রবীন মণ্ডল ২০১৮-র শুরুতে ৯০ বছরে পা রাখলেন। এই মুহূর্তে তিনি প্রবীণতম বাঙালি চিত্রকর। এখনো তিনি প্রতিদিন ছবি আঁকেন এবং সভা-সমিতি ও চিত্রপ্রদর্শনীতে যান। তাঁর এই নিরলস কর্মজীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর ছবি চিরকালের মানবযাত্রার অসামান্য চিত্ররূপ। তাঁর ছবি শুধু ভারতবর্ষে নয়, ভারতবর্ষের বাইরেও বহু চিত্রশালায় স্থান পেয়েছে। তাঁর জীবনের কিছু কথা এই সাক্ষাৎকারে লিপিবদ্ধ করা গেল। এই সংখ্যায় তাঁর সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় এবং শেষ অংশ মুদ্রিত হল।
পরবাস : আসলে সে আমলে তো শুধু ছবি এঁকে জীবিকা অর্জন হতো না, প্রত্যেককেই চাকরি করতে হয়েছে। শিল্পচর্চা করে হোলটাইমার হওয়া যেত না। সেই হিসেবে আপনি হয়তো চাকরি না করলে পারতেন না। কিন্তু আপনি এতই কাজ করেছেন যে আপনাকে সবাই হোলটাইমার হিসেবেই জেনে এসেছে।
রবীন মণ্ডল : আমার তো ওটাই মিশন ছিল ... (আর্টকে) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না।
পরবাস : সেই সময় ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে আপনার শিক্ষক কারা ছিলেন?
রবীন মণ্ডল : সেরকম ভাবে কেউ নয়। একমাত্র আমরা বিশ্বনাথদাকে চিনতুম। বিশ্বনাথ সোম, তিনি আমাদের শেখাতেন। তেমন উল্লেখযোগ্য মাস্টারমশাই ওখানে কেউ ছিলেন না। আর ওই সব জায়গায় মাস্টার বেশি থাকে না কম মাইনের জন্য। আমার ওখানে ভর্তি হবার মূল উদ্দেশ্য ছিল ন্যুড স্টাডি, লাইফস্টাডি করতে পারতাম। তবে ওখানে ভর্তি হয়ে আমার উপকারই হয়েছে।
পরবাস : আপনার শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে আপনার মিলন কিভাবে ঘটল?
রবীন মণ্ডল : ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে তখন দিনেরবেলায় পড়ত সুহাস রায়। এছাড়া শুভ্রাংশু, সত্য এরা সব ভালো ছেলে। এই করতে করতে দুচার দিন পর থেকে একই আড্ডায় গর্ভমেন্ট আর্ট কলেজ এবং ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের ছেলেরাও আসত। জি. সি. আই-এর উলটো দিকে সোডা ফাউন্টেন বলে একটা দোকান ছিল, সেখানেই আমাদের আড্ডা হতো। ওখানে আমাদের ছোটখাটো সমাবেশ হতো। বিকাশ আসছে, গণেশ আড্ডা মারত। আমরাও একটা টেবিল করে ফেলেছিলুম।
পরবাস : আপনারা যে একটা ক্যালকাটা পেন্টার্স করেছিলেন ...
রবীন মণ্ডল : সেটা তো অনেক পরে হল। প্রকাশের সঙ্গে আলাপ হবার পর আমরা ঠিক করলাম যে একটা একজিবিশন করব।
পরবাস : ক্যালকাটা পেন্টার্সের মেম্বার কারা ছিলেন?
রবীন মণ্ডল : প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরী, মহিম রুদ্র, আমি, নিখিল বিশ্বাস এবং আরো দুজন ছিল। ৬-জন না ৭-জন মিলে ক্যালকাটা এইট নাম দিয়ে আরম্ভ করলুম। দুজন জুনিয়রকে সঙ্গে নিয়েছিলুম। পরে 'ক্যালকাটা পেন্টার্স' হয়ে গেল। দু'বছর চলার পর বোম্বেতে প্রথম একজিবিশন দারুন হিট করে গেল। মানে লাগিয়ে দিলুম আর কি। আর তখন ফাঁকিবাজি করে কেউ ছবি আঁকত না। প্রকাশ, বিজন, নিখিল প্রত্যেকেই অসম্ভব ভালো। আমার একটা কমপ্লেক্স ছিল, ওরা সব গর্ভমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা, আমি নই--এই কমপ্লেক্সে ভুগতুম একটু।
পরবাস : কিন্তু প্রকাশ কর্মকার তো আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা নন।
রবীন মণ্ডল : সুযোগ পায়নি কিন্তু পড়েছিল। তাছাড়া রক্তের মধ্যে ছিল ওর। বাবার (প্রহ্লাদ কর্মকার) কাছে থেকে পেয়েছিল। ওর বাড়ির একটা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। ক্যালকাটা পেন্টার্স শর্ট টাইমের মধ্যে সোসাইটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন একটা গ্রুপ হয়ে গেল। ওদের বিকাশ এবং আরো অনেকের একটা দল ছিল। এদিকে প্রকাশ, বিজন, নিখিল বিশ্বাস আসার পর আমাদেরটা আরো বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেল।
পরবাস : ছবি আঁকার জগতে আপনার চোখের সামনে কোন মডেল ছিল? দেশ-বিদেশ মিলিয়ে? মানে যারা চিত্রশিল্পীর জগতে ... বাঙালি বা বিদেশে কাদের ছবি আপনি দেখতে ভালোবাসতেন?
রবীন মণ্ডল : তখনকার দিনে দুর্ভিক্ষের টাইম বলে জয়নাল আবেদিন নামে একজন বাঙালি শিল্পী দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে ইন্টারন্যাশানালি ফেমাস হয়ে যায়। আর আমরা চোখের সামনে দেখছি মা, খেতে দাও এইসব করছে। একটু ভাত খাবার পর একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল আমাদের বাড়ির সামনে। জ্যাঠাইমা তো ভয়ে অস্থির। আমার বাড়ির সামনে মারা গেলে তো কেলেঙ্কারি হবে। ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। ডাক্তারবাবু এসে বললেন যে ভয় নেই, ওকে একটু বসান, জল দিন, দুধ থাকে তো দিন তাহলে ও সুস্থ হয়ে উঠবে। ২-৩ ঘন্টা পরে সুস্থ হয়ে উঠল। তখন জ্যাঠাইমা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তুমি কি বাড়ি যেতে পারবে? সে বলল হ্যাঁ পারব। কোথায় যাবে? না হাওড়া ময়দান থেকে এইখানে যাব। তা কিছুটা এগিয়ে দিয়েছিল বোধহয়। দুর্ভিক্ষ আমার চোখের সামনে দেখেছি। মানুষ মরে পড়ে আছে রাস্তাঘাটে এই সবকিছুই চোখের সামনে দেখেছি।
পরবাস : এইসব ঘটনা বা দৃশ্য কি আপনার ছবিতে প্রভাব ফেলেছিল?
পরবাস : বিদেশি চিত্রকর কাকে আপনার আদর্শ মনে হতো?
রবীন মণ্ডল : ওইভাবে কার কথা বলব, বিরাট ব্যাপার ভাই। আমাদের দেশের জলবায়ুতে বহু সাকসেসফুল আর্টিস্ট ছিলেন। আর ও দেশের যেমন রেমব্রান্ট একজন অসাধারণ আর্টিস্ট। এদিকে খ্যাঁচা মার্কা ছবি করে, কিন্তু একদম অন্যরকম তিনি হলেন পিকাসো। পিকাসো যেন স্বাধীনতার মুক্তি এনে দিল। নাহলে ওইরকম ছবি হয়! তখন হাত দিয়ে যা বেরোচ্ছে মনে হয় ভাল যত্ন করে করলে ভালো হবে। পিকাসোর খুব overpowering capacity ছিল। যে যা বিশ্বাস করত, তাকে ভেঙে দিয়ে নিজের লাইনে ফেলে দেওয়ার ঝোঁক। গোটা পৃথিবীতেই তাই হয়েছে। পিকাসো, ব্রা, মাতিস এই তিনজন গোটা পৃথিবীর শিল্প জগতের চেঞ্জ করে দিয়ে গেছেন।
পরবাস : তার আগে?
রবীন মণ্ডল : আমি আধুনিক চিত্রশিল্পের কথা বললুম। তার আগে ছিল রিয়েলিস্টিক স্কুল। রুবেন, ত্রিপেন নিয়ে তখন এদেশের আর্ট কলেজে পড়ানো হয়।
পরবাস : ভ্যান গঘ-কে কি লেবেলে রাখেন আপনি?
রবীন মণ্ডল : ভ্যান গঘের আঁকার জন্য অনেক সাহস পেয়ে যাই। লোকটা তো অশিক্ষিত শিল্পী। নিজে থেকে self taught হয়ে গেছেন, কোনো শেখার ব্যাপার ছিল না। ফলে আমাদের সাহসটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পরবাস : তারও আগে ধরুন মিকেলএঞ্জেলো ....
রবীন মণ্ডল : আমি জানি, ওই পারফেকশনে আমি যেতে পারবো না, আমি চেষ্টাও করবো না। কারণ আধুনিক ছবিতে ওদের ফর্মটা ভাবা যায়, কিন্তু আমি তো চেষ্টা করলেও পারবো না ওটা। একটা মিডিয়ামকে দখল করতে গেলে যে সময় লাগে তখন আমার সে বয়স পেরিয়ে গেছে, তাই আমি আর চেষ্টা করিনি।
পরবাস : বেঙ্গল স্কুল সম্পর্কে আপনাদের কি বক্তব্য ছিল?
রবীন মণ্ডল : একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আমি নিজে খুব উৎসাহিত হইনি। কারণ ওই ধরনের কাজ করে আমি তৃপ্তি পেতুম না।
পরবাস : আমার ধারণা বেঙ্গল স্কুল অনেকটাই লালন-পালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জায়গায় স্থান দিয়েছেন। কিন্তু তিনিই আবার বেঙ্গলি স্কুলকে ভেঙেছেন।
রবীন মণ্ডল : রবীন্দ্রনাথ একাই তো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন।
পরবাস : রবীন্দ্রনাথকে আপনি শিল্পী হিসেবে কিরকম রেট করেন?
রবীন মণ্ডল : ক্রিয়েটিভ মানুষ, মাস্টার পেন্টার বলব না।
পরবাস : কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে self portrait এবং landscape ওই লেভেলের কাজ কি সেইসময় আর কেউ করেছেন?
রবীন মণ্ডল : সেটা তো অবশ্যই। রক্তের একটা ব্যাপার আছে, এমনি এমনি আকাশ থেকে তো হয় না ওটা। ওঁর খেলা করা ছবির মধ্যেও একটা অন্য ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপার অ্যাকাডেমিক বা পাশ করা লোকের পক্ষে হজম করা একটু কষ্ট হয়। যে এরাও নাম করে ফেলল, আমরা এতদিন শিখলুম। কিন্তু শিল্পটা তো হচ্ছে ভেতরের ব্যাপার।
পরবাস : রামকিঙ্কর বলেছিলেন যে "আমরা বাইরের দৃশ্যকে ধরি, উনি (রবীন্দ্রনাথ) ভিতরের দৃশ্যকে ধরেন।" রামকিঙ্করতুল্য একজন মহাশিল্পী রবীন্দ্রনাথকে এইভাবে মূল্যায়ন করেছেন।
রবীন মণ্ডল : রামকিঙ্কর একটা অন্য ব্যাপার। না, রবীন্দ্রনাথের ছবিকে কেউ তো ফেলেনি। সবাই হজম করেছে তো। শুধু এখানে নয় সারা ভারতবর্ষেই। এবং অনেকেই মনে করেন যে ভারতবর্ষে আধুনিকতার পথিকৃৎ তিনি। অন্য প্রদেশের শিল্পীরা এটা মনে করেন কিনা আমি জানি না। তবে বর্ষীয়ান শিল্পীরা মনে করেন। ব্যাকরণ শিখে ছবি করা আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছবি করছেন, আর ওই বাড়ির কালচার। তাঁর লাইন ধরলেই বোঝা যায় যে কুঁড়েঘর থেকে জন্মাননি, অন্য প্রাসাদ থেকে জন্মেছেন।
পরবাস : আপনি কালচারের ওপর জোর দিচ্ছেন, কিন্তু আমি জোর দিচ্ছি ব্যক্তিপ্রতিভার ওপর। শুধু কালচার দিয়ে তো হোত না।
রবীন মণ্ডল : তা তো বটেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে পরিবেশে লালিত হয়েছেন সে তো অন্য কেউ হয়নি। কিন্তু রামকিঙ্কর হলেন কি করে? ওই Tagorean atmosphere বলেই হয়েছেন। ওই atmosphere না হলে রামকিঙ্কর lost হয়ে যেতেন একেবারে। যতই বলা হোক গোঁফদাড়িওলা বুড়ো ভারতের গোটা শিল্পজগতকে অত্যন্ত আলোড়িত করে দিয়েছিলেন। রামকিঙ্করও ভারতীয় শিল্প জগতে একজন স্তম্ভ। যারা দেখে তারাও বলে, না এর মধ্যে অন্যরকম ব্যাপার আছে।
পরবাস : আপনি নন্দলাল বসু, যামিনী রায় সম্পর্কে কি বলবেন?
রবীন মণ্ডল : ওঁদের বিষয়ে বলব যে ওঁদের অনেক বেশি পাওনিয়ারিং ব্যাপার আছে। ওঁদের ছেড়ে দিলে রামকিঙ্কর অনেকটা পঙ্গু হয়ে যাবে।
পরবাস : নন্দলাল বসুকে ছেড়ে দিলে?
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ। এইজন্য বলছি ইনজেকশনটা কিন্তু নন্দবাবুই দিয়েছিলেন। নন্দবাবু মাস্টারমশাই হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন। যারা ওঁর কাছে পড়াশোনা করেছিল তারা বলেছেন আমাকে।
পরবাস : উনি বেঙ্গল স্কুলের টিপিক্যাল জায়গা থেকে সরেও এসেছিলেন...
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ, নন্দবাবু অনেক সরে গিয়েছিলেন। রামকিঙ্করও তাই। যখন একটু ম্যাচিওরড হয়ে গেলেন তখন পুরোনো জিনিসকে মানেননি।
পরবাস : আপনি নন্দলাল বসু প্রমুখের কাছে কখনো যাননি?
রবীন মণ্ডল : না, তবে রামকিঙ্করের কাজকর্ম আমি পাশে বসে দেখেছি। একদিন আমার দেশপ্রাণ শাসমল রোডের বাড়িতেও এসেছিলেন।
পরবাস : তার মানে আপনার কাজ উনি দেখেছিলেন?
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখেছিলেন। বলেছিলেন, "ক্যারি অন, চালিয়ে যাও। ভালো-মন্দ পরে বিচার হবে, চালিয়ে যাও।"
পরবাস : এটা তো আপনার একটা বিরাট পাওনা...
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। রামকিঙ্কর ভারতীয় শিল্পজগতে একজন স্তম্ভ। ওঁকে পলিটিক্স করে কেউ যদি আন্ডার এস্টিমেট করে সেটা ঠিক নয়। এই যে রবীন্দ্রনাথ, রামকিঙ্কর ভারতীয় শিল্পজগতে একটা উচ্চতায় রয়েছেন এটা মেটিরিয়ালি যারা খুব দক্ষ শিল্পী তাঁরা স্বীকার করতে পারেন না। আর্ট শিক্ষা করলেই যে বড় শিল্পী হবেন তার কোনো মানে নেই।
পরবাস : একটা কথা মনে পড়ল, ছোটবেলায় আপনি একবার জওহরলাল না নেতাজী কার যেন ছবি এঁকেছিলেন সেই ঘটনাটা একটু বলুন।
রবীন মণ্ডল : শিবনারায়ণ ব্যানার্জী বলে একজন লেবার লিডার ছিলেন খুব পপুলার অল ইন্ডিয়াতেই। তিনি হাওড়ায় থাকতেন ময়দানের কাছে। অরিজিনালি ছিলেন পূর্ববঙ্গের কিন্তু ডেরাটা ছিল হাওড়া। জওহরলাল এবং অন্যরাও তাঁকে খুব মান্য করতেন। তাঁরই পরিচালনায় হাওড়া ময়দানে চারদিনের একটা জনসভা হয়, তাতে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের সমস্ত বড় নেতা এসেছিল একেকদিন। তা নেহরু আসার আগে আমাকে কে একটা ছেলে বলল তুমি তো ছবি-টবি আঁকো, যদি পার একটা ছবি এঁকে দিও। তো আমি একটা বড় করে নেতাজীর ছবি এঁকে ফুল দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে গেছি, কর্তৃপক্ষ সেটা মঞ্চের ওপর ইজেলে রেখে দিয়েছিল। নেহেরু ঢুকেই দেখেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেছেন 'হু ডিড দিস?' কে একজন বলল - 'দ্যাট বয়, দ্যাট বয়।' তখন আমি সবে স্কুল ছেড়েছি। আমাকে দেখে বললেন 'ও, ইউ ডিড ইট। ওকে ওকে।' মানে ওনার রিঅ্যাকশন আমার মিটিং-এ নেতাজি কেন! শিল্পর গুণাগুণ নিয়ে উনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। দেখলেন অল্প বয়েস, উনি একটু এক্সকিউস করে গেলেন যেন। পরবর্তীকালে অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু নেহেরুকে আমার খুব ভালো লাগত। একটা চলমান লোক। মানে গোবিন্দবল্লভ পন্থ, রাজেন্দ্র প্রসাদ এদেরকে দেখলে মনে হোত এরা কি করে মন্ত্রী হয়। একটা রোমান্টিক ক্যারেকটার ছিল। মহা জ্ঞানী লোক ছিলেন। না হলে 'ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া' লেখা কি কম কথা!
পরবাস : আপনার ওপর অনেক লেখালিখি হয়েছে। আমিও একটা লেখা লিখেছিলাম, The artist as an author of human tragedy অর্থাৎ আপনাকে একজন human tragedy-র author হিসেবে আমি দেখিয়েছি। এবং যেটা আপনার ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য সেটা হচ্ছে, যে ফিগার আপনি এঁকেছেন সে ফিগার হয়তো সুন্দর নয়, কিন্তু তাতে আপনি চিরকালীন মানবযাত্রা চিত্রায়িত করে গেছেন। ফলে সেই প্রাচীনতাটা আপনার ছবির ফিগারের মধ্যে আছে। কিন্তু সবচেয়ে যেটা ইন্টারেস্টিং আমার মনে হয়েছে সেটা হল এরা প্রত্যেকেই হচ্ছে kind। প্রত্যেকেই পরস্পরকে সমর্থন করছে। প্রত্যেকেই অসহায় লোক হয়তো, কিন্তু পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে। আপনার রাজা অসহায়, তাকে খুন করা হবে, তার ঘাতকও আছে। কিন্তু সেই অসহায় রাজাকেও আরেকজন বন্ধু সান্ত্বনা দিচ্ছে, বাঁচতে সাহায্য করছে। এই যে মানবিক সহানুভূতি এবং পারস্পরিকতা এটা আপনার ছবিতে এত অসাধারণভাবে এসেছে সেটা আপনার সময়ে আর কারো মধ্যেই আসেনি। এ বিষয়ে আপনার মত কি?
রবীন মণ্ডল : এত গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এই ভাবনাটা আমার মনের মধ্যে ছিল। আর কাজ করতে করতে হয়ে গেছে, এখনও চলছে।
পরবাস : এই ৯০ বছর বয়সে পা দিয়েও আপনি নিয়মিত ছবি আঁকছেন, এটা সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়!
পরবাস : আপনার স্ত্রী মারা যাবার পর আপনি গত ১৫-১৬ বছর একাই আছেন সঙ্গে চন্দনকে নিয়ে। ওই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখছে।
পরবাস : পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আপনার কোন উপদেশ আছে?
রবীন মণ্ডল : না, না, উপদেশ কিছু নয়। কাজ করে যাও ভালোভাবে। মনে কর যদি এই তোমাকে খাওয়াবে পরাবে, দোতলা বাড়ি করাবে, তোমার স্ত্রী গাড়িতে চড়বে তাহলে ওসব ছেড়ে দাও। 'সব ঠেলে বেয়ে তরী হতে হবে পার' এই দর্শন যদি মনে থাকে তাহলে চালিয়ে যাও। সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামাফোন ওটা ধরো না।
পরবাস : এখন যে দুটো জিনিস হচ্ছে একটা অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে ঝোঁক, অনেকে শুধুমাত্র রঙ তুলি বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর একটা হচ্ছে ইনস্টলেশন। এ সম্বন্ধে আপনার মত কি?
রবীন মণ্ডল : অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি নিয়ে বলা খুব শক্ত। কে কি ফিলিংস নিয়ে করছে জানি না। ওরা বলেন এর মধ্যে দুঃখ আছে, হাসি-কান্না সবই আছে। একটা লোক ছবি দেখে একটা ইমপ্রেশন নিয়ে যায়। সে যোগ-বিয়োগ করে বলবে এটা দুঃখের ব্যাপার, কি আনন্দের ব্যাপার অত কিছুর দরকার নেই। ছবি দেখে যদি সে পেয়ে যায় তাহলে ঠিক আছে। তা নাহলে তারা বলে এ রঙ নিয়ে খেলা করেছে ভালো। যেমন জ্যাকসন পোলক। জ্যাকসন পোলকের যন্ত্রণাটা আমরা যারা ছবি আঁকি তারা বুঝতে পারি কত যন্ত্রণার মধ্যে সে ছবিগুলো করেছে। অন্যের কাছে ওগুলো অ্যাবস্ট্রাকট পেন্টিং, কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
পরবাস : ইনস্টলেশনের কোনো ভবিষ্যত আছে বলে মনে হয় আপনার?
রবীন মণ্ডল : ভবিষ্যত হবে না কেন? মডার্ন যুগ এসেছে, ঘর-বাড়ি বাড়ছে। পয়সাকড়ি বাড়ছে। আমি যদি একটা ইনস্টলেশন করি, তাহলে সেটা বিক্রি হতেও পারে। তারা সযত্নে রেখে দিতেও পারে।
পরবাস : সেটাকে কি আপনি খুব বড় মাপের আর্ট হিসেবে ধরেন?
রবীন মণ্ডল : ইনস্টলেশন যদি ঠিক করে করতে পারে তাহলে খারাপ কেন? আমি বিরাট মাপের বলব না কিন্তু একজন আর্টিস্ট রোজ পেন্টিং করছেন, একদিন একটু ইনস্টলেশন করলেন মন্দ কী? সেটা অন্যের থেকে আলাদা হবেই। ইনস্টলেশন আর্ট তখন একটা অবজেক্ট হয়ে যায়।
পরবাস : আসলে মানুষের জগতকে বুঝতে গেলে মানুষকে আঁকতে হবে এবং তার সঙ্গে তার পরিবেশকে অর্থাৎ গাছপালা ইত্যাদি। মানে নেচার আর হিউম্যান বিয়িং এই জায়গা থেকে কী ছবি সরে যাবে কখনো?
রবীন মণ্ডল : আমার তা মনে হয় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে কখনো অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজের দিকে কখনো ঝুঁকিনি। রঙ তুলি নিয়ে খেলতে গেলে আমার মনে হয়েছে আমি যেটা জানি সেটাই করব। গাছপালা, মানুষ এইসব। এখন মানুষ আঁকতে গিয়ে পুরো মানুষের মতো না হয়ে হয়তো ভূতের মতো হয়ে যায়। সেটাকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। তবে তার pictorial value আছে একটা। যেমন ভাষার মধ্যে একটা গদ্য তৈরি হয়, সেটা যিনি লিখছেন তার ওপর নির্ভর করে, আমাদের ছবির লাইনেও তাই। আর্টিস্ট যেভাবে করছে, তার মধ্যে হয়তো তার বক্তব্য থাকে। যেমন আমাদের নিখিল বিশ্বাসের ছবি। দেখলেই বোঝা যায় যন্ত্রণাকাতরতা আছে, তা থেকে কাটিয়ে ওঠার ঝোঁক আছে। একদিক দিয়ে বলব ও সাকসেসফুল। পেন্টিং-এ যে ও সব সময় ভালো করেছে তা নয়, কিন্তু ড্রয়িং-এ ও সাংঘাতিক ভালো করেছে। এই প্রসঙ্গে বলি যে বেদনা বা suffering-ই পৃথিবীতে যে কোন সৃষ্টির মূল। পেন্টিংসই হোক বা সাহিত্য। Suffering is a main source of good creative faculty.
পরবাস : আপনি একটা লেখায় লিখেছেন লাইন জমে মাস (mass) হয়ে যায়। এই কথাটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। এই কথাটার সোর্স কি বা এই কথাটার মানে কি?
রবীন মণ্ডল : না, ধর আমি একটা মুখ করছি, আমার মনে হল পেছনটা ওরকম সাদা কাগজে না করে একটু রঙ দিলে ওটা বেরিয়ে আসছে, মানে একটা কম্পমান ঢেউয়ের মতো বেরিয়ে আসছে। এই জন্য আমি মাসটা কাজে লাগাই, মানে শেডটার জায়গায় মাসটা লাগাই আর কি। মানে কম্বিনেশন অফ ফিউ লাইনস একটা মাস তৈরি করছে।
পরবাস : আপনি তো মনে হয় না জীবনে কখনো ড্রয়িং করে তারপর রঙ লাগিয়েছেন?
রবীন মণ্ডল : না, ড্রয়িং একটা roughly করতেই হবে। ডিটেলস ড্রয়িং নয়, কিন্তু কত স্পেসে কি ছাড়ব না ছাড়ব সেটা ধরতে হবে তো। তারপরে আরও সাহস বাড়িয়ে দিয়েছেন ওই পিকাসো। ওহঃ, যা খুশি করে গেছেন, আমরাও খানিকটা এঁটো-কাঁটা নিয়ে দেখি কি করা যায় এই আর কি।
পরবাস : আপনি স্প্যাচুলাই ব্যবহার করেন বেশি মনে হয়।
রবীন মণ্ডল : না, দুই-ই করি। ব্রাশও ব্যবহার করি। শুধু স্প্যাচুলাতে কাজ করা সম্ভব নয়। আমি করি না সেটা।
পরবাস : আপনি ওয়াটার কালার করেছেন কখনো?
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ। অল্প ব্যবহার করেছি। আর্ট কলেজে পড়ার আগেই দুই বন্ধু মিলে আমরা গ্রামে চলে যেতুম, সেখানে গিয়ে ওয়াটার কালার করতুম।
পরবাস : তার মানে আপনি সমস্ত রকম মিডিয়ামেই কাজ করেছেন?
রবীন মণ্ডল : হ্যাঁ, তা করেছি।
পরবাস : আমাদের দেশে চিত্রশিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন বলে আপনি মনে করেন?
রবীন মণ্ডল : দেখ, সাহিত্য বা সঙ্গীতের প্রতি আমাদের যে রুচিবোধ তা দৃশ্যশিল্পের প্রতি তৈরি হয়নি। এটা এসেছেও অনেক পরে, অতীতে ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া বাংলাদেশে প্রায় ছিলই না। এটা সম্পূর্ণভাবেই সাম্প্রতিক ব্যাপার। তাই যারা আর্ট বোঝেন না তাদের কাছে গুরুত্ব নেই। সে রামকিঙ্কর বল আর রবীন্দ্রনাথই বল। তারা বলে ঠিক আছে আমরা ঠিক বুঝি না রে। এখন কোন ছেলে যদি দুম করে একটা ছবি কিনে আনে তার বাবা তাকে বলবে এত টাকা খরচ করে ছবি কিনলি? ভালো প্রিন্টেরও একটা দাম আছে তো। আসলে অর্থনৈতিক বিন্যাসটা তো আমাদের দেশে সুষম নয়, ফলে ভালো লাগলে কোনো ছেলে যদি একটা পেন্টিং কেনে তার গিন্নীও বলবে এত টাকা খরচা করলে! কি আছে এতে? এখন যে মুহূর্তে বলবে না গো, এটা কাল আমি বিক্রী করলে ৫০০ টাকা বেশি পাবো। তখন বলবে ঠিক আছে। তবুও আমি হতাশ নই। কারণ এখন বাঙালি শিল্পীরা ভারতীয় সিনে একটা ভালো জায়গায় আছে। আর শুধু বাংলাই নয় সব প্রদেশের শিল্পীরাই কম-বেশি ভালো কাজ করছেন। তবে তার মধ্যে বোম্বে, কলকাতা বেশিরকম এগিয়ে যাওয়ার মতো কাজকর্ম করছেন।
পরবাস : আপনার সঙ্গে অনেক কথা হল, এবং এই খোলামেলা আলাপচারিতা আমাদের খুব ভালো লাগল। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
(শেষ)
(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)