• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৩ | জুলাই ২০২১ | গল্প
    Share
  • মামণি : সুস্মিতা ঘোষ


    “উফ্ দম বন্ধ হয়ে গেল, কতদিন বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি,” আপন মনে ভাবতে ভাবতেই ঈশানীর মনে পড়ল, শেষবার সে বেরিয়েছিল প্রায় দেড় বছর আগে। শহরতলির কলেজের একজন অধ্যাপিকা হিসেবে সে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিল ইংরেজি বিভাগের সেমিনারে যোগ দিতে, বরাবরের মতোই উঠেছিল মামণির কাছে। হঠাৎ মনে হলো, “তাই তো! অনেকদিন ফোন করে মামণির কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। লকডাউন হওয়া পর্যন্ত এর-ওর কাছ থেকে প্রায় সব খবরই পেয়েছে বটে, কিন্তু তারও তো অনেকদিন হলো। লকডাউনের এতদিন পরে কেমন আছেন, কী করছেন কে জানে? কলেজ-ইউনিভার্সিটিও তো সব বন্ধ, বয়স্ক মানুষ… একাই আছেন কি?”

    শেষ ফোনটিও তো করেছিল তখনই, ঘর খালি আছে কিনা জানতে। মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেল দেড় বছর আগের সেই দিনটিতে। মনে পড়ল সে জিজ্ঞাসা করেছিল, “মামণি! দোতলার ব্যালকনি লাগোয়া ঘরটা পাওয়া যাবে? আগামী বুধবার আমার সেমিনার আছে, মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যে আমি শিলিগুড়িতে পৌঁছে যাব।”

    “ওই ঘরে তো এখন দু’জন বি.এ. ক্লাসের ছাত্রী আছে। ঠিক আছে তুমি এসো, কোনো-না-কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবে,” সেই চির-আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন মামণি।

    কণ্ঠস্বরের ব্যস্ততাই বলে দিচ্ছিল ফোনটা রেখেই তিনি নিশ্চয়ই ছুটলেন রান্নাঘরে, বরাবরের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞে। যেমন আগেও দেখেছে, দৃশ্যগুলো ভাসছিল চোখের সামনে— সুচরিতা, অপর্ণা ও দেবারতি বসে আছে খাবার টেবিলে, ওদের খেতে দিতে হবে। দশটা বেজে গেছে, খেয়েদেয়ে ওরা ইউনিভার্সিটি যাবে। ওদের খাওয়ার পর্ব মিটতে না মিটতেই ঊর্মি, সুপর্ণা, ঐন্দ্রিলা ও বিপাশা খাবার টেবিলে এসে বসল, ওরা ল. কলেজের ছাত্রী। এরপর একে একে বাকি মেয়েরাও নিজেদের সময় সুযোগমতো খেয়ে যেতে লাগল। যারা আজ বের হবে না, তারা ধীরে-সুস্থে একটু পরে এল খেতে। মুন্নি ও ঈশিতা বাড়ি গিয়েছিল কয়েকদিন আগে, প্রথমে ঠিক ছিল না যে ওরা আজই ফিরবে; একটু বেলা করে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, “মামণি খাবার পাওয়া যাবে?”

    “তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে এসো, যা আছে তোমাদের দু’জনের হয়ে যাবে।”

    দুপুরের খাওয়াদাওয়া মিটতে মিটতে বেলা প্রায় গড়িয়ে এল। রাতে কী রান্না হবে, সেবিষয়ে মালতীদিকে উপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে মামণি চললেন তার যোগ ক্লাসে। সেখানে তিনি নিজে তো চর্চা করেনই, পাশাপাশি আরও কয়েকজনকে শেখান। সেখান থেকে সৎসঙ্গ আশ্রম হয়ে ফিরতে ফিরতে রাত্রি প্রায় আটটা বেজে গেল। কোনোমতে সন্ধ্যারতি সমাপ্ত করেই আবার তাকে নজর দিতে হলো রাতের খাবারের দিকে, যে-পর্ব সমাধা হতে হতে রাত্রি প্রায় এগারোটা। এরপর তিনি খোঁজ নিতে শুরু করলেন সবার ঠিকঠাক শোয়ার ব্যবস্থা হলো কিনা। যারা এক-দু’দিনের জন্য এসেছে তাদের কিছু দরকার আছে কিনা। মশারি লাগবে কি না? সমস্ত ব্যবস্থাপনা শেষ করে ঘুমোতে তার প্রায় প্রতিদিনই রাত্রি বারোটা-সাড়ে বারোটা বেজেই যায়, আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আবার পরদিন আলো ফুটতে না ফুটতেই শুরু হবে তার নতুন দিন। এর মধ্যে যদি কারও কাকভোরে আসার কথা থাকে, তবে তিনি সেইসময় উঠে দরজা খুলে দেবেন, তাদের কিছু প্রয়োজন আছে কিনা তাও দেখবেন।

    গলিরাস্তার পাশে লাল টিনের গেটওয়ালা সামনে ছোট্ট একটুকরো বাগান ও পেছনে চারহাতি ফাঁকা জমিসহ অর্ধসমাপ্ত এই হলুদ দোতলা বাড়িটি ছিল মামণির স্বামী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল দেবব্রতবাবুর। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একদিন হঠাৎ মাঝরাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হলে মামণি দিশেহারা হয়ে পড়েন। এর তিন বছরের মাথায় মেয়েও বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে সময় এবং একাকিত্ব কাটাতে তিনি এমনিতেই একটা কিছু করার কথা ভাবছিলেন। ইতিমধ্যে সফট্‌ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে ভালো চাকরির সুযোগ পেয়ে বেঙ্গালুরু পাড়ি দেওয়ায় সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ইউনিভার্সিটি-সংলগ্ন এই বাড়িটিতে তিনি একটি মেয়েদের হোস্টেল শুরু করেন। উপরে এবং নিচে অ্যাটাচড বাথসহ দুটি ঘর তিনি দু’জন শিক্ষিকাকে ভাড়া দিয়েছেন। দোতলার বাকি দুটি ঘরে এবং নিচের দুটি ঘরে যেসব মেয়েরা ইউনিভার্সিটি বা আশপাশের কলেজগুলোতে পড়াশোনা করে, তাদের ভাড়া দেন। নিচতলার অন্য তিনটি ঘরের একটি তার শোয়ার ঘর, একটি বসার এবং একটি খাবার ঘর। সিঁড়ির তলার একটুকরো অংশে চলে রান্নাবান্নার কাজ। পরিস্থিতি অনুযায়ী যে মেয়েরা কোনো পরীক্ষা দিতে বা অন্য কোনো কাজে আসে, প্রায় নিয়মিতভাবেই তাদেরও এখানে দু-চার দিন থাকার ব্যবস্থা মামণি নিজের অংশের ঘরগুলো থেকেই করে দেন। এরা সবাই খাওয়াদাওয়া করে মামণির কাছে।

    সবাই তাকে মামণি বলে ডাকে, কেউ জানে না তার আসল নাম— যারা এখানে আসে, তারাও না; আর আশেপাশের বাড়িগুলোতে যারা বাস করেন, তারাও গেছেন ভুলে। ফলে লোকমুখে এই বাড়িটি ‘মামণির মেস' নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখানকার ব্যবস্থাপনা খুব উন্নত না হলেও যেকোনো পরিস্থিতিতে আসা একা মেয়েরা পায় নিশ্চিত নিরাপত্তা, ঘরের খাবারের স্বাদ, আর মায়ের স্নেহ। সত্তরোর্ধ্ব প্রাণোচ্ছল কর্মোদ্যমী সদাহাস্যমুখী মানুষটি মেয়েদের একান্ত নির্ভরস্থল।

    তবে এরপরেও এখানে বসবাসকারী স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে কখনো কখনো অসন্তোষের বাষ্প ধূমায়িত হয়ে উঠতে দেখা যায়, আর তার পেছনে মূল কারণ এখানে থাকা সাতটি বিড়াল। তারা অন্য কোনো ঘরে খুব একটা না ঢুকলেও সর্বক্ষণ রান্নাঘরের উনুনের আশেপাশে এবং খাবার টেবিলের উপরে ও নিচে বিচরণ করতে থাকে।

    সুপর্ণা--“মামণির কাছে খাওয়ার সবচেয়ে বড়ো সমস্যা এই বিড়ালগুলো… আমার মাঝে মাঝে এত ঘেন্না লাগে!”

    “আমি পরশুদিন দেখেছি একটা বিড়াল ভাজা মাছ থেকে একটা তুলে নিয়ে খাচ্ছিল,” ঘৃণা মিশ্রিত গলায় বলে উঠল ঐন্দ্রিলা, “থালায়় রাখা বাকি মাছগুলো কি আর ফেলে দিয়েছে, ওগুলোই নিশ্চয়ই রান্না হয়েছে!”

    বিপাশা--“ও, তাই তুই সেদিন মাছ খেলি না! আমি ভাবলাম হঠাৎ তোর হলো কী?”

    “হ্যাঁ, নিজের চোখে দেখে কী করে খাই!”

    “তাহলে আমাদের বলিসনি কেন?” চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করল সুপর্ণা।

    “আমি তো জানি না, ওই মাছই রান্না হয়েছে না ফেলা গেছে? বললে সেটা নিয়ে আবার হইচই হতো, তাই চুপ করে ছিলাম…”

    “জানিস আজ যে ঢেঁকিশাক রান্না হয়েছে, সেগুলো মনে হয় পেছনের ড্রেনের পাশ থেকে তুলে আনা। ওখানে অনেক শাক ছিল, আজ দেখছি পুরো জায়গাটাই পরিষ্কার…,” চাপা গলায় বলল সুপর্ণা।

    বিপাশা--“ওয়াক! ওয়াক! ছি ছি… আমার এখন কেমন যেন লাগছে…”

    এমনই মাঝে মাঝে মামণিকে নিয়েও জোর আলোচনা চলে। বয়স্ক মানুষ, একা একা কেন এখানে থাকেন? ছেলে-মেয়েদের কাছেও তো থাকতে পারেন? সবার মনে বিরাট জিজ্ঞাসা…

    অপর্ণা--“সত্যিই! আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে, এই বয়সে একা একা থাকাই শুধু নয়, সারাদিন এত পরিশ্রম… কী করে পারেন উনি?”

    “তুই থাম তো! যা করেন, তা টাকার জন্যই করেন। বাড়ি ভাড়া দিয়ে টাকা, মেস চালিয়ে টাকা… বুড়ো বয়সে এত টাকা খাবে কে?” বিদ্রুপ ঝরে পড়ে সুচরিতার গলায়।

    দেবারতি সায় দিল--“ঠিক বলেছিস… নিজের জন্যেও তো একটা আলাদা ঘর সবসময় রাখেন না, বেশি ভিড় হয়ে গেলে সেটাও ভাড়া দিয়ে দেন।”

    “একদম… আর রান্না তো করেন ওই কচুঘেঁচু, বেশিরভাগ দিনই হয়তো পেছনের জমিটা থেকে যা পারেন তুলে এনে রান্না করে দেন। মাছ-ডিমটুকুই যা কেনেন, সবজির খরচটা তো মনে হয় না করেন…,” সুচরিতা বলল।

    দেবারতি--“মেয়ে এত কাছে থাকে, শুনেছি তো মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব, তবুও একদিনের জন্য উনি গিয়ে থাকেন না সেখানে। যদি আয় কমে যায়! বাপরে বাপ!... কী ভয়ানক বৈষয়িক!”

    অপর্ণা--“তবে যাই বলিস, উনি এখানে আছেন বলেই কোথায় থাকব কী খাব সেটা নিয়ে ভাবতে হয় না, নয়তো ভীষণ সমস্যায় পড়তে হতো।”

    দেবারতি--“হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক….”

    আলগাভাবে কানে আসে মামণির সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের মন কষাকষি। ছেলে অভ্র তাকে বেঙ্গালুরু যেতে বললে উনি বলেন, “অত দূরে আমি গিয়ে থাকব কী করে? চেনা পরিচিত কেউ নেই, একজন কথা বলারও লোক পাব না। তার চেয়ে ছুটি পেলে তুই এসে ঘুরে যা।”

    বোঝা যায় ওপ্রান্ত থেকে অভিযোগের সুর ভেসে আসে, মামণি হেসে বলেন, “তোরা তো কেউ এখানে থাকিস না, সারাবছর বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। আমি যদি না রাখি, মেয়েগুলো তবে যাবে কোথায়?”

    অন্যদিকে মেয়ে তাপসী এসে তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে, উনি বলেন, “আমার মেয়েদের এখন পরীক্ষা চলছে মা, শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যেতে পারব না।”

    “পরীক্ষা শেষ হলেও কি তুমি যাবে? আজ পর্যন্ত কোনোদিন তো দেখলাম না!”

    “ঠিক আছে, আমি না পারলে তোরা এসে মাঝে মাঝে ঘুরে যাবি।”

    “আমারও ভাগ্য! বিয়ে হওয়া থেকে একদিনের জন্য বাপের বাড়ি এসে থাকতে পারলাম না! সব ঘরে তোমার বোর্ডার ভরতি। যখনই আসি, ঘণ্টাখানেক থেকে দেখা করে চলে যেতে হয়, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না… না তুমি গিয়ে থাকবে, না আমরা এসে থাকতে পারব…,” হতাশায় ভেঙে পড়ে তার গলা।

    “সে তো তুই চাইলেই এসে দু-চার দিন থেকে যেতে পারিস। এত মেয়ে আছে আর তোর থাকার জায়গা হবে না, তাই কি হয়!”

    “তোমার নিজেরই সবসময় একটা খালি ঘর থাকে না, তার উপর বাচ্চাকাচ্চা-সহ আমি এসে থাকব কোথায়? বাড়িতে সর্বক্ষণ এত বাইরের লোকজন, আর তুমি এত ব্যস্ত… ভালো লাগে না এভাবে থাকতে।”

    মেয়ে অভিমান করে, মামণিরও নিশ্চয়ই কষ্ট হয়, কিন্তু তিনি তা বুঝতে দেন না। তার উপর নির্ভর করে আছে এতগুলো মেয়ে, উনি তাদের ফেলে চলে যেতে পারেন না। জীবন এবং সময়ের দাবি মেনে এক এক করে তার প্রিয়জনেরা যত বাড়ি থেকে দূরে চলে গেছে, তত তিনি এক এক করে সন্তান স্নেহে এদের আঁকড়ে ধরেছেন। এরা যে তার দিশাহীন জীবনের একমাত্র লাইট হাউস…

    এরপরও হোস্টেলের দিনগুলো একইভাবে গড়াতে থাকে। মামণির জীবন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একইরকম ব্যস্ততায় কাটে। মেয়েদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিলেও হাসিমুখে মামণি সব সামলে নেন। বিড়ালগুলোকে নিয়ে মেয়েরা অভিযোগ করলে সাময়িকভাবে তাদের সরিয়ে দেন বটে, কিন্তু সবাই যে যার কাজে চলে গেলেই আবার ডেকে খেতে দেন, আদর করেন।

    এবার ঈশানী প্রায় চারবছর পর এল, কিন্তু একইরকম দেখতে পেল মামণি এবং ‘মামণির মেস’কে। অর্ধসমাপ্ত বাড়িটি সম্পূর্ণ হয়ে আকারে বাড়লেও বা সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এর মূল কাঠামো অটুট। একটু বিস্মিত হয়ে আরও দেখল সব ঘরে ঘরে বোর্ডার মজুদ, ফলে খুব চিন্তায় পড়ে গেল, রাতে থাকবে কোথায়? মামণি কী ব্যবস্থা করবেন?

    “মামণি একটিও ঘর ফাঁকা নেই?”

    “না, আসলে এখন ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা চলছে তো, তাই সব ঘরে পরীক্ষার্থীরা রয়েছে।”

    “আমি তবে থাকব কোথায়?”

    “আপাতত তুমি আমার ঘরে একটু বিশ্রাম নাও, আমি দেখছি পরে কী করা যায়…”

    “কিন্তু আমার কাল সেমিনার আছে মামণি, পড়াশোনা করতে হবে। একটু নিরিবিলি জায়গা পেলে ভালো হতো,” সামান্য ইতস্তত করেই বলল ঈশানী।

    “তুমি এই ঘরেই দরজা বন্ধ করে বিছানাতেই বসে পড়াশোনা করো, কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না,” মামণির আশ্বাস ভরা কণ্ঠ।

    “কিন্তু আপনি তবে থাকবেন কোথায়?”

    “আমাকে নিয়ে ভেবো না, আমি কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে ফেলব।”

    রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মামণি তাকে নিজের বিছানা ছেড়ে দিয়ে নিজে বসার ঘরের সোফাতে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিলেন। ঈশানীর মনে পড়ল, আগেও এমন হয়েছে যখন ফোনের কানেকশন না পেয়ে সে মামণিকে খবর দিতে পারেনি, ঝড়-জলের রাতে হঠাৎ এসে দেখে মামণি বাড়িতে নেই। খুব ভয় পেয়ে যখন কী করবে ভাবছে, এমন সময় আশ্রম থেকে ফিরে এসে একটুও বিরক্ত না হয়ে হাসিমুখে মামণি তাকে ডেকে নিয়েছিলেন, করে দিয়েছিলেন থাকার ব্যবস্থা। শুধু তাই নয় একবার সে মামণিকে বলেছিল, “ভাড়ার পরিমাণটা কি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?” যদিও অন্য যেকোনো জায়গা থেকে এখানে থাকা-খাওয়া অনেক কম খরচে হয়ে যায়। আসলে চাকরি পাওয়ার আগে ছাত্রজীবনে হাতে তেমন টাকা থাকত না বলে সে এমন একটা গর্হিত মন্তব্য করে ফেলেছিল, এখন অনুশোচনা হয়। মামণি সেই মূহূর্তে চুপ করে থাকলেও পরে ভেবেচিন্তে পরিচিত একজনের হাত দিয়ে কিছু টাকা তার বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কী করে পারে কোনো মানুষ এমন হতে? বিস্ময় জাগে…

    পরবর্তী বছরগুলোতেও মামণি একইভাবে তার কাজকর্ম চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, হয়তো এভাবেই বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু হঠাৎ ঘটল ছন্দপতন। যেদিন সরকারিভাবে লকডাউন ঘোষণা হলো, মেয়েরা একে একে হোস্টেল ছেড়ে যেতে শুরু করল, মামণি সকলের মঙ্গল কামনা করে চোখের জলে বিদায় জানালেন প্রত্যেককে। আহ্বান জানালেন পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলে সকলকে আবার ফিরে আসার জন্য। রান্নাবান্নার তেমন প্রয়োজন নেই বলে মালতীদিকেও আসতে নিষেধ করে দিলেন।

    “উনি তবে এখন করছেন কী?” ভাবতে ভাবতেই ফোনের আওয়াজে চটকা ভেঙে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল ঈশানী। ফোনটি ধরে কোনোমতে কথা শেষ করল, তারপরই কল লিস্ট খুঁজে মামণির নম্বরটি ডায়াল করে কানে চেপে ধরল। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে পাওয়া গেল মামণির গলা, “হ্যালো…”

    “আমি ঈশানী বলছি মামণি, ঈশানী চৌধুরী, বালুরঘাট থেকে… কেমন আছেন আপনি?”

    “ও ঈশানী, বলো কেমন আছো তুমি? কী ভালো লাগছে তোমার গলা শুনে। কতদিন পর শুনলাম…”

    “আমি ভালো আছি মামণি, আপনি কী করছেন?”

    “কিছুই করার নেই আমার এখন। সারাদিন অফুরন্ত অবসর। রান্নাঘরে কী রান্না হবে ভাবতে হয় না, খাবার টেবিলে এসে কেউ খেতে বসে না, ঘর খালি আছে কি না জানতে কেউ ফোন করে না, ভোরবেলা কাউকে দরজা খুলে দেওয়ার তাড়া নেই, ঘরে ঘরে কার কী প্রয়োজন জানার দায়ও নেই…। ঘুরে বেড়াই এঘর-ওঘর... খুব ইচ্ছে করে তোমাদের দেখতে… নিজেকে কখনও কখনও মনে হয় এক জীবন্ত প্রেতাত্মা…”

    “যোগ ক্লাস করেন না?”

    “করি কিন্তু এখন তো সবই অনলাইন, তাতে না মন ভরে না সময় কাটে,” হতাশা মেশানো গলায় বলে ওঠেন মামণি। সঙ্গে যোগ করেন, “কখনও কারও উপর নির্ভর করতে চাইনি, একাকিত্বকে দূরে সরাতে গিয়ে কাজে ডুব দিয়েছিলাম, এখন এই অখণ্ড অবসর আর ফাঁকা বাড়ি আমাকে গিলতে আসে…”

    “কিছুদিন নাতি-নাতনিদের কাছে থেকে আসুন না, হয়তো ভালো লাগবে।”

    “হ্যাঁ, ওরাও খুব বলে, গিয়েছিলামও মেয়ের কাছে থাকব বলে, কিন্তু মন টিঁকল না। সবসময় মনে হয় এই বোধ হয় মেয়েরা ফোন করবে, এই বোধ হয় তারা ফিরে আসবে, কিন্তু…,” কান্নায় বুজে আসে গলা।

    “মন খারাপ করবেন না মামণি… আশা করি আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ততদিন যে ধৈর্য ধরতেই হবে আমাদের…”

    কান্নাভেজা গলায় একবুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন মামণি, “জানো, বিড়ালগুলোও আর আসে না আমার কাছে…”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments