মহারাজ দুর্যোধনের অন্তিম রাত্রি। বর্তমান আলেখ্যে তাঁর অপরিসীম নৈসঙ্গের স্বগত-চিন্তন বর্ণিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই চিন্তন কোনো প্রকার বাক্স্ফূরণে উদ্গীথ হচ্ছেনা। এটি একান্তই তাঁর অন্তিম চিন্তনের কাল্পনিক আত্মকথন। অসম্ভব দৈহিক এবং মানসিক ক্লেশে তাঁর বিক্ষিপ্ত মানসিক চিন্তন-প্রবাহ উপলক্ষুব্ধ বিবিক্ত ধারার প্রকাশভঙ্গীতে যেন এই আলেখ্যে প্রকাশমান।রচনার মধ্যে সে কারণেই পৌনঃপুনিকতা জ্ঞানতই রাখা হয়েছে। অকপটেই বলতে চাই এর মধ্যে পৌরাণিক অথবা মহাভারতীয় কাহিনীর নিপাট বুনোট রাখার প্রচেষ্টা করা হয়নি। সম্পূর্ণ জ্ঞান লুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত একজন মহাশক্তিধর মানুষের চিন্তনে কতটা চেতনতা থাকা সম্ভব, তার প্রকাশ করার বাসনায় এই রচনা-প্রচেষ্টা। জানি না, এরকম একটি ঢিলেঢালা রচনা পাঠকচিত্ত আকর্ষিত করবে কিনা।
দুর্যোধনের মধ্যে কি শেষ পর্যন্তও প্রতিহননেচ্ছা বিরাজিত ছিল? না কি, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, কৃতবর্মাকে নৈশসমরে, সম্মতি প্রদান করে, তিনি আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হচ্ছিলেন? মহাভারতে অশ্বত্থামা চরিত্র যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তাতে মনে হয়, তিনি যতটা বীর যোদ্ধা, ততটা পরিণামদর্শী ছিলেন না। দুর্যোধন, সম্ভবত, পঞ্চপাণ্ডবের ঔরসে দ্রৌপদীর গর্ভজাত পঞ্চ পুত্রের ছিন্নশির দর্শনে হর্ষ লাভ না করে বিষাদগ্রস্তই হয়েছিলেন। কাশীদাসী মহাভারতে এরূপ উক্ত আছে, তবে কালীপ্রসন্ন অনূদিত মহাভারতে সেরূপ উল্লেখ নেই, বরং সেখানে দেখানো হয়েছে, পাণ্ডবরা নির্বংশ হয়েছে বলে দুর্যোধন প্রীতই হয়েছিলেন। পাণ্ডবদের নিধন বিষয়ে কোনো কথারই সেখানে উল্লেখ নেই।
মহাভারতকার যেন ধার্তরাষ্ট্রদের মধ্যে একমাত্র বিকর্ণ ব্যতিত আর কারো মধ্যেই মানবিক গুণ দেখাতেই চান নি। যত গুণ সবই পাণ্ডবদের অধিগত এবং যত দোষ-ত্রুটি তার সব কিছুর আধার কৌরবেরা। দুর্যোধনের আত্মকথনে, তাই ব্যাসদেবের এই একদেশদর্শিতার ইংগিত উল্লিখিত হয়েছে।
এই আলেখ্য কোনো সামগ্রিকতায় গ্রথিত নয়। এখানে নিতান্তই সামান্য কাল ব্যাপ্তিতে দুর্যোধনের -- ‘কালসন্ধ্যার’ বৃত্তান্ত বলার চেষ্টা করা হয়েছে। সময়ের বিচারে সর্বার্থেই এটি ‘কালসন্ধ্যা’ ছিল। জীবনের শেষ লগ্নে দুর্যোধন তাঁর প্রতি অনুষ্ঠিত অন্যায়ের যেমন বিবরণ দিয়েছেন, তেমনি স্বয়ংকৃত অন্যায়ের জন্য আত্মসমালোচনা করেছেন। বলা বাহুল্য, এই আলেখ্যটি সর্বতোভাবেই কল্পকথায় বিন্যস্ত।
সর্বশেষ তিন জন মিত্র এখন আমার জন্য ভাবিত। মনে হচ্ছে, অশ্বত্থামা ভয়ানক কিছু করার জন্য চিন্তা করছে। তার ধারণা সে আমাকে আবার পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে। আমার ভগ্ন-ঊরুদ্বয় আবার অস্থি সংযুক্ত হয়ে শল্য চিকিৎসক তথা বৈদ্যদের দ্বারা পূর্ববৎ সবলতা লাভ করবে। আমি আবার সব বৈভব প্রতিপত্তি অর্জন করে এই সঙ্গীত্রয়ের সাহায্যে অনতিবিলম্বে চতুর্বলের অধিকারী হব। এ কারণেই অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মার সঙ্গে পরামর্শ করে গুরুপুত্রকে সৈনাপত্যে বরণ করেছি। কৃপাচার্য অবশ্য বলছেন পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। কৃতবর্মা মদীয় বংশীয় পেশাদার যোদ্ধা। কৃপাচার্য আমাদের শৈশবের প্রাথমিক পর্যায়ের অস্ত্রগুরু মাত্র।
এই তিন যোদ্ধা এখন আমাকে ঘিরে বসে নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলছেন। অশ্বত্থামা নিশ্চিত যে সে আজ রাতের মধ্যে পৃথিবী পাঞ্চাল ও পাণ্ডবশূন্য করবে। নানা ভাবে তাঁরা আমাকে আরাম দেবার চেষ্টা করছেন। আমি অবশ্য কোনও ভাবেই আশ্বস্ত হচ্ছি না।
গদাযুদ্ধের সময় মানবগুণ সম্পন্ন একজন মানুষই যুদ্ধস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলদেব। ভীমের অন্যায় গদা প্রহার তিনি সমর্থন করতে পারেন নি এবং ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে কুচক্রী কৃষ্ণ তাঁকে নিরস্ত করে দ্বারকায় পাঠিয়ে দেন। পাণ্ডবেরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য বদ্ধমূল হয়ে যুদ্ধ করছিল। আমি যুদ্ধের সময়ে, সুযোগ পেয়েও তাদের কাউকে হত্যার কথা ভাবিনি। যুদ্ধে আমি একটাই অনৈতিক কাজ করেছিলাম, সেটা অভিমন্যুকে সপ্তরথীর দ্বারা হত্যা। নিন্দনীয় কাজ সন্দেহ নেই। তবে আমার পুত্র লক্ষণ এবং আমার ভ্রাতাদের পুত্রদের মহাবলী ভীম নির্মম ভাবেই হত্যা করেছে। আমি এখন এইসব কথা চিন্তা করে ঘোর সন্তাপে সময় ব্যয় করেছি। কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা গণনা করে যাচ্ছেন কৌরব পক্ষের পলায়িত সেনা সংখ্যায় কত হতে পারে এবং তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করা কীভাবে সম্ভব। কিন্তু আমার মনে এমন ভরসা হচ্ছে না যে ভূমি-শয্যা থেকে আমার উত্থান আর আদৌ সম্ভব হবে। না, কোনও অবস্থায়ই আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করব না। কার জন্য আমি যুদ্ধ করব, কার জন্যই বা সন্ধি করব? কোনও কিছুর জন্যই আমার আর কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই।
এক্ষুণি এঁরা তিনজন আমাকে একা রেখে চলে যাবে। আমাকে একাই প্রাণপণ চেষ্টায় হিংস্র রক্তলোলুপ শ্বাপদদের কাছ থেকে বাঁচার শেষ সংগ্রাম করতে হবে। আশে পাশে অনেক গৃধ্রাদি আমমাংসভোজী ভীষণ প্রাণীরা লোলুপভাবে আমাকে নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে। সঙ্গীরা আমার চতুঃপার্শ্বে অগ্নিপ্রজ্বলিত করে রেখে গেছেন। সর্বশেষ শত্রুরা যুদ্ধক্লান্ত হয়ে তাদের নিরাপদ এবং অজ্ঞাত শিবিরে বিশ্রামরত। অশ্বত্থামা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আজ রজনীর গভীর যামে ওই সব শত্রুদের ধ্বংস করে আমার রাজ-রাজত্ব নিষ্কন্টক করবেন, তাঁর এই প্রতিজ্ঞা।
এখন রজনীর প্রথম যাম। জানু উত্থিত করে উপবেশন করার মত ক্ষমতা আমার আর অবশিষ্ট নেই। শুধু হস্তদ্বয়ের সাহায্যে বিকলাঙ্গ ভিখারীর মত জীবনের নিকট প্রার্থী হয়ে আছি। অপরিসীম শারীরিক ক্লেশে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাটুকুও আর নেই। একটি মাত্র আশার বর্তিকা অশ্বত্থামা আমার মনে জাগরিত রেখে গেছে। সে পঞ্চপাণ্ডবের পঞ্চ ছিন্ন-শির আমার জন্য উপহার নিয়ে আসবে। অশ্বত্থামা মহাবীর। কিন্তু এতো যুদ্ধ নয়, এ যে গুপ্ত হত্যার চক্রান্ত। তাছাড়া, অশ্বত্থামা কি জানে, কোন্ শিবিরে পাণ্ডবেরা থাকবে? অশ্বথামা কি কৃষ্ণের চাতুর্য বিষয়ে জ্ঞাত? আমার মনে হয়, পাণ্ডবদের সুরক্ষার বিষয়ে কৃষ্ণ ব্যবস্থা নেবে। সাধারণভাবে বললে বলতে হয় কৌরব এবং যাদব অধিকারের সর্বত্র যাদব রক্তের প্রতিষ্ঠাই কৃষ্ণের উদ্দেশ্য। সেজন্যে বর্তমানের কোনও ব্যক্তি বা বংশকে ধ্বংস করতে তাঁর দ্বিধা নেই। প্রয়োজনে সে নিজের যদুকুলকেও ধ্বংস করতে দ্বিধা করবে না। এরকম একজন আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী ব্যক্তি যদি আর কখনও জন্মে থাকে। অত্যন্ত ক্রূর এই কৃষ্ণ।
যাদব এবং পাঞ্চালরা কুরুকুলের পরম বৈরি। বিশেষ করে পাঞ্চালেরা। পাণ্ডবেরা স্বাভাবিক ভাবে আমাদের এতটা শত্রু হতো না, যদি যাদব এবং পাঞ্চালদের সঙ্গে তারা অতটা সম্পৃক্ত না হত। আসলে এর পশ্চাতে ছিল কৃষ্ণের চক্রান্ত। কৃষ্ণ এক সময় ব্রাহ্মণ ঋষি মুনিদের দ্বারা সনাতন পুরুষ রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। একথা অবশ্য সত্য যে কৃষ্ণ অতি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, শক্তিমান এবং অঘটন-ঘটন পটিয়সী পুরুষ। অনেক কূটকৌশল বিস্তার করে সে বাসুদেবত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সর্বক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যসমাজ তার সহায়ক ছিল। কিন্তু আমি তার ঈশ্বরত্বে বিশ্বাসী নই এখনও।
এই ব্রাহ্মণদের তুল্য শত্রু আর্যাবর্তের সাধারণ মানুষদের আর নেই। আমাদের জৈবিক পিতামহ ব্যাস মহাবোধ সম্পন্ন মানুষ। কৃষ্ণের সহায়তায় তিনি ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্য বিস্তারে যত্নশীল হয়েছিলেন। তাঁদের নির্মিত সমাজকে রক্ষাকল্পে তাঁরা ক্ষত্রিয় শক্তিকে পাণ্ডবদের অধীন রাখার প্রযত্ন করেছিলেন। আমাদের অর্থাৎ কৌরবদের ধ্বংসের পিছনে তাঁরা সক্রিয় ছিলেন। জৈবিকভাবে আমরা একই পিতামহের বংশধর, বিশেষ ভাবে আমি এবং যুধিষ্ঠির তো বটেই। অন্য চার পাণ্ডবদের উৎসপিতা পৃথকবিধায় তারা সম্ভবত একই ধারার নয় বলেই আমার বিশ্বাস। এদের মধ্যে হস্তিনায় আসার পর থেকেই ভীমকে আমি একান্তভাবে অপছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। তার স্বভাবে অত্যধিক বন্যতা আমার এবং আমার ভ্রাতাদের পক্ষে অসহনীয় ছিল। একথাও অবশ্য সত্য যে স্বভাবগত ভাবে আমি বরাবরই অত্যধিক অভিমানী, মৎসর এবং অহংকারী ছিলাম। এসবই আমার ক্ষত্রিয়সুলভ স্বভাব। আমার স্বভাবে নানাবিধ দোষের সমন্বয় ছিল। সবচাইতে বড় দোষ যেটা, সেটা হল বাল্যকাল থেকে আমি অসম্ভব ক্রোধপরায়ণ। এটা আমার মৌলিক স্বভাব। কুরু প্রবীণেরা এজন্য আমাকে নিয়ত তিরস্কার করতেন। কিন্তু তাঁরা একটা জিনিস জানতেন না, বা অধিকাংশ মানুষেরই সেটা জানা নেই যে শুধু উপদেশ আর তিরস্কারে মানুষের মৌলিক স্বভাব সংশোধিত হয়না। তার জন্য অন্য প্রচেষ্টা চাই। -- যদি ভীম না থাকত, ধার্তরাষ্ট্র এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বিরোধ এটা রক্তক্ষয়ী হত না। যদি শুধু যুধিষ্ঠির হতেন সম্ভবত মাৎসর্য থাকা সত্ত্বেও আমি নিজেকে সংযত করতে পারতাম। যুধিষ্ঠির প্রকৃতই অজাতশত্রু। কিন্তু তাঁর একটাই বিশেষ ত্রুটি, তিনি অপরিসীম ধর্মবাতিকগ্রস্ত এবং মুনিঋষিগণের মুখাপেক্ষী। রাজধর্ম পালনে প্রশাসনিক দক্ষতা এবং ইহজাগতিকতা আবশ্যক। অত্যধিক মোক্ষ-কামুকতার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রজা প্রশাসনে দক্ষতার অধিকারী হতে পারেন নি। রাজ্যলোলুপতা আমার অবশ্য ছিল, কিন্তু প্রজাগণ জানে আমি সমাজকল্যাণকর্মে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং দক্ষ ছিলাম। সেখানে ব্রাহ্মণদের অনাবশ্যক প্রাধান্য এবং তথাকথিত অনার্য জাতীয়দের জন্য নির্বিচার অত্যাচার অবলম্বন কখনই করতাম না -- যা কৃষ্ণের প্ররোচনায় পাণ্ডবেরা চিরকালই করে এসেছে। অতি নিন্দনীয় এই আচরণ।
কৃষ্ণ অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ, সন্দেহ নেই। লোকচিত্ত জয় করার জন্য মুখে এবং বিশেষত দৌত্যে বা সভায় সে অত্যন্ত আপাত যুক্তিপূর্ণ বাক্বিস্তারে পারদর্শী ছিল। কিন্তু আমার যতই নির্বুদ্ধিতা থাকুক, এই মানুষটির ধূর্ততা আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। কৃষ্ণ এক ভয়ানক সমস্যাসংকুল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বিচার না করেই আর্যাবর্তকে এক ধর্মরাজ্যে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল শুধু তার একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। ফলে, আর্যাবর্ত পরস্পর বিরোধী অসংখ্য ধর্মমতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আমি সর্বশক্তি নিয়ে তার এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এই মহাদেশ-তুল্য ভূখণ্ডে কখনই একটা একক-ধর্মরাজ্য বা সমাজ হলে তার বৈচিত্র আর বজায় থাকবে না। তাছাড়া এই মানসিকতাটা মানবসমাজে ভবিষ্যতের জন্য একটা চিরস্থায়ী অভিশাপ হয়ে থাকবে। আমার সমস্যা ছিল, বৌদ্ধিক ভাবে আমার এই বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক করার মত পারদর্শিতা বা বাক্-কুশলতা ছিল না।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধতার জন্য পূর্ণভাবে রাজপদে অভিষিক্ত হতে পারেন নি। তবে রাজকার্যে তাঁর মত দক্ষ কৌরবকুলে খুব কমই জন্মেছিলেন। পাণ্ডু খুব সুদক্ষ নৃপতি ছিলেন না। মৃগয়া, দিগ্বিজয় ইত্যাদি এবং শেষে অকাল বানপ্রস্থেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি মহাবীর ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রীদের, বিশেষ ক’রে ভীষ্ম এবং বিদুর প্রভৃতির সহায়তায় তাঁর অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রই বেশিদিন রাজ্য শাসন করেছেন। শাসক রূপে তাঁর খ্যাতি ছিল। আমার পঞ্চদশ বৎসর বয়োক্রম পর্যন্ত, তিনি নানাভাবে যখন আমাকে রাজকার্যে শিক্ষিত করে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার জন্য প্রস্তুত করছিলেন, ঠিক সেই সময়ে মাতা কুন্তী পাণ্ডবদের নিয়ে তাঁদের শতশৃঙ্গ আশ্রমাবাস থেকে মাদ্রি আর পাণ্ডুর শবসহ হস্তিনায় এলেন। যদিও অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের জন্ম সংবাদ যথাসময়ে রাজধানীতে পৌঁছোলে, ভবিষ্যতে তিনিই কুলরীতি অনুযায়ী রাজপদের উত্তরাধিকারের জন্য নির্ধারিত হয়েছিলেন, তথাপি অন্ধরাজার অভীপ্সা ছিল, কুরুপ্রবীণেরা অন্ধত্বের কারণে তাঁর বঞ্চিত হবার কথা বিচার করে আমাকে রাজপদ প্রদান করবেন। ক্রমে বিভিন্ন কারণে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বিরোধের উদ্ভব ঘটলে কুরুরাজ্য প্রবীণদের ইচ্ছায় দ্বিধাবিভক্ত হয়। এই প্রাচীন রাজ্য সহজে বিভক্ত হয়নি। এ নিয়ে জ্ঞাতিদের মতবিরোধ ছিল অনেক। একপক্ষ আমাদের এবং আর এক পক্ষ পাণ্ডবদের অনুকূলে ছিল।
আর্যাবর্তীয় রাজবংশগুলো সকলেই বিষম আত্মম্ভরী; প্রত্যেকেই মনে করে বংশ গৌরবে সে-ই অন্যের অপেক্ষা উচ্চ। এ বিষয়ে আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং প্রিয় সখা চার্বাকের বিচার আমার নিকট যথার্থ যুক্তিপূর্ণ। সে বলে, মানুষ প্রাকৃতিকভাবে একই পদ্ধতিতে সংসারে জন্মায়। সুতরাং আর্য হোক, অনার্য হোক কেউই একে অন্যের চাইতে বড় বা ছোট নয়। তবে হ্যাঁ, আর্য ও অনার্যজাতিদ্বয়ের বিকাশে শিক্ষার ভিন্নতা আছে। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশও সব জাতির একরকম হয় না।
কুরুকুল আকারে অতি বৃহৎ ছিল। তারা চেয়েছিল, কুলগৌরব রক্ষা করার জন্য যেন এই বংশ কোনও ভাবেই বিভক্ত না হয়। পাণ্ডবেরা যে আদৌ কৌরব কুলের সঙ্গে ঔরস সূত্রে সম্পর্কযুক্ত এরকম কোনও প্রমাণ ছিলনা। অবশ্য এক্ষেত্রে নিয়োগ পুত্রের অধিকারের কথা বলা হয়। কিন্তু যুধিষ্ঠিরাদির জন্মবৃত্তান্ত যারপরনাই রহস্যাবৃত। এই কারণে তাদেরকে আমি কোনওদিন কুরুবংশের বলে মনে করিনি। কুলগত সেই অভ্যাসেই, মনে মনে তাদের হীনজন্মা মনে করেছি। মনে আছে অস্ত্রশিক্ষা পরীক্ষাকালে, ভীম কর্ণকে সূতপুত্র বলে কুৎসিত ভাবে উপহাস করলে, ভীমের মুখের উপর প্রকাশ্য সভাস্থলে শুনিয়ে বলেছিলাম --“ভীমসেন, এরূপ বলা তোমার শোভা পায় না। বলই ক্ষত্রিয় চরিত্র চর্যার ব্যক্তিদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, বীরপুরুষ এবং নদীর উৎপত্তিস্থল জানা শক্ত।
"(পুরাণে আছে) জল থেকে অগ্নির উৎপত্তি। দধিচীর অস্থি দ্বারা বজ্র হয়েছিল। ভগবানগুহকে আগ্নেয়, কার্তিকেয়, রৌদ্র, গাঙ্গেয় ইত্যাদি বলা হয় (তাহারও জন্মবৃত্তান্ত রহস্যাবৃত)। বিশ্বামিত্র প্রমুখ ক্ষত্রিয়গণ যে তপঃপ্রভাবে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন, তাও তোমার না জানার কথা নয়। আচার্য দ্রোণ কলস থেকে উৎপন্ন, শরশুম্ব থেকে গৌতমের জন্ম। (সবচেয়ে প্রধান কথা) তোমাদের জন্মবৃত্তান্তও আমার জানা আছে।”
আমার মিত্র চার্বাক আমাকে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রমী সমাজ দর্শনের ব্যতিরেকী ভিন্ন মতের তাত্ত্বিক জ্ঞানে ভিন্নভাবে শিক্ষিত করছিলেন। সে কারণে কুরু প্রবীণেরা এবং ঋষি-মুনিরা আমার প্রতি অত্যন্ত বিরূপ ছিলেন। আমার চরিত্রে সবচেয়ে বড় ত্রুটি এই যে আমি খুব ভেবে-চিন্তে, সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না। আধ্যাত্মিকতার চর্চাকারী যাঁরা, তাঁরাই বেশী সাজিয়ে গুছিয়ে, মিথ্যে আশ্বাসে মানুষকে স্তোক দিয়ে রাখে। যদিও চার্বাক বলেন, এরা সকলেই ভণ্ড, ধূর্ত এবং প্রবঞ্চক, আমি মনে করি প্রশাসন কল্পে কিছু সামঞ্জস্য রক্ষা সাধারণের সঙ্গে অবশ্যই বজায় রাখতেই হয়। তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দের ক্ষেত্রে আমার উগ্রতা অতি তীব্র। সেটা চার্বাকের সংস্বর্গেই আমার স্বভাবে বর্তেছে। একারণেই ব্রাহ্মণ্য সমাজে বা রাজসভার বিদ্বজ্জনেরা আমাকে অত্যন্ত অপছন্দ করেন। অবশ্য সেসব আমি কোনওদিন গ্রাহ্য করিনি।
পিতা আমাকে বলেছিলেন -- “বৎস, তুমি আমার জেষ্ঠপুত্র। পাণ্ডবদের হিংসা কোরো না। যুধিষ্ঠির তোমাকে হিংসা করেনা, সে তোমার মিত্র, তুমি তার সমান সম্পত্তি ভোগ করছ। (তাঁরা স্ব ক্ষমতায় অধিক ধনার্জন করছেন)। পরধনে স্পৃহা অনার্যের আচরণ। তুমি মিত্রদ্রোহী হয়ো না।” আমি বলতে পারতাম -- ‘পিতা, আপনার কথা যদি যথার্থ হয়, তবে পররাজ্য লুন্ঠন করে তারা কি অনার্যোচিত কাজ করছে না? তারা যাদের রাজ্য লুন্ঠন করছে, তাদের মধ্যে অনেকেই তো আমাদের মিত্র’ সেজন্য তাদের আপনারা কিছু বলছেন না কেন? শুনেছি মহারাজ পাণ্ডুও প্রভূত লুন্ঠনাদির দ্বারা ধনরত্ন আহরণ করে আপনাকে প্রদান করতেন। তার সম্যক কারণ ছিল এই যে অন্ধতার কারণে রাজপদ না-পাওয়ায় আপনার দুঃখমোচন করাটা তিনি প্রয়োজনীয় বোধ করেছিলেন। কিন্তু পাণ্ডবেরা পরপীড়ন করে কোন্ ধর্মোচিত কাজ করছে? ওরকম কাজ আমি কখনোই করব না।'
পিতা এবং প্রবীণ কৌরবেরা ধরেই নিয়েছিলেন, আমি পরশ্রীকাতর এবং পাণ্ডবদের ঐশ্বর্যের জন্য আমার লোভ ও মাৎসর্য অপরিসীম। কিন্তু আমার আচরণের তো ভিন্ন অর্থও হতে পারে।
পিতা বলেছিলেন -- ‘তুমি মিত্রদ্রোহী হয়ো না।’ কথাটা শুনে আমার ক্রোধ এবং বিরক্তি বাধা মানল না। আমি জানি পিতা নিজেও যথেষ্টই লোভী চিত্তের মানুষ। আসলে ভণ্ডামি অনেকেরই আছে। আমার কথা হচ্ছে, আসল কথাটা বলে ফেলাই ভাল। নিতান্ত অশিষ্টভাবে আমি পিতাকে বললাম -- “ব্যঞ্জনের রসে সিক্ত হলেও দর্বী ব্যঞ্জনের স্বাদ বুঝতে পারে না, সেইরূপ প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তি শাস্ত্রজ্ঞ হলেও শাস্ত্রের মর্ম বুঝতে পারে না। তুমি যাদের উপদেষ্টা, সেই আমাদের বাঁচার কোনও আশা নেই। আমরা নিজ কার্যে উপযুক্ত হলে তুমি আমাদের মোহযুক্ত কর। শত্রু ও মিত্রের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা লিখিত বা স্থিরীকৃত নেই। যে যাকে তাপিত করে, সে তার শত্রু বলে কথিত। জ্ঞাতির বড় শত্রু আর নেই। যাদের জীবিকার উপায় একই শ্রেণীর, (??) তারাই পরস্পর শত্রু, অপর কেউ শত্রু নয়।
অন্যের উপর বল প্রয়োগ করে ধন সংগ্রহ যদি পাণ্ডবদের পক্ষে দূষণীয় না হয়, আমি পাণ্ডবদের ধন বলপূর্বক আহরণ করলে তা দূষণীয় বা অধর্ম হবে কেন? আমাকে সর্বব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত করে কিশোরকাল থেকে প্রবীণ কৌরব এবং মুনি ঋষিরা একেবারে কোনঠাসা করে ফেলেছিলেন। একসময় বাধ্য হয়ে আমায় এক ভিন্ন রাস্তায় চলা শুরু করতে হল। সেই থেকে সুযোধনের পরিবর্তে আমি প্রকৃতই দুর্যোধন হলাম। এর পর থেকে একমাত্র যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কেউ সুযোধন বলে আমায় সম্বোধন করেনি। এই প্রসঙ্গে যুধিষ্ঠিরের বিষয়ে আমার কিছু ধারণা ব্যাক্ত করতে চাই।
পঞ্চ পাণ্ডবের মধ্যে একমাত্র যুধিষ্ঠির ব্যতীত কাউকেই আমি খাঁটি মানুষ বলে মনে করি না। যুধিষ্ঠির তাঁর স্বভাবে অতি আধ্যাত্মিকতার ভাবে বিভোর মানুষ। সেটা তাঁর বিশ্বাসের জগৎ, অন্যদের মত ভণ্ডামি নয়। কিন্তু ক্ষত্রিয়সুলভ দার্ঢ্য তাঁর নেই। আর একটা ব্যাপার, যেটা তাঁর চারিত্রিক ত্রুটিই বলব, সে বড় অতি-সরল প্রকৃতির। অবশ্য সেজন্য যে আমি তাঁকে আমাদের শত্রু মনে করিনি কোনও দিন এমন না। আমরা দুজনেই সিংহাসনের প্রত্যাশী। তবে সেই প্রত্যাশা যুধিষ্ঠিরের পক্ষে পরিত্যাগ করা সম্ভব হলেও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেকথা এতটাই সত্য বলে আমি মনে করি, যে আজ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও সেটাকেই বড় বলে বলতে পারছি।
আমার বিশ্বাস, আমি যদি সরল বিশ্বাসে তাঁর নিকটে গিয়ে বলতাম -- ‘অগ্রজ, আপনি আমার আকাঙ্খা পূরণ করে যুদ্ধ পরিহার করুন', তিনি তাতে অস্বীকার করতেন না। কিন্তু আমার পরম শত্রু অহংকার তা আমাকে করতে দিল না। এখানে আমি প্রকৃতই দোষী।
শত্রু মিত্র, যারা যাই বলুক, আমরা উভয় পক্ষের কেউই কম দোষে দুষ্ট নই। ক্ষত্রিয় নামধারী অথবা ক্ষত্রিয় চর্যাশ্রয়ী মানুষের প্রথম ও প্রধান দোষ তারা ভূমিলোভী। অন্যের ভূমি অধিকার করাকে তারা ধর্ম মনে করে। এই কুরুজাঙ্গাল মূলত দাস অথবা ধীবরদের আবাদিকৃত ভূমি ছিল। গঙ্গা এবং যমুনার তটস্থ ভূমি তারা আবাদ করেছিল তাদের বাসস্থান কল্পে। ক্রমশ তাদের একদল মৎস শিকার পরিত্যাগ করে কৃষিকর্মে উদ্যোগী হয়। তখনও তারা দুই ভিন্নগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়নি। বিষয়টি ক্রমশ বিবর্তনে নিষ্পন্ন হয়। আজ যাকে ধর্মক্ষেত্র-কুরুক্ষেত্র বলে মর্যাদা দেওয়া হয়, সেখানের অধিবাসী দাসদের শ্রমে মহারাজ কুরু ব্যাপক কুরুজাঙ্গাল এবং কুরুক্ষেত্রের স্থাপনা করেন। এই আবাদকালেই স্যমন্ত পঞ্চক হ্রদের নির্মাণ এবং ক্রমে তা তীর্থস্থানে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে দাসদের সঙ্গে ক্ষত্রিয় ভূমিগ্রাসীদের বিরোধ ও সমন্বয়ে আমাদের কুরুবংশের মত মিশ্র ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীদের প্রাধান্য বিস্তৃত হতে থাকে। কিন্তু আর্যানার্য বিভেদের বীজ তাদের মধ্যে থেকেই যায়।
একসময় ভূমির অধিকার, বিশেষ করে, ব্রাহ্মণদেরই ছিল। পুরাণে বর্ণিত আছে এই অধিকার নিয়ে ক্ষত্রিয়দের উদ্ভবের পর, বহুকাল-ব্যাপী দ্বন্দ্ব ঘটতে থাকলে, একসময় ক্ষত্রিয়কুল ব্রাহ্মণদের হাতে নির্মূল হয়। পরে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ক্ষত্রিয়কুলের বিধবাদের গর্ভে নতুন ক্ষত্রিয়কুলের উদ্ভব ঘটে। বহুকাল ধরে এই প্রক্রিয়া ঘটতে থাকলে একসময় ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের মধ্যে সামাজিক ক্ষমতার বিভাজন ঘটে। আমার সখা চার্বাক আমাকে এই তত্ত্বই ব্যাপকভাবে শিক্ষা দিয়েছিল। অবশ্য এ নিয়ে ঋষিদের কল্পনা-বিলাসী পুরাণকথা ভিন্ন।
কিছুক্ষণ পরে কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য এসে অশ্বত্থামাকে পাণ্ডব-পক্ষীয় শিবির সমূহের অবস্থান অবগত করালে আমি বললাম -- ‘গুরুপুত্র, আর কেন? এবার এ অনর্থক রক্তক্ষয় বন্ধ হোক।’ অশ্বত্থামা বীভৎস হুঙ্কারে বললেন, ‘পঞ্চপাণ্ডব এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার পিতার মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমি আপনার আদেশে সব কিছু করতে পারি, মহারাজ। কিন্তু এ আদেশ আমি পালন করতে পারলাম না। ধৃষ্ট্যদ্যুম্ন আমার যোগযুক্ত পিতাকে নিরস্ত্র অবস্থায় শিরচ্ছেদ করেছে। যুধিষ্ঠির পিতাকে অর্ধসত্য বলে বিভ্রান্ত করেছেন। অন্য পাণ্ডবেরাও মিথ্যাচার করেছেন। তাদের কারোরই বেঁচে থাকার অধিকার নেই।'
এই মানসিকতায় আমার ক্রোধে এগারো যুত সাত অক্ষৌহিণী বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য প্রাণ দিয়েছে। উভয় পক্ষের সামান্য কিছু সংখ্যক সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আমি অশ্বত্থামাকে আজ সেনাপত্যে অভিষিক্ত করে মহা ভুল করেছি। সে যে কী মহা সর্বনাশ করবে ধারণা করতে পারছি না। আমার খুব বেশি সময় আর বাকি নেই বলেই অনুভব হচ্ছে। সুতরাং এই অন্যায় নৈশ সমরে যে বা যারাই নিহত হোক্, আমার এখন আর কিছু যায় আসে না। তবে যুদ্ধের আবার ন্যায় অন্যায়ই বা কী? যুদ্ধ ব্যাপারটাই যে অন্যায় তা আগে আমরা কোনও পক্ষই বুঝিনি। একমাত্র অগ্রজ যুধিষ্ঠিরই কাউকে শত্রু বলে মনে করতেন না বলে যুদ্ধের একান্ত বিরোধী ছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ, সাত্যকি ইত্যাদিদের সনির্বন্ধ প্ররোচনায় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে তিনি মত প্রদান করেছিলেন। সে জন্য তাঁকে দোষী বা দায়ী করা যায় না। তিনিও তো মানুষই, যদিও আমাদের চেয়ে মাপে অনেক বড়।
যুদ্ধের জন্য কোনও একক ব্যক্তিকে দায়ী করা যায় না। যদিও পাণ্ডব পক্ষ আমাদেরই বিশেষত আমাকে দায়ী করে থাকে। এই জায়গাটাতেই আমার আপত্তি। আমি জানি, আমি কতটা অসহিষ্ণু, অহংকারী এবং আত্মম্ভরী। সেগুলো অবশ্যই আমার দোষ এবং সেই দোষসমূহ নিঃসন্দেহে এই যুদ্ধের জন্য অধিকাংশরূপেই দায়ী। কিন্তু কৃষ্ণ, সাত্যকি, ভীম এবং অনুরূপ অন্যান্য ব্যাক্তিরা কি এই যুদ্ধের বিষয়ে প্ররোচনা সৃষ্টি কম করেছে? কৃষ্ণ যেহেতু সাত্যকি বা ভীমের মত উত্তপ্ত মস্তিষ্কের মানুষ নন, তিনি তাঁর কূটনৈতিক পারঙ্গমতা দ্বারা, তাদের চাইতে অধিকতর প্ররোচনা সৃষ্টি করে যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন। আমি অবশ্যই কুরুরাজ্যের সামগ্রিক অধিকার লাভ করতে আকাঙ্ক্ষী ছিলাম, কিন্তু আর্যাবর্তের সমুদয় রাজন্য কি পররাজ্য লোভী ছিল না? আমি মনে করতাম, এই কুরুরাজ্য জন্মসূত্রে আমার উত্তরাধিকার, কারণ পাণ্ডবেরা স্বাভাবিক অথবা বিধিসম্মত নিয়োগ সূত্রে জাত উত্তরাধিকারী বলে আমি কোনওদিন স্বীকার করিনি। এমন কি প্রবীণ কৌরবেরাও তা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হননি। আসলে তাঁরা নিজেরাই সকলে এ বিষয়ে সহমত ছিলেন না। ব্যাপারটা যেন কিরকম একটা এলোমেলো ভাবে সকলে মেনে নিয়েছিলেন।
আর একটা কথা এ বিষয়ে বলা প্রয়োজন। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর প্রভৃতি যে যুগে নিয়োগ-পুত্র রূপে উৎপাদিত হয়েছিলেন, তার বেশ কিছুকাল পূর্ব থেকেই নিয়োগ প্রথার ক্রমশ বিলোপ শুরু হয়েছিল। সামাজিক বিধি রূপে নিয়োগ প্রথা পাণ্ডুর জীবিতকালে কিছুটা প্রচলিত থাকলেও তার পদ্ধতি, ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পুরুষের ঔরসে পুত্রলাভের সপক্ষে ছিল না। কুন্তীর তিন গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে একমাত্র যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কেউ ক্ষেত্রজ পুত্র রূপে স্বীকৃতি পেতে পারে না। আমার যতদূর বিশ্বাস যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়েছে বিদুরের পিতৃত্বে। সেক্ষেত্রে বর্ণগত কারণে, যুধিষ্ঠির রাজপদে বৃত হতে পারেন না। যুধিষ্ঠির প্রথাসম্মত ভাবে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ঔরস জাত নন।
আজ যদিও আমার অন্তিম মুহূর্তে এইসব বিধিবদ্ধতা আমার নিকট অর্থহীন বলে বোধ হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে মানুষ, শুধু মানুষই এবং তার উপরে আর কিছুই নেই। কিন্তু আমাদের বর্ণবিভাগী সমাজে অকারণে বিভিন্ন বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। মুনি ঋষি তথা শাস্ত্রকারেরা অত্যন্ত সুকৌশলে সমাজে স্বার্থের তারতম্য ঘটিয়ে বর্ণচুতষ্টয়ের সৃষ্টি করেছেন।
বর্ণাশ্রমে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী বর্ণ-ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণের পরেই তার স্থান - এরকম বলা হয়ে থাকে। ব্রাহ্মণ বর্নে যে কেউ অধিকারী হতে পারে না। স্বাভাবিক গুণ এবং কর্ম অনুসারে বর্ণ-চতুষ্টয়ের বিভাজন করা হয়েছে বলে মুনি, ঋষিরা বলে থাকেন বটে, কিন্তু ক্রমে এইসব বর্ণই জন্মসূত্রে অধিকারে আসে। কোনও ব্রাহ্মণপুত্র তার আচরণে বর্বর স্বভাবের হলেও সে অন্য তিন বর্ণের নিকট নমস্য। এই ধরনের বিধি আমার নিকট অর্থহীন মনে হয়।
যেমন আগে বলেছি, ক্ষত্রিয়রা এক সময় বর্ণগত কৌলীন্যে ক্ষত্রিয় বলে মান্য ছিল। কিন্তু ভূমির অধিকারগত কারণে তারা একসময় ব্রাহ্মণদের বিরোধী হয় এবং এক পর্যায়ে এক ব্যাপক সংঘর্ষে নাকি পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হয়ে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন ক্ষত্রিয়দের বিধবাদের গর্ভে ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়-সন্তানের জন্ম দেয়। এরকম নাকি একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় এবং সঃক্ষত্রিয় অবস্থায় পুন:প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে সামাজিক ক্ষমতা এই দুই বর্ণের মধ্যে ভাগাভাগী হলে, ক্ষত্রিয়রা শাসক জাতি রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এইভাবেই ব্রাহ্মণেরা পৌরোহিত্য, শাস্ত্রানুশীলন, পূজা যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদির এবং স্মৃতি-শ্রুতির অধিকারী হলে, সেই সময়ে সংখ্যালঘুত্বে পর্যবসিত নব্য ক্ষত্রিয়কুল অন্য জাতি থেকে ক্ষত্রিয় চরিত্র চর্যাশ্রয়ীদের মধ্য থেকে জন সংশ্লেষের দ্বারা নিজ গোষ্ঠীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। ব্রাহ্মণেরা এ ব্যাপারে তাদের সামাজিক তথা শাস্ত্রীয় সহায়তা প্রদান করে। এভাবেই একদার স্বার্থগত বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে তারা পরস্পরের সহায়ক হয়।
এইসব পুরাণ কথার মধ্যে যে নানারকম কিংবদন্তী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়রা প্রচার করে সে বিষয়ে আমার সখা চার্বাক আমাকে সম্যক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। চার্বাক বলেছিলেন -- ‘ও সব চন্দ্রবংশ, সূর্যবংশ বা পুরাণপুরুষের মস্তিষ্ক, বাহু, উরু বা পদদ্বয়ে বর্ণ চতুষ্টয়ের জন্ম বৃত্তান্ত উদ্দেশ্যমূলক।'
আমি চার্বাকের নিকট জানতে চেয়েছিলাম -- ‘সখা, পাণ্ডবেরা কি ক্ষত্রিয়?’ চার্বাক বলেছিলেন -- ‘ক্ষত্রিয় কথাটির প্রাথমিক উদ্ভব হয় ক্ষেত্র-কর্ম থেকে। ক্ষত্রিয়রা একসময়ে শুধু পশুপালনকারী ছিল। কৃষিকর্মে দীক্ষিত হয়ে তারা প্রথমে কৃষক এবং ক্রমশ রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা করে। ক্ষত্রিয়রা ভূমি গ্রাস করতে করতে ক্রমশ বাহুবলীর ভূমিকায় উন্নীত হতে থাকে। মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী নানা গুণ অর্জন করে থাকে। এবং তার থেকেই তার ব্যক্তিক এবং গোষ্ঠীগত স্বভাব অর্জিত হয়।'
অনেক অন্যায় কর্মই আমি করেছি। কিন্তু একজন ক্ষত্রিয়ধর্মী মানুষের পক্ষে এতো প্রায় অবশ্য কর্তব্যকর্ম। এবং শাস্ত্রকারেরা বলেন -- এটাই তাদের অবশ্য পালনীয় ধর্মও। তাই যদি হয় তবে, আমার বিরুদ্ধ পক্ষ যা যা করেছে, আমিও তো তাইই করেছি। পাণ্ডবপক্ষীয় আচরিত যুদ্ধকে কৃষ্ণ ধর্মযুদ্ধ নামে সাধারণ্যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে আর আমাদের যুদ্ধটা, অধর্ম বা পাপাত্মক যুদ্ধ। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন -- ‘যামনুসর যুদ্ধ চ।’ যুদ্ধেও সে অনুসরণ করতে বলেছে তাঁকেই। অর্থাৎ, তাঁর নিজের ক্ষেত্রে বাসুদেবত্ব বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য সে যেমন যেমন আচরণ করেছে, তার অনুগ্রহপুষ্ট জনদেরও সে সেই পন্থা অনুসরণ করতে বলেছে। পিতা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবশক্তিকে ভয় করতেন না। কিন্তু সেই তিনিই যুদ্ধ-প্রাক্কালে কৃষ্ণ বিষয়ে অবহিত হয়ে বলেছিলেন -- ‘যখন শুনেছি, কৃষ্ণ পাণ্ডবদের পরামর্শদাতা, তখন ভবিষ্য যুদ্ধে আমি আর জয়ের আশা করিনি, পুত্র। কৃষ্ণ অত্যন্ত কুটিল ও ধূর্ত। তুমি আর বিরোধিতায় যেও না।’
পিতা মিথ্যে বা ভুল বলেন নি। কিন্তু আমি নিজে রণকৌশল, অপরিসীম বীরত্বের অধিকারী বলে শুধু পিতার নয়, কারও নিষেধই শুনিনি। আর্যাবর্তের অধিকাংশ আর্য এবং অনার্য কথিত রাজন্যেরা আমার গুণগ্রাহী ছিলেন। আমি নিজরাজ্যে পরম প্রজাবৎসল বলে আদৃত ছিলাম। কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত কোনও ফলোদয় হলনা। কৃষ্ণের কৌশলে আমার পক্ষীয় বিশেষ বিশেষ শক্তিশালী ব্যক্তিরা গোপনে পাণ্ডবের পক্ষপাতিত্বে চলে গেলেন এবং একান্তভাবেই তা আমার অজান্তে।
যুদ্ধ সংঘটনে আমার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে ছিল। কিন্তু অপর পক্ষ নির্দোষ ছিল না। পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণ, শল্য প্রভৃতি মহাযোদ্ধারা পাণ্ডবদের সঙ্গে গোপন পরামর্শে লিপ্ত ছিলেন। এমন কি ক্ষত্তা বিদুর কৌরব মহামন্ত্রী হয়েও প্রকাশ্যেই পাণ্ডবদের পক্ষপাতিত্ব করেছেন। আমার নিজেরও ভুল ছিল অনেক। একমাত্র অর্জুন ছাড়া, পাণ্ডবদের কাউকেই আমি গ্রাহ্য করিনি। তাদের যুদ্ধে নিহত করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু একমাত্র ভীম এবং অর্জুন ছাড়া অন্য কাউকেই আমি বধ্য মনে করিনি। ভীমের উপর আমার জাতক্রোধ ছিল, আর অর্জুন অসামান্য যোদ্ধা বলে একমাত্র কৃষ্ণ-সারথ্যে তাকেই আমি ভয় করতাম। যুধিষ্ঠিরকে বহুবার আয়ত্তের মধ্যে পেয়েও আমি নিহত করিনি, কারণ আমি তা চাইনি। তাছাড়া যুধিষ্ঠিরকে আমি ঠিক মহারথ যোদ্ধা মনে করতাম না।
শিষ্য বিধায় যুধিষ্ঠিরকে গুরু দ্রোণ নিহত করতে চাননি, যেমন পিতামহ চাননি তাঁর কোনও পৌত্রকে হত্যা করতে। গুরু দ্রোণকে আমি বলেছিলাম জীবন্ত বন্দী করে যুধিষ্ঠিরকে আমার হাতে তুলে দিতে। বলেওছিলাম যুধিষ্ঠিরকে আমিও অবধ্য মনে করি। সামর্থ্য থাকলেও গুরু তা করেন নি। আমি বুঝেছিলাম তিনি তা ইচ্ছে করেই করেন নি। গুরুপুত্রের সাক্ষাতেই আমি সেকথা বললে, আজকে যে অশ্বত্থামা সেনাপত্য লাভ করে পাণ্ডবনিধনে নৈশ যুদ্ধে গেছে, সে আমার প্রতি বিলক্ষণ ক্রোধ প্রকাশ করেছিল। আমি জানি সে এই কাজে গেছে শুধুমাত্র তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। সম্ভবত সে কৃষ্ণের কৌশলে বিপথে চালিত হয়ে কিছু বিপরীত কাণ্ড করবে। অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ বর্ণীয় হয়েও ক্ষত্রধর্মাচারী। সুতরাং খুব একটা সূক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী নয়। কৃষ্ণ তাকে এমন একটা কার্যের মধ্যে ঠেলে দেবে যে তাতে তার নিজের ভবিষ্যতের কিছু স্বার্থ সিদ্ধি হয়। সম্ভবত কৃষ্ণের মনোগত ইচ্ছা তার পৌত্রদের কেউ কেউ ভবিষ্যতে যাদবদের এবং কৌরবদের রাজত্বের অধিকারী হোক।
আমার একমাত্র ভরসাস্থল এবং সর্বতোভাবে বিশ্বস্ত ছিল মহাবীর কর্ণ। কিন্তু মাত্র একদিনের যুদ্ধে কৃষ্ণ ও শল্যের কূট চক্রান্তে সে বীরশয্যা লাভ করে। শল্য যা করেছিল তাকে অত্যন্ত গর্হিত এবং নীচাশয় ব্যক্তির কার্য ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? তবে কৃষ্ণ সবার ঊর্ধে। তার তুল্য কার্যসিদ্ধির জন্য জঘন্য পন্থা অবলম্বনকারী আর দ্বিতীয় নেই। যদিও সখা কর্ণ নিজে আমাকে বলেনি, তথাপি আমার গূঢ়পুরুষের নিকট জেনেছি যে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষালম্বনের জন্য কর্ণকে উৎকোচ পর্যন্ত দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কর্ণ নম্রভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করে। কর্ণ যে জননী কুন্তির কানীন পুত্র সেই গূহ্য কথা পর্যন্ত তাকে সে জানিয়ে চেষ্টা করেছিল অর্জুনের সুরক্ষার স্বার্থে তাকে পাণ্ডব দলভুক্ত করতে। ধন্য, কর্ণ কোনও প্রলোভনে বশীভূত হয়নি। অতঃপর কৃষ্ণ স্বয়ং কুন্তীর দ্বারা তাকে স্নেহমূল্যে ক্রয় করার চেষ্টা করে, কিন্তু সত্যবদ্ধ কর্ণ সেই প্ররোচনার শিকারও হয়নি। সে কুন্তীকে বলেছিল, --‘আপনি পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন। এই যুদ্ধে হয় অর্জুন বেঁচে থাকবে অথবা কর্ণ। আমি তো এতদিন আপনার নিকট মৃতই ছিলাম। এর পরেও না হয় তাই থাকব।’ আমার মনে হয়, কর্ণ বোধহয় নিজেও নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ ছিল। অত্যন্ত হতভাগ্য আমার এই প্রাণসখা। কিন্তু কোনও কিছুর জন্যই সে তার বন্ধুর প্রতি কর্তব্যবিমুখ হয়নি। দলে পড়ে সে দ্রৌপদির প্রতি অনেক আকথা, কুকথা বলেছে, কিন্তু এ ব্যাপারে তার সপক্ষেও কারণ ছিল। ব্যবহারিক জীবনে কর্ণ অভব্য ছিল না।
চার্বাক বলেছিলেন -- ‘সখা, আমি নাস্তিক বলে সংসারে পরিচিত। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে আমার কোনও সমাজ নৈতিকতার বালাই নেই। তোমার সখা কর্ণ প্রকৃতি উপাসক, সূর্য পূজারী অর্থাৎ সৌর সম্প্রদায়ের মানুষ। তার বিশ্বাসে আলৌকিকতার প্রতি নির্ভরতার দোষ আছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাকে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। সে সমাজ নৈতিকতায় ভণ্ড নয়। সে একটা জীবন যাপনে একনিষ্ঠ, যা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু সমাজ নৈতিকতার প্রতি একনিষ্ঠতাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তার সঙ্গে আমার বিরোধ একটাই, সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আমি করি না। কিন্তু আমি মনে করি, মানুষটি বেশ। সে যা সত্য বলে মনে করে, তাই নিয়ে থাকে। তোমার প্রকৃত বন্ধু একমাত্র তাকেই আমি মনে করি। তিনি প্রাণপাত করবেন কিন্তু সত্য ভঙ্গ করবেন না। তোমার মধ্যে যে মানবিক গুণাবলি অর্থাৎ প্রজাবৎসলতা, সাধারণের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠা ইত্যাদি আছে, তার জন্যই সে তোমার অনুরক্ত। তুমি তাকে অঙ্গ রাজ্যের রাজা করেছ। সে জন্য সে কৃতজ্ঞ, কিন্তু সেটাই তোমার প্রতি তার প্রধান অনুরক্তি নয়। তোমার প্রশাসনিক দক্ষতাকে সে মূল্য দেয়।’
বলেছিলাম -- ‘সখে, আমার অনুগামী মিত্রেরা এবং আমি; বিশেষ করে কর্ণ এবং আমি, অক্ষক্রিড়ায় জয়লাভ করে দ্রৌপদিকে যেভাবে লাঞ্ছিতা করেছিলাম, পরে সেজন্যে কর্ণ এবং আমি অন্তত ভীষণভাবে নিজেদের কাছে লজ্জিত হয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষত্রিয় সমাজে এরূপ আচরণ দুর্লভ নয়। এখানে আমাদের সপক্ষে কিছু বলবার মত বক্তব্য নেই। রাজসূয় যজ্ঞের সময় থেকে আমার লোভ এবং মাৎসর্য অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সামান্য কারণে দ্রৌপদি আমাকে সর্বসমক্ষে যেভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছিল তার জ্বালা আমি ভুলতে পারিনি। আর কর্ণ কোনওদিনই ভোলেনি।'
আসলে কর্ণ স্বয়ংবর সভাতেই দ্রৌপদির রূপমুগ্ধ হয়েছিল। বিষয়টা স্বয়ংবর সভা সংক্রান্ত। রীতি অনুযায়ী সভায় সম্ভাব্য প্রতিযোগী কারা কারা হবেন, তার ঘোষণা আগেই করা হয়। কর্ণকে যেভাবে দ্রৌপদি ‘সূতপুত্র’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তার কোনও কারণ ছিলনা। কোন জাতীয় মানুষ লক্ষ্যভেদে অধিকারী হবে, তার বিষয় কিছুই আগে জানানো হয়নি। অকারণে ওভাবে কর্ণকে অসম্মান করেছে বলেই না সে সারাজীবন বিদ্বেষ পোষণ করে গেছে। তারপর, একটা কথা প্রচলিত ছিল পাণ্ডবেরা পিতৃপরিচয়হীন। তারা কিভাবে অন্য একজনের জন্ম বিষয়ে কুৎসিৎ মন্তব্য করে এবং তা প্রতিনিয়ত? আর স্বয়ম্বর সভার পশ্চাতে রাজা দ্রুপদের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। অর্জুনকে কন্যাদান করার ইচ্ছা ছিল তার, তার একদার বন্ধু এবং পরবর্তীকালের শত্রু দ্রোণকে দমন করার উদ্দেশ্যে। লক্ষ্যবিদ্ধ করে পাছে কর্ণ সফলতা লাভ করে, তাই কর্ণকে লাঞ্ছিত করাটা প্রয়োজন হয়েছিল।
কর্ণ বা আমার দিক থেকে যে কারণই থাকুক না কেন, সেদিন আমাদের আচরণ একান্তই অভব্য ছিল। তবে ক্ষত্রিয় রাজসভার ভণ্ডামি এবং প্রবীণদের প্রচারিত ধর্ম-বিচারকে একটু নাড়িয়ে দেবার ইচ্ছেও আমাদের অবশ্যই ছিল।
সব চাইতে বড় অনুতাপ এই যে আমরা সবাইই আমাদের লোভ, অসূয়া এবং জিঘাংসাকে অবদমন করতে না পেরে যুদ্ধের মত একটা বড় রকমের অন্যায় উপায়ের আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমরা ভেবে দেখিনি। কোনও লোভনীয় বস্তু লাভ করার জন্য বা কোনও সমস্যার সমাধান করার জন্য যুদ্ধ কখনওই একটা পন্থা হতে পারে না। এই প্রাকৃত ভূমণ্ডল অতি অপূর্ব। প্রকৃতি স্তরে স্তরে নানা সুখকর ব্যবস্থা আমাদের জন্য করে রেখেছে। এখানে কোনও বৈর লোভনীয় নয়। এই বিশ্ব সর্বজনের উপভোগের জন্য যেন নির্মিত হয়েছে কারও দ্বারা, এমনই মনে হয়। আমি কোনওদিনই খুব একটা ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ নই। বরং আমাকে অজ্ঞেয়বাদিই বলা যায়। সেই সুন্দরকে ধ্বংসে আমি অংশী হলাম! -- আমি এখন জীবনের অন্তিমতম মুহূর্তে এসে যেন অনুভব করছি যে নিশ্চিতই কোনও বৃহৎ বুদ্ধি এই প্রকৃতিকে এক শৃংখলায় পরিচালনা করেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বহমানা রেখেছেন এবং তিনিই সাধারণের নিকট ঈশ্বর বলে বন্দিত। চার্বাক যাই-ই বলুন, তাঁর দর্শনের অন্বীক্ষায় সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। হ্যাঁ, ঈশ্বরবাদী ব্রাহ্মণেরা তাঁদের ধূর্ততার জন্য প্রভূত সামাজিক ক্ষতি করে চলেছেন। কিন্তু একথাও তো সত্য যে এই জ্বালা, যন্ত্রণা, শোকতাপের থেকে সাময়িক শান্তির জন্য ঈশ্বর এবং পারলৌকিক অস্তিত্ব তাদের নিকট বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু তা নিয়ে বিশদ কথা বলার মত পাণ্ডিত্য আমার নেই। আস্তিক অথবা নাস্তিক উভয় দর্শন বিষয়ে আমার যতটুকু ধারণা, তার উপাধ্যায় বা আচার্য চার্বাক। সেই শিক্ষা নেহাৎই অগভীর তথা অকিঞ্চিৎকর। তথাপি আমার ধারণা, যদিও সব মতের মধ্যেই কিছু কিছু সত্যাভাস আছে, চার্বাকীয় মতে যুক্তির আধিক্য প্রণিধানযোগ্য। এই মতের ইহজাগতিক প্রায়োগিকতা ক্রমশ শীলিত হয়ে অধিকতর সত্যাভাসযুক্ত হবে ভবিষ্যতে বলেই আমার অনুমান। কিন্তু এ প্রসঙ্গ আমার স্বভাবোচিত নয়।
আমাদের ক্ষত্রিয়কুলের স্বভাবধর্মের কথা বলতে গেলে একমাত্র তাদের বীরত্ব, নিষ্ঠুর যুদ্ধকর্ম এবং অন্যের ভূমি অধিগ্রহণের লালসার ক্রমবৃদ্ধি ছাড়া কিছুই বলার মত পাই না। যদিও এর সবটাই আমি বুঝি, আগেও যে বুঝিনি বা বুঝতাম না এমন নয়। তথাপি, নিজেকে এই ধারা থেকে বিযুক্ত রাখতে পারিনি। আমিও এই পন্থাই অনুসরণ করে এসেছি বরাবর, বরং বলা যায়, একটু বেশি করেই। আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে এরূপ ক্ষাত্র-ধর্মাচরণের ব্যাতিরেকী ব্যক্তি একমাত্র অগ্রজ যুধিষ্ঠির। যদিও বর্ণগতভাবে আমি তাদের ক্ষত্রিয় বলে এখনও মনে করিনা, তথাপি তারা ক্ষত্রচর্যাশ্রয়ী জীবন তো যাপন করত। এই চর্যা যুধিষ্ঠিরের স্বভাবে ছিল না বলে, শুধুমাত্র পরমত-চালিত হয়েই তিনি যা কিছু অন্যায় বা মিথ্যাচার করেছেন।
যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে, তাদের বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস শেষ হলে, যখন উভয় পক্ষে দৌত্যকর্ম চলছিল, আমাদের পক্ষ থেকে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বিশেষ নির্দেশ সহকারে যুধিষ্ঠিরের নিকট পাঠিয়েছিলেন। সঞ্জয় যথাসাধ্য যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হবার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল। সঞ্জয় তাকে বলেছিল, -- ‘অজাতশত্রু রাজা যুধিষ্ঠির, আপনাদের জেষ্ঠতাত, অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র আমাকে আপনার নিকট সন্ধির প্রস্তাবসহ পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, --"সঞ্জয়, তুমি তাকে ব’লো যে অনেক ভাগ্যে সে এবং তার ভ্রাতারা তেরো বছরের সুদীর্ঘ সময় বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে ফিরে এসেছে বলে আমি আনন্দিত। আমার মন্দমতি পুত্র দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি প্রভৃতি তার দুষ্ট মন্ত্রণা দাতাদের কূট পরামর্শে, কপট দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের রাজ্য এবং সম্পদসমূহ হরণ করেছে। আমি এরকমটা চাইনি। আবার এখন যে সে বিনা যুদ্ধে সেসব প্রত্যার্পণ করতে ইচ্ছুক নয়, তাও আমার অভিপ্রেত নয়। সঞ্জয়, যুধিষ্ঠির এবং তার ভ্রাতারা অতি বিবেচক এবং সজ্জন। তুমি তাকে আমার মনোগত ইচ্ছা বুঝিয়ে, জানাবে, কোনও অবস্থায়ই তারা যেন এই কুলধ্বংসী, আহতে লিপ্ত না হয়। এই যুদ্ধ ঘটলে, কারওই মঙ্গল হবে না।"' যুধিষ্ঠিরকে সঞ্জয় বলেছিল,-- ‘অজাতশত্রু মহারাজ। আপনি চিরকালই শান্তির নিমিত্ত তিতিক্ষা দেখিয়ে এসেছেন। আমি আপনার স্নেহাস্পদ সঞ্জয় বলছি, এখানে এই সভায় দেখছি, আপনারা এক সামগ্রিক যুদ্ধেরই আয়োজন করছেন। মহারাজ, যুদ্ধ আপনার জন্য নয়। দুর্যোধন যদি আপনার রাজ্য প্রত্যার্পণ না করেন, আপনারা বরং যাদব নগরে গিয়ে ভিক্ষান্নে জীবন যাপন করুন। যুদ্ধ সর্বার্থে পরিতাজ্য।’
সঞ্জয় হস্তিনায় এসে এই বৃত্তান্তের কথা সভায় জানালে বিশেষ বিতর্ক উপস্থিত হয়েছিল। ইতিপূর্বে পাণ্ডব পক্ষের অভিভাবক রূপে মহারাজ দ্রুপদ এক ব্রাহ্মণকে দূত রূপে হস্তিনার সভায় প্রেরণ করেন। সেই ব্রাহ্মণ অত্যন্ত উগ্রস্বভাবী এবং অনেক অপ্রীতিকর বাক্যে সভাকে উত্তপ্ত করে প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে বিদায় নিল। সেই ব্রাহ্মণ, একান্তভাবেই দূত স্বভাবের পরিপন্থী বাক্য ব্যবহার করেছিল। কর্ণ এবং আমি তার ঔদ্ধত্বপনায় সাতিশয় ক্রুদ্ধ হলে, পিতা এবং পিতামহ আমাদের উভয়কেই সংযত করেন। এর পরেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল সঞ্জয়কে দূত রূপে বিরাট নগরে (উপলব্য) প্রেরণ করে একটি সর্বতোভদ্র শান্তি চুক্তি করা। অবশ্য আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম যে যা-ই ঘটুক, কোনওভাবে যেন আমার মাথা নীচু না হয় এবং আমার মানহানি না ঘটে। যুদ্ধে অংশ গ্রহণ, অথবা পুনরায় বারো বৎসর বনবাস এবং একবছর অজ্ঞাত বাস।
পুনর্বার তাদেরকে বারো বৎসর বনবাস এবং একবছর অজ্ঞাতবাস যাবার জন্য আমার যুক্তি ছিল যে, কেননা দ্যূতক্রীড়াটিকে নানাজনে নানাভাবে উল্লেখ করেছেন, এটি যে একটি বহুকালাবধি চলে আসা রাজন্য প্রথা, তা তো অস্বীকার করা যায় না। খেলায় যুধিষ্ঠির সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তিনি আমন্ত্রিত হয়ে সেচ্ছায়ই খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে কেউই খেলতে বাধ্য করেনি। তিনি দু-দুবার খেলায় হেরে যাবার পর কেউ কেউ বলতে লাগলেন যে শকুনির পাশা মন্ত্রপূত ছিল এবং ক্রীড়ক বিচারে তিনি কৈতবপন্থানুসরণ করেছিলেন। খেলায় হেরে গেলে পরাজিত পক্ষে এরকম কথা অনেকেই বলে থাকে। যুধিষ্ঠির এই খেলায় দক্ষ ছিলেন না। পণ-বাজিতে এই খেলায় অংশগ্রহণ একজন প্রকৃত জুয়াড়ি ছাড়া কেউ করে না।
বস্তুত যুধিষ্ঠির এই খেলায় আদৌ দক্ষ ছিলেন না, অথচ তাঁর এই খেলাটার প্রতি ছিল অপরিসীম প্রবণতা। ফলে, খেলারম্ভে যতই তিনি হারছিলেন, ততই তাঁর ঝোঁক বেড়ে যাচ্ছিল। একের পর এক তিনি তাঁদের সমস্ত সম্পদ, ধনদৌলত এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর ভ্রাতাদের পর্যন্ত পণ রেখেও যখন সর্বস্বান্ত হলেন, তখন দ্রৌপদিকে পর্যন্ত পণ রাখলেন এবং হারলেন। হারলেন, নিজেকে পণ রেখে এবং তা আগেই।
একথা সত্য যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আমার জন্যই পাণ্ডবদের দ্যূতক্রীড়ায় আমন্ত্রণ করেছিলেন। পণবাজি সহকারে অক্ষক্রীড়া আমাদের সমাজে অধর্ম বা অন্যায় বলে মনে করা হয় না। আমার দিক থেকে বলতে গেলে বলব, কৃষ্ণের প্ররোচনায় পা দিয়ে পাণ্ডবেরা, বিশেষত যুধিষ্ঠির যদি রাজসূয় যজ্ঞের মত একটা প্রদর্শনীমূলক যজ্ঞ না করতেন, তাহলে পরবর্তী অপ্রীতিকর ঘটনাগুলি ঘটত না। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্য করে তাঁরা আর্যাবর্তের চতুর্দিকের সমস্ত রাজন্যকুলকে নির্যাতিত করে বিপুল ধন লুন্ঠন করেন। পাণ্ডবেরা নিঃসন্দেহে হতদরিদ্র ছিলেন না। রাজত্ব বিভাজিত করে কুরুপ্রবীণেরা যখন তাঁদের অর্ধাংশ প্রদান করেন, তাঁরা তাতে সন্তুষ্ট হন নি। অতি দ্রুত তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ এবং প্রভুত্ব বৃদ্ধি করার দিকে অগ্রসর হলেন। বলা বাহুল্য কৃষ্ণ এবং যাদবেরা এজন্যে তাঁদের সহায়তা করেছেন সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে। কৃষ্ণ চেয়েছিল যুধিষ্ঠির আর্যাবর্তের সম্রাট পদ লাভ করেন। কারণ সেটা তাঁর বাসুদেবত্ব পদ লাভের সহায়ক। প্রতিবেশী রাজ্যকল্পে আমাদের পক্ষে তা নিরাপদ বলে মনে করিনি। পাণ্ডবেরা যদি রাজত্বের অর্ধাংশ নিয়ে খুশী থাকত, মুখে যাই-ই বলি, আমি যুদ্ধের পথে যেতাম না। সে কারণেই দ্যূতক্রীড়ায় তাদের সর্বস্বান্ত করাটা আমার কাম্য ছিল। পাণ্ডবেরা যেভাবে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করছিল, তাতে আমরা ধার্তরাষ্ট্ররা নিরাপদ বোধ করিনি। এ বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে আমাদের বিচারের পার্থক্য ছিল। প্রকৃত পর্যবেক্ষণে ধরা পড়বে পাণ্ডবেরা খুব কম লোলুপ ছিল না। ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী স্থাপনের পরই কৃষ্ণ এবং ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় তারা অনার্য জন অধ্যুষিত খাণ্ডবারণ্য অধিকার করে অনার্যদের ব্যাপকভাবে বিতাড়িত করে তাদের রাজত্ব বৃদ্ধি করে। এই কার্যে নেতৃত্বে ছিল কৃষ্ণ এবং অর্জুন। ব্যাপক হত্যা এবং অগ্নি সংযোগে তারা খাণ্ডবের প্রাকৃত বলয় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে তাদের নিজস্ব আবাদ বিস্তৃত করে। তাদের এই কার্যটিকে আমি কোনও মতেই সমর্থন করতে পারিনি।
অনার্য জাতীয় জনেদের সঙ্গে ভূপতি রূপে আমার সহজ এবং সহানুভূতিশীল সম্পর্ক ছিল। একলব্যের পিতা হিরণ্যধনুর সহিত আমার সখ্য ছিল। একলব্য আমাদের কৈশোরের অস্ত্র শিক্ষার সময়ে অত্যন্ত নিন্দনীয় কারণে গুরু দ্রোণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু তার অধ্যবসায়ের গুণে এবং পিতা হিরণ্যধনুর সহায়তায় উত্তম তীরন্দাজরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তথাপি গুরুদক্ষিণা প্রদান ছলে অস্ত্রগুরু কী ব্যবস্থা করেছিলেন তা সকলেই অবগত। আমি রাজা হবার পর হিরণ্যধনু এবং একলব্যের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে তাদের প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিকার করেছিলাম। যুদ্ধে, পরবর্তীকালে তারা আমার পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। হিরণ্যধনু বীরশয্যা লাভ করলে একলব্য তার পিতৃরাজ্য রক্ষার কারণে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়।
পাণ্ডবেরা কিশোরকাল থেকে অধিকাংশ সময়েই এই সব অনার্যদের বিরোধিতা তথা বৈরিতা অবলম্বন করে। ভীম নিজের শক্তিমত্তায় বক, কির্মির, হিড়িম্ব ইত্যাদি অনার্য গোষ্ঠীপতিদের কারণে অথবা কারণ ব্যতিরেকেই হত্যা করে। হত্যা না করে যদি তারা এই সব আরণ্যক জাতীয়দের সহিত সহজ সখ্যে যেত, তাদের জীপন যাপন অনেকটাই সহজসাধ্য হত। হিড়িম্বাকে বিবাহ করে এবং ঘটোৎকচ ও তৎপুত্র অঞ্জনপর্বাকে লাভ করে পাণ্ডবেরা যে সহায়তা লাভ করেছে তাও তারা মনে রাখেনি। এমন কি কৃষ্ণ তাদের মানুষ রূপেও গণ্য করেনি। এর পিছনে অবশ্য ব্রাহ্মণদেরও স্বার্থ জড়িত ছিল।
আজ মনে হয়, এই সর্বধ্বংসী যুদ্ধের জন্য যদি সামাজিকভাবে কাউকে দায়ী করতে হয়, তারা ব্রাহ্মণ্য বর্ণেরই লোক। রাজ্যশাসন বলতে পাণ্ডবেরা শুধু ব্রাহ্মণদের স্বার্থরক্ষাই বুঝত। সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে যে তারা আদৌ কোনও কার্য করেছে, এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই। ব্যক্তিমানুষ রূপে আমার বিবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমার প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে প্রজাসাধারণের কোনও অসন্তোষ ছিল না, বরং তারা শান্তিতে ছিল।
আমাদের দুই পক্ষের বিরোধটাকে অধিকাংশ মানুষ মনে করত সাধারণ জ্ঞাতি বিরোধ সংক্রান্ত বিবাদ। কিন্তু বিষয়টা তত সাধারণ ছিল না। মৃত্যুকে শিয়রে রেখে এবং তার জন্য অপেক্ষারত আমি আত্মপক্ষের অপরাধ স্খালনের জন্য কোনও কথা বলছি না। আমি নিজের ত্রুটি স্বীকার করেই একটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে মরতে চাইছি, পরিবার বর্গের সবাই, এমন কি আমার জন্মদাতা পিতাও কেন আমার মধ্যে শুধু দোষাধিক্যই দেখলেন! প্রজাসমুদয়কে যে আমি অপরিসীম যত্নে পালন করেছি, সে কথাটা কেউই একবারও স্মরণ করলেন না কেন? সকলেই, বিশেষ করে প্রবীণ কৌরবেরা বলেছে বা প্রচারও করেছেন যে আমি পররাজ্য লোভে পাণ্ডবদের সঙ্গে বিরোধ করেছি। কিন্তু কেউ এটা বলল না যে, রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষ্যে তারা অগণিত রাজ্য লুন্ঠন করেছে। খাণ্ডববন দগ্ধ করে অনার্যদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করেছে। এর সবটাই কৃষ্ণের প্রচারে সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বলে অভিহিত হয়েছে। সর্বশেষ এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটাকেও সে ধর্মযুদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। চার্বাকের কথায় বলতে গেলে কৃষ্ণকে ভণ্ড, ধূর্ত, প্রবঞ্চক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। প্রসঙ্গত বলি, তাকে আমি অন্তত এই মৃত্যু সময় পর্যন্ত ঈশ্বর অথবা পরম-ব্রহ্ম সনাতনের অবতার বলে স্বীকার করি না। সে যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই হবে, তবে জরাসন্ধের আক্রমণে উত্যক্ত হয়ে কেন মথুরা ছেড়ে সবান্ধব দ্বারকায় পালিয়ে চলে এসেছিল? তার ইচ্ছা মাত্রেই নাকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয় ঘটে থাকে। তাহলে জরাসন্ধকে কেন ভীমার্জুনের সহায়তা নিয়ে কূট চালে হত্যা করতে হল? কেন সে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিল তিন জনের? সেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা কি, যার জন্য কৃষ্ণ তাদের সব অন্যায় কার্যকে তথাকথিত সনাতন ধর্ম স্থাপনের হেতু বলে উল্লেখ করেছে। এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড নিয়ত পরিবর্তনশীল, সেখানে শাশ্বত-সনাতন বলে কোনো পন্থা, মতবাদ বা ধর্মের কল্পনা করাই আমার ধারণায় ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদ। জগৎ নিত্য পরিবর্তনশীল।
জরাসন্ধ মহাবলশালী ছিলেন, কিন্তু কোনও মানুষ যদি অপ্রস্তুত অবস্থায় হঠাৎ আক্রান্ত হয়, সে কী করতে পারে? একটা জঘন্য চক্রান্তের শিকার হয়ে জরাসন্ধ প্রাণ হারান। কৃষ্ণের কৌশলই ছিল অকস্মাৎ আক্রমণে কাউকে হত্যা করা, যেমন শিশুপাল হত্যা ঘটিয়েছিল সে। এরকম উদাহরণ আরও অনেক আছে। তার সর্বশেষ অনৈতিক কাজ ভীম ও আমার গদাযুদ্ধে অর্জুনসহ সে ভীমকে ইঙ্গিতে জানায় অন্যায় ভাবে আমার ঊরুতে গদাঘাত করে ভূপাতিত করতে। আমি যদি যে কোনও উপায়ে শত্রুনাশ করার পক্ষপাতি হতাম, তাহলে আমার ন্যায় যুদ্ধে সে যখন মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েছিল, তখনই তাকে মারতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। আমরা দুজনেই মহাত্মা উদারধর্মী বলদেবের নিকট গদাযুদ্ধ শিক্ষা করেছিলেম। আমি ভূপতিত হলে বলদেব প্রতিবাদ করে পাণ্ডবদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও কৃষ্ণ কূটকৌশলে বলদেবকে নিরস্ত করলে তিনি দ্বারকায় প্রস্থান করেন।
আমি ভূপতিত হলে অত্যন্ত উন্মত্তের মত ভীম আমাকে পদাঘাত পর্যন্ত করল, যা ক্ষাত্রধর্ম বিরোধী। কিন্তু শুধু ভীমই নয়, পাণ্ডবেরা কেউই এই যুদ্ধে ক্ষাত্রধর্ম অনুসরণ করেনি। যুদ্ধের নীতি নিয়ম আমাদের পক্ষ থেকে একবারই লঙ্ঘন করেছিলাম, সেটা অসম যুদ্ধে বালক অভিমন্যুর সপ্তরথীর বেষ্টনে নিধন। সত্য কথা বলা, নিজের স্বভাব অকপটে স্বীকার করা আমার স্বভাব। সে কারণে, স্বীকার করছি যে অভিমন্যুহত্যা আমার পক্ষে অত্যন্ত কলঙ্কজনক এবং নিন্দনীয় অপরাধ। তবে তাকে ওভাবে না মারলে, আমরা সপ্তরথীরা সকলেই নিহত হতাম তার হাতে। অভিমন্যু দক্ষ যোদ্ধা, অর্জুনতুল্য। এক্ষেত্রে আমাদের অন্যায় যুদ্ধটা নিন্দনীয় হলেও প্রাণরক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। অবশ্য অর্জুনের অনুপস্থিতিতে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবদের উচিত হয়নি ওই বালককে চক্রব্যূহ ভেদ করতে বলা। আসলে কৌশলগত কারণে গুরু দ্রোণের ব্যূহ নির্মাণ সেদিন পাণ্ডবদের পরাজয় অবধার্য করেছিল। তথাপি আমার আত্মগ্লানি এই যে শেষ পর্যন্ত আমরাও অন্যায় তথা ক্ষাত্র–বিধান বহির্ভূত অন্যায়যুদ্ধ করেছি। এই অপযশ পরবর্তীকালে লোকসমাজে প্রবল প্রাধান্য পাবে বলেই আমার এই অন্তিম সময়ে মনে হচ্ছে। এই সমাজে যুদ্ধ যদি অপরিহার্য হয়ই, তবে এই শেষ লগ্নে এই কথাই বলে যাব যে অন্তত যুদ্ধের যশোগান যেন আমরা না করি।
সর্বাঙ্গে অসম্ভব বেদনা এবং যন্ত্রণা। কোনওরকম ভাবেই স্বস্তি বোধ করতে পারছি না। দুই হাতের উপরে ভর দিয়ে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? উরুদ্বয় এবং কটিদেশ ভগ্ন। সুতরাং বসে বা শুয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। পাণ্ডবেরা, কৃষ্ণসহ তাদের যাদব মিত্ররা এখন তাদের বস্ত্রাবাসের শিবিরে পান, ভোজন এবং বিশ্রামে ক্লান্তি অপনোদন করছেন। বারাঙ্গনারা তাদের বিনোদন উপলক্ষ্যে নৃত্যগীত এবং সুরতক্রিয়ার আয়োজন করছে। ক্ষত্রিয় রীতি অনুযায়ী, তাদের উচিত ছিল আমাকে বন্দী করে আমার শুশ্রূষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু যুদ্ধের শুরু থেকে কোনও প্রচলিত বিধি বিধানই তারা মানেনি।
কথায় কথায় পাণ্ডবেরা এবং কৃষ্ণ আমার বিরুদ্ধে নানাভাবে মিথ্যে প্রচার করে এসেছে বহুকাল থেকেই। সেই তারা যখন শতশৃঙ্গ থেকে হস্তিনায় আসে, আমি তাদের এই কুলে গ্রহণ অনুমোদন করিনি। আমার নিজের নিকট এ ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য আছে। আমি চেয়েছিলাম, কৌরব সভায় তাদের কুলে গ্রহণ করার বিষয়ে প্রধান কৌরবদের পরিষ্কার এবং যুক্তিসহ বিতর্ক হোক। আমাদের পিতামহদ্বয়, অর্থাৎ মহর্ষি বেদব্যাস এবং দেবব্রত ভীষ্ম বিষয়টির সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করুন যে পাণ্ডবেরা শাস্ত্রবিধান অনুসারে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র, তারপর তাদের উত্তরাধিকার সাব্যস্ত হোক। শুধু মুখের কথা এক্ষেত্রে প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হতে পারে না। বিষয়টি আমি পিতার নিকট উপস্থিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি বা অন্য কেউ তা শোনেননি।
গুরুপুত্র অশ্বত্থামা আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে গেল, পাণ্ডবদের নির্মূল করে সে পুনরায় আমাকে রাজপদে বৃত করবে। আমি জানি সে তার পিতৃহন্তাদের প্রতি দ্বেষবশত এবং আমাকে আশ্বাস দেওয়ার জন্যই এরূপ শপথ গ্রহণ করেছে। কৃষ্ণ এখনও পাণ্ডবদের রক্ষাকর্তা। তার কূটবুদ্ধিতে পাণ্ডবদের নিধন করা অশ্বত্থামার পক্ষে অসম্ভব। সে মহারথ, কিন্তু বুদ্ধির ব্যাপ্তি বিশেষ নেই।
তাছাড়া ধরে নেওয়া যাক্, অশ্বত্থামা আমার জন্য বিজয় অর্জন করে আনল, কিন্তু আত্মজনদের সবাইকে এবং সব সম্পদ তথা সৈন্যদের হারিয়ে আমি কাকে নিয়ে এবং কী নিয়ে রাজ্য সুখ ভোগ করব? ভ্রাতা, পুত্র এবং বন্ধুদের কেউই তো আর বেঁচে নেই। শাস্ত্রে কথিত আছে, 'সত্যমেব জয়তে।’ একথা আমি বিশ্বাস করি না। পাণ্ডবদের প্রতি আমার বিদ্বেষ নিয়ে আমি কোনও মিথ্যাচার বা ভণ্ডামি করিনি। আমি আমার বিশ্বাস মত কাজ করেছি। পক্ষান্তরে তারা সেই কিশোরকাল থেকে মিথ্যের পর মিথ্যে রটিয়ে আমাকে পরিবার এবং প্রজাদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করে গেছে। ভীমকে আদৌ বিষ প্রয়োগে অচৈতন্য করা হয়নি। অতিভোজী এবং অতিপায়ী ভীমকে অচৈতন্য দেখে আমরা চলে এসেছিলাম। ও নেশায় অচৈতন্যের মত ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা কাল্পনিক কাহিনী তৈরি হয়। অচেতন ভীমকে এক নাগকুলের গোষ্ঠিপতি, শুশ্রূষা করে সুস্থ করে প্রাসাদে পৌঁছে দেবার পর তাকে বিষ প্রয়োগের গল্প প্রচারিত হয়। আসলে তা সর্বৈব মিথ্যা।
বারণাবতের অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে যে গল্প তৈরি হয় তার পশ্চাতে বিদুরের হস্তক্ষেপ স্পষ্ট। এই ব্যক্তি সকলের নিকট অত্যন্ত আদরণীয় এবং স্বয়ং ‘ধর্ম’ নামে খ্যাত। কিন্তু তাই বলে তিনি পক্ষপাতশূন্য ছিলেন না। পাণ্ডবেরা, বিশেষ করে যুধিষ্ঠির তাঁর প্রাণতুল্য। যুধিষ্ঠির নিঃসন্দেহে তাঁরই ঔরসজাত। অবশ্য সে কারণে আমি কোনও দোষ দেখিনা। জাতি বর্ণের ভেদ বা আত্মজ পুত্রের বৈভব কামনা মানুষের থাকতেই পারে। তাই যদি হয়, তবে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সদা সর্বদা তিনি কেন পরামর্শ দিতেন আমাকে পরিত্যাগ করতে? আমি তো তাঁর শরীর থেকে উৎপন্ন, রক্তমাংসের অংশ। আমার মধ্যে যে অসূয়া, ক্রোধ এবং হিংসার উদ্ভব ঘটেছে, তার জন্য বিদু্র ইত্যাদির নিয়ত পাণ্ডবগণের প্রশংসা এবং আমাদের নিন্দা দায়ী নয়? আসলে বিদুর ছিলেন মাতা কুন্তীর প্রণয়ী। তার পক্ষপাতদুষ্টতার এটা একটা প্রধান কারণ।
বারণাবতের অগ্নিকাণ্ড এবং পঞ্চপুত্র সহ নিষাদ রমণীর মৃত্যু হওয়া আদৌ কাকতলীয় ছিলনা। বিদুর তাঁর গূঢ়পুরুষদের সহায়তায় আমাদের দায়ী করার জন্যই এই চক্রান্তটি করেন। চক্রান্তমূলক না হলে এতটা কাকতলীয় ঘটনা স্বাভাবিক নয়। এই গোপন ষড়যন্ত্র ভবিষ্যতের মানব সমাজের নিকট এক অশুভ শিক্ষার বার্তা বহন করবে। ব্যাপারটা পুরোই চক্রান্তমূলক এবং আমার নামে মিথ্যে কলঙ্ক আরোপ করাই এর উদ্দেশ্য ছিল।
মানুষের মধ্যে যে যে দোষ ত্রুটি সাধারণত থাকে আমার এবং আমার পিতার স্বভাবে সেসব স্বাভাবিকভাবেই ছিল। তথাপি পিতা পাণ্ডবদের স্নেহ সহকারেই গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তাদের জন্ম পাণ্ডুর ক্ষেত্রে, যদিও তা ক্ষেত্রজ বিধিরূপে নয়। কিন্তু রাজপদের লোভ তাঁর মধ্যে এবং ক্রমশ আমার মধ্যেও উদ্ভূত হয়েছিল। আমরা বিভাজিত রাজ্য ভোগে সন্তুষ্টই ছিলাম। যদি পাণ্ডবেরা খাণ্ডব দহন, অনার্য নিধন এবং ক্রমে ক্রমশ রাজ্য বিস্তার ও সর্বশেষ যুধিষ্ঠিরকে চক্রবর্তী সম্রাট রূপে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য কৃষ্ণের প্ররোচনায় রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে প্রদর্শনীর প্রকল্পনা না করত, তবে আমার অসূয়া বৃদ্ধি পেত না। যেখানে জ্ঞাতি বিরোধের সম্ভাবনা থাকে, সেখানে বিষয় বৈভবের এক পক্ষীয় প্রদর্শনী অসূয়া বৃদ্ধি করবেই। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
আমার জীবনীশক্তি শারীরিকভাবে ক্ষীণ হয়ে আসলেও এই সব চিন্তা এখনও আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল, বস্তুত সব রিপু বোধহয় শারীরিক অক্ষমতা জনিত কারণে লুপ্ত হয় না, বিশেষত অসূয়া। লোভ, অসূয়া, ক্রোধ ইত্যাদি আমার মধ্যে যেমনভাবে প্রকাশ পেত, পাণ্ডবদেরও সেইসব যে ছিল না এমন নয়। তবে একমাত্র ভীম ছাড়া সে সবের উগ্র প্রকাশ অন্য কারোর মধ্যে তেমন দেখা যেত না। যুধিষ্ঠিরের মধ্যে তো নয়ই। জনৈক ঋষি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মহারাজ আপনি ধর্ম, অধর্ম বিষয়ে কিরূপ চিন্তা করেন? আপনার বিচার কিরূপ?’ বলেছিলাম -- ‘জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিং জানাম্যধর্মং ন চ মে নির্বৃত্তিম্ কেনো? পি দেবং হৃদিস্থিতেন, যথা নিযুক্তো? স্মিং তথা করোমি।’ আমি সখা চার্বাকের নিকট এই শ্লোকটি শুনেছিলাম। অস্যার্থ, ধর্ম কি আমি জানি, কিন্তু তাতে আমার প্রবৃত্তি নেই। অধর্ম কি, তাও জানি, তবে তাতেও আমার নিবৃত্তি নেই। যে দেব অন্তরস্থ থেকে আমাকে যেভাবে নিযুক্ত করেন, তাই আমি করি। ধর্ম, অধর্ম নিয়ে তত্ত্বচিন্তা আমার স্বভাবে নেই। আমি জানি, আমি প্রজাশাসন করি। তাদের মঙ্গলের জন্য যা যা করণীয় সেই সবই আমি কর্তব্য মনে করি। জাঁকজমক সহকারে যাগ্-যজ্ঞ ইত্যাদিতে আমার রুচি নেই বলে, ব্রাহ্মণ মুনি, ঋষিরা আমার উপর অপ্রসন্ন।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)