The Avadh Punch—Wit & Humour in Colonial North India-—Mushirul Hasan; Niyogi Books, NewDelhi-110020; First published Aug 2007; ISBN: 978-81-89738-18-1
অধ্যা. মুশিরুল হাসান সাহেবের কোনো একটাও বই পড়ে কম-খুশি হয়েছি, মুগ্ধতা কিছু কম হয়েছে—এমনটা মনে পড়ে না। বর্তমান গ্রন্থটি পড়ে, তথা বারংবার পাতা উল্টোতে উল্টোতে ও ছবি দেখতে দেখতে এত অফুরান আনন্দ পাওয়া গেছে, যার তুলনা মনে আসছে না চট করে।
এর প্রধান কারণটা যদি হয় কার্টুনগুলির অসাধারণ মান ও সম্পাদকীয় মুন্সিয়ানা [প্রত্যেক উর্দু ভাষ্যের পাশে পাশে ইং তর্জমা দেওয়া রয়েছে, ব্যাখ্যা সমেত], তো দ্বিতীয় কারণ হলো এই কলমচির সম্পূর্ণ অজ্ঞতা!
সেটা কী রকম?
যেমন, মনে করুন না , জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক বাঁকে দেখলেন রয়েছে চমৎকার এক জলপ্রপাত যার জলের ছিটেয় রামধনু খেলে যাচ্ছে! বা, তৃষ্ণার্ত কোনো পথিক কি অচানক এক মরুদ্যানের আবিষ্কারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বে না? এ’বই পাঠের অনুভূতিটা সেই রকমই। কারণ এই গোত্রের একটা পত্রিকা—নাম যার ‘অওধ পাঞ্চ’— যে আদৌ ছিল, সেটাই জানতাম না আগে।
**
আসলে, আমরা বাঙালিরা এটা ভাবতে বেশ গরব অনুভব করি যে ‘হিন্দু কালেজ’ [১৮১৭ খ্রি.]-এর প্রতিষ্ঠা ছাড়াও নেকাপড়া-কাগজকলমের আঙিনায় ‘আধুনিক’ ভারতে যা যা কিছু প্রথম ঘটেছে—তা হিকি-সাহেবের ‘বেঙ্গল গেজেট’ [১৭৮০ খ্রি.] হোক্ বা, প্রথম হিন্দি দৈনিক ‘উদন্ত মার্তণ্ড’ [১৮৩০ খ্রি.]—সে-সবই হয়েছিল আমাদের এই কলকেতা শহরেই।
সেখানে, লক্ষ্মৌ-র মতো এক খানদানী নবাবী শহরে ১৮৭৭-এ বেরোলো এক কার্টুন-পত্রিকা—যার গুণ-মান-পৌঁছ্ আজও মাতোয়ারা করে দেয় পাঠককে—এটা এই অর্বাচীন কলমকারের কাছে এক অবাক-করা সংবাদই বটে!
এবং কী মান সেই কার্টুন ও লেখাজোকার! সেখানে যেমন আছে ‘ভারত-মাতা’ , ‘কাশ্মীর দুর্ভিক্ষ’ বা ‘তিব্বত ও দলাই লামা’–র উপর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন, তেমনই রয়েছে ‘মর্লে-মিন্টো সংস্কার’-এর উপরেও ঘোর রাজনৈতিক ছবি ও লেখাজোকা।
নির্ভীক, উন্নতশির, মজাদার!
প্রাণভরে দেখতে হয়, মন খুলে তারিফ করতে হয়।
**
লন্ডন থেকে প্রকাশিত [প্রথম প্রকাশ ১৮৪১ সাল] জগৎবিখ্যাত কার্টুন-পত্রিকা ‘পাঞ্চ’–এর নাম কে না জানে? সেই ভাগীরথী-পত্রিকার ধারা বেয়ে [পড়ুন, ‘অনুপ্রাণিত হয়ে’] বিশ বছর বয়সী এক লক্ষ্মৌভী নওজওয়ান মুন্সী সাজ্জাদ হুসেন [১৮৫৬-১৯১৫ খ্রি.] বের করে ফেললেন এই সাপ্তাহিক ‘আওধ পাঞ্চ’ কার্টুন-পত্রিকা । বিশ বছরের মধ্যে এই পত্রিকা বম্বে-কলকাতা-লাহৌর থেকে প্রকাশিত অনেক নামী-দামী পত্রিকাকে টেক্কা মেরে সার্কুলেশনের শীর্ষে ওঠে! না, কোনো তেল-মারা বা পিঠ-চুলকানো লেখা-ছবি নয়, আগাগোড়া ব্রিটিশ সরকারের বিদ্রুপ-সমালোচনা করেই এগিয়েছে এই ‘আওধ পাঞ্চ’ পত্রিকা; এবং তুলোধোনা করতো নকলনবীশ দিশি ভারতীয়া-আংরেজদেরও। সাজ্জাদ হুসেনের এন্তেকালের পরেও, ১৯৩৬ পর্যন্ত নব কলেবরে রমরম করে চলেছিল এই পত্রিকা।
কে না লিখেছেন এই পত্রিকায়? উর্দুসাহিত্যের রথী-মহারথীরা—কবি আকবর এলাহাবাদী, রতননাথ সরশর, ত্রিভুবননাথ হাজিরা থেকে নবাব সৈয়দ মহম্মদ আজাদ, মাচ্ছু বেগ সীতম সাহেব প্রমুখ [সত্যি বলছি, এঁদের সম্বন্ধে কিচ্ছু জানতাম না। এখন এই বইটা পড়ে আর নেট-ফেট ঘেঁটে/জেনে অবাক হয়ে যাচ্ছি! ]। আর বর্তমান বইটির সম্পাদক মুশিরুল হাসান সাহেবের মুন্সিয়ানা হলো এই যে উর্দুভাষা না জানলেও ইং-তে লিখিত ওঁর সহজ-সরল ও রংদার মন্তব্যের মাধ্যমে ষোলর উপরে আঠারো আনা ওঠাতে পারবেন এ’ পুস্তকপাঠের আনন্দ।
**
হাস্যরস যে সাহিত্যের একটি মহৎ রস—এ’ তো সর্বমান্য। অতি প্রিয়ও বটে। তাই না আজও ইং-সাহিত্যে জারোম কে জারোম বা বাংলায় শিব্রাম চক্রবর্তী মশাই এত জনপ্রিয়। তার ওপর আবার লেখার সঙ্গে যদি ছবিও যুক্ত হয় তবে তো সোনায় সোহাগা। কার্টুন, তাই, চিরকালের সোর্স অব্ জয়! তাই না আর. কে. লক্ষ্মণ-সাহেবের কোনো এক কাজ দেখে আজও হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠতে হয়। একাত্তর সংখ্যায় [https://www.parabaas.com/PB71/LEKHA/brBhababhuti71.shtml] মারাঠী কার্টুনিস্ট শিবরাম ফাড়নীসের কথা পড়েছিলাম আমরা। কার্টুন যে ভাষা মানে না, সময় জানে না ! তাই তো মারাঠী হোক্ বা উর্দু—‘অওধ পাঞ্চ’-এর মতো পত্রিকা হয়ে ওঠে অপার আনন্দের উৎস ।
আলোচ্য বইটি তাই মাথায় করে রাখি।
**
পাঠশেষে একটাই অনুযোগঃ
যে ডিটেইলস নিয়ে এখানে হাস্যরসের লেখকদের [ভাষ্যকার] আলোচনা করা হয়েছে, ওয়াজীর আলি বা লালবাহাদুর মুশাওয়ারের মতো আঁকিয়েদের উপরে ততটা বিস্তারিত আলোচনা নেই, যদিও সেকালে গগন ঠাকুর ব্যতীত আর কে এই মানের কার্টুন ছবি এঁকেছেন, জানি না।
**
শেষে, দিল্লির বাঙালি প্রকাশক ‘নিয়োগী বুকস’-এর উদ্দেশে মাথার টুপি না খুললে ঘোরতর অন্যায় হবে। ভারতে বড়সড় সাইজের পিকটোরিয়াল বুকস্-এর পথিকৃৎ এনারা। অসাধারণ করেছেন এই বইটি [31 cm X 21 cm. সাদাকালোয়]। ভূমিকাতে বইখানির অনামী সম্পাদিকা দীপা চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছেন লেখক হাসান-সাহেব। কুর্নিশ জানাই তাঁকেও—বইটির অসাধারণত্বের খাতিরে।
ভাগ্যিস করেছেন এ’ বইখানি, নইলে ‘অওধ পাঞ্চ’-এর কথা জানতাম কী করে?
বাংলা সাহিত্যে জরুরি অবস্থার প্রতিফলন—ঐশিক দাশগুপ্ত; অভিযান পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৯; ISBN 978-93-87575-88-2
তরুণ লেখক ঐশিক দাশগুপ্ত আদতে ছাত্র বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের, যিনি যে বিষয়টির উপরে পি.এইচ.ডি. করেছেন সেটি কিন্তু আদ্যন্ত রাজনৈতিকঃ ‘জরুরি অবস্থা’। বর্তমান গ্রন্থটি তাই, সম্ভবত, ওঁর থিসিসের উপরেই আধারিত। ব্লার্বে এই তথ্যটি জেনে বইটি খরিদে আকৃষ্ট হই, এবং না, আশাহত হইনি।
এই বিষয়টির উপরে বাংলায় আগে লেখালেখি হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।
**
ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত রোষে ঘোষিত ‘ইমারজেন্সি’ (১৯৭৫-১৯৭৭) ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক দগদগে ঘা, যেমনটা কিনা বিন-তুঘলক থেকে ব্রিটিশরাজ—কেউই করতে পারেনি। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি নির্মল মুখার্জী (শেষ আই.সি.এস.) অবশ্য সেই মিটিঙে সরাসরি বলেও ছিলেন যে, ‘ম্যাডাম গান্ধী, আপনার ব্যক্তিগত রাগের কারণে সারা দেশটাকে ভোগাবেন কেন?’ [শাস্তি’ও পেয়েছিলেন সেজন্য । যাক্ সে গল্প।] বস্তুত, এই প্রাচীন দেশে নির্বাচিত শাসকের দ্বারা যে এ’হেন নিষ্ঠুর ও কণ্ঠরোধী ঘটনা ঘটতে পারে—এটাই ছিল চিন্তার বাইরে । কিন্তু সেটা ঘটেছিল; এবং চলেছিল প্রায় দুই বৎসর ধরে। এটাই আশ্চর্য। কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। ইন্দিরার ইমারজেন্সি!!
**
জরুরি অবস্থার স্বরূপ/বিবরণ/পিঠ-কথা—কিছুই আজ আর অজানা নয়। ইংরিজিতে কুমি কাপুর থেকে কুলদীপ নায়ার, বা বাংলায় বরুণ সেনগুপ্ত প্রমুখ অনেকেই ইমারজেন্সির বীভৎস কাহিনী লিখে গেছেন। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম চারটি অধ্যায় জুড়ে সে-সব ঘটনাবলীর রি-ক্যাপ চট করে পড়ে নেওয়া যেতে পারে।
**
যদিও গ্রন্থের মূলে প্রবেশ তার পরে।
৫ম-৬ষ্ঠ-৭ম অধ্যায় জুড়ে তৎকালীন বাংলা ছোটগল্প-উপন্যাস-কবিতার মধ্যে দিয়ে কীভাবে ‘জরুরী’-যন্ত্রণার প্রকাশ করেছেন বাঙালি লেখককুল—তা-ই বর্তমান গ্রন্থখানির প্রধান উপজীব্য, এবং তথায় যথেষ্ট সফল এই নবীন লেখক।
আবুল বাশারের ‘অগ্নিবলাকা’ উপন্যাস, জয়া মিত্রের ‘হন্যমান’, শঙ্খ ঘোষের ‘সর্বনাশের গাথা’ কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি এই সময়ের উপরেই, এবং উপযুক্ত স্থান পেয়েছে এ’বইয়ে। উল্লেখ থাক্, এই সময়কালটির অব্যবহিত আগেই, প.বঙ্গে নকশাল-আন্দোলনকালে অসাধারণ সব প্রতিবাদী-সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল (যার পাঠ দুর্লভ নয়), এবং বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য বা শৈবাল মিত্রের মতো বেশ কিছু মান্য সাহিত্যিক এই দুই রচনাকালেই আছেন। আছেন এই বইয়েও।
**
এক বিস্মৃতপ্রায় কবিতার উল্লেখ এখানে করবার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ
ঘাস খাবে না, কচু খাবে না, ভাত চাইছে খোকা
পুলিশ ডেকে জলদি ওকে জেলখানাতে ঢোকা
পরীক্ষা কর এর পরে ওর লালা এবং গ্রন্থি
ব্যাটা বোধহয় এ’দেশী নয়, —সিওর উগ্রপন্থী।[কবিতাঃ ‘ঘাস খাবে না’—কবি সৃজন সেন]
না না, এ’কবিতা ২০২০-এর দশকে লেখা হয়নি, ১৯৭০এর দশকে! বর্তমান গ্রন্থে ঐশিক উল্লেখে এনেছেন কবি সৃজন সেনের ‘থানা গারদ থেকে মা-কে’ কবিতার কয়েকটি অসামান্য ও উপযুক্ত লাইন। [পৃ. ১৭৬] উৎসাহী পাঠক পড়ে নেবেন।
মহাশ্বেতা দেবী, গৌরকিশোর ঘোষ, শঙ্খ ঘোষ তো পরিচিত প্রতিবাদী লেখক। বারে বারে এসেছেন তাঁরা এ’সংকলনে। তেমনই বেণু দাশগুপ্ত-বিপুল চক্রবর্তী-তপোবিজয় ঘোষের মতো স্বল্প-বিখ্যাতরাও আছেন। উৎসাহী পাঠক আরও আরও পাঠ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন বর্তমানেরটি থেকে।
শেষে ‘গ্রন্থপঞ্জী’-র ভাণ্ডারটি বেশ পুষ্ট ও কাজের।
**
প্রকাশনার মান উত্তম। মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি।
তবে শেষে একটা অপছন্দের কথা বলিঃ বহু বহু স্থানে লেখকের অতি অতি দীর্ঘ বাংলা বাক্যগঠন পাঠকটু লেগেছে। তেমনই মানি না ‘জনতা আমল’-এর উপরে লিখিত শেষ অধ্যায়ে [‘পরিশিষ্ট’, পৃ. ১৮৭-১৯০] লেখকের অনেকানেক মতামত।
গত দিনের যত কথা—কল্যাণী দত্ত; ‘থীমা’ প্রকাশনালয়, কলকাতা-১৮; প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৮; ISBN 978-93-81703-72-4
না, ওঁর কথা বলা শেষ হবে না। তিনি যে হলেন ‘মা’!
৫৪(চুয়ান্ন) [https://www.parabaas.com/PB54/LEKHA/brBhababhuti54.shtml ] এবং ৫৯(ঊনষাট) সংখ্যায় ওঁর দু’টি অনবদ্য বইয়ের কথা বলতে পেরে ধন্য হয়েছিলাম। আর, বর্তমান বইটিতে যে দুটি ‘মুখবন্ধ’ ও ‘ভূমিকা’ পড়লাম, কোনো এক বাংলা বইয়ে এত সু-উপযুক্ত ও উচ্চমানের প্রাক্-কথন আগে কখনও পড়িনি। লেখিকাদ্বয় কল্যাণী ঘোষ ও রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায় হলেন কল্যাণী দত্তের বন্ধু-কাম-সহকর্মী ও ছাত্রী। একজন নিরভিমানী সুপণ্ডিত প্রচারবিমুখ গুণীর লেখার সাথে পরিচিতি কীভাবে ঘটাতে হয়—সেটা শিখতে হবে এঁদের কাছ থেকে।
**
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপিকা কল্যাণী দত্ত (১৯২৭-২০০৩ খ্রি.) আজীবন দক্ষিণ-কলিকাতার অনামী কলেজে পড়িয়ে এসেছেন। ১৯৯২-তে চাকুরি থেকে রিটায়ার করবার পরে ওঁর প্রথম যে বই বেরোল থীমা থেকে [ ‘থোড় বড়ি খাড়া’, দ্র. গ্র.স. ৫৯ সংখ্যা https://www.parabaas.com/PB59/LEKHA/brBhababhuti59.shtml ]—-চমকে উঠেছিল আম-বাঙালিপাঠক—কল্যাণী দত্তের অনবদ্য স্টাইলে, তাঁর লেখনীর গভীরতায় আর অনায়াস বিচরণক্ষেত্রের ব্যাপ্তি দেখে। বাঙলাসাহিত্যের এক এক ক্লাসিক সৃষ্টি করে গেছেন কল্যাণী দত্ত তাঁর এক এক বইয়ের মধ্যে দিয়ে।
বড় মনে পড়ে যায় প্রায়-সমবয়সী প্রথিতযশা-তথা-সংসারেসন্ন্যাসিনী হিন্দী লেখিকা মন্নু ভাণ্ডারী-জী কে (জ. ১৯৩১), যাঁর কথা একষট্টি সংখ্যায় আমরা পড়েছি। [https://www.parabaas.com/PB61/LEKHA/brBhababhuti61.shtml ] সে-ই বঞ্চিতাদের কথা বলা, সে-ই উপেক্ষিতাদের ভিড় করে আসা কলমের ডগায়। না, কল্যাণী দত্ত বা মন্নু ভাণ্ডারীদের শুধুমাত্র ‘নারীবাদী’ লেখিকা বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। এঁরা সেই সেই সব মানুষের কথা বলেছেন যাদের কথা হয়ত বেশি আর কেউ বলতে পারত না। ঘটনাক্রমে তারা নারী।
তাঁদেরই কথা বলে তসলিমা আজও নির্যাতিতা হয়ে রয়েছেন।
**
বর্তমান গ্রন্থের কয়েকটি অধ্যায়ের নাম করি, পরিসরটা বোঝা যাবে তাহলে…
>> ‘শিবমোহিনী ও বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ’
>> ‘সেকালিনীর কালি-কলম’
>> ‘জোড়াসাঁকোর যৎকিঞ্চিৎ’
>> ‘সে-যুগের দাসীদিদিরা’
কল্যাণীর কলমে অনায়াসে উঠে এসেছে বিদ্যাসাগর মশাই থেকে ছান্দসিক-কবি সত্যেন দত্তের অতি-মাতৃভক্তির প্রসঙ্গ, আছে নির্মম-নিষ্ঠুর লোকাচারের কথা, ICS-সত্যেন ঠাকুরের বধূমাতা সন্ন্যাসিনী সংজ্ঞা দেবীর উপাখ্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। বিদ্যাসাগর মশায়ের পালিতাকন্যা শিবমোহিনী সম্পর্কে হতেন কল্যাণীদির পিসিমা। তাই তাঁর মুখে ফাস্টহ্যান্ড বিদ্যাসাগরীয় কথা শুনতে পাওয়াটা বিশেষ একটা ‘পাওয়া’।
ভাবি, বাংলা ও বাঙালি তো তখন খ্যাতি-প্রতিপত্তির শীর্ষে ছিল! ‘নবজাগরিত’! কিন্তু কেবলই মনে হয়, কার ‘নবজাগরণ’? কার জন্যে ‘নবজাগরণ’? বাংলার নারীকুল তো তখনও ছিল তেমনই বঞ্চিতা নিপীড়িতা।
প্রখ্যাতা সমাজতাত্ত্বিক জোন কেলী-র সেই সাড়া-জাগানো নিবন্ধ ফের পড়িঃ ‘Did Women have a Renaissance?’ [ 76 (ছিয়াত্তর) সংখ্যা দ্রষ্টব্য. https://www.parabaas.com/PB76/LEKHA/brBhababhuti76.shtml ].
ধর্ম ও জেন্ডারের নিরিখে যে সমাজের অর্ধেকের বেশি পড়েছিল প্রদীপের নিচের আঁধারে—তার আবার কিসের ‘জাগরণ’ গা?!
**
কল্যাণী দত্তের লিখন-স্টাইল নিয়ে দু’টো মন্তব্য করি, সে-এলেম নেই। কিন্তু এত মৌলিক এত গভীর এত অন্তর্ভেদী সে-লেখা—- পড়তে পড়তে অপরাধবোধ জেগে ওঠে মনে— পুরুষ ব’লে, উচ্চবর্ণীয় ব’লে, সুবিধেভোগী শ্রেণীর ব’লে। দুঃখ কেবল এ-ই যে জীবদ্দশায় এই ক্ষণজন্মা লেখিকা কল্যাণী দত্ত কণামাত্র প্রচার-প্রতিষ্ঠা পাননি; হয়ত তার পরোয়াও করেননি।
নইলে ওঁর ‘তিন বেণী’, ‘শ্রাবস্তী’ ‘ঋজুবলাকা’-র মতো কাব্যগ্রন্থগুলি আজও অগোচরে থেকে যায়? সেখান থেকেই অনবদ্য এক উদ্ধৃতি রয়েছে ‘ভূমিকা’-তে…
“দাও গণিকার চোখ, দাও মোরে কবির লেখনী
এককাব্যরাজ্যপাশে খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত জগৎ
বেঁধে দিব আমি!”
*
কল্যাণী দত্ত না পড়লে বাংলা নিবন্ধসাহিত্যপাঠ অপূর্ণ থেকে যায়।
দূরের বই—চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ ১৯৮০ (১৯৯৯); ISBN 81-7215-378-3
কী বলব এ’বই-কে?
মজার? অদ্ভুত? দারুণ?
বস্তুতঃ, এমন একটা বই যে বাংলাভাষায় লেখা হয়েছে, সেটাই জানতাম না। যদিও বইটির প্রথম প্রকাশ চল্লিশ বছর আগে, আনন্দ-ই পুনর্মুদ্রণ করেছে বিশ বছর আগে, ১৯৯৯তে।
ভি এস নয়পালের ‘দ্য মিমিক মেন’, বা হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান…’ , বা করবেট সাহেবের ‘মাই ইন্ডিয়া’…..এই সব তো বিশ্ববিখ্যাত সব বই। কে না পড়েছে [ # ] ? কে না মুগ্ধ হয়েছে? কিন্ত একটি নয় দুটি নয় এমন এমন আশিখানি বিখ্যাত বইয়ের কথা তিন-চার তিন-চার পৃষ্ঠার মধ্যে বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে, এবং এই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়ে রয়েছে দুই-মলাটের মধ্যে—এটা চমৎকার এক প্রাপ্তি। মোটামুটিভাবে, তার আগের পঞ্চাশ বছরে বিদেশ থেকে বেরোনো বেশ কিছু কিছু নামী ইংরিজি বইয়ের কথা ‘যুগান্তর’ কাগজে লিখতেন নামী গ্রন্থাগারিক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, ১৯৭০-এর দশকে। পরে সেগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তিন খণ্ডে। অতঃপর এই অখণ্ডাকারে বেরিয়েছে।
বইটি উৎসর্গও করেছেন লেখক ‘যুগান্তর’-এর কিংবদন্তী-সাংবাদিক দক্ষিণারঞ্জন বসুকে। আমরা, অবশ্য, তাঁকে আজ আর মনে রাখিনি।
**
আচ্ছা, ইংরিজি বইয়ের সমালোচনা (বা, পরিচিতি), তো পাস্তেরনাকের ‘ডক্টর জিভাগো’, বা টমাস মানের ‘দ্য ব্ল্যাক সোয়ান’, বা ফ্রাঁসোয়াজ সাগানের ‘বঞ্জুর ট্রিস্টেস’ কী করে এ’বইয়ে স্থান পায়?
সে-গল্প শোনাও বেশ ইন্টারেস্টিং।
যেমন, সোভিয়েত সরকারি প্রকাশনালয় ‘ডক্টর জিভাগো’ প্রকাশ করতে রাজি হয়েছে জানতে পেরে পাস্তেরনাক সে-বইয়ের অনুবাদসত্ত্ব বিক্রি করে দিলেন । কিন্তু পরে কী-জানি-সে-কারণে মস্কো বেঁকে বসলেও ইতোমধ্যে ইংরিজি ও ইতালীয় অনুবাদ বেরিয়ে তুমুল সাফল্য পেয়ে গেছে! মূল রাশিয়ানে বইটি বেরিয়েছে অনেক পরে।
আবার ধরুন, ‘বঞ্জুর ট্রিস্টেস’ (১৯৫৪) যখন প্রথম প্রকাশিত হয়ে দু’লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে গেছে লেখিকা ফ্রাঁসোয়াজ সাগান তখন মাত্তর আঠেরো বছরের এক তরুণী; মূল ফরাসী থেকে ইঙ্গ-অনুবাদের বিক্রি হয়েছে তার থেকেও বেশি! এমন এমন সব বইয়ের কথা জানতে পারা, বাংলা ভাষায় তাদের সম্বন্ধে পড়তে পাওয়া, যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক বটে ।
ভাষা অতি প্রাঞ্জল, কোত্থাও পাণ্ডিত্য ফলানো নেই।
**
বেশ কয়েকটি বইয়ের কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু উপায় নেই। যেমন, ১৯৫৪-তে প্রকাশিত মরিস মার্পেলসের কেতাব ‘আ হিস্ট্রি অব্ ফুটবল’ [লক্ষণীয়, তখনও কিন্তু পেলে আসেননি!]
বা, আরও মুগ্ধ হয়েছি পড়ে বাংলায় নীলকর অত্যাচারের উপরে লিখিত মার্কিন লেখক ব্লেয়ার ক্লিঙের ‘দ্য ব্লু মিউটিনি’-র কথা পড়ে।
কয়েকটি বই বা নিবন্ধশীর্ষের নাম শুনুনঃ
>> টমাস মান ও বেতাল পঞ্চবিংশতি
>> গান্ধীজির জীবনে নারী
>> আধুনিক আরবী কবিতা
>> উপন্যাসে প্লটের বৈচিত্র্য
নাঃ, আর কিচ্ছু বলে দেবো না, কারণ [ # ] এত বইটইয়ের কিচ্ছুটি এই অধমের পড়া নাই। [এখানে তিনটি ক্রন্দন-স্মাইলি!]
এ’ বইয়ের আরও কদর ও প্রচার হওয়া দরকার।