দক্ষিণ দিকের দাওয়াটা এখনো অক্ষত আছে। গোটা কয়েক ঠ্যাকনা আর বাতার বাঁশ-সহ খড়কুটো নিয়ে মা জাহ্নবীর বুকের ওপর ঝুলে আছে চাঁদমালাদের শেষ আশ্রয়টুকু! একখানা হাতকোদাল নিয়ে উদ্ভ্রান্ত ইঁদুরের মতো সকাল-সন্ধ্যা ভিটের মাটি সরাচ্ছে দুলাল! এই মাটিটুকুই ওর একমাত্র পৈতৃক সম্পত্তি। খুব জোরে হাত চালায় দুলাল। মাটি টানতে টানতে হাঁপিয়ে ওঠে সে। কিন্তু কোথায় নেবে এত মাটি? জানে না দুলাল। দুদণ্ড জিরেন দিতে গেলেই সর্বনাশীর স্রোত চাং চাং মাটি চেটে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে! অর্থাৎ থামলে চলবে না। চাঁদমালা ময়লা কাপড়-চোপড়ের পুঁটলিটা বুকে জড়িয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে! চাঁদমালার বয়েস দুলালের থেকে প্রায় ছ-সাত বছরের ফারাক। তার ওপর ওর শরীরটা পানার ডাঁটার মতো পলকা। আজকাল দুঃখ পেলে কাঁদতেও পারে না। পাছে কাশি পায়, এই ভয়ে সবসময় দাঁতে দাঁত চেপে সংসারের সমস্ত রকম নিয়ম-অনিয়মগুলো ভাবতে চেষ্টা করে। কোদালের কোপ দিয়ে ভিটের মাটি ঝুরুঝুরু করে ফেলেছে দুলাল। বড় ঢেলাগুলো আছাড়ের উলটো পিঠ দিয়ে বাড়ি মেরে দেখে নেয় আদৌ ওর নিচে আর কিছু আছে কিনা। আজ সকালে উত্তরদিকের বারান্দায় বেশ কয়েকটা পেতলের বাটি আর কাঁসার গ্লাস পেয়েছে ওরা। বাটনাবাটা নোড়াও উঠেছে দুটো।
--“হ্যাদে দেখ প্রায় চার যুগ পরে অবশেষে আমি আমার পাঁটার নুড়াটা পেলাম!”
চাঁদমালা অবাক হয়, “এটা তোমার পিসি? তা আমাদের ভিটের তলায় চাপা পড়ল কী করে?”
একরাশ অবজ্ঞা উগরে দিল কেষ্টর পিসি, “কে আবার! তোর শাশুড়ি, নলিনীর কাজ!”
--“আমার শাশুড়ি তোমার নুড়া চুরি করতে যাবে কেন?”
--“শুধু নুড়া না বাপু! ওই যে বাটি-গিলাস উঠিয়েছ, তেঁতুল ঘষে দেখো, কাদের কাদের নাম লিখা আছে!”
চাঁদমালা কেন্নোর মতো গুটিয়ে আসে, “এতবড় সংসারখানা গঙ্গায় ডুবে যেতে বসেছে। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হয়ত সীমানার চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না। আর শেষে কিনা...!”
দুলাল লজ্জা পেল না। সে নিজের মনেই মাটি কোপাতে লাগল।
কেষ্টর পিসি ছানিপড়া চোখের ঘোলা মুছে অনেক গল্প করল, “নলিনীকে চোর বদনাম কোন দুঃখে দিতে যাব বউমা? ও তো গ্রামের মঙ্গলের জন্যেই এসব করত! যেদি আকাশে খুব মেঘের আনাগুনা দেখত, কিম্বা দেবতার খবর খারাপ শুনত অমনি এর-ওর ঘর থেকে বাটি গেলাস নুড়া নুকিয়ে এনে পুঁতে ফেলত! মেঘ মুছে রোদ্দুর বেরোত, মানুষের যেমন ঘরদোর তেমনি অক্ষত থাকত। সাত মহল্লার জল টেনে এনে গঙ্গাও খুব বেশি বাড়াবাড়ি করতে পারত না!”
--“বাটি পুঁতে ফেললে মেঘ সরে যেত? বৃষ্টি ধরে যেত? সত্যি?”
--“জানিস ওর কত হাতযশ ছিল? ও থাকতে পাড়ার শ্রাদ্ধ বলো আর অন্নপ্রাশনই বলো কোনও অনুষ্ঠান কাজ্জিতে বিঘ্ন ঘটেনি! এমনকি ঘোর বর্ষা-বাদলার দিনেও মেঘের গায়ে একফোঁটা ঘাম জমত না! পুঁতত বটে! কিন্তু পরক্ষণে আবার তুলেও দিত। কিন্তু যেবার তোর ছোট দেওরের কাটিঘা হল, সেই শোকে ওর মাথাডা এলোমেলো হয়ে গেল, আর মনে করতে পারত না কনে কোনডা পুঁতেছে! শেষ বয়েসে মানুষের মঙ্গল করতে গিয়ে অনেক নাথিঝ্যাঁটা খেয়েছে না!”
মায়ের কথা শুনতে শুনতে ষাঁড়াষাঁড়ি বানের শব্দ শুনতে পেল দুলাল। সে ঘরের মাঝ খুঁটিটি মুঠোর মধ্যে ধরে সেইদিকে চুপচাপ চেয়ে রইল।
শান্তিপুর থেকে আরও সাত মাইল উজানে সাতকালীতলা। এইখানে সকল প্রকার বাণিজ্যবিমুখ শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে সাতপুরুষ ধরে বসবাস করে আসছে এরা। পিসিমা সেইসব প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে একজন! দুলালের ইচ্ছে করছিল কোদালের উলটো পিঠ দিয়ে পাতালকোঁড় কুড়োনো পিসির মুণ্ডুটা থেঁতো করে দিতে! কিন্তু না! ওঁর শুকনো চোখের কোটরে ওই যে এক বিন্দু অশ্রু লুকোনো আছে, ওখানে ওর মাও কথায় কথায় টাল খায়, ভেসে ওঠে!
মনমরা দুলালের বুকে পিসি হঠাৎ হঠাৎ হুতোস জাগিয়ে তোলে, “ওই যো, ওই এক চাং খসে গেল!”
সত্যি সত্যি স্রোত মাটি টানছে। পায়ের তলায় শিরশিরানি অনুভব করে চাঁদমালা। সে সরে দাঁড়ায়।
কেষ্টর পিসি তাগাদা দেয় খুব, “আর দুদিন আগের থেকে শুরু করতিস! ক্ষতির পরিমাণ তাহলে আর এতটা হত না!”
আলগা মাটিতে কোঁচড় ভর্তি করে পাতালকোঁড় কুড়োচ্ছে পিসি। মাঝে একবার ঠং করে আওয়াজ হল। কিন্তু সেদিকে আর ভ্রূক্ষেপ করল না পিসি। কেননা সে এখন অন্য তালে আছে। এই মৌজার কাগজ নাকি দুলাল নিজে আটকে রেখেছে! সরকারের অনুদান এলে একা খাবে দুলাল, সে কখনো হতে পারে না! পিসি অপেক্ষায় আছে চালচুলো যেদিন খসে পড়বে, সেদিন আতাবাতা উটকে ঠিক নথিটা নিজের কাছে নিয়ে নেবে!
সে অপলক নেত্রে জাহ্নবীর জলধারার দিকে চেয়ে রইল। কতকাল হল সে প্রাণভরে সাঁতার কাটেনি! কেননা এটাতেই তার রুটিরুজি। সারাবছর ধরে নদীবক্ষের আবর্জনা কুড়িয়ে ডাঙায় ডাঁই করে রাখে দুলাল। তারপর একসাথে পাইকারি দরে বিক্রি করে সে। চাঁদমালাকে নিয়ে সংসার পাতার পর থেকেই এভাবেই একপ্রকার সংসার চলে দুলালের। সমাজের কুৎসা আর কামটের ভয়কে উপেক্ষা করে যেসব আবর্জনা সে তুলে আনে তার মধ্যে অন্যতম ভাসানের প্রতিমা। আধপচা কাঠামোর কাঠ-বাঁশ বেচে কতই বা উপার্জন হয়! তবু নদীকে ভালোবেসে দুলাল একটি দিনের জন্যেও তার জল-সূচি বন্ধ রাখেনি! কিন্তু এখন? অনভ্যাসে হাতের পাখরো দুটোয় মাঝে মাঝে খিঁচ ধরে দুলালের। মহামারী তখনও আসেনি। শুধু প্রতিমার কাঠ-বাঁশ নয়, গঙ্গার বুক থেকে আপন গরজে কত কিছুই উঠিয়ে এনেছে সে। শিক্ষিত সচেতন মানুষের প্রশংসা ছাড়াও দুটো-একটা অতিতুচ্ছ পুরস্কারও পেয়েছে দুলাল! কিন্তু এখন? জলের সাথে একপ্রকার আড়াআড়ি বিচ্ছেদ হয়ে গেছে দুলালের! কেননা সবাই বলে, “দুলালের সাংঘাতিক লোভ! সকাল হতে-না-হতেই ও এখন মড়া তুলতে যায়!”
দুলালকে আনমনা থাকতে দেখে পিসি জিজ্ঞেস করে, বক্সিদের ঘরখানা তোর মনে আছে?”
--“কী বলো! মনে থাকবে না? বেশ মনে আছে আমাদের পাঁচটা বাড়ির পরে সাতকালীর থান। দক্ষিণে সোনাকাকার মুদি-দোকান, তারপরে বক্সিদের বাড়ি! ওদের দুয়োরে কাশীপুরের কাঁঠালের ফ্রেম ছিল। আমাদের দোরে ছিল নৌকোর গুঁড়ো। ওদের নম্বর ছিল গ’ ৫৮০। আমাদের ছ’ ৭৯৪। ভাঙন শুরু হতেই প্রথমে সোনাকাকার দোকানটা গেল। তারপর ৩৩০ ক’ পরের সপ্তাহেই ঙ’ ১১১, চ’ ৪২৪ সব সব...!”
--“কনে কোনডা ভেসে গেল! আচ্ছা তোর বেলার কথা মনে আছে?”
--“কে অনিলকাকার মেয়ে?”
--“তা নয় তো কে? ছুড়িটা বেঁচে থাকলে এদ্দিন সাতটা ছেলের মা হতো! আচ্ছা সত্যি করে বল দিকিনি, তুই কি ওকে সাঁতার শেখাচ্ছিলি?”
নীচের জল ওপরে উঠে আসলে নদীর বুক যেমন ঘোলা হয়, ঠিক তেমনিভাবে দুলালের এপার-ওপার সবকিছু আবছা হয়ে এল! দুলালের এখনো বেশ মনে আছে অনেক বড় মুখ করে বেলাকে তার কাছে সাঁতার শিখতে পাঠিয়েছিল অনিলকাকার বউ। দুদিন পাড় ছুঁয়ে, ভাসন্ত কাঠামোয় বুক বাধিয়ে বেশ সাঁতরেছিল বেলা! কিন্তু বিধির বিপাক! সেদিন সম্ভবত দুর্গাভাসান। একটা বড়মাপের প্রতিমার খাঁচা দেখে হাত নিশপিশ করে ওঠে দুলালের। মুহূর্তে দুলালের হাত ফসকে বেলা চলে যায় অনেক দূরে! চেষ্টা করেও বেলা আর কূলে ফিরতে পারে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অব্দি ফলুই মাছের মতো ছুটেও বেলাকে পেল না দুলাল! অবশেষে সে যখন খবরটা বাড়িতে দিল, অমনি অনিলকাকা আর ক্লাবের লোকজন লাঠিপেটা করে দুলালকে গঙ্গায় ঠেলে ফেলল! আর বলল, “যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েকে তুলে না আনবি, ডাঙায় উঠবি না!” একটানা দুদিন দুরাত জলের সাথে থাকতে থাকতে দুলালের শরীরে যখন হাজা লাগার উপক্রম হয়েছিল, সেদিন নলিনীর কান্নাকাটিতে অনিলকে একটুখানি নরম হতে দেখা গিয়েছিল!
সূর্য মাথার ওপর থেকে গড়িয়ে নামে। কোঁড়গুলো কুঁচিয়ে ধুয়েপাকলে ঘরে নেবে পিসি। কিন্তু জলে একপা দিয়েও সড়াৎ করে সরে আসে পিসি।
চাঁদমালা চালার নিচ থেকে উঁকি মারে, “কী গো, উঠে এলে যে? কামট?”
--“না!”
--“তা’লে?”
--“ও তুই বুঝবিনে!” কিছুক্ষণ থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে পিসি। তারপর পাতালকোঁড়গুলো আঁচল থেকে ঢেলে দিয়ে বলল, “এই নে, আজ তুরা খাসকেনে। এতখানি ভুল করে ফেললাম?”
আগ্রহ নিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে আসে চাঁদমালা, “কী ভুল পিসিমা?”
দুলাল গাঁয়ের নোনা মুছতে মুছতে বলে ওঠে, “মড়ার পা ধরে টেনেছ নিশ্চই?”
পিসিমা এবার কেঁদেই ফেলল, “মোটে নঙ্গ করবিনে বলে দিচ্চি! নদীটাকে দিনকে দিন নরক বানিয়ে তুলল গো! কই কোনও মিনসে তো কিছুই বলে না!”
এবার দুলাল ঝাঁঝিয়ে উঠল, “তুমি তো দেখছি মিডিয়ার আরেক কাঠি ওপর দিয়ে যাচ্ছো পিসিমা! মড়াধড়া যেসব ফেলা হচ্ছে বলে খবর, ওসব তো হয় বিহারের নিউজ, নয় উত্তর প্রদেশের! এতটা ম্যানিয়া মোটেই ভালো না!”
পিসি আঁচল ঝেড়ে উঠে গেল। উষ্টে পাতালকোঁড়গুলো এখন পাতায় রাখা প্রসাদের মতো একটা একটা করে ভেসে যাচ্ছে!
চাঁদমালার বাড়িটা এখন রীতিমত ঝুলন্ত উদ্যান! অনেকেই আসে হাওয়া খেতে। তবে এদের মধ্যে অধিকাংশই সাতকালীতলার পুরোনো বাসিন্দা। কেউ আসে নদীটা গড়ছে কিনা দেখতে, কেউ-বা পুরোনো কাঁসা-পেতল উত্তোলনের খবর পেয়ে ছুটেছে, কেউ আসে দুলালের ভিটেটুকু গঙ্গাবক্ষে বিলীন হবার মুহূর্তকে মোবাইলবন্দী করার জন্যে!
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। আজ উঠোনে প্রদীপ দিয়েছে চাঁদমালা। উঠোন বলতে ওই আর কী! দুদিন আগে উত্তরপোতার মেঝের তলা থেকে যেসব জিনিসপত্তর উঠেছিল, ওগুলো তেঁতুল দিয়ে ভালো করে মেজেধুয়ে প্রদীপের আলোয় দিয়ে রেখেছে চাঁদমালা। যাতে নতুন কোনও দাবীদার এলে তাকে আর ন্যাকড়াচোকড়ার পুঁটলি হাতড়াতে না হয়! কিন্তু আজকাল গ্লাস বাটির কাছে কেউই আসছে না। সবারই নজর ভাঙন কদ্দুর এগোল!
আজ কেষ্ট এল। সাথে সনাতন। চাঁদমালা একটা উলের আসন চেলে দিল।
--“কী গো, দুলাল গেল কনে?”
--“কী জানি কদ্দুর ভেসে গেল বলি কী করে বলো দিকিনি!”
--“ডাকো দরকারি কথা আছে!”
চাঁদমালা ভয় পেয়ে গেল। সে ভাবল কী জানি কী না কী করে বসেছে! সে মিহি করে জানতে চাইল, “কেন গো ঠাকুরপো? উঠে যাবার জন্যি চাপ দেচ্ছে বুঝি?”
--“কিছুটা চাপ আছেই। আমি বলতে এসেছি অন্য কথা। কাল দিল্লি থেকে একটা দল আসবে। মাপজোক হবে। তোমাদের বাড়ির নিচ দিয়ে গার্ডওয়াল হবে। ওদের কাগজপত্তরে কদ্দুর কী আছে আমি জানিনে। এই মৌজার আসল নকশা নাকি দুলালের কাছে আছে! ওকে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে, মনের ভুলেও যেন অনিলকাকার হাতে না দেয়! উনার হাতে একবার যদি রশি চলে যায়, ও রাতারাতি চাঁদে জমি কিনে আমাদের মাথায় পা দিতে চাইবে! দুনিয়ায় এত মানুষ মরছে, ওদের মরণ নেই! রীতিমত রাবণের পুরী! সব শরিকের টাকা ও একাই খেয়ে মোটা হবে!”
--“অনিলকাকা গ্রামের হত্তাকত্তা! উনি তদবির না করলে একটা টাকাও নাকি ছ্যাংশান হবে না শুনছি?”
--“না হোক! আমি এটাই চাইছি!”
সনাতন শনশন করে উঠল, “এ ভাঙন অনেক দূর অব্দি নিয়ে যেতে হবে! দুলাল কনে গেল সেটা তো আগে বলো!”
গঙ্গায় ভরা জোয়ার। সেইসাথে জলধোয়া আকাশ আর পূর্ণ চাঁদের সহাবস্থানে নদীর দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। নখের আগা দিয়ে পাড়ের মাটি খুঁচিয়ে একবার ডাকল। কিন্তু সে ডাক বেশিদূর প্রতিধ্বনিত হল না।
সনাতন সহাস্যে বলল, “পুজোপাজা তো একপ্রকার বন্ধই। এত রাত অব্দি জলে ডুবে ডুবে কী ধরতে যায় দুলাল? মিডিয়ায় যেসব দেখছি ওই ধান্দায় নয় তো?”
চাঁদমালা চমকে উঠল, “মিডিয়ায় কী দেখাচ্ছে ঠাকুরপো?”
কেষ্টর মাথা অল্পতে গরম হয়ে ওঠে। সে সনাতনকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “যে ল্যাওড়া দেখায় দেখাক! ওতে আমার ইনটারেস্ট নেই! মাল কি উঠেছে কিছু?”
চাঁদমালার চোখ চিকচিক করে উঠল! কতদিন হল দুর্গার পিঁড়ি সে ছোঁয়নি! মনে মনে ভাবল মানুষ তো আগে বাঁচুক তারপরে তো পুজো!
--“কী গো, চুপ করে আছো যে! অন্য ঘাটে উঠোচ্ছে নিশ্চই?”
চাঁদমালা কথা ঘুরিয়ে বলল, “না। এখন এসব একটাও আসছে না। যা দুয়েকটা আসছে তাও সব পচা পল-বিচুলি। কাঠ বাঁশ তাতে নেই বললেই চলে!”
--“ধ্যানাচি রাখো! গেল হপ্তায় এখানে আট গাড়ি আধলা ফেলা হয়েছে শুনেছি। এই কদিনে এত ইট কোথায় গেল শুনি? এইবার বুঝলি তো সনাতন এরা কেন এখনও উঠছে না?”
দুলালের সংসারে এসে অনেক সয়েছে চাঁদমালা! শেষে কিনা ললাটে এটাও লেখা ছিল? লজ্জায় অপমানে গায়ে আগুন দিতে ইচ্ছে হল চাঁদমালার! সে পাথরের পুতুল হয়ে বাতার বাঁশ ধরে ঝুল খেতে লাগল! আর ঠিক এইসময় গঙ্গার ওপার থেকে কোনও এক শহরবাসীর শৌখিন পূজার শঙ্খধ্বনি ভেসে আসতে লাগল! ঠিক যেন চাঁদমালার সর্বস্ব হারানো হাহাকারের মতো!
কেষ্ট উঠে যেতেই সনাতন সাহস করে ঝাঁপ দিল। এবার সে চিৎ হয়ে মুখের জল পিচকারি করে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “চাঁদ, দেখো তো, এইভাবে...?”
এবার চাঁদমালা খিলখিল করে হেসে উঠল। আর ওর হাসিতে জ্যোস্নার তরঙ্গগুলো আরও কুচিকুচি হয়ে ঢেউয়ের মুখে ছিটিয়ে পড়ল!
এখন অনেক রাত। চাঁদমালার হাতখানি বুকের ওপর জড়িয়ে রেখেছে দুলাল! চারিদিকে জল আর জল। একটু ভাবতে গেলেই মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে ওঠে চাঁদমালার! চোখের পাতা মোটে এক হতে চায় না! একসময় উঠে বসল সে।
-“কী গো, আমরা এখনো উঠে যাচ্ছি না কেন?”
আরও একটু আবিষ্ট হবার ভান করে দুলাল, “মনে করো কালই উঠে গেলাম। এবার ভাবো, এতো অপূর্ব হাওয়া-খেলা ঘর আর কোথাও পাবি?”
চাঁদমালা ঝনঝন করে উঠল, “এমন সব্বোনেশে হাউসবোট আমার দরকার নেই!”
--“বাহ দারুণ কথা বললি তো চাঁদ! হাউসবোট! হাউসবোট! আমাদের নৌকোবাড়ি! আচ্ছা আমাদের বে হল কত বছর? মনে আছে?”
--“কাগজখানা কোথায় রেখেছ শুনি?”
চাঁদমালার বুকের ওপর লাফিয়ে ওঠে দুলাল, “কোন কাগজ চাঁদ?”
--“পোঁতা ভাঙার দিন পিসিমাও কিন্তু ওই তালেই ছিল! এই মৌজার আসল নকশা...!”
দুলাল অস্থির হয়ে চাঁদমালার কণ্ঠীর কাছটায় দাড়ি ঘষতে ঘষতে বলতে থাকল, “আসল নকশা? এই এইখান থেকে এক্কেবারে...!”
চাঁদমালা হিসহিস করে ওঠে, “আঃ আস্তে! দেখেছ চৌকির পায়াটা কতখানি পুঁতে গেছে?”
--“আর একটুখানি থির থাক, তোকে দারুণ একটা কথা বলব!”
--“আর বলতে হবে না! সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি গঙ্গার বুকে চিৎ হয়ে ভেসে থেকে কত টাকা কামালে শুনি?”
--“ধুর কী যে বলিস!”
--“ওই একটা ফুটেজ ওঁরা কত টাকায় বেচবে জানো?”
এবার দুলাল চাঁদমালাকে বিছানার ওপর জোর করে বসিয়ে চিবুক ছুঁয়ে বলে উঠল, “সত্যি আমি যদি মড়া সেজে ভেসে যাই?”
চাঁদমালা দুলালের মুখে চাপা দিয়ে বলে উঠল, “তার আগে ওই কাঁসা পেতলগুলো পিটিয়ে একটা ডাবুর করে আনো!”
--“কী করবি?”
--“ওতে বালি ভর্তি করে জল তুলতে যাব!”
দুলাল চাঁদমালাকে বুকে জড়িয়ে ধরল! এখন আর মাটি ভাঙছে না, শুধুমাত্র পাড়ের গায় জলের বাড়ি খাওয়া শব্দ উত্থিত হছে ছলাৎ ছলাৎ!
পরদিন বিকালে বিডিও এলেন। কেষ্টর পিসি নিজে থেকেই হাঁকাহাঁকি শুরু করল, “হ্যাদে ও বউ, কাগজপত্তর কনে কোনডা আছে গুছিয়ে রাখো!”
সাতকালীতলা বাঁকে জলের টান সাংঘাতিক। এই অংশে গঙ্গার স্রোত কুমিরের দাঁতের মতো ধারালো! গত দশ বছরে এই অঞ্চলে অন্তত একশো বার পরিদর্শনে এসেছেন কেন্দ্র-রাজ্যের ছোটবড় অনেক আধিকারিক! কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সবাই সরে গেছে। সরে যেতে বাধ্য হয়েছে! একমাত্র হলুদ সতর্কতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুলালের অবাধ্য ঘরখানা! আজ এই চকের অনেককে নিয়ে বিডিও সাহেব অনেকটা ঘুরলেন, ছবি তুললেন, খাতা লিখলেন, লাইন টানলেন, সিগারেট খেলেন! এতদিন যারা ঘরদোর হারিয়ে খালপাড়ে লাইনধারে কাটাচ্ছিল, খবর পেয়ে তারাও ছুটে এল। কিন্তু কারও কথা উত্থাপন করার আগেই অনিলকাকা আগ বাড়িয়ে বলতে লাগলেন, “উরা উদ্বাস্তু, এদেশের কেউ না!”
সবাই হইচই করে উঠল, “এ আবার কেমন কথা?”
অনিলকাকা জনরোষকে আরও খানিকটা উসকে দিয়ে বললেন, “আগে ওই আপদটাকে তো উঠতে বল!”
অর্থাৎ কে ঘর পাবে, কে পাবে না, সাতকালীর পাড় বরাবর পাকা কংক্রিটের ঢালাই হবে, নাকি বল্লি পুঁতে তাতে তারের খাঁচা বেঁধে আবারও আধলা ইট ফেলা হবে, কিছুই স্থির হল না!
সূর্য ডুবু ডুবু, ঠিক এইসময় দাওয়ার বাকি অংশটুকু বিডিও সাহেবের সামনেই ধসে গেল। গ্রামের লোক ময়লা কাপড়ে চোখ মুছে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “এইবার একটা পাকাপাকি গার্ডওয়ালের ব্যবস্থা করেন সার! দরকার হলে আমরা সেন্টালেও ছবি পাঠাব, এখানে বাধা দেবার মতো আর তেমন কিছুই নেই!”
চাঁদমালা কোলের পুঁটলিটা টান মেরে ফেলে দিয়ে কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠল।
--“হা ভগমান! কাগজখানা ফেলে দিলি?” খ্যানখ্যান করে উঠল কেষ্টর পিসিমা!
অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল, “কই কই?”
--“ওই তো ওই তো খড়খুটোর সাথে পাক খাচ্ছে!”
কে একজন অন্ধকারে হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিল, “ওরে, এট্টু তেল আন দিকিনি! চাঁদের মাথা মনে হচ্ছে এলোমেলো হয়ে গেছে! ওর বুদ্ধি হরে গেছে! ওরে দুলাল কনে দুলাল?”
দুলাল এসব কথায় একটাও উত্তর দিল না। সে ঝপ করে ঝাঁপ দিল।
--“ও মাগো! কেন করলে এমন কাজ!” কন্ঠী বেয়ে কান্না ঠেলে উঠতে গিয়েও মাড়ি এঁটে এল চাঁদমালার!
--“কী সর্বনাশ! খোঁজ! খোঁজ!”
কিন্তু কে খুঁজবে? বিডিও সাহেব দূরাভাষে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। মুহূর্মুহূ রিপোর্টিং করতে লাগলেন, “সকলের এখন জলে ভয় স্যার, জলে আতঙ্ক স্যার! বিশেষত গঙ্গায় অরুচি স্যার! কাকে নামায় বলুন তো স্যার?”
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দু-একজন দুলালের জন্যে অনুশোচনা করতে লাগল! কেউ কেউ ভগবানের কাছে মানত করল কাগজখানা যেন কিছুতেই তলিয়ে না যায়! অবশেষে বিডিও সাহেবের তৎপরতায় একখানা বড়সড় নৌকো ম্যানেজ করা গেল। সনাতন সাথে করে এনেছে একজন ছোকরাকে। সে নাকি মিডিয়ার লোক। প্রায় দুশো লোক একটা হ্যাচাগের জন্যে হয়রান হয়ে ঘুরছে! এমনসময় শুশুকের মতো জল ছুড়তে ছুড়তে উঠে এল দুলাল। সাথে অনেকগুলো খড়বিচালি, টুকরোটাকরা কাঠ টিন ইত্যাদি।
--“কাগজখানা পেলি?” ভাঙনের মুখে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কেষ্টর পিসি।
দুলাল কথা বলার অবস্থায় নেই। সে হাঁপাতে হাঁপাতে টেনে আনা কাঠকুটোগুলো পাড়ে চেলে চেলে ফেলতে লাগল।
পিসি চাঁদমালার চোখেমুখে আচ্ছা করে জলের ছিটে দিল! হ্যাঁ, হুঁশ ফিরেছে! সে শোক ডুবিয়ে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল, “ভিটের মাটি তো নেই এট্টুও নেই! কী হবে এগুনু?”
দুলাল চেয়ে চেয়ে দেখল সমগ্র সাতকালীতলার বুকের ওপর ফ্যানা আর ফ্যানা! এতদিনকার সভ্যতার আর একটুও অবশিষ্ট নেই! এবার সে দূর আকাশের তারা খুঁজবার ভান করে বলে উঠল, “রোদ উঠলে শুকিয়ে এগুলোয় আগুন দিস! এতটা বালাই ওঁর বুকে নাই-বা চাপালাম!”