এক ছিল ছোট্ট রাজ্য আর সেখানে ছিল এক রাইকিশোরী রাজকন্যা। রাজকন্যা হলে কী হবে, তার গড়ন পেটন কেমন যেন! দীর্ঘ, তণ্বী রজনীগন্ধার ডাঁটি নয় বরং অবাধ্য বনতুলসীর ঝোড়ার (??) সঙ্গেই সে দেহবল্লরীর বেশি সাদৃশ্য। মেয়ের চুলের বর্ণ রাগি ঝড়ের মেঘের মতলালচে কালো, অবিন্যস্ত ছড়িয়ে থাকে পিঠ ছাপিয়ে ফুলে ফেঁপে। তার নাকটা ঠিক তিলফুলের মত তিখোলো নয়, চোখদুটি নয় খঞ্জন পারা, ভুরু তেমন সুডোল যুগ্মধনু নয়, ঠোঁট নয় বিম্বফলের লাখান। কোমর নয় কলসীর মাপে, বাহুযুগল দেখে কখনই পদ্মপাতার পেলব ডাঁটি বলে ভুল হয় না। মানে এক কথায় রাজকন্যার যে কত খুঁত, রূপের খাতায় কত যে লাল কালির দাগ তা গুনে শেষ হবে না। স্বভাবতই রাজ্যে সকলের খুব দুঃখ -- আজ অবধি কেউ শুনেছো রাজকন্যার নাম অতসীলতা, তার গায়ের বর্ণ অতসী ফুলের পাপড়ির মত? দেশের লোকের লজ্জায় মাথা হেঁট। রাজকন্যার সখীরা মুখ ভার করে থাকে, যতই লোধ্ররেণু মাখানো হোক, যতই মনসা পাতার কাজল চোখে টানা হোক, যতই তাম্বুলের রসে ঠোঁট ভিজিয়ে দেওয়া যাক, রূপ আর খোলে না, সেই সাধারণ গেরস্থ বাড়ির মেয়েদের মত পাঁচপাঁচী চেহারা।
রাজকন্যা এখন নাহয় রাইকিশোরী, কালো ভ্রমরের মত রাজবাড়ির এ মহল থেকে ও মহল তুড়ুক নেচে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু সেইদিন খুব দূরে নেই যেদিন নিয়মমত স্বয়ংবরের নিমন্ত্রণ নিয়ে এ রাজ্যে ওরাজ্যে পাড়ি দেবে দূত। রাজামশাই এখন থেকেই দুশ্চিন্তায় ভ্রূকুটি কুটিল, স্বয়ংবর ডাকলে যদি কোন রাজপুত্র না আসে, সে ভারি লজ্জার কথা হবে। রূপের খ্যাতি যেমন সাত সমুদ্র তেপান্তর ছড়িয়ে যায়, অরূপের খ্যাতিও তেমন বাতাসের আগে ছুটে চলে। রাজা জরুরী সভা ডাকলেন মন্ত্রী সান্ত্রী পাত্র মিত্র কোটাল সেনাপতি নিয়ে।
এদিকে রাজকন্যাকে নিয়ে যে এত সমস্যা, সেটা তিনি জানেনই না। কে জানাবে? রাজার মেয়ে বলে কথা! কার ঘাড়ে একটা ছেড়ে দুটো মাথা আছে যে অতসীলতাকে গিয়ে বলবে তোমার রূপ নেই। আসলে রাজকন্যা না হলে তো কোন সমস্যাই হত না। রুক্ষ চুলের শ্যামল বরণ মেয়ে, চোখ ভর্তি দুষ্টুমি, মুখ ভর্তি হাসি, পা ভুঁয়ে পড়লেই চঞ্চল ছাঁদে নেচে ওঠে, হাতে ফুটে ওঠে নৃত্যছন্দ — রূপুসী হতে আবার কী চাই? অতসীলতা মনের সুখে ভোর ভোর উঠে লালচে সোনালী আভা মেখে বাগানে উড়ে আসা পাখিদের চাল খাওয়ায়, হরিণদের গায়ে হাত বোলায়, কাঠবেড়ালীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, গাছে টাঙানো দোলনায় দোল খেতে খেতে গান গায়। তারপর রাণীমার বকুনি খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে লুচি আর সাদা আলুর চচ্চড়ি খেয়ে গুরুমশাইয়ের কাছে পড়তে বসে। কাব্য ও শুভঙ্করী, বিজ্ঞান ও দর্শন -- সবেতেই তার সমান দখল, সমান আগ্রহ। অতসীলতার কাছে গুরুমশাইয়ের তাবড় তাবড় ছাত্র ডাহা ফেল। ছাত্রীরা অতসীলতার খাতা টানাটানি করেআঁক মক্স করে।
পড়ার পর স্নানপর্ব। এটা একটু ঝঞ্ঝাট। দাস দাসী মুসুরডাল বাটা, হলুদবাটা, সরবাটা, চন্দনপ্রলেপ -- সব নিয়ে অপেক্ষা করে আর অতসীলতা কারোকে কিছু না বলে রাজার দিঘিতে ডুব সাঁতারে এপার ওপার করে রান্না বাড়িতে উপস্থিত হয়ে চিৎকার করে -- খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। খাওয়ার পর দুপুরবেলা গল্পের বই পড়ে, ছবি আঁকে, কখনও নিজের লুকোনো খাতা খুলে লেখে মনের কথা। আর খুব কদাচ ক্বচিৎ পড়ার বইতে লুকিয়ে রাখা অনামা চিঠি পড়তে বসে, গুরুমশাইয়ের কোন ছাত্রের কীর্তি। প্রিয়সখীকে ডেকে পড়ায়। হাসিও পায়, রাগও হয়। আবার কেন কেজানে লজ্জাও পায় -- কী বাজে কথাই না লিখতে পারে ছেলেগুলো! বিকেলে খেলাধুলো শেষে সন্ধেবেলা পরের দিনের পাঠ। সন্ধে একটু রাত গড়াতেই রাজকন্যার চোখে ঢুল লাগে, রাণীমার বকুনি খেতে খেতে, মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে, পাতের ভাতকটি শেষ করেন । তারপর বিছানায় অঙ্গ ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই “ঘুমো রে চোখ এটা/ঘুমো রে চোখ ওটা।” রাজকন্যার দিন কাবার পরম সুখে, আয়না দেখার সময় কই? তার কোন মাথাব্যথাই নেই স্বয়ংবর সভা নিয়ে। রাজাসভাঘরে মন্ত্রণা করেন, কী করা যায়। রাজার মেয়ে বলে কথা, যোগ্য রাজকুমার তো চাই নয়তো লোকে বলবে কী! এদিকে বড় বড় রাজ্যের রাজারা রূপসী ছাড়া কন্যা আনেন না ঘরে, তাঁদেরও একটা মান-মর্যাদা আছে তো, লোকে বলবে রাজ্যের লোভে কালো কুচ্ছিৎ বউ এনেছে। প্রথমেই রাজবৈদ্য ভয়ে ভয়ে বললেন,
--আমার যতটুকু সাধ্য আমি করেছি মহারাজ। খোদার ওপর খোদকারি ওর চেয়ে বেশি চলে না। সেনাপতি, কোটাল বললেন -- রাজ্যজয় করতে বলুন, করে দিচ্ছি। কিন্তু রাজকুমারীর রূপচর্চার ব্যাপারে আমাদের কী করার আছে বলুন! পাত্র মিত্র হাতজোড় করলেন -- মার্জনা করবেন মহারাজ, রাজ্যশাসনের কোন ত্রুটি হলে আমরা মাথা পেতে শাস্তি নিতে প্রস্তুত কিন্তু এক্ষেত্রে ...। অনেক ভেবে চিন্তে মন্ত্রীমশাই বললেন -- মহারাজ, ভেবে দেখলুম ওসব লোধ্ররেণু, তাম্বুলরস আজকাল আর চলে না। শুনেছি সাত সমুদ্র তেরোনদী পেরিয়ে জম্বুদ্বীপে অনেক ভাল ভাল প্রসাধনের সরঞ্জাম আছে। আপনি সেই সব উপকরণ রাজকুমারীকে আনিয়ে দিন। কেশরঞ্জনী, ওষ্ঠরঞ্জনী, কপোলে শ্বেতপ্রলেপচূর্ণ, অক্ষিকোটরে রক্তিমাভ প্রলেপচূর্ণ, ভ্রূপল্লবকৃষ্ণতুলিকা, নয়নপক্ষবর্ধনী, আঁখিরঞ্জিনী, নখরঞ্জিনী, রোম-উত্থোলিনী ...
রাজা বিষম খেয়ে বললেন -- আরে থামুন থামুন। এসব কী? শুনে তো মনে হচ্ছে আণবিক অস্ত্র-শস্ত্র কিছু হবে। মন্ত্রীমশাই মৃদু হেসে বললেন -- তা আপনি কাছাকাছি গেছেন, এগুলি আণবিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর অস্ত্র, এখন নারীশক্তি দশ হাতে ত্রিশূল-আদি আয়ুধ ধারণ করেন না, এই সব অস্ত্রেই শান দিয়ে অসুর বিনাশ করেন।
রাজামশাই সওদাগরকে ডেকে বললেন -- আপনি মন্ত্রীর কাছ থেকে তালিকা নিয়ে এগুলি আনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। যা স্বর্ণমুদ্রা লাগবে রাজকোষ থেকে নিয়ে নিন।
--যথা আজ্ঞা, মহারাজ। সওদাগর বললেন।
সওদাগরের ময়ূরপঙ্খী তৈরিই ছিল সাগরে ভাসবে বলে। রাজামশাইয়ের তালিকা হাতে নিয়ে মাঝি-মাল্লাকে খবর পাঠালেন পরের দিন ভোর বেলায় জাহাজ ছাড়তে। সেদিন সারা রাত সওদাগরের বাড়িতে নিভৃতে রাজপুরুষের আনাগোনা । সকলের ঘরে বালিকা, কিশোরী, নবযৌবনবতী কন্যা আছে, সকলের বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। সকলের ঐ তালিকামত এক প্রস্থ সাজের জিনিস চাই। সকলের ক্ষেত্রেই অর্থ কোন বাধা নয়। মন্ত্রীমশাইকে তাঁর কমিশন বুঝিয়ে, প্রচুর অর্ডার নিয়ে সাগর পাড়ি দিল সওদাগর।
এদিকে সকল লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নেয় দেখে সেনাপতি, কোটাল, পাত্র, মিত্র এগিয়ে এলেন। বললেন -- মহারাজ, শুধু প্রসাধনে কি সব দোষ খণ্ডায়? সুঠাম অঙ্গ, লাবণ্যময়ত্বক, নিবিড়চাহনি, গূঢ় সংকেত, ফুল্ল অধর –- এ সবই তো দরকার রূপসী হতে হলে।
-- তাই নাকি, সেতো জানতাম না। তা এ বিষয়ে আবার কী করণীয়?
-- যদি অনুমতি করেন, আমাদের পরিচিত এক ভদ্রমহোদয়ের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে, কিছু অর্থ সাহায্য পেলেই তিনি অঙ্গ সঞ্চালন কেন্দ্র এবং বিভঙ্গবিকাশ কেন্দ্র খুলতে পারেন।
-- সে সব কী জিনিস?
-- আজ্ঞে ম্লেচ্ছ ভাষায় বলতে পারেন জিম আর গ্রুমিং সেন্টার, জিমে শরীরটা মাপমত কাটছাঁট করা হয়, যাতে পুরুষদের চোখে ভাল লাগে। গ্রুমিং সেন্টারে নিজেকে লাস্যময়ী, বিভঙ্গময়ী, দৃষ্টিনন্দনী করে তোলার শিক্ষা দেওয়া হয়।
এতক্ষণ রাজকবি নিজেকে খুবই অবহেলিত মনে করছিলেন, এতক্ষণ পর একটু সুযোগ মেলায় তিনি বলে উঠলেন -- এইসব প্রয়াস, সাধনা ও শিক্ষায় সেই মহাকবি কালিদাস বর্ণিত রূপ অর্জন করে নারীঃ
তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ
শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং
যা তত্র স্যাদ্ যুবতিবিষযে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ
রাজামশাই বিষম খেয়ে ধপ করে সিংহাসনে বসে পড়ে বললেন -- বলেন কী? ঐ পুঁচকি মেয়ের বর জোটাতে এত আয়োজন! এতে তো একটা রাজ্য জয় করা যায়!
রাজার বাড়ির ব্যাপার, মুখ থেকে কথা খসালেই কাজ হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই ভারে ভারে প্রসাধনী নিয়ে সওদাগরের জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই আরেকটি জাহাজ সমুদ্রে ভাসল, আরেক সওদাগরের ছেলে পাড়ি দিল আরেক প্রস্থ তালিকা হাতে। পাত্র মিত্র বরাত দিয়ে আনিয়ে নিল অঙ্গ সঞ্চালনের যন্ত্রপাতি, সেনাপতির ভগ্নীপতির পিসতুতো ভাইপো অঙ্গসঞ্চালনের নির্দেশক হিসাবে নিযুক্ত হল, কোটালের শ্যালকের দ্বিতীয় পুত্রের তৃতীয় ভায়রাভাই এল বিভঙ্গ বিকাশ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরূপে। রাজবাস্তুকার নিজে পরিকল্পনা করে প্রায় রাতারাতি পথে প্রান্তে বেশ কিছু সুরম্য প্রসাধনগৃহ বানিয়ে দিলেন। সবাই যে যার হিসাব বুঝে নিয়ে খুশি। রাণীমা এবার পড়লেন অতসীলতাকে নিয়ে। ভোরবেলা ঘুম চোখ খোলা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া অবধি একেবারে কড়া নিয়মে বাঁধা পড়ল তার সময়। জনা দশেক দাস দাসী বরাদ্দ হল রাজকন্যার জন্য, তাদের প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল অতসীলতার দৈনন্দিন সৌন্দর্যচর্চার সূচি। রাজকন্যা কখন ঘুম থেকে উঠবেন, সারাদিনে কী খাবেন, কখন খাবেন, কতটা খাবেন, কতক্ষণ ব্যায়াম করবেন, কীকী প্রলেপ লাগিয়ে কতক্ষণ বিশ্রাম নেবেন, কী পোশাক পরবেন, কেমন ভাবে চুল বাঁধবেন, কেমন ভাবে দাঁড়াবেন, কেমন ভাবে তাকাবেন এই সব প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক নিযুক্ত করা হল।
দিন যায়। রাজকন্যার সঙ্গে তার সব সখীর দল, রাজ্যের প্রতিটি গণ্যমান্য রাজপুরুষের অবিবাহিতা কন্যার দল যোগ দিয়েছে সুন্দরী হবার সাধনায়, সপ্তাহে দু বার করে এখন সাগর পাড়ি দেয় সওদাগরের জাহাজ, সমস্ত সভাসদের ছেলেরা বাবার পেশায় না গিয়ে এখন ঝুঁকেছে সওদাগরির কাজে। আরো দশটি ময়ূরপঙ্খী বন্দরে পণ্য নিয়ে ফেরি করে। আজ প্রসাধন আসে তো কাল আরো আধুনিক অঙ্গ সঞ্চালনের যন্ত্র আসে, পরশু আসেন কোন বিশেষজ্ঞ যিনি অনেক স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে শিখিয়ে দেবেন কোন অত্যাধুনিক অঙ্গবিভঙ্গ, নৃত্যছন্দ। শিখিয়ে দেবেন আধুনিক প্রসাধনী কীভাবে আরো আধুনিক ধাঁচে ব্যবহার করা যায়। রাজ্যের বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে রাজ্যের কন্যাদের সৌন্দর্যচর্চার খাতিরে। অতএব সবাই খুশি।
দিন যায়। রাজকন্যার ও তাঁর সখীদের আর সময় নেই কাব্য বা অঙ্কের বই খোলার, মাঠে ঘাটে গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দোল খাওয়ার। কাঠবেড়ালি হরিণের সঙ্গে খেলা করার। এতদিনে রাজকন্যা বুঝেছেন যে তিনি নিতান্তই কুচ্ছিত, কুরূপসী।(??) তাড়াতাড়ি সুন্দরী না হতে পারলে ভাল বিয়ে হবে না। আর ভাল বিয়ে না হলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাঁর সারাদিন মনখারাপ, আয়না দেখেন মাঝে মাঝে, দর্পণে ভেসে ওঠা টুকটুকে কৃষ্ণকলি মুখটি দেখে বুঝতে পারেন না কেন লোকে অসুন্দর দেখে, কেন কুচ্ছিত বলে। তার তো নিজেকে বেশ লাগে। খুব ইচ্ছে করে একটু কাব্যচর্চা করে বা একটা দুটো শক্ত উপপাদ্য করে মনের ভার কমাতে কিন্তু সময় নেই, সারাক্ষণ কেউ না কেউ, কিছু না কিছু উপকরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসেবা করার জন্য।
সেদিন শ্রাবণ মাসে অনেকদিন পর বিকেলে একটু অবসর মিলেছে অতসীলতার। যথাস্থানে লাগসই উদ্ধৃতি মুখস্থ করানোর যিনি শিক্ষক, তাঁর জ্বর, আসেন নি। রাজকন্যা রাজবাড়ির ছাদে এসে মেঘছেঁড়া কমলালেবু আলোয় খুলে বসলেন তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুন ও মণিপুর রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার কাহিনী। সেই কবে কোন কালে গুরুমশাই দিয়েছিলেন তার পঞ্চদশী জন্মদিনে, সৌন্দর্যচর্চার চাপে পড়ে ওঠার সময় হয়নি। পড়তে পড়তে কখন সন্ধ্যা নেমেছে, রাজকুমারী মনে মনে দেখছেন অরণ্যে অশ্বারোহিণী চিত্রাঙ্গদাকে, যেন দিঘির জলে নিজের প্রতিচ্ছবি। এদিকে অন্দরমহলে দাস দাসীর পল্টন বাহিনী ভারে ভারে সোনার থালায় শত শত উপচার সাজিয়ে রাজকন্যার অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে উঠেছে, তাঁর বৈকালিক প্রসাধন এখনও শেষ হয় নি। অতসীলতা ভুলে যাওয়া ছটফটে খালি পায়ে দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এল রাণীমার মহলে -- মা, আজ আমি তোমার কাছে থাকব, রাতেও তোমার কাছে ঘুমোবো, আমার একটুও সাজতে ইচ্ছে করছে না। দেখো, আমার গা গরম হয়েছে। রাণীমা মুখ টিপে হেসে প্রদীপের সলতেটা একটু উস্কে দিয়ে মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন। সত্যি বলতে কী, ওনার আবার এই চকচকে, ঝকঝকে পালিশকরা রাজকন্যা অতসীলতার চেয়ে সেই উখুসুখু, তিরতিরে, গেছো মেয়ে আতসকেই বেশি ভাল লাগত, বেশি আপন মনে হত। মায়ের পাশে শুয়ে অতসীবালা পড়তে লাগল মণিপুরের সেই আশ্চর্য রাজকুমারীর কথা, যিনি রূপসী ছিলেন না কিন্তু রাজ্যের সাধারণ লোকের তাকে দেখে মনে হত ‘সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী’।
পড়তে পড়তে কখন রাত হয়ে এল, কখন পুরোনো দিনের মত রাণীমা ঘুমে ঢুলে পড়া মেয়েকে বকুনি দিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুলে দিলেন, কখন অতসীলতা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল সে যেন সেই মাঠের অশথডালের দোলনায় আগের মত খোলা চুলে বসে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুনের মত এক আশ্চর্য পুরুষ। স্বপ্নে সে অদ্ভুত এক অহংকারে ঠিকরে উঠে তাকে বলছে -- আমি রাজকন্যা, অতসীলতা। আমি ঠিক যেমনটি দেখছ, তেমনটি। সুন্দরী কিনা জানিনা কিন্তু অপূর্ব, অনুপম।
ভোরের হাওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল তার। প্রধানা দাসী এসে বলল কাল থেকে ওর প্রশিক্ষকেরা এসে ফিরে যাচ্ছেন, সহচরীরা প্রসাধনের ডালি নিয়ে অপেক্ষমান, উদবিগ্ন রাজামশাই রাজ চিকিৎসককে ডেকে পাঠিয়েছেন, আর বলে পাঠিয়েছেন যেন এখুনি সভাকক্ষে আসে রাজকন্যা।
অতসীলতা ধীরে সুস্থে ওর পুরোনো ঘাঘরা চোলী পরে, লালচে চুল ঝামর করে, মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, রুনুর ঝুনুর নূপুর বাজিয়ে রাজসভাকক্ষে এল। রাজামশাইয়ের ভুরু গেল কুঁচকে। কিছু বলার আগেই রাজকন্যা বললেন -- বাবা আমি আর রূপসী হতে পারছি না। হাজার জঞ্জাল মুখে মাখলেও আমি রূপসী হতে পারব না। জিম করে করে গা ব্যথা হয়ে গেছে। বিড়াল-পায়ে হেঁটে হেঁটে গোড়ালি ঝিম ঝিম। আধপেটা খেয়ে আমার সবসময় মাথা ঘোরে। আমাকে রেহাই দাও।
-- কিন্তু, তাহলে কী করে হবে মা? তোমার সৌন্দর্যবর্দ্ধক কোর্সের সময়সীমা তো দু বছর, মোটে তো ছমাসও হয় নি।
--না হোক, আমার আর এসব চাই না।
রাজামশাই সমস্যাসঙ্কুল দৃষ্টিতে মন্ত্রী, পাত্র, মিত্রদের দিকে চাইলেন। রাজকন্যার মুখটা একটু লাল হয়ে গেল। ও এবার সভার দিকে তাকিয়ে বলল
-- কি আপনাদের মনে হয় আমাকে দেখতে ভাল নয়? সবাই চুপ। ও আবার বলল,
--আমার কিন্তু নিজেকে আয়নায় দেখতে খুব ভাল লেগে। মনে হয় আমার এমন ঝামর ঝামর লালচে চুল, এমন ছোটছোট চোখ, একটু বোঁচা নাক, মোটা ঠোঁট, গোলগাল বেঁটে বেঁটে গড়ন — এসব ছাড়া আমি অতসীলতা হতেই পারতাম না। আমি যেমন আছি একদম নিখুঁত, কোথাও কোন বদল চাই না। কি মা, তোমার মনে হয় আমি দেখতে খারাপ?”
রাণীমা হেসে ফেললেন -- দূর পাগল, আমি কি তোর রূপ দেখি নাকি? তোর কথা ভাবলেই সেই জন্মের পরে পুঁচকি রোগা ন্যাড়া মাথা মেয়েটার মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তোকে যেমনই দেখতে হোক, আমার কাছে তুই পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে।
--বাবা, তুমি?
রাজামশাই আমতা আমতা করে বললেন -- কিন্তু মা, শুধু আমরা বললে তো হবে না, সবাইকেই তো বলতে হবে।
--কেন? আমি কেমন দেখতে সেটা আমি বুঝব, আর কারো মতামতের কি দরকার! এমন কথা কে বলেছে, সুন্দরী হতে হলে গায়ের রঙ ফর্সা হতে হবে? চোখ হতে হবে টানা টানা? কে বলেছে বার্বি ডলের মত টিংটিং রোগা হওয়া ভাল, টেডি বিয়ারের মত গোলগাল হলে খারাপ দেখায়। আমার তো উল্টোটাই লাগে।
--মা, তোমার ছবি নিয়ে দূত কত রাজ্যে রাজ্যে ঘুরছে, কারো পছন্দ হচ্ছে না, তোমার জন্য রাজপুত্র লাগবে তো একটা। আমার পর রাজ্য কে চালাবে?
--কেন, আমি। তোমার আনা রাজপুত্রের চেয়ে ভালই চালাবো। পছন্দ গড়ে ওঠে অভ্যাসে, যেটা দেখার অভ্যেস নেই সেটা দেখতে ভাল লাগে না। ওদের ভাল না লাগতেই পারে, তার মানে এই নয় আমাকে খারাপ দেখতে। তুমি এইসব আপদগুলোকে আজই বিদায় করে দাও। আমার অর্জুন আমি নিজে খুঁজে নেব। শুধুমাত্র আপনাদের দেখতে ভাল লাগবে বলে আমি আর আমার সখীরা আর দিনের পর দিন সৌন্দর্যচর্চার নামে এই অত্যাচার সহ্য করব না।
চারদিক থেকে আওয়াজ উঠল -- না, না, না। আমরা আধপেটা খেয়ে থাকি, অস্বস্তিকর পোশাকে হাঁফিয়ে উঠি, সুউচ্চ পাদুকার ভারে চলতে গেলে পড়ে যাই। সারাদিন সুন্দরী হওয়ার সাধনায় কে ভুরুর চুল তুলে নিচ্ছে, কে গায়ে গরম মোম ঢালছে, কানে, নাকে ঠোঁটে মোটা গুণছুঁচ ফোটাচ্ছে, এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।
সভাসদেরা সভয়ে দেখলেন সকলের কন্যারা একজোট হয়ে অতসীলতার পাশে দাঁড়িয়ে, সকলের হাত মুষ্টিবদ্ধ, সকলের চোখে এক তীব্র জ্যোতি। ধমক দিয়ে এদের চুপ করানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
রাজামশাইয়ের মনে হল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। রাজকোষের অর্থ তলানিতে এসে ঠেকেছে, রাজ্যশাসন মাথায় উঠেছে, সত্যি তো, কে বলেছে তাঁর মেয়েকে দেখতে ভাল নয়, তাঁর তো খুব ভাল লাগে। অন্যরকম দেখতে হলে রূপসী হত ঠিকই কিন্তু তাঁর আদরের অতসী-মা হত কি? লোকের সাহসও তো কম নয় তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মেয়েকে বলবে দেখতে ভাল নয়! কী করে হতে দিলেন এমন একটা কাণ্ড!
তিনি বললেন, “মন্ত্রীমশাই তাহলে?” মন্ত্রীমশাই সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন,“তা হলে?” সেনাপতি পাত্রের, পাত্র মিত্রের, মিত্র কোটালের — সবাই সবার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। এদিকে ঘটনা শুনে সওদাগরের দল রাজগৃহে উপস্থিত হয়েছে, তারা ক্ষতিপূরণের বিশাল অঙ্কের দাবী জানিয়ে দাবীপত্র পেশ করেছে। সভাসদগণের ভাইপো বোনপোর দল, যারা বিশেষজ্ঞ হিসাবে চাকরি পেয়েছিল, তারা কালো পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। যে সব দৈনিক কর্মী সৌন্দর্য শিল্পে নিযুক্ত আছে তারা অনশন আন্দোলন করবে হুমকি দিচ্ছে। সভাসদেরা মনে মনে হিসাব করছেন তাঁদের মাসে মাসে কমিশন বাবদ কত ক্ষতি হল, সবাই ক্রুদ্ধ, যে কোন সময় ক্ষোভে ফেটে পড়বে, বিদ্রোহ করাও অসম্ভব নয়।
এদিকে অতসীলতারা ততক্ষণে মোমবাতি নিয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়, এই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে। তাদের মায়েরাও হুমকি দিচ্ছেন যদি এই সৌন্দর্যবর্ধন চর্চা এখনি না বন্ধ হয়, তাঁরাও প্রদীপ হাতে রাজপথে নামবেন, কে বলেছে যে তাঁদের মেয়েদের দেখতে খারাপ? ঐ মাথামোটা পুরুষমানুষের দল? ওরা কী না বলে থাকে! ওদের কথা ধরলে সংসার চলে? রাজামশাই চাইলেন রাজগুরুর দিকে। রাজগুরু তাঁর শ্বেতশুভ্র দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন -- রাজা, জ্যা-মুক্ত শর একবার বেরিয়ে গেছে, আর তো তূণে ঢুকবে না। তোমার রাজত্বের অর্ধেক মানুষের জীবিকা এখন প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে গেছে সৌন্দর্য শিল্পের সঙ্গে, বিবাহ নয়, দেশের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে। হঠাৎ সব বন্ধ করে দিলে গণবিপ্লব অবধি বেঁধে যেতে পারে।
রাজামশাই আবার সভাসদদের নিয়ে জরুরী মিটিং ডাকলেন।
ইতিমধ্যে অতসীলতা মিছিল শেষে সখীদের নিয়ে চলে গেছে গুরুমশাইয়ের ক্লাসে, অনেকদিন পর প্রিয় বইগুলো খুলে পাতায় পাতায় হাত বোলাচ্ছেন, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আবার মুখে ফুটে আছে অপূর্ব এক হাসি।
সর্বশেষ পাওয়া সংবাদ অনুসারে, রাজামশাইয়ের ইচ্ছানুক্রমে এবং মন্ত্রীসভার অনুমোদনপূর্বক পাঠ্যসূচি থেকে চিত্রাঙ্গদার উপাখ্যানটি বর্জন করা হয়েছে এবং রাজ্যে নারীর পরিবর্তে সকল পুরুষের, বয়স নির্বিশেষে দিনে দ্বিঘটিকা সৌন্দর্যচর্চায় মনোনিবেশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আশা করা যায়, রাজ্যে এবার শান্তি ফিরবে।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)