Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে সন্ধ্যা ভট্টাচার্যের
লেখা


ISSN 1563-8685




দেশান্তরের কথা

ভাবনীয়, অকল্পিত এই দুর্ভিক্ষ দেখে দেশের সাধারণ মানুষও ধারণা করতে পেরেছিল যে সোনার বাংলায় এক ওলটপালট আসন্ন। তারই পূর্বাভাস এই দুর্ভিক্ষ। কিন্তু এটা বুঝতে পারেনি যে ভিনদেশী আগ্রাসীরা সোনার বাংলাকে ছারখার করবার পরিকল্পনা করছে। সময়ের নিয়মেই চলে এল ১৯৪৪ সাল, বাংলা ১৩৫১ সন। রাজনীতি আমি বুঝি না বা বোঝবার প্রয়োজন বা বয়স আমার মত এক গ্রাম্য কিশোরীর তখনও হয়নি। দেশের সেই দুঃসময়ের মধ্যেই আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলাম ও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গবাসী হলাম।

তখনো দেশভাগ হয়নি। আকাশে যখন কালবৈশাখীর প্রলয় ঝড় ওঠে তখন যেমন একটি গৃহকোণ থেকে সারা দেশের অবস্থা বোঝা যায় না, গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত মেয়ে আমার পক্ষেও আমার সোনার বাংলার সেই আগামী দুর্ভাগ্যের কথা জানা বা বোঝা কোনটাই সম্ভব হয়নি।

পরবর্তী জীবনে চলার পথের শেষে বয়সের উত্তরণের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন পিছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম আমার শৈশবের সুখস্মৃতি বিজড়িত, অমৃতরসে ভরপুর, আবাল্যের প্রিয় জন্মভূমি লাঞ্ছিত, খণ্ডিত, বিধ্বস্ত। স্মৃতিপটে যে মধুর স্মৃতিচিত্র আঁকা ছিল সে-সবের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব নিশ্চিহ্ন, রূপান্তরিত। আমার মাতৃভূমি বাংলা তখন অন্য এক দেশের অধীন, আমাদের কাছে বিদেশ, পরদেশ। মনে তখন এক তীব্র বোবা আক্রোশের সৃষ্টি হয় যা লেখনির মুখ-নিঃসৃত হয়ে বেরিয়ে আসে। সাধ্যানুসারে অতীতের কিছু বিবরণ ঠাঁই নেয় খাতার পাতায়। সেই লেখার মধ্যে বুঁদ হয়ে আঁকড়ে ধরতে চাই হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিনগুলির সুখস্মৃতিকে। লাভ করি এক আত্মতৃপ্তি, এক অনাবিল সুখ।

আবার ফিরে যাই ছেলেবেলার কথায়। সেই আনন্দমুখর দিনগুলির স্মৃতিচারণে। আমার পাশের বাড়ির মেয়ে মণিকা ছিল আমার প্রিয় সাথী। সেই মণিকার বিয়ে ঠিক হল শ্রাবণ মাসে। বাংলা দেশের বর্ষা নামকরা। আকাশ ভেঙে নামবে যখন চরাচর প্লাবিত করে দেবে। মণিকার বিয়ের দিনও সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। সকাল থেকে বিয়ের নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান শুরু হল। বেলা পড়ে এল, সন্ধে হয় হয়। বর আসবে নৌকায়। যেখানে স্থলপথ ছিল না সেখানে জলপথই ছিল ভরসা। বাড়ির বাইরে থেকে বাড়ির পিছন দিকে নদীর ধার পর্যন্ত হ্যাজাক আর ডে-লাইটের আলোয় আলোকিত করা হয়েছিল। বরের উপযুক্ততা নিয়ে মণিকার মনে খুব সূক্ষ্মভাবে একটু ক্ষুণ্ণতা লুকোনো ছিল। আমাদের মনেও একটু হাসির ভাব চাপা ছিল। বর ছিল কোনো এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতের অধ্যাপক (পণ্ডিত)।

যথাসময়ে নৌকাপথে বর এল। দেশীয় আচার অনুসারে কনেকর্তা গলবস্ত্র হয়ে বরকে আনতে গেলেন নদীর ঘাটে। সঙ্গে হ্যাজাকের আলো নিয়ে চলল চাকর-বাকরের দল। আমরাও ছুটলাম বর দেখতে। সুসজ্জিত নৌকায় বর বসে আছে বরযাত্রীদের নিয়ে। পাশের ডিঙি নৌকায় বাজনদারেরা।

সংস্কৃতের পণ্ডিত বলে আমাদের সকলের মনে টিকিওলা পণ্ডিতের যে ছবিটা আঁকা ছিল, আর মনে মনে হাসিও পাচ্ছিল সেটা উবে গেল বর দেখে। গায়ের রঙ শ্যামলা, মাঝারি গড়ন, সুন্দর মুখশ্রী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, সুপুরুষ মানুষ। তবে সেকালের রীতি অনুযায়ী মাথার চুল পণ্ডিতদের মত ছোটো ছোটো করে ছাঁটা, পিছনে একটি ছোট্ট টিকি।

যথাসময়ে বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন হল। সবাই বরকনেকে ঘরে নিয়ে গেল। নিমন্ত্রিতরা যে যার বাড়ি চলে গেল। পরদিন সন্ধ্যার সময় বরকনে বিদায় হবে। দুপুর থেকেই শুরু হয়েছে মণিকার কান্না। কান্না আর থামেই না, তাই দেখে আমরাও কান্নায় সামিল হয়েছি। এবার রওনা হবে। মণিকা বায়না ধরল যে, তার বন্ধুরা মানে আমরা কয়েকজন নৌকা চেপে ওর সঙ্গে কিছুদূর অবধি যাব। গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে আমরা সেজেগুজে মণির সঙ্গে নৌকায় চাপলাম। রাতের মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। বর্ষার জলে পুষ্ট বিস্তৃত নদীবক্ষে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে নৌকো। আগতপ্রায় শরতের ক্ষীণ কুয়াসায় চারদিকে একটা ধোঁয়াটে ভাব। ক্রমে নৌকা এগিয়ে গিয়ে পড়ল একটা ফাঁকা জায়গায়। পিছনের ডিঙিনৌকায় বাজনদারেরা অন্যসব বাজনা থামিয়ে শুধু বাঁশিতে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাটিয়ালী সুরে গান বাজাতে শুরু করল। চতুর্দিকের নীরবতার মাঝে শোনা যাচ্ছে বাঁশির মধুর সঙ্গীত আর জলের মধ্যে মাঝিদের বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ। মাথার ওপর সাক্ষী ছিল পূর্ণিমার চাঁদ।

আমাদের দেশে নদীনালায় এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ ছিল। এর নলের মত কাণ্ডটা থাকত জলের ওপর। শালুক পাতার মত দেখতে পাতাগুলি ছিল আকারে ছোটো। পাতাগুলি জলের সঙ্গে লেপটে ভেসে থাকত। দিনের বেলা ছাড়া খুব একটা নজরে পড়ত না। ফুলগুলি হত সাদা, আর আকারে খুব ছোটো। দেশীয় ভাষায় এগুলিকে বলত ‘কেওরালী’। রাতে নদীর জলের কোন রঙ বোঝা যায় না, কালো দেখায়। যদিও জলের কোন বর্ণ হয় না। সেই নদীবক্ষের কালো জলে চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছিল অসংখ্য সাদা সাদা ফুল। মুক্তোর মত লাগছিল। মাথার ওপর জেগে ছিল রূপার থালার মত চাঁদ, জলে ছিল মুক্তার দানার মত ভাসমান ফুল আর নৌকার ভিতর থেকে ভেসে আসছিল বরকনের গলার বেলফুলের মালার ভুরভুরে সুগন্ধ। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল। এক স্বর্গীয় পরিবেশে আমরা বসে ছিলাম নৌকায়। সেই স্বর্গীয় দৃশ্য আর সেই অনুভূতি আজও আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, অনুভব করি। কিছুক্ষণের জন্য মন চলে যায় সেই হারানো গ্রামবাংলার পরিবেশে।

আর চলমান নৌকার সাথে, আকাশের পূর্ণচাঁদের প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব, চলমান শান্ত নদীর বক্ষে, সেদিন ধরিত্রীর এই অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম যে কতক্ষণ, সে-কথা এই দীর্ঘ বৎসরেও ভুলি নাই।

ক্রমে নৌকা এগিয়ে গ্রামের শেষ সীমানায় এসে গেছে, এবার আমাদের উঠতে হবে। আবার মণির কান্নার সুর বের হল। আমরা চলে এলাম বাড়ি।

ইহার পর মণির বর একবার আমাকে একটি পত্র লিখেছিল। সে পত্রের এত সুন্দর মার্জিত রুচি, আর সাংস্কৃতিক ক্ষমতা ও শালীনতার পরিচয়ে সকলের কাছেই খুব সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।

ইহার পর দীর্ঘকাল দেশ বিভাজনের ফলে কারো সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। দীর্ঘদিন পর অধুনা পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকালে জানতে পেরেছিলাম দুই ছেলে রেখে মণি ইহলোক ত্যাগ করেছিল। শুনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আর তাই আমার লেখায় মণির স্মৃতি কিঞ্চিৎ ধরে রাখার অভিপ্রায়।

যাক সে-সব কথা। ১৯৪৪ সালে আমার বয়স পনের পার হয়ে ষোলর কোঠায় পা দিয়েছে। সঙ্গীসাথি যারা তাদের কারো বিয়ে হয়ে চলে গেছে। যারা বাকি এখনও তারা এখন ঘরবন্দি কারণ এখন বড়ো হয়ে গেছে কাজেই যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো সঙ্গত নয়। ইচ্ছামত একা কারো সাথে কারো দেখা করা সম্ভব নয়।

যদি দৈবাৎ কারো সাথে কারো দেখার সাধ জেগেছে, তবে গুরুজনের অনুমতিক্রমে, ছোটো কিংবা বড়োভাই বোনের সাথে অথবা বাড়ির প্রবীণা কোন কাজের লোকের সাথে ভিতরবাড়ির উঠান দিয়ে একে অপরের বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা, ফূর্তি-আমোদে সময় কাটাতে পেরেছে। আমার মনে পড়ে একবারের কথা। আমাদের গ্রামের উত্তরের পাড়ায় ডাক্তারের মেয়ে মিনতি। এই মিনতি আবার আমাদের ছোটোবেলায় পুতুলের বিবাহসূত্রে পুতুল কনের মা, সেই সম্পর্কে বেয়ান। অতএব বড়ো হয়ে নিয়মিত পুতুল খেলার পাঠ উঠে গেছিল বটে তবু একজন আরেকজনকে দেখলেই বেয়ান বলে সম্বোধন করতে ভুলতাম না।

একদিন গ্রীষ্মের দুপুর বাড়ির প্রবীণা কাজের লোক বুড়িকে সঙ্গে নিয়ে মিনতি এল আমাদের বাড়ি। মিনতিকে দেখে আমারও খুব আনন্দ হল মনে। রান্নার আঙিনায় অনেকক্ষণ বসে নানারকম গল্প গুজব করলাম। বড়ো হয়ে গেছি বলে এখন আর চু-কিৎকিৎ, বা গোল্লাছুট জাতীয় ছোটোছুটি খেলা হবে না। অতএব রান্নার আঙিনায় বসে মাটিতে দাগ কেটে ষোলগুটি খেলার ঘর তৈরি করে, তাতে ষোলগুটি খেললাম।

ছোটোবেলায় খেলার মধ্যে রান্নাবাটি খেলাটা ছিল অন্যতম খেলা। আমার বড়োবৌদি ছিল বারাণসীর, মেয়ে অতএব বৌদি যখন বাপের বাড়ি থেকে আসত তখন আমার জন্য নিয়ে আসত বিভিন্ন রকমের খেলার সামগ্রী। বারাণসীতে কাঠের খেলনা পাওয়া যেত। নিখুঁত বিভিন্ন রং-সমাহারে চিত্রিত সুন্দর খেলনা। বৌদি একবার আমাকে এনে দিয়ে ছিল কাঠের তৈরি একটি চিত্রিত ঘড়া আর একটি ঘটি। তার সঙ্গে রান্নাবাটির সরঞ্জাম। যেমন পেতলের ছোট্ট হাঁড়ি ঢাকা-সমেত, পেতলের হাতা খুন্তি, গামলা, কড়াই, ছোট্ট একখানা বঁটি।

মনে পড়ে খুব ছোটোবেলায় একবার এমনি এক বর্ষার দিনের কথা। দিন রাত অনবরত বৃষ্টি। দিনের পর দিন এত বৃষ্টি যে সূর্যদেবের মুখ দেখা যায় না। হাট বাজার সব বন্ধ। বড়োরা ছাতা, মাতলা মাথায় দিয়ে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারছে। আমরা ছোটোরা বারান্দার কোণে রান্নাবাটি খেলার সরঞ্জাম নিয়ে খেলতে বসেছি।

আমদের দেশে, বসতবাড়ির চর্তুদিকে বেড়া দেওয়া হত একরকম কাটা গাছ দিয়ে তাকে বলা হত মেন্দি। এই মেন্দি গাছ প্রতি বৎসর সমান করে ছেঁটে না দিলে বড়ো হয়ে যেত। এই গাছের ফল হত ছড়া ধরে। ফলগুলি দেখতে ছিল অবিকল ছোলার মত (বুটকলাই) হলুদ টুকটুকে রং। এই ছোলাকৃতি মেন্দির ফলগুলি দিয়ে তৈরি করতাম খেলার রান্নায় “ছোলার ডাল"। ছিটে রং পাতাবাহারের পাতা হত পুঁটিমাছ। আনারসের পাতা হত বোয়াল মাছ। এইরকম নানা আকৃতির উদ্ভিদের পাতায় তৈরি হত নানারকম উপচার। বনজঙ্গলে একরকম লতানো গাছ ছিল, তার পাতাগুলি চটকে রস বের করে এই রসের সাথে খানিক চুন মিশিয়ে দিলে, সেই পাতার রস খানিকক্ষণ বাদে জমে দই-এর মত হয়ে যায়। এই পাতার রস নারকেলের মালায় জমিয়ে নিয়ে তৈরি হত খেলার রান্নাবাটিতে দই।

আমাদের পূবপাড়ায় চুনী নামে খুব ঝগড়াটে একটি মেয়ে ছিল। বয়সে আমাদের থেকে কিছু বড়ো ছিল। এই ঝগড়াটে স্বভাবের জন্য খেলার সাথীদের সঙ্গে ওর খুব একটা বনিবনা ছিল না। কাজেই এই চুনী নামের মেয়েটি নিজেকে খুব একা মনে করত। খেলার সাথীদের সাথে ছিল ওর আড়ি। একদিন রান্নাবাটি খেলার আসর বসেছে। আমাদের বাড়ি খুব জমজমাট। চুণী তখন আমাদের সাথে ভাব করার উদ্দেশ্য নিয়ে করল কী, কতগুলি পাকা হলুদ রঙের মান্দার পাতা আর ফুল নিয়ে এসে বলছে, “এই তোরা আমাকে খেলায় নিবি? দ্যাখ তোদের খেলার জন্য পাকা কাঁঠাল এনেছি।”

আমাদের মধ্যে বিমলা উঠে বলল, “তোকে খেলায় নিতে পারি কিন্তু তোর গলায় অনেক ময়লা জমে আছে। আগে পরিষ্কার কর তবেই নেব।”

কিছুদিন আগে চুনী ম্যালেরিয়ায় ভুগেছে বলে স্নান-টান নেই। তাই ওর গায়ে এত ময়লা। চুনী তখন নিরুপায়। দীর্ঘদিন সাথীদের সাথে আড়ি থাকার পর অনুকূল পরিস্থিতি দেখে রাজি হয়ে গেল গায়ের ময়লা তোলায়। পরনের কাপড়ের কোণা আঙুলের ডগায় পেঁচিয়ে মুখ থেকে থুতু দিয়ে ভিজিয়ে ঘসে ঘসে ময়লা তুলে এসে খেলায় যোগ দিল। যাইহোক কিছুদিন বাদে শুনতে পেলাম চুনীর বিয়ে। তারপর একদিন সে শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়ে স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল।

দেশগাঁয়ের বিপর্যয়ের বহু বৎসর পর চুনীর সাথে দেখা হয়েছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গে। ছেলেমেয়ে নিয়ে পুরোমাত্রায় সংসারী। চুল পেকে বুড়ি হয়ে গেছে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দেখামাত্রই এক গাল হেসে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোর মনে পড়ে? পাকা মান্দার পাতা পেয়ে দীর্ঘদিন আড়ির পর ভাব হয়েছিল তোদের সাথে।” পুরানো কথা মনে করে সেদিন প্রাণ খুলে কি হাসাহাসিই না হয়েছিল!

ছুটন্ত ঘোড়াকে শিকলে আবদ্ধ করলে তার মনের ছুটন্ত গতি অবরুদ্ধ অবস্থায় সর্বক্ষণ দিক দিগন্তে ছুটে মরে। বড়ো হয়ে গেলাম বলে সেই ঘোড়ার শিকলে যেন আটকা পড়ে গেলাম। বাল্য চাপল্যে পুরাদস্তুর ভাটা পড়ে গেল। প্রিয় সাথী যারা, তারা অধিকাংশই যে যার ভাগ্যানুসারে শৈশবের আনন্দমুখর দিনগুলিকে পিছনে ফেলে রেখে, নিয়তির অমোঘ টানে চলে গেল নিজ নিজ সংসারে। দেহমনের ঘটল রূপান্তর। শুরু হল হাসি, কান্না, জয়, পরাজয়, উত্থান, পতনের ঘূর্ণাবর্ত।

এই রূপান্তরের সময়ের একটা স্মৃতি মনে আসছে। এইখানে সে-কাহিনী বলি। আমাদের গ্রামের জ্ঞাতি সম্পর্কে এক ভাইপো ছিলেন। বয়সে প্রবীণ। কর্মস্থল থেকে অবসর গ্রহণের পর, সপরিবারে চলে এলেন গ্রামের বাড়িতে। ওনার তিনটি ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বপ্রথম কন্যা নীলিমা আমারই সমবয়সী।

গ্রামের বাড়ির ভিন্ন পরিবেশে নীলিমা সবসময় মনে একটু নিরুৎসাহ বোধ করত। প্রথমা কন্যাকে সুশিক্ষায় পারদর্শী করার অভিপ্রায়ে তার বাবা অপেক্ষাকৃত দূরের কোন এক গ্রামের একজন গানের উস্তাদকে নিয়োজিত করল কন্যাকে ঘসেমেজে গানে বাজনায় পারদর্শী করে তুলতে।

প্রতি সপ্তাহে উস্তাদজি আসেন গানের তালিম দিতে। তবে তাতেও সঙ্গীসাথীহীন নীলিমার কোন বিশেষ পরিবর্তনের কোন লক্ষণ না দেখে একদিন নীলিমার মা বিকালবেলায় তাকে নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি বেড়াতে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এলেন আমাদের বাড়ি।

তখনকার দিনে পুত্রবধূ বা সেইস্থানীয়রা শ্বশুর-শাশুড়ীস্থানীয়দের, ঠাকুর বা ঠাকরুন বলে ডাকত। তবে শ্বশুরকে মুখোমুখি ঠাকুর বলেও সম্বোধন করার কোন নিয়ম ছিল না। চলতি সময়ে যেমন শ্বশুরকে অবলীলায় মাথায় ঘোমটার পাট চুকিয়ে উচ্চস্বরে বাবা বাবা করে মাতিয়ে দেয়, তখনকার দিনে সে-নিয়মও ছিল না। পুত্রবধূরা শ্বশুরের সামনে ঘোমটায় মুখ ঢেকে থাকত।

নীলিমার মায়ের খুড়শাশুড়ী হলেন আমার মা। অতএব মা নীলিমার মায়ের শাশুড়ীস্থানীয়া। কাজেই তাঁকে ঠাকরুন সম্বোধন করতে হবে। আবার, জ্যেঠতুতো বা খুড়তুতো অথবা জ্ঞাতি সম্পর্ক বা পড়শি হিসাব করলে একেকজনের বহু ঠাকুর বা ঠাকরুন, বহু জ্যাঠা জেঠি বা খুড়া খুড়ি হয় গাঁ-ঘরে। অতএব তফাৎ বোঝাবার জন্য তাঁদের একেকজনকে ঠাকুর ঠাকরুন বা অন্য গুরুজন-সম্বোধনের আগে বিভিন্ন বিশেষণ যোগ করা হত। কেউ বড়ো ঠাকুর বা ঠাকরুন, কেউ মধ্যম, কেউ ছোটো, কেউ বা গোরা, কেউ বা রাঙ্গা। আমার মাকে ডাকা হত গোরা দিয়ে। তিনি কারো কাছে গোরা জ্যেঠি, কারো গোরা খুড়ি, অথবা সম্পর্কভেদে গোরা দিদি, গোরা ঠাকরুন নামে সম্বোধিত হতেন আলাপ আলোচনার ফাঁকে।

তা বাড়িতে এসে আলাপচারির ফাঁকে নীলিমার মা তাঁর গোরা ঠাকরুনের কাছে অনুমতি চাইলেন, তাঁদের বাড়িতে গানের ঘরোয়া আসরে আমাকে নিয়ে যাবেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন আর দিয়ে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিলেন। মা আপত্তি করলেন না।

যাই হোক তো এইভাবে যাওয়া আসা আর গান বাজনায় আমার সাথে নীলিমার সখীত্বের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠল। একদিন বিকালবেলায় নীলিমা তার ছোটো ভাই নন্দকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি এল। এসেই নন্দকে বিদায় দিল এই বলে যে কিছুক্ষণ পরে এসে আমাকে নিয়ে যাবি।

নন্দকে পাঠিয়ে দিয়ে সে আমাকে বলল, “চল নির্জন জায়গায় গিয়ে একটি জিনিস দেখাব।”

পূর্ণ উৎসাহ নিয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ির পিছনদিকে নির্জন জায়গায় নানাবিধ বড়ো ছোটো গাছের সাথে মাঝারি ধরনের একটি জাম গাছ ছিল। সপ্তাহে একবার করে মালি আসত এসব গাছের তলাগুলো একবার ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করতে।

দেশে একটি সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তাদের কাজ ছিল প্রতি বাড়ি সপ্তাহের এক একদিন এই সমস্ত অপরিষ্কার জায়গার আর্বজনা পরিষ্কার করা। মাসান্তে যৎসামান্য অর্থ ছিল এদের পাওনা। এছাড়া কোন উৎসব অনুষ্ঠানে এদের প্রাপ্য ছিল প্রচুর।

এই মালিদের মধ্যে একজন ছিল আমাদের বাড়ির মালি, তার নাম রমণী। রমণী মালির ঝাঁট দেয়া পরিষ্কার জায়গায় জামগাছে একটি দোলা টাঙানো ছিল। এই জাম গাছের লাগোয়া নানা জাতের গাছ এবং কয়েকটি পেয়ারা গাছও ছিল। পাকা পেয়ারার সুবাদে বিভিন্ন জাতের পাখির মেলা বসত। গাছগুলিতে রকমারি পাখিদের বিভিন্ন রকমের সুললিত আওয়াজের সাথে ঘুঘুর তান্‌, কুবো (হাঁড়িচাঁচা) পাখির থেকে থেকে একঘেয়ে ডাকের সঙ্গে বনের নির্জনতা মনোরম ও উপভোগ্য হয়ে উঠত।

এই জামগাছের দোলায় বাড়ির বৌয়েরাও অবসরক্ষণে পেয়ারায় কোঁচড় ভর্তি করে নিয়ে আপন মনে চিবাত আর দোলায় দোল খেত। বনের চিরপরিচিত জীবজন্তু আর পাখির দল ছাড়া সেখানটাতে আর কোন মনুষ্যের গতাগম্য ছিলনা।

যাইহোক তো নীলিমা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বসল ওই দোলায়। আমাকে জোরে দোল দিয়ে দোলায় উঠে বসে জামার ভিতর থেকে কয়েকটা চিঠি বের করল। ব্যাপার কী জানতে চাইলাম। তা দেখি, ব্যস্ততার সাথে চিঠিগুলো খুলছে আর হেসে কুটিপাটি হয়ে বলছে, “ঠাকমা ঠাকুর্দার গোপনীয় চিঠি। বিছানার তলা থেকে চুরি করে এনেছি তোকে দেখাব বলে।”

দেশান্তরে বৃদ্ধ স্বামীর তৃতীয় পক্ষের যুবতী স্ত্রীর গ্রামের বাড়ি থেকে পাঠানো পত্রে আকার-ইকার-শূন্য লেখায় শুধু বাড়ির চাকর বাকরের নামে অনুযোগ। পান সুপারি আর দোক্তা (তামাক পাতা) পাতার অভাব। তাছাড়া আসার সময় একখানা সিনারি পেড়ে কাপড়, একখানা সেমিজ ইত্যাদি ইত্যাদি বায়না। পত্র লেখার ছিরি দেখে সেদিন দোলায় বসে আমরা কী হাসাহাসিই না করেছিলাম!

যাই হোক তো এভাবে চলতে চলতে এল আশ্বিন মাস। নীলিমার বাবার মানত দুর্গাপূজার তোড়জোড় চলছে। প্রতিমা তৈরি প্রায় শেষ। তখনকার দিনে কোন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাড়তি আনন্দের উপকরণ ছিল নানারকম পালাগান, যাত্রা ইত্যাদি।

তবে যুগ পরিবর্তনের সাথে এইসব বিনোদনের পদ্ধতিতে নতুন জিনিস যোগ হয়েছিল। আমাদের সময় পালাগান ছাড়াও বসত ঘরোয়া গানের মজলিস আসর। উৎসব বাড়ির কাছারিঘরে। প্রতি বাড়িতেই থাকত কিছু না কিছু বাদ্যযন্ত্র। যেমন খোল, করতাল, বিভিন্ন ধরনের বাঁশি। বিশেষ করে বাংলার ঘরে ঘরে বাঁশের বাঁশি ছিল অন্যতম। সেতার, এস্রাজ, তবলা, ডুগি, হারমোনিয়াম তো ছিল সর্বজনীন। এই সব বাদ্যযন্ত্রের সুদক্ষ শিল্পীগণ আপ্যায়িত হয়ে আসত উৎসব বাড়িতে। এই সব গাইয়ে-বাজিয়ে আর শ্রোতাদের পানভোজন বলতে ছিল নানারকম সুগন্ধি মশলাযুক্ত পান--যেমন এলাচ দানা, জৈত্রী, চুয়া ইত্যাদি। প্রমাণ আকারের বাটা সাজিয়ে রাখা হত পানের সরঞ্জাম দিয়ে। সেই সঙ্গে সারি সারি লম্বা নলযুক্ত ফার্‌সী হুঁকা। তাতে সাজিয়ে দেওয়া হত বিভিন্ন সুগন্ধি তামাক, যেমন খাম্বিরার তামাক। আর থাকত অগুন্‌তি ব্যস্ত-ত্রস্ত চাকর-বাকর, পান-তামাকের জোগানদার হিসাবে।

শুরুতে এই সব গানের আসরে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে আর পিত্রালয়ে আগত কোন বয়স্ক মহিলা ছাড়া দর্শক বা শ্রোতা হিসাবে কোন স্ত্রীলোকের উপস্থিতি ছিল গুরুতর নিন্দনীয়। তবে ক্রমশ আধুনিকতার সূচনায় গ্রাম দেশে মৃদু পরিবর্তন দেখা দেয়ায়, বড়ো মেয়েদেরও কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে বাহির বাড়িতে এসে গানবাজনা করার নিন্দনীয়তায় কিছুটা ভাঁটা পড়েছিল। তবে বেশভূষায় বা হাবেভাবে অত্যন্ত সংযত থাকতে হত।

এই ভিতরবাড়ির বাইরে বের হয়ে বড়ো মেয়েদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রচলনটা এসেছিল আমাদের সময়ে। তবে অল্প সময়ের জন্যই তা পেয়েছি আমরা। এর পরপরেই রাজনৈতিক কারণে দেশগাঁয়ের আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার সূচনা দেখা দিল। সেই সময়ই বিবাহ এবং দেশছাড়া।

সেইসব আনন্দমুখর দিনের সুখস্মৃতিকে অন্তত কিছুটা ধরে রাখার অভিপ্রায়ে আমার এই সীমিত জ্ঞানের ক্ষুদ্র প্রয়াস। যাই হোক-- ওস্তাদের কাছে নীলিমা জোরদার তালিম নিচ্ছে। কারণ পূজামণ্ডপের আরতির পর মেয়েদের গানের আসর বসবে। পূজার ছুটিতে আমার মেজদা এল বাড়ি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মায়েদের আমলের সেই পুরানো কথা আর সুরের গানে মন ভরে না। অতএব নতুন গানের বায়না জানালাম মেজদাকে। ছোটোবেলায় শোনামাত্র হুবহু মুখস্থ করার ক্ষমতা থাকায়, সে রাতে পূজামণ্ডপে গাইবার জন্য মেজদার কাছ থেকে শিখে নিলাম দু’খানা গান। তার কিছু কিছু আমার এখনও মনে পড়ে। গানদুটি ছিল এই রকম—

প্রথমটা—

চোখের জলে পুজব এবার
উমা মায়ের চরণ দুটি
বলবো মাগো কৃপা কর
দশভূজা মূর্তি ধর
দশহাতে মা বিনাশ কর
অসুর যে ঐ আসছে ছুটি।


দ্বিতীয়টি—

আজি এ শারদ
বিজয়া গোধূলী
কেন এল শুধু বেদনা ভরা
চন্দন কাঁদে পুষ্পথালায়
বেণুবনে আজ বায়ু কেঁদে যায়
হারানোর ব্যথা বুক ভরা নিয়ে
কাঁদে বার বার শ্যামল ধরা
কেন এল.....বেদনা ভরা
চরণের ছায়া রেখে যাও ঘরে
আসিবে মা তুমি বরষের পরে
ভুলো না ভুলো না শারদ প্রতিমা
মনে রেখো মাগো দুখ হরা।
যাই হোক তো এই ভাবে নিলীমার সঙ্গে সখিত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠল। একদিন কেউ কাউকে না দেখলে যেন দুজনেই যেন থাকতেই পারে না। দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে চলল। এল ১৯৪৬ সন বাং ১৩৫২। আমার ভাগ্যে অদেখা বদলের প্রথম তরঙ্গ জাগল সেই বছর।

(ক্রমশ)