উত্তরকথা;—সৈকত রক্ষিত; প্রথম প্রকাশ: ২০১৫; পারুল প্রকাশনী- কলকাতা; ISBN: 978-93-85555-00-8
গল্পকে কী গোলাকার একটা দৃশ্যপাঠ্য বস্তু হতে হবে, যার একটা তাক-লাগানো আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গে একটা নিটোল শেষ থাকতেই হবে? যদি এই প্রশ্ন কোনো পাঠকের নিদ্রাহরণ ক’রে থাকে তো তাঁর জন্য সৈকত রক্ষিতের গল্প, বড়গল্প বা উপন্যাস নয়। পারুলের ছাপা ‘উত্তরকথা’ (২০১৫) সংকলনের ‘আঁকশি’ পড়তে গিয়ে ঠিক এই কথাটাই মনে হলো সর্বপ্রথম। ‘জিয়নকাঠি-র’ ছোঁয়ায় মৃতদেহ ওঠে জেগে, কিন্তু যদি গল্পটি ‘জুয়ালকাঠি’ গ্রাম নিয়ে হয়, তাহলে তো কাহিনীর কমনীয়তার কোনো নিয়মই মানা হল না, নয় কি? তাই গল্পের গোড়াতেই যখন পড়তে গিয়ে একটা চিত্রবিচিত্র গাছ-গাছালিতে ঘেরা জুয়ালকাঠি গাঁয়ের কথা পড়ছি যেখানকার মানুষজনেরা নিজেদের মতো ক’রে গাছগুলির নাম রেখেছে ‘আগাই’, ‘কুড়োন’ বা ‘হটু’ — নামকরণের ব্যাকরণে কোনো আভিধানিকের সম্মতির তোয়াক্কা না ক’রেই — অথচ শব্দকোষ নির্মাতারা ‘হ’- বলতে হটন, হট্ট (হট্টচোর, হট্টবিলাসিনী প্রভৃতি সমেত), হঠ-হঠন থেকে ‘হঠাৎ’ অবধি এসেই থেমে যাচ্ছেন! এইসব ‘গাঁওয়ালি’- নামে শুধু থাকে এক ধরনের ব্যবহারিক লজিক — যার কোনো ব্যাখ্যা সভ্যজগতের বিজ্ঞানে অনুবাদ সম্ভব নয়। আমি নাম-না-জানা গাছ, যার আগাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে চাইছে মাটি স্পর্শ করতে, তার নাম যদি রাখি ‘আগাই’ তো বৈয়াকরণের গাত্রদাহ হয় কেন? আমার ‘কুড়োন’ গাছ যতটা ঠায় দাঁড়ায়, তার থেকে বেশ হয়তো টুপটাপ ছোট ছোট ফল-পাতা ঝরায় জলে-জঙ্গলে — সেটাই তার লজিক হলে কার আপত্তি? লেখক তো বলেই নিয়েছেন: “অদ্ভুত সব গাছ। বিচিত্র তাদের নাম”, এই বৈচিত্র্য কী সভ্যসমাজের জীববিজ্ঞানের নির্মিতি? না-হলেই বা কী?
বাংলার সঙ্গে বঙ্গেতর সংস্কৃতি ও ভাষার সীমারেখায় যে মানুষজন থাকে, তাদের বাচিক সংমিশ্রণ যেন খুব সহজেই এইসব গল্পগাছায় চলে আসে — নিজের অজান্তেই গল্পের সঙ্গে গাছের একটা আত্মীয়তা আমি খুঁজে পেলাম এই ‘গল্প-গাছা’য়। কখনও লিখছি ‘গাঁওয়ালি’, কখনও ‘সারা-কে-সারা’ জঙ্গল। নিজের মতো দেখছি — ‘গলগল’ গাছে ফুল ফুটছে আর সেগুলি জঙ্গলের মত্তভাষায় হয়ে যাচ্ছে ‘উলুরিঝুলুরি’ ফুল! অদ্ভুত তো বটেই!
সেখান থেকে আমরা ঢুকে গেছি সটান মাঝ-জঙ্গলে; যেখান থেকে প্রায়ই ভেসে আসে মন-শরীর তোলপাড় করা ধামসা, নাকাড়া আর আড়বাঁশির সুর। গান-নাচ-উল্লাস ও শিকার, সব মিলিয়ে এই বর্বরতা উদ্ভাসিত সাঁওতালদের কথায়, দেহে, ব্যবহারে — কেননা জুয়ালকাঠির মাগরাম মুচিরা যে জঙ্গলে যায় ‘শিমুলয়ালা’ হয়ে, তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই এই অরণ্যপ্রান্তের আদিবাসিদের। তার ক্বচিত-কদাচিত একঝুড়ি ‘ক্যাঁন্দপাকা’ নিয়ে আসে গাঁয়ে বেচবে বলে, নয়তো তারাও ‘সিধা’ চলে যায় মানবাজারের হাটে নিজেদের বেসাতি নিয়ে। সব কটি গাঁ-গেরাম-জঙ্গলের মানুষদের যোগাযোগের জায়গা হলো এই ‘মানবাজার’।
মানবাজারে আছে মানভাঙানোর সদুপায়, গ্রাম থেকে আধাশহর যাওয়ার স্থানীয় বাস, আছে বেসাতি করতে আসা নানান গাঁয়ের মানুষ, আধাশহরের বণিকেরা আর শখের মণিহারী জিনিষপত্র — একটা যেন দূরের ছোঁয়া ও সম্ভাবনা। যেখানে যাওয়ার হাতছানি মাগারাম মুচিদের কেউ দেয় না। তারা জুয়ালকাঠির টাকারোজগারের অজানিত জোয়ালেই থাকে আবদ্ধ — ভরসা শুধু গাছপালা ও প্রকৃতি।
যে নুনু (প্রান্তিক ভাষায় ‘শিশু’ বা চব্বিশ পরগণার মুসলমানী বাংলায় ‘কচি’র প্রতিনাম) বা নীলকমল প্রকৃতির পাঠশালাতেই বেড়ে ওঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যে আঁকশি দিয়ে পাড়া যায় কল্পতরুর কাঞ্চনফল, এ হলো তেমনই এক পরিবারের দিনচর্যার বর্ণনা। এদের ‘আদিমতাপূর্ণ’ বসাবাসের শৈলীতে কোনও ‘কারিগরি’ নেই। নেই ‘সভ্যতার লেশমাত্র’ ছোঁয়া। যে আদিবাসী মানুষজনকে তাদের শিল্প, কলাভাবনা, উন্নত লোকসংগীত সত্ত্বেও আমরা হীনচোখে দেখি — মাগারাম মুচিরা যেন তাদের তুলনাতেও অনেক বেশি অনুন্নত — “চৌকো করে তোলা মাটির পাতলা দেয়াল”-এ ঘেরা “খোঁটা পুঁতে ঢালু করে বসিয়ে দেওয়া... চালার ঠাট”-এ “মহুল গাছে”র মাথায় “চালার খড়”-এর ওপর “সাউড়ি ঘাস”-এ ঢাকা আস্তানায় তারা থাকে। নিজেদের সম্পর্কগুলো যেমন অনাদরে-অযত্নে জোড়া, ঠিক তেমনি মানের চিহড় লতা দিয়ে বাঁধা তাদের কাঠপোঁতা বাড়িঘর। যার না আছে ছিরি, না আবরুর ছাঁদ, না নিরাপত্তা। বিপদেরও আসা বারণ, কারণ তাকে আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় দরোজাটুকুও নেই মুচিরামের; আছে শুধু দুর্দিনের “ভরমার”। ভুট্টা সেদ্ধ করে ল্যাটো ক’রে খেয়েও কাঁহাতক বাঁচতে পারে পাঁচ-পাঁচটি পরাণ? মাটি কেটে, পাথর ভেঙে, অন্যের ক্ষেতে লাঙ্গল ঠেলেও যখন হয় না কিছুই, তখন মানবাজারের শেঠেদের কাছে টাকা ধার ক’রে তারা বেরিয়ে পড়ে শিমূলের সন্ধানে। কোথায় পাবে ফলন্ত শিমূল, নীলকমল জানে — কিছুই তার নজর এড়ায় না; ফলন্ত গাছ দেখলেই কাঁধের লম্বা আঁকশিটা সে আকাংখার আশমানের দিকে তুলে ধরে।
তবে পরিবর্তিত কালে যখন রাতারাতি জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছে, “দরকারি ও মূল্যবান গাছগুলো লরি বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে শহরের দিকে — টাটা-চান্ডিল-পুরুলিয়ায়” — এমন আকালে হয়তো অনেক খুঁজলে “দুটো-একটা গাছ মিলে যায়”। এই গল্প সেই গাছ পাওয়া, চরম ক্ষুধা ও তারই মধ্যে “উড়ে যাওয়ার আগেই শুকনো ফল গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া”-র গল্প। এতগুলি অভুক্ত গ্রাম — অদ্ভুত যাদের নাম (ঘাগরা, কাশি-ডি, ভালুবাসা, বামনি কিংবা পিয়ারশোল) তারা সবাই বেরিয়ে পড়ে শিমূলের সন্ধানে, কেননা খাদ্যপানীয়ের অন্যতর স্রোত চোত-বোশেখের শূন্যপ্রায় নদী-পুকুর-ইঁদারার শুষ্কতার মাঝে তাদের রক্ষা করে শিমূল — তার ফাটানো ফল, তার থেকে বেরোনো তুলো — যা ঠেসে ঝুড়ি-বস্তায় ক’রে নিয়ে গিয়ে মানবাজারের আড়তখানায় বেচে পাওয়া ঐ ক’টা টাকা।
প্রায় অনেকটা অংশ জুড়ে আছে বেদনি, নীলকমল আর মাগারামের শিমূলযাত্রা। তাগিদ দেয় মাগারাম — বলে “চাঁড়ে চ না!” অথচ এরই মধ্যে ঘরের “কাজ-পাইট্ওলা” করতে হবে, নুনুর মুখ থেকে শুকিয়ে আসা মাই টেনে ফেলে “বারান্দায় বাঁধা ছাগলের নাদিপেচ্ছাপ” ঝাঁটাতে হবে, “উঠে-কে-উঠে” ইস্তক ঘুঘু-ডাকা বেলা পর্যন্ত হাজারো কাজ ক’রে ঘুঁটের ব্যাপার সামলে তবে না সে বেরোতে পারবে, দুলকি চালে। নীলকমল লুকিয়ে পড়লে সে খেজুরগাছের টঙের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বলে: “হা ভাল, তোর মাথার উপ্রে কি আছে। ভালবি ন।” ‘ভাল’- কথাটির একাধিক অর্থে প্রয়োগ আর তার সঙ্গে রয়েছে পেট “সাঁই সাঁই” করার মতন বর্ণনা, কিংবা মাগারামের ‘তুরন্ত’ আঁকশি বাড়ানোর মত শব্দচয়ন। ভালুকের ‘থাপুক-থুপুক নাচ’ যা ছোট্ট নীলকমল বেমালুম আয়ত্ত ক’রে ফেলেছে, তার সঙ্গে ‘রাঢ়ের বাজিকর’-এর অদৃশ্য ডুগডুগি সমেত ‘গ্যানঘ্যাটাগ্যান’ গান — সব মিলিয়ে গল্পটির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে গল্পের ভাষার গতিপ্রকৃতিকেও বিশিষ্ট ক’রে তোলে। তারই মধ্যে ভকু গরাইয়ের সঙ্গে গাছচুক্তা করতে এসে মানুষের প্রাচুর্য ও পরিহাস — সবই সহ্য করতে হয় বোঝে সে। যে জগতের যেমন নিয়ম: একদল প্রাচুর্য নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে, আবার মাগারামের মতো আরেক দল শুধু অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আনচান করতে থাকে”। হাস্যচ্ছলে গরাই করে মাগারামের নামের ব্যাখ্যা: “তার মানে তুঁই মাইগে মাইগে বুলিস?”
গাছচুক্তা হওয়ার আনন্দে মাগারাম আর বেদনির রোদে “ঝামা ধরা মুখে ক্ষীণ হাসি ফোটে। এই হাসি দিয়ে দিনভর অনাহারের কালিমাকে সে উপেক্ষা” করতে পারে। ভকুকে শিমূলিয়ার অর্থনীতি বোঝাতে বোঝাতে সে নিজেও বোঝে — “বঞ্চনার চিরন্তন রীতি টের পেয়েও ক্ষুধার্ত মানুষের সর্বশেষ আক্রোশ নিয়ে হামলে ওঠার পথ সে অনুধাবন করতে পারে না। বরঞ্চ এটাকেই আস্তে আস্তে সে ভেবে নিয়েছে প্রথা। নিয়তি। একদল যোগান দিয়ে যাবে, আরেক দল তার মুনাফা লুটবে।” অথচ “তুলার পসা/ কুলা কুলা” যে আর নেই, ‘মাহাজন’-দের কথা বলতে নিয়ে লারাণ কর, ভবতারণ মাহিন্দার, টুটুল দত্তরা কেন এখন প্রবাদের অতীত থেকে অন্য ব্যবসায় চলে যাচ্ছে, তাও সে বোঝে, বুঝিয়ে বলে। একটা ক্রমসৃয়মান বাণিজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মাগারাম মুচি, কালুয়া ডোম, ভদ্র মাহালী, রৈথা মুচি, বৈদ্যনাথদের আনাগোনার দলিল হিসেবে এই অদ্ভুত জীবিকার পারিপার্শ্বিক অবস্থান নিয়ে এক অসাধারণ গল্পকথা এই ‘আঁকশি’।
শেষ অংশে, যেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে পাঠক - শহুরে বাংলা ভাষার ভদ্র পাঠককুল যখন ভাবছেন — এইবার বুঝি একটা কিছু হবে শোষণ, পীড়ন অথবা নিদেনপক্ষে যৌন অত্যাচার — তখন দেখা যাচ্ছে ভকু গরাই দয়াপরবশ হয়ে গরুর জাবনার পাত্রে না-ফেলা ফ্যান বাগালকে দিয়ে জামবাটি ভরে আনিয়ে দেয় মুচি পরিবারের জন্য — যে বেদনি পুঁটুলি থেকে বের করা বড় টিনের বাটিতে ঢেলে নেয় — ভাগ্যিস সে মুখ ফুটে বলতে পেরেছিল: “বাবু, টুকু মাড়জল আছে ও দাও ন। এই নুনুটা হামদের সারাদিন লে ভখেই আছে!” তড়াক তড়াক ক’রে গাছ থেকে নেমে মাগারামও পেট-পাঁজরে মাড়জল ও সঙ্গে ‘চাটু ভাত’ খেয়ে বাঁচে। আর তার পরই আসে পথের অন্ধকার — যার বুক চিরে এগিয়ে চলে জুয়ালকাঠির শিমুলয়ালা পরিবার, পথচলার পরিশ্রম দূর করতে ধরে গোঙানির স্বরে কোনো লৌকিক গীত, আউড়ে যায় পুরুলিয়ার লোককবির রচনারাশি।
সারাটা গল্পে যেন একটা সাদা ক্যানভাসে সরু-মোটা দাগের ছবির রঙ ও রেখার ছাপ, মাগারামদের জীবনের কোনো উত্থানও নেই, পতনও — শুধু জুয়ালকাঠিতে ঘূর্ণন।
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)