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।
(আলো বদল)
দৃশ্য—৭
অবনী—আচ্ছা গোমেজ, তুমি তো অনেক পড়াশুনো করেছ। হিন্দুদের শ্রাদ্ধ হয় জানো তো?
গোমেজ—আলবাত জানি, আমি পাক্কা পাঁচ বছর হিপি ছিলাম। শ্রাদ্ধ হলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে।
অবনী—ল্যাঠা চুকে যাবে মানে?
গোমেজ—মানে তুমি যদি ভূত হও তবে সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি, তুমি ফুস করে হাওয়ায় মিশে যাবে, আর জামাকাপড়গুলো এইখানে পড়ে থাকবে। আর যদি মানুষ হও তো আরো ভালো।
অবনী—কেন, কেন। জ্যান্ত মানুষের শ্রাদ্ধ হলে কি হয়।
গোমেজ—এও জানো না। জ্যান্ত মানুষের শ্রাদ্ধ হলে সে সন্ন্যাসী হয়ে যায়, তখন স্ত্রী পুত্র পরিবার, তুমি কার কে তোমার। তখন তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, এই দুনিয়ার ঘানিতে তেল দেওয়া তোমার শেষ। দেখো দেখি তোমার কপাল।
অবনী—না, না, আমি হাওয়ায় মিশে যেতে কিংবা সন্ন্যাসী হতে চাই না। আমি শুধু আমার নাতনিকে দেখতে চাই। আমি পালাব। এখান থেকে পালিয়ে যাব আমি।
গোমেজ—কোথায় পালাবে? তোমার না আছে পাসপোর্ট, না আছে ড্রাইভিং লাইসেন্স, পকেট খালি, শরীর দুর্বল, তোমাকে পাকড়াও করে এবার জেলেই পুরে দেবে।
অবনী—তাহলে তুমি যা বলেছিলে তাই চেষ্টা করে দেখি। এই জানলাটা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একটা ফয়সালা হয়ে যাক যে আমি মানুষ না ভূত।
গোমেজ। খুব ভালো আইডিয়া। আমি জানতাম যে একদিন না একদিন তুমি রাজি হয়ে যাবে। তাই তো অ্যাদ্দিন ধরে বিছানার চাদর পাকিয়ে পাকিয়ে তোমার জন্য এইটা বানিয়ে রেখেছি (বিরাট একটা দড়ি টেনে বার করে)। ওদিকে বেচারা হাউজকিপারটায় চাকরি যায় যায়। ওর স্টক থেকেই চুরি করতাম তো।
অবনী—কিন্তু তুমি যে সেদিন বললে—
গোমেজ—আরে সেদিন গপ্পো আলাদা ছিল। তখন তুমি আশি পার্সেন্ট প্রেতাত্মা ছিলে, এখন পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। না বন্ধু ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই, আমি ধরে নিচ্ছি যে তুমি দেহধারী, সেইমতনই সব ব্যবস্থা হবে।
অবনী—কিন্তু ভাই গোমেজ আমি তো মানে কোনোদিন দড়ি বেয়ে জানলা দিয়ে নামিনি।
গোমেজ—আমি নেমেছি। অনেকবার। ভিয়েতনামে, সোমালিয়ায়। তোমার জন্য স্পেশাল দড়ির দোলনা তৈরি হবে, তুমি শুধু চোখ বুজে ঝুলে পড়বে, বাকি দায়িত্ব আমার।
অবনী—ভিয়েতনামে, সোমালিয়ায়। তুমি ঠিক কি ধরনের পাগল, একটু বলবে?
গোমেজ—ইউ এস স্পেশাল ফোর্সের পাগল। সেই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের হিপি ছেলেটা, যে সব জেনেও হঠাৎ একদিন দেশপ্রেমের ঝুটো গল্পটাতে বিশ্বাস করে বসেছিল। আমাদের মধ্যে অনেকেই পাগল হয়ে যায়, জানো। ওরা সব নিয়ে নেয় তো। কান, চোখ, মাথা, নার্ভ, মন, রাত্রের ঘুম, বিবেক, ভালোবাসা, শান্তি। শুধু অস্তিত্বটুকু নষ্ট করতে পারেনি, আর সেই অস্তিত্বের মধ্যে বিলকুল উদ্ভট এক বোধ এখনো বেঁচে আছে। সেইখান থেকে বলছি, তোমার কোন চিন্তা নেই বন্ধু, জীবন এখনও তোমাকে ত্যাগ করেনি।
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— কাদম্বিনী যে কেমন করিয়া রানীহাটে ফিরিয়া গেল, তাহা বলা কঠিন। সে যে কী ভাবিয়া শ্বশুরবাড়ি আসিয়াছিল জানি না, সে নিজেও জানে না, কেবল এইটুকু জানে যে একবার খোকাকে চক্ষে দেখিয়া যাইবার ইচ্ছা। তাহার পর কোথায় যাইবে, কী হইবে, সে কথা সে ভাবেও নাই।
দীপালোকে দেখিল, রুগ্ন শীর্ণ খোকা হাত মুঠা করিয়া ঘুমাইয়া আছে। দেখিয়া উত্তপ্ত হৃদয় যেন তৃষাতুর হইয়া উঠিল— তাহার সমস্ত বালাই লইয়া তাহাকে একবার বুকে চাপিয়া না ধরিলে কি বাঁচা যায়।
এমন সময় খোকা হঠাৎ পাশ ফিরিয়া অর্ধনিদ্রিত অবস্থায় বলিয়া উঠিল, “কাকিমা, জল দে।” আ মরিয়া যাই। সোনা আমার, তোর কাকিমাকে এখনও ভুলিস নাই। তাড়াতাড়ি কুঁজা হইতে জল গড়াইয়া লইয়া, খোকাকে বুকের উপর তুলিয়া কাদম্বিনী তাহাকে জল পান করাইল।
যতক্ষণ ঘুমের ঘোর ছিল, চিরাভ্যাসমতো কাকিমার হাত হইতে জল খাইতে খোকার কিছুই আশ্চর্য বোধ হইল না। সে আধোঘুমে কাকিমাকে জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকিমা, তুই মরে গিয়েছিলি?”
কাকিমা কহিল, “হাঁ, খোকা।”
“আবার তুই খোকার কাছে ফিরে এসেছিস? আর তুই মরে যাবি নে?”
ইহার উত্তর দিবার পূর্বেই একটা গোল বাধিল— ঝি এক-বাটি সাগু হাতে করিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল, হঠাৎ বাটি ফেলিয়া ‘মাগো’ বলিয়া আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেল।
চীৎকার শুনিয়া তাস ফেলিয়া গিন্নি ছুটিয়া আসিলেন, ঘরে ঢুকিতেই তিনি একেবারে কাঠের মতো হইয়া গেলেন, পলাইতেও পারিলেন না, মুখ দিয়া একটি কথাও সরিল না।
এই-সকল ব্যাপার দেখিয়া খোকারও মনে ভয়ের সঞ্চার হইয়া উঠিল— সে কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল, “কাকিমা, তুই যা।”
সূত্রধর ২— গভীর রাতে ওরা নিউইয়র্ক পৌঁছল। রাতটা এয়ারপোর্টেই কাটিয়ে দিয়ে সকালবেলায় সোজা নার্সিংহোম। শুভেন্দু ফোন করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। দেখা গেল বাড়িটার সামনে আধ ডজন পুলিশের গাড়ি আর প্রচুর গোলমাল। নিখিল প্যাটেল অথবা অবনীবাবুর ভূত রাত্তিরে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁর রুমমেট অ্যান্টনি গোমেজেরও পাত্তা নেই যে কিনা জটিল স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী এবং শোনা যায় মানুষ খুন অবধি করেছে। প্যাটেল পরিবারও মহা হাঙ্গামা বাঁধিয়েছে, তারা নাকি নার্সিংহোমের নামে মামলা করবে। এসবের মধ্যে অবনীবাবুর পরিবার এসে হাজির হবার ফলে বিশৃঙ্খলা একদম চরমে পৌঁছে গেল।
সারাদিন ওরা তন্নতন্ন করে এলাকাটা খুঁজে দেখেছে। অবনীবাবুর কোন চিহ্ন নেই। নার্সিং হোমের জানলা ভেতর থেকে খোলা যায় না, কেউ একজন সুকৌশলে নাটবল্টু আলাদা করে কাজটি করেছে। পুলিশ রিপোর্টে মিসিং পার্সন হিসাবে অ্যান্টনি গোমেজের সঙ্গে নিখিল প্যাটেলের নামই লেখা হয়েছে বটে কিন্তু এভিডেন্স লিস্টে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে মৌলীর হেফাজতে থাকা অবনীবাবুর টুথব্রাশটিও জমা হয়ে গেছে। হাসপাতালে তদন্ত করতে হাসপাতালে রওনা হয়ে গেছে পুলিশ, প্যাটেলরাও তাদের সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলায় ক্লান্ত আর পুরোপুরি বিভ্রান্ত অবস্থায় নিউ জার্সির বাড়িতে ফিরে গেছে মৈত্র পরিবার। পরের কয়েকটা দিন কিভাবে যে কাটল শুধু ওরাই জানে।
(আলো বদল)
দৃশ্য-৮
উষসী—হয়তো আমাদেরই ভুল। হেস্টি কাজ করে ফেলেছি।
শুভেন্দু—এ নিয়ে ভেবে এখন আর লাভ নেই উষি। কাকামণিকে বলে দিয়েছি কাগজপত্র যা সই করতে হবে, আমি করে দেব, বাড়ি নিয়ে ওরা যা চায় করুক। মা আপাতত আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
সবিতা—ওই বাড়িতে আমি বউ হয়ে এসেছিলাম। শ্বশুর-শাশুড়ি একে একে দেহ রাখলেন, তোরা এলি, তারপর একদিন তোরাও চলে গেলি। কত স্মৃতি।
মৌলী—ঠাম্মা, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে দাদুভাই আর ওর বন্ধু মিলে কোথাও লুকিয়ে আছে। দে আর হাইডিং। অ্যান্ড হ্যাভিং ফান। জাস্ট ওয়েট ফর আ ফিউ ডেজ।
উষসী—দেখতে পাচ্ছি তুই প্রথম থেকেই কনফিডেন্ট। কিন্তু অ্যাডাল্ট হিসাবে আমাদের হয়তো আরেকটু প্র্যাকটিক্যাল হওয়া উচিত ছিল।
(শুভেন্দুর ফোন বেজে ওঠে।)
শুভেন্দু—হ্যালো। ইয়েস মৈত্র স্পীকিং। হ্যালো অফিসার, এনি নিউজ। হোয়াট! (কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। বাকি তিনজন উত্তেজনায় পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে। শুভেন্দু ঢোকে, ওর মুখচোখ উত্তেজনায় থমথম করছে।)
শুভেন্দু—ওয়ান অফ দি মিসিং মেন ইজ মোস্ট লাইকলি অবনীভূষণ মৈত্র, নট নিখিলভাই প্যাটেল। ডি-এন-এ টেস্টের প্রিলিমিনারি রিপোর্ট তাই বলছে। খুঁজে পাওয়া গেলে কনফার্মেটরি টেস্ট হবে।
সবিতা—ও বেঁচে আছে! কিন্তু তাহলে বাড়ি ফিরে আসছে না কেন?
মৌলী—মে বি হি ইজ অ্যাফ্রেইড। যদি তোমরা ওকে ঘোস্ট ভেবে তাড়িয়ে দাও। বাট ডোন্ট ওরি হি উইল কাম ব্যাক। আই নো। গোয়িং টু বেড নাউ। (হাই তোলে) গুড নাইট।
শুভেন্দু—আমার মেয়েটা কি ক্লেয়ারভয়েন্ট নাকি?
উষসী—ও আর ওর দাদুর মধ্যে একটা কানেকশন আছে। একটা ভাইভ, যোগাযোগ, যেটাকে এক্সপ্লেইন করা মুশকিল। সে যাই হোক ওর অপটিমিজম কিন্তু খুবই ছোঁয়াচে। (হাসে) মা, আমারও মনে হচ্ছে বাবা ফিরে আসবে।
সবিতা—তোদের কথা সত্যি হোক, তোদের মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক। ঠাকুর তুমি ওকে ফিরিয়ে এনে দাও।
শুভেন্দু—কাল সকালে আমরা হসপিটাল অথরিটি, প্যাটেল ফ্যামিলি আর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সঙ্গে বসব। রাত্তির হয়েছে চলো আজ শুয়ে পড়া যাক।
সবিতা—চলো। (বেরিয়ে যায়। উষসী যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। দুজনে মুখোমুখি।)
উষসী—এই শোনো।
শুভেন্দু—আবার কি?
উষসী—আমিও না একটু ক্লেয়ারভয়েন্ট। আমার প্রিমোনিশন হয়।
শুভেন্দু—উষি! তুমি একটু পাগল আমি জানি, কিন্তু তাই বলে—
উষসী—তুমি আর মৌ—তোমাদের কিছু হলে আমি টের পাই। সত্যি বলছি।
শুভেন্দু (হেসে ফেলে)—তাই বুঝি? আচ্ছা বেশ, এখন শুতে চলো।
(দুজনে একটু কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, পরস্পরের হাত ধরে, তারপর বেরিয়ে যায়। স্টেজ আধো অন্ধকার, কয়েক মিনিট বাদে অ্যান্টনি গোমেজকে গুঁড়ি মেরে ঢুকতে দেখা যায়।)
গোমেজ—সবাই ওপরে ঘুমোচ্ছে। তুমি চুপচাপ এসে নিশ্চিন্তে এই সোফাটার ওপরে শুয়ে পড়ো। (অবনীবাবু ঢোকেন)
অবনী—গোমেজ, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? কাল সকালে আমাকে দেখে যদি ওরা ভয় পায়। তাছাড়া—
গোমেজ—তাছাড়া যদি তুমি সত্যি সত্যি ভূত হও? হা হা, দিস উইল বি আ হন্টেড হাউজ দেন। চিন্তা কোরো না তুমি ভূত হলে ওরা তোমাকে দেখতে পাবে না।
অবনী—তুমি কি করে জানলে হে? ভূত হয়েছিলে কোনোদিন? তাছাড়া আমি নাহয় বাড়ি পৌঁছে গেছি, তুমি কোথায় যাবে শুনি।
গোমেজ—দেখলে তো আমার আস্তানা। কটা দিন কেমন মজায় কাটল বলো দেখি? ভাবছি, ছাড়া পাগল হয়েই আরো কিছুদিন কাটাব। তারপর অসুখ বাড়লে আবার হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে। রোজগারপাতির চিন্তা নেই, দেখছ তো চুরিবিদ্যায় আমি ওস্তাদ, এইসব দরজা, জানলা, সিকিওরিটি সিস্টেম, আমার কাছে সব ছেলেখেলা।
অবনী—গোমেজ, তোমার মতন বন্ধু আমি কোনোদিন পাব বলে ভাবিনি। প্লীজ কয়েকদিন থেকে যাও, আমার ফ্যামিলির সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হোক।
গোমেজ—সেটি হচ্ছে না বাপু। তারপর যদি সত্যিই দেখা যায় যে তুমি সত্যিই এমন ভূত যাকে মানুষেরা দেখতে পায় তখন সবাই আমাকেই দুষবে। তাছাড়া আমি সবসময় এক রকম থাকি না। মাঝে মাঝে সব গণ্ডগোল হয়ে যায়। আমি এভাবেই আছি, কখনো ছায়া, কখনও কায়া, একই শরীরে ঈশ্বর আর শয়তানের বাস। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি, এবার তুমি বোঝো। আদিওস আমিগো।
(গোমেজ বেরিয়ে যায়। অবনীবাবু হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। স্টেজের অন্যদিক থেকে মৌলী উঁকি মারে।)
মৌলী—দাদুভাই!
অবনী (প্রচণ্ড ঘাবড়ে যায়)—মউ, তুই ঘুমোসনি। রাত একটা বাজে।
মৌলী (কাছে এসে দাদুকে জড়িয়ে ধরে)—আই হ্যাড আ ড্রিম যে তুমি ফিরে এসেছ। ঘুম ভেঙে গেল, বিছানা থেকে উঠে পড়লাম জানলা দিয়ে দেখি কি, কে একটা লোক গ্যারেজের দরজাটা খুলছে! আই ওয়াজ গোয়িং টু স্ক্রীম বাট দেন আই স ইউ ওয়াকিং ইন।
অবনী—কি করে বুঝলি ওটা আমি। চোর ডাকাত নয় কিংবা আরো খারাপ কিছু। (বিড়বিড় করে) মানে ওই ভূত আর কি—
মৌলী—আই জাস্ট নিউ, ইট ইজ ইউ।
(দরজা খুলে শুভেন্দু ঢোকে, ওর হাতে একটা বেসবল ব্যাট)
শুভেন্দু—কে ওখানে? (হাত থেকে ব্যাটটা পড়ে যায়) বাবা! মৌ!
(সবিতা আর উষসী দৌড়ে ঢোকেন। অবনী মৌলিকে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে যান)
অবনী—তোমরা বিশ্বাস করো আমি মরে যাইনি। আমি ভূত নই, নিখিল প্যাটেলও নই। হাসপাতালের ভুল।
উষসী (কান্না মেশানো গলায়)—আমরা জানি বাবা।
(সবাই দৌড়ে গিয়ে অবনীবাবুকে জড়িয়ে ধরে)
সবিতা—ওগো, তোমাকে ওরা কি করেছিল, কোথায় আটকে রেখেছিল এতদিন? খেতে পাওনি তো, শুকিয়ে যে অর্ধেক হয়ে গেছ।
অবনী—সে অনেক অনেক গল্প, আস্তে আস্তে বলব। এখন দেখো আমি বেঁচে আছি। আঃ বেঁচে থাকার কি যে আনন্দ। মউ সোনা, তুইই আমাকে বাঁচিয়েছিস।
(আলো বদল)
সূত্রধর ১— কাদম্বিনী অনেক দিন পরে আজ অনুভব করিয়াছে যে, সে মরে নাই। সে ব্যাকুলভাবে কহিল, “দিদি, তোমরা আমাকে দেখিয়া কেন ভয় পাইতেছ। এই দেখো, আমি তোমাদের সেই তেমনি আছি।”
গিন্নি আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না, মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন। শারদাশংকরবাবু স্বয়ং অন্তঃপুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তিনি জোড়হস্তে কাদম্বিনীকে কহিলেন, “ছোটোবউমা, এই কি তোমার উচিত হয়। সতীশ আমার বংশের একমাত্র ছেলে, উহার প্রতি তুমি কেন দৃষ্টি দিতেছ। আমরা কি তোমার পর। তুমি যাওয়ার পর হইতে ও প্রতিদিন শুকাইয়া যাইতেছে, উহার ব্যামো আর ছাড়ে না, দিনরাত কেবল ‘কাকিমা’ ‘কাকিমা’ করে। যখন সংসার হইতে বিদায় লইয়াছ তখন এ মায়াবন্ধন ছিঁড়িয়া যাও— আমরা তোমার যথোচিত সৎকার করিব।”
তখন কাদম্বিনী “ওগো, আমি মরি নাই গো, মরি নাই গো, মরি নাই—” বলিয়া চীৎকার করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া, সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর জলের মধ্যে গিয়া পড়িল। শারদাশংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস্ করিয়া একটা শব্দ হইল।
সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল; তাহার পরদিন সকালেও বৃষ্টি পড়িতেছে, মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।
সূত্রধর ২—সময় এগিয়েছে তাই অবনীবাবু জ্যান্ত অবস্থাতেই প্রমাণ করতে পারলেন যে তিনি মরেননি। হাসপাতাল থেকে মোটা ক্ষতিপূরণ পেলেন, ওদিকে প্যাটেল পরিবারের সমস্যাও মিটে গেল। অবনীবাবুর কলকাতার বাড়িটা মেরামত আর রং করা হয়েছে। এই নিয়ে বিকাশ-অঞ্জনার সঙ্গে এখনও কিছু চাপান-উতোর চলছে কিন্তু ঝামেলা বুঝে ক্ষেত্রীজি কেটে পড়েছেন। অ্যান্টনি গোমেজ কোথায় গেছে কেউ জানে না। এখনও গভীর রাত্রে মাঝে মাঝে ওঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি এক অদ্ভুত ছায়ারোদ্দুরে ভরা সরাইখানায় দেখা হয় দুই বন্ধুর। হয়তো স্বপ্নেই হবে।
(যবনিকা)