• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৩ | জুলাই ২০২১ | গল্প
    Share
  • হারিয়ে যেও না : পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়


    বৈশাখ মাস। দুপুরগুলি প্রতিদিন নিয়ম করে রোদ্দুরে পুড়ছে। এরই মধ্যে আবার কোনো কোনো দিন মনে হয়, দিনদুপুর আর রাতদুপুরের কিছু তফাৎ নেই। সবচেয়ে বাউন্ডুলে কুকুরটিও বিকেল অব্দি কোথায় গায়েব হয়ে থাকে। যত দূরে চোখ যায়, যেন বিরাট একটি গর্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে চোখের আলো। কিন্তু চোখ যায়ও না বেশি দূর। তার আগেই ঝিলমিল করে ওঠে রোদের প্রতিরোধ। মাথাটা টলে যায়।

    যারা গ্রামে থাকে না তারা ভাবে এসব বুঝি অনেক পুরনো দিনের কথা। কিন্তু তিরিশ-চল্লিশ বছরেও একটি গ্রাম্য লোকালয়ে টুকটাক কিছু পরিবর্তন ছাড়া সব কিছুই প্রায় একই থাকে।

    খেয়েদেয়ে কোনো একটি বই নিয়ে বসা দোয়েলের মা-র সেই কত কালের অভ্যেস! আবার পড়তে পড়তেই তিনি একসময় ঘুমিয়েও পড়েন। মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি এখন আর পড়তে পারেন না। তাঁর চোখেও একটু সমস্যা হয়েছে।

    মা ঠিক কতক্ষণ ঘুমোবেন দোয়েল জানে। তিনি ঘুম থেকে ওঠেন খুব ভোর বেলা, তখন তাঁর নানা কাজ। আবার সেসব সারা হয়ে গেলেই তিনি আর নিয়ম বাঁধা কোনো কাজে হাত দেন না। সেলাই করেন, বই পড়েন, ঘুমোন। এই অবসরটি তাঁর নিজস্ব।

    মা ঘুমিয়ে পড়ার পরও দোয়েল কিছুক্ষণ পড়ে। মোটেও ইস্কুলের পড়া নয়। তার নিজের সংগ্রহে আছে নানারকমের কিছু কিছু বই। তাছাড়া গ্রামে একটি ছোটো লাইব্রেরিও আছে।

    পড়তে পড়তেই আজকাল একেক সময় সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। তখন আর কিছুই ভালো লাগে না। ইদানিং এটা বারবার হচ্ছে। এই সময় দোয়েলকে ভূতের চেয়েও সাংঘাতিক ভাবে চেপে ধরে কিছু মনখারাপ। সেগুলি বেশ অস্পষ্ট। তারপর অদৃশ্য একটা চুম্বক তাকে টেনে নিয়ে যায় একটি জায়গায়। রিনাপিসিদের পোড়ো বাড়ি।

    যে বাড়িতে মানুষ থাকে তার নানা দিকেই জেগে ওঠে পথের রেখা। রিনাপিসিদের ভিটেয় কিন্তু পৌঁছতে হয় বেশ কষ্ট করে। ঝোপঝাপ ভেঙে।

    মা-র ঘুম বেশ পাতলা, দোয়েল বেরিয়ে গেলেও তিনি জেনে যান ঠিকই। একেকদিন সরাসরি সে ধরাও পড়ে যায়। তখন দু-জন দু-দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করে। মার কাছে দোয়েলের লুকোনোর কিছুই নেই। রিনাপিসিদের বাড়ি যাওয়াও ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হয়ে আসছে।

    এক বছর হয়ে গেল দোয়েলের ইস্কুল নেই। পৃথিবীতে এরকম দিন খুব কম আসে। দোয়েল যে মানসিক কষ্টে আছে মা বোঝেন। এ এক এমন পরিস্থিতি যখন বন্ধুদের সঙ্গেও দূরত্ব রাখতে হয়। অশরীরীরাই বরং কাছে আসে। তাদের দিকেই বাড়াতে হয় বন্ধুত্বের হাত।

    ‘কিন্তু, রিনাপিসিরাও কি অশরীরী মা?’

    এই কথাটা এমন স্পষ্ট জিজ্ঞেস করতেই দোয়েলের ভয় হয়। মা যদি বলে বসেন, ‘ওমা শুনিসনি তুই, রিনারা যে কবেই –’

    থাক মা থাক, ওসব শুনে কাজ নেই।

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে শান্তিনিকেতনে একবার লীলা মজুমদার বলেছিলেন, ছোটোদের লেখায় রক্ত দেখাতে নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড়ো স্মৃতিকথার বইতেও তাঁর কোনো বন্ধু কিংবা আত্মীয়-বিয়োগের কথা নেই। তাই দোয়েল তাঁর এমন অন্ধ ভক্ত।

    দোয়েল বই ভালবাসে। বইয়ের কথায় দু-জনের অনেকটা সময় কাটে।

    একদিন মা বললেন, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কত বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখি, কিন্তু একটা বই এখন আর কোথাও নজরে আসে না। ‘মা আমার মা’। বইটা তুই পড়েছিস, দো?’

    দোয়েল বলল, ‘কই না তো! ওরকম নামের বই আছে নাকি তাঁর? নিশ্চয়ই দারুণ! আমার এখনো পড়া হয়ে উঠল না?’

    মা-ও একসময় বুভুক্ষু পড়ুয়া ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে দোয়েলের নেশা তিনিই ধরিয়েছেন।

    মা বললেন, ‘দশটি কিশোর উপন্যাসেও এমন ভালো বইটার জায়গা হয়নি। কী অন্যায় বল তো!’

    দোয়েল সেদিন থেকেই বইটা পেতে ছটফট করতে লাগল।

    আবার রিনাপিসিরাও রয়ে গেল সেই ছটফটানির ভেতর।

    একেকদিন বিকেলগুলো লাগে এমন অন্ধকার!

    ‘ও মা, মাগো, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না যে!’

    মা বললেন, ‘দুর পাগল, দেখতে পাবি কী রে! বেলা ডুবছে। এদিকে মেঘও এসেছে দস্যুর মতন।’

    ‘তোমায় যে দেখতে পাচ্ছি তবে?’

    ‘আমি উনুনের কাছে বসে, তাই।’

    মা-র মুখ থেকে বুকে পড়েছে আগুনের আলো। বাকি সব গেছে অন্ধকারের পেটে। এদিকে ঘরের চালে ফুটো। জানলার পাল্লা ভাঙা। পুরুষ মানুষ নেই বাড়িতে। কিন্তু বৃষ্টি না হয়ে যদি শুধু ঠান্ডা হাওয়া আসে তাহলেও আপশোস। ভাদ্র মাসের বৃষ্টি। তার কি ঠিক আছে কিছু! আবার কবে আসবে। আশঙ্কায় আকাঙ্ক্ষায় মা-র মুখ গনগন করছে। কখনো কুঁচকে যাচ্ছে নাকের কাছটা। নাকের ওপর একটি ঘামের বিন্দু। টলটল করছে। চারিদিক অন্ধকার আর মা একা আলোকিত বলেই এমনভাবে চাক্ষুষ হচ্ছে মা-র মুখের প্রতিটি রেখা।

    একটু সরে এসো না মা, আগুনের কাছ থেকে। লক্ষ্মী সোনা আমার! তবেই কষ্ট কমবে তোমার। ... হোলিকা রাক্ষসীকে বলবো আমি, সে যেন বোঝায় তোমায় – আগুন কেমন জ্বালায় তাকে, কেমন করে পোড়ায়! – দোয়েল বলছে খুব জোরে জোরে চেঁচিয়ে। তবে মনে মনে। কারণ মা-র মাথার দিকটা হলো শৃঙ্গ। অনেক উঁচুতে আছে। আর সে শুয়ে আছে মা-র কোলে। উপত্যকায়। জোরে না বললে মা শুনতেই পাবে না।

    মা কিন্তু অন্তর্যামী। কাজের ফাঁকেই পাশে হাত বাড়িয়ে সেই হাত দোয়েলের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘মা, না হোলিকা, নাকি রিনাদের ঘরবাড়ি – কার জন্যে যে তোর মনখারাপ – এখনো তুই বুঝতেই পারছিস না, তাই না রে, দো?’ একটু চুপ করে মা বলেন, ‘হোলিকার কথা তো আমি বেশি জানি না, কিন্তু বেচারা রিনারা ছিল সত্যিই অভাগী। কোনোদিন একটু আনন্দেরও মুখ দেখে যেতে পারল না মুখপুড়িরা।’


    দুই

    রিনাপিসিদের বাবা ছিলেন দারোগা। রিনাপিসিরা ছিলেন পাঁচ বোন। অনেক বয়স অব্দি কারুর বিয়ে-টিয়ে হয়নি। কে দেবে বিয়ে? দারোগার চাকরি থাকতেই হঠাৎ মারা গেলেন রিনাপিসিদের বাবা। তাঁদের আত্মীয় স্বজন কারুর সঙ্গেই ভাব ছিল না রিনাপিসির মা-র। বিয়েতে অনেক খরচ। আর কোনো উপলক্ষ্যেই খরচ করা তিনি দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না।

    রিনাপিসিদের বাবা চলে যাওয়ার পর দেখা গেল, টাকাপয়সা তাঁর কিছু নেই। কপর্দকশূন্য অবস্থা। যেটুকু যা ছিল – ঋণ-ধার, চিকিৎসা-খরচে উবে গেল।

    রিনাপিসির মা-র সংসারে পুরুষ-অভিভাবকের দরকারই হতো না। তিনি ছিলেন খুবই খান্ডার। ব্লাউজ পরতেন না জীবনে। বাহুগুলি সবসময় খোলা থাকত। বেশি বয়েসে ঢলঢল করত বাহুর মাংসপেশি। গরমের দিনে সবসময় ঘেমেনেয়ে হাঁসফাঁস দশা হতো তাঁর। বড়ো বড়ো কলেজে-পড়া তিনটে মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে মারতেন। ছোটো দুটিকে কুমড়োর মতন আছাড় দিতেন উঠোনে। রিনাপিসিরা প্রায়ই ছুটতে ছুটতে, কখনো রক্তাক্ত হয়েও, পাড়াপ্রতিবেশিদের ঘরে আশ্রয় নিত। তাঁদের মা মেয়েদের বলতেন, ‘সংসার চালাবার পয়সা আমি কোথায় পাই! কার ভরসায় এসেছিলে তোমরা পিথিমীতে? যে যেখান থেকে পারো রোজগার করো গে। তা নইলে, এ বাড়ি এখনো আমার – মাটির হোক আর যাই হোক তবু তো আমারই বাপের পয়সায় তোলা, মরো গে সব যেদিকে দু-চোখ যায়।’

    তাঁদের মা-কে রিনাপিসিরা যমের মতন ভয় পেতেন। সেই অবস্থায়ই কলেজে পাশ-টাশ করে, মরিয়া হয়ে টিউশানি করে রোজগারের চেষ্টা করত ওপরের দিকের তিন বোন – রিনাপিসি, মান্তুপিসি আর ক্ষমাপিসি। তাঁদের মা ঘরে মুড়ি ভেজে বেচতেন। কিন্তু পাড়াপড়শির সঙ্গেও তাঁর ব্যবহার বড়ো খারাপ ছিল। ঝগড়ার সময় কারও না কারওকে প্রায়ই বলতেন, ‘দাঁড়া না, মনে থাকে যদি, তোর মুড়ির সঙ্গে নির্ঘাৎ বিষ মিশবে।’ সেই ভয়ে মুড়িও বিক্রি হতো না তেমন।

    মা-র কাছে, বাবার কাছে, এবং আরও নানা লোকের মুখ থেকে শোনা কথাগুলি নিয়ে বিভোর হয়ে ভাবতে ভাবতে দোয়েল রিনাপিসিদের পোড়ো বাড়ির কাছে ঝুপসি বটতলায় একসময় নিজের হাত, পা – সমস্ত শরীর হারিয়ে ফেলে। সন্ধ্যা নামছে। বটতলার পরই এক প্রাচীন পুকুর। তার নামও পুরানো সায়র। বরফের মতন ঠান্ডা জল। পা ডোবালেই, ভরা গ্রীষ্মকালেও ছ্যাঁৎ করে ওঠে শরীর। এই পুকুরে একটিও পোকামাকড় কিংবা শালুক ফুলও নেই। কোনোদিন কোনো মাছকেও দোয়েল বুড়বুড়ি কাটতে দেখেনি। টলটল করছে স্বচ্ছ জল, অথচ জলাশয়টি প্রাণহীন?

    এই পুকুরে বিষক্রিয়া আছে, বাইরে থেকে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না।

    রিনাপিসিরা যতদিন ছিল, পুকুরটি ছিল তাদের তিন বোনের মন খুলে গল্প করার জায়গা। এই জলে একসময় দারুণ ডাল সেদ্ধ করা যেত, জল নিতে আসার সময়টির জন্য ওরা তিনজনে অপেক্ষা করে থাকতেন। মাঝে মাঝে সাঁতার কেটে বহুদূরে চলে যেতেন রিনাপিসি। ওর বোনেরা উতলা হয়ে ডাকতেন – ‘দিদি আর না। এবার ফিরে আয়, ফিরে আয়।’ রিনাপিসি হা হা করে হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে বলতেন, ‘মা-কে গিয়ে বলিস আমি আর ফিরব না।’

    বাবা এলেও রিনাপিসিদের গল্প নিজেই তোলেন আজকাল।

    বাবা থাকেন অনেক দূরের একটি ছোটো শহরে। মাড়োয়ারির গদিতে মুন্সির কাজ করেন তিনি। মাসে একবার ঘরে ফেরেন।

    বাবা সেবার মা-কে বললেন, ‘রিনাদের সবচেয়ে ছোটো বোন শিখাকে তোমার মনে পড়ে?’

    মা ভাত বেড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কেন পড়বে না। কী সুন্দর ফুটফুটে দেখতে ছিল শিখা! আহা, ভালো করে খেতে পেত না।’

    বাবা ভাত মেখে রেখেও খেতে পারলেন না। থেমে থাকলেন।

    দোয়েল তাঁর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, ‘বাবা, তুমি খাবে না?’

    বাবা বাঁ-হাত দিয়ে দোয়েলের চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললেন, ‘ওদের অভাবের কথা ভাবলেই মনটা কীরকম খারাপ হয়ে যায়। ওরা করত কী জানিস? ইচ্ছে করে দুপুরবেলা কারুর না কারুর ঘরে গিয়ে গল্প করত। অনেকেই বিরক্ত হতো। তা কি আর ওরা বুঝত না, বিশেষ করে ওপরের তিন বোন – রিনা, মান্তু আর ক্ষমা? ওরা তখন যথেষ্টই বড়ো, কলেজে যায়। কিন্তু খিদে এমনই জিনিস যে উপায় থাকত না। লজ্জা অপমান ওরা ভুলে যেত। দুপুরবেলা গৃহস্থের বাড়ি বসে থাকলে একসময় খাওয়ার কথা তো বলতেই হবে। এইভাবে ওদের খাওয়া জুটত। কোনোদিন বা জুটতও না।’

    মা-র চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরতে লাগল।

    বাবা সেদিকে তাকালেন না। বললেন, ‘শিখাটা ছিল সবচেয়ে ছেলেমানুষ। নতুন সায়র পুকুরে যখন শয়ে শয়ে মাটি কাটছে মানুষ, পুকুরটাকে আকারে আয়তনে আরও বাড়াবে বলে সরকারের ইচ্ছে, ঊননব্বই-নব্বই সাল – কতই বা তখন শিখার বয়েস, বড়োজোর আট-দশ – শীতকাল; সকলে চলে যাবার পরও দেখা যেত, পৌষের বাঘ-ঠান্ডায় মেয়েটা বসে আছে তো আছেই। হাতে একটা ক্রিসমাস কার্ড।’

    দোয়েল বলল, ‘কেন বাবা?’

    ‘তার চেয়েও বড়ো কথা’, বাবা বললেন, ‘ওদের যা অবস্থা সংসারের, ওরকম শখের জিনিস কেনার কথা নয়। এটা একটা রহস্যই।’

    বাবার এই কথায় মা-র মুখে সরু ফাটলের মতন হাসির রেখা দেখা দিয়েছে। তখন আর তিনি কিছু বললেন না অবিশ্যি।

    খাওয়া হলো না কারুরই ভালো করে। বাবা যখন একদিন-দু-দিনের জন্য ঘরে আসেন, গল্পে গল্পে রাত হয়ে যায় শুতে। এবার প্রায় সাড়ে এগারো বেজে গেল। বাবাকে কালকেই চলে যেতে হবে। রাত্তির থাকতেই। দোয়েল বাবার চলে যাওয়া দেখতে পাবে না। বাবা বলবেন, ‘কাঁচা ঘুম আর ভাঙাবো না মেয়েটার।’ দোয়েলের সঙ্গে বাবার দেখা হবে আবার সেই একমাস বাদে।


    তিন

    দোয়েলের শিয়রের কাছে জানলা। খোলা। ধূ-ধূ জ্যোৎস্নায় বহু দূর অব্দি দেখা যায়। নামোকুলি, বড়মা-দের ঘর, তারপর খেপি কালী মন্দিরের চুড়ো। খেপি কালী মন্দিরের পরে কিছুটা ছাড়া ছাড়া ঝোপজঙ্গল। এখন শুধু সেখান অব্দি চোখ যাচ্ছে। এরপর আছে আরও ঘন গাছপালা। মন্দিরে আর পুজোও হয় না। যাদের মন্দির তারা সব গাঁয়ের পাট উঠিয়ে চলে গেছে। আর আসে না। সেই কবে শেষবার নিরঞ্জন হয়ে ফিরে এসেছিল মা-র কাঠ-খড়ের কাঠামো, ভেঙেচুরে আজও রয়ে গেছে। বাবা-শিবের খড়ের হাত এলিয়ে মাটিতে নেমে এসেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শেয়ালের শরীর। আর পাথরের বিমর্ষ প্রদীপ, চিরস্তব্ধ শাঁখ।

    এই মন্দির নিয়ে নামকুলির লোকেরা একদিন উপরকুলির বাসিন্দাদের সঙ্গে দারুণ প্রতিযোগিতা করত। নামোকুলিই জিতে যেত সব বার। ওদের পাড়ার লোকেরা ছিলেন অবস্থাপন্ন। যারা বহু দূরের বড়ো বড়ো শহরে চলে গেছেন এখানে থেকে, তাঁদের কারুর সঙ্গে এই গ্রামের কারুর ফোনে কথা হলেই ওই কথায় তারা প্রাণখুলে হেসে ওঠেন। বড়ো আনন্দ পান।

    রিনাপিসিরাও বহুকাল হয়ে গেল, নেই। সে যাওয়া অবশ্য আলাদা। ঝড়ের মুখে কুচিকুচি কাগজের মতন একসময় তাঁরা কে কোথায় ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেছেন। তালাবন্ধ ঘর। মাটির কোঠা ধসেও পড়েছে অনেকখানি। খেপি কালী মন্দিরের জঙ্গল লম্বা সময়ের অজুহাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে রিনাপিসিদের উঠোনে উঠে এসেছে। রিনাপিসিদের উঠোন ক্রমাগত পিছু পিছু হটতে হটতে এখন এক কোণঠাসা দ্বীপ।

    কার যেন কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি সুগন্ধের মতন ভেসে ভেসে এল। ‘জাগরণ বলে কিছু কি আছে?/ ঘুমের মধ্যেই জেগে আছে মানুষ।’

    দোয়েল তো চোখ মেলেই আছে। তারপরও সে কি ঘুমন্ত? যে ঘুমিয়েই আছে চিরদিন, ওঠেনি – উঠবেও না, সে জাগরণ শব্দটা পেল কোথায়? তা ছাড়া একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে মা-ই তো তাকে বকেন।

    মা হঠাৎ কোথা থেকে বলে উঠলেন, ‘তা একটু-আধটু বকি বইকি।’

    শুনে দোয়েল অবাক হয়ে গেল। একে তো, এত রাতে মা তার বিছানায় এসে বসে আছেন বলে, তাছাড়া তার মনের কথা মা-র কানে গেলই বা কী করে! তারপরই আরও অবাক কাণ্ড। মা বলে বসলেন, ‘তোমার মনের কথা আমার কানে গেল কি করে এই তো?’

    মা দুষ্টুমি করে মিটিমিটি হাসছেন। বললেন, ‘তোর চোখ জড়িয়ে এসেছে। সে অবস্থায়ই বিড়বিড় করে বকে চলেছিস। আমি বসে বসে সেই কখন থেকে শুনছি। কিন্তু এই হিসেবে তো কবিতাটা আক্ষরিক ভাবেই ঠিক। ঘুমের ভেতর তোকে আর নতুন করে ঘুমোতেই হচ্ছে না।’

    মা-র ঘাড়ের কাছটা দু-হাতের আবেষ্টনীতে আলগা করে জড়িয়ে ধরে দোয়েল বলল, ‘ঠিক আছে, হয়েছে; কিন্তু তুমি কি জানো শিখাপিসি ক্রিসমাস কার্ড কোথায় পেয়েছিল সেবার?’

    মা বললেন, ‘উমম্‌ – একটা অনুমান তো লাগানোই যায়। তোর কৌতূহল ঠিক ইতিহাস জানতে চাওয়ার মতন। বেশ ধারাবাহিকতা আশা করে বসে আছিস তুই। কিন্তু ইতিহাসের মাঝে মাঝে অনেক ফাঁক থাকে। এরকম হলে কিছু কিছু জায়গা অনুমান দিয়ে জোড়া লাগিয়ে নিতে হয়। তাতে দোষ কিছু হয় না। যে ব্যাপার মানুষ মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সেখানে অনুমানগুলিও বিশ্বাসযোগ্য হয়।... তোর অসীমজেঠু ছিলেন না! তিনি থাকতেন হলদিয়ায়। প্রতিবার আসতেন পৌষমাসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বড়দিনের ছুটিতে। তোর অসীমজেঠুর মেয়ে কুসুম ছিল ওদের মান্তুর বয়সি। আর ছেলে সৌরভ শিখার। আসা মাত্রই পিকনিকের তোড়জোড়। রিনাদের পাঁচ বোনও থাকত। সৌরভের সঙ্গ ছিল শিখার খুব প্রিয়। একদিন সে শুনতে পায়, সৌরভের মা সৌরভকে হাতখরচের দুটো পয়সা দিতে দিতে বলছেন, ‘সব আবার শিখাকে খাইয়ে এসো না যেন।’ শিখা আড়ালে দাঁড়িয়ে পষ্ট শুনেছে সেই কথা। তবু সৌরভের ওপর তার রাগ নেই। সে যে ওর মা-র কথা শুনে ফেলেছে ঘুণাক্ষরেও সে সৌরভকে তা জানতে দেয়নি। আমরা ধরে নিতে পারি, সৌরভই শিখাকে ক্রিসমাস কার্ড দিত। একটা নয় দুটো করে। একটা থাকত ফাঁকা। একজন শুভেচ্ছা জানালে তাকেও তো শুভেচ্ছা জানাতেই হবে। যত কম দামই হোক ক্রিসমাস কার্ড কেনার পয়সা শিখার একটাও নেই। তাই সৌরভ তাকে বলে দিয়েছে, সে যেন ওই ফাঁকা কার্ডে ছবি-টবি এঁকে তার নামে উপহার দেয়।

    মধ্য রাত্তিরে অবাক হয়ে মা-র কথা শুনছে দোয়েল। শিখাপিসির চেয়ে মা অনেক বড়ো, তিনি তো বলবেন না সেই বয়েসে মা-কে এসব কথা। মা তবু এতদূর ভাবতে পেরেছে? মা যেন বহুদূর নির্জনতা পেরিয়ে আরও বহুদূরে এসে গেছে একা একা।

    দোয়েল কেন জানি অনেকখানি নতুন এক আরাম বোধ করল আজ। রিনাপিসিদের জন্য তারই শুধু মনখারাপ নয়, মা-র অন্তর জুড়েও তারা আছেন, প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে।

    মা বললেন, ‘তারপর শিখার সেদিন পুকুরের কাছে শীতের মধ্যে ওভাবে বসে থাকা নিয়ে কী বলা যায় জানিস! বলা যেতে পারে, শিখা তো তখনো ছেলেমানুষ, আবার ভীষণ সরলও, সে ভেবেছে বন্ধু সৌরভকে সে একটা নতুন স্নানঘাট উপহার দেবে। তাই রোজ বসে বসে সে দেখত কোন দিকটা দেওয়া যায়, কোন দিক বেশি সুন্দর।’

    দেখতে দেখতে রাত আরও বেড়ে গেল। দোয়েল মা-র মুখটা ধীরে ধীরে নিজের মুখের কাছে নামিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল, আর মা, হোলিকা রাক্ষসী?’

    দোয়েল তাকিয়ে আছে জানলার দিকে। দেখা যাচ্ছে আকাশ। অনেক উঁচুতে উড়ছে একটা এরোপ্লেন। ধকধক করে জ্বলছে লাল-সবুজ আলো।

    মা বললেন, ‘হোলিকার দিকে কোনোদিন তোর আগুনের তীর ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করেনি, সবাই বললেও না, তাই না রে দো?’

    দোয়েল চুপ করে থাকল।

    মা বললেন, ‘আমি জানি, করেনি।’

    দোয়েল মনে মনে বলল, ‘তুমি সব বুঝতে পারো, আমি না বললেও – আমিও জানি।’

    মা বললেন, ‘হোলিকাকে দেখে তোর মায়া হয়। রিনাদের উঠোনে সে দাউদাউ করে জ্বলে। ফাগুনের জ্যোৎস্নার ওপর কাঁপা কাঁপা হলুদ ছোপ পড়ে। তখন আর পিছন ফিরে তাকাতে নেই। সোজা চলে আসতে হয়। হ্যাঁ রে দো, রিনাদের উঠোনে সেই বন-শিমুল গাছটা আছে এখনো?’

    দোয়েল বলল, ‘কত কাল তুমি বাইরে বেরোওনি। একদিন বেরোবে দুই মা-মেয়ে মিলে?’

    তারপর বিছানার ওপর উঠে বসে বলল, ‘শেষবার কখন রিনাপিসিদের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল মনে আছে মা?’

    মা খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘অনেকটা আছে। অনেকদিন আগে এক সপ্তমী পুজোর দিন। আমি সেদিন রিনাকে দেখতে পেয়ে বলেছিলাম, এ কী রিনা, তুমি এখনো কাপড় ছাড়োনি? নামোকুলির পুজো যে হয়ে এল! যাবে না দেখতে? রিনা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না গো বউদি, তোমরা এসো গিয়ে।’ আমি কিছু না বুঝেই বলে ফেললাম, এ মা, কেন? শিখা দাঁড়িয়েছিল কাছে। সে তখন খুবই ছোটো, ন্যাড়া মাথা, সে হঠাৎ বলে বসল, ‘বড়দিদের তিনজনের শাড়ি-কাপড় তো কেনাই হয়নি। হয়েছে শুধু টুকিদিদি আর আমার।’ তারপর ঠোঁট উলটে বলল, ‘তাও মোটে একটা করে। একটুও ভালো না। ফ্রকটা পরতে গেছি, দুটো বোতাম ছিঁড়ে গেল।’ রিনা তার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাতেই সে অমনি পালিয়ে গেল। তারপর রিনা আমার দিকে চেয়ে ফিকে হেসে বলল, ‘পুঁচকে দুটোর জামা-টামা কেনার পরও আরও কিছু টাকা হাতে ছিল, জানো বৌদি। তাতে আমাদের তিন বোনের যেমন তেমন একটা করে শাড়ি হয়ে যেত। তবু তো নতুন বস্ত্র উঠত গায়ে। মা দিল না। বাড়তি টাকাটা রেখে নিল। আমাদেরই তিন বোনের টিউশানির জমানো টাকা। মা বলল, হ্যাঁ ভারী তো পুজো এখানকার। বোঝাই যায় না। সেই তো আর পাঁচটা দিনের মতোই সব। মা-র ওপরে আমরা আর কী বলি বলো! তোমরা তো সবই জানো।’

    মা চুপ করলেন। রিনাপিসিদের মুখের কথাও মা ওদের মতন ‘আমি-আমি’ করে বলছেন। সব কথা মা-র হুবুহু মনে আছে? কিংবা, যেভাবে যা হয়েছিল তার সঙ্গে মা-র আজকের কষ্ট হু-হু করে তাঁর অজান্তেই মিশে গিয়ে এ এক আশ্চর্য কথামালা হয়ে উঠেছে? রিনাপিসিদের জীবন একেকদিন একেক তারিখে যেখানে যেখানে থেমে গিয়েছিল, মা-র শুরু ঠিক সেখান থেকেই। একে তো ইতিকথা বলা যাবে না। এ যে ইতিকথার পরের কথা।

    জানলার ধারে মস্ত এক সেগুন গাছ। পাতা খসে পড়ল একটা। গাছেরা রাতেও ঘুমোয় না। সারা রাত ধরে পাতা খসায়, ফুল ফুটিয়ে রাখে। সকাল বেলা তাদের চুপচাপ দেখে মানুষ বুঝতেই পারে না গোটা রাত কী কাণ্ড তারা ঘটিয়েছে। তবু একেকটা রাত অন্যরকম। সব রহস্য যেন খুলে যায়। সেগুন গাছটা যেন দোয়েলের দিকে চেয়ে চেয়ে ফিক ফিক হেসে বলছে, ‘দেখলে, আজ কেমন ব্যক্তিগত হয়ে গেলাম তোমার সঙ্গে!’

    মা তার আগের কথার সূত্র ধরে বললেন, ‘তারপর আমি নিজেই বললাম রিনাকে যে সে যদি কিছু মনে না করে, আমার তো চারটে শাড়ি হয়েছে এবার – বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া তার মধ্যে দুটো – আমরা যদি চার বোনে চারটে ভাগ করে নিই – রিনা, মান্ত, ক্ষমা আর আমি – তাতে ক্ষতি হবে কিছু? রিনা সাংঘাতিক আপত্তি করল প্রথমে। অনেক করে রাজি করালাম। নিজে ওদের বাড়ি গিয়ে চুল বেঁধে দিয়ে এলাম। তিন বোনই কেঁদে ফেলল। রিনা বলল, ‘বউদি, আর কত সাহায্য করবে বলো তো তোমরা সবাই! ভাত তো প্রতিদিন চেয়েই খাই।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ চাপা দিয়ে বললাম, ‘গাঁয়ের মেয়েদের সুখে-দুঃখে থাকাটা কী এমন বড়ো কথা হয়ে গেল! ও কিচ্ছু না। সেই যাওয়া রিনাদের বাড়ি। হ্যাঁ রে দো, সেই কোঠাবাড়ির আর কিছু আছে বেঁচে?’

    দোয়েল রোজই দেখে, অনেকটা ধসে পড়েছে। তবু দুটো ঘর এখনো মোটামুটি টিকে আছে। তালাবন্ধ। তবে একটা ঘরের শেকল বেশ আলগা। দুটো কপাটের মাঝে অনেকখানি ফাঁক। এবার ফাল্গুন মাসে সবাই যখন হোলিকা দহন করে ফিরে যাচ্ছে, পিছনে তাকাবো না তাকাবো না করেও দোয়েল ঘুরে দাঁড়াল।

    পূর্ণদাদু তার কাছ দিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘থেমে থাকতে নেই, পিছন ফিরে চাইতে নেই। চ, চ।’

    দোয়েল বলল, ‘এই যাচ্ছি।’ বলেই লুকিয়ে পড়ল ঝোপজঙ্গলের মধ্যে।


    চার

    চারিদিক যখন জনশূন্য, সন্ধ্যা উতরে গেছে, দোয়েল বেরিয়ে এল।

    হোলিকার খড়ের শরীর ছাই হয়ে গেছে। পোড়া গন্ধ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঘুরছে-ফিরছে রিনাপিসিদের উঠোনে। মুখটা সম্পূর্ণ পোড়েনি হোলিকার। জীবনে এই প্রথম বোধহয় কেউ ফিরে এসে হোলিকার ক্ষয়ক্ষতি দেখছে। হোলিকা, তুমি অবাক হয়ে গেলে তো? তোমায় পুড়তে দেখেও ওরা আনন্দ করে। ওদের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। দোয়েল বলছে হোলিকার যন্ত্রণার কাছে দাঁড়িয়ে। বলতে বলতে তার চোখ ভরে গেছে জলে। হোলিকা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে শুধু। করালি ছুতোর কখন যে বানায় হোলিকাকে কেউ দেখতে পায় না। বলে নাকি দু-মাসের বেশি লেগে যায়। চোখ আঁকাই সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। চোখ দিয়েই তো ফুটে বেরোবে হোলিকার রাগ আর অবাক হওয়া ভাব। কৃষ্ণ-ঠাকুরের ভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে আগুনের ওপর বসে পড়েছে হোলিকা। আগুনকে সে মোটেও ডরাতো না। সে জানত, আগুন তাকে পোড়াবে না, এরকমই বর সে চেয়েছিল – পেয়েও গেছে। প্রহ্লাদের বাবা হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলছে, ‘ওরে ছেলে আর তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তোর কেষ্ট ঠাকুরও না। এবার তুই মরবি। আর হোলিকার গায়ে থাকবে না একটিও পোড়াদাগ।’ হিরণ্যকশিপু কী করে জানবে, অনিষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে আগুনে বসলে আগুন হোলিকাকেও ছাড়বে না! হোলিকার পাওয়া বরটার ভেতর এই শর্তটাও ছিল। হোলিকাও সেটা একদম ভুলে গেছে। যখন থেকে অগ্নিকুণ্ডে তার শরীরে জ্বালা ধরতে শুরু করেছে তখন তার একটু একটু করে অবাক হওয়ার পালা। কিন্তু কেন জানি, হোলিকাকে এতটা খারাপ দোয়েল কিছুতেই ভাবতে পারে না। এ নিশ্চয় তার অপবাদ। সে রাক্ষসী বলে সবার তার ওপর রাগ। সবাই চলে গেলে এই একা মেয়েমানুষ যে সারা রাত বসে বসে কাঁদে, তার বেলা?

    ধীরে ধীরে রিনাপিসিদের দাওয়ায় উঠে এল দোয়েল। দ্বীপের মতন অল্প একটু ফাঁকা জায়গাটা কিছুতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। সে যেন জেনেই গেছে, আজ নয় কাল ঝোপঝাড়ের ফৌজ এসে তার দখল নেবেই। সেই অপেক্ষায় শুধু দিন গোনা তার।

    একটা বাড়ি অনেকদিন ফাঁকা পড়ে থাকলে তাকে নিয়ে নানা রকমের ভূতের গল্প ছড়ায়। কিন্তু রিনাপিসিদের বাড়ির একটা সুবিধে রয়েছে। রিনাপিসিরা যতদিন এখানে ছিলেন, এই ঘরের কেউই অপঘাত কিংবা অসুখেবিসুখে মারা যাননি। রিনাপিসিদের বাবা মারা গিয়েছিলেন তাঁর কাজের জায়গায়। কাজের মধ্যেই।

    একদিন শুধু শেষবারের জন্য এসেছিল সাদা ধপধপে একটা ট্যাক্সি। একেবারে রিনাপিসিদের এই উঠোন অব্দি এসে উঠেছিল গাড়িটি। গ্রীষ্মকালের দুপুর খাঁ খাঁ করছে। পুরনো সায়র পুকুরে শুধু ছিপ ফেলে বসেছিলেন অমিয়জেঠু। তিনিই দেখেছিলেন একটা পুঁটলি নিয়ে রিনাপিসিদের মা তাঁদের ভিটেকে প্রণাম করে চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠছেন।

    এর আগেও রিনাপিসিদের বাড়ি নানা গাড়ি এসেছে গেছে। সব ক-টিই বরের গাড়ি। পোড়ো মন্দিরে মা কালীর ভাঙাচোরা কাঠামোকে সাক্ষী রেখে প্রতিবারই নির্জন নিস্তব্ধ দুপুরবেলা একেকটি বোনের বিয়ে। রিনাপিসির মা কারুকে ডাকেননি। গাঁয়ের মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। তিনি তো আর ভোজ খাওয়াতে পারবেন না, তাই কারুকে খবর দিতে লজ্জা পান, রিনাপিসিদের মা মুখে বলতেন এরকম। আসলে ভাবতেন, গাঁয়ের লোক বিয়ে ভেঙে দিতে পারে পাত্রপক্ষের কান ভাঙিয়ে। কেন এমন ভাবতেন তিনিই জানেন। গাঁয়ের লোক তাদের ভালোই চাইত বরাবর। পাঁচ মেয়ের বেলাতেই ঘটেছিল এরকম।

    রিনাপিসির বিয়ের সময় মা এসেছিলেন বাণী জেঠিমাদের সঙ্গে। সেবার বরং লোকজন হয়েছিল কিছু বেশি। দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মহিলাদের সবাই। কিন্তু মা-র ইচ্ছে ছিল, বিয়ের ব্যাপারে রিনাপিসির ইচ্ছে-অনিচ্ছে নিয়ে আলাদা করে কথা বলার।

    অমিয়জেঠু প্রভৃতির প্রশ্নের জবাবে – বিয়েতে রিনাপিসির মত থাকার – এবং কেউ তাঁকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে না শোনার পরেও মা-র মনে গভীর সন্দেহ ছিল রিনাপিসির কথাগুলি মন থেকে বলা কিনা।

    শেষের সেবার রিনাপিসিদের মা-কে গাড়িতে উঠতে দেখে অমিয়জেঠু উত্তেজিতভাবে এগিয়ে এসে তাঁকে বললেন, ‘মেয়েদের তো বিয়ের নামে কাকে কোথায় পাঠিয়ে দিলে গাঁয়ের লোকে জানতেই পেল না। তুমি নিজে এখন কোথায় চললে বলো তো? কেউ তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে না তো? বলো তো লোকজন জড়ো করি।’

    রিনাপিসির মা বললেন, ‘জোর করে আজকাল কি আর কেউ কারুকে কোথাও নিয়ে যেতে পারে ঠাকুরপো? থানা আছে, পুলিশ আছে, তোমরাও আছো। সবই আমার কপাল।’

    তারপর ড্রাইভারকে বিমর্ষ ভাবে বললেন, ‘চলো এবার, গাড়ি ছাড়ো।’

    সেই তাঁর শেষ যাওয়া।

    কতকাল আগের কথা এসব। দোয়েল তখনো পৃথিবীতে আসেইনি।

    হোলিকার পুড়ে যাওয়া মুখটাকে কেন জানি দোয়েলের রিনাপিসির মা-র মুখের মতন মনে হলো। তুমি কেন ইচ্ছে করে লোকের চোখে খারাপ হতে চাইতে দিদুন? কেন? মেয়েদের তুমি ভালোবাসতে না বললেই হবে! একটা টাকাপয়সা থাকত না তোমার হাতে, এদিকে ঘরে এতগুলি মানুষের পেটে জ্বলছে আগুন, তুমি নির্ঘাত লুকিয়ে কাঁদতে। কিন্তু তুমি ছিলে জেদি। রুক্ষ সেজে সব্বাইকে ঠকাতে তুমি। মা-র মতন সাংঘাতিক অন্তর্যামী মানুষও – যিনি সারা দিনরাত কত ভাবতেন তোমাদের নিয়ে আর জ্যোৎস্না, অন্ধকার, অবসর সবেতেই সর্বক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে থাকা একটি কান দিয়ে শুনতে পেতেন তোমাদের দুঃখ আর দুঃসময়ের পদধ্বনি – সেই তাকেও তুমি কোনোদিন তোমাকে চিনতে দাওনি? সত্যি দিদুন তুমি একটি জিনিয়াস। আর এই যে হোলিকাদেবী, তুমি রাক্ষসী না ছাই! দিদুন আর পৃথিবীতে নেই বটে কিন্তু তোমার দহনকে মোটেও ইতিকথা নয় বরং দিদুনের স্মৃতিকথাই মনে হয় হয়ে বেশি। সংসারের জ্বালাযন্ত্রণায় এত বছর পরেও তিনিই তো তোমার নামে পুড়ছেন।

    একদিন বাবাকে দোয়েল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রিনাপিসিরাও দেখত বাবা, ওদের উঠোনে একজনকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে?’

    বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘কাকে কষ্ট দেয়ার কথা বলছ তুমি – হোলিকাকে? কিন্তু হোলিকা তো রক্তমাংসের মানুষ নয় রে, দো। সে যে পুতুল!’

    দোয়েল জানে, বাবা তার খুব কাছের মানুষ। তবু তিনি তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারেন না। রিনাপিসিদের আর তাঁদের মা-র, হোলিকার – এদের সবার জন্য দোয়েলের ছোটো ছোটো মনখারাপ আর কষ্টের দিকে মা-র এমন একটা খোলা চোখ আছে যেটা আর কারুর নেই। কিছু বলে না দিলেও সব মা-র নখদর্পণে। হয়ত মা-র জগৎ খুব ছোটো বলেই তাঁর অনুভূতি এমন তীক্ষ্ণ।

    বাবাও বোধ হয় দোয়েলকে বোঝার চেষ্টায় খানিক চুপ থাকলেন।

    তারপর বললেন, ‘রিনারা যখন গাঁয়ে থাকত তখন হোলিকা-দহন হতো অনেক দূরে। ওদের উঠোন থেকে শুধু দেখা যেত কাঁপা কাঁপা আবছা আগুনের রেখা। তারপর কখন কীভাবে যে সেই দূরের আগুন ওদের উঠোনে চলে এল বাড়িটা চার-পাঁচ বছর ফাঁকা থাকার পরে, তা আমারও আর মনে পড়ে না।’

    দাওয়ায় পড়ে আছে দুটো মশাল। একটায় এখনো আগুন রয়ে গেছে। যেকোনো সময় লতাপাতায় লেগে যেতে পারে। দোয়েল তাড়াতাড়ি মশালটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। আর কোথাও দু-একটা রয়ে গেছে কিনা খুঁজে দেখল। না, নেই।

    রাধাকৃষ্ণ ঠাকুর সিংহাসনের ওপর চার কাঁধে চেপে হোলিকার কাঠ-খড়ের মূর্তিকে প্রদক্ষিণ করা অব্দি সকলকে মশাল ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতগুলি মানুষ, কারও মুখে কথা নেই, থমথম করছে চারিদিক। মানুষের কিংবা গাছপালার ছায়াগুলো কিন্তু শান্ত নয়। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় ছায়ারা ইচ্ছেমতন হুটোপাটি খেলছে।

    দোয়েল খুঁজছে একেবারে নির্দিষ্ট করে সেই জায়গাটা, যেখানে দাঁড়িয়ে রিনাপিসিদের মা চলে যাবার দিনে অমিয়জেঠুর কাছে কেঁদেছিলেন। অমিয়জেঠু আজ আছেন দোয়েলের কাছ থেকে ঠিক তিনটি লোকের পরেই। বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন এখন। তাঁকে একবার বলবে দোয়েল, জায়গাটা দেখিয়ে দিতে? যদি তিনি বলে বসেন, কী হবে জেনে? অথবা, তিনি ভুলেই গেছেন সেই ঘটনাটার কথা!

    এই উঠোনে আজ এত সমাগম। এরপর আর কেউ এক বছর এদিকে আর আসবেই না। ভুলেই যাবে রিনাপিসিদের উঠোন বলেও একজন আছে গ্রামে।

    এক সময় সনৎকাকু পুরোহিত বলে ওঠেন, ‘ভগবানের আদেশে এবার হোলিকাকে সবাই মিলে নিধন করুন।’ তখন, প্রথমে পূর্ণদাদু, অমিয়জেঠুর মতন বয়স্করা, তারপর ছেলেপুলে যারা এসেছে সবাই যে যার হাতের মশাল হোলিকার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই উলটো মুখে হাঁটতে থাকে। দেখা দেয় আগুনের প্রথম পুরুষ। তারপর বহু শিখায় জন্ম নেয় তার বংশধর। আজ হোলিকা দহন, কাল দোল উৎসব। হোলি খেলা।

    এবার বাবা ছুটি পাননি। দোয়েল একাই এসেছে। তাই তো লুকিয়ে পড়ার সু্যোগ হয়ে গেল।

    কোঠা ঘরটিতে মরচে ধরা তালা থাকলেও দরজা দুটির মাঝখানে অনেকটা ফাঁক। দাওয়া থেকে উঠে দোয়েল চোখ রাখে সেখানে। ভেতরটা অন্ধকার। ভালো করে কিছু দেখা যায় না। বেশি বেশি চেষ্টা করতে গিয়ে কপাটে লেগে নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে।

    ভেতরে কয়েদ হয়ে আছে রিনাপিসিদের আমলের সেই আদ্যিকালের বাতাস। তার সঙ্গে মিশে আছে রিনাপিসিদেরও নিঃশ্বাস। দোয়েল কুকুরের মতন নাকটা ভেতরে ঢুকিয়ে শ্বাস টানলো – আঃ!

    দোয়েল বিড়বিড় করে বলতে লাগল, রিনাপিসিদের নিঃশ্বাস, তোমাদের খুব কষ্ট হয় বন্দী হয়ে একা একা থাকতে, না? এই নাও, আমার নিঃশ্বাস তোমাদের দিলাম। সে-ও আজ থেকে তোমাদের বন্ধু।

    হঠাৎ দেখে, ঘরের অন্ধকারে ঝুলছে, রিনাপিসিদের তিন বোনকে দেওয়া মা-র সেই পুজোর শাড়ি। বেনে বউ পাখির মতন হলদে রং। আঁচলে লতাপাতা। ছোটো ছোটো তারাও বসানো। কে যেন দোয়েলের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কী করে বুঝলে এই সেই শাড়ি? মা-র সেই শাড়ি তো তুমি দ্যাখোইনি কোনোদিন। তুমি তো তখন আসোইনি মা-র ঘরে! দোয়েল খুবই বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, না এলেও আমি বুঝে গেছি। আর তোমাকেও চিনি। তুমি সবেতেই ফ্যাকড়া বাধাও। তুমি আমার মন। কিন্তু তুমিই সব নও। তোমারও আবার একটা মন আছে। তারপর তারও একটা। এই করে করে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড থেকে আসছে এই সংকেত। তারপরই দোয়েলের মনে হলো, দুর বাবা কী সব উলটোপালটা সে বকছে! মন নিয়ে মা-র ভাবনা কী সুন্দর! কত স্পষ্ট। দোয়েলের ধমক-খাওয়া মন বলল, হতে বাধ্য। কেননা, মা ভালো করেই জানে যে ভাবনা আমরাই গড়ি যত্নে। যেমন মা বেঁধে দেয় চুল মেয়ের। একটা কথা তুমি অবিশ্যি ঠিকই ধরেছো। মনের অনেক অণু-পরমাণু। অনেক প্রসার, বহু বিস্তার। ভাবনা নিয়েই দিনরাত আমাদের ভাবনা। আলোচনা। ধৈর্য। রাতজাগা। শেষে একটু ভালো ব্যবহার আশা করা কি অন্যায়? বেচারা মন যেন কেঁদেই ফেলবে। দোয়েল ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, না, না, ভুল হয়ে গেছে। রেগে গিয়েছিলাম এমনিই। এমনিও নয়। আসলে জ্বর এসেছে আমার। শিব্রাম চক্কোত্তি মশায়, তুমি যেমন কথায় কথায় বলো – আমার কিন্তু সত্যি সত্যি সেরকম ঘটছে। আমি জ্বর-জড়িত। জর্জরিত। না, না, ওই জ্বর-জড়িতই। ...তারপর তার আবার মনে হলো, উঁহু, এবার কিন্তু বাজে বকাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।


    পাঁচ

    মা দোয়েলের অবস্থা প্রথমে বুঝতেই পারেননি কিছু। দোয়েল ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘তোর সুবীরকাকু এসেছিলেন। বাবা কী পাঠিয়েছেন দেখবি যা। টেবিলে রাখা আছে।’

    সুবীরকাকু আর বাবা এক জায়গাতেই কাজ করেন। সুবীরকাকুর ঘর পাশের গ্রামে। বাবা নিজে না আসতে পারলে টুকটাক জিনিস তাঁর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দেন। আর প্রায়ই পাঠান হাত-চিঠি। বাবা জানেন, ফোনে কথা হলেও মেয়েটা তাঁর চিরকুটের অপেক্ষায় বসে থাকবেই।

    টেবিলের ওপর প্যাকেটে মোড়া একটা জিনিস। দেখেই বোঝা যায়, বই। শরীর যতই খারাপ থাক বই দোয়েলকে টানবেই। খুলে দেখে, মা-র বলে দেয়া সেই দুর্লভ হিরে। ‘মা আমার মা’ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আনন্দে উত্তেজনায় যেন টলে যায় সে। প্রত্যাশা মতোই হাত-চিঠিও আছে। এসব বাদেও আরও একটি মোড়ক। নতুন স্মার্ট ফোন।

    বাবা লিখে পাঠিয়েছেন –

    ‘প্রিয় বান্ধবী দো,

    ‘আমাদের ঘর তো আর আজকাল আমাদের নেই, রিনাদের হয়ে গেছে, তাই ভেবে দেখলাম, এবার যেভাবেই হোক ওদের এক বোনের অন্তত সেলফোন নম্বর জোগাড় করতেই হবে। তা খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম একেবারে রিনারই নম্বর। আমি নিজেই এতদিন জানতাম না, সোশ্যাল মিডিয়ায় হারিয়ে যাওয়া অনেককেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বাড়ি ফিরে বলব সব। নীচে রিনার ফোন নম্বর লিখে দিয়েছি। আমাদের ঘরের ফোনটা পুরনো। তাই ভালো ফোন কিনলাম একটা তোমার আর মা-র জন্য। রিনার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বোলো। মা পারবেন না ভিডিও কল। তুমি দেখেশুনে লাগিয়ে দিও। মা-কে প্রথমে ফোন দিয়ে তাঁর সঙ্গে রিনাকে কথা বলতে দিয়ে তারপর তুমি বোলো। মা কথা বললেই রিনা চিনতে পারবে। তাছাড়া আমি নিজেই কথা বলেছি রিনার সঙ্গে। ওরা সবাই ভালো আছে।

    তোমরাও ভালো থেকো। মা-কে দেখো।

    তোমার বন্ধু/তোমার বাবা’

    মা পিছনে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি হাসছিলেন। তারপর দোয়েলের কাছে এসে বুঝতে পেরেছেন তার অসুস্থতার কথা। উদ্বিগ্ন হয়েছেন।

    কিন্তু সেসব কিছু না। একটু দুধ সামান্য ভাত খেয়ে পরের দিন অব্দি দু-বেলা ঘুমিয়েই আবার সুস্থ হয়ে উঠেছে সে।

    এখন মা বলছেন, ‘রিনার সঙ্গে কথা বলবি দো? লাগা না ফোনটা একবার।’

    দোয়েল মা-র কোলে মাথা রেখে ফোন লাগিয়ে মা-কে দিল। তারপর উত্তেজনায় দুরুদুরু করতে লাগল বুক।

    ফোন বাজছে এবার – ক্রিক ক্রিক... ক্রিক ক্রিক... ক্রিক ক্রিক...

    এত দূর থেকেও জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই ঝুপসি বন-শিমুলের মাথা। এখনো সেখানে বিকেলের একটু আনমনা আলো। তার নীচেই রিনাপিসিদের ঘর।

    সেদিকে চেয়ে, বাবার চিঠির প্রতিধ্বনি করে খুব জোরে জোরে দোয়েলের বলতে ইচ্ছে হলো – রিনাপিসিরা ভালো আছে-এ-এ-এ ...



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments