• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৩ | জুলাই ২০২১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • পরিত্যক্ত রোমে একদিন : মলয় সরকার


    উরোপের অনেকখানি দেখে, ভুল বললাম, ইউরোপের অনেকখানি দেখা সম্ভব নয়, বলা ভাল ইউরোপে বেশ কিছুদিন (প্রায় একমাস) এখানে-ওখানে ঘুরে শেষে এলাম রোমে। রোম শহর তো সব ভ্রমণার্থীর কাছেই খুবই লোভনীয় এবং ঈপ্সিত এর ভ্যাটিকান এবং সিস্টিন চ্যাপেল, প্যান্থেয়ন, ট্রেভি ফাউন্টেন, কলোসিয়াম ও প্রাচীন রোমান ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষের জন্য। সেসব তো বহুচর্চিত। তবু যদি প্রয়োজন হয়, পরে আলোচনা করা যাবে। আজ বলতে বসেছি এমন এক জায়গার কথা, রোম শহরের খুব কাছেই কিন্তু সাধারণত কোন সাধারণ ভ্রমণার্থীর পায়ের ধুলো পড়ে না এখানে, ফলে এত আশ্চর্য ইতিহাস লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অবশ্য সব দেশেই এরকমটা হয়। সরকার পক্ষ থেকে যাকে পাঁচজনের সামনে বড় করে তুলে ধরা হয়, মানুষ সে দিকেই ছোটে আর এর বাইরেও বহু জিনিস থেকে যায় সবার চোখের আড়ালে অবহেলিত হয়ে। একমাত্র মার্কিন দেশেই দেখেছি, যেহেতু ওদের দেশের নিজস্ব কিছু ইতিহাস তেমন নেই, ছোটখাট কোন কিছু পেলেই তাকে তুলে ধরার জন্য সমস্ত মানুষ নানা ভাবে এগিয়ে আসে। এমন অনেক জায়গাতেই ওখানে গেছি, যেখানে, আমাদের চোখে, উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছুই নেই।

    যাকগে, যা বলতে বসেছিলাম, সব ঘুরে এসে রোমটাকে চষে ফেললাম কিছুটা নিজের মত করে, তার শীর্ণকায়া টাইবার নদী, জিওর্দানো ব্রুনোর হত্যাস্থল ইত্যাদি কিছুই বাদ দিলাম না। তারপরেও দেখলাম হাতে রয়ে গেছে গোটা একটা দিন। এটা বিশ্রামের জন্য ধরা ছিল। একবার ভাবলাম, বিশ্রাম নিয়ে আর কি হবে। বাড়ি ফিরে তো অঢেল বিশ্রাম; এখানে তো আর আসা হবে না। তার থেকে ভাল, যাই ঘুরে আসি মাউন্ট ভিসুভিয়াসের ধ্বংসলীলার চিরকালীন সাক্ষী পম্পেই, যেখানে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুদ্ধ আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছিল, অতি অল্প সময়েই, অত বড় এক সমৃদ্ধ শহর।

    কিন্তু আমার হাতে যা সময়, তাতে অত দূর গিয়ে দেখা সম্ভব হবে না। তাই আক্ষেপ থেকে যাচ্ছিল যে, এত দূর এসে, এতকালের শোনা হারকিউলেনিয়াম আর পম্পেই না দেখে ফিরে যাব!?

    তখন ছেলেই বুদ্ধিটা দিল, যাও ঘুরে এসো, পম্পেই-এর মতোই আর এক পরিত্যক্ত শহর, রোম শহরের কাছেই, একদিনেই স্বচ্ছন্দে ঘোরা হয়ে যাবে, নতুন একটা জিনিস দেখাও হবে। ভাবলাম তাই হোক, দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটুক। রাতেই মোটামুটি দেখে নিলাম, কোন দিকে যাব, কী করব।

    পরদিন সকালে উঠে দেখি বুলুর শরীরটা বেশ ভাল নয়। অল্প জ্বর ভাব। আসলে এই ইউরোপ ভ্রমণে আসার অল্প কিছুদিন আগে ও পক্স থেকে ভুগে উঠেছিল। তার দুর্বলতা ছিলই। তার সঙ্গে ইউরোপে প্রায় একমাস হাঁটাহাঁটির ধকল, শেষের দিকে এসে যেন বেশ কাবু করে দিয়েছে। গতকালও ট্রেভি ফাউন্টেন দেখতে গিয়ে ওকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। রাতে কিছু ওষুধ খেতে দিলাম। সকালে বললাম, ছাড়ো, আজ রেস্ট নাও। আর বেরোব না। ও বলল, আর জীবনে হয়ত রোমে আসব না, চলো দেখেই আসি।

    ওর জেদেই বেরোলাম সকালে। তখন বুলু অনেক ফ্রেশ ছিল।

    ব্রেকফাস্ট করে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বাস টার্মিনাসে, সামনেই, রোমান ফোরামের কাছেই। বাস টার্মিনাস কতকটা কোলকাতার এসপ্ল্যানেডের মতই। এখানে-ওখানে বাস ড্রাইভাররা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের নির্দিষ্ট বাস ছাড়ার অপেক্ষায়। প্রত্যেকটি বাস তার নির্দিষ্ট রুটের চ্যানেলে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বাসের টিকিট অনেক দোকানেই পাওয়া যায়। পাসও পাওয়া যায়। তা ছাড়া মেট্রো আর বাসে একই টিকিট চলে। আগে থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠতে হয়। বাসে উঠলেই এক ভাড়া, সে যেখানেই নামো। চীনে এবং আরও অনেক জায়গায় দেখেছি এ-রকম।

    জিজ্ঞাসা করলাম সবাইকে, যে, পিরামিডে স্টেশনে যাব, কোন বাসটা যাবে। জানা গেল ২৮০ নম্বর বাস যাবে। দেখলাম বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে উঠে ফাঁকা সিট দেখে জানালার ধারে বসলাম। সরকারি বাস বোধ হয় এগুলো। আমাদের এখানকার মতই। লোকেদের হালচাল বা ঢংঢাং আমার তো কোলকাতার লোকেদের মতই লাগল। যাই হোক, উঠেই, আগে ড্রাইভারকে বলে দিলাম, নতুন লোক, বুঝতে পারব না তো, তুমি বাবা আমাদের একটু ‘পিরামিডে’ স্টপে নামিয়ে দিও। সে বিশাল এক ঘাড় নেড়ে আশ্বস্ত করল। এই ভাবেই আগের দিন এক দিদিমনি বাস ড্রাইভার আমাদের খুব যত্ন করে ভ্যাটিকানের সামনে নামিয়ে কোন দিকে কতটা যেতে হবে সব বলে বুঝিয়ে দিয়েছিল। কাজেই আমরা এনাকেও সব বলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলাম।

    বাস চলেছে বড় রাস্তা, ছোট রাস্তা এ-পাড়া সে-পাড়া ঘুরে। আমরাও রোমের বাজারহাট লোকালয় ইত্যাদি দেখতে দেখতে রোমের সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করতে করতে চলেছি। অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পর মনে হল বাস কেমন যেন লোকালয় ছাড়িয়ে শহরের বাইরে ফাঁকা জায়গায় এসে পড়েছে। চিন্তা হল। উসখুস করছি, এখনও আমাদের গন্তব্য ‘পিরামিডে’ কি আসেনি! বেশ খানিকটা উসখুস করতে করতে অধৈর্য হয়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা ‘পিরামিডে’ আসেনি? সে চোখ কপালে তুলে বলল, সে কি, আপনারা এখনও বাসে রয়েছেন? ‘পিরামিডে’ তো প্রায় একঘন্টা আগে পেরিয়ে এসেছি।

    রাগ হল একটু, মনে মনে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললাম, আমরা নতুন চিনি না, তাই তো তোমাকে বলেছিলাম, নামিয়ে দিতে। সে মাথা নিচু করে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, একেবারে ভুলে গেছি। আসতে আসতে দেখেছেন না, রাস্তায় এক জায়গায় কাঁচের একটা বড় পিরামিড ছিল, ওইটাই ‘পিরামিডে’ স্টপেজ। মনে পড়ল দেখেছিলাম বটে। কিন্তু সেটাই যে স্টপেজ বুঝিনি। ওখানে আবার বাসে স্টপেজের নাম লেখা ওঠে না। ফ্লোরেন্স এবং অনেক জায়গায় দেখেছি বাসে স্টপেজ আসার আগে ভিতরের বোর্ডে স্টপেজের নাম লেখা ওঠে। তাই দেখে বুঝতে পারা যায় যে কোন স্টপেজ আসছে। এখানে সে ব্যবস্থা নেই, আমাদের দেশের মতই। তাই এখানেও নতুন জায়গায় গেলে যেমন কন্ডাক্টরকে বলে রাখি নামিয়ে দিতে ওখানেও তাই করেছি। বলতে কি, যেখানে এরকম সুবিধা নেই, সেখানে কন্ডাক্টর বা ড্রাইভার, নিদেন সহযাত্রীদের বলে রাখি। যাই হোক, ড্রাইভার অপরাধীর মত মাথা নামিয়ে বলল, মাফ করে দিন, আর তাছাড়া আমরা লাস্ট স্টপেজে প্রায় এসে গেছি। আমি ফেরত বাসের ড্রাইভারকে বলে দেব, সে আপনাদের ঠিক নামিয়ে দেবে।

    অগত্যা, কি আর করা। বাস যেখানে থামল, সেখানে নেমে মনে হল, রাজারহাট এলাকা যখন নতুন হচ্ছিল, তখন যে বাসগুলো সবে চালু হয়েছিল, তার বাস টার্মিনাসের মত। দুটি বাস দাঁড়িয়ে আছে, আশপাশে ফাঁকা মাঠ, ঝোপজঙ্গল। দূরে দূরে কিছু নতুন বাড়ি হচ্ছে। বুঝলাম নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠছে। ড্রাইভার ফিরতি বাসের ড্রাইভারকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। সে ঘাড় নেড়ে আমাদের বাসে উঠে বসতে বলল। আমরা মনে মনে ভাবছি, খামোকা দু-তিন ঘন্টা সময় আর পয়সা গেল।

    ফেরত বাস একটু পরেই ছাড়ল। সে আর পয়সা নেয়নি। শুধু তাই নয়,স্টপেজ আসার আগের স্টপেজে জানিয়ে দিল, তৈরি হোন, পরের স্টপেজে নামতে হবে। সে যত্ন করে পরের স্টপেজে নামিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দিল।

    বাঁচলাম। আমরা ‘গ্রাসিয়ে’ জানিয়ে এগোলাম রাস্তা পেরিয়ে স্টেশনের দিকে। পাশেই রেল স্টেশন। সেখানে টিকিট কেটে দেখি, আমাদের লোকাল ট্রেনের মত ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কোনটা যাবে, জেনে নিয়ে উঠে বসলাম। এখানে ভয় নেই, আমার কাছে লিস্ট ছিল,কোন স্টেশনের পর কোন স্টেশন আসবে, আর কোথায় আমরা নামব। ট্রেনটা নিছকই আমাদের সুবার্বান ট্রেনের মত। দেখি কয়েকটি গ্রাম্য ছেলে, একটি ছাগল আর একটি কুকুর নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। ট্রেনও চলেছে একেবারে গ্রামের মধ্যে দিয়েই।

    নামলাম অস্টিয়া এন্টিকা-তে। স্টেশনে নেমে জিপিএস-এ দিক ঠিক করে নিয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজ পেরিয়ে এগোলাম দুজনে এপাশ-ওপাশ দেখতে দেখতে। আহামরি কিছু নয়, নিছক আমাদের মফস্বল শহরের বা আধা গ্রাম্য স্টেশনের মতই তার পরিবেশ।

    এসে হাজির হলাম অস্টিয়া এন্টিকার চৌহদ্দিতে। কাছেই একেবারে। আজও যেন একটি ঘুমন্ত শহরের মত ঘুমিয়ে আছে। নুড়ি বিছানো রাস্তা, কোন ভিড় নেই। মাত্র চার-পাঁচ জন দর্শক বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুটা দূরেই রোম শহরে ভ্যাটিকানে কি কলোসিয়ামের প্রবেশ লাইন দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। অথচ এখানে লোকই নেই। টিকিট কাউন্টার যেন বলছে, “শূন্য এ বুকে পাখী মোর ফিরে আয়, ফিরে আয়--”

    এখানে রোদ বেশ ভালই উঠেছে, আকাশ ঘন নীল, অল্প অল্প হাওয়াও বইছে। কিন্তু ছায়া দেওয়ার মত বিশেষ কিছু নেই। আকাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে আলো আর রোদের বন্যায়। গাছপালাও বিশেষ নেই। দূরে দূরে অল্প অল্প কয়েকটি বড় গাছ রয়েছে। সে সময়ে কি আর এমন ছিল, নিশ্চয় তারা নিজেদের জন্য ভালই সব ব্যবস্থা রেখেছিল। তবে এখন সরকার এটাকে, বিশেষ আধুনিকতায় সাজিয়ে,এর পৌরাণিকতাকে নষ্ট করতে চায়নি বলে এখানে রাস্তাটাও পাকা নয়, ভাঙা ইটের কুচি আর মাটির।

    তবে এখানে এসেই আমার একটা কেমন যেন ভাবালুতাতে আচ্ছন্ন লাগছিল। এটা কি সেই প্রাচীন রোম শহর যার মধ্যে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছি। একসময় এখানে কত রোমান মানুষ ঘোরাফেরা করেছে। তাদের ঘরগৃহস্থালি, সুখ-দুঃখ কান্না-হাসি জন্ম-মৃত্য খেলাধুলো শান্তি-উদ্বেগ নিয়ে এই শহর জমজমাট ছিল। আর আজ সব কোথায়! একটা চলন্ত জীবন্ত শহর যেন কারোর অভিশাপে আজ পরিত্যক্ত মৃত হয়ে আমার সামনে পড়ে আছে। ভাবতেই আমি যেন কোন যুগে চলে যাচ্ছি মনে হচ্ছে।

    এই অস্টিয়া এন্টিকা, বর্তমান রোম শহর থেকে মাত্র ত্রিশ কিমি দূরে, অবহেলিত হয়েও, এক প্রাচীন গৌরবগাথা নিয়ে, প্রাচীন সমৃদ্ধির গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একসময় এটি গড়ে উঠেছিল বন্দর শহর হিসাবে টাইবার নদীর মোহানায়, সমুদ্রের মুখে সমুদ্রবন্দর হিসাবে। যেকোন বন্দর শহরেরই রমরমা হয় তার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা থাকার জন্য।

    রোম শহরের ভিত্তি স্থাপিত হয় রোমুলাসের হাতে। আর এই রোমুলাসের ব্যাপারে অনেক গল্পগাথা আছে। তার মধ্যে যেটি বহুল প্রচলিত তা হল, এক রাজার দুই ছেলে পরিত্যক্ত হয় জঙ্গলে, যখন তাদের কাকা তাদের বাবার রাজ্য কেড়ে নেয়। তাদের মৃত্যুমুখে ফেলে দিয়ে আসা হয় টাইবার নদীর ধারে এক জঙ্গলে। কিন্তু সমস্ত নদীর দেবতা,এবং টাইবার নদীর পিতা টিবেরিনাস তাদের রক্ষা করেন। লুপারক্যাল নামে এক বাঘিনীর তাদের দেখে মায়া হয় এবং সে তাদের নিজের দুধ খাইয়ে বাঁচায়। পরে এক রাখাল তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে ও তারা রাখালের ঘরে বড় হয়। পরবর্তী কালে বড় ভাই রোমুলাসের হাতে রিমাসের মৃত্যু হয়। রোমুলাস এক শহর পত্তন করেন এবং সেটিই রোম নামে বিখ্যাত হয়। রোমুলাসই হলেন রোমের প্রথম রাজা।

    এই অস্টিয়া এন্টিকাই সেই প্রাচীন রোম, যেটি নাকি, বলা হয় ৫০৯-২৭ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত রমরমিয়ে চলেছিল। সম্রাট জুলিয়াস সীজার এর যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন এবং এই শহর প্রায় ৪র্থ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। কালক্রমে এটি জনশূন্য হয়ে পড়ে।

    আজ এই দুপুর রোদে এখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল যেন সেই যুগের রোমেই এসে পড়েছি। হয়ত এখনই কোন সিনেটরের সাথে দেখা হয়ে যাবে বা কোন রোমান সুন্দরী এসে পড়বে সামনে। এখানে আসলে ভূমিকম্পও হয়নি বা হারকিউলেনিউয়াম বা পম্পেই-এর মত আগ্নেয়গিরির ছাই চাপাও একে পড়তে হয়নি। কাজেই সেই ভাবে এটা নষ্ট হয়নি। যা নষ্ট হয়েছে সব কালের প্রভাবে। আমি তো ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে, মনে হচ্ছে আমি যেন সেই যুগেরই এক রোমান ঘুরে বেড়াচ্ছি শহরে। শহরের লোকজন সব ঘুমিয়ে আছে। এখনই হয়ত জেগে উঠবে সব,ঘর্ঘর রবে শুরু হবে জীবন যাত্রা।


    আর একটি অক্ষত নিঁখুত শিল্পকর্ম, নীচে বুলু

    সুন্দর পরিকল্পনা করা চওড়া রাস্তা। রাস্তাগুলো বড় বড় পাথরের স্ল্যাব বিছিয়ে সমান করা। অনেক জায়গাতেই আপাতত মাটির রাস্তা। তখন তো আর কংক্রিটের বা পিচঢালা রাস্তার প্রচলন ছিল না, পাথরে বাঁধানো ছিল রাস্তা। রাস্তার দুধারে বেশ কিছুটা ছাড় দেওয়া। অনেকটা আজকের ফুটপাথের মত। আজকের আমাদের থেকে এমন কিছু আলাদা নয়। তার পরে সারি সারি বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। দুটি পাশাপাশি বাড়ির মধ্যে ফাঁক নেই, সবই জোড়া; অনেকটা পুরানো কলকাতার বাড়ির মত। দ্বিতল বাড়ি নেই তবে প্রতিটা বাড়িই বেশ উঁচু। বাড়ির মধ্যে অনেকগুলোরই প্রধান দরজা অক্ষত। সেখান দিয়ে বাড়িতে ঢোকা যায়। পাথরের সুন্দর কারুকার্য করা বাড়ি। ভাবছিলাম, আমাদের এত বিজ্ঞান এত প্রযুক্তির উন্নতির পরেওআজ ব্রিজ ভাঙে, কাল ফ্ল্যাট ভেঙে পড়ে। আর এরা কি দিয়ে বানিয়েছিল এত বড় বড় থাম, বাড়ি--সব প্রায় নিখুঁত আছে এত দিন এত বৃষ্টি ঝড় সহ্য করেও।

    এইভাবেই চমকে উঠেছিলাম তুরস্কে গিয়ে। দেখলাম সেই আদ্যিকালের বানানো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য, ডায়ানা দেবীর মন্দির বা আর্টেমিসের মন্দিরের একটি স্তম্ভ আজও দাঁড়িয়ে আছে তার বিস্ময়কর ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের স্থাপত্য নিয়ে। অবশ্য সেটাও এই সময়েরই অর্থাৎ ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের তৈরি। এখানে যা হয়ে থাকে--যে কোন পরিত্যক্ত প্রাসাদ বা ঘরের, অনেক বাড়িরই ছাদটা নেই তবে বাকি দেওয়াল, দরজা জানালা সব আছে।

    হঠাৎ বুলু জামাটা টেনে ধরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল. রাস্তার ধারে একটি মূর্তির দিকে--এক নগ্ন নারীমূর্তি, দাঁড়িয়ে আছে তার দু-পায়ের আঙুলের উপর ভর করে, অদ্ভুত এক ভঙ্গিমায়। তার নগ্নতা নয় সমস্ত শরীরের যে শৈল্পিক সৌন্দর্য তা মুগ্ধ করবে যেকোন শিল্পরসিককেই। এমনই দেখেছিলাম ফ্লোরেন্সের মাইকেলএঞ্জেলোর ডেভিড মূর্তি। সারা জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় ব্রোঞ্জ বা ওই ধরনের কিছু দিয়ে তৈরি সবুজাভ সারা দেহে,যেন আলো পিছলে যাচ্ছে। তাতে যেন ওই পরিবেশে তার সৌন্দর্য আরও বেশি করে ফুটে উঠেছে। একটা নারীশরীরের সৌন্দর্য কত সুন্দর হতে পারে কবি হলে হয়ত বর্ণনা করা সম্ভব হত। তবে এ মূর্তির সামনে যেকোন মনই কবি হয়ে ওঠে। এরকম আরও বেশ কিছু অক্ষত শিল্পকর্ম রয়েছে, রয়েছে অনেক মূর্তি। অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম শিল্পীর শিল্পকর্ম, বুলুও তাই।

    এখানে দেখলাম বাড়িগুলো তৈরি সব পাতলা চওড়া চওড়া ইট দিয়ে, যেমনটি আমাদের দেশেও পু্রানো দিনের বাড়ি বা মন্দিরগুলোতে ছিল। এবং দেওয়ালগুলো বেশ চওড়া। পাথরের ব্যবহার কম। বড় বড় থামও বেশিরভাগই পাতলা ইটের তৈরি। তার ফলে বাড়ি থাকত মজবুত এবং যথেষ্ট ঠান্ডা। আমি বুঝিনা, যে পদ্ধতিতে তৈরিবাড়িঘর এত দিন থাকতে পারে ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করে, সেই পদ্ধতি ছেড়ে বর্তমান পদ্ধতির অপলকা বাড়ি কেন তৈরি হয়, সে কি শুধু কম খরচ আর তাড়াতাড়ি করার জন্য? কে জানে।


    ছাদহীন ঘরের সারি


    দুই সারি বাড়ির মাঝের চলাচলের রাস্তা

    এসে পড়লাম অডিটোরিয়ামে। এগুলো ছিল মুক্তমঞ্চ। এটি প্রায় অক্ষতই আছে। গ্রীকরা বা রোমানরা এই মুক্তমঞ্চের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই একই মঞ্চ অনেক দেখেছি তুরস্ক, জর্ডনে। তুরস্কের এফেসিউয়াস-এ গ্রেট থিয়েটার তো দেখার মত। সেদিনের সেই বৃত্তাকার মুক্তমঞ্চে, নাটকের প্ল্যাটফর্মে দেখেছি একটি জায়গা চিহ্নিত করা থাকত, যেখান থেকে কথা বললে মঞ্চের শেষ মানুষটিও শুনতে পাবে। নাটকের পাত্রপাত্রীরা যার যখন কথা বলার থাকত, ওই চিহ্নিত জায়গায় চলে এসে কথা বলত। আর গোলাকৃতি যে অডিটোরয়াম, তা একেবারে এখনকার মত। তখন তো আর মাইক্রোফোন ছিল না, খালি গলায় কী করে অত দূরের মানুষ শুনতে পেত ভাবলে আশ্চর্য লাগে। আমি পরখ করে দেখলাম, সত্যিই তা হয়। এ ছাড়া আরও একটা জিনিস আমাকে আশ্চর্য করল, তা হল, প্রতিটা সিটে নম্বর দেওয়া ছিল, এবং সে-ও শ্রেণীভেদ করা। সেই যুগে--ভাবা যায়? পুরো পাথরের তৈরি বৃত্তাকার মুক্তমঞ্চ। তার টিকিট বিক্রীর জায়গা, পাত্রপাত্রীর ঢোকার জায়গা, গ্রীন রুম সব ছিল। এমন কি অডিটোরিয়ামে দর্শকদের প্রবেশের জায়গাটিও সম্পূর্ণ অক্ষত। আর দর্শকদের জন্য মঞ্চের গ্যালারিতে ঢোকার জায়গা, অনেকটা এখন খেলার স্টেডিয়ামগুলোতে ফুটবল খেলোয়াড়রা যেমন ভাবে দুপাশে গ্যালারির মাঝখান দিয়ে প্রবেশ করেন তেমনই। শুধু যেখানে নাটকের মঞ্চ তার তিনদিকে গোল করা ঘেরা গ্যালারি থাকত পিছন দিক বাদ দিয়ে। অবশ্য গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস তো সে যুগেরই মানুষ, যাঁর লেখা আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নাটকের ব্যাপারে বা মঞ্চের ব্যাপারে গ্রীক বা রোমানরা যে অনেক উন্নতি করেছিল তা বলাই বাহুল্য। রোমের কলোসিয়াম দেখতে গিয়েই তার প্রমাণ পেয়েছি।

    এখানে উল্লেখযোগ্য দেখলাম, গণ শৌচালয়। এখানে একটা চৌকো বড় জায়গায় দেওয়ালের ধার বরাবর উঁচু করে প্ল্যাটফর্ম করা এবং তার উপর পাশাপাশি এখনকার ল্যাটরিনের মত গর্ত করা আছে। তবে একজনের সাথে আর একজনের মাঝে লজ্জা আটকানোর কোন দেওয়াল ছিল না। হয়ত সেকালে এতে লজ্জা ছিল না। বা পুরুষ নারীর আলাদা করার মতও কিছু দেখিনি। তার তলা দিয়ে ড্রেন ছিল যেখান দিয়ে মল বা জল বাইরে চলে যেত। এ রকম অনেক শৌচালয় ছিল। এই রকমই দেখেছি তুরস্কের এফেসিয়াসে। ঠিক একই রকম গণ শৌচালয়। তখন হয়ত গ্রীক বা রোমানদের মধ্যে এরকমই নিয়ম ছিল।


    স্নানাগারের আশ্চর্য অক্ষত মোজাইকের কাজ

    এ ছাড়া দেখলাম স্নানাগার। সেটা এখনকার মতই সুইমিং পুল বা গণ স্নানাগার। তবে তার থেকেও উল্লেখযোগ্য তার মেঝের কালো পাথরের মোজাইকের কাজ অপূর্ব। আজও সমান সুন্দর আছে। চারটি ছুটন্ত ঘোড়ার রথে তার সারথি যেন একেবারে জীবন্ত। এ ছাড়া অন্যান্য মনুষ্য ছবি, সর্পিল ড্রাগন বা মাছের ছবি একেবারে এককথায় অদ্ভুত। শুধু যে কালো পাথরের মোজাইকই আছে তা নয়। নানা রঙের সুন্দর সুন্দর মোজাইক আছে নানা রঙের শেড যেন রঙ দিয়ে তুলিতে আঁকা। মোজাইকের কাজ আরও আছে। এবং তা যথেষ্ট সুন্দর। আমি এর আগে জর্ডনে মাউন্ট নেবোতে (২৩৩০ ফুট উঁচু), যেখান থেকে মোজেস সমস্ত অনুগামীদের প্রতিশ্রুত ভূমির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন (বর্তমানের জেরুজালেম) এক ভীষণ সুন্দর ও বিশাল মোজাইক দেখেছিলাম। ওখানকার মোজাইকেরও যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। ছবিগুলি একটি একটি পাথরের ছোট টুকরো দিয়ে শিল্পী কি নিখুঁত করে করতেন, ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। অনেক বাড়ি রয়েছে যার প্রধান দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়। কত শিশুদের ধুলোখেলা, কত হাস্যপরিহাস, কত গৃহিণীদের সুনিপুণ গৃহিণীপনার যে এখানে স্মৃতি রয়ে গেছে প্রতিটি ইট পাথরের কাঁজে খাঁজে কে তার পরিমাপ করবে। বাড়ির পাথরগুলি অনেকটা লালচে হলুদ রঙের তবে দেওয়াল বেশিরভাগ জায়গাতেই চওড়া পাতলা ইটের। দরজার মাথার খিলানগুলো ধনুকের মত সেও শুধু ইটেরই।

    তাকিয়ে দেখি আশপাশে দু-চার জন দর্শক ঘোরাঘুরি করছে। হঠাৎ বুলুর শরীরটা কেমন অস্বস্তি লাগতে আরম্ভ করল। আসলে চড়া রোদ, আর ওর শরীরটাও তো ভাল ছিল না। কি করি, ছায়া দেখে বসলাম, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম কিছু ওষুধ, জল আর অল্প খাবার। তাই দিলাম। চিন্তায় পড়েছিলাম। এই বিদেশ বিভুঁই জায়গা। কেউ নেই। কথা বুঝি না। কিছুক্ষণ বসে সুস্থ হয়ে ও বলল, চলো ঘুরে নিই। এখনও অনেক বাকি। ওর মনের জোরেই আবার উঠলাম দেখতে।

    রয়েছে বিশাল বাজারের জন্য ফাঁকা জায়গা। যেখানে এক সময় হয়ত ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে গমগম করত। আর হবে না-ই বা কেন। এখানে লোকসংখ্যাও তো কম ছিল না, প্রায় সাত-আট লক্ষের মত মানুষ না কি বাস করত এখানে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে অর্থাৎ আমাদের দেশে তখন বুদ্ধদেবের সময় চলছে, তখন রোমের ঐশ্বর্য, শিল্পস্থাপত্যের এক চরম নিদর্শন এই অস্টিয়া এন্টিকা। অবশ্য আমাদের দেশেও, যদিও বেশিরভাগই পুরানো স্থাপত্যই বিদেশী বিজেতারা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, যেগুলি অক্ষত আছে সেগুলিতেও স্থাপত্যের উৎকর্ষতার নমুনা অনস্বীকার্য। বাজারের জায়গাটিতে রয়েছে এখন বড় বড় গাছ। শূন্য স্মৃতির গল্প করছে তাদের পাতারা শিরশির আওয়াজে; হয়ত কান পাতলে এখনও শোনা যাবে। এর পতনের যদিও অনেক কারণ পণ্ডিতেরা অনুমান করেন,কয়েকটি কারণ বেশি আলোচিত হয়। কেউ বলেন যে প্লেগে বহু মানুষ মারা যাওয়ায় বাকিরা শহর ছেড়ে চলে যান। কেউ বলেন, আরবদের সাথে সংঘর্ষে বার বার হারতে হারতে মানুষ বিরক্ত হয়ে এই জায়গা ছেড়ে চলে যান। যেমন আমাদের শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধের অত্যাচারে মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় চলে গিয়েছিলেন। আবার কেউ বলেন, শহরের প্রতি শাসনকর্তাদের একটু নজর কমে আসে কারণ তখন আরও সমুদ্রবন্দর তৈরি হয়ে যাওয়ায় এর গুরুত্ব হ্রাস পায়। অবশ্য টাইবার মোহানায় পলি পড়ে নাব্যতা কমে যাওয়াও এর গুরুত্ব হারানোর একটি কারণ। মানুষের এই শহরের উপর আকর্ষণ ক্রমশ কমে যায়। তবে যাই হোক, এটি যেহেতু পম্পেই-এর মত কোন অগ্ন্যুৎপাতে বা বিজয়ীদের নির্বিচার ধ্বংসে নষ্ট হয়নি, তাই এর অনেক কিছুই অক্ষত আছে। এখানে সুন্দর চার্চও ছিল। এখানেই দেহত্যাগ করেন, সেন্ট অগাস্টিনের মা সেন্ট মনিকা ৩৮৭ খ্রীষ্টাব্দে।


    একটি বড় বাড়ির অন্দরমহল

    বেনিটো মুসোলিনির সময় (১৯৩৯-৪২) এখানে অনেকখানি খনন কাজ চলে। তবে পণ্ডিতেরা বলেন যা পাওয়া গেছে তা নাকি আসল শহরের মাত্র এক তৃতীয়াংশ। এখনও দুই তৃতীয়াংশই রয়ে গেছে লোকচক্ষুর বাইরে, মাটির তলায়। এর চারদিকে ছিল শক্ত দেওয়াল শত্রু জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে। এখন একটি দেওয়াল রয়েছে। চড়া রোদের জন্য অনেক কিছুই হয়ত দেখা হল না, আবার হলও অনেক কিছু। নানা ছবি, মূর্তি, সিঁড়ি, বিশেষ করে ঘরের প্রবেশপথগুলো, সুন্দর পরিকল্পিত শহরের বাড়িঘরের নকশা,সুন্দর মোজাইক মন ভরিয়ে দিল। অনেক ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখেছি, ছাদের উপরে গিয়েও অনেক জায়গায়। অনেক বাড়ি রয়েছে প্রায় অক্ষত, শুধু ছাদ বাদে।

    যাই হোক, বেলা পড়ে এল। ফিরতে হবে। আসতে মন চাইছিল না। মনে হচ্ছিল, থেকেই যাই এই শহরের সেই আবছায়া অশরীরীদের সাথে।

    ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম ফেরার পথে। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে অনেকখানি। ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। ভাবছিলাম, বিদায় অস্টিয়া এন্টিকা, তুমি হয়ত দাঁড়িয়ে থাকবে আরও বহুদিন ফেলে আসা স্মৃতি বুকে করে, শোনাতে থাকবে এরকম অনেক পথযাত্রী আগন্তুককে। আমার হয়ত আর কোনদিনই আসা হবে না এ জীবনে। পিছন থেকে গাছের ডালে বসা একটি পাখি ডেকে উঠল দীর্ঘ আর উচ্চ আওয়াজে। মনে হল যেন বলছে, যাচ্ছ যাও, মনে রেখো আমাদের, মনে রেখো এই পরিত্যক্ত শহরের গোপন নিঃশব্দ ব্যথার কথা, অতীত গৌরব-স্মৃতি স্মরণ করে একাকী নিঃশব্দে অশ্রুমোচনের কথা----



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments