The observer is a prince enjoying his incognito wherever he goes. - বোদলেয়ার
আলেখ্যদর্শন:
আমরা বরং শুরু করি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত আলোকচিত্রটির দিকে তাকিয়ে। একটু পরেই আমরা দেখব প্রভূত কুসংস্কার ও কিংবদন্তির অবসান। আমরা বুঝতে পারব নির্জনতার যে অধিকার কবির মৌলিক অধিকার হিসেবে সংরক্ষিত ছিল, ইতিহাস তা হরণ করেছে। আমাদের সাহিত্যে যাঁরা তাকে নিঃসঙ্গ ও একাকী অস্তিত্ব ভাবতেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন এই কবির মেধাবী মুখোশে। এই মুখোশের আড়ালে আছে মুখ। আত্মা যেমন করে ছলনা করে যায় শরীরকে, এই মুখ তেমন পরিহাস করেছে মুখোশকে। বাস্তবিক এই আলোকচিত্রটিই আজ যাবতীয় গোপনীয়তা থেকে তাঁকে ডেকে আনছে রৌদ্রে, চৈত্রের প্রখর চরাচরে। জীবনানন্দ আজীবন নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছেন, শনাক্ত হতে চাননি, স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন নিজের প্রসঙ্গে নানা কৌতূহলোদ্দীপক বিভ্রান্তিকে। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাটি এ বিষয়ে আশ্চর্য একটি দৃষ্টান্ত নির্মাণ করে। অথচ ফটোগ্রাফটি তাঁকে চিনিয়ে দেয়। একজন ভ্রাম্যমান দর্শক হিসেবে তাঁর অভিনয় ব্যর্থ হয় ও ভিড়ের মধ্যে তাঁর লুকিয়ে থাকা থমকে দাঁড়ায়। তিনি নির্ভুলভাবে চিহ্নিত হন। আধুনিক কাব্যের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় শার্ল বোদলেয়ারেরও অনুরূপ প্রয়াস অসফল হয়েছিল। ইতিহাসের একটি বিশেষ অবস্থান এই দুজন গুরুত্বপূর্ণ আধুনিকের জন্যই একটি সাংস্কৃতিক পরিসর রচনা করে। ছোট এই লেখায় আমি সে বিষয়েই কয়েকটি কথা বলতে চাই।
প্রচলিত অভ্যাসের বাইরে থেকে দেখলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি দর্শকের পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্মুখবর্তিতা নেই। এই দৃষ্টি কেন্দ্রাভিমুখী নয়, নিবদ্ধ ও মনোযোগী কিন্তু চকিত। এই চোরা চাহনিতে একটু অন্যমনস্ক থাকার, ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আছে। অথচ জীবনানন্দের দৃষ্টি আত্মমগ্ন সন্ন্যাসীর নয়, গত শতাব্দীর আপনভোলা ভাবুকের নয়। তীব্র, সংলগ্ন তবু অন্যত্র। হে পাঠক (বা পাঠিকা) খেয়াল করুন এই চোখ আপনাকে দেখছে না। তাঁর দৃষ্টি ফ্রেমের বাইরে চলে গেল যেন এক্ষুনি। যেন ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি সংহত উদাসীনতার মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। 'সকল লোকের মাঝে বসে / আমার নিজের মুদ্রাদোষে' আলাদা হওয়ার সচেতন ও আকুল শ্রম নাদার গৃহীত বোদলেয়ারের আলোকচিত্রেও পাওয়া যায়। 'নির্জন স্বাক্ষর' নামে তাঁর আদিযুগের এক কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন -
"তুমি তা জানো না কিছু - না জানিলে
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;"
এখানে সবিনয়ে জানাতে চাই প্রথম পাঠে যাকে সামান্য প্রণয়াঞ্জলি বলে ভুল হয় তা আসলে একটি পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি। এই গানসমূহ কোনও নিবেদন নয় (পড়ার ভুলে যদি আমরা 'লক্ষ্য কোরে' উচ্চারণ করি তবে এরকম প্রসন্ন লিরিকের জন্ম হওয়া যদিও অসম্ভব নয়)। প্রকৃত প্রস্তাবে এ একরকমের অভিসন্ধিমূলক দৃষ্টিপাত। অনেকদিন পর আজ মনে হয় কে কাকে লক্ষ করেছিল এবং কীভাবে? যা দ্রষ্টব্যের অগোচরে ঘটে যাচ্ছে এমন দৃষ্টিপ্রবাহে কি ষড়যন্ত্র-মনস্কতাও আভাসিত হচ্ছে না? আসলে কেউ তৃতীয় একজন যে দেখে যায়, আমি নই; যে নিরীক্ষণ করে সে আমার সৃষ্টিকর্ম। এই লক্ষ করা যা দ্রষ্টারও অন্তর্ভুক্তি দাবি করছে না, তা ইতিহাসের হাতে সময়ের দান। জীবনানন্দের এই চাউনি ইতিহাস চেতনার দায়ভাগ - যা অন্তবর্তিকালীন, ক্ষণপ্রভ ও আকস্মিক অর্থাৎ যা আধুনিক।
পর্যটনব্রত:
তিরিশ দশকের সময় থেকে জীবনানন্দ দাশের কাব্যে শহরের উপাখ্যান লক্ষ করা গেল। প্রথমদিকে শহরের কাব্যে তিনি গ্রামকে সন্নিবিষ্ট দেখতে পারতেন; পরে গ্রাম ক্রমশই বিমূর্ত সঙ্কেতে পুনর্জিত হতে শুরু করে। তাঁর এই শহরবাসের ইতিকথায় নানা পর্ব-বিভাজন আছে। আমরা শুধু দেখতে চাইব কী করে বনলতা সেন-এর 'পথ হাঁটা' কবিতা থেকে জীবনানন্দের মধ্যে একটি শাহরিক পরিব্রাজনার চরিত্র তৈরী হল। এই চলমান পরিক্রমা যে ধরনের দৃষ্টি সংগঠন করে তাতে একধরনের রেটরিক অব ওয়াকিং বা পায়ে হাঁটার অলঙ্কারশাস্ত্র রচিত হয়। এই দর্শক যে নিজেকে ভিড়ের হৃদয় থেকে অচিহ্নিত করে অথচ ভিড়কে নথিভুক্ত করে, আমাদের সমালোচনা তত্ত্ব তাকে ফ্ল্যানেরি নামে নির্দেশ করেছে। যেমন উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী প্যারিসে বোদলেয়ারের বিখ্যাত নৈশভ্রমণও আমাদের আধুনিকতার উপত্যকাটিকে স্পষ্ট করে দেয়, জীবনানন্দের পর্যটনব্রত সে-রকমই ইতিহাস সম্পর্কিত একটি ধারণার উন্মোচন। এই শতাব্দীর প্রথমদিকে রদ্যাঁর সচিব থাকার সময়ে আরেক মহাকবি রিলকে প্যারিসের পথ পরিক্রমায় যে ত্রাস ও বিস্ময় অনুভব করেছেন তা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর পত্রাবলি ও একমাত্র উপন্যাস মাল্টে ব্রিগগের নোটবুকে। জীবনানন্দ এমন নয় যে বোদলেয়ার বা রিলকের অন্তর্যামী গ্রাহক কিন্তু আমি পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়েই বলব আমাদের কাব্যে ও গদ্যে তাঁর উপস্থিতি সম্পূর্ণ গুণগত উত্তরণ। রবীন্দ্র বিরোধিতা তো একটি তুচ্ছ উপলক্ষ; সন্দেহ নেই তুমুল সতর্কতায় জীবনানন্দ পার হয়ে যাচ্ছিলেন ঐতিহ্যের পরিচিত ধারা-উপধারা; তাঁর কাব্যে প্রখর সচেতনতায় বর্জন করেছিলেন, বরিশালের এক বাঙালির পক্ষে যা অচিন্ত্যনীয়: বর্ষা ঋতু। আদি রোমান্টিকতার অবসান ঘোষণা করে তাঁর কাব্য পরিহার করে যায় বসন্ত ঋতু, গোলাপের মত ফুল বা কোকিলের মত পাখি নয় তো দক্ষিণ সমীরণ! কেননা তা রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। তবু আমি বলব এ সমস্ত তাঁর প্রসাধন চর্চা। শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের সভ্যতাকে যে সমস্ত মেধাবী যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে তা কখনও উত্তর কলকাতার মেসবাড়ি, কখনও রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে সৌন্দর্যের সারাৎসার: নশ্বরতা থেকে অমরতা। বরিশাল থেকে কলকাতা - সাতটি তারার তিমির শুধু ভৌগোলিক স্থানান্তরণ নয়; এই স্থানান্তরণ ইতিহাসের একধরনের রূপান্তরণ। নাগরিকতার এ ধরনের অভিব্যক্তি কখনই উজ্জয়িনী বা এথেন্সে ছিল না। পাপের ফুল্লকুসুমিত প্যারিস অথবা ট্রামলাইন মথিত কলকাতা এমন এক ইতিহাস চেতনার পরিসর যে আমরা নিশ্চিত হই বোদলেয়ার বা জীবনানন্দ সময়ের প্রভু।
এখানে আমাদের মনে রাখা জরুরী যে সত্যজিৎ রায় যেভাবে লীলাকে কলকাতা শহর দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছেন অপরাজিততে, জীবনানন্দের শহর সেরকম নয়। তা আলোকপ্রাপ্তির বহুদূরে; একধরনের উত্থিত ভীতিতরঙ্গ। জীবনানন্দ যখন বলেন - 'হৃদয়, অনেক বড়ো বড়ো শহর দেখেছো তুমি'; (শহর - মহাপৃথিবী), তখন তিনি বিশেষভাবে কোনও কোনও শহরের ভৌগোলিক পরিকাঠামো বা স্থাপত্যরীতির কথা বলছেন না, তাঁর উদ্দিষ্ট নয় কোনও শহরের যূথবদ্ধ জীবনপ্রণালী। তাঁর আগ্রহ এক নির্বেদের কোনও হৃতচক্ষুর উদ্বোধনে। অর্থাৎ আমরা যদি লা মদার্নিতে বা আধুনিকতার প্রসঙ্গে ভাবি, জীবনানন্দ কলকাতা শহরকে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করেননি। কলকাতা তাঁর কাছে সংস্থাস্বীকৃত এমন পরিসর যা যতটা ভৌগোলিক বা সামাজিক তার থেকে অনেক বেশী মননের পরিণাম, ধারণার চিত্রলেখ ও মতাদর্শের স্থানাঙ্কনির্ণয়। আমি বলব এই কলকাতা একটি ইমাজিনড এনভিরনমেন্ট বা বাস্তব-অতিরিক্ত পরিবেশ। আর এই চিন্তায়নের সাম্রাজ্যে জীবনানন্দ দাশ একজন আদর্শ ফ্লান্যোর। অন্তত তার চল্লিশ দশকের কবিতার প্রসঙ্গে আমি এই মন্তব্যের সত্ত্ব বহন করে যেতে প্রস্তুত। এমনকি বিষ্ণু দে ও সমর সেনের শহর প্রীতির সঙ্গে জীবনানন্দের পার্থক্য অত্যন্ত মৌলিক।
বোধহয় আমার পাঠক বুঝতে চাইছেন ফ্লান্যোর বা ফ্লান্যোরি বলতে কী বোঝায়। ভাষাগত অর্থের দিকে তাকালে এর সঙ্গে পথ পরিক্রমার মিল আছে। কিন্তু মধ্য উনিশ শতকে প্যারিসে বোদলেয়ারের ভ্রাম্যমাণ রূপ শব্দটিকে দার্শনিক সংস্থিতি দিয়েছে। ১৮৬৯-এ প্যারিস স্প্লীন নামের কৃশতনু সঙ্কলনটি বলে দেয় এই পথ পরিক্রমার রহস্য। আমরা বুঝতে পারি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বজনীন ও প্রকাশ্য পরিবেশ প্রসঙ্গে কবির মনোপ্রবণতা কীরকম। বোদলেয়ারের কবি প্রকাশ্য দিবালোকে, পাবলিক স্ফিয়ারে, নিজেকে অন্তরালে রাখেন কিন্তু কখনই ধরণীর এককোণে নিরালা অবকাশ খোঁজেন না - He is the man who is only at home existentially when he is not at home physically. এই কবি, প্রথা ও সংস্কার ভেঙে, নিঃসঙ্গ ও পরিত্যক্ত নন। কিন্তু ভিড়ের হৃদয়ও তাঁর নয়। তিনি জনতার একজন কিন্তু জনতান্তর্গত নন। অর্থাৎ তিনি জনস্রোতের মধ্যে একা ও নিরাসক্ত অবলোকনে অভ্যস্ত। বোদলেয়ার লিখেছেন - The man who is unable to people his solitude is equally unable to be alone in a bustling crowd.
রাস্তায় যিনি ঘুরে বেড়াবেন তিনি দ্রষ্টা এই অর্থে যে বিরাট শহরে তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে সর্বত্রগামী। কবি যদি নিজেকে অদৃশ্য করতে না পারেন তবে তিনি অন্যকে দৃশ্য করতে পারবেন না। এই যে পরস্পরবিরোধী ধারণা - ভিড় বিষয়ে আগ্রহ ও ভিড়ে রাজকীয় নির্লিপ্তি - বোদলেয়ার কবিকে স্ববিরোধিতার এই উত্তরাধিকার সমর্পণ করেছেন। বোদলেয়ারের প্যারিস কী ধরনের শহর, মধ্য উনিশ শতকে প্যারিস নিতান্ত ফরাসি রাজধানী নয় বস্তুত সমগ্র মহাদেশের কেন্দ্রভূমি। সম্রাট ও সৈনিক, ভবঘুরে, লম্পট ও গণিকা ও নানা ধরনের আগন্তুক সমাবেশে উত্তর শিল্প বিপ্লব সমাজে লুম্পেন প্রোলেতারিয়েতের একটি নতুন প্রতিকৃতি রচিত হয়েছে যা গতিশীল। শিকড়শূন্য এক জনসমাজ যারা গৃহস্থ নয় যা সরাইখানায়, মদে, উকুনে, সর্বনাশে মজে আছে। এরাই নতুন সভ্যতার ষড়যন্ত্রী - গন্ধর্ব ও কিন্নর। মার্কস এদের কথা অসামান্যভাবে লিখে গেছেন লুই বোনাপার্তের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার রচনায়। জর্মন চিন্তাবিদ্ ওয়াল্টার বেঞ্জামিন উন্নত পুঁজিবাদী সমাজে শার্ল বোদলেয়ারের কবি - ফ্ল্যান্যোর সত্তার নির্মাণে মার্কসের কাছে প্রভূতভাবে ঋণী।
জীবনানন্দের চল্লিশ দশকের কলকাতার সঙ্গে উনিশ শতকীয় প্যারিসের কিছু সাদৃশ্য আছে। কলকাতা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সুযোগে কসমোপলিটান। কিছু উজবুক ভাগ্যান্বেষী, কতিপয় সন্দেহভাজন অন্যদেশী, বেশ কিছু মার্কিন সেনা ও অনেক পল্লীবাসীর আচমকা উপস্থিতিতে এই শহর জীবনানন্দকে অন্যরকম সাংস্কৃতিক মাত্রার সন্ধান দিল যা পূর্ববঙ্গের মফস্বল শহর বরিশালে ছিল না। উপরন্তু বরিশালে তাঁর স্থায়ী আশ্রয় ও গৃহ ছিল কিন্তু কলকাতায় তাঁর আশ্রয় কখনও উত্তরের মেসবাড়িতে কখনও দক্ষিণের ভাড়াবাড়িতে। বোদলেয়ার হোটেলে থাকতেন ও নৈশভ্রমণে অভ্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে যা স্বাভাবিক তেমন কোন স্থায়ী কাজ জীবনানন্দের ছিল না। তিনি হয়তো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন উদ্দেশ্যহীন পথ চলায়। তাঁর অসুখী দাম্পত্য জীবন হয়তো তাঁর শহর পরিক্রমা বিশেষত রাত্রির সফরে সহায়কও হয়ে থাকবে। বন্ধুহীন, স্বজনহীন, এই একাকী পথ হাঁটা এই শতাব্দীর কিছু মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসল বুনে দিল এ দাবি করার সময় মনে রাখতে হবে এই পথহাঁটা একধরনের প্রাচ্যপন্থী ফ্ল্যানেরি যা পথের মানচিত্রকে টেনে নেয় ইতিহাসে।
জীবনানন্দ পথ হেঁটেছেন সম্ভবত প্রথম বনলতা সেনের 'পথ হাঁটা' কবিতায়। এক রাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা এরকম ইমেজের থেকেও যা বড় তা হল কবি এই পর্যটনব্রতকে পুরাঘটিত বর্তমানে ব্যাবিলন থেকে কলকাতায় স্থাপন করেছেন অর্থাৎ অবিরত ভ্রমণকে তিনি ইতিহাসাশ্রিত করতে চান। কিন্তু একই সঙ্গে লক্ষ করছি, এই ভ্রমণের কারণ অনির্দিষ্ট ও আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণের প্রতি অনুগত থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। এর পরের প্রসিদ্ধ 'বনলতা সেন'ও পথ পরিক্রমা কিন্তু এখানে কালের চিহ্নায়ন নেই, রয়েছে, নামের মতো, চিত্রগুলি সামনে দাঁড়িয়ে। জীবনানন্দের অতিচেতনা অতঃপর পদচারণার একটি নির্দিষ্ট অভিব্যক্তির মধ্যে প্রকাশিত হয়:
'কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে' - হে পাঠক, সবিস্ময়ে লক্ষ করুন একজন বাঙালি কবি অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্মাণ করেছেন পদচারণার নন্দনতত্ত্ব। বোদলেয়ার যেমন 'ন্যাকড়া কুড়ুনির মদ' কবিতায় লিখেছিলেন:
He takes great oaths and dictates sublime laws / Casts down the wicked, aids the victims cause; / Beneath the sky, like a vast canopy. / He is drunken of his splendid qualities.
জীবনানন্দ ভিড়ের ভিতরে তবু খেয়াল করে যান ভিখিরির বাগ্মিতা।
আমাদের দেশে একদল সরলমতি সমালোচক আছেন যাঁরা বুঝতেই পারেন না জীবনানন্দে কী করে গ্রাম ও শহর মাঝে মাঝেই অবস্থান বদলায়। পুঁজিবাদের এই অবক্ষয়ী অবস্থায় কবি একজন যিনি alternately tends his ear to the forest and to the masses. এরকম একজন পিয়ের দুপঁ। বোদলেয়ার তাঁর কাব্যসঙ্কলনের ভূমিকায় লিখেছিলেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। কলা কৈবল্যবাদ প্রসঙ্গে বোদলেয়ারের স্ব-বিরোধিতাও সুপরিজ্ঞাত; বস্তুত জীবনানন্দের লেখাতেও এরকম গোধূলি সন্ধি দুর্লক্ষ্য নয়।
এরপরই জীবনানন্দ নিমতলা রাজাবাজার চিৎপুর ও ফিয়ার্স লেনের হিরণ্যপ্রভ রাত্রিকে খুঁজে পেলেন। আমাদের দ্রুততার সঙ্গে পড়ে ফেলতে হবে অনিশ্চয়তার সেই উপনিষদ, আমরা পরীক্ষামূলক ভাবে বেছে নিচ্ছি 'রাত্রি' ও 'সৃষ্টির তীরে' - এই দুটি লেখা। লেখা দুটিই শহর পরিক্রমার মরণোত্তীর্ণ স্থাপত্য। জরায়ু পর্যন্ত মধ্যরাত্রিকে অনুসরণ করতে করতে জীবনানন্দ পৌঁছে গিয়েছেন এক রহস্যময় ও আতঙ্কজনক জলবায়ুতে। ভূগোলের এই সব মলিন এলাকা ভূতলবাসীদের মাতৃভূমি। অবাক লাগে জীবনানন্দ স্বভাববিরুদ্ধ দ্রুত কোলাজে ভাষার এরকম উইণ্ডোশপিং গড়ে তুলেছেন। নগরীর মহৎ রাত্রিতে যেরকম সন্দেহভাজনদের ভিড়, প্রান্তিক চরিত্রদের বিন্যাস, আলোর আচ্ছন্ন তাপ ও দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তা সমগ্র লেখাটিতে একটি গোয়েন্দা কাহিনীর মেজাজ এনে দিয়েছে। অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার এরকম নিচুতলার মানুষজনের প্রচুর ছবি আঁকে। প্যারিসে পেশাদার ষড়যন্ত্রকারীরা যে সমস্ত সরাইখানায় জমায়েত হত সেখানে বোদলেয়ারের যাতায়াত ছিল। জীবনানন্দের রাত্রি বন্দনাতে নরকের সরায়ের চা-এর কথা জানতে পারছি সৃষ্টির তীরেতে। হেমন্তের এরকম অনেক বেলাবেলি দিন চায়ের নির্দোষ ক্যান্টিনে শেষ করে দেবেন জীবনানন্দ। খুবই অস্বাভাবিক যে আপাত নিরীহ এই বিশিষ্ট বাঙালি সচেতনভাবে উপাসনা করেছেন দূরগামী হিংস্রতার। তাঁর কবিতায় যারা জড়ো হয়েছে, তারা গগন, বিপিন, শশী, ইয়াসিন, হানিফ, মকবুল নিশ্চয়ই গ্যালিফ স্ট্রীট, এণ্টালি ও মানিকতলার, কিন্তু তার বাইরে আপিলা চাপিলার মতো অপরাধপ্রবণরাও আছে। তা আমাদের কাব্যে একটি অপরিচিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত।
জীবনানন্দ ইচ্ছে করেই কলকাতার জনতার মুখরিত সমুদ্রে নিজেকে ঘিরে একটি দ্বীপ নির্মাণ করেছিলেন যাতে একরকম অবলোকন (gaze) গড়ে ওঠে। আমরা প্রমাণ পাই যে চল্লিশদশকের কলকাতার অস্থির আর্থ-সামাজিক পটভূমি ও তার মুখশ্রীর পুঁজিবাদী রক্ত চলাচল এরকম দেখাকে প্রশ্রয় দেয়। আমি আবারও বলব যেভাবে ভারতচন্দ্র রায়, ঈশ্বর গুপ্ত বা সমর সেন নাগরিক, জীবনানন্দের নাগরিকতা তেমন নয়। তাঁর শাহরিক ভ্রমণের যে বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তার তুলনা লোরকার নিউইয়র্কে কবি ও রিল্কের মালটে লাউরিডজ ব্রিগগের নোটবই এবং অবশ্যই বিবমিষায় আতোয়ান রোকাত্যাঁর মতো পদাতিক। নেরভালের যা মনে হয়েছিল জীবনানন্দের দক্ষিণ কলকাতার পথ হাঁটা সম্বন্ধে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য - 'যা আমাদের দরকার তা ঠিক নিঃসঙ্গতা নয় কিন্তু এলোমেলো হেঁটে বেড়ানোর স্বাধীনতা।' অসুখী পারিবারিক জীবন তাঁর অন্দরের পরিসরকে দুর্বিষহ করে তোলে ফলে তিনি অপরকে খুঁজে পান বাইরে। সে বিষয়ে তদন্তকর্মে নিযুক্ত হন ধার্মিকের মতো। আধুনিকতা মানেই হল শাশ্বতের, স্থিরতার বিরুদ্ধাচরণ। অচিরস্থায়ী, অন্তবর্তী ও মুহূর্ত বন্দনা। জীবনানন্দের দৃষ্টিপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন নয়; স্থাপত্যের টুকরো, রাস্তার বিকেল, বন্দরের ওষ্ঠ। সরোজিনী হত্যা রহস্য সেখানে মিলেমিশে থাকে। যেমন বোদলেয়ারের আত্মপ্রতিকৃতিতে একটি তীব্র, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, জীবনানন্দের মধ্যেও একটু আড়চোখে দেখা। ইতিহাস যাকে বিশ্বাস করে এই বুর্জোয়া সভ্যতায় সে নির্মল ও নিষ্পাপ সৌরকরময় অক্ষিগোলক মেলে দিতে পারে না। সন্দেহের অধিকার তার মজ্জাগত। কিন্তু জীবনানন্দের এই সাময়িকতা ও সময়হীনতার গভীর ব্যবহার এক ধরনের কবিতা শিক্ষা দাবি করেছিল যা চলিত শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালি পাঠক সমাজে ছিল না। আজ যারা রৈখিক নিয়মে তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থায় জন্মজয়ন্তীতে জীবনানন্দের প্রতিরূপ নির্মাণ করছেন, তাঁরা অনুমানও করতে পারছেন না জীবনানন্দ সময়ানুক্রমিক অবস্থানের জন্য আধুনিক নন, যেমন কাব্যবিশ্বাসের জন্য প্রগতি বা প্রতিক্রিয়ার দ্বারস্থ নন। তাঁর মধ্য দিয়ে এক ধরনের পরিকল্প বাংলা সাহিত্যে উপস্থিত হয় যা আমাদের আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াটিতে এক অন্যরকম মন্তব্য। এই লেখায় সেরকম দেখার বিষয়ে ছোট একটি খসড়া রাখলাম। বস্তুত জীবনানন্দ দাশের সৌজন্যেই বাংলা কবিতা প্রথম আন্তর্জাতিক সমকালীনতার স্বাদ পেল।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বাঙালি ছিলেন না। আমাদের সৌভাগ্য জীবনানন্দ দাশ বাঙালি ছিলেন!
অলংকরণঃ উইকিপেডিয়া থেকে