আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, নচিকেতাদের বাড়িটা ছিল উঠোনময়। উঠোনের মাঝে ও ধারে ধারে আম, পেয়ারা আর পেঁপে গাছ। এক লপ্তে অনেকটা গোলাকার উঠোন, পাকা ঘর, রক, সিঁড়ি। এদিকে দুটি মাটির ঘর, একটি চালা ও রান্নাঘর। যা একে একে সব ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে পাকা ঘর মাথা তুলেছে তিনটি। ডালিমগাছটা তো সেই কবেই কেটে ফেলা হয়েছে। নচির মায়ের হাতে লাগানো খুব সখের গাছ। বেশ বড় গাছ, গোলাপি সুন্দর ফুল আসত, ফলও ধরত কিন্তু একটু বড় হলেই ঝরে যেত। ফল একটু বড় হলে খোসা ভেঙে দেখেছে, হালকা লালের ছিট দেওয়া কচি ডালিমের দানা। স্বাদে কষা, কিন্তু হাজার হোক, গাছের ফল তো! তাই ভেঙে ভেঙে খাওয়া হত। তার ছায়ায় আসন পেতে নচিরা খেতে বসত। সন্ধেতে তার দাদু মাঝে মাঝে দুলে দুলে সুর করে বলত, ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, সাঁঝ সকালে ভিজিয়ে দিতাম দুই নয়নের জলে।’
তখন উচ্চিংড়ে ডাকত। সন্ধ্যার গন্ধ, মাটির গন্ধ মিলেমিশে এক অচেনা পৃথিবীর চোখ যেন ফুটে উঠত নচিকেতার সামনে। আহা, পৃথিবীটার গোটাটাই একটা রূপকথার মোড়কে মোড়া!
ছাদের সিঁড়ি তখন ঘেরা ছিল না। ন্যাড়া ছাদ, ন্যাড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির নিচে হাঁসেদের ঘর। মাটির দেল টালির চাল। তারা সকালেই ধান ভেজানো খেয়ে মুদিপুকুরে চরতে যায়। একবার হাঁসঘরের তক্তা ঠিকমতো না পড়ায় রাতে একটা হাঁস বার করে নিয়ে যায় ভামেরা। তার সেসব মনে পড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বাড়িটা? তাদের পুরো বাড়িটা? প্রথম থেকেই কি এমন ছিল?
এর মধ্যে ঠাকুমার ঘর কোনটা?
গতকাল রাত দশটায় নচির ঠাকুমা মারা গেছে। গাড়ি ভাড়া করে তারা যখন শহর থেকে গ্রামে এল তখন রাত দুটো। রাস্তায় খুব জ্যাম। এখন কলকাতাগামী বাইরের লরিরা টোল এড়িয়ে এদিকের অহল্যাবাঈ রোড দিয়ে যাতায়াত করে। ফলে তীব্র যানজট। তার উপর পুলিশের গাড়িকে পাশে রেখে সিভিক ভলেনটিয়ার্সরা টাকা তুলছে লরিওয়ালাদের থেকে।
ঠাকুমার পা ছুঁয়ে নচিকেতার মা বসেছিল। তার মা দু’দিন আগেই এসেছে। তখন ঠাকুমার যায় যায় অবস্থা। ঠাকুমার মৃত্যুর জন্য নচিকেতারা প্রস্তুত ছিল। আরও সোজাসুজি বললে, অপেক্ষাই করছিল মৃত্যুর। ঠাকুমার বয়স হয়েছিল তিরানব্বই। একেবারেই অর্থব হয়ে ছিল শেষ ছয়মাস। বিছানাতেই পেচ্ছাপ-পায়খানা করত। তবু, একটা মানুষ চলে গেল। কান্না আসে বইকি। অনেকে কাঁদছিল। নচিকেতার কান্না আসেনি। তার কেবল মনে পড়ছিল বাড়িটার কথা।
ঠাকুমার পায়ে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করে নচিকেতা পাশের ঘরে গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল! নচিকেতা ঘুম থেকে উঠে সকালে যখন বারান্দায় বসল, কে যেন ঠেস মেরে বলল, কীরে নচি, ঘুম হল?
তখন বাড়িটার কথা মনে পড়ল নচিকেতার। কেমন ছিল তাদের এই বাড়িটা? সে যা এতক্ষণ ভেবে এল, সেইরকমকি? পুরোটাই কি ছিল মাটির বাড়ি? এক মাটির গন্ধ ঘিরে থাকত তাদের দেহভাণ্ডকে? অনেক পরে ভেঙে পাকা হল তারপর?
সেই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নচিকেতা দেউড়ির দিকে গেল। দেওয়াল গাত্রে শ্বেতপাথরে লেখা, ‘আমাদের বাড়ি’। সেখানের পাঁচিলে এখনও লতিয়ে আছে মাধবীলতার গাছ। ঠাকুমার হাতে বসানো গাছ। নচিকেতা তখন বালকমাত্র। বৈশাখের কোনো এক বিকেলে গাছ বসিয়ে ঠাকুমা বললে, এইবার এই মাটির চাঁদটা লাল হয়ে ফুটবে দেখিস। আর তখন দেবতা আদিত্যবর্ণ চাঁদ নিয়ে খেলা করবেন।
আমরা জানি, চাঁদ ওঠে। ঠাকুমা বলে, চাঁদ ফোটে। যেমন সন্ধের সময় যূথী ফোটে, তেমনই। চাঁদ হল চাঁদফুল। আর আমাদের এই বাড়িটা, সেও এক ফুল। গৃহফুল। এই ফুলে যেমন দেবতা বাস করেন, তেমনই বাস করে গৃহসর্প, গৃহপ্যাঁচা। ঠাকুমার কাছে সে শুনেছে এই বাড়িটা পুরোপুরি তাদের ছিল না। এখন যেখানে অনেকটা উঠোন, সেখানে আরও দুটি ঘর ছিল। একটি কাঙালির মায়ের, অপরটিতে এক বহুরূপী বাস করত। সে সকালেই সেজে বেরিয়ে পড়ত। সে কালীঠাকুর সাজতে খুব ভালোবাসত। সারাদিন দেবদেবী সেজে ভিক্ষে করে, নানা জায়গায় ঘুরে সন্ধেতে ফিরে আসত ঘরে। সন্ধের পর দুয়ারে বসে সে ভাটিয়ালী সুর তুলত গলায়। কোনোদিন বা শ্যামাসংগীত।
আর বাড়ি-ঘরের মালিক কাঙালিকে ঠাকুমাই বিয়ে হওয়া ইস্তক দেখেনি, তার গল্প কেবল টিঁকে আছে দাদুর মারফত। তবে কাঙ্গালির বুড়ি মাকে ঠাকুমা দেখেচে। সে তখন মরমর। একাকী স্বামী সন্তানহীনা এক মহিলা একটি ঘরে বাস করত। চেয়েচিন্তে দিন কাটাত। অনেকপরে সেই মহিলা নিজের ঘরখানাকে দাদুর বাবাকে বেচে দিয়ে চলে যায়। তখন তো আর কাগজে-কলমের এত চল ছিল না। মুখে মুখে বিক্রি হত ঘরবাড়ি, মানুষের সংসার। একজনের সংসার অন্যজনে ভোগ করত।
আর বহুরূপী যে চলে গেল, কাউকে বলেও যায়নি। একদিন সেজে বেরুল, আর ফিরল না। ক্রমে পড়ে থাকতে থাকতে এই দুটি ঘর মলিন ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে ওঠে। তখন সেগুলি নচির দাদুর বাবা নানাভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ঘর পড়ে গেলে বাড়িয়ে নেওয়া হয় উঠোন।
সেই উঠোনে এখন হরিনাম হচ্ছে সকাল থেকে। নচিও তাদের সাথে বসে পড়ল। তারা নানাভাবে, নানাসুরে গান করছে। বিশ্রাম নিচ্ছে। আর লাল চা চলে আসছে আধঘন্টা অন্তর। সেই দলের একজন খঞ্জনি বাজানো থামিয়ে তার কানে কানে বলল, এবার একটা দলের টাকা দিয়ো, ঠাকুর।
মানে? কি দল? নচি অবাক।
সে কানের গোড়ায় মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, দল মানে হল হরিনামের দল, ভাইপো—ফি বছর দোলের সময় হয়। গায়ক বাজনদার মিলে জনা চারেক থাকে। এখন একটা দল করা মানেই বারো হাজারের ধাক্কা। তিনদিনের গান। দুটি দল তো করতেই হবে। মানে চব্বিশ হাজার। এর উপর প্যান্ডেল খরচা, লাইট খরচা। গেরামের লোক এখন আর চাঁদা দিতে চায় না। আবার নামগানও বাদ দেওয়া যাবে নে। চাঁদা অবশ্যি কোনোকালেই দিত না। দু’শত টেকা চাঁদা ফেললে দেয় মাত্তর পঞ্চাশ টেকা। এদিকে দিনরাত বাড়িতে বাড়িতে মোচ্ছব লেগেই আছে। আর এখন মোচ্ছব মানেই ইংলিশ বোতল! ইদিকে গেরামের অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদার কথা বলতে গেলেই হাত উলটে দেবে। তোমাদের এই বাড়িটা থেকে আমরা এইবছর এই টাকা নিচ্ছি। আর গান শুনতে এসো। কতদিন তো আসো না। জানো তো, তোমার ঠাকুমা হরিনাম সংকীর্তন খুব ভালবাসতেন।
নচিকেতা এলোমেলো হাঁটতে থাকে গ্রামের পথ ধরে। সে বালকবেলায় গ্রাম ছেড়েছে। শহরে গেছে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে। এখন সে শহরের মানুষ। গ্রামের অনেক মানুষের কাছেই তার মুখ ঝাপসা। সেও ভুলে গেছে বহুজনের নাম-ঠিকানা-পরিচয়। যা কিছু মনে পড়ে তা ভাসাভাসা।
ছোটবেলায় শহর থেকে গ্রামে এলে খালপাড়ে চুপ করে বসে থাকত। পাশে বৈরীগাছ। সেই বৈরী গাছ এখনও বেঁচে আছে। তেমনি করে জলের প্রতি ঝুঁকে। ছোটবেলায় সেই গাছে হেলান দিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরত নচি। এখন গাছটাকে দেখে কেমন যেন ক্লান্ত বলে মনে হয়। তখন ঠাকুমা মাঝে মাঝে বলত, তুই অত কী ভাবিস নাতি? এই কচি বয়স তোর, ইস্কুলে পড়িস, এখনই এত ভাবনা কেন?
নচি কথা বলে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে বৈরীগাছের গোপন পাতার নিচ থেকে উড়ে যাচ্ছে ছোট্ট মাছরাঙ্গাটি। ঠাকুমা বলে, অত ভাবিস না, এখনও লম্বা জীবন পড়ে আছে। একশো বছর পরমায়ু হোক তোর, তখন না হয় ভাবিস।
খালের জলে এখন আর কেউ নামে না। পচা জল। কচুরিপানায় পূর্ণ। ছেলেবেলায় যখন জল কমে আসত চোত-বোশেখ মাসে, ঠাকুমা হাঁটু অবধি কাপড় গুটিয়ে খালের পাঁকে নেমে গরুর জন্য কচুরিপানা, বর্মি আর হিঞ্চে কেটে আনত। তখন বৈরী গাছের নিচে বসে নচিকেতা দেখত। ঠাকুমার পিছুপিছু ঘুরত বক। পোকা খাবার আশায়। একঝোড়া বার্মাশাক কাস্তে করে কেটে এনে পাড়ে নামাত ঠাকুমা। দম ফেলে বলত, নে, এবার একগেলাস নেবুর জল করে নেসে দে।
সে চলে এল বিশালাক্ষীতলায়। আগে যেটা শুধু চাতাল ছিল, এখন সেখানে গ্রীলঘেরা মন্দির। বসার জন্য জায়গাও আছে। প্রচুর গাছপালা। তাতে আনমনে ঘোরে পাখির দল। নচি সেখানে বসে হাওয়া খেতে লাগল। সামনে খাল। ছোটবেলাতে যখন খাল গুলানো হত, অনেকবার মাছ ধরতে গেছে সে।
নচিকেতা খেয়াল করল, কে একজন ওই প্রাচীন অর্জুন গাছের নিচে বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখে ব্রজেনকাকু। মেজঠাকুমার মেজো ছেলে। নচি অবাক হয়ে বলল, আরে! তুমি এখানে? এখানে কখন এলে?
তার দিকে মুখ ফিরিয়ে ব্রজেন বলল, আসার কিছু নেই রে! আমি তো এখানেই শুয়েছিলুম।
অবাক হল নচি। বলল, মানে?
জলের দিকে মুখ ফিরিয়ে ব্রজেন বলে, এই তো, প্রিয়তোষের বাড়িতে শুয়েছিলুম। ভোর হতে উঠে এসেছি। নচিকেতা ব্রজেনের পাশে বসে পড়ল। বলল, কিছু বুঝলুম না।
খালের ভেতর কয়টি ডাহুক চলছে। তাদের দিকে তাকিয়ে ব্রজেন বললে, আমি কাল সকালে এসেছি। বড়মাকে দেখতে। বড়মার এখন-তখন অবস্থা শুনে ভাগ্যি এসেছিলুম, তাই চোখের দেখা দেখতে পেলুম। রাত পুইতে না পুইতেই বড়মা মারা গেল! তোরা কাল কখন এলি?
মাঝরাতে। আর বলো না, এত জ্যাম! এখন কলকাতাগামী সব লরি এদিক দিয়েই পাস হয়। বড় রোড ধরলে টোল দিতে হবে। এখানে ফ্রি।
হুম! আমি রাত বারোটার সময় এখানে চলে এসেছি। বড়মা চলে গেল, ওখানে বাড়ির সব লোক আছে আমি আর থেকে কী করব। একটু ঘুমুতে এলাম। আজ পুড়িয়ে তবে বাড়ি ফিরব। তুমি এতদূরে ঘুমুতে আসো কেন? ঘরেই তো শুয়ে নিতে পারতে।
কিছু করার নেই রে। ওই বাড়িতে আমার কোনো ঘর নেই।
তার মানে? নচি হাঁ হয়ে গেল, তোমাদের তো অনেকগুলি ঘর!
তার একটাও আমার নয়। আমার দুই ভাই সেইসব কব্জা করে নিয়েছে। রাস্তার ধারের মাটির ঘরটা আমি চেয়েছিলুম। কিন্তু পবা’র ছেলে বললে, জেঠু, আমি যখন বড় হব, ডাক্তার হব। আমি ওখানে চেম্বার করব। ফলে হল কি, আমার আর কোনো ঘর রইল না। বাপের কোনোকিছুই আমি পেলাম না — মাটির ঘরটাও নয়!
নচি চুপ করে রইল। এটা মেজঠাকুমাদের পারিবারিক ব্যাপার। আর এখনকার দিনে কেউ কারও বাড়ির ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তা সে যতই নিজের লোক হোক।
ডাহুক দুটি উড়ে যাচ্ছিল। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নচিকেতা বলল, তোমার মনে আছে কাকু, কেমন ছিল আমাদের বাড়িটা?
ব্রজেন উত্তর না করে চুপ করে রইলে। গাছপালাও আর তেমন কথা বলছে না। গ্রামেও এখন আর তেমন পাখি দেখা যায় না। শিয়াল কমে গেছে। অথচ ছোটবেলায়, সন্ধে হলেই দুয়ারে থলে পেতে পড়তে বসে নচি হাজার শিয়ালের ডাক শুনতে পেত। দাদু বলত, শিয়ালের মাংস খেলে আর ঠান্ডা লাগে না।
একটু চুপ থেকে ব্রজেন বললে, আগে বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম ছিল। মেলামেশা ছিল, ভাষা ও ভাবের আদানপ্রদান ছিল। আর এখন? সব ভেঙেচুরে একশা হয়ে গেছে! আগে তোদের বাড়িতে টক না হলে জেঠু খাবার সময় হাঁক পাড়ত, লুপু একবাটি টক গিয়ে দিয়ে আসত। আবার চায়ের সময় আমাদের ঘরে চিনি না থাকলে লুপু এক কাপ চিনি ধার করে নিয়ে আসত। আর এখন? কেউ কারও খবরই নেয় না। বাড়ির খবর কে রাখে?
ব্রজেনকাকু খালের দিকে তাকিয়ে বলে চলে, এখন কী মনে হয় জানিস, বাইরে চলে গেছি, তবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। কিছু করেছি। বাঙালদের সঙ্গে ভিড়ে খাস জমি দখল করেই হোক, আর যাই হোক, শহরের উপকন্ঠে দু’খানা ঘর, ইট-টালির ঘর তো গড়ে তুলতে পেরেছি! তাই বা ক’জন পারে? এখানে থেকে গেলে কী হত? সেই এক হাত জায়গার জন্য মাথা ফাটাফাটি করতে হত!
একটু চুপ করে থেকে ব্রজেন বলে, এখানে যদি তোরাও থাকতিস কী হত? সেই ঘর নিয়ে ঝামেলা। না জেঠু জমি করতে পেরেছে, না আমার বাবা পেরেছে! এখানের এমএ পাশরা দুইবেলা চ্যাটাই পেতে টিউশনি করে। আর কবে সরকারি চাকরির শিকে ছিঁড়বে, সেই আশায় দশ-বারো বছর ধরে নানা পরীক্ষা দিয়ে যায়। এই যে তুই একটা প্রাইভেট চাকরি করছিস—করছিস তো! এখানে থাকলে কি সেসব হত? আমাদের বাড়ির বাকিরা কেউ এখান থেকে বেরুতেই পারল না! তারা একটা ঘরের জন্য কুঁদোকুঁদি করবে না তো কে করবে?
তাদের বাড়ি থেকে একজন দৌড়তে দৌড়তে আসে। ও-বাড়ির ছোট পিসির ছেলে। মাধ্যমিক দিল মনে হয় এবার। সে রাগত স্বরে বলে, তোমরা এখানে? আর কতজন তোমাদের খোঁজে কতদিকে গেছে। কেউই মোবাইল নিয়ে বেরুওনি। এখানে আছ, বাড়িতে বলে আসবে তো!
ব্রজেন শান্ত স্বরে জিঞ্জাসা করল, কেন রে? কি হল?
কেন আবার, দেহ শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে না?
বাড়িতে ঢুকতেই নচির দিকে নানাজনের নানা বিদ্বেষ ভেসে আসে, তোর আর কাণ্ডজ্ঞান কোনদিন হবে না। ঠাকুমা এখানে মরে পড়ে আছে, সারা রাত ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়ে এখন খালধারে গিয়ে বসে আছিস? তোর মধ্যে মানবিকতা বলে কি কিছু নেই?
যারা দেখার ছিল সকলে এসে গেছে। পাড়ার লোক, গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে। রাস্তাতেও লোক। নানাজনে নানা কথা বলাবলি করছে। এবার ঠাকুমাকে তোলা হবে। অনেকেই বলল, যা, কাঁধ দে। তুই তো নাতি। নাতি অনেক আছে — এই বলে নচি সরে এল। পঞ্চাশজনের দল শ্মশানে পৌঁছে গেল। নচি সকলের চোখ এড়িয়ে গিয়ে বসল পাশের গ্রামের শ্মশানে।
এই দুই শ্মশান পাশাপাশি অবস্থিত। প্রথমে আমাদের, মাঝে একটা ছোট ডোবা, তারপর পাশের গ্রাম জগরামপুরের শ্মশান। ওই গ্রামের শ্মশানে যেমন একটা মা কালীর মন্দির আছে, এই শ্মশানেও আছে। পাশে একটি চালা। সেখানের দাওয়ায় বসে একজন গাঁজা পাতা কাটছে ছোট একটা ছুরি দিয়ে। বসে আছে তিনজন। নচিকেতাকে দেখে বললে, এসো ঠাকুর। বোসো। একহাত হয়ে যাক। আর একজন বললে, ঠাকুমা চলে গেল তাহলে! বাকিজন বলল, তা যাবার বয়স হয়েছে বটে।
এই গ্রামের কয়টি ছেলে নচিকেতার সঙ্গে পড়ত। তাদের একজন নিশিকান্ত। ওদের কাছে নিশিকান্তর খোঁজ করল সে। ওরা বলল, নিশিকান্ত এখন ছোটহাতি চালায়। হরিপুরের মিনিবাস বন্ধ হয়ে গেল। এখন হাতি নিয়ে নিশিকান্ত বাইরে বাইরে যায়।
কথা চলতে চলতে ঠাকুমাকে নিয়ে বাড়ির, পাড়ার লোক ও আত্মীয়রা সকলে এসে গেল। এক বটের ছায়ায় ঠাকুমাকে রাখা হয়েছে। ভালকরে ঠাকুমার মুখটা দেখে নিল নচি। ব্রজেন কাঁধে গামছা চাপিয়ে চাতালে বসে আছে মুখ নিচু করে। একজন সাইকেলে চেপে ঠান্ডা ও রসগোল্লা আনতে গেল।
এবারে শ্মশানে এসে একটা জিনিস দেখে ভাল লাগল নচির। আগে খালপাড়ে ঝোপ পরিষ্কার করে চিতা সাজানো হত। এখন সেখানে পাকা বন্দোবস্ত। মাটি থেকে অনেকটা উঁচু করে সিমেন্ট বাঁধানো চিতা সাজানোর ব্যবস্থা। ছাদ। বর্ষায় চিতা নেভার ভয় নেই। এলাকার বিধায়ক করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, গরমেন্ট পালটে এই লাভ আমাদের হয়েছে।
একজন গাঁজা টানতে টানতে তাকে ধরে ফেলে। তার নাম কাশী বাগ। সে উদাস গলায় বলে, তুমি কি এখানে লুকিয়ে থাকতে চাও, ঠাকুর?
নচিকেতা কোনো উত্তর দেয় না। সামনে ফসলের খোলা আদিগন্ত মাঠ। চালার পিছনে এক ভয়ানক বাঁশবাগান। সেদিকে তাকিয়ে একঝলকে এক শিয়াল দেখল বলে মনে হল। দ্বিতীয়বারে দেখে এক ডাহুকপাখি বাঁশবনের ভেতর ঘুরে যাচ্ছে।
আগুন জ্বলে গেছে। তার ঠাকুমা জ্বলে যাচ্ছে। এই সময় কি ব্যথা লাগে মানুষের? জানা নেই। যেমন জানা নেই আশপাশের যে গাছেদের ছুঁয়ে যাচ্ছে চিতার ধোঁয়া, তারা কি জানে কে পুড়ে যাচ্ছে? কোনো মানুষ, তার কোন স্বপ্ন, কোন স্মৃতি, মনের মধ্যে ঘরবাড়ির ভাঙাগড়ার কাহিনি নিয়ে কত মানুষ এইভাবে জ্বলে যায় — লেলিহান শুকনো আগুন তার খবর রাখে না। এমন কতশত ধোঁয়া টেনেও তারা নির্বাক বেড়ে ওঠে, জল টানে, জল খায় তা কে বলতে পারে! ছিলিম টেনে একজন বললে, বেশিক্ষণ লাগবে না। বড় জোর ঘন্টা দেড়েক। শরীরে কিছু তো ছিল না। অপরজন বললে, এই বয়সে আর কি-ই বা থাকবে দেহে। যা আছে তাই নিয়ে পুড়ে যাবে।
এই সময় কেউ একজন এদিকে কোন কাজে এসেছিল। সে দেখে ফেলল। বলল, এখানে বসে তুই কি করছিস নচি?
এমনিই।
চলে আয়। দেরি করিস না।
সামনের জমিতে মাচা করে পটল চাষ হচ্ছে। পটলের নিচে আলো-ছায়াতে বেড়ে উঠছে সুন্দর বেড়ে উঠছে পালমশাক। দেখে নচি উঠে যায়। মাচার ভেতর নিচু হয়ে ঢুকে দেখে সেখানে কার্তিক বসে বসে মাটি চাঁচছে। নচিকে দেখে বললে, কি ভাইপো? বললাম, এইভাবে পালমের চাষ দেখিনি। আগে এমনি হোত না। কার্তিক বলল, এখন এমনি শুরু হয়েছে। পালমের দাম এখন অনেক। কিলো প্রতি চল্লিশ। খোলা বাজারে ষাট টাকা কিলো। পাঁচ কিলো পালম বেচতে পারলে ভাল লাভ — পটলের চেয়ে বেশি। পাকা পটল খাবি?
এটা কি তোমার জমি?
দূর! আমি গরীব মানুষ, জমি কোথা পাব। আমি কাজ করি। তিনশ টাকা রোজ পাই। সকাল সাতটা থেকে বেলা বারোটা।
এখন তো বারোটা পার হয়ে গেছে।
জানি। এটা বিকেলের খাতার হিসেবে হবে। যার জমিতে খাটি, তাকে বলা আছে। বিকেলের রোজ আলাদা। দু’শ টাকা। এই যে — পাকা পটল। নিয়ে যা, ভেজে খাস। তোর ঠাকুমার তো হয়ে এল।
শ্মশানে গেল নচি। চিতাতে জল ঢালতেই হল। সকলে বলল, কোথা ছিলিস এতক্ষণ? সব মিটে গেল, আর এখন এলি?
ক্রমে সন্ধে নেমে আসে। আকাশে এই বড় চাঁদ ওঠে। চাঁদ ফুটলে নচি বাইরে আসে। বাড়ির ভেতর থেকে হই-হল্লার শব্দ বাড়ির বাইরে এতটাই আসে যে মনে হয় সেখানে কোন উৎসব চলছে। বাইরে ফটফট করছে চাঁদের আলো। শহরে চাঁদকে মাপা যায় না। চাঁদ হল একটি ফুল যার গন্ধ আকাশ মাতোয়ারা হয়ে আলো দেয়। এই যে আলো, তা আসলে আলো নয়, চাঁদফুলের সুবাস। দেউড়ির কছে এসে নচিকেতা দেখল, ব্রজেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতে বললে, আজ খুব গালমন্দ খেলি তুই। এমন করার কি খুব দরকার ছিল? এবার নচি চুপ। ব্রজেন বলে, যাক, ছাড় ওসব। বল দেখি, এদিক-ওদিক ঘুরে পুরানো বাড়ি নিয়ে কী কী খবর জোগাড় করলি?
কিছু না। আসলে আমি খুঁজছিলাম অন্য এক জিনিস। সেটা কাউকে বলা যায় না।
কৌতূহলী হয়ে ব্রজেন জানতে চাইল, কী সেটা?
‘আমাদের বাড়ি’ যদি বলো, তা গড়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। আমরা যারা ভাঙচুর করে নতুন করে গড়ি, তারা সেই পুরাতন ছাঁচই গড়ি; তবে নতুন করে। আর সেই নতুন ছাঁচের ভেতর একটু একটু করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা হারিয়ে যেতে থাকে। আমি আসলে বাড়ির সেই ছাঁচের ভেতর সেই তাদেরকে খুঁজছিলাম। গত মানুষেরা আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে কিনা।
তা কী দেখলি?
ওঁরা গত হয়েছেন; মুছে গেছেন। গ্রামের সকলে বলল, তোমাদের বাড়িতে এই কাকা, এই দাদা এই এই করেছে। মুছে যাওয়া মানুষেরা কী কী করেছেন এই বাড়ির জন্য, তা তাদের মনে নেই। ফলে কেবল ‘আমাদের বাড়ি’ কেন, নিজেদের বাড়িই কেমন ছিল, তা তারা নিজেরাই ভুলে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্রজেন বলল, সেই হয় বুঝলি। পুরানো সবকিছু ধুলো হয়ে গেছে রে — মাটি হয়ে গেছে, কে আজ আর তার কথা মনে রাখে! আমি এই বাড়ি ও সংসারের জন্য কম কিছু করেছি? যেই বাইরে গিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালুম, সবাই ভুলে গেল আমায়। এবার আমাকেও সব ভুলে যেতে হবে। এখানের মাটি, এই টান, এই জন্মভূমির গ্রাম — হয়তো এটাই সংসারের নিয়ম!
তুমি আজ বাড়ি গেলে না?
দূরের দিকে তাকিয়ে ব্রজেন বলে, ভালো লাগল না জানিস। মনে হল থেকে যাই। বড়মা মারা গেল। এই আকাশে-বাতাসে আজ আর আমার কেউ নেই। এক ছিল বড়মা, এলে কাছে বসে একটু শান্তি পেতুম। মনের কথা বলতে পারতুম। আর পেতুম এক মাটির গন্ধ। সহজ-সরল মানুষদের গা থেকে এক মাটি মাটি গন্ধ বেরোয় — জানিস তো? বড়মা তেমনি ছিল। আমার সেই বড়মাও চলে গেল। এখানে আর কাকে দেখতে আসব? গ্রামে আসার পাঠ আমার ফুরুল। তাই একদিন চেপে থেকে গেলুম। কাল সকালেই বেরুব। আবার সেই বড়মার কাজের দিনে আসব। নচিকেতা বলে, তুমি একটা কাজ করবে? আমার কাজ। কিন্তু কাউকে বলতে পারবে না।
ব্রজেন ভুরু কুঁচকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। বলে, তোর আবার কী কাজ?
নচিকেতা নীরব। ব্রজেন একটু ইতস্তত করে বলল, আচ্ছা বল, দেখি পারি কিনা।
আমি এই যে এদিক-ওদিক করছিলাম, তা আর কিছুই নয়; ঠাকুমার একটুকরো বাসস্থানের জন্য। কারণ এই বাড়িতে ঠাকুমা আর বাঁচবে না।
ব্রজেন সোজা হল। বলল, তার মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?
নচিকেতা বলে, তোমার মতো, কালকেই আমাকে চলে যেতে হবে। আজ ছুটি করেছি, কাল ছুটি নেই। আমিও আসব সেই কাজের দিন। সেদিনই ব্যাক করব। আমার এই বুড়ি ঠাকুমাকে তোমার ভিটেতে একটু জায়গা দেবে?
হাঁ মুখ করে ব্রজেন বলল, এইসব কী কথা? পুড়িয়ে এলি কয়েকঘন্টা হয়েছে মাত্র। তোর হল কী!
নচিকেতা বলে, এই মাধবীলতার গাছ তুমি তোমার বাড়ির বাঁশের বেড়া ধরে উঠতে দেবে? তাহলে ঠাকুমা বেঁচে যায়। আমার শহরে ঠাকুমার জন্য জায়গা করতে পারব না—’ বলতে বলতে এই প্রথম গলা ধরে এল নচিকেতার।
তখন ব্রজেনের ঠোঁটে আলতো এক অদ্ভুত হাসি দেখা দিল। বাড়ির ভেতরের ঝলমলে আলোর দিকে তাকাল একবার। বাড়ির সবাই খোশগল্পে মত্ত। হাহা হাসির কলরব। মৃতেরা এখানে বেঁচে থাকে না। দূর আকাশের তারা হয়ে চাঁদফুলের পাশে রয়ে যায়।
সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে গাছের গায়ে, ফুলেদের গায়ে হাত বুলাতে লাগল ব্রজেন। বলল, তুই ঠিক বলেছিস, নচি, জানিস! তুই ঠিক। আমি যেখানে আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকি, এবার থেকে বড়মাও সেখানে থাকবে। বড়মার শেষ কয় বছর খুব কষ্টে কেটেছে, আমরা সকলেই জানি। শুনেছি, বড়মা ঠিকমতো ভাত পেত না, জল পেত না। শুনি নাকি মারধোরও খেয়েছে। হা কপাল! বয়স হলে মানুষের কপালে এই থাকে জানিস — লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা! মানুষ যত বেশিদিন বাঁচে তত দ্রুত সে মারা যায়। সবই বুঝি, জানি। কিন্তু নিজেদের ভেতর থেকেও এখন বলাবলি, শাসন করা সব উঠে গেছে। এখন যে যার, সে তার — তাই আর সেসব কথা তুলিনি। এসেছি, বড়মাকে দেখে ফিরে গেছি। কাল বড়মাকে আমি নিয়ে যাব নিজেদের বাড়ি। সেখানে বড়মাকে সকাল-সন্ধে জল দিতে পারব, আমার যখন বাতাসের দরকার হবে, বড়মা জানালা দিয়ে শীতল বাতাস পাঠাবে; আকাশে চাঁদ উঠলে বড়মার সঙ্গে বসে সেই মাটির চাঁদফুল দেখব। যা ছিল শুধু আমার একার বাড়ি, কাল থেকে সেটা বড়মারও বাড়ি হয়ে উঠবে। বড়মাকে ভিটেহীন হতে দেব না। এখানে আমার ঘর হল নাতো কী, ঘরের মানুষকে তো নিয়ে চলে যাচ্ছি—এই আমার অনেক! আমার বাড়ির টিনের দরজায় বড় করে লিখে দেব, ‘আমাদের বাড়ি’।
অন্ধকারে চোখ দুটি মুছে নিল নচিকেতা।