স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় লোকটাকে প্রথম দেখেছিল পিঙ্কি আর তাতাই। একদম সাদামাটা দেখতে লোকটাকে। গায়ের জামাকাপড়ও ছেঁড়াফাটা আর হাতে একটা বিশ্রী দেখতে পিজবোর্ডের ঢাউস বাক্স। স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় যে বটগাছটা পড়ে সেই গাছের তলায় বসেছিল লোকটা। তবে জামাকাপড় ছেঁড়া হলে কী হবে পায়ে একটা রঙচঙে নাগরা জুতো! পিঙ্কি আর তাতাইকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল লোকটা। এখন মা-বাবা তো পইপই করে বলে দিয়েছেন যে অচেনা কেউ ডাকলে যাবে না তাই ওরা প্রথমে থমকে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু কাছে যায়নি। লোকটা ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল, “এসো না কাছে, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না!” তাও পিঙ্কি আর তাতাইয়ের সাহস হয়নি।
“আমার এই বাক্সে অনেক মজার জিনিস আছে! এসো দেখাবো!” লোকটা আবার বলেছিল।
তাও ওদের বিশ্বাস হয়নি।
“চল তাতাই!” বলে পিঙ্কি ভাইকে হিড়হিড় করে টেনেই নিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ওদের চোখগুলো লোকটার দিকেই ছিল। এমন সময় ওরা দেখল লোকটা বাক্সের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা টিয়া পাখি বার করে আকাশে উড়িয়ে দিল। পিঙ্কি আর তাতাই তাই দেখে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা দাঁড়িয়ে দেখছে দেখে লোকটা বাক্স থেকে আরেকটা টিয়া বার করে আকাশে ছাড়ল। ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। তবে আর দাঁড়ায়নি ওরা। বাড়ির দিকে ছুট দিয়েছিল।
পরদিন লোকটাকে আবার দেখেছিল ওরা। ঠিক একই জায়গায় গাছের তলায় বসে আছে। ওদের দেখে আবার মুচকি হেসে বলল, “দেখবে নাকি আজ আমার বাক্সে কি আছে?” বলে বাক্সে হাত ঢুকিয়ে দিল। বাক্স থেকে বেরলো দুটো আপেল, একটা কলা আর একটা কমলালেবু! সেগুলো নিয়ে খানিক লোফালুফি করে ওদের দিয়ে দিতে চাইল লোকটা কিন্তু ওরা কিছুতেই নেবে না! এর পরেই কেমন করে জানি লোকটার সঙ্গে ওদের ভাব হয়ে গেল।
পিঙ্কি আর তাতাই যা পায় চকোলেট টফি নিয়ে যায় লোকটার জন্যে আর তার বদলে লোকটা ওদের ম্যাজিক দেখায়। ওর ওই বিশ্রী দেখতে বাক্সটার ভিতর থেকে কত কী যে বের হয়! তবে ওরা দেখতে চাইলেও কোনদিন বাক্সটার ভিতরে দেখতে দেয় না ওদের রূপদর্শী। হ্যাঁ, ওটাই ওর নাম। ওর ওই দোমড়ানো মোচড়ানো পিজবোর্ডের বাক্স থেকে কখনও বের হয় খরগোশ, কখনও একটার সঙ্গে একটা বাঁধা নানা রঙের রুমাল, কখনও পায়রা, কখনও রঙিন ফুল। পিঙ্কি আর তাতাই মোহিত হয়ে দেখে। কখনও বটতলায় জাদু দেখায় সে বা সেখানে ভিড় থাকলে পুরনো ভাঙ্গা রক্ষাকালী মন্দিরের পিছনে।
ওরা জাদু দেখে বাড়ি ফিরলে মা রাগ করেন, বলেন, “কী এক উটকো লোকের সঙ্গে ভাব করেছে এরা দুজন! আমার তো খুব ভয় করে!”
বাবা বলেন, “আহা উটকো লোক কেন হতে যাবে? ও তো রূপদর্শী! ওদের ম্যাজিক দেখায়। আমি রানাদাকে জিজ্ঞেস করেছি। ওই যে কয়েকমাস আগে সার্কাসটা এসেছিল ও তাদের সঙ্গেই এসেছিল তারপর সার্কাস চলে গেল কিন্তু ও থেকে গেছে। বাচ্চাদের ভালবাসে ও, ওদের কোন ক্ষতি করবে না!”
বাবার মুখে ওই কথা শুনে পিঙ্কি আর তাতাইয়ের তো আরো পোয়াবারো। ওরা রূপদর্শীর কাছে সার্কাসের গল্প শুনতে চায়। রূপদর্শী খুব সুন্দর গল্প বলতে পারে। ওর গল্পে সার্কাস হয়ে ওঠে সুন্দর মায়াবী এক জগৎ।
তাতাই সেইসব গল্প শুনে বলে, “আআআমিও সা-সা-সার্কাসে যাব!”
তাতাইয়ের ওই এক অসুবিধা। বেচারা বড্ড তোতলায়। পিঙ্কি আর মা-বাবা ছাড়া সবাই ওর কথা শুনে হাসে। রূপদর্শী অবশ্য হাসে না। সে তাতাইয়ের সার্কাসে যাওয়ার কথা শুনে হাঁ হাঁ করে ওঠে, বলে, “সার্কাস দেখতে যাবে যেও কিন্তু খবরদার সার্কাস ঢুকো না! বড্ড কঠিন জীবন! এক জায়গায় থাকা যায় না। সব সময় খালি এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে হয়। খুব ক্লান্তি লাগে। তাছাড়া তুমি কেন সার্কাসে যাবে, বালাই ষাট! তুমি তো পড়াশোনা করে বড়ো মানুষ হবে!”
তাতাই ওর কথা কিছু বুঝতে না পেরে বলে, “ব্ব-বড়ো মানুষ?”
“হাঁ! অনেক বড়ো মানুষ!”
তাতাই একটু ভেবে বলে, “খুখুব ল-লম্বা? মামা খুব ল-ললম্বা!”
রূপদর্শী হেসে ফেলে, “না, না, লম্বা নয়! মানে লম্বাও হতে পারো ক্ষতি নেই তবে আমি বলছিলাম মনের দিক থেকে বড়ো মানুষ। সেটা কী তোমরা এখন বুঝবে না। আচ্ছা এসো একটা ম্যাজিক দেখাই!” বলে নিজের ধুরধুরে পিজবোর্ডের বাক্সটা থেকে এক গোছা রঙিন ফুল বার করে ফেলে। সব ভুলে জাদুর জগতে চলে যায় পিঙ্কি আর তাতাই।
রূপদর্শী তাতাইকে একদিন বলল, “আমি তোমাকেও একটা জাদু শিখিয়ে দেব তাতাই দাদাভাই। দেখবে তুমি ঠিক সুন্দর করে কথা বলতে পারছ!”
শুনে তাতাই তো খুব খুশি।
তারপরেই গণ্ডগোলটা শুরু হল। সেদিন রাতে গোবর্ধনের দোকানে চুরি হল। গোবর্ধনের একটা মুদির দোকান আছে। ভালোই চলে দোকানটা। অনেক বাঁধা খদ্দের আছে ওর। সেদিন রাতে যখন দোকানটা বন্ধ করছিল গোবর্ধন তখন একজন মুখোশ পরা লোক দোকানে এসে হাজির। শীতের রাত তাই দোকানে আর কেউ ছিল না। কর্কশ স্বরে লোকটা গোবর্ধনকে বলল, “টাকাকড়ি যা আছে সব আমাকে দিয়ে দে নাহলে এই বন্দুক দিয়ে তোর পেট ফুটো করে দেব!”
গোবর্ধন ভয় পেয়ে তাকিয়ে দেখল লোকটার হাতে সত্যিই একটা বন্দুক ধরা! তাও অতগুলো টাকা এক বদমাইশের হাতে তুলে দিতে ওর মন চাইছিল না। সে দেরি করছে দেখে লোকটা বন্দুকের বাঁট দিয়ে সজোরে এক ঘা মারল গোবর্ধনের কপালে। যন্ত্রণায় ‘উফফ' করে উঠল গোবর্ধন। রক্ত পড়তে লাগল কপাল থেকে। কাঁপা হাতে সে ক্যাশবাক্সের চাবিটা লোকটাকে দিয়ে দিল। দোকানের সারাদিনের যত আয় সব টাকা নিয়ে লোকটা পালিয়ে গেল।
পরদিন এলাকা জুড়ে হইচই। গোবর্ধনের মাথায় ঢাউস পট্টি বাঁধা। সবাইকে ফলাও করে ডাকাতির গল্প বলছিল সে। এদিকে গোবর্ধনের ভাগ্নে কালুয়া রটিয়ে দিল যে মামা দেখেছেন যে লোকটা ডাকাতি করতে এসেছিল তার পায়ে রঙচঙে নাগরা জুতো ছিল, ঠিক যেমনটা রূপদর্শী পরে! সবাই তখন বলাবলি করতে লাগল তাহলে কী...? কথাটা আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়ল। গোবর্ধনকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, “হ্যাঁ, রঙচঙে জুতো ছিল বটে লোকটার পায়ে!”
ক্রমে পুলিশের কানেও গেল কথাটা। দারোগা সত্যপ্রকাশ বটতলায় এসে হাজির হলেন রূপদর্শীকে ধরতে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার তাকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না।
সবাই বলতে লাগল, “সব টাকা নিয়ে ভেগেছে লোকটা! এটাই নিশ্চয়ই ওর মতলব ছিল!”
তাতাই তো খুব ছোট সে তেমন কিছু বোঝে না কিন্তু পিঙ্কি বোঝে, ওর খুব কষ্ট হল কথাটা শুনে। সে তো জানে রূপদর্শী চোর নয়, সে কোনদিন কাউকে মেরে তার টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে না!
বিকেলে তাতাই মুখ ভার করে বসেছিল এমন সময় পিঙ্কি ওকে ফিসফিস করে বলল, “চল তাতাই আমরা রক্ষাকালী মন্দিরের পিছনটা একবার দেখে আসি।”
যেমন বলা তেমনি কাজ। দুই ভাই বোন ছুটতে ছুটতে সেখানে গিয়ে হাজির। প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না, তারপর একটু ভালো করে খোঁজাখুঁজি করতে ঝোপের পিছনে রূপদশীর বাক্সটাকে দেখতে পেল ওরা। তাতাই তো বাক্সটা দেখতে পেয়ে মহানন্দে সেটার ওপর বাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু বাক্সটা খুলে ভিতরে কিছুই দেখতে পেল না ওরা! যে বাক্সটার ভিতর থেকে কত রকমের জিনিস একে একে বার করত রূপদর্শী সেই বাক্সটা কিনা একেবারে খালি! না, অবশ্য একেবারে খালি বললে ভুল হবে, একটা চিঠি ছিল ওটার মধ্যে।
তাতাই পড়তে পারে না তাই পিঙ্কিই পড়ল চিঠিটা। রূপদর্শী লিখেছে, “আমার ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা যখন এই বাক্সটা খুঁজে পাবে তখন আমি অনেক দূরে চলে গেছি। আমি যেতে চাইনি। তোমাদের এখানেই থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার কপাল মন্দ তাই থাকতে পারলাম না। ওই মুদির দোকানে ডাকাতি কে করেছে আমি জানি না কিন্তু তোমাদের বলে দিতে চাই যে ও কাজ আমি করিনি। হয়তো কোনদিন আসল অপরাধী ধরা পড়বে। তোমরা ভালো থেকো আর খুব বড়ো মানুষ হয়ো। হয়তো কোনদিন আবার দেখা হবে, বলা তো যায় না!”
তাতাই কাঁদছিল। ও তো বোঝে না কিছু। ও ভাবত ওই বাক্সতেই সব জাদু তাই খালি বাক্স দেখে সে খুব হতাশ কিন্তু পিঙ্কি জানে বাক্সটাতে কোন জাদু নেই, ছিলও না কোনদিন। জাদু ছিল রূপদর্শীর কথায় আর হাতে।
পিঙ্কি ঠিক করল সে রূপদর্শীর চিঠিটা যত্ন করে রেখে দেবে। তাতাইয়ের পড়ার মতন, বোঝার মতন বয়স হলে ওকে দেখাবে।
কিছুদিন পরে রূপদর্শীর মতন রঙিন জুতো পরে নরেশের দোকানে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল কালুয়া। পুলিশের কাছে সে স্বীকার করল যে নিজের মামার দোকানে ডাকাতিও সেই করেছিল।
পিঙ্কি আশা রাখে যে কালুয়ার ধরা পড়ে যাওয়ার খবরটা পেলেই রূপদর্শী আবার ফিরে আসবে। তাতাইকেও সেটাই বলেছে ও।