অগ্নিসূত্র; —দুলাল ঘোষ; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০০; অক্ষর পাবলিকেশন - আগরতলা; প্রচ্ছদ -- পুষ্পল দেব; ISBN: 81-86802-24-X
‘আর্থসামাজিক প্লবতাকে অনুপুঙ্খ মানবিক ভাবনায় উপস্থাপিত করে যে স্তম্ভ, তা উপন্যাস।’ পুস্তকের প্রথম ফোল্ডারে একেবারে শুরুতেই উল্লেখ আছে এই আপ্তবাক্যটির। কথাগুলো মেনে নিতে খুব একটা অসুবিধা ছিল না যদি আমরা উইলিয়াম বারোজ কিম্বা জাঁ জেনে না পড়তাম। না জানতাম ‘ফিনিগানস ওয়েক’-এর মতো উপন্যাসের কথা। এবারের নোবেল প্রাপক হান্টকেও তেমনই একজন বেপরোয়া গদ্যকার যার রচনা ‘আর্থসামাজিক প্লবতার’ ধার না ধেরে ছুঁচোবাজীর মতো বেহিসাবি উড়তে চায়।
অবশ্য এসবই বিদেশের কথা। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা তথা সাংস্কৃতিক অবস্থান আমাদের থেকে একেবারেই আলাদা। একেবারে চাঁদের এপিঠ ওপিঠ। অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘ফ্রাইডে আইল্যান্ড’ গোত্রের কয়েকটি উপন্যাস বাদ দিলে আমাদের বাংলা উপন্যাসের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ হয়েছে আর্থসামাজিক প্লবতায় সিক্ত মানবিক ভাবনার রসায়নে। হ্যাঁ ঠিকই, প্রথম ফোল্ডারের প্রথম বাক্যটি বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে অমোঘ।
বাংলা উপন্যাস বলার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক বিভাজন। প্রশ্ন ওঠে কোন বাংলা — পশ্চিমবাংলা না বাংলাদেশ? না কি ত্রিপুরা? এই তিন জায়গাতেই বাঙালির অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রকোষ্ঠে। রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে তিন বাঙালি সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। ভাষাগত গঠনশৈলি ও সিনট্যাক্সের দিক থেকেও তিন জায়গার বাংলা ভাষার পাকদণ্ডী তিন রকমের। এখানে আমরা কিন্তু প্রমিত বাংলা নিয়েই নাড়াচাড়া করতে চাইছি। হাটবাজারের ভাষা তো প্রতি দশ কিলোমিটার অন্তর পাল্টে যায়, সে কথা আলাদা।
উপন্যাস যেহেতু মুখ্যত প্রমিত বাংলা নির্ভর তাই বাঙালি ঘনত্বের এই তিন জায়গায় উপন্যাসের চলন আলাদা। আর আমরা জানি যে চলন আলাদা হলে গঠনও আলাদা হয়ে যায়। সে হিসেবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে যে উপন্যাস তার সঙ্গে পশ্চিমবাংলার উপন্যাস যমজ হলেও দুটির ডিএনএ ভিন্ন। ত্রিপুরার বাংলা উপন্যাসের হাবভাবও একইভাবে অন্যরকম। অবশ্য আলোচনার এই পরিসর থেকে বাজার চলতি উপন্যাসগুলিকে সসম্মানে সরিয়ে রাখা হচ্ছে কারণ বাজারের বোলচাল সারা পৃথিবীতেই একইরকম।
পশ্চিমবাংলার উপন্যাস বেশ সংযত এবং মধ্যবিত্তপনায় আচ্ছন্ন। অন্যরা তুলনায় একটু হাটুরে ও সাবঅলটার্ন সংস্কৃতির নিকটবর্তী। আসলে পশ্চিমবাংলার এই ভিন্নতা আদতে ছিল না। বটতলার সাহিত্য থেকে হুতোম-টেকচাঁদ পর্যন্ত বেশ খাপখোলা লেখালেখি চলছিল। অন্যদিকে জেলেপাড়ার সং থেকে রূপচাঁদ পক্ষী বা নিধুবাবুর টপ্পা ঘিরে মোচ্ছবমগ্ন বাঙালিআনা জমেছিল ভালই। হুল্লোড়বাজ বাবু থেকে হাভাতে ছোটলোক সবাই মজেছিল একই রসনায়। হঠাৎ করে কক্ষচ্যুত অ্যাস্ট্রয়েডের মতো তাকে আঘাত করল ব্রাহ্ম জীবনবোধ আর রবীন্দ্রনাথ। এই জোড়াধাক্কায় জড়সড় বৈঠকি কালচার সেঁধিয়ে গেল ফরাসের তলায়। রবীন্দ্রনাথের পর উপন্যাসের আসরে অবতীর্ণ হলেন তিন বাঁড়ুজ্যে। ন্যারেটিভের বন্যায় ভেসে গেল বাংলা উপন্যাস সাহিত্য। বস্তুত এই বাংলায় সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বা নবারুণ ভট্টাচার্যের মত দুএকটি ব্যতিক্রম আছে — যদিও অবশ্য এই দুই লেখককেই জাত ঔপন্যাসিকের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
পূর্ববাংলার সাহিত্য-ধর্ম আবার প্রথম থেকেই বইতে শুরু করেছে অন্য খাতে। এবার সামান্য দু-এক কথায় পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশ পর্ব সেরে নিয়ে মূলত ত্রিপুরার উপন্যাস সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করব আমরা । কারণ ‘অগ্নিসূত্র’-র লেখক দুলাল ঘোষ একজন ঘোরতর ত্রিপুরাবাসী এবং তার উপন্যাসের মূল চরিত্র কোনো ব্যক্তি নয়। এর নায়ক ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী শহর — আগরতলা।
আমরা জানি যে ইতিহাসের চরম প্রহসনে পূর্ববাংলা পরিণত হয় পূর্বপাকিস্তানে। তারপর বাংলাভাষী মানুষের প্রবল প্রতিরোধে পত্তন হয় স্বাধীন বাংলার — জন্ম নেয় বাংলাদেশ। গ্রামীণ সংস্কৃতির জেদি এবং মাটি কামড়ানো অবস্থান ছাড়া তৎকালীন পূর্ববঙ্গজ সাহিত্য ফসলের পুরোটাই ছিল পশ্চিমবাংলা প্রভাবিত। এমনকি বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক শহীদুল্লাহও পড়াশোনা করেছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সুতরাং তাঁর কালি-কলমের মধ্যে যে রবীন্দ্রনাথ এবং পরের প্রজন্মের লিখনশৈলি ও দর্শন মিশে যাবে তা বলা বাহুল্য। বস্তুত উপন্যাস সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত, তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো স্বকীয়তা লক্ষ্য করা যায়নি পদ্মাপারের বাংলায়। পরে কালো ঘোড়ার মতো দাপিয়ে এরিনা কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এপারের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে অনেক দূরে এক বিস্ময়কর ন্যরেটিভের খেলা দেখিয়েছেন তিনি।
ত্রিপুরার মাটি-রস নিংড়ে তৈরি হয়েছে এমন উপন্যাসের সংখ্যা কিন্তু বিশেষ বেশি নয়। প্রমিত বাংলায় লেখার অপারগতা, পশ্চিমবাংলার উপন্যাসের গুরুভার আর ককবরক ভাষার গা-ঠেলাঠেলি অতিক্রম করে বাংলা উপন্যাসের আলাদা মাটি নির্মাণ করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল ত্রিপুরায়। তার মধ্যেই আমরা পেয়েছি কার্তিক লাহিড়ীর মতো বিস্ফোরক ঔপন্যাসিক, পেয়েছি মীনাক্ষী সেন-এর মতো দুরন্ত লেখক। লেখক বাহিনীর এই জয়যাত্রায় নবতম সংযোজন দুলাল ঘোষ।
অবশ্য দুলাল ঘোষকে ঠিক নবতম বলা উচিত হবে না। আলোচ্য ‘অগ্নিসূত্র’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০০ সালের জানুয়ারিতে। ১৭ বছর পরে দ্বিতীয় সংস্করণ। কলকাতার কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় এ-বইয়ের টিকি খুঁজে পাওয়া যেত না এতদিন। এবার মনে হয় উৎসাহী পাঠকগণ একটি অবশ্যপাঠ্য উপন্যাসের তীব্র আঘাত উপলব্ধি করার সুযোগ পাবেন।
দুলাল ঘোষের লিখনশৈলি অনেকটাই বাংলাদেশ সুলভ। প্রমিত বাংলার নড়া ধরে মাঝেমাঝেই তাকে বিপরীত দিকে ঘোরানোর চেষ্টা। আমি এমন গদ্যরূপেই লিখব, তোমাদের বোঝার হলে বোঝ — এমন একটা জামার কলার তোলা ভাব। অনেক আছে উদাহরণ, আপাতত তিনটি উল্লেখ করা যেতে পারে — ‘সেবার এনকোয়ারির সময়ও বুড়াকে তোতা পড়িয়ে দিয়েছিলেন অতসী। লোকটা বড় তাতুভাতু, সন তারিখে সবসময় প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে।’ (পৃ ৩২) বা ‘মাছিটা এবার নাক ছেড়ে কানের কাছে ভুতুভুতু করছে। শানিত চোখ বুজেই হাই তুলল চুটিও মারল দুইটা — একটা শব্দ হল। তবু চোখ বুজে থাকল।’ (পৃ ১৩০) ‘বাবাও দুইটা ঢেঁকুর তুলে আবার খাচ্ছে। শানু এক কোণায় কুচিমুচি করে বসা জুঁইয়ের পাশে গিয়ে বসল ক্যাজাকেজি করে। সে একটু আপত্তি করল — এটা কি মা? একেবারে গায়ের ওপর কেন। কিন্তু কিছু করার নেই, এত ছোট পাকাঘর। তাছাড়া বাবা এখনও সেই বাংলাদেশি পিঁড়িতে বসে খায়।’ (পৃ ১০৮) না, শুধু পশ্চিমবাংলার অচেনা এমন শব্দের ব্যবহারই নয় — বাক্য গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যেও একটা উল্টোপ্যাঁচ আছে। একইরকম উল্টোপ্যাঁচের গোলকধাঁধায় ঘোরানো হয় ন্যারেটিভকে। প্লটের চাকা সামনে গিয়ে আবার পেছনে আসে। বাঁয়ে বেকতে গিয়ে ঘুরে যায় ডানে। এই সব কিছু মিলে একটা অভাবনীয় নাটকীয়তা তৈরি হয় কাহিনির চলনে।
উত্তরবাংলার উপন্যাস সাহিত্যের সূত্রে এমন গঠনবিন্যাসের সঙ্গে আমাদের কিছুটা পূর্ব পরিচয় ছিলই। মূলত অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘মহিষকুড়ার উপাখ্যান’ এই বিষয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে। আশ্চর্যজনকভাবে উত্তরবাংলায় জলহাওয়ায় অনেকটা সময় লালিত হওয়ার সূত্রে দেবেশ রায়ের উপন্যাসের মধ্যেও এমন ছোঁয়াচ দেখা যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ত্রিপুরার কার্তিক লাহিড়ীর নাম। বাংলাদেশের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর সেলিনা হোসেনের সঙ্গেও দুলাল ঘোষের আত্মীয়তা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের বাংলা উপন্যাসের সমাবেশে ‘অগ্নিসূত্র’ পুরোপুরি অচেনা না হলেও তার হাবভাব চালচলন অনেকটাই উদ্ধত, উগ্র আর হিপনোটিক। এই ঔদ্ধত্য, এই তীব্রতা আমাদের ভীত করে কিন্তু এক অমোঘ টানে সেই নিউক্লিয়াসের দিকেই ধাবিত হয় আমাদের আকর্ষণ।
জেমস জয়েসের উপন্যাসে যেমন শহর ডাবলিন, এখানে সেইরকম আগরতলা। কোনোদিন যিনি আগরতলা যাননি তিনিও চিনে ফেলবেন এই আধা শহর আধা গ্রামটির সামাজিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটিকে। একটি উপন্যাসের সূত্রে এক অঞ্চলের সামগ্রিক মানচিত্র ফুটিয়ে তোলার দুঃসাধ্য কারুকার্য দারুণ মুনশিয়ানার সঙ্গে সম্পাদন করেছেন দুলাল ঘোষ। লেখকের পরিমিতিবোধ আমাদের সত্যিই অবাক করে। নানান ক্রসকারেন্টের মধ্যে থেকে ঠিক কোনদিকে বাঁক নেবে কাহিনি তা যেন একেবারে কম্পাস নির্ধারিত পথে এগিয়ে গেছে। নিশানা একশোভাগ অব্যর্থ। এতটুকু ভুলচুক হলেই কাহিনির ক্লাইম্যাক্স চূড়া পুরোপুরি ভোঁতা হয়ে যেত।
কাহিনির সিংহভাগ আবর্তনই গড়ে উঠেছে শানিত-কে ঘিরে। শানিত একটি সরকারি চাকরি পেয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক সক্রিয়তার অভিযোগে এমারজেন্সির সময় (১৯৭৬ সাল) তার চাকরিটা চলে যায়। লেখালিখি সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল শানিতের। একটি দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকের চাকরি যোগাড় করতে তার বিশেষ অসুবিধে হয় না। এই সাংবাদিকতার সূত্রেই আগরতলা শহরের সাবঅলটার্ন জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে সে। সীমান্ত শহরের স্মাগলিং চক্র আর তার বীভৎস রৌরবে ক্রমে তলিয়ে যেতে থাকে শানিত। এক পরাক্রমী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়।
এরই মধ্যে এক নিরুচ্চার অন্তঃসলিলা প্রেমের চোরাস্রোতে ঘুরপাক খেতে থাকে শানিত। কাহিনির মধ্যে গাঢ় নিভৃতির সঙ্গে বুনে দেওয়া হয়েছে শানিতের প্রেমপর্ব। ছায়ার মতো শানিত আর লীলার সে কাহিনি লেপটে থাকে মূল কাহিনির গায়ে। কখনোই উৎপাত করে না। বস্তুত এমারজেন্সির সময়কার শীতল সন্ত্রাস বা আগরতলা রাজ পরিবারের দ্বান্দ্বিক অবস্থান কিম্বা সেখানকার জাতিসত্তার অবস্থান — জনজাতি বনাম অ-জনজাতি কোন্দলের গল্প সবই যথার্থ পরিসরে বুনে দেওয়া আছে কাহিনির মধ্যে। দুলাল ঘোষের সার্থকতা এটাই যে নানান বিপরীতমুখী বিষয় পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত না করে দারুণ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছে। যে প্লটের যতটা স্পেস দরকার ততটাই বিস্তার ঘটানো হয়েছে — এতটুকু বেশিও নয়, কমও নয়। এমন ভারসাম্য থাকার কারণে সার্থক একটি উপন্যাস হয়ে উঠেছে ‘অগ্নিসূত্র’।
কাহিনি যত শেষের দিকে এগোয় ততই বাড়তে থাকে তীব্র সংঘাত। ঘটতে থাকে অভাবনীয় যোগসূত্র। পাঠকের এমনটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে সরকারি চাকরি ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছন্দে ফিরে আসবে শানিতের যাপন কিন্তু ঘটনা ঘটে তার উল্টো। আর চাকরি জীবনের নিস্তরঙ্গ যাত্রায় ফিরে যেতে পারে না সে। ইতিমধ্যে যে পাতাল চক্রের মাতাল সমীরণে মেতে উঠেছিল শানিত সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। অভিমন্যুর মতো চক্রব্যূহের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে সে। অগ্নিকুণ্ডলীর গোলকধাঁধায় পাক খেতে খাকে। আর সেই বিষ-মন্থনের পাকদণ্ডে জড়িয়ে যেতে থাকে তার বাবা, মা, তার বোন জুঁই আর প্রেমিকা লীলা। ক্রমে এক চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সকলের ভবিতব্য। আমরা যদি ভাবি শেষের সেদিন কতটা ভয়ংকর — তারই এক রূপকল্প নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে। কতটা তীব্র সেই কশাঘাত তা না-বলা থাক উৎসাহী পাঠকদের জন্য।
যদিও আলোচ্য উপন্যাসে আগুনখেকো বিষয়ের সমাহার যথেষ্ট বিদ্যমান তবু এমারজেন্সি সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কিছুটা আলগাভাবেই ছুঁয়ে গেছেন লেখক। অথচ কাহিনির প্রধান চরিত্র সরকারি চাকরিটি হারায় এমারজেন্সির সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার অভিযোগে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল চাকরি-হারা শানিত যে অন্যদের মতো মুচলেকা দিয়ে চাকরি ফিরে পেতে চায়নি একথা জানা যায় ২১৪ পাতায় এসে। ২৬৩ পাতায় উপন্যাস শেষ। শানিত এমন কিছু ঘোরতর পার্টিজান ছিল না, কোনো দুর্ভেদ্য কমিটমেন্টও আচ্ছন্ন করেনি তাকে — এ অবস্থায় শানিত যে গড্ডলিকায় গা ভাসাবে সেটাই তো ছিল স্বাভাবিক। অথচ ঘটনা ঘটল তার উল্টো। পুরো বিষয়টি কেন যে এমন দায়সারাভাবে এবং উপন্যাস প্রায় শেষ হবার আগে নমোনমো করে চালিয়ে দেওয়া হল বোঝা মুশকিল।
টেক্সট-এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ‘এখন এমারজেন্সির সময়’ এমন স্টেটমেন্ট করা হয়েছে কিন্তু সেই সময়ের ভয়াবহ আতঙ্কিত সমাজের চেহারা তুলে ধরা হয়েছে খুব দায়সারা ভাবে। বরং আগরতলা তথা ত্রিপুরার উদ্বাস্তু সমাজের আর্থসামাজিক সংকট এবং প্রবল ঘোরপ্যাঁচে বাঙালি জীবনের অসহায়তার চিত্র অনেকটা দগদগে হয়ে উঠেছে দুলাল ঘোষের মারকাটারি কলমে।
অনবদ্য ন্যারেটিভের গাঁথনি ঘিরে প্লট আর সাবপ্লটের যে সাপলুডো খেলা চালিয়ে গেছেন লেখক তা দুএকটি ক্ষেত্রে আরও স্পেস দাবি করে। যেমন সাব ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন বৈদ্য ও জুঁইয়ের (শানিতের বোন) টানাপোড়েন বা পঙ্কজ তলাপাত্র আর শানিতের ঘৃণিত সংঘর্ষের সাবপ্লট উপযুক্ত জমি তৈরির আগেই শুরু হয়ে গেছে। জমি তৈরি ছিল না বলে এক্ষেত্রে ফসলও ভাল ফলেনি।
হয়তো সাবপ্লটের চাপ আর একটু কমলে ভাল হত তবু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এমন একটি অগ্নিগর্ভ উপন্যাস পাঠককে চমকে দেবেই। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের শিহরনকারী ঝাঁঝালো উপন্যাস খুব কমই লেখা হয়েছে। এবং একইভাবে কোনো উপন্যাসের এমন মাথা কনকন করা কঠিন কঠিন শব্দ সমন্বিত মুখবন্ধ বা ভূমিকাও কিন্তু আমরা কমই পড়েছি।
এসব এলেবেলে কথা ছেড়ে, সব শেষে কিন্তু মাথার টুপি উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় — সাবাস দুলাল ঘোষ। যুগ যুগ জীও।
(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)