পরের দিন সাংবাদিক বিমল মিশ্রের পালা।
উনি প্রথমেই একটি ডিসক্লেমার দিলেন—এ কদিন ধরে শুধু হিন্দুসমাজের জাতপাত নিয়ে কথা উঠেছে। আমি একটু ইসাই (ক্রিশ্চান) ও পাঠান (মুসলমান)-দের নিয়েও গল্প শোনাতে চাই। কারও মনে আঘাত লাগলে আগেভাগে মাপ চেয়ে নিচ্ছি। কোন ধর্মকে ছোট করে দেখাতে চাইনে। ভালোমন্দ সব জায়গায় আছে।
—অ্যাই ব্যাটা মিশির! বেশি জ্ঞান দিবি না তো! আমরা কাউকে অসম্মান করিনে। তুই তোর গল্প শোনা, জম্পেশ হওয়া চাই। নইলে ফাইন।
দেবাংগন থাকতে পারে না—একটু খোলসা করবেন কি? জাতপাত তো খালি হিন্দুদের মধ্যে আছে। শিখ-মুসলিম-ইসাইদের মধ্যে জাতপাত কোথায়?
—আরে না রে! তুই এখনো ছেলে মানুষ। হিন্দুসমাজের ছোঁয়া সবাই পেয়েছে।
ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখ—রামগড়িয়া শিখ ও রণধাওয়া শিখদের মধ্যে বিয়ে হয় না। মুসলিমদের মধ্যে সৈয়দ বা কুরেশিদের পরিবারের সঙ্গে অস্পৃশ্যদের থেকে মুসলমান হওয়া পরিবারের সম্বন্ধ হয় না। ক্রিশ্চানরাও সম্বন্ধ হওয়ার সময় খোঁজ নেয়—পরিবারটি হিন্দু থাকার সময় কোন জাত ছিল।
তামসকর বললেন—চা এসে গেছে। চুমুক দিয়ে শুরু কর দিকি!
এটা জানেন তো, বছর তিন আগে, এই শহরের নামকরা স্কুলটিতে সায়েন্স এগজিবিশনের সময় ক্লাস টেনের দুটি ছাত্রের তৈরি মডেলটি দ্বিতীয় দিন থেকেই তুলে নেয়া হয়। তারপর ছেলের বাবা কোর্টে কেস করে।
—কেন? কেন?
—মিশনারি স্কুল। ফাদার জনের খেয়াল হল যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে তৈরি মডেলটি বাইবেলের সৃষ্টি-তত্ত্বের বিরোধী। উনি সায়েন্সের টিচারকে কড়কে দেন এই বলে যে ঈশ্বর ছয়দিন পরিশ্রম করে এই দুনিয়া বানিয়েছেন। তারপর রোববার বিশ্রাম করেছেন। তার জায়গায় এসব কি হাবিজাবি পড়ানো হচ্ছে? বাঁদর থেকে মানুষ?
উত্তরে সায়েন্স টিচার ওঁকে বায়োলজির বই দেখিয়ে ইভ্যোলুশনারি থিওরি বোঝাতে গেলে উনি হাত তুলে টিচারকে চুপ করতে বলে নিজে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন যদি টিচার মনে করেন যে ঈশ্বরের ছয়দিন ধরে নির্মাণ ও সপ্তমদিনে বিশ্রাম নেয়ার থিওরিটি মিথ্যে তাহলে তিনি যেন রোববার দিন বিশ্রাম না নিয়ে স্কুলে চলে আসেন।
পরদিন থেকে ওই মডেল এগজিবিশন থেকে তুলে নেয়া হল।
মডেল যারা বানিয়েছিল তাদের একজনের বাবা আদালতে নালিশ করলে অনেক জলঘোলা হয়।
এবার মুখ খুলেছেন কাকা গোপালদাস —পণ্ডিতজী, বাজে কথা বলবেন না। ওটা ভালো স্কুল। আগে আমি পড়েছি, এখন আমার ছেলে পড়ে। আর বিজ্ঞানের ক্লাসে এখন ডারউইনের বিবর্তনবাদ দিব্যি পড়ানো হয়।
—দূর ব্যাটা সিন্ধি! নিজেই তো বললি 'এখন' পড়ানো হয়। তার মানেই 'তখন' বা 'কখনো কোন এক সময়" পড়াতে বাধা ছিল। ওটা টিউশনে বা বাড়িতে নিজে নিজে পড়তে হত।
—আমি বলছি কি সে হল আদ্যিকালের কথা। হ্যাঁ, ওই ফাদার জন বেশ খিটখিটে গোঁড়া ফান্ডামেন্টালিস্ট ধরনের ছিল। ব্যাটা বিয়ে করেনি, বাচ্চা পয়দা করেনি। ও সৃষ্টিতত্ত্বের কি জানবে? তবে ওতো কবে বদলি হয়ে গেছে। এখনকার ফাদার—
—চুপ কর! তাহলে এ নিয়ে আর একটা গল্প শোনাই।
তখন সবে একটি স্থানীয় হিন্দি দৈনিকে সাংবাদিক হিসেবে ঢুকেছি। অল্প মাইনে হলেও মাসের দশ তারিখের মধ্যে দিয়ে দিত। কিন্তু ট্যুরের জন্যে মোটর সাইকেলও দিত না। বস বলত—পেট্রলের পয়সা কে দেবে?
তাই বাসে-ট্রেনে ভ্রমণ আর শহরের মধ্যে সাইকেল অথবা হন্টন।
সেসব দিনে আজকের ঝাঁ চকচকে ভলভো বাস-টাস কোথায় ছিল? সরকারি কি বেসরকারি—সবার শক আপ খারাপ, বডি মুড়ির টিনের মত ঝরঝরে।
এমনি এক জষ্টির দুপুরে চাঁদিফাটা রোদ্দুরে শহর ছেড়ে ধমতরি যাব বলে একটি সরকারি বাসে বসেছি। স্থান পেলাম একেবারে পেছনের লাইনে। মেজাজ গেছে খিঁচড়ে। বাস গর্তে পড়ে ব্রেক কষলেই এই সীটগুলোর যাত্রীদের ছাদে মাথা ঠুকে যায়। কন্ডাকটার নীচের ঢাবায় দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিচ্ছেন। অধিকাংশ যাত্রী গরমে কাহিল হয়ে ক্লোরোফর্ম নেয়া রোগীদের মত অচেতন ভঙ্গিতে ঝিমোচ্ছে।
এমন সময় একটা কর্কশ আওয়াজে চটকা ভেঙে গেল। বাসে উঠেছে ঝোলা কাঁধে সাদা জামাকাপড় পরা একজন কুচকুচে কালো লোক। স্পষ্টঃ ওরাওঁ আদিবাসী থেকে ক্রিশ্চান হয়েছে।
কিন্তু ও কোথাও বসার চেষ্টা না করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্যাগের থেকে কিছু চটিবই বের করে নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছেঃ
"প্রভু কী বাণী! প্রভু কী বাণী! মাত্র এক রুপিয়া, এক রুপিয়া!
উঠো ভাইয়োঁ! জাগো! পড়ো প্রভু যীশু কী বাণী! সির্ফ এক রুপিয়া! ওনলি ওয়ান রুপি, স্যর!"
কিন্তু গরমে-ঘুমে ধুঁকতে থাকা অচেতন জনগণ না বই কিনল, না নড়ে বসল।
মানবজাতির এই গেঁড়েপনায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে সেই লোকটি লেকচার দেয়া শুরু করলঃ
"আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। এই অমূল্য মানব জীবন নিয়ে কি করবেন একটুও ভাবছেন না? জীবনের উদ্দেশ্য কি তা জানার আগ্রহ নেই? আরে, প্রভুর বাণীর বই কিনে দেখে নিন, সব বুঝতে পারবেন। শুধু পেটপুজো আর বাচ্চা পয়দা করা? এ তো পশুপাখিও করে।"
এবার লোকজন একটু আড়মোড়া ভেঙে ওর দিকে তাকাল।
এতে উৎসাহ পেয়ে ও একজন হাটুরে লোককে জিগ্যেস করল—আপ জরা বতাইয়ে তো, ঈশ্বর ইস দুনিয়া কো কিঁউ বনায়া হ্যায়?
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল—ঈশ্বর কো খুদকো নহী মালুম।
ভগবান নিজেই জানে না কেন বানিয়েছে।
ওর রক্তচক্ষু এবার আমার দিকেঃ
—মানে? কি বলতে চান?
—নতুন কিছু বলছি না। মুকেশের গানটা শোনেন নি?
"দুনিয়া বনানেওয়ালে, ক্যা তেরা দিল মেঁ সমায়ী?
কাহে তো দুনিয়া বনায়ী, হায়! কাহে তো দুনিয়া বনায়ী?"
এবার ও উৎসুক জনতার দিকে ফেরে।
"শুনলেন তো? দু'পাতা ইংরেজি পড়েছে, হজম হয় নি। বলে কি কেন বানালেন ভগবান নিজেই জানেন না। হুঃ এই যে বাসে আপনারা বসে আছেন এটা। সরকারি বাস। মানে সরকার বানিয়েছে। তো সরকার কি জানে না কেন বাস বানিয়েছে? নিশ্চয় জানে, তাই তো?
তেমনি ভগবানও জানেন উনি কেন এই দুনিয়া বানিয়েছেন। শুধু জানি না আমরা, দু'পাতা ভুল ইংরেজি পড়ে বড় হওয়া লোকজন।
ডারউইন বলে এক ইংরেজ সাহেব লিখেছেন যে একজোড়া 'বেন্দরা-বেন্দরি সড়ক পর চুতর ঘিঁষতে ঘিঁষতে ধীরে ধীরে একদিন খড়ে হো গয়ে অউর ইনসান বন গয়ে।
[একজোড়া বাঁদর-বাঁদরী রাস্তায় পোঁদ ঘষতে ঘষতে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল আর দুনিয়ায় মানবজাতির আবির্ভাব হল।]
এমন যুক্তিহীন হাস্যকর কথা কখনো শুনেছেন? এইসব আলতু-ফালতু চিজ আধুনিক স্কুলে পড়ানো হয়।"
আমার বাক্যি হরে গেছে। ভাবছি ডারউইনের বিবর্তনবাদের কী গ্রাফিক বর্ণনা! কী অসাধারণ চিত্রকল্প!
এবার বাসের অধিকাংশ জনগণ প্রচারকের সঙ্গে সায় দিয়ে মাথা নাড়ল, বই বিক্কিরিও শুরু হল।
হই-হই শুরু হয়ে গেল। দেওয়ানজি হাঁক দিলেন। দু'রাউন্ড চায়ের দাম ওসুল! সবাই মেতে উঠলো ক্রিশ্চিয়ানদের আর পাদ্রিসাহেবদের নিয়ে চুটকি ও ব্যক্তিগত অনুভবের গল্প শোনাতে। বিমল মিশ্রের গল্প আর কেউ শুনছে না।
কিন্তু মিশ্রজি ঘাঘু সাংবাদিক, স্থানীয় রাজনীতির মোটামুটি নামকরা পত্রকার।
সবার নজর কাড়তে উনি স্ট্র্যাটেজি বদলে ঠাট্টাতামাশার পরিবেশ বদলে গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে শুরু করলেনঃ
—আসলে ছত্তিশগড়ে ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটি হল সব আড্ডার পাঞ্চিং ব্যাগ। এখানকার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নিক্তিতে ধর্মপরিবর্তন করে ইসাই হওয়া পরিবারের মেয়েরা নিজেদের ফরওয়ার্ড দেখাতে তক্ষুণি পোশাকে আশাকে আচারে বিচারে নিজেদের বদলে ফেলে।
ছোট্ট সমাজের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে অনেক সহজ ভাবে মেলামেশা করে। রোববার রোববার গির্জেয় যাওয়া-আসার পথে মুচকি হাসি, চোখের চাওয়ার হাওয়া স্থানীয় লিংগোতে আই-টনিকের কাজ করে।
তাই এই সমাজের মেয়েদের একটি কোড নেম হল চিড়ই। মানে চড়াই পাখি। কারণ ওরা নাকি চড়াই পাখির মত তিরিক-তিরিক লাফিয়ে বেড়ায় আর চিড়িক-চিড়িক করে হেটো ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে উচ্চগ্রামে কথা বলে।
ব্যাংক ম্যানেজার দেবাংগন দোহার দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেঃ
—ঠিক বলেছেন আপনি। আমার বদলি হয়েছিল ন্যাশনাল হাইওয়ে নম্বর ৬-এর পাশে জগদীশপুর বলে গ্রামে। আসলে ওটা কানাডার মেননাইট চার্চের ছত্তিশগড়ের হেড কোয়ার্টার। হাসপাতাল-স্কুল-চার্চ সব আছে। বুঝলেন, সেখানে দেখি স্থানীয় লোকজন ওই জনপদকে বলে নিউ ইয়র্ক। কেন? ওখানকার মেয়েরা নাকি পোশাকে-আশাকে চলনে-বলনে রাজধানী রায়পুরকেও ছাড়িয়ে যায়।
বাধা পড়ায় বিরক্ত মিশ্রজি হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে আবার নিজের কথার খেই ধরে নিলেনঃ
—সাধারণত এই কমিউনিটি গড়ে ওঠে আদিবাসী ও হরিজনদের ধর্ম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। গ্রাম সমাজে দলিতদের স্থান হয় গ্রামের একপ্রান্তে, ভাটা বা রুক্ষ, অনুর্বর জমির ওপর ফ্রি-তে চালাঘর তুলে।
তাই এই প্রান্তিক মানুষগুলো ধর্মান্তরিত হয়ে চার্চের আশ্রয়ে সবচেয়ে আগে পেটভরে খাওয়া পায়। চার্চের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা বস্তা বস্তা গম নামমাত্র মূল্যে বা বিনে পয়সায় এদের দেয়া হয়। কেউ কেউ চার্চে বা স্কুলে বা হাসপাতালে আয়া, চাপরাশি বা ড্রাইভারের কাজ পেয়ে যায়। আর পায় জামাকাপড়। বাইরে থেকে আসা, সম্ভবতঃ সায়েবদের ব্যবহৃত, সেকেন্ড-হ্যান্ড মাল। কিন্তু সেগুলোর কাট-ছাঁট এমন যে সবার চোখ টাটায়।
দেখতে দেখতে রিয়েল ইনকাম বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারটির জীবনযাত্রার মান বদলে যায়। ওরা এক অর্থে জাতে ওঠে।
আর একটা কথা। এই লোকগুলো গাঁয়ের হিন্দু মন্দিরে ঢুকতে পারেনি। ওদের ছোঁয়ায় ভগবানও অপবিত্র হয়ে যান। কিন্তু প্রভু যীশুর সামনে সব সমান। তাই একবার কেরেস্তান হয়ে এরা যখন অন্ন-বস্ত্র ও সম্মান পায়, পায় আত্মার আরাম, এদের পুরনো খাঁচায় ঢোকানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
এবার হাত তুলেছেন লাফটার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তামসকর; ঘোর আরএসএস-পন্থী:
—আমরা কি সাতসকালে কোন পাদরিবাবার বক্তৃতা শুনতে এয়েচি?
সবাই চুপ। পরিবেশ থমথমে।
দেওয়ানজি হালকা করার চেষ্টায় বলেন—আরে কিছু হাতে-গরম অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবে তো বসি, নইলে বাজারে যাই।
ফক্কড় গোপালদাস বলে—আরে সেই "চুমায়ন কার্যক্রম" বা সার্বজনিক চুমু খাওয়ার গল্পটা বলুন না।
সবার মুখে ফিচেল হাসি।
—সার্বজনিক চুমু? চুমায়ন কার্যক্রম? সে আবার কি!
মৃদু হাসেন মিশ্রজি—কিসিং সেরিমনি! বলছি।
তখন আমার কার্যস্থল রায়পুর মহাসমুন্দ হয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে নং ৬ ধরে ওড়িষ্যার বরগড়-সম্বলপুরের সীমানা অব্দি। মানে মুম্বাই-কোলকাতা হাইওয়ের রায়পুর ডিভিশন এলাকা।
সেইসময় এত ট্রেন ও ভলভো বাস দেখা যেত না। আর রাস্তাঘাটের অবস্থাও এত ভাল ছিল না।
শীতের দুপুরে বাসের অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি জোসেফ গড়রিয়া। মেননাইট চার্চের কর্মকর্তা। দেখলে মনে হবে কেরালার লোক, আসলে ছত্তিশগড়ি আদিবাসী। ধর্মান্তরিত হয়ে ইসাই হয়েছে। সব সময় একটা মেড ইন ইউএসএ মার্কা টি-শার্ট বা জ্যাকেট পরে থাকে। আমাকে কিছু কিছু খবর-টবর দেয়, অধিকাংশ সরকারি অফিসারদের ঘুষ খাওয়া বা যৌন কেলেংকারি নিয়ে। বেশিরভাগ খবরের কোন সাপোর্ট ডকুমেন্ট বা সাক্ষী পাওয়া মুশকিল, ছাপলে লাইবেল এর দায়ে জেলে যেতে হবে।
আমাকে দেখে হড়বড় করে মোটরবাইক থেকে নেমে বলল—কদ্দূর যাবেন? মহাসমুন্দ না সরাইপালী?
—মহাসমুন্দ ছাড়িয়ে ওই বসনা অব্দি।
—খুব ভালো হল। আপনাকে বাসে যেতে হবে না। মিশনের জীপ যাচ্ছে। কানাডা থেকে পাদরিবাবা এসেছেন। মানা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে গাড়ি আসছে। এইখানে আর মিনিট পনের দাঁড়ান। সঙ্গে ফাদার মনোহর লাল যাচ্ছেন। কিন্তু আপনি সঙ্গে গেলে গোরাচামড়া পাদরিবাবার ইংরিজি বুকনি ও বকবকের ব্যাখ্যা করে দিতে পারবেন। রাজি হয়ে যান। আমাদের গাড়িতে আরামে যাবেন আর ১২০ কিলোমিটার পথ আড়াই থেকে তিনঘন্টায় পৌঁছে যাবেন। কফি জলখাবার ড্রাইফুট এসবও জুটবে, না করবেন না। আপনি গেলে আমার আর যেতে হবে না। গিন্নির শরীর ভাল নয়।
যাত্রা শুরু হল। প্রত্যাশামত কফি-নাস্তা-ড্রাইফ্রুট সবই জুটছিল । ষাটোর্ধ্ব গোরা পাদ্রীবাবা ভাঙা ভাঙা হিন্দি শিখেছেন! ফাদার মনোহরের থেকে এখানে চার্চের সেবামূলক কাজ কেমন চলছে, নেটিভদের মধ্যে প্রভুর মাহাত্ম্য কদ্দূর ছড়িয়েছে সেসব জিগ্যেস করতে লাগলেন। দেশি পাদ্রীবাবা দেখলাম বেশ বাড়িয়ে রিপোর্ট দিচ্ছে।
শীতের সন্ধে একটু তাড়াতাড়ি নামে।
মহাসমুন্দ ছাড়িয়ে পিথৌরা পৌঁছতে পৌঁছতে ঝুপ্পুস করে গাঢ় কালো পর্দার মতো অন্ধকার নেমে এল। রাস্তার দুধারে ধানক্ষেত, একটু কুয়াশার ভাব। ধানকাটা চলছে। এই সময় নানান পোকা ওড়ে, গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পোকারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে য্তক্ষণ সম্ভব আলো জ্বালানো হয় নি। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষের রাত। ড্রাইভারকে বললাম—হেডলাইট জ্বালিয়ে দাও। একটু ডিপার দিয়ে দেখে নাও।
গাড়ির আলো জ্বলে উঠতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে উঠল। রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে বসে থাকা মেয়ের দল গাড়ু হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
বিলিতি ফাদার পুলকিত। মনে করলেন এই শীতের সন্ধ্যায় ইশুমন্ত্রে নবদীক্ষিত নারীরা দলে দলে চারপাশের গ্রাম থেকে ওঁকে বরণ করতে সারিবেঁধে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে!
—প্যাস্টর! টেল য়োর ড্রাইভার টু স্লো-ডাউন।
গাড়ি এবার ধীরে ধীরে এগোয়। যত এগোয় তত আলোর বৃত্তে ক্রমশঃ গাড়ু হাতে দাঁড়াতে থাকা মেয়ের দলের অপেরা ধরা পড়ে। বিলিতি ফাদার উত্তেজিত, উদ্বেলিত। এবার উনি নীচে নেমে গাড়ুধারিণী মেয়েদের কাছে গিয়ে বলতে থাকেন—সিট ডাউন, সিট ডাউন! বইঠো, বইঠো। ডোন্ট স্ট্যান্ড অন সেরিমনি।
আমি আর প্যাস্টর মনোহর লাল ওঁর দুপাশে চলতে থাকি। কানে আসে লজ্জিত অপ্রস্তুত মেয়েদের ছত্তিশগড়ি ভাষায় গালাগাল।
—কেইসে বুরবক হবে ডোকরা! ওকর আঁখি লা ফুটিস কা? দেখে নাই হমন কাবর এম অন্ধেরে মা বৈঠেহন লোটা লেকে?
(কেমন বোকাহাঁদা এই বুড়োটা? বলি চোখের মাথা খেয়েছে নাকি? ভর সন্ধেয় আমরা মেয়েছেলেরা কেন অন্ধকারে গাড়ুহাতে রাস্তার ধারে বসেছি বুঝতে পারছে না? বদমাশ, মরুটে!)
এবার বিলিতি ফাদারকে অনেক করে 'দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেকটা পথ বাকি' এইসব বলে-টলে ফিরিয়ে এনে গাড়িতে বসাই, তারপর সোজা জগদীশপুর মিশনের হেডকোয়ার্টার। রাত্তিরে ওদের কাছেই থেকে যাই। কালকের দীক্ষাগ্রহণ সমারোহ দেখবো, সেটাই রিপোর্ট বানিয়ে পাঠিয়ে দেব।
—আর ধেত্তেরি! চুমু খাওয়ার গল্পটা কখন শুরু হবে?
—শুরু হয়ে গিয়েছে, একটু শান্ত হয়ে বস দিকি।
রাত্তিরে মিশনের গেস্ট হাউসে শুয়েছিলাম, মুরগির ঝোল আর আচার সহযোগে হাতে গড়া রুটি—খ্যাঁটন মন্দ হয়নি।
সকালে কাফিলা চললো সিংহনপুর গাঁয়ে, একটি স্কুলের প্রাঙ্গণে দীক্ষাগ্রহণ, ব্যাপ্তিস্মা (ব্যাপটিজম) ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটা লাল ভেলভেট মোড়া চেয়ারে বৃদ্ধ ফাদার বসলেন। স্থানীয় কয়ার ইংরেজি ও হিন্দিতে 'মসীহী গীত' (ক্রিশ্চিয়ান সং) গাইল। পবিত্র মন্ত্রপূত বারি ছিটোনো হল। শেষে স্থানীয় হিন্দিতে ঘোষণা করা হল—চুমায়ন কার্যক্রম (কিসিং সেরিমনি)।
সবাই এক এক করে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ফাদারের রোজারি ঘোরানো হাতে চুমু খেল। উনি মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। কেমন মনে হল কায়দা কানুন খানিকটা হিন্দুদের মতই। শুধু চুমু খাওয়াটা বাদে। হিন্দুরা বড় পিউরিটান। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া নিয়ে ওদের কেমন ঘেন্নাপিত্তি আছে। খালি রজনীশের হেরেটিক সেক্টটি ব্যতিক্রম। কোরেগাঁওয়ে দেখেছি চ্যালা-চেলীরা একে অন্যকে 'আমোরে আমোরে' বলে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে সোজা ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে, কখনো আবার কয়েকজন—
—আরে বাঙালিরা ও এ'ব্যাপারে বেশ কনজার্ভেটিভ। আমার কলকতিহা বন্ধু বলেছিল।
—অ্যাই বর্মা! তোমার বলা বলা হয়ে গেছে, এখন মিশ্রকে ব্যাটিং করতে দাও। মুখ বুজে রিজার্ভ বেঞ্চে বস।
—আরে শুনুন না। ভারতীয় সিনেমায় চুমু খাওয়া এল সেই ১৯৬৯ সালে। সেন্সর লিবারেল হল। আগে দেবানন্দ-সুরাইয়া বা রাজকাপুর-নার্গিস জুটি স্লো মোশনে ঠোঁট এগিয়ে আনতেন, ক্লোজ আপ! কাট্। দুটো কবুতর চোঁচ মেঁ চোঁচ ডালে হ্যাঁয়, নইলে মৌমাছির হুলের চাপে ফুলেরা দুলে দুলে উঠছে।
সবাই হেসে ফেলে।
—কিন্তু এর মধ্যে বাঙালির চুমু খাওয়া নিয়ে আদিখ্যেতার কি হল?
—শুনুন তো! বম্বেতে নায়ক নায়িকার চুমা-চাটি হই হই করে শুরু হয়ে গেল। ইউ সার্টিফিকেট দরাজ হাতে দেয়া হতে লাগল। কিন্তু বাংলা সিনেমার মহানায়ক, আরে যিনি 'অমানুষ' সিনেমায় ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। কি যেন নামটা—হ্যাঁ, হ্যাঁ, উত্তমকুমার। তিনি প্রেসকে বললেন—চুমু খাওয়ার আগে নায়িকার মেডিক্যাল রিপোর্ট চাইব।
বোঝো ঠ্যালা!
—অনেক হয়েছে। মিশ্রের গল্পটার একেবারে অ্যান্ড-ব্যান্ড-মোটর স্ট্যান্ড হয়ে গেছে। তবু শেষ হোক।
মিশ্র বিরস বদনে বললেন—যাক গে, সংক্ষেপে সারছি। সিংহনপুর প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে, উড়িষ্যা বর্ডারের কাছে আদিবাসী এলাকায়।
আকাশছোঁয়া পাহাড়ের নীচে সুন্দর গাঁ, ঢোকার মুখে বেশ বড় দীঘি। মিশন কম্পাউন্ডে গিয়ে দেখি ফাদাররা থাকেন অ্যাসবেসটসের ছাদের আটপৌরে বিল্ডিংয়ে। ছেলেরা বেশ ভালো পাকা বাড়িতে। জুনিয়র ফাদার, নাম জুলিয়েন কিসকু, দেখলাম ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলছেন।
আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে প্রশ্নের ফুলঝুরি লাগিয়ে দিই।
—এই সব ছেলেরা আসে কোত্থেকে? এদের কোন বই বা কোর্স পড়ানো হয়? আপনারা বিদেশ থেকে টাকা পান? কোন দেশ থেকে? এদের ভবিষ্যৎ কী?
সাদা জামাকাপড়ে তেলচুকচুকে কালো ছোট ফাদার জানালেন যে ওঁরা পাহাড়ের ওপার থেকে গরীব ওঁরাও ছেলেদের বাপ-মার অনুমতি নিয়ে এখানে রেখে সরকারি বোর্ডের বই এবং কোর্স অনুযায়ী পড়ান ও ফুটবল খেলতে শেখান, নিখরচায়। আর শেখান স্বাস্থ্যবিধি, যেমন—হাত ধুয়ে খাবার খাওয়া, পায়ে চপ্পল, ঠিক ভাবে দাঁত মাজা। খোলা মাঠে পায়খানা না করা, রান্না করা খাবার খাওয়া, তামাক ও মদ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি।
এর জন্যে টাকা আসে ফ্রান্স ও জার্মানী থেকে, ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রতি ছ'মাসে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ভারত ও রাজ্য সরকারের দফতরে পাঠাতে হয়। বাচ্চাদের মেইনস্ট্রীম কোর্স পড়ানো হয়, তাই পরে সরকারি কলেজে ভর্তি হতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
নইলে আছে আই টি আই অথবা মিশনেরই হাতের কাজ শেখানোর ওয়ার্কশপ।
এখানে একটি নতুন ক্রিশ্চান হওয়া মেয়ের জন্মদিন। ফাদারের আশীর্বাদের পরেও চুমাওন কার্যক্রম চলতে থাকে। অনেকে লাইন দিয়ে এসে মেয়েটির হাতে উপহার তুলে দেয় আর দু'গালে চুমো খায়।
আমি অন্য দিকে মুখ ফেরাই।
শীতের বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, রায়পুর ফিরতে হবে। মনোহর লাল কে বলি—গাড়ি কখন ছাড়বে?
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)