 Wild Swans: Three Daughters of China--Jung Chang; Harper Collins, 1991, Pgs. 530; ISBN: 9780007463404
Wild Swans: Three Daughters of China--Jung Chang; Harper Collins, 1991, Pgs. 530; ISBN: 9780007463404
পনেরো বছর বয়সে আমার দিদিমাকে এক স্বাধীন ক্ষমতাবান সেনাপতি রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ করেন।
এইভাবে শুরু হয় ইয়ং চ্যাংয়ের এপিক আত্মজীবনী ওয়াইল্ড সোয়ান, যে-বইটি চীনে নিষিদ্ধ। দিদিমা, মা ও নিজের জীবন, তার সঙ্গে চীনের প্রায় একশো বছরের ইতিহাসের আশ্চর্য পালাবদল, মানুষের সংকট, ক্ষমতা, লোভ, সবশেষে মানুষের শক্তিরই জয়গান পড়তে পড়তে এক মুহূর্তের জন্যও অন্যমনস্ক হওয়া যায় না।
১৯১১ সালে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর চীনের সম্পূর্ণ অরাজক সময়ে লেখিকার দিদিমার কাহিনী দিয়ে বইটি শুরু হয়েছে। তখনকার মেয়েদের করুণ অবস্থার কথা প্রতিটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। তবু ইয়ং চ্যাংয়ের দিদিমা নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে করেছেন কারণ তার একটা নাম ছিল ইউ ফ্যান। তার আগের প্রজন্ম পর্যন্ত চীনে মেয়েদের নামে দেওয়া হত না। এক নম্বর দুই নম্বর করেই কাজ চালানো হত — এতই হেলাফেলার বস্তু ছিল তারা। সে দিক দিয়ে দেখলে ভারতীয় মেয়েদের অবস্থা বোধ হয় সামান্য ভাল ছিল।
দিদিমা ইয়ু ফ্যাং ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। তার ওপর তখনকার চীনের সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনুযায়ী ছোট অথচ প্রায় অক্ষম একজোড়া পায়ের জোরে আরও সুন্দরী বলে বিবেচিত হতেন। কার চাপে জানি না তবে তখনকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এই সুন্দরী হয়ে ওঠা কী ভয়ঙ্কর ছিল তা একটু বলি। একটা কুড়ি ফুট কাপড় দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা বাদ দিয়ে সব কটা আঙ্গুলসুদ্ধ পায়ের পাতা বেঁধে দেওয়া হত। তারপর ভারী পাথর পায়ের পাতার ওপর চাপিয়ে সমস্ত হাড় গুঁড়িয়ে ভেঙে দেওয়া হত। সেই অবস্থায় পা বেঁধে রাখা হত দিনের পর দিন যাতে পায়ের তলা একেবারে সমতল হয়ে যায়। মেয়েরা যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেলেও রেহাই মিলত না। তারপর সারা জীবনের জন্য অসহ্য পায়ের ব্যথা সঙ্গী হয়ে থাকত।
ন-বছর যন্ত্রণাময় জীবন কাটাবার পর দিদিমা রক্ষিতার জীবন থেকে মুক্তি পান। কন্যাসহ তাঁর বিয়ে হয় কয়েকটি সন্তানের পিতা বিখ্যাত ভেষজ চিকিৎসক ডাক্তার জিয়ার সঙ্গে। নিজের মেয়ে দে হংয়ের বয়স তখন চার। এই পর্বে হান চাইনিজদের ট্র্যাডিশনাল বিয়ের অপূর্ব বর্ণনা দেখতে পাই। এছাড়া ভেষজ ব্যবহার করে চীনের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। দে হং চীনের ওপর জাপানের দমননীতি দেখতে দেখতে বড় হলো। ১৯৩৮ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্থানের মধ্যে দিয়ে সে ক্রমশ কম্যুনিজমের দিকে দিকে আকৃষ্ট হল।
কুয়োমিনটাং ও কম্যুনিস্টদের যৌথ চেষ্টায় জাপানীদের তাড়ানো হলো। কিন্তু এবার এই দু'দলের মধ্যেই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এই পরিবারটির মধ্যেও নানা বদল ঘটতে লাগল। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে কম্যুনিজ্ম্কায়েম হল চীনে। দে হং তখন ছাত্রদলের উঠতি একজন নেত্রী। তেজস্বিনী দে হংয়ের বিয়ে হল আর এক কম্যুনিস্ট নেতা শউ ইয়ুর সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক ১৯৪৯ সালেই।
সেই সময় চীনের অভ্যন্তরীণ ঘটনার বিন্দুবিসর্গ যাতে বাইরের পৃথিবী জানতে না পারে তার জন্য কমিউনিস্ট চীনে কঠোর সতর্কতা ছিল। যতটুকু তারা চায় ততটুকুই জানত বাইরের দুনিয়া। অবশ্য এখনও সেই মনোভাব কিছুটা রয়ে গিয়েছে। সেই জন্য গুগলের মত কোম্পানিকে ব্যবসা গোটাতে হয় চীন থেকে। আশ্চর্য হয়ে দেখি যে-সাম্যের বাণীর ওপর কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠিত তা কি হাস্যকর ভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে পয়েন্ট সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে। ১১ পয়েন্টওলা স্বামী গাড়িতে, ১৭ পয়েন্টওলা স্ত্রী অসুস্থ সন্তানসম্ভবা হলেও লটবহর কাঁধে পায়ে হেঁটে দলের সঙ্গে। রেলের কামরায় স্বামী গদি আঁটা চেয়ারে। স্ত্রী কাঠের বেঞ্চিতে। মা বাবা অন্য সাধারণ কামরায়। বাচ্চারা ধাইমার সঙ্গে অন্য আরেকটায়। পরিবার ও ব্যক্তিগত অনুভূতির কোনো জায়গা নেই। দলের মধ্যে যার যেমন স্থান তাদের সব নাগরিক সুবিধে পয়েন্ট দিয়ে ভাগ করা।
কুয়োমিন্টাং আমলের দুর্নীতির প্রতিবাদে শউ ইয়ু এত কঠোরভাবে কম্যুনিজমের আদর্শ মেনে চলতেন বলে সাধারণ লোক গভীর শ্রদ্ধা করলেও স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমদিকে খুবই ভুল বোঝাবুঝি হত। দলের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ভক্তি থাকলেও দে হং আবার ব্যক্তিগত অনুভূতিকে উপেক্ষা করতে চাইত না; তাতে যদি একটু অনিয়ম ঘটে তো ঘটুক । এই নিয়েই ছিল বিরোধ। সত্যি শউ ইয়ুর এক একটি আচরণ স্ত্রী হিসেবে দে হং য়ের পক্ষেও মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল।
গর্ভবতী দে হং-এর জন্য তার মাকে পুষ্টিকর খাদ্য না করতে দিয়ে কমিউনিটি কিচেনের সাধারণ খাবার খেতে বাধ্য করা, গর্ভপাতের মত দুর্ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও গাড়ীর ব্যবস্থা না করা — এমন আরও অজস্র। দল এবং নীতি সবথেকে বেশি মূল্য পাচ্ছে কিনা এটাই বিবেচ্য ছিল তার কাছে। পরে অবশ্য দুজনেই দুজনের প্রতি গভীর প্রেমে মগ্ন ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝাতেও তা অটুট ছিল।
১৯৫২ সালে লেখিকা ইয়ু চ্যাংয়ের জন্মের সঙ্গে তার বাবা ও মা দলের মধ্যে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সময়টি ছিল এই পরিবারের সবথেকে সুখের সময়। এরপরই প্রতিবিপ্লবী সন্দেহে দে হং-কে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় থেকেই কম্যুনিজমের ব্যাখ্যা হতে লাগল মাওর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। প্রতিবিপ্লবী ও দক্ষিণপন্থী সন্দেহে নির্বিচারে গ্রেফতার ও অত্যাচার চলতে লাগল। আর তার সঙ্গে শুরু হলো মাওর অদ্ভুত সব ধারণার বাস্তব রূপ দান। তার মধ্যে একটি হল — গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড। স্টীল তৈরির কাজে আবালবৃদ্ধবনিতাকে উদ্বুদ্ধ করা। চাষীরা কৃষিকাজ থামিয়ে স্টীল উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফলে ১৯৬১ সালে চীনে সাঙ্ঘাতিক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। অথচ এর বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশের পরিণাম মৃত্যু।
আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় এই জাতিটির কষ্টসহিষ্ণুতা আর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিঁকে থাকার অসীম ক্ষমতা দেখে।
এই দুর্ভিক্ষের সময় অনাহার অপুষ্টিতে শরীরে জল জমে ইডিমাতে আক্রান্ত হত সবাই। এর দাওয়াই হিসেবে তারা তাদের প্রাচীন ভেষজের ব্যবহার করত যা খুবই অদ্ভুত। টবের মধ্যে এক জাতীয় বীজ নিজেরাই চাষ করত যার প্রাণরস ছিল সাধারণ জল নয়, মূত্র। সেই ভেষজ নাকি হত প্রোটিনে ভরপুর ও রক্ষা করতে সক্ষম অপুষ্টি ও ইডিমার হাত থেকে।
এত সব সত্ত্বেও মাও-পূজা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে বিরাট আকার ধারণ করল। আর এই দুর্ভিক্ষের মধ্যেই ইয়ু চ্যাংয়ের কনিষ্ঠতম ভাই জন্মগ্রহণ করল।
ডাক্তার জিয়ার মৃত্যুর পর এদের সঙ্গেই থাকেন দিদিমা ইয়ু ফ্যাং। পাঁচ ভাই বোন মা বাবা দিদিমাকে নিয়ে আটজনের এই পরিবারটি ১৯৬৬ সালে কালচারাল রেভোলিউশন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলো। মা কুয়োমিন্টাং জেনারেলের রক্ষিতা ছিল — সেই সূত্র ধরে দে হং-কে আগেই ডিটেইন করা হয়েছিল। এবার তীর ঘুরল শউ ইউর দিকে। কমিউনিস্ট চীনে ডিটেনশন পর্বটা এক বীভৎস ব্যাপার। ভাঙ্গা কাঁচের উপর হাঁটু মুড়ে বসে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অন্যান্য অত্যাচারের তুলনায় ছিল জলভাত। মাথা কামিয়ে ট্রাকে করে ঘোরানো, মারধর, এমনকী বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে হত্যা পর্যন্ত করা হত নির্বিচারে। মাও বলেছেন, যে যত পড়ে সে তত মূর্খ। সেইজন্য স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেল একে একে। গাছ, ফুল, ঘাস বুর্জোয়া সভ্যতার প্রতীক — তাই ধ্বংস করা হল নির্মমভাবে। চড়াই পাখি মাওয়ের পছন্দ নয় তাই এই নিরীহ পাখিটা বেঁচে থাকার অধিকার হারাল। বাড়ি বাড়ি ঢুকে বই বাজেয়াপ্ত করে আগুনে পোড়ানো শুরু হল। সমস্ত চীনে কার্ল মার্কস আর মাও-এর লেখা ছাড়া ছাপার অক্ষর বলে প্রকাশ্যে আর কিছু রইল না। বংশানুক্রমে সঞ্চিত জিনিস ভাঙ্গা আর লুঠ চলল অবাধে, কারণ মাও-এর একটি স্লোগান ছিল — প্রথমে ধ্বংস করো, তারপর নিজে নিজেই সৃষ্টি হবে। সব দেশের মত সাধারণ মানুষ স্লোগান মাহাত্ম্যে চমকে যেত। স্লোগান শুনতে শুনতে আওড়াতে আওড়াতে সেটাই বিশ্বাস করে ফেলত অন্ধভাবে। দুর্ভিক্ষের সময় একটা স্লোগান ছিল — নিপুণ গৃহকর্ত্রী উপকরণ ছাড়াই খাদ্য প্রস্তুত করতে পারেন।
তালিবানি কায়দায় অনেক প্রাচীন স্থাপত্যও ভাঙ্গা হয়েছিল এই সময়ে। কপালজোরে রক্ষা পেল ফরবিড্ন্সিটি।
বিপ্লবের প্রধান দর্শন মুড়ি মিছরি এক দর, তাই ডাক্তার শিক্ষক এঞ্জিনীয়ার সবাইকে ধরে কলকারখানা ও চাষের কাজে লাগানো হল।
এই ডামাডোলে দিদিমা ইয়ু ফ্যাং কিন্তু অসাধারণ মানসিক শক্তি ও স্থৈর্যের পরিচয় দেন। সামান্য উপকরণে পরিবারের সকলের খাদ্যের জোগান ও অত্যাচারিত লাঞ্ছিত মেয়ে জামাই ডিটেনশন শেষে বাড়ি ফিরলে তাদের শুশ্রূষা করা, নাতি-নাতনিদের বুক দিয়ে আগলে রাখা সবই ছিল। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন প্রায় অক্ষম ওই পা দুটি নিয়ে। এই সময় থেকেই আস্তে আস্তে কট্টর কম্যুনিস্ট জামাইয়ের বুর্জোয়া শাশুড়ির উপর যে বিদ্বেষ ছিল তা আস্তে আস্তে দূর হতে থাকে। বইটিতে সাদা কালো পুরনো অস্পষ্ট ছবির মধ্যে থেকেও দিদিমার জ্যোতির্ময় মুখখানা দেখে বোঝা যায় তিনি কত অসাধারণ ছিলেন।
এতকিছু সত্ত্বেও কিন্তু মাও ভক্তি অটুট। ১৯৬৬ সালে চোদ্দ বছর বয়সে লেখিকা ইয়ং চ্যাং মাও-এর রেডগার্ড আর্মিতে নাম লেখাল। সারা দেশজুড়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়া বেকার কিশোর-কিশোরীর দল বিপ্লবের মদে মাতাল — মনে একমাত্র দেবতা মাও সে তুং। এদের মগজ ধোলাই হত সারাক্ষণ। বলা হত স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানে। বাইরের ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়ায় মানুষ পশুর জীবনযাপন করে।
অনেক পরে ইয়ং চ্যাং নিজেকে প্রশ্ন করেছিল — এই যদি স্বর্গ হয় নরক তবে কী? বইটিতে আগাগোড়া লেখিকা জীবনকে দেখার সরস ভঙ্গিটি বজায় রেখেছেন। আদর্শ ও নীতির পেছনে যে ভণ্ডামি থাকে তাকে বারবার নিরীহ অথচ অমোঘ প্রশ্ন করেছেন শিশুর সারল্যে। শউ ইয়ু চারপাশের অরাজকতা ও দুর্নীতি দেখে স্বয়ং মাওকে একখানা চিঠি লেখেন। এই জন্য তাকে গ্রেফতার করা হল। শারীরিক অত্যাচারের সঙ্গে ভয়ঙ্কর মানসিক পীড়ন করে তাকে বোঝানো হল প্রিয়তমা স্ত্রীই তার সব থেকে বড় শত্রু। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্দেশ ছিল তার চিকিৎসা না করার । মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় শউ ইয়ু একদিন রাতে স্ত্রীর কানে এমন মারলেন যে সারা জীবনের জন্য দে হংয়ের একটি কান বধির হয়ে গেল। এরপর ছয় সাত বছর ধরে লাগাতার পীড়ন ও লাঞ্ছনার কাহিনী। এই সময়ে সমস্ত দেশ যেন হাসতে ভুলে গিয়েছিল। সামান্য কথার পরিণাম ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে এই আতঙ্ক পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকত। পরস্পরকে সন্দেহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো অর্থহীন হয়ে গেল। প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই কেউ না কেউ ডিটেনশনে চলে যায় যখন-তখন। স্বামী-স্ত্রীকে, ভাই ভাইকে, পাড়া-প্রতিবেশী কেউ কারওকে বিশ্বাস করে না। শিশুরা ধাই-মার দুধ খেয়ে বড় হয়। একসঙ্গে কমিউনিটি কিচেনে খাওয়া। ব্যক্তিগত অনুভব, অনুভূতির রেশ যেন কোথাও না থাকে সেটাই মানা হত কঠিন ভাবে। এমনকি দম্পতিরা পর্যন্ত একসঙ্গে থাকার জন্য বছরে মাত্র কয়েকদিনের ম্যারেজ লীভ পেত। নারীর প্রেম কমনীয়তা সৌন্দর্য কিছুতেই যাতে ফুটে না ওঠে তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চলেছিল। সেইজন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে ছাই বা নীল রঙয়ের ঢোলা পোষাক আর ছাঁটা চুল, এই ছিল সারাদেশের ইউনিফর্ম।
যারা প্রফেশনালি এক্সপার্ট তারা পলিটিক্যালি নট কারেক্ট — মাওর আর একটি বিখ্যাত স্লোগান। দিশেহারা হয়ে সবাই সবকিছু ছেড়ে দল ভজনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দলীয় মিটিং-এর থেকে নিজের পরিবারকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার জন্য অন্যদের চোখে দে হং ছোট হয়ে গিয়েছিলেন। নিজেদের এই ‘নট ক্লীন’ বা ‘সন্দেহজনক’ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য দে হং পিকিং গিয়ে সরাসরি চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তার আর্জি জানায়। সম্ভবত সেই কারণে শউ ইয়ু মাও-এর সমালোচনা করে ‘আই উইল নট সেল মাই সোল’ বলা সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে রইলেন। তবে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বহু দূরে হিমালয়ের কোলে রুক্ষ অনুর্বর মিয়ি ক্যাম্পে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হত। তারা জীবনে হাল লাঙ্গল চোখে দেখেছে কিনা সে প্রশ্ন ছিল অবান্তর। যাবার আগে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাননি শউ ইয়ু। সকাল থেকে স্ত্রীর ডিটেনশন ক্যাম্পের বাইরে দাঁড়িয়ে দুজনের নীরব চোখাচোখি হবার মুহূর্তটা পড়তে গিয়ে চোখ ভিজে যায়।
আশ্চর্য হয়ে যাই এই পরিবারের প্রতিটা মানুষের পরস্পরের জন্য ভালবাসা দেখলে। একে অন্যের পাশে এই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল বলেই শেষ পর্যন্ত কঠিন যুদ্ধে জয়ী হয়ে পরবর্তী জীবনে তারা সাফল্যের মুখ দেখেছে।
প্রায় পনেরো মিলিয়ন মানুষকে চাষবাস আর কলকারখানায় কাজ করার জন্য শহর থেকে উৎখাত করে বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে যে কী কঠিন জীবন পড়তে গিয়ে মনে হল তার পরেও এই জাতটি বেঁচে রইল কেমন করে? পনেরো ষোল ঘন্টা ধরে মাঠে ধান রোয়ার কাজ, খাবার জল সংগ্রহ, প্রাকৃতিক কর্ম করা… সমস্তই ছিল এক কঠিন লড়াই।
মাত্র ষাট বছর বয়সে চিকিৎসার অভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা গেলেন দিদিমা ইয়ু ফ্যাং। এই অসাধারণ মহিলার নীরব আত্মত্যাগের জীবন পাঠকের মনে এক অবর্নণীয় অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। ইনি একজন লোভী বাবার কন্যা, একজন সেনাপতির রক্ষিতা, একটি বিরাট পরিবারের সৎমা, দুজন কম্যুনিস্ট নেতার মা ও শাশুড়ি — বৈভব, জাপানী আগ্রাসন, গৃহযুদ্ধ, দারিদ্র্য, দমননীতি প্রতিটা অবস্থাই গ্রহণ করেছেন শান্তভাবে। প্রাণাধিক নাতি নাতনী ও কন্যার দিকে তাকিয়ে সমাজের বিপুল পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদের দুর্দশা ও বন্দীদশায় মেয়ের ওপর শারীরিক মানসিক অত্যাচার, সর্বোপরি মরণাপন্ন অবস্থাতেও কোনো রকম চিকিৎসা না পাওয়া তাঁকে অকালে শেষ করে দিল।
লেখিকার মতো আমাদের মনেও প্রশ্ন জাগে যেখানে মানবিকতার এত লাঞ্ছনা এত পীড়ন সেই বিপ্লবের মানে কী?
লাল ফিতের ফাঁস আর প্রটোকলের জেরে প্রতিটা পরিবারই ছত্রখান। বিশাল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কমিউন। বিভিন্ন কমিউনের বাসিন্দাদের এক পরিবারভুক্ত হলেও পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সহজ ছিল না। একই কমিউনের কাগজ না থাকলে একসঙ্গে থাকা অপরাধ বলে গণ্য হত। তবে সব দেশ সব কালের মত আইনের সঙ্গে আইনের ফাঁকও ছিল। সামান্য আড়াল রচনা করে ব্যক্তি ও সময় বিশেষে সবই হত যা হওয়া উচিত ছিল না তখনকার চীনে।
সেইসময় দেশের ভেতরে দূর দূরান্তের পরিবহন বলতে মালবাহী ট্রাক। ইয়ং চ্যাং পরিহাস করে বলেছে — যে ট্রাকে মাও-এর মূর্তি বানানোর পাথর আসত সেগুলোতে আমাদের লিফট দেওয়া হত না। ওগুলো এত ‘পবিত্র' ছিল। কাগজ বলতে পিপলস ডেইলি। সেই কাগজ পুরনো হলেও অন্য কাজে ব্যবহার হত না। কারও পেতে বসার পর্যন্ত সাহস ছিল না কারণ তার সর্বত্র মাওয়ের ছবি মাওয়ের বাণী।
হাতে কলমে কাজ শেখা বাধ্যতামূলক তাই ইয়ং চ্যাং এবার চাষী থেকে বেয়ারফুট ডাক্তার হয়ে কিছুদিন কাটাল। তারপর শুরু হল স্টীল ওয়ার্কার আর ইলেকট্রিশিয়ানের জীবন। সবগুলোই ট্রেনিং ছাড়া। কিন্তু পরে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ইউনিভার্সিটিতে ঢোকবার জন্য যখন জোর ঠেলাঠেলি চলছে তখন একদা- চাষী আর শ্রমিক ছিল এই যোগ্যতার জোরেই সে সুযোগ পায়।
১৯৭২ সালে বিপ্লবের ধামাকা একটু নরম হল। দেং জিয়াও পিং ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফরে এলেন। বিপ্লব শেষে ডানাভাঙ্গা পাখিরা ঘরে ফেরবার অনুমতি পেল। শউ ইয়ুয়ের স্বাস্থ্য এত ভেঙ্গে গিয়েছিল যে ক্যাম্প থেকে ফিরে মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন। কালচারাল রেভোলিউশনের আগে পরে মাত্র ছয় বছরের তফাতে শউ ইয়ুর ছবি দেখে বোঝা যায় এই বিপ্লব তাকে কী পরিমাণে বিধ্বস্ত করেছে। এই রকম মানুষেই তখন হাসপাতালগুলো ভর্তি ছিল।
দে হং স্বামীর মৃত্যুতে চোখের জল ফেলার সময় পেলেন না। অসাধারণ মানসিক শক্তির প্রতিমূর্তি এই মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য শউ ইয়ুকে নির্দোষ বা ‘ক্লীন’ প্রমাণ করা কত জরুরী। ওপর মহলে ধরাধরি করে তিনি সেই ক্লীন সার্টিফিকেট বার করেন যা শউ ইয়ুর শোক সভায় পাঠ করা হয়। এটি না হলে এই পরিবারটির গায়ে ‘ব্ল্যাক’ তকমা লেগেই থাকত।
ইয়ং চ্যাং ইংরেজির ছাত্র ছিল। পড়াশুনো করার জন্য তার প্রাণ আকুলি-বিকুলি করত। সাত বছর সেই জগৎ থেকে দূরে থাকার পর ১৯৭৩এ সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। বিদেশী ভাষা বলা ও শোনা অভ্যাস করার জন্য তাদের বন্দরের নাবিকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হত। বলাবাহুল্য কড়া নজরদারিতে। এইভাবে ইয়ং চ্যাংয়ের বিদেশীদের সঙ্গে প্রথম মোলাকাত হয়। পড়াশোনা শুরু হলেও প্রপাগান্ডায় ভর্তি থাকত পাঠ্য বই। ‘লং লিভ মাও’ কথাটা ব্যাকরণগত ভাবে ভুল বলায় মার খেয়েছিলেন এক অধ্যাপক। মাওয়ের প্রধান সহযোগী ম্যাডাম মাও শিক্ষাজগতটিকে নয়ছয় করতে বিশেষ পছন্দ করতেন। এতে চাষবাস কলকারখানার ক্ষতি হত না। ফলে জীবনধারণের সাধারণ শর্তগুলি পূর্ণ হবার অসুবিধে ছিল না অথচ শিক্ষিত সম্প্রদায়কে হয় দমিয়ে নয় হাতে রাখা যেত। ১৯৭৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর মাও সে তুং-য়ের মৃত্যুর পর ম্যাডাম মাও সহ কুখ্যাত গ্যাং অফ ফোরের গ্রেফতারের সঙ্গে শুরু হল দেং জিয়াও পিং এর নেতৃত্বে নতুন জমানার কম্যুনিস্ট আমল। বাইরের দুনিয়ার হাওয়া বইতে লাগল এই নতুন চীনে। তার ফলে ১৯৭৮ সালে ইয়ং চ্যাং লন্ডনে পড়তে যাবার জন্য স্কলারশিপ পায় । এতদিন যে ধরনের পোশাক তারা পরত তা বাইরের দুনিয়ায় অচল। আধুনিক দুনিয়ার উপযোগী পোশাক কেনার জন্য তাদের আলাদা করে টাকা দেওয়া হয়। সে-ই প্রথম চিনা মহিলা যে ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ ডি করেছে। চীনের প্রায় একশো বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস তার সঙ্গে নিজেদের পরিবারের চলনটি সে এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে ধরেছে যে বইয়ের প্রতিটি পংক্তিই মনোযোগ কেড়ে নিতে বাধ্য করে। এই একশো বছরের রাজনৈতিক সামাজিক জীবনের যে ছবি সে এঁকেছে তা এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা দুঃসাধ্য। নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কাহিনী বয়ে গিয়েছে শান্ত নদীটির মত।
দশ বছর পরে এই বইটি লেখার সময়ে অক্সফোর্ড থেকে এসে চীনের সর্বত্র ঘুরে বেড়াবার সময় সে বিপুল পরিবর্তন লক্ষ করে। বিদেশী মূলধন কম্যুনিস্ট চীনের অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার এনেছে। ব্যবসায়ীরা সমাজের মাথা। তাদের সমাদর সর্বত্র। সেইসময় একদিন দে হং দেখল এক বিশাল হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে রাজকীয় খানাপিনা শেষে এক মহামান্য রাজঅতিথি সবাইকে তার বিলাসবহুল অট্টালিকা গাড়ি ইত্যাদির ছবি দেখিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে। দে হং চিনতে পারল — এই লোকটিই চল্লিশ বছর আগে কম্যুনিস্টদের শত্রু ছিল আর কম্যুনিস্ট হবার অপরাধে গ্রেফতার করেছিল দে হংকে।
এই পঙ্ক্তিটি দিয়েই মহাকাব্যের বিশালতা গভীরতায় রচিত বইটি শেষ হয়।
(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)