একটা হলুদ পাতা অল্প হাওয়ায় এদিক ওদিক হয়ে মাটিতে পড়ল। দূরে বেলা চারটের আজান পড়াও শেষ; মাঠ থেকে ছেলেদের হুল্লোড়ের অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে। আর একটা পাতা পড়ল, এবারেরটা খয়েরী, ওটার পর একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ এল। একটা ডিজেল এঞ্জিন বেরিয়ে গেল খড়গপুর ষ্টেশন থেকে, উত্তুরে হাওয়া তার শব্দ বয়ে আনল।
হাল্কা, খুউব হাল্কা পাখিদের ডাকে চারদিক ভরা। ঠিক বলা যাচ্ছে না কোনটা কার, বাসায় ফেরার তাড়া আছে তো ওদের। কারো ঘরে কাঠের কাজ চলছে, ঠক ঠক, ঠক ঠক, — হাতুড়ি পেরেক ঠুকছে; বেলা বেরিয়ে গেল সর সর শব্দের সাথে। এত শব্দ — তবু কিছু ছুঁয়ে যাচ্ছে না মন, অথচ সব যেন ঘিরে রয়েছে।
মানুষটা, (এখন অবশ্য মানুষ না বলে দেহ বলাই ঠিক হবে), দেহটা গত রাত থেকে হসপিটালের কোল্ড রুমে রয়েছে, সেই যখন (বোধহয় আটটা নাগাদ) মানুষটা দেহ হয়ে গিয়েছিল, খবর দেওয়া হয়েছে — ওরা বেড়াতে গেছে, ফিরেছে অবশ্যই। কিন্ত রাত আটটায় আবার কি আসবে কলকাতা থেকে খড়গপুর? ওদের গাড়ি আছে — তা থাক — বেড়ানোর পর একটা ক্লান্তি লাগে তো। পাশের মানুষটা তাই কোল্ড রুমে (এতদিন তো একে অন্যের পাশেই ছিল। পাশে থাকাটা যেন অভ্যাসই হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মনেই হত না পাশে আছে)। কেমন যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে ও। যে যা বলছে মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে যাচ্ছে। সেই তারা সকালে আসবে, তা অব্দি দাহ স্থগিত, বেশ তাই সই, কিছু মনে হচ্ছে না, সব যেন জল হয়ে গলে যাচ্ছে, না হয় থেমে গেছে। সকালে এক কাপ চা পেয়েছে; খাবার, জল সবেরই জোগান আছে, কে বা কারা করছে জানতে ইচ্ছে হয়নি। ওই ওরা এল বোধহয়, খানিকটা কান্না, তার সাথে তাল রেখে নিজের চোখও ভিজে উঠল। কোনো প্রশ্ন নেই, কেন এই একবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা থেকে খড়গপুর আসতে এক রাত লাগে, কেন হসপিটালে ভরতির খবর যেতেও শেষ দেখা হল না। কাব্য করার সময় কি আজ? তবু জ্যাক্সের সিনিসিজম মনে এসে গেলঃ
“Tis right,”---“Thus misery doth partবেশ কিছুদিন একসাথে থাকা তারপর তো যাওয়া — খানিকটা তৈরি থাকা, তবু যেন পুরনো অভ্যাসগুলো হঠাৎ না থাকায় কেমন যেন একটা নিথর ভাব। নিজের সেই খিটখিটে ভাবটা নেই, সারাদিনে নিয়ম করে সবার ওপর চোখ রাখা নেই, ক্লান্তি — তাই-ই নেই।
The flux of company”—
“Sweep on, you fat and greasy citizens;
“Tis just the fashion:—"
ওরা এসেছিল। রিমা সুরঞ্জন — বাচ্ছাদের আনেনি। তা ভালই করেছে। একবেলার খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম — তাই বা কেন? আর ওসবে চোখ কান দেওয়াই বা কেন। তাও তো শুনে ফেলল ও ‘বাবাঃ একপাক রাঁধা টাধা পোষাবে না, মা যেন আবার ওসব ফেঁদে না বসে—’ ওর কানের জন্য কথাগুলো ছিল না, তাই যেন শোনে নি, এমন ভাব করে ও রিমাকে বলেছিল ‘তোর বাবি ওসব পছন্দ করত না, তোদের কোনো কষ্ট তার সইবে না, যেমন দিন চলে তেমনি চালাস।’ রিমা খানিক ‘কেন মা কেন মা’ করে ইতি টানলে ‘বেশ তুমি যখন বলছ।’ রিমাকে মানা করে কেন যে ছবিটা ভেসে উঠল---এ জি ক্রনিনের বই হাতে বাপ মেয়ের চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকা।
ওরা অবশ্য বলেছিল এদিককার পাট মিটিয়ে ওদের রাজারহাটের ফ্ল্যাটে চলে আসতে। ধন্যবাদ জানায়নি, ভেবে দেখবে বলেছে ও। অতটা সিভিল হলে ওরা যে দুঃখ পাবে।
বেলা পড়ে এসেছিল। সরস্বতী পুজোর না কড়া না মিঠে রোদের দিকে তাকিয়ে ও ভাবছিল বিল্টুটা তো রয়েইছে। ও তো কেবল ড্রাইভারই নয়, এ পর্যন্ত ও রিমাকে খবর দেওয়া থেকে সবই করেছে। নীচের ঘরে স্বপাক রাঁধবে বলছিল, তা ও বলেছে বিল্টু যেন ওর সাথেই নিয়ম মানে। তারপর একটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট খুঁজে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া। এত ভাবনা কিসের? হলুদ পাতার মত ঝরে পড়া বই তো নয়।
(এই সংখ্যায় নিবেদিতা দত্ত-র আরো একটি গল্পঃ 'ইউনিফর্ম')
(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)