আত্মপরিচয়ের সংকট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব, যৌন নিপীড়নের মত নানাবিধ সামাজিক সমস্যা যখন নারীকে প্রান্তিক জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তখন সে জীবনের চেহারাটা কেমন দাঁড়ায়? এই ছোট গল্পটিতে ফুটে উঠেছে সর্বার্থে বঞ্চিত, কলঙ্কিত এক নারীর জীবনের নির্মম ছবি।এ নারী আমাদের অতি পরিচিত। রাস্তার মোড়ে, ফুটপাতের পাশে প্রত্যহ এদের দেখা মেলে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক সর্বহারা বুড়ি ভিখারিনি যার জীবন বোরখা আর বালিশের বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হয়। তাই প্রতিদিন সেলাই দিতে দিতে সে বালিশকে শক্ত রাখতে হয়। সমাজ তাকে যে অন্যায় করতে বাধ্য করেছে, আর তার জন্য যে পাপবোধ, সে সবই যে ঢাকা আছে ওই বালিশের সেলাইয়ের পরতে পরতে। এই ত্যাড়াবাঁকা, কণ্টকাকীর্ণ জীবনের শেষ কোথায়? এ জীবনের সমাপ্তিটা কি মসৃণ?
প্রখ্যাত উর্দু গল্পকার ইসমত চুঘতাই (১৯১১-৯১) প্রান্তিক জীবনের রূঢ় বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন যে গল্পে, সেটির অনুবাদের জন্য লাহোরের ‘রোহটাস্ বুকস্’ থেকে ১৯৯২-এ প্রকাশিত ‘সরি মাম্মি’ গল্প সংগ্রহে মুদ্রিত গল্পটি ব্যবহার করেছি।
—অনুবাদক
আল্লাহ্ই জানেন নান্হি-র দিদার বাপ-মায়ের দেওয়া নামটি কী ছিল। কেউ কখনও তাকে সে নামে ডাকেনি। যখন সে সরু গলিতে নাক-ভর্তি পোঁটা নিয়ে ছুটোছুটি করা ছোট্ট মেয়েটি ছিল, তখন গলির মানুষ তাকে ‘বফাতানের বেটি’ বলে হাঁক পাড়ত। তারপরে কিছুদিনের জন্য সে হল বশিরার বউমা। পরে বিসমিল্লার মা বলেই লোকে তাকে চিনত। আর প্রসবের সময় বিসমিল্লার চাচি যখন নান্হি’কে অনাথ রেখেই মারা গেল, তখন থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সে ছিল ‘নান্হি কি নানি’।
দুনিয়ায় এমন কোনও কাজ নেই যা নান্হির নানি করে দেখেনি। যেদিন থেকে সে নিজের হাতে বাটি ধরার মত বড় হয়েছে, সেদিন থেকে লোকের বাড়িতে দু’বেলার রুটি আর পুরোনো জামাকাপড়ের বিনিময়ে ছুটকো কাজ ধরে নিয়েছে। যে বয়সে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হেসেখেলে সময় কাটানোর কথা, সেই কচি বয়সে যদি কাউকে লোকের ঘরে কাজ করতে হয়, তা হলে সেই বোঝে সে কাজের মর্ম কী! সেই সব ছুটকো ফাইফরমাশের তালিকায় ছোট মিয়াঁর সামনে ঝুমঝুমি বাজানো থেকে শুরু করে বড় সরকারের মাথা টিপে দেওয়া পর্যন্ত কত কীই না ছিল।
জীবনের দৌড়ঝাঁপের মধ্যে একটু রান্নাবান্না শিখে ফেলায় জীবনের কত বছর যে রাঁধুনির কাজ করতে করতে হারিয়ে গেছে। কিন্তু যখন চোখের জ্যোতি কমে আসায় ডালের মধ্যে টিকটিকি আর রুটির মধ্যে মাছি মিলতে শুরু করল, তখন সে রিটায়ার হতে বাধ্য হল। তারপর থেকে তো নান্হির দিদার গুলগপ্পো করা আর এর কথা তাকে লাগানো ছাড়া আর কোনও কাজই রইল না। কিন্তু এই কান ভাঙানোর পেশাও বেশ লাভজনক হতে পারে। সব মহল্লাতেই ঝগড়াঝাঁটি, বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই থাকে। যদি বিপক্ষ শিবিরে খবর পৌঁছে দেওয়ার সাহস কারও থাকে, তা হলে খাতির তো জুটবেই। কিন্তু এই পেশায় বেশিদিন চালানো যায় না, লোকে নানি’কে রটন্তী বলে ডাকে। এ’কাজে কোনও ভবিষ্যৎ নেই বুঝে নানি অবশেষে তার জীবনের শেষ এবং সবচেয়ে লাভজনক কাজ ধরে ফেলল — সুশীলা এক ভিখারিনীর কাজ।
খাবার সময় হলে নানি নাকের পাটা ফুলিয়ে গন্ধ নিয়ে দেখে কোন্ ঘরে কী রান্না চড়েছে। আর যেখান থেকেই রান্নার খুশবু আসবে, দৌড়তে দৌড়তে সেই ঘরে সে পৌঁছে যাবে।
‘এই বউ, কুমড়ো দিয়ে মাংস রাঁধছ?’ নানি নিষ্পাপ মুখে জিগ্যেস করবে।
‘না বুয়া, আজকাল কুমড়ো একদম সেদ্ধ হয় না। আলু দিয়েছি।’
‘সুভান আল্লাহ্, কী খুশবু বেরিয়েছে! আল্লাহ্ বিসমিল্লাহ্র বাবাকে শান্তির আশ্রয় দিন। তিনি আলু কী পছন্দই না করতেন! রোজ কী না বিসমিল্লাহ্র মা আলু-গোস্ত রাঁধবে। এই বউ, মাংসে ধনে পাতা দিয়েছ?’ নানির মুখে উদ্বেগের ছাপ।
‘না নানি, আমার সব ধনে পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। ভিস্তির হতচ্ছাড়া কুকুরটা আমার কেয়ারি করা বাগানে ঢুকে হুটোপুটি লাগিয়ে সব গাছগুলোর বারোটা বাজিয়েছে।’
‘হায়, হায়, ধনে পাতা ছাড়া আলু-গোস্ত কি মুখে রুচবে? হাকিমজির বাগানে কত হয়ে আছে।’
‘না-না দিদা, হাকিমজির ছেলেটা গতকাল শব্বান মিয়াঁর ঘুড়ির সুতো কেটে দিয়েছে। তাকে আমি বলেছি খবরদার, বারান্দায় পা ফেলেছিস তো দেখে নেব!’
‘আরে তুমি কি ভাবছ আমি তোমার নাম করে চাইতে যাব?’ এই বলে তো নানি চটি ফটফটিয়ে বোরখা সামলাতে সামলাতে হাকিমজির বাড়ি পৌঁছোল। গায়ে রোদ লাগানোর বাহানায় দেওয়ালের পাশে কার্নিশের তলায় যেখানে ধনে পাতা লাগানো আছে, গুটিশুটি মেরে সেখানে হাজির হল। প্রথমে যেন শুঁকে দেখবে বলে একটা পাতা তুলে আঙুলে ঘষে গন্ধ শুঁকল। তারপরে যেই হাকিমজির বৌমা পেছন ফিরেছে, সঙ্গে সঙ্গে নানি মুঠো ভরে ধনে পাতা তুলে নিয়েছে। আর ধনে পাতা এনে দেওয়ার পরে নানি তো এক মুঠো খাবারের দাবিদার হয়েই যেত।
তার এই হাত সাফাইয়ের জন্য গোটা মহল্লা নানি’কে চিনত। খাবার জিনিস দেখেছে কী দুয়েক গাল তুলে নেবেই। বাচ্চার দুধের পাত্র খোলা পড়ে থাকলে হয়ত মুখ লাগিয়ে চোঁ-চোঁ কয়েক ঢোঁকেই শেষ করে দিল। চিনি হাতে পেল তো সোজা মুখে পুরে দিল। গুড়ের ডেলা হাতের তালুতে চটকে নিয়ে রোদে আরাম করে বসে হয়ত চুষছে। পাজামার দড়ির ব্যবহারেও বুড়ি ছিল পারদর্শী। সুপুরি তুলে নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখল। দুটো রুটি নিয়ে তাও কোমরে গুঁজল। রুটির আদ্ধেক ভেতরে, বাকিটা বাইরে ঝুলে থাকে। কিন্তু কুর্তা দিয়ে ঢেকে রাখে, আর তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় উঃ-আহ্ করতে করতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সরে পড়ে। সবাই এই হাত সাফাইয়ের ব্যাপারটা জানলেও কারও মুখ খোলার সাহস ছিল না, কারণ নানির কাটাফাটা বুড়ো হাত দুটি বিদ্যুতের ঝলকের মত দ্রুততায় কাজ সারত। আর নিতান্ত অসুবিধেয় না পড়লে খাবার না চিবিয়ে গিলে ফেলায় তার জুড়ি কেউ ছিল না। আর যদি কেউ তার ব্যাপারে সামান্যও সন্দেহ করত, তাহলে বারবার কসম খেতে খেতে এমন হৈচৈ বাধিয়ে দিত, যে সকলেই তাকে এড়িয়ে যেত। নানি বলত যে সে কোরান ছুঁয়েও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে রাজি। কে তাকে কোরান ছুঁয়ে মিথ্যে বলিয়ে নিজের কবরে পোকামাকড় ফেলতে চাইবে?
গুলগাপ্পা দেওয়া, চুরি করা আর লোক ঠকানো ছাড়াও নানি ছিল এক নম্বরের মিথ্যুক। সব থেকে বড় ঝুট ছিল তার ওই বোরখাটি, যেটা সব সময় তার গায়ে চড়ানো থাকত। কোনও কালে হয়তো সে বোরখায় মুখ-ঢাকা নিকাবও ছিল। কিন্তু ক্রমশ যখন মহল্লার গণ্যমান্য বৃদ্ধরা একে একে চলে যেতে শুরু করলেন অথবা তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এল, তখন নানি’ও তার মুখের অবগুণ্ঠনকে বিদায় জানাল। কিন্তু বোরখার খাঁজকাটা কেতাদুরস্ত টুপিটি মাথায় এমন চেপে লাগানো থাকত যেন সেটি মাথারই একটা অংশ। সামনে যদি ফিনফিনে কুর্তার তলায় ভেতরের জামা নাও বা থাকে, পেছনে বোরখা বাদশাহী ধড়াচুড়োর মত ঢেউ তুলত। আর সে বোরখা শুধু মাথা ঢাকতেই ব্যবহার হত না, বরং দুনিয়ার শত শত সম্ভব বা অসম্ভব কাজ ওই বোরখার সাহায্যেই সম্পন্ন হত। বোরখাই ছিল তার বিছানার চাদর, পুঁটলি বাঁধলে তাই হয় তার মাথার বালিশ। আর কদাচিৎ কখনও যদি নানি স্নান করে, তা হলে বোরখাকেই তোয়ালের মত ব্যবহার করা হত। পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পরার সময় আসন, আর যখন পাড়ার কুকুরগুলো তার দিকে দাঁত বার করে তেড়ে আসে, তখন বোরখাই হয় তার ঢাল। কোনও কুকুর যদি তার পায়ের গুলিতে কামড়াতে আসে, তা হলে নানির বোরখার ভাঁজ কুকুরের মুখে ছোবল মারে। বোরখাটি নানির বড়ই প্রিয়। ফুরসত পেলেই বসে বসে সে তার বোরখাটির বয়েস হয়ে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ করে। যদি একটা টুকরো কাপড় কোথাও পেল, তো সযত্নে বোরখায় তালি মারে। সেই দিনের কথা ভাবলে নানির কাঁপুনি আসে যেদিন তার এই বোরখাটিই আর রইবে না। যদি কফনের জন্য আট গজ থান কাপড় কোনওভাবে জুটে যায়, তাহলেই তার অনেক ভাগ্যি!
নানির কোনও স্থায়ী হেডকোয়ার্টার ছিল না। সেপাইয়ের মত জীবন — আজ এর দালানে তো কাল তার ছোট্ট উঠোনে। যেখানেই একটু জায়গা মিলল, তাঁবু খাটিয়ে নিল। যখন কেউ তাড়িয়ে দিল, তখন আবার এগিয়ে চলল। অর্ধেক বোরখা নিচে পেতে আর বাকিটুকু দিয়ে শরীর ঢেকে লম্বা হল।
কিন্তু বোরখার চেয়েও নানির অনেক বেশি দুশ্চিন্তা ছিল তার একমাত্র নাতনি নান্হি’কে নিয়ে। কঁক্-কঁক্ করে ডাকতে থাকা মুরগির মত নানি তার নাতনিকে ডানার সুরক্ষিত আশ্রয়ে রাখত। কে জানে কখন সে নজরের বাইরে চলে যায়! কিন্তু যখন এমন সময় এল যে হাত-পা আর তেমন চলে না, অন্য মহল্লার মানুষ তার চটির খস্খস্ আওয়াজ শুনলেই সতর্ক হয়, তখন নানির কোনও ইশারা ইঙ্গিতই আর কাজে লাগত না। পেটের তাগিদে ছোট্ট নান্হি’কে তখন নিজের পুরোনো পেশা, অর্থাৎ লোকের বাড়ি ফাইফরমাশ খাটার কাজেই লাগিয়ে দিতে হয়। অনেক চিন্তাভাবনার পর সে নাতনিকে ডেপুটি সাহেবের বাড়িতে রুটি-কাপড় আর মাসে দেড় টাকা মাইনেতে কাজে লাগিয়েই দিল। কিন্তু নান্হির দিদা প্রতি মুহূর্তে ছোট্ট নাতনিটির সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থাকত। নান্হি নজরের বাইরে গেলেই তার নানি চেঁচামেচি শুরু করত। কিন্তু ভাগ্যের লিখন কি এক জোড়া বুড়ো হাত কখনও মুছতে পেরেছে? তখন দুপুর। ডেপুটির বউ তার ভাইয়ের বাড়িতে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব পাড়তে গেছে। মনিব খস্ এর পর্দা লাগানো ঠাণ্ডা ঘরে দিবানিদ্রায় মগ্ন। নান্হি পাখার দড়ি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে দড়িটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ঝিমোচ্ছে। পাখা বন্ধ হতেই মনিবের ঘুম গেছে ভেঙে। তার ভেতরের শয়তানটা যেই জেগে উঠেছে, তখনই নান্হির কপাল হল অন্ধকার।
লোকে বলে বার্ধক্যজনিত ক্ষমতাহানি থেকে বাঁচতে হাকিম-বৈদ্যরা বিভিন্ন ওষুধ আর মলম ছাড়াও মুরগির ঝোলও খেতে বলে। কিন্তু ন’বছরের ছোট্ট নান্হি তো একটা মুরগিই!
তন্দ্রাচ্ছন্ন নানি যতক্ষণে চোখ খুলেছে, ততক্ষণে নান্হি আর সেখানে নেই। সারা পাড়া খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না। কিন্তু রাতে যখন তার ক্লান্ত দিদা কুঠুরিতে ফিরে এল, তখন দেখে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নান্হি একটা আহত পাখির মত শ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নানির তখন যেন কথা বলার শক্তিও আর নেই। কিন্তু নিজের দুর্বলতাকে ঢাকতে সে নাতনিকে খুব একচোট গালি দিল। ‘এই বেশ্যা মাগি, তুই এখানে বসে আছিস! তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমার বুড়ো পা-দুটো ফুলে উঠল। দাঁড়া দেখাচ্ছি, সরকারকে বলে তোকে মেরে তক্তা বানানোর ব্যবস্থা করছি।’
কিন্তু নান্হির চোট বেশিক্ষণ লুকোনো থাকল না। নানি মাথায় থাপ্পড় মারতে মারতে চিৎকার করে উঠল। প্রতিবেশী মেয়েরা যখন জানতে পারল তখন তাদেরও মাথায় হাত। যদি ডেপুটির ছেলে এই পদস্খলন ঘটাত, তাও বা কিছু বলা চলত। কিন্তু ডেপুটি সাহেব.....এ’মহল্লার সবচেয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তি, তিন নাতি-নাতনির দাদু তিনি! পাঁচবার নমাজ পড়েন। এই সেদিন তো মসজিদে চাটাই অর জল রাখার লোটা দান করলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও নালিশ তো মুখেই আনা যাবে না।
মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর যার জীবন, সেই নানির মনের দুঃখ চেপে রাখা ছাড়া আর কীই বা করার থাকে? সে নাতনির কোমরে গরম সেঁক দেয়, আটা গুড়ের হালুয়া খাওয়ায়, আর নিজের মনের কষ্ট যতটা সম্ভব সওয়ার চেষ্টা করে। দু-চার দিন এপাশ-ওপাশ করার পরে নান্হি উঠে দাঁড়াল। কয়েক দিনের মধ্যেই তার যা হয়েছিল, তা ভুলেও গেল।
কিন্তু পাড়ার ভদ্রমহিলারা ঘটনাটা ভুললেন না। তাঁরা লুকিয়ে-চুরিয়ে নান্হি-কে ডেকে জানতে চাইতেন।
‘না-না, নানি আমাকে মারবে,’ নান্হি পালাতে চায়।
‘নে, এই চুড়িগুলো পরে নে সোনা। নানি কী করে জানবে?’ নিজেদের কৌতূহল মেটানোর জন্য তারা নান্হি’কে লোভ দেখায়।
‘কী হয়েছিল? কেমন করে হয়েছিল?’ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তারা জানবে। আর নান্হি বেচারা, সে ঘটনার তাৎপর্য কিছুই না বুঝে যতটা সম্ভব বিস্তারিত তাদের বলে। আর পাড়ার বউরা দোপাট্টা দিয়ে নাক ঢেকে খিল্খিল্ করে হেসে ওঠে।
নান্হি ভুলে গেলেও প্রকৃতি-পরিবেশ ভোলে না। ফুলের কুঁড়ি তৈরি হওয়ার আগেই তুলে নিয়ে তাকে ফোটাতে চাইলে তার পাপড়িগুলো সব ঝরে যায়, শুধু বোঁটাটা পড়ে থাকে। নান্হির মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় সে ফুল থেকেও না জানি কত পাপড়ি ঝরে গেছে। গোল্লায় যাওয়া নির্লজ্জ-বেহায়া একটা মেয়ের মুখ। সে কচি খুকি থেকে কিশোরী হওয়ার সুযোগ পেল না। এক লাফে যেন আওরত হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির সুদক্ষ, অভ্যস্ত হাতে গড়া পূর্ণাঙ্গ নারী সে নয়। বরং এক ত্যাড়াবাঁকা আওরত যাকে কোনও দানবের দু’গজ লম্বা পা মাড়িয়ে দিয়ে গেছে। বেঁটেখাটো, মোটা, ফোলাফোলা মাটির এক পুতুল যা শক্ত হওয়ার আগেই কুমোরের হাঁটুর চাপে যেন পিষ্ট হয়ে গেছে।
ময়লা, তেলচিটে পড়া কাপড় যদি কেউ নাক ঝাড়ার জন্য নেয়, তা হলে কে আর বাধা দেয়? রাস্তায় চলার সময় ছেলেরা খেলার ছলে তার শরীরে চিমটি কাটে, তারপরে তাকে মিঠাই খেতে দেয়। নান্হির চোখে শয়তানি ঝিলিক মারে। আর নানি তাকে ঠুসে হালুয়া খাওয়ানোর বদলে ধোপার মার মারে। কিন্তু ময়লা তৈলাক্ত কাপড়ের ধুলোও তো ঝরে না। রবারের বলের মত, ড্রপ খাইয়েছ কী তোমার দিকেই লাফিয়ে উঠবে।
কয়েক বছরেই নান্হির বাছ-বিচারহীন যৌনতায় পাড়া কেঁপে উঠল। শোনা যায় তাকে নিয়ে ডেপুটি সাহেব আর তার ছেলের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়েছে। তারপরে শোনা গেল যে তাকে নিয়ে ঝগড়া হওয়ায় পাল্কিবাহক রাজওয়া মসজিদের মুল্লাজি’কে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে। তারপরে নান্হি সাদিক পালোয়ানের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কে লিপ্ত হল। প্রতিদিনই নান্হির প্রায় নাক কাটা যায় আর গলিতে তাকে নিয়ে লড়াই আর বাক্বিতণ্ডা চলে।
এইভাবে একদিন সে মহল্লাটি নান্হির পক্ষে অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠল। কোথাও আর তার পা রাখার জায়গা নেই। সাদিক পালোয়ানের ভাগ্নের পালোয়ানি আর নান্হির জওয়ানি মহল্লার বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল।
তারা দু’জনে মিলে যা চালাত, লোকে বলে দিল্লি-বোম্বে’তে সে সবের পাইকারি ব্যবসার কদর আছে। হতে পারে তারা দু’জনে তেমনই কোনও বড় শহরে চলে গেল।
যেদিন নান্হি পালাল, সেদিন তার নানির ভাগ্যবিধাতারও বোধহয় সন্দেহ হয়নি যে এমনটা হতে পারে। তিন দিন ধরে হারামাজাদি একেবারে চুপ করে ছিল। নানি’কে একবারও গালিগালাজ না করে সে আপন মনে বসে শূন্য চোখে তাকিয়েছিল।
‘এই নান্হি রুটি খেয়ে নে,’ নানি বলত।
‘খিদে নেই নানি!’
‘এই নান্হি, অনেক রাত হল শুয়ে পড়।’
‘নানি, ঘুমও তো আসে না।’
রাতে সে নানির পা টিপতে লাগল।
‘নানি, এই নানি, সুবহানক-আল্লাহ্-হুমা(১) ...শোন তো, মনে আছে কি নেই?
নানি শুনল তার নাতনির মনে আছে, গড়গড় করে বলে চলেছে।
‘যা বেটি, এবার শুয়ে পড়,’ নানি পাশ ফিরে শোয়। একটু পরেই উঠোনে নাতনির খটখট আওয়াজ শুনে নানি বলে, ‘আরি, মরতি কিঁউ নহিঁ?’
বুঝল খান্কিটা এবার তার উঠোনটাকেই বোধহয় নোংরা করতে শুরু করেছে। কোন্ হারামিকে আজ ঘরে নিয়ে এসেছে কে জানে? কিন্তু উঠে যখন উঠোনের দিকে ভালো করে নজর করল, তখন নানি আশ্চর্য হয়ে গেল। তার নাতনি ইশা-র নমাজ পড়ছে। পরদিন ভোরেই নাতনি গায়েব।
কখনও কেউ দূর দেশ থেকে এলে খবর মেলে। কেউ বলল যে কোনও গণ্যমান্য নবাব নান্হি’কে তার রক্ষিতা করে রেখেছে। সে এখন টমটমে চড়ে, বেগমের মত থাকে। আবার কেউ হয়ত বলল তাকে হিরামাণ্ডিতে দেখা গেছে। কেউ তাকে ফারস রোড আবার কেউ সোনাগাছিতেও দেখেছে। কিন্তু নানি বলে তার নাতনির কলেরা হয়েছিল, আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ওলটপালট খেতে খেতে মারা গেছে।
নান্হির জন্য শোক পালনের পর থেকে তার দিদিমা একটু যেন বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। লোকে পথ চলতে চলতে তার পেছনে লাগত।
‘এই নানি, একটা বিয়ে করো,’ ভাবিজান ঠাট্টা করত।
‘কাকে করব, নিয়ে আয়, তোর বরের সঙ্গে করিয়ে দে,’ নানি বিরক্ত।
‘এই নানি, মুল্লাজিকে শাদি করে নাও। আল্লাহ্র কসম, তিনি তো তোমার জন্য পাগল।’
আর নানির গালপাড়া শুরু হয়ে যেত। এমন সব অনন্য, বর্ণময় সে গালিগালাজ যে লোকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকত।
‘ওই বেশ্যার দালালটাকে....ওর দাড়ি যদি উপড়ে না নিই!’
কিন্তু এসবের পরেও যদি কখনও মুল্লাজির সঙ্গে গলির কোথাও দেখা হয়ে যেত, তা হলে নানি সত্যিই লজ্জা পেয়ে যেত।
মহল্লার রাস্তার ছেলেগুলো ছাড়া জীবনভর নানির শত্রু ছিল হারামজাদা বাঁদরগুলো। এই বাঁদরদের কয়েক প্রজন্ম সে পাড়ায় বড় হয়েছে। আর সেই সুবাদে মহল্লার সব বাসিন্দাকে তারা চিনত, পুরুষেরা বিপদজনক, বাচ্চারা বদমাশ আর মহিলারা ডরপুক হয়, এটা তারা জানত। কিন্তু নানি যে সারাটা জীবন তাদের মধ্যেই কাটিয়েছে! সে বাঁদরদের ভয় দেখানোর জন্য কোনও বাচ্চার গুলতি হাতিয়ে নিয়েছিল। মাথায় বোরখার পাগড়ি বেঁধে গুলতি তাক করে সে যখন বাঁদরদের তাড়া করত, তখন বাঁদরগুলো কিছুক্ষণের জন্য ভয় তো পেত, কিন্তু তার পরেই আবার তারা নিশ্চিন্তে টহল দেওয়া শুরু করত।
বাসি খাবারের টুকরো নিয়ে বাঁদরের দল আর নানির মধ্যে টক্কর চলতেই থাকত। পাড়ায় যখনই কোথাও বিয়ে-শাদি অন্নপ্রাশনের উৎসব হত, তখনই নানি সেখানে পৌঁছে গিয়ে ফেলে দেওয়া খাবারের টুকরোগুলো ঠিকে নিয়ে নিত। কোথাও লঙ্গর খুললে, কাঙালি ভোজনের ব্যবস্থা হলে, নানি লোকের নজর এড়িয়ে চার-চারবার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ত। এইভাবে খাবার সংগ্রহ করে সে সেই খাবারের স্তূপের দিকে মনে কী আনন্দই না নিয়ে তাকিয়ে থাকত! ভাবত আল্লাহ্ যদি তার পেটে উটের পিঠের মত বন্দোবস্ত করে দিতেন যাতে সে পেটের মধ্যেই চার দিনের খাবার জমিয়ে রাখতে পারে, তা হলে কী মজাটাই না হত! চারদিনের খাবার পেটে ভরে নিলে ছুটি পেত। কিন্তু খাবার মেলার এত উল্টোপাল্টা ব্যবস্থা করে আল্লাহ্ যে কেন তার পেটের মেশিনে এমন খুঁত রেখেছেন যে দুয়েক বেলার বেশি খাবার সেখানে জমিয়ে রাখার কোনও উপায়ই নেই। এই কারণে নানি খাবারের টুকরোগুলো চটের কাপড়ের ওপরে ফেলে রেখে শুকিয়ে নিয়ে ঘড়ার মধ্যে ভরে রাখত। খিদে পেলে সেই শুকনো খাবারের একটু ভেঙে নিয়ে তাতে জলের ছিটে দিয়ে অল্প নুন-লংকা মেশালেই সুস্বাদু মণ্ড তৈরি।
কিন্তু গরমের সময় আর বর্ষাকালে এই রন্ধন প্রক্রিয়ার ফলে নানির পাতলা পায়খানা লেগেই থাকত। তাই খাবারের বাসী টুকরোগুলো পচে গিয়ে গন্ধ বেরোলে নানি সেগুলো যৎসামান্য দামে পড়শীদের কাছে কুকুর আর ছাগলের খাবার জন্য বেচে দিতে চাইত। কিন্তু সাধারণত দেখা যেত যে কুকুর আর ছাগলের হজমশক্তি নানির চেয়ে কমই হত। আর সেই কারণে লোকে সে খাবার এমনি দিলেও নিতে চাইত না, পয়সা দিয়ে কেনা দূরে থাক। কিন্তু তাসত্ত্বেও, লোকের ফেলে দেওয়া সেই সব ছাইপাঁশ খাবারের টুকরো নানির প্রাণাধিক প্রিয় ছিল আর সেগুলো সংগ্রহ করতে নানি’কে কম লাথিঝাঁটা আর গালিগালাজ সহ্য করতে হয়নি। আর সেই খাবার রোদে শুকোনোর সময় সমগ্র বানর প্রজাতির সঙ্গে পবিত্র যুদ্ধে নামার প্রস্তুতিই তাকে নিতে হত। যেখানেই সেগুলো বিছিয়ে দিক না কেন, বাঁদরের পাল বেতার মারফত খবর পেয়ে যেত। তারা দলে দলে এসে আশপাশের দেওয়ালগুলোর দখল নিত, আর ছাদের টালির ওপর লম্ফঝম্প করে কী আওয়াজটাই না তুলত। তারা ছাদের খড় ধরে টানত, আর পথচারীদের সঙ্গে বকবক করতে করতে মুখ ভ্যাঙাত। নানি’ও সেই সময় ময়দানি মরদ বনে গিয়ে মাথায় বোরখার পাগড়ি বেঁধে হাতে গুলতি নিয়ে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে যেত। সারাদিন ধরে সেই বাঁদর তাড়ানোর লড়াই চলত। তারপর সন্ধ্যে হলে বাঁদরদের হুটোপাটির পরে যা পড়ে থাকত, তাই কুড়িয়ে নিয়ে বাঁদরদের গালি পাড়তে পাড়তে ক্লান্ত নানি ঘরে ফিরে ঘুমে ঢলে পড়ত।
নানির বিরুদ্ধে বাঁদরগুলোর জাতক্রোধ ছিল। যদি তাই না হবে, তা হলে কেনই বা জগতের সব কিছু ছেড়ে তাদের প্রলুব্ধ করবে নানির ওই ছাইপাঁশ খাবারের টুকরোগুলো? আর বড়, পাজি, লাল ডোরাকাটা বাঁদরটা নানির প্রাণের চেয়ে প্রিয় বালিশটা নিয়ে পালাবে? নান্হি চলে যাওয়ার পরে সেই বালিশটাই ছিল পৃথিবীতে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বোরখা ছাড়া ওই বালিশটাই তো সারাক্ষণ তার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকত, যে বালিশের সেলাই খুলে গেলেই সে পাকা সেলাই দিয়ে মেরামতের কাজে লেগে যেত। অনেক সময়েই নানি’কে দেখা যেত একটা কোণে নিরিবিলিতে বসে তাকিয়া নিয়ে এমন খেলা খেলছে যেন সে নিজে নান্হির সন্তান। আর তাকিয়াটি তার খেলার পুতুল। নানি তার সমস্ত দুঃখের কথা তাকিয়াটিকে বলে যেন মনের ভার কমানোর চেষ্টা করছে। তাকিয়ার প্রতি যতই তার ভালোবাসা উথলে উঠত, ততই নানি পাকা সেলাই দিয়ে দিয়ে তাকে শক্তপোক্ত করে রাখত।
আর দেখুন নিয়তি নানির সঙ্গে কী খেলাটাই না খেলল! গায়ে বোরখা জড়িয়ে সে কোনও বারান্দার নিচে বসেছিল। আর তার কোমর বন্ধনী থেকে বেছে বেছে উকুন বার করছিল। এমন সময় একটা বাঁদর হঠাৎ লাফ দিয়ে সেখানে এসে নানির বালিশটি নিয়ে চম্পট দিল। মনে হল কেউ যেন নানির হৃদয়টা নিয়ে পালাল। সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এমন শোরগোল তুলল যে মহল্লার সব বাসিন্দা সেখানে জমা হল।
বাঁদরদের তো নিয়মই হল যে চোখ নামালেই একটা গ্লাস বা বাটি নিয়ে উধাও হয়ে যাবে। তারপরে বারান্দার ছাদে বসে সেই বাসনটা দু’হাতে ধরে দেওয়ালের সঙ্গে ঘষবে। বাটির মালিক হয়ত নিচে দাঁড়িয়ে তাকে ভোলানোর জন্য পেঁয়াজ দেবে, রুটি দেবে। তারপরে যখন বাঁদর মিয়াঁর পেট ভরে যাবে, তখন সে বাটিটা ছুঁড়ে দিয়ে নিজের রাস্তা দেখবে। নানি ঘড়া ভর্তি খাবারের টুকরো ঢেলে দেওয়ার পরেও হারামি বাঁদরটা তাকিয়া ছাড়ে না। নানা ভাবে তাকে ভোলানোর চেষ্টা করেও কোনও লাভ হল না। সে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত বালিশের খোল ছাড়াতে শুরু করল। সেই খোলগুলো যার সেলাই শক্ত করার জন্য নানি তার ক্ষীণদৃষ্টি চোখদুটি দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলে।
বাঁদরটা যেমন একটার পর একটা ওয়াড় খুলতে শুরু করল, তেমনই নানির আর্ত কান্নার রোল আরও তীক্ষ্ণ হতে লাগল। এইভাবে বাঁদরটা শেষ ওয়াড়টিও খুলে নিল। তারপরে সে ছাদের ওপর থেকে একটার পর একটা বালিশের ভেতরের জিনিসগুলো ফেলতে শুরু করল। বালিশের অভ্যন্তর থেকে তুলোর ডেলার বদলে তখন বেরোচ্ছে শাবহানের হাতখোলা জ্যাকেট, ভিস্তি বানুর গামছা, হাসিনা বি-র অন্তর্বাস, মুন্নি বি-র পুতুলের ঘাগরা, রহমতের উড়নি, খইরাতি’র ছোট প্যাণ্ট, খইরানের ছোট ছেলের খেলনা বন্দুক, মুন্সিজি’র মাফলার আর ইব্রাহিমের কামিজের কাফ-লাগানো আস্তিন, সাদিকের ধুতির টুকরো, আমিনা বি-র সুর্মাদান, বফাতানের কাজলদানি, সাকিনা বি-র রাংতার ডিবে, মুল্লাজির জপমালার সবচেয়ে বড় পুঁতিটি আর বকির মিয়াঁর নমাজ পড়ার আসন, বিসমিল্লাহ্র শুকিয়ে যাওয়া জন্মনাড়ি আর নান্হির প্রথম জন্মদিনের রঙিন সুতোয় মোড়া হলুদের গাঁট, একটু দূর্বা ঘাস আর একটা রুপোর আংটি। আর যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসার পরে বশির খানকে সরকারের দেওয়া একটা গিল্টি করা মেডেল।
কিন্তু কেউ ওইসব জিনিসগুলোকে দেখছিল না। তারা দেখছিল বহু বছর ধরে চুরি করা নানির জিনিসপত্রের সেই সংগ্রহকে।
‘চোর.....বেইমান.......হারামজাদি বুড়ি!’
‘একে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দাও!’
‘পুলিশের হাতে তুলে দাও!’
‘আরে ওর তোশকটাও খুলে দেখো! তার মধ্যে না জানি কত কী ভরে রেখেছে!’
যার মুখে যা এল সে তাই বলে গেল।
নানির তারস্বরে চিৎকার হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে, সে মাথা নামিয়ে, মুখ বুজে সেখানে দাঁড়িয়ে। তাকে কাটলেও যেন রক্ত বেরোবে না। সারা রাত দু’হাত দিয়ে হাঁটু দুটোকে জড়িয়ে ধরে কান্নার শুকনো হেঁচকি তুলতে তুলতে সে সামনে-পেছনে করতে করতে কাটিয়ে দিল। কখনও নিজের বাপ-মায়ের নাম নিয়ে, মিয়াঁকে স্মরণ করে আর বিসমিল্লাহ্-নান্হির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আর আফশোস করতে করতে রাত তো কাবার হল। কয়েক মুহূর্ত হয়ত ঝিমিয়ে পড়ল। তারপরেই যেন আবার পুরোনো ঘায়ে পিঁপড়ের কামড় থেকে জেগে উঠে বিড়বিড় করে কাঁদছে। কখনও হাপুস নয়নে কাঁদছে, আবার কখনও বা নিজের সঙ্গেই কথা বলছে, আবার হয়ত নিজের মনেই হেসে উঠল। কখনও পুরোনো কোনও স্মৃতি মনে এলে হয়ত বুড়ো কুকুরের মত অদ্ভুত আওয়াজ করে কাঁদতে কাঁদতে সে সারা মহল্লাকে চমকে দিত।
এই অবস্থায় দু’দিন কাটার পরে, পাড়ার লোকেরা ধীরে ধীরে তাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পেল। নানির তাকিয়ায় ভরা সে সব সামগ্রীর তো কারও কোনও প্রয়োজন ছিল না। বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সে জিনিসগুলোর কথা তো তারা ভুলেই গিয়েছিল। তারা নিজেরাই বা এমন কোন্ লাখপতি? একটা খড়ের ওজনও অনেক সময় কড়ি-বরগার চেয়ে বেশি হয়। তবু সে সামান্য জিনিসগুলোর জন্য তো তারা মরে যায়নি। শাবহানের সেই তুলো ভরা জ্যাকেটটা শীতে আর কোথায় আরাম দিত? আর জ্যাকেটের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শাবহানের তো আরও লম্বা-চওড়া হওয়া আটকে থাকেনি? হাসিনা বি তার সেই অন্তর্বাসটিকে অযোগ্য মনে করে তো ত্যাগই করেছিল। আর যে গুড়িয়ার মাটির পুতুলের ঢোলা পাজামাটি চুরি হয়েছিল, সে তো পুতুল খেলার বয়েস পেরিয়ে রান্নাবাটি খেলার মত বড় হয়ে গেল। পাড়ার লোকেরা এসবের জন্য কি নানির জান নেবে নাকি? আদি যুগে এক দৈত্য ছিল। সেই দৈত্যের প্রাণটি ছিল এক কালো ভ্রমরের মধ্যে। সাত সমুদ্র পেরিয়ে এক গুহায় একটা সিন্দুক ছিল। সেই সিন্দুকের ভেতর আরেকটি সিন্দুক। তার ভেতরে ছিল একটা ডিবে। সেই ডিবের মধ্যে একটা কালো ভ্রমর। এক বাহাদুর শাহজাদা এল। এসে সেই ভ্রমরের একটা পা ছিঁড়ে নিতেই জাদুর বলে দৈত্যের একটা পা খসে পড়ল। তারপরে শাহজাদা ভ্রমরের দ্বিতীয় পা’টাও ছিঁড়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে দৈত্যের আরেকটা পাও খসে পড়ল। এরপরে শাহজাদা ভ্রমরটিকে পিষে মেরে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে দৈত্যটাও মরে গেল।
নানির জান ছিল সেই তাকিয়ার মধ্যে। বাঁদর যখন নখ দিয়ে বালিশটা ছিঁড়ে ফেলল, তখনই কেউ যেন নানির বুকে গরম শলাকা বিঁধিয়ে দিল।
জগতে এমন কোনও দুঃখ, কোনও অপমান, কোনও বদনাম বোধহয় ছিল না যা নানির ভাগ্যে জোটেনি। স্বামীর মৃত্যুর পর যখন তার সোহাগের চুড়িগুলো পাথর মেরে ভাঙা হল, তখন সে জানত আর মাত্র কয়েকটি দিনেরই অতিথি সে। যখন বিসমিল্লাহ্কে চাদরে মোড়া হচ্ছে, তখন সে ভেবেছিল উটের পিঠে সেই শেষ খড়ের আঁটি। আর যখন নান্হি তার নানির মুখে কালি লেপে দিয়ে পালিয়ে গেল, তখন মনে হয়েছিল সেটাই শেষ মার।
জন্মের মুহূর্ত থেকেই তার রোগভোগের শেষ নেই। শুধু গুটি বসন্তই তো ওর মুখে সাত বার ঝাড়ু মেরে গেছে। প্রতি বছর উৎসবের সময় তার লেগে থাকত পাতলা দাস্ত।
আপনার-আমার বাড়ির গু-মুত ধুতে ধুতে আঙুলগুলোয় হাজা ধরে হাড় বেরিয়ে গেছে। জীবনভর বাসন মাজার কাজ করতে করতে হাত দুটি কাটাকুটির দাগে ভর্তি। বছরে কয়েকবার অন্ধকারে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে পড়ে যাওয়া তো আছেই। দু’চারদিন বিছানায় ওলোট-পালোট খেয়ে আবার ঘষটাতে-ঘষটাতে চলা শুরু। পূর্বজন্মে নানি নিশ্চয়ই কুকুরের গায়ের রক্তচোষা পোকা ছিল। তাই তার জান এত শক্ত। মরণের সাধ্য কী তার কাছে ঘেঁষে। শতচ্ছিন্ন কাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াবে, তবু মরা মানুষের কাপড় ছোঁবে না পর্যন্ত। কে জানে মৃত্যু যদি কাপড়ের সেলাইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে, আর আদর-যত্নে মানুষ হওয়া নানি’কে ধরতে আসে! কে জানত যে তার নিয়তি বাঁধা পড়েছে কয়েকটা বাঁদরের হাতে।
সাত সকালে ভিস্তি তার মশক নিয়ে জল ঢালতে আসে। সে দেখেছে নানি’কে টালি বাঁধানো সিঁড়ির ওপর উবু হয়ে বসে থাকতে। তার মুখটা হাঁ করা। দুয়েকটা মাছি তার চোখের কোণে উড়ে বেড়াচ্ছে। এর আগেও মহল্লাবাসী নানি’কে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়েছে। ভেবেছে যে সে মরে গেছে। কিন্তু নানি হামেশাই বিড়বিড় করতে করতে জেগে উঠত, গলা খাঁকারি দিয়ে কফ ফেলত। যে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাত, তারই ভাগ্যে জুটত বাছা বাছা গালিগালাজ।
কিন্তু সেদিন যে নানি সিঁড়িতে উবু হয়ে বসে থাকতে থাকতে আর দুনিয়াকে অজস্র গালাগালি দিতে দিতে কখন চলে গেছে, কেউ তা জানে না! জীবনে তার একটা দিনও সহজে কাটেনি। যেখানে বসেছে, সেখানেই অসংখ্য কাঁটা বিঁধেছে। নানির শব যখন কাপড়ে জড়ানো হচ্ছে, তখনও সে উবু হয়ে গুঁটিয়ে বসে। শত টানাহ্যাঁচড়া করেও সে শরীর আর সোজা করা গেল না।