'অনন্য জীবনানন্দ' : মূল গ্রন্থের পরিপূরক একটি অনুবাদ

সুমিতা চক্রবর্তী



অনন্য জীবনানন্দ জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী; ক্লিনটন বি. সিলি-র 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' গ্রন্থের অনুবাদ : ফারুক মঈনউদ্দীন; প্রথম প্রকাশ : আষাঢ় ১৪১৮, জুলাই ২০১১, প্রথমা প্রকাশন - কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫, বাংলাদেশ, পৃষ্ঠাঃ ৩৫৬ ; ISBN : 978-984 8765 76 X

সাহিত্যের আলোচনায়, অথবা যে-কোনো শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পীর জীবনী জানবার প্রয়োজন আছে কি না তাই নিয়ে গত শতকে তর্ক তুলেছিলেন প্রকরণবাদী সাহিত্য-ভাবুকেরা। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে (মোটের উপর ১৯১২ থেকে ১৯৩০) রাশিয়ার প্রকরণবাদী (ফরম্যালিস্ট) গোষ্ঠীর চিন্তন-সূত্র পরবর্তী কালে ইউরোপ-এর সাহিত্য-তত্ত্ববিদদের অনেকের কাছেই এই অভিমত গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, সকলেই এটি মেনে নিয়েছিলেন। অথবা সার্বিক নিরুৎসাহ গড়ে উঠেছে শিল্পীদের জীবন পর্যালোচনার কাজে। যে-সব মানুষ গড়পড়তা সাধারণ জনতার একজন, এই পরিচয় ছাপিয়ে কোনও না কোনও দিকে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন; কেমনভাবে গড়ে উঠেছিল তাঁদের মননের স্বরূপ এবং কেমন ছিল তাঁদের আশৈশব যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাপুঞ্জ — সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল থাকেই। এই কৌতূহল কেবল শিল্পী, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞানী, কর্মবীরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বিশিষ্ট খ্যাতিসম্পন্ন অপরাধীদের সম্পর্কেও আমাদের জানবার আগ্রহ কম নয়। সরল কথাটি এই যে, উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের জীবনীচর্চা পৃথিবীর সর্বত্র যথেষ্টই চাহিদা মেটায়

বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনার সূত্রপাত হয়েছিল তাঁর মধ্যবয়সেই। তিনি নোবেল পুরস্কার পাবার পরেই তাঁর জীবনী রচিত হয়েছিল বাংলায়, ইংরেজিতে। তার পর থেকে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বাংলার তথা ভারতের জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধি এবং তাঁর জীবনী রচনার বিভিন্ন প্রয়াসও ক্রমেই বর্ধিত হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত জীবন-লেখ থেকে শুরু করে প্রমাণ মাপের নয়-দশ খণ্ডের পরিসরের পরেও সেই জীবনের তথ্য সন্ধান থেকে যায় অসম্পূর্ণ।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কোনও কোনও আগ্রহী জনকে বাদ দিলে, আমাদের দেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনী রচনার জন্য যে অনুরাগ, মেধা, কর্মদক্ষতা এবং দুরূহ প্রচেষ্টার সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় তার নিতান্তই স্বল্পতা দেখা যায়। বিদ্যাসাগর মশাই বেশ কিছুকাল আগে থেকেই সেই মনোযোগ আদায় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলার সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশার্‌রফ হোসেন, শরৎচন্দ্রের মতো লেখকদের সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ ও সশ্রম গবেষণামূলক জীবনী রচনার কাজ সম্পন্ন হয়েছে গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে, তার আগে নয়। শরৎচন্দ্র সম্পর্কে এর পরেও বলা চলে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী 'আওয়ারা মসীহা' লিখেছেন একজন অবাঙালি - শ্রী বিষ্ণু প্রভাকর - উত্তরপ্রদেশের মানুষ। পরে প্রকাশিত হয়েছে তার বাংলা অনুবাদ - 'ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ'।

মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন এবং শরৎচন্দ্রেরই যখন প্রাপ্ত (প্রাপ্য??) জীবনীর অপ্রতুলতা রয়েছে, তখন রবীন্দ্র-উত্তর কালের কবিদের নিয়ে সেই প্রয়াস যে অত্যন্ত সীমিত হবে তা বলাই বাহুল্য। জীবনী লেখার চাড় আসে অনেকটা সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তার নিরিখে। রবীন্দ্র-উত্তর কালের বাংলার কবিদের মধ্যে জনপ্রিয়তম নিঃসন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্পর্কে বহুদিন পর্যন্ত যা লেখা হয়েছে সেগুলি তাঁর পরিচিতজনের রচিত স্মৃতিকথা। প্রামাণ্য জীবনী লেখা হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। দুটি নজরুল-জীবনীগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের গবেষক রফিকুল ইসলাম রচিত 'কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃষ্টি' (১৯৯৭) এবং পশ্চিমবঙ্গে অরুণকুমার বসু লিখিত 'নজরুল জীবনী' (২০০০)। কাজেই জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে জীবনী লেখার আয়োজন করা যে দরকার— সে কথা বহু কাল পর্যন্ত বাঙালি গবেষকদের মনেই পড়েনি। সেই শূন্যতা পূরণ করে সহসা ১৯৯০-এ বন্যাস্রোতের মতো ঝাঁপিয়ে এল একটি ইংরেজিতে লেখা জীবনানন্দ-জীবনী। লেখকের নাম ক্লিনটন বি. সিলি (Clinton B. Seely)। বইটির নাম 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' ('A Poet Apart')। গ্রন্থটি ১৯৯৩-এ পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্টি সাহিত্য সম্মান 'আনন্দ পুরস্কার'-এ ভূষিত হয়। এই বইটির কোনও বাংলা অনুবাদ বহুকাল আমাদের হাতে ছিল না। এটি লক্ষণীয় যে, মূল্যবান ইংরেজি বইয়ের, এবং যে-সব অন্য ইউরোপীয় ভাষার গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যায় সেগুলি অনুবাদ করতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তেমন আগ্রহ দেখান না। হয়তো ইংরেজি ভাষায় বুদ্ধিজীবী বাঙালির অধিগম্যতার স্বাচ্ছন্দ্যের কারণেই এমন হয়। যদিও তেমন না হওয়াই কাম্য। তবে সেই খেদ অনেকটাই মিটিয়ে দেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের কাছে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলার গুরুত্ব কিছু বেশি। তাই বেশ কিছু ইংরেজি ও ইউরোপীয় ভাষায় লিখিত চাবি-গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ তাঁদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। বিশ শতকের বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতিকে অন্তরে উৎকীর্ণ করে নেবার পথে কবি (এখন জানা গেছে তিনি দুর্দান্ত কথাসাহিত্যিকও) জীবনানন্দকে শিল্পকৃতিতে ও জীবনে গভীরভাবে জেনে নেওয়া নিতান্তই প্রয়োজনীয়— এই সত্যটি বোধ হয় অস্বীকার কেউ করবে না। সেই জানা যেমন তাঁর লেখায় অভিনিবিষ্ট হয়ে সম্পন্ন করতে হবে, তেমনই অনুসরণ করতে হবে তাঁর জীবনকেও। কারণ একজন মানুষকে বোঝবার জন্য তাঁর কর্মপ্রয়াস এবং তাঁর জীবন—দুই-ই জানতে হবে—এমনই আমাদের বিশ্বাস।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক শ্রী ফারুক মঈনউদ্দীন এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আকাঙ্ক্ষিত কাজটি সম্পন্ন করেছেন; বাংলায় অনুবাদ করেছেন 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' বইটি; নাম দিয়েছেন 'অনন্য জীবনানন্দ'। তাঁকে অজস্র ধন্যবাদ।

একটি অনুবাদ গ্রন্থ সামনে রাখলে আলোচকের কিছুটা সমস্যাই ঘটে। আলোচক কি মূল গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু বলবেন? অথবা প্রধান আলোচ্য করে তুলবেন অনূদিত পাঠটিকেই? দুটি ক্ষেত্রে আলোচনার পদ্ধতিও কিছুটা আলাদা হবে। প্রথম ক্ষেত্রে মূল গ্রন্থটির এবং গ্রন্থলেখকের পরিচয়কে বড়ো করে তুলতে হবে এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করতে হবে অনুবাদের ভাষা এবং যাথার্থ্য। তবে এক্ষেত্রে এই দুটি পদ্ধতির কোনওটিই একান্তভাবে গ্রহণ না করে, কিছুটা পরিসরের সীমায়ন সম্পর্কেও সচেতন থেকে আমরা গ্রহণ করেছি একটি মিশ্রিত কৌশল।

মূল গ্রন্থটিকেও আমরা খানিকটা পাঠকদের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করব; সেই সঙ্গে অনুবাদকের কাজটি সম্পর্কেও বলব কিছু কথা। ক্লিনটন বি. সিলি-র বইটি সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই প্রশস্তিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। তবুও যে আমরা সেই কাজে অতি সংযত থাকব তার কারণ এই যে, মূল বইটি প্রকাশিত হয়ে গেছে তেইশ বছর আগে। জীবনানন্দ-অনুরাগী এবং সামগ্রিকভাবে বিশ শতকের কবিতার অনুরাগী পাঠক-গবেষকদের সে বই পড়া হয়ে গেছে অনেককাল। তবু অল্প কিছু কথা বলে নেওয়া এ জন্যই&mdashএখনও যাঁরা পড়েননি এবং সাহিত্য পঠন-পাঠনের জগতে নবাগত তরুণ-তরুণ—যাঁরা এখনও বইটি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত হতে পারেননি তাঁদের বইটি সম্পর্কে কিছু জানানো।

ক্লিনটন বি. সিলি-র কথাই আগে বলা যাক। মানুষটি ১৯৬০-এর প্রথম দিকে ছিলেন আমেরিকা-র 'পিস কোর' (Peace Core)-এর স্বেচ্ছাসেবী। সেই প্রকল্পের কর্মসূত্রে দু বছর কাটিয়ে গেছেন বরিশালে। কিন্তু তখন জীবনানন্দের নাম শোনেননি। এখান থেকে বোঝা যায় যে, জনপ্রিয় লেখকদের জীবনী রচনার যে-প্রবণতা অনেক লেখককে এ-ধরনের কাজে প্রবৃত্ত হতে উৎসাহিত করে এই লেখক সে-ধরনের মানুষ নন। পরে ক্লিনটন সিলি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এশীয় পাঠশৃঙ্খলা (এশিয়ান স্টাডিজ)-র অধ্যাপক রূপে সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার জগতে চলে আসেন। সেই সময়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রিত অধ্যাপক, কবি এবং প্রাবন্ধিক জ্যোতির্ময় দত্ত জীবনানন্দের আশ্চর্য পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর। সেই জগৎ থেকে কোনও দিন আর পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি ক্লিনটন সিলি। তিনি কলকাতায় এলেন; পরিচিত হলেন জ্যোতির্ময় দত্তের শ্বশুর মহাশয়, সেই বিখ্যাত বুদ্ধদেব বসু, এবং নরেশ গুহর (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান) সঙ্গে। জীবনানন্দ বিষয়ে গবেষণা-নিবন্ধ রচনা করে পরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি. এইচ. ডি. উপাধি প্রাপ্ত হন। গবেষণা-গ্রন্থটির নাম ছিল 'আ ডো ইন হীট' ('A Doe in Heat')। 'ঘাই হরিণী' শব্দের ক্লিনটন-কৃত রূপান্তর। যদিও এই রূপান্তর ঠিক যথাযথ নয়। তা অনুধাবন করেই যখন পরিমার্জিত আকারে গ্রন্থটি প্রকাশিত হল তখন তিনি নাম দিলেন 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট'—যার চমৎকার বাংলা ভাষান্তর করেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন—'অনন্য জীবনানন্দ'। আমার সৌভাগ্য, অধ্যাপক নরেশ গুহ-র অমিত সৌজন্যে তখনও অ-মুদ্রিত গবেষণা-গ্রন্থটি দেখতে পেয়েছিলাম। বিরলতর সৌভাগ্য—ক্লিনটন বি. সিলি-র সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়েরও কিছুটা সুযোগ ঘটেছিল আশির কালপর্বে এবং পরেও। মাঝে মাঝেই তিনি কলকাতায় এসেছেন। জীবনানন্দের পৃথিবী থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে পারেননি বলে যে মন্তব্যটি আগে করেছি তার সাক্ষ্য তাঁর পরবর্তী কালে রচিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধ-সংকলনের নাম—'বরিশাল অ্যাণ্ড বিয়ণ্ড' এসেজ অন বাংলা লিটারেচার' ('Barishal and Beyond Essays on Bangla Literature', ২০০৮)। এ গ্রন্থেও আছে জীবনানন্দকে নিয়ে, তাঁর কবিতা নিয়ে লেখা নতুন প্রবন্ধ।

'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' গ্রন্থটির শিরোনামের সঙ্গে ছোটো হরফে যুক্ত আছে নির্দেশসূচক একটি বাক্যাংশ— 'A Literary Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1899-1954)'। অর্থাৎ বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) একটি সাহিত্যিক জীবনী। 'সাহিত্যিক জীবনী'--এই শব্দবন্ধের সংকেত অনুসরণ করে আমরা অতঃপর প্রবেশ করি গ্রন্থটির অভ্যন্তরে। জীবনানন্দের জীবনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি, তাঁর পিতামাতা এবং পূর্ব প্রজন্মের সদস্যদের পরিচয়, ব্রাহ্ম সমাজের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের কিছুটা বিস্তৃত পরিচয়; এবং তারও আগে বঙ্গভূমির ভৌগোলিক চালচিত্রটি তুলে ধরবার সঙ্গে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তনটিও অতি সংক্ষেপে অথচ নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। যেহেতু এই বইটি ১৯৪৭-এর অনেক পরে লেখা এবং লেখক স্বাভাবিকভাবেই বরিশালকে কেন্দ্র করে শুরু করেছেন তাঁর কথকতা, তাই পূর্ববঙ্গের বিবরণ দিয়ে শুরু হয়েছে তাঁর এই ইতিবৃত্ত। গবেষণার কাজটি যখন সম্পন্ন করেছেন তখনও স্বাধীন বাংলাদেশ অস্তিত্ববান হয়নি। পরে জীবনানন্দের কলকাতায় আসার সঙ্গেই তাঁর ভাষ্যও প্রবেশ করেছে পশ্চিমবঙ্গে। তবে জীবনানন্দের গড়ে ওঠার পৃথিবীরূপে স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব বাংলার দেশ-পরিচয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ক্লিনটন সিলি-র প্রারম্ভিক সংক্ষিপ্ত পরিচ্ছেদটি মন কেড়ে নেয়। তিনি শুরু করেছেন বাংলার বর্ষপঞ্জি দিয়ে। বাংলার প্রকৃতি, প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য এবং মধ্যযুগের বাংলার ঐতিহাসিক বিবরণ শেষ করে ইংরেজ রাজত্ব অতিক্রম করে বিশ শতকের প্রথমার্ধের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়নগুলির প্রতিটি সোপান ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন তিনি। অতঃপর ক্রমে বিস্তৃত হয়েছেন জীবনানন্দের জীবনকথায়। সেই বিবরণের ডিটেল আমাদের প্রতি মুহূর্তে বিস্মিত করে। জীবনানন্দের পিতামহ থেকে শুরু করে পিতামাতা এবং পরিবারের অন্য সকলের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি লেখা, প্রাপ্ত পত্র ও পত্রাংশ এবং তাঁদের সম্পর্কে বিভিন্ন জনের স্মৃতিসঞ্চিত উপাদান একত্র করে, বিন্যস্ত করে এবং বিশ্লেষণ করে ধীর ক্রমিক উন্মোচনে জীবনানন্দের আবির্ভাবের পটকথা তিনি এঁকেছেন অতীব সূক্ষ্মতায়। ভূমিকাতেই তিনি আমাদের চমকে দিয়েছিলেন চুনিলালের উল্লেখে। এই চুনিলালের চা-এর দোকান ছিল রাসবিহারী অ্যাভিনিউ আর ল্যান্সডাউন রোড-এর মোড়ে। ট্রামের চাকায় পিষ্ট জীবনানন্দের শরীরকে তিনিই ট্রামের একটি পাশ তুলে ধরে বার করে আনতে সাহায্য করেন। এই জীবনীটি লিখতে গিয়ে যে অজস্র মানুষের সঙ্গে অসংখ্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছেন লেখক তাঁদের একজন হলেন এই চুনিলাল।

এই জীবনকথা অতঃপর প্রবাহিত হয়ে চলে জীবনানন্দের বেড়ে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে। জীবনানন্দের বিদ্যালয়জীবন, কিশোরকাল, পারিবারিক পরিবেশ, ব্রাহ্ম সমাজের বাতাবরণ, বরিশালের প্রকৃতি, জীবনানন্দের প্রথম লেখা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য। সেই সঙ্গেই সমান্তরালভাবে বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ধারা ও তরঙ্গগুলিও ফুটে উঠতে থাকে সিলি-র লেখায়। কারণ একজন সাহিত্যিকের জীবন তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সঙ্গে যেমন অনুপুঙ্খভাবে জড়িত, ঠিক তেমনই সমকালের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাবলির সঙ্গেও অবিচ্ছিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট।

বাংলা সাহিত্যের, তথা বাংলা কবিতার সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকজন এই গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত। অতিরিক্ত বিবরণ আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া বাহুল্য হবে। তবু দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারি না তাঁর প্রদত্ত সুবিস্তৃত তথ্যসূত্রের দিকে। লক্ষ না করে পারি না তাঁর অতি সুলিখিত নির্ঘন্ট। বিশেষভাবে চোখে পড়ে এবং মনের মধ্যে ঢেউ তোলে জীবনানন্দের জীবনকথা পরিবেশনের সঙ্গেই জীবনানন্দের রচনা থেকে সমান্তরাল ও প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি। কীভাবে এই বিদেশি গবেষক জীবনানন্দকে পাঠ করেছিলেন তা অনুভব করে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। পুনরুক্তি করেই বলছি তাঁর প্রদত্ত তথ্যসূত্রের বিপুল সম্ভার এবং অনুপুঙ্খের যাথার্থ্য অধিকাংশ বাঙালি গবেষকের কাছে ঈর্ষণীয় এবং শিক্ষণীয়। ক্লিনটন সিলি-র অপরিসীম পরিশ্রম এবং জীবনীলেখক হিসেবে তাঁর অসামান্য প্রতিভার কিছুটা অংশও হৃদয়ঙ্গম করতে গেলে বইটি হাতে নিয়ে দেখতে হবে প্রত্যেক পাঠককে, পাঠ করে দেখতে হবে প্রত্যেক গবেষককে।

আমরা বইটির প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করছি, কেবল তুলে দিচ্ছি বই-এর পরিচ্ছেদগুলির অনুক্রম— ভূমিকা, শেকড়, কল্লোল যুগ, বরিশাল ফেরা, যুদ্ধকাল: প্রস্তাবনা ও ফলাফল, উপন্যাসের আরেকটি প্রয়াস, রাজনীতির কবিতা, মরণোত্তর জীবনানন্দ, নির্ঘন্ট। আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য এই যে, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে এই বইটি প্রকাশিত হবার আগে গোপালচন্দ্র রায় রচিত একটি জীবনীগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। এই পথের প্রথম পথিক রূপে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচ্য। তবে গবেষক রূপে ক্লিনটন সিলির মতো অপ্রতিহত ভ্রাম্যমানতা না থাকায় এবং পরিকল্পনার দিক থেকেও সুচিন্তিত ভাবনাবিস্তার ছিল না বলে গোপাল চন্দ্র রায়ের বইটি কিছু উপাদানের জোগান দিলেও প্রামাণ্য বলে পরিগণিত হতে পারেনি। গবেষণার ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ যে একটি প্রশিক্ষণসম্মত বিদ্যাচর্চা—সেই সংস্কারটি আমাদের অনেকেরই থাকে না। মোটামুটি ভাবে গোপালচন্দ্র রায়ের তা ছিল, কিন্তু ক্লিনটন সিলি-র মতো প্রায় আক্রমণাত্মক নিষ্ঠা সহযোগে তার প্রয়োগ ছিল না। এখানেই সিলি-র সঙ্গে আরও অনেক গবেষকের পার্থক্য। পরবর্তী কালে প্রভাতকুমার দাস 'জীবনানন্দ দাশ' নামে একটি চমৎকার জীবনী লিখেছেন, প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৯-এ। তিনি ক্লিনটন সিলি-র গ্রন্থের সহায়তা পেয়েছিলেন। তাঁর গ্রন্থটি বিশুদ্ধ জীবনী; প্রতি পর্যায়ে জীবনানন্দের সৃষ্টিকর্মের ব্যাখ্যায় সম্প্রসারিত নয়।

এমন একটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ছিল না। সেই কাজটি করে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন ফারুক মঈনউদ্দীন। তাঁর পরিচিতি রূপে যেটুকু আমরা গ্রন্থের ব্লার্ব-এ পাচ্ছি তা হল—জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৫৮। তিনি কোন্‌ পাঠশৃঙ্খলা অনুসারী লেখাপড়া করেছেন তা উল্লিখিত নেই। কিন্তু ব্যক্ত আছে যে, তিনি লিখেছেন অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সংক্রান্ত তিনটি বই। আরও লিখেছেন চারটি ভ্রমণকাহিনী। সত্তরের শেষভাগে সম্ভবত গল্প দিয়েই তাঁর লেখার জগতে প্রবেশ। প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম 'বৈরী স্রোত'। এছাড়াও আছে আরও দুটি গল্প-সংকলন। দুটি অনুবাদ-গ্রন্থ তিনি সম্পন্ন করেছেন বলে জানানো হয়েছে। অবশ্যই এই 'অনন্য জীবনানন্দ' গ্রন্থ তার মধ্যে একটি। ব্লার্ব-এ যেটুকু লিখিত হয়েছে তা থেকে মনে হয় তাঁর আরও কিছু লেখা আছে এবং সেগুলির বিষয় নানাবিধ। বলতে বাধ্য হই, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থের অনুবাদকের ব্লার্ব-পরিচিতি আরও একটু সুনির্দিষ্ট ও বিশদ হলে ভালো হত।

এই অনুবাদ গ্রন্থটি পরিকল্পিত ও প্রকাশিত হবার ইতিহাসটুকু বাংলা সংস্করণের বইটির জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা লিখে বিবৃত করেছেন ক্লিনটন বি. সিলি। তাতে প্রথমেই তিনি যা জানিয়েছেন তা উদ্ধৃত করতে চাই - "আমার সৌভাগ্য, ১৯৯৩ সালে আমার ইংরেজিতে লেখা বই 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট''-কে আনন্দ পাবলিশার্স তাদের বার্ষিক অশোককুমার সরকার স্মরণীয় আনন্দ পুরস্কার প্রদান করে। তার অব্যবহিত পরে সেটার অনুবাদ করার জন্য একটা প্রস্তাব উঠেছিল। এ নিয়ে আলোচনা হয়, সময় কেটে যায়, তবে শেষ পর্যন্ত অনুবাদের ব্যাপারে কিছু হয়ে ওঠেনি।" যদিও সিলি-র সুভদ্র ভাষায় স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়নি, তবু মনে হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকেই উঠেছিল সেই অনুবাদের প্রস্তাব এবং সেটি কার্যকর হয়নি।

যেখান থেকে তিনি আনন্দ পুরস্কার পেলেন সেখান থেকে বইটির অনুবাদ হলে আমাদের ভালো লাগত। এই পুরস্কারের সতেরো বছর পরে ঢাকার শ্রী সাজ্জাদ শরিফ তাঁকে জানান যে 'প্রথমা' নামের একটি পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা তাঁরা স্থাপন করেছেন এবং সিলি-র বাংলায় লেখা কোনও প্রবন্ধ সংকলন তাঁরা প্রকাশ করতে চান। এই প্রস্তাবের উত্তরে ক্লিনটন সিলি সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট''-এর অনুবাদ তাঁরা প্রকাশ করতে রাজি কি না। সম্মত হবার জন্য সাজ্জাদ শরিফকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সিলি। আমরাও তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

অতঃপর সিলি অনুবাদক সম্পর্কেও কয়েকটি কথা বলেছেন যা তাঁর ভাষাতেই উদ্ধৃত করতে চাই--"একজন অনুবাদককে নিযুক্ত করা হল। ফারুক মঈনউদ্দীন কেবল দক্ষ অনুবাদক নন, তিনি নিজেই সাহিত্যিক; প্রধানত ছোটগল্প লেখেন। তা ছাড়া সাজ্জাদ শরিফ আমার কাছে তাঁকে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তিনি জীবনানন্দ দাশের নিখাদ ভক্ত। আমিও কিছু অনুবাদ-টনুবাদ করেছি, অবশ্য বাংলা থেকে ইংরেজিতে। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনুবাদ কাজটা কঠিন, অত্যন্ত পরিশ্রমের। পুরো একটা বই অনুবাদ করতে গেলে প্রচুর সময় লাগে। ফারুক মঈনউদ্দীন এত তাড়াতাড়ি অনুবাদ করে ফেলেছেন দেখে আমি অবাক এবং সত্যিই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।"

ফারুক মঈনউদ্দীন সম্পর্কে এই পরিচিতিটুকু নিয়েই আমাদের আপাতত সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমরাও তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। সিলি-র ভূমিকা থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের খ্যাতনামা গবেষক ও কবি হায়াৎ মামুদ এই গ্রন্থের কিছু সম্পাদনা করেছেন। ক্লিনটন সিলি লিখেছেন যে, 'অনন্য জীবনানন্দ' অনুবাদ-গ্রন্থটি 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' গ্রন্থের যথাযথ বঙ্গানুবাদ। তবে গ্রন্থপঞ্জি অংশটি তাঁরা বর্জন করেছেন কারণ ইতোমধ্যে জীবনানন্দ সম্পর্কে বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ এবং আলোচনা-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যেগুলিতে আছে সুবিস্তৃত এবং অনুপুঙ্খ গ্রন্থপঞ্জি। বিশেষভাবে সিলি উল্লেখ করেছেন প্রভাতকুমার দাস লিখিত 'জীবনানন্দ দাশ' গ্রন্থে সংযোজিত সুবৃহৎ তালিকার কথা। এছাড়া তিনি আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন। এই নিবিষ্ট জীবনানন্দ গবেষক ২০১০-এ প্রয়াত হয়েছেন।

পরিশেষে সিলি-র লিখিত বাংলা ভূমিকাটির শেষ অনুচ্ছেদটি উদ্ধৃত করছি। একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ গড়ে ওঠবার মূলে বহুদিন ধরে সঞ্চিত হতে থাকে পরিমণ্ডল, অনুরাগ ও অভিপ্রায়ের সমন্বয়। তারই পথরেখা আমরা দেখতে পেলাম ষাটের দশকের প্রথম দিকে 'পিস কোর'-এর স্বেচ্ছাসেবক ক্লিনটন বি. সিলি-র ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত, বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশনীর 'অনন্য জীবনানন্দ' অনুবাদ গ্রন্থটিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পাঁচ মাসের মধ্যে এই সুপরিসর গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছে। বাংলা ভূমিকাটির শেষ অংশে আবদুল মান্নান সৈয়দ-কে হৃদয়স্পর্শী ভাষায় স্মরণ করেছেন সিলি। এই ভূমিকার শেষ বাক্যগুলি এরকম—"শেষে স্বীকার না করলে অন্যায় হবে - এ বইটি হতো না যদি তিনজন মানুষ আমাকে সমর্থন, সহায়তা ও সাহায্য না করতেন: আমার প্রধান শিক্ষক ও পরে সহকর্মী এডওয়ার্ড সি ডিমক, অল্প দিনের জন্য আমার শিক্ষক ও তারপর চিরদিনের জন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু জ্যোতির্ময় দত্ত এবং আমার ও অনেকের শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধদেব বসু। আজীবন আমি এই তিনজনের কাছে ঋণী।

ক্লিন্টন বি সিলি
স্টার্জেন বে, ওইস্‌কন্‌সিন, ইউএসএ
ফেব্রুয়ারি, ২০১১"

মূল গ্রন্থের ইংরেজি ভূমিকাটিতে আরও অনেকের কাছে ঋণ স্বীকৃত হয়েছে। সেটির বঙ্গানুবাদ এখানে পাই। কিন্তু অনুবাদ-গ্রন্থের বাংলা ভূমিকাটি সিলি-র স্বতন্ত্র বাংলা রচনা - যা ইংরেজি বইটিতে নেই। অনুবাদকের ভূমিকায় ফারুক মঈনউদ্দীন কাজটির প্রতিটি পর্যায়ে ক্লিনটন সিলি-র সহায়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি যথার্থভাবে মন্তব্য করেছেন যে, অনূদিত ভাষাটির উপর মূল গ্রন্থকারের যদি ভালো দখল থাকে তা হলে তা অনুবাদকের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুবিধাজনক হয়। অনূদিত ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার ওপর ক্লিনটন সিলি-র দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা। ভাষার সেতুপথে চলতে চলতে যিনি জীবনানন্দের মতো স্রষ্টার অন্তরকে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন তাঁর বাংলা ভাষাজ্ঞান এবং ভাষাবোধ দুই-ই অত্যন্ত গভীর তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। তা ছাড়াও অনুবাদকের ভূমিকা থেকে ক্লিনটন সিলি-র পঠন-পাঠনে নিবেদিত ব্যক্তিত্বের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিকৃতি উঠে আসে— "... কোনো বাক্য বা শব্দ দুরূহ মনে হলে ক্লিনটনের শরণাপন্ন হয়েছি, তিনি তাঁর নিজের অধ্যাপনা পেশার প্রতি সুবিচার করে সুশিক্ষকসুলভ ধৈর্যে সেসবের যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দীর্ঘ নোট লিখে অযথার্থভাবে অনূদিত শব্দ কিংবা বাক্য পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁর অপরিচিত কোনো বাংলা শব্দ পেলে জানতে চেয়েছেন সেগুলো সম্পর্কে। ক্লিন্টনের বেশ পরিশ্রম হলেও একটা বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে যে বইটিতে কোনো শব্দ বা বাক্যের ভুল বা অযথার্থ তরজমা নেই।"

প্রসঙ্গত 'প্রথম আলো' পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে এবং 'প্রথম আলো'-র ব্যবস্থাপনা-সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ-কেও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মঈনউদ্দীন। ধন্যবাদ জানিয়েছেন আরও অনেক সাহিত্য-কর্মীকে— মলয় রায়চৌধুরী, গৌতম চৌধুরী, সৈয়দ শহীদ, জ্যোতির্ময় দত্ত, তুষার দাশ এবং জীবনানন্দ-গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী।

'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' গ্রন্থটি এতকাল ধরে অনেকেই পড়েছেন; আবার অনেকেই পড়েননি। জীবনানন্দ-গবেষকেরা প্রায় সকলেই পড়েছেন; সাহিত্য নিয়ে যাঁরা অন্যান্য কাজ করেন তাঁদেরও কেউ কেউ পড়েছেন। কিন্তু নিঃসন্দেহেই বলা যায় বাংলায় অনুবাদ হবার ফলে আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে এই বইটি পৌঁছে যাবে। অসামান্য এই জীবনীগ্রন্থে জীবনানন্দের জীবন-তথ্যের অনুপুঙ্খ সম্ভার যেমন আমরা পাই; তেমনই সমান্তরালভাবে পাই তাঁর রচিত কবিতা, কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের উদ্ধৃতি। কবিতায় অভিব্যক্ত জীবনানন্দের মন এবং তাঁর জীবনের খুঁটিনাটিকে সর্বত্র একটি সম্পর্ক-সূত্রে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সিলি। সেই সঙ্গে এক-একটি কবিতার ব্যাখ্যায় অন্যান্য আলোচকেরা কী বলেছেন তা-ও তুলে এনেছেন তিনি। ফলে একটি কবিতার অনুভব যে বিভিন্ন পাঠকের চিত্তে কিছুটা ভিন্নও হতে পারে—তা-ও হৃদয়ঙ্গম করি আমরা। সেই সঙ্গে জীবনানন্দের যাবজ্জীবনকে ঘিরে রেখেছিল যে দেশ-কাল—'প্রবাসী' থেকে 'শতভিষা' ও 'কৃত্তিবাস' পর্যন্ত সাহিত্য-সাময়িক পত্রগুলির জীবন্ত অস্তিত্ব এবং এই পত্রিকাগোষ্ঠীগুলির লেখকদের সঙ্গে জীবনানন্দের মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া —এ সবই তুলে এনেছেন সিলি। 'কল্লোল', 'প্রগতি', 'শনিবারের চিঠি', 'পরিচয়', 'পূর্ব্বাশা', 'কবিতা', 'নিরুক্ত' প্রমুখ পত্রিকাগুলির সঙ্গে জীবনানন্দের কবিজীবনের বেড়ে ওঠা অত্যন্ত আকর্ষক এক জীবন-পরিক্রমাকে তুলে ধরে।

সেই সঙ্গে আছে দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করা জীবনানন্দের সমাজদৃষ্টি, সমাজ ও মানুষের নির্মম সম্পর্ক-বন্ধন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির বিভিন্ন প্রচ্ছায়ের বিবরণ। জীবনানন্দের বরিশালের বসবাস ও কলকাতার অভিজ্ঞতা — দুটি দিককেই তুলে আনা হয়েছে গ্রন্থে।

আজ সিলি-র বইটি হাতে নিয়ে সামান্য একটু অভাববোধ জাগে কথাসাহিত্য আলোচনার পরিচ্ছেদটিতে। যে সময়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে সেই সময়ের মধ্যে মুদ্রণের আলো দেখেছিল জীবনানন্দের তিনটি মাত্র উপন্যাস— 'মাল্যবান' (১৯৭৩), 'সুতীর্থ' (১৯৭৭), ও 'জলপাইহাটি' (১৯৮৫)। পরবর্তী কালে 'প্রতিক্ষণ' প্রকাশনা সংস্থা থেকে জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের যে বিচিত্র ও সমৃদ্ধ সম্ভার আমাদের হাতে এসেছে সেগুলিকে আলোচনার বৃত্তে আনতে পারেননি সিলি। তবে সে-জন্য তাঁর কোনো দায়িত্ব ছিল না। সিলি-র লেখায় ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তীব্রমন্থিত ঘূর্ণির অসাধারণ বিশ্লেষণী লিপিচিত্র পাওয়া যায়। অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য শেষ পরিচ্ছেদটি—'মরণোত্তর জীবনানন্দ'। এখানে জীবনানন্দের প্রয়াণের পর কোথায় কী সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, কী স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি মৃত্যুর পরে, জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিদের লেখায় কীভাবে জীবনানন্দের ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিস্তীর্ণ হয়ে আছে তারও বেশ কিছুটা আলোচনা আছে। তবে এই অংশটি যে দিনে দিনে পরিব্যাপ্ত হয়ে চলেছে তা আমরা অনুভব করি এখন। আবুল বাশার কিংবা রবিশংকর বলের নিজেদের গদ্য লেখায় কীভাবে রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের মতোই জীবনানন্দীয় উত্তরাধিকার সংশ্লেষিত হয়ে যাচ্ছে তার পরিচয় ১৯৯০-এ ততটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি।

একটি ভিন্ন ধরনের অনুভূতি হয় অনুবাদ-গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে যা মূল গ্রন্থটি থেকে একটু হলেও আলাদা। ইংরেজিতে লেখা মূল গ্রন্থে জীবনানন্দের কবিতা ও উপন্যাসের উদ্ধৃতিগুলি আমরা পেয়েছি ক্লিনটন সিলি-র অনুবাদে। কিন্তু অনুবাদ-গ্রন্থটিতে আমরা সেই উদ্ধৃতিগুলি পাচ্ছি জীবনানন্দের নিজের ভাষায়। ফলে মূল গ্রন্থে মিশে আছে কিছুটা অনুবাদ এবং অনুবাদ-গ্রন্থে পেয়ে গেলাম সেই অনুবাদের মূল লিখন। দুটি বই হয়ে উঠল পরস্পরের পরিপূরক।

অনুবাদ সম্পর্কে স্বয়ং ক্লিনটন সিলি-র অনুমোদনের কথা আমরা জেনেছি। সত্যিই চমৎকার অনুবাদ হয়েছে এবং যতদূর সম্ভব যথাযথ। মূল গ্রন্থের উৎসর্গ-লিপিরও অনুবাদ আছে। সেটি দুটি ভাষাতেই তুলে দিচ্ছি —

মূল —
To Gwendolyn Layne,
who, though she neither speaks nor reads Bengali,
understands Jibanananda's poetry
as well as anyone I have met,
Bengali or no.

বঙ্গানুবাদ —

উৎসর্গ

গুয়েণ্ডলিন লেন-কে,
তিনি না বলেন বাংলা, না পড়েন বাংলা,
কিন্তু বাঙালি বা অবাঙালি যাঁদের সঙ্গেই আমি মিশেছি,
তাঁরা যত ভালো করে জীবনানন্দের কবিতা বোঝেন, তেমন করে
বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে ভালো করে বুঝতে পারেন তিনি।

আমার ভাষায় এই অনুবাদ হত এরকম—

গুয়েণ্ডলিন লেইন-কে,
যিনি, যদিও বাংলা বলেনও না পড়েনও না,
বোঝেন জীবনানন্দের কবিতা
যে-কোনো ব্যক্তির মতোই ভালোভাবে, যাঁদের সঙ্গে আমি মিশেছি,
বাঙালি হলেও অথবা না হলেও।

'কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে ভালো করে' অংশটি ফারুক মঈনউদ্দীন-এর সংযোজন। সিলি-র মূল লিখনটিতে এই অতিশয়োক্তির প্রশ্রয় নেই। আমার অনুবাদে আমি একটি 'কমা' যোগ করেছি চতুর্থ ছত্রে বাংলা ভাষার প্রকৃতি অনুসারে। তবে গুয়েণ্ডলিন যে মহিলা তা বাংলা অনুবাদে বোঝানো যায়নি। ব্যাকরণের বাধায়। তাই আমার মতে দ্বিতীয় পঙক্তিটি হওয়া উচিত—'যদিও সেই মহিলা বাংলা বলেনও না পড়েনও না'। অনুবাদ-গ্রন্থের সম্পূর্ণ শিরোনাম হল--"অনন্য জীবনানন্দ জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী"-- ইংরেজি শিরোনামটির মতোই। তবে ইংরেজি শিরোনামে উল্লিখিত আছে বন্ধনীভুক্ত '(1899-1954)'। এই বন্ধনীটি বাংলা অনুবাদে বর্জিত।

দু-একটি শব্দে যদি সামান্য প্রশ্ন জেগেও থাকে, বোধ হয় পৃথিবীর এমন কোনও অনুবাদ নেই যার সম্পর্কে তেমন প্রশ্ন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকবে। খুব ছোট্ট একটি দৃষ্টান্তও তুলে ধরছি। জীবনানন্দের 'ভিখিরি' কবিতাটির ('একটি পয়সা আমি ...') সম্পূর্ণ অনুবাদ তুলে দিয়ে ক্লিনটন সিলি মূল গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—"This poignant little poem shows Jibanananda, the humanist, at his best. He sees the beggar, hand outstretched, craning to gain recognition. Whereas he fantasized Banalata Sen, now he sees an actual human being."

এই অংশের অনুবাদে ফারুক মঈনউদ্দীন লিখেছেন —"এই মর্মভেদী ছোট কবিতাটা দিয়ে মানবতাবাদী জীবনানন্দকে সবচেয়ে ভালভাবে দেখা যায়। তিনি ভিখারিদের দেখেন বাড়িয়ে দেওয়া হাত, চোখে পড়ার জন্য গলা লম্বা করে দিচ্ছে। অথচ তিনি কল্পনা করেছিলেন বনলতা সেনকে, আর এখন দেখছেন সত্যিকারের মানুষ।"

'হোয়্যারঅ্যাজ' শব্দটির বাংলা হিসেবে 'অথচ' অনেকক্ষেত্রেই যথাযথ হতে পারে। কিন্তু এই বাক্যটিতে হয়তো অন্য শব্দই প্রকৃত ব্যঞ্জনাটুকু বার করে আনতে পারত। যেমন--"যেখানে বনলতা সেনকে তিনি কল্পনা করেছিলেন, এখন তিনি দেখছেন সত্যিকারের মানুষ" এমন দু-চারটি প্রশ্ন এখানে ওখানে জাগে এবং তার ফলে পাঠকের পাঠক্রিয়াও হয়ে ওঠে সতর্ক ও পরিশ্রমী। এমন সর্বতোসার্থক অনুবাদ-গ্রন্থ খুব বেশি চোখে পড়ে না।

পরবাস, জুন, ২০১৩