|| ১ ||
ফিসফাস গুঞ্জন উড়ে বেড়াচ্ছে ভিড়ের মধ্যে। জনু গুণিনের ছেলেকেই শেষে কিনা! তাহলে তাদের উদ্ধার করবে কে বিপদে-আপদে। বাইশ তেইশ বছরের নধর লখাই বাগদির শবদেহ ঘিরে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে। —"এও সম্ভব!" লাখাইয়ের রুগ্ন ছেলে, বউ কাঁদতে ভুলে গেছে আজকে। মৃত্যুর আকস্মিকতা তার জীবন্ত সত্তায় জায়গাটা ঘিরে রেখেছে যেন। শুধু মায়ের একটানা বিলাপ নিস্তব্ধতার ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে। ভীড় সচকিত হয়ে উপলব্ধি করিয়ে দিচ্ছে, লখা বাগদির দেহে প্রাণ নেই।
মাটির এবড়ো খেবড়ো পাঁচিল পেরিয়ে উঠোনে পা রাখতে গেলে এই বাড়িতে কোমর বেঁকিয়ে গুঁড়ি হয়ে ঢুকতে হয়। প্রতিদিনকার সাধারণ জীবনে কয়েকটা হাঁস মুরগির ছানা উঠোন ময় কিচকিচ করে বেড়ায়। কখনো দাওয়ায় বসে থাকা রুগ্ন বউ বাচ্চাটাকে মাই দেয়। আধ খাওয়া শুকনো মুড়ির বাটিতে খাবলা মারে বোবা ছেলেটা। দরমার ছিটে বেড়ার এক চিলতে রান্নাঘর থেকে গনগনে আগুন জিভ বের করে আসে, বাড়ির গিন্নির খনখনে গলার ছন্দে। কিন্তু আজ এ বাড়ির পুরোটাই এলোমেলো। লোকের পিলপিলে ভিড় হাঁস মুরগির বাচ্চাদের পরবাসী করে ছেড়েছে।
এ বাড়ির একমাত্র বোবা জোয়ান ছেলেটা সাপের কামড়ে মারা গেছে আজ। নাড়ি ধরে আসরে বসে ছিল জনু বাগদি। নাড়ি ছেড়ে যেতেই উঠে মাটির ঘরে দোর দিয়েছে। সাজানো আসর তখনও টাটকা। বাঁটহীন ছুরি দিয়ে কাটা লক্ষণ গন্ডির ভিতর লখা যেন খেলাচ্ছলে চুপ করে শুয়ে আছে। একপাশে নরম মাটির থানের উপর মনসার ডাল পোঁতা। কাঠের পাটার উপর সিঁদুরের স্বস্তিকা আঁকা অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি। ঘটিতে ভরা জল আমের শাখা, লাল জবাফুল, অলৌকিক সত্তার জানান দিচ্ছে। সাথে একটা প্লাস্টিকের ছোট প্লেটে পাঁচসিকে পয়সা তামা,তুলসী ইত্যাদি।
জনুর সর্বক্ষণের সঙ্গী, সব কাজের সাক্ষী নিতাই অনেক ইতস্তত করে বন্ধ দরজায় টোকা দেয়। ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কি করছে জনু! বিলাপ করার মত বান্দা তো সে নয়! মনে দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে ওঠে নিতায়ের। মাটির বাড়ির এবড়োখেবড়ো চটা খসে পড়া দেওয়ালের রঙচটা কাঠের দুটো পাল্লা। জোরে ধাক্কা দিলে খসে পড়ে যাবে। নিতাই সে কারণে টোকা দেয়। এত নামডাক জনুর! এলাকার সেরা গুণিনের ছেলে কিনা সাপে কেটে মারা গেল! বিশ্বাস যায় না মনে নিতাইএর। ভাবে তাহলে খুড়োর মনের হাল কি! পাগলা না হয়্যে যায় মানুষট্যো।
|| ২ ||
ব্রাহ্মণী নদী পেরোলেই বেলে বাড়ি। বর্ষার দুই তিন মাস বাদ দিলে বর্ষার জলে পুষ্ট নদীর প্রাণ ভোমরা বেরিয়ে যায়। সে তখন নির্জীব। পায়ে হাঁটা পথ বা লড়ঝড়ে সাইকেল চালিয়ে দিব্যি এপার ওপার করা যায় বাদবাকি বছরভর। নদীর এপারের আয়াস গ্রামের লোকেরা তাই বর্ষা বা বন্যা নিয়ে চিন্তিত নয় একেবারেই।
সাপে কাটা, বিছে বা বিষাক্ত পোকায় কাটা বিষ অবহেলায় রুগীর শরীর থেকে নামায় জনু। আয়াশের উত্তর পাড়ার জনু ওঝার সেকারণে প্রায় এদিক সেদিক ডাক পড়ে।এসব কাজে জনুর কাউকে সাথে নেওয়া পছন্দ নয়। শুধুমাত্র তার ভাইপো নিতাইকে সে বিশ্বাস করে। লোকের মুখে প্রচার জনু বাগদী বিষ চালাতে পারে। সব বিষ নিজেই শুষে নিয়ে রোগীকে বাঁচায়। লোকের এই অতি বিশ্বাসে মনে মনে হাসে জনু। ছোট থেকে মা মনসার অন্ধিসন্ধি আয়ত্ত করেছে সে কঠোর পরিশ্রমে। সাপের ছোবলে একমাত্র মা মনসার দয়াই ভরসা, সে নিজেও জানে। চিতি সাপ ওঝার কাছে জব্দ। লোকে তো ইনি, হলহলে, বেতাঝাড়, ঢোঁড় সাপের কামড়ে মরা কান্না জুড়ে দেয়। সাপ-সাপিনী কে বশে রাখতে পারলেই ওঝার কাজ শেষ জনু সাপকে পোষ মানায়- গরু, ছাগল, হাঁস,মুরগির মতো। সাপ ধরা তার নেশা। সাপের বৃত্তান্ত সে কাউকে শেখায় না। এ জনুর গুপ্তধন। বাপ ঠাকুরদার থেকে ভালই আয়ত্ত করেছিল সে এই বিদ্যা।
ওই দেখো বাউলে বোবা পোলার কান্ড দ্যাখো! জোরে ধমকে ওঠে বাপ—'এই লখা! পা চালিঙে চল দিনি।' নদীর এপার ওপার তাই ছেলেটাকে সঙ্গে এনেছে জনু। ছোটো ছেলেটাকে মাঝে মধ্যে সাথে নিয়ে ঘোরে সে, যখন ডাক আসে বিষ ঝাড়ার। কোলের এই বোবা ছেলেটার প্রতি তার মনে মনে বড্ড মায়া। না হলে ঝাড়খণ্ডের গা ঘেঁষা দূর-দূরান্তের গ্রামগুলো থেকেও তার ডাক আসে। আবার বনে-বাদাড়ে সাপও ধরতে যায়।
|| ৩ ||
ওঝাগিরি করতে শুরু করা ইস্তক জনুর চুল সযত্নে লালিত হালকা জটায় আবৃত। চোখের জমি টকটকে লাল করে রাখতে পারলে বিষ ঝাড়ার সময় অগুনতি জোড়া চোখের সম্ভ্রম পাওয়া যায়। দৈনন্দিন কর্মপ্রয়াস এর সাথে চেক কাটা লুঙ্গি, কালো শার্টের সঙ্গতে কোমরে মনসার সিঁদুরে ছোপানো লাল কাপড়ের টুকরো বাঁধা—গ্রামে গঞ্জের যুক্তি না মানা মানুষগুলোর কাছ থেকে ঘাড় ধরে সমীহ আদায় করে নেয়।
ঘরের বাইরে শ শ মানুষের কাছে ভক্তি সম্ভ্রম পেলে কি হয়, জনুর মনের অশান্তি অন্য জায়গায়। তার বড় ছেলেটার এসবে একদম মন নাই! শুধুই আরো পড়বো পড়বো ইচ্ছা! ছোটটা তো বোবা। আরে বাপু তুই বিদ্যাটা নিয়ে নে বাপের থেকে। কিন্তু কিছুতেই বশ মানে না। কি করে ভবিষ্যতে পেটের ভাত জুটবে সে চিন্তাও নেই। তবে বোবা ছেলেটা বিষঝাড়া বা আসরের পাশে বসে সব কিছু মন দিয়ে দেখে। বাপের প্রতি সম্ভ্রম, বিশ্বাস আর বিস্ময় সেই বড় বড় চোখের দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে।
'আসর' সাজানো হয়ে গেছে। সাপে কাটা নিথর মানুষটা একটু একটু নড়ছে মনে হচ্ছে। হাঁটুর উপরে মনসার সিঁদুরে ছোপানো লাল কাপড় কষে বেঁধে দেয় জনু। দেহ প্রদক্ষিণ করে। অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি থেকে জল ছেটায় আর বিড়বিড় করে--
"নিভে গো আধাঁরি গোউরা রাতিজল ছেটায় আর বিড়বিড় করে। বিড়বিড় করে আর জল ছেটায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শিরা উপশিরাগুলো হাত মুঠিতে নীল হয়ে ওঠে। চোখের জমি হালকা লালচে আভা থেকে টকটকে রঙ ছড়ায়। ওঝার মাথা উপর নিচে দুলতে থাকে।
না জানি সাপা তু কোন কোন জাতি
চিতি, চৌতি, চৌমালন্তি
আগে না বাড়িয়ে পা
হরের মৈথুনে মথিলাম
কালকুটির বিষ তু পিছনে যা....."
আশেপাশের ভিড় রুদ্ধশ্বাসে দেখে প্রায় অচৈতন্য মানুষটা নড়ছে। তাকে টেনে উঠে বসিয়ে বিষাক্ত ক্ষতে থকথকে লেপন দেওয়া হয়। ইশ্বরমূল, চন্দ্রমূল, অনন্তমূল কালকাসুন্দা, মুলুক চাঁদার মূল বাঁটা ওষুধ। পঞ্চমুখী ওষুধ, তিনদিন সন্ধ্যাবেলায় মা মনসার নামে ধুপ দীপ দিয়ে লাগাবে আর মন্ত্র পড়া জল খাবে—অমোঘ বিধান ঘোষিত হয় ওঝার। যে অবিশ্বাসী তার কোন ফল হবে না সে কথা গ্রামীণ মানুষগুলো জানে। তাই রুগীর পরিবার জনুর পা ধরে হাউমাউ করে কৃতজ্ঞতার কান্না কেঁদে ফেলে। দূরে আসরের পাশে বসা বোবা ছেলের চোখে আনন্দ গর্ব ঝরে পড়ে বাপের জন্য। জনুর বুক ফুলে ওঠে।
লোকে বলাবলি করে—
“ভাগ্যিস জনু ওঝা ছিল—”
"সাপের বিষ ট্যুন নিজের শরীরে টেনে নিলে।”
গ্রাম্য মোড়ল বুক ফুলিয়ে বলে, “বইলে ছিলাম, শওরের হাসপাতালে যাওয়ার কুনো দরকার লাই...।”
“হ! হ! জনু হাসপাতালের বাপ! সাক্ষাৎ মনসার মানতপুত। নাহলে অত ভর হয়!”—অতি কৌতুহলী এক সঙ্গী বলে ওঠে।
বাস্তবিক এরা হাসপাতাল যাওয়ার ইচ্ছা রাখে না মনে, কারণ জনুই তো ধন্বন্তরি। এই বিশ্বাস এদের বুকের পাঁজরে বয়ে চলে দিবারাত্রি।
মাটির ঘুলঘুলি জানলার ফুটো দিয়ে ধূ ধূ রোদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে মনে মনে ভাবছিল দাপুটে ওঝা—রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের দাপট তার তেজ নোয়াতে পারেনি কোনোদিন। এইতো এদিনকার কথা! লখাকে নিয়ে অনেক জায়গাতেই সে বিষ ঝাড়তে গেছে! আজ অন্ধকার মেটে ঘরের ঘুলঘুলিতে রোদের দাপট তার চোখ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। চিন চিন করছে দুচোখের পাতা। তার বোবা ছেলেট্যো.....
"ঠুক....ঠুক.... ঠুক...দরজা খুলো কেনে খুড়ো! যা হওয়ার হয়্যে গেছে। সামনে বগা পঞ্চমী আসছে! পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে লেগে পড়ে...." নিতে'র কাতর আবেদন ভেসে আসে। মনসা পুজো জনুর ঠাকুরদার আমল থেকে চলে আসছে। হাজার একটা তার নিয়ম বিধি। সব বোঝে জনু। কিন্তু বোবা ছেলেট্যা... বউএর গোঙানি....নিতাইএর উৎকন্ঠা আজ তাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। জনুর বিষ ফুঁসে উঠতে চাইছে কিন্তু পারছে না!
|| ৪ ||
নিতে মানে নিতাই বাগদী ফাটাফুটো দরজার কাছে গা এলিয়ে বসে পড়ে। কি অসময়েই ঘটনা ঘটে গেল একটা। মা মনসা যে কাঁচা দেবতা। পুজোর কত রীত কানুন। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে সাপ সাপিনীর গায়ে জল পড়ে। লীলায় মাতেন উয়ারা। বাচ্চা বিয়ান। চারিদিক থেকে হাঁকডাক আসে সাপ ধরার জন্য। ছোটো থেকে নিতাই এই দেখে আসছে। হাতের একখান লাঠি আর সাপ ধরার মন্ত্রই সম্বল ছিল বাপ,কাকার। ফণা তুলে ফুঁসে ওঠা সাপ শুধু হাত ঘোরানোর জাদুতে বশ করতে দেখেছে নিতাই, তার বাপকে।দুহাতে মাটি তুলে ঝুরঝুর করে ছড়িয়ে দিত বশীভূত সাপের চারপাশে---
"মাটি মাটি মাটিসাপা সাপির তেজ নেতিয়ে গেলেই চকচকে উল্লাসে বাপ খুড়োর চোখ উঠত নেচে। বিষের থলি কামিয়ে, তেল সিঁদুর দিয়ে ঘরে বরণ করত বাড়ির মেয়েরা মিলে। মাটির জালায় বেঁধে দিত নতুন আস্তানা। এরপর ভাদ্র মাসের বগা পঞ্চমীতে পুজো করে মা দুগগার আসা অবধি মনসা নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়ানো, বিষ ঝাড়া, ওষুধ দেওয়া, তাবিজ মাদুলি মন্ত্র পড়ে দেওয়া। এই দু-তিন মাসই যা রোজগারের সময়। সারা বছরের ছেঁড়া জামাগুলো বাদ দিয়ে নতুন জামা কাপড় হবে। লাট্টু, লাটাই, ঘুড়ি, বলিতে উৎসর্গীকৃত হাঁস, পায়রার মাংস, পাঁঠার ঝোল। ভোজের মত খাওয়া দাওয়া—এসব ভাবলেই আর ধৈর্য ধরত না নিতাই-এর। বছরভর অপেক্ষা মনসাপুজো আর তার পরের দু তিনমাসের জন্য।
দুই হাতে সম্পুটি
মাটি পড়হে করলাম সার
সাপাসাপি তু রাখ ঘর অন্ধকার।
হাত মোর গোরুড়, পা মোর গোরুড়
গোরুড়ে বেড়িল সর্বরঙ্গ গা
দুই হাতে ধরিনু সাপা, সাপিনী
তু কোনখানে খাবি খা।"
খুড়োর বড়ো ছেলেটা শুধু পুজোর থানে যেত সেই দিনে। আর লখা তখন খুড়িমার কোলের। মনসা পুজোর আগের দিন সংযমের দিন। সেদিন মেটে বাড়ি, ঘর দুয়ারে নতুন লেপন দিতে হয়। ভোর থাকতে উঠে চাট্টি খইজল মুখে দিয়েই মা-খুড়িরা লেগে পড়ত লেপাপোঁছা, ঘষামাজার কাজে। বাপ, খুড়ো যেত সিজ গাছের ডাল, আমপাতা, মাটির বারি জোগাড়ের কাজে। উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটনির পর চাট্টি সেদ্ধপোড়া ভাত খেতে হয় আজকের দিনে। এরপর প্রায় দুদিনের উপোস। মাঝেমধ্যে একটু সরবত ছাড়া পেটে কিছুই পড়বে না। ভোর থেকেই মনসার থানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পুজোরি এলেও নিয়ম হলো, যাদের বাড়ির পুজো তারাই একডুবে 'বারি' ভরবে। একটুও অন্যথা হওয়া যাবে না। মনসা কাঁচা দেবতা। সাপের বিষে মারতেও পারেন আবার বাঁচাতেও পারেন।
এইরকমই এক বগা পঞ্চমীতে তার বাপটা মনসার বারি মাথায় করে পুকুরে সেই যে ডুবল আর উঠলো না। ভেসে উঠলো তার নীল হয়ে যাওয়া শরীরটা। ঠাকুরদা কত্ত বিড়বিড় করে বিষ ঝাড়লে--
"চাঁদবেনে সদাগরঠাকুমা থানে দণ্ডী কাটলে। কিন্তু নিতাইয়ের বাপ চোখ মেলে উঠে বসলো না।
সুচম্পা নগরে ঘর
জগতে জানে রে হাসন হোসেন
দুটি ভাই, কারে জবদ করিবরে
বিরুটাক মারিবরে, ঝাঁপান তুলিব
এতু করি রঙ্গে টুকারিতে টুক জ্ঞান
টুকারি মারিব রে জ্বলন্ত, গুরু
নাই মোর সঙ্গে। কে বসে আধ্যে
কে বসে মধ্যে, মধ্যে বসিল সতের
কুমার বিধে হয়, ছুবি যায় ছুবি যায়
বিষে কপাটি, ভিজিল ইংলাল, পিংলাল
পঙ্কজ উড়ি যায় তারে করি বন্দী
অনাড় ঘরে কে যাবি রে পঞ্চপুরায়
ফুটিয়া স্বপ্নের বিষ, দৃষ্টি পেলাম পানি নাগরী পর্বতে সিনা ধরে টান
ষোলশ বাদীর মিয়া না ধরে পরান
আম তামুক আগ মিটায়, ধূমা খায়
কালিয়া কালকূটের বিষ
বাদীর বান সর্পপুরে যা "
সেই থেকে কাকার ঝোঁক চাপলো বড় ওঝা সে হবেই। আর নিতাই হল সর্বক্ষণের সাকরেদ। নিতাই জানে তার কাকা তাকে কেন এত মানিয়ে চলে। জনু কারো মেজাজ দেখে না। কারো কথার ধার ধারে না। কিন্তু নিতাই কিছু বললে চুপ করে থাকে। সেই অল্প বয়সেই নিতাইকে গলায় কণ্ঠী পরিয়ে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল নিতাইয়ের বাপ। সেই দোষেই মা মনসা রোষ উগড়ে দিল নিতাইয়ের বাপের উপর—এমনটাই মনে করে আশেপাশের মানুষজন। কিন্তু নিতাই জানে কৃষ্ণসার মন্তর ছাড়া সব অচল। নিতাই নিজের দাম জানে। বাপ মরা নিতাই।
বাপ মারা যাওয়ার পর জীবনকে নতুন করে চিনতে শিখেছিল নিতাই। সে দেখল লোকের মনে বিশ্বাস জমিয়ে রাখার জন্য খুড়োর কি অমানুষিক পরিশ্রম। বিষপড়া ওষুধ কোথাও না পাওয়া গেলেও জনু বাগদী বনে বাদাড়ে আঁদাড়ে পাদাড়ে ঘুরে ঠিক মূল পাতা জুটিয়ে রাখে। কোনো মানুষ যেন ফিরে না যায়। আর দেখেছে অসীম সাহস। কখনো কখনো বিষ নামানোর জন্য শুধু চাপড় মন্ত্রই যথেষ্ট। ভিন জাতের (অন্য ধর্ম) মানুষগুলোও হাঁকডাক শুরু করেছিল কাকাকে। বিছের কামড়, কুকুরের কামড় সব রকম মানুষ আজকাল আসতে লেগেছে খুড়োর নাম ডাক শুনে।
এসব ভাবতে ভাবতে নিতাই টের পায়নি, খুড়িমা কখন শোক ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছে। নিতাই এর কাছে এসে দেখে গেছে জনু দরজা খুলল কিনা! নিতাই বিড়বিড় করে আপন মনে, "মানুষট্যো ভিতরি কি করত্যে লেগেছ্যে! দাঁতি লেগ্যের জ্যালো নাকি! যা জিদ কাকার!"
|| ৫ ||
কপালের রগ দপদপ করছে জনু ওঝার। সে বুঝতে পারে ভাইপো নিতাই দরজায় টোকা দিল দু-তিনবার। দরজার খিল খুলে বেরিয়ে আসার জন্য এক পা বাড়িয়ে আবার পিছিয়ে যায়। দরজার বাইরে সারি সারি চোখ দাঁড়িয়ে আছে অবিশ্বাস নিয়ে। জনুর আধিদৈবিক ক্ষমতার প্রতি অবিশ্বাস! কোন মুখে সে বেরোবে! লখার বাপ হয়েও সে জানতো না তার গুপ্ত ম্যাজিকের প্রতি বোবা ছোট ছেলেটার এত গভীর বিশ্বাস! ভোররাতে ছেলেটা একাই গেছিল মাঠে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই পা টেনে ফিরে এল। গোড়ালির খানিকটা উপরে দাঁত ফুটিয়েছে। রক্ত জমে আছে বিষে নীল হয়ে ফুলে উঠেছে। ব্যাথায় মুখ বেঁকে গেছে।
দেখেই বুঝেছে জনু এ হলো খরিসের বিষ। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল তার। কি করে যে বাঁচাবে ছেলেকে! সে জনু ওঝা! সবাই --—দূর-দূরান্তের গ্রামেগঞ্জের লোকেরা জানে এবং মানে জনু বিষ চালাতে পারে। সাপের বিষ শুষে নেয় নিজের শরীরে জনু। কিন্তু এই জনুর হাতেও মৃত্যু হয়েছে। পারেনি জনু বাঁচাতে। না, সেখানে তার সব সময়ের সঙ্গী নিতাই ছিল না! সে সব ব্যর্থতার ক্ষতিয়ান চাপা পড়ে থাকে জনুর আপাতসাফল্যে। তার মনে পড়ে সেদিনের জনু ওঝার দুর্বার রাগের কথা! জড়ো হওয়া ভীড় অবাক বিস্ময় দেখেছিল মা মনসার সাথে জনুর মন কষাকষির চমৎকার অভিনয়। মা সন্তানের মান-অভিমানে সন্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মা। ফল ভুগতে একটা ডবকা মেয়ে বিধবা হয়েছিল সেদিন। শিউরে ওঠে জনু তবে কি সেই বিধবার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল তার ছেলের শরীরে! তার বোবা লখাও কি মনসার কুনজরে পড়ল! নাহলে লখা অমন জিদ ধরলো কেনে! বাপ্যের কাছেই ঝাড়ন নেওয়ার!
হঠাৎ দরজা খুলে যায়। পরনে ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি আর ত্যানা লুঙ্গি জড়িয়ে জনু বারান্দায় বেরিয়ে আসে ধীর পায়ে। আসরের পাশে দাঁড়ায় সে। লখার আসরে দাঁড়িয়ে জনুর ভিতর হাহাকার করে ওঠে। এত জোরালো বিষ! যদি হাসপাতাল যেত, ছেলেটা তার আবার হাসত! আবার দাওয়ায় বসে মুড়ির বাটিতে খাবলা দিত!
ওঝার এই অদ্ভুত শান্ত অবস্থা আগে কেউ কোনদিন দেখেনি। ঘোলাটে চোখে চারিদিক দেখে নেয় সে। কোমরের লাল সিঁদুর ছোপানো মা মনসার মানতের কাপড় এখন হাতে প্যাঁচানো। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে তার। একে একে ছুঁড়ে ফ্যালে—স্বস্তিকা আঁকা কাঠের পাটা, সিঁদুর লেপা ঘট, তামা, তুলসী, পয়সা। আজ জনুর চীৎকার করে বলতে থাকে—
“কি নাটক দেখবে আর এখানে! শোনো তবে, আমার কোনও গুপ্ত মন্ত্র জানা নেই! আমি বিষ চালাতে পারি না! “
নরম মাটির থান থেকে উপড়ে নেয় মনসার ডাল। টুকরো টুকরো করে ফ্যালে সেটা।
“সব গ্রামে গ্রামে বুল্যে দাও... জনু ওঝা পারেনি তার ছেলেকে বাঁচাতে......” কর্কশ চীৎকারে বাড়ির নিস্তব্ধতা খান খান হয়, শোকের বিনবিনে কান্না থেমে যায় সহসা।
দুপুরের গনগনে আঁচে গোটা শরীর ঘেমে ওঠে দাপুটে ওঝার। তার ছেলে সাপের ছোবলে মরেছে। বাপের ক্ষমতা হয়নি তাকে বাঁচানোর। লন্ডভন্ড আসরের মাঝে নিথর শুয়ে থাকা তার লখার পাশে গিয়ে বসে জনু। বুকের মধ্যে মৃত্যুতে নীল হয়ে যাওয়া ছেলের মুখ চেপে স্থির হয়ে বসে লখার বাবা। চুমু খায়। এই বিষ তার শরীরে আসুক, জিভের লালায় মাখামাখি হোক। হাউ হাউ করে কাঁদে।
“ছেলের বিষ আজ তার শরীরে ঢেলে দিক মা মনসা! জনু ওঝা মরুক...” ডুকরে ডুকরে প্রলাপ বকে চলে লখার বাবা।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)