গুঞ্জার অন্তরাত্মা শিহরিয়া উঠিলো। পালাইবার পথ নাই।
গগন তখন সায়াহ্নের রুধিরাক্ত রূপ ত্যাগ করিয়া ক্রমশ মসীবর্ণ হইয়া উঠিতেছে। সম্মুখের কৃষ্ণসমুদ্র করাল মৃত্যুর ন্যায়। সমুদ্রগর্ভ হইতে উঠিয়া আসিয়াছে কৃতান্তের ন্যায় ভয়ংকর এক কুম্ভীর। তাহার শ্বেতদন্তপাটের ঝলকে মৃত্যুর বিভীষিকা।
গুঞ্জা যে অতিক্ষুদ্র প্রস্তরখণ্ডের উপর কোনোরূপে নিজেকে প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছে, তাহা নিতান্তই অস্থাবর। যেকোনো মুহূর্তে তাহা খসিয়া গিয়া গুঞ্জাকে গর্জনময় সমুদ্রের গর্ভে নিক্ষেপ করিবে। ভয়াল ক্ষিপ্ত রুদ্ররূপী কুম্ভীর যেথা বিদ্যমান।
গুঞ্জার সঙ্গিনীরা কথঞ্চিৎ দূরের দ্বীপটিতে রহিয়াছে। বারংবার হাত নাড়িয়া ডাকিতেছে গুঞ্জাকে। কিন্তু তথায় যাইতে হইলে সমুদ্রগর্ভে ঝাঁপ দিয়া কুম্ভীরের গ্রাস এড়াইয়া যাইতে হইবে। অতীব বিপদসংকুল।
বিদ্যুৎচমকের ন্যায় একটি কৌশল গুঞ্জার মনে আসিলো। কুম্ভীরটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে নিজের বাম পদের পাদুকাখানি গুঞ্জা অলক্ষ্যে খুলিয়া ফেলিলো। তাহার পর শরীরের বাকি অংশ স্থির রাখিয়া শুধুমাত্র বাম পদের একটি অতর্কিত আঘাতে গুঞ্জা পাদুকাটি বহুদূরে নিক্ষেপ করিলো। কুম্ভীরকে অতিক্রম করিয়া সমুদ্রের জলে গিয়া সশব্দে পড়িলো পাদুকাখানি।
এই অকস্মাৎ শব্দে সচকিত হইয়া কুম্ভীরটি পিছন ফিরিয়া আওয়াজের উৎস বুঝিবার চেষ্টা করিতে লাগিলো। এবং সেই মুহূর্তেই সমুদ্রবক্ষে ঝাঁপ দিলো গুঞ্জা। গভীর কৃষ্ণবর্ণ সমুদ্রের উদ্বেল তরঙ্গের সহিত তীব্র যুদ্ধ করিয়া চলিলো সেই দিকে, যেখান হইতে উহার বন্ধুনীরা বারংবার হাত নাড়িতেছে।
কুম্ভীরটি তৎক্ষণাৎ ঘুরিয়ে গুঞ্জার পানে ধাইয়া আসিলো।
গুঞ্জার চিন্তা করিবার সময় নাই। নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া পাগলের ন্যায় সে আগাইয়া চলিতেছে মুক্তির দিকে, তাহাকে ধাওয়া করিতেছে নিশ্চিৎ মৃত্যু। শুধু আর কয়েকটি মুহূর্তের প্রয়োজন গুঞ্জার...
অকস্মাৎ সমুদ্রবক্ষ চিরিয়া তীব্র গতির এক অলৌকিক জলযান বিপুল জলোচ্ছ্বাসে আসিয়া গুঞ্জার অনতিদূরে সগর্জনে থামিয়া গেলো। জলযানের দ্বার খুলিয়া উত্তীর্ণ হইলো এক দৈত্য। তাহার চক্ষুদ্বয় রক্তাক্ত, নাসিকা হইতে অগ্নি নিঃসারিত হইতেছে; উন্নত মস্তক যেন অন্তরীক্ষের চূড়া স্পর্শ করিতে চাহে।
গুঞ্জার দ্যুলোক ভূলোক কাঁপিয়া উঠিলো।
হুংকার দিয়ে উঠিলো সেই দৈত্য--
“কি হচ্ছেটা কি? রাস্তায় কুমীর-ডাঙ্গা খেলা? আরেকটু হলেই তো গাড়িটার সামনে চাপা পড়তে! বাঁদরামির একটা সীমা পরিসীমা রাখবে না তোমরা?”
বারান্দা থেকে মা হাঁক দিলেন “গুঞ্জা, স্মিতা – সন্ধে হয়ে গেছে, শীগগির বাড়ি এসো। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসো। লুচি ভাজছি। গুঞ্জা, চটিটা রাস্তার ওপারে ফেলেছিস, মনে করে নিয়ে আসিস।”
স্বর্গে দুন্দুভি বাজিয়া উঠিলো। সুরকুলসুন্দরীরা পুষ্পবৃষ্টি করিলেন। চন্দনচর্চিত সুবাতাসে ভুবন মাতোয়ারা হইয়া গেলো।
বাবার পিছন পিছন গুঞ্জা আর স্মিতা বাড়িতে ঢুকে পড়লো।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দু'টি গল্পঃ 'সেই ছবিটা' ও 'বিশ্বাসবাবুর গান')
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)