রাতের খাওয়া সেরে মুখে জর্দা পান গুঁজে বিশ্বাসবাবু ওনার এক চিলতে বারান্দাতে এসে বসলেন। এটা ওনার বরাবরের অভ্যেস। এখন বয়েস হয়েছে বলে একটা লাঠির সাহায্য নিতে হয়। চাকরটা একটা চেয়ার রেখে দিয়েছে বারান্দায়, ওখানেই এসে বসেন।
ওইটুকু আসতেই অনেক সময় হাঁপানিটা জ্বালায়। আজ অবশ্য জ্বালালো না। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বাইরের দিকে চোখ ফেললেন। দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে আপন মনে দু কলি গেয়ে উঠলেন - “যে দিন সকল মুকুল গেল ঝরে, আমায় ডাকলে কেন গো।”
দোতলা বাড়িটি অভিজাত পাড়ায়। ত্রিকোণ পার্কের থেকে বেশি দূর নয়। সন্ধ্যার পরে শান্ত হয়ে আসে পাড়াটা। রাসবিহারী আভেনিউএর ট্রামের গদ্যছন্দের আওয়াজ শোনা যায় ওনার বাড়ি থেকে। ওনার বাড়ি মানে অবশ্য ভাড়া বাড়ি। তবে বহুবছর ধরে উনি আছেন এই বাড়িতেই।
“ভয় পাবেন না স্যার।”
হঠাৎ করে পেছন থেকে গলা পেয়ে ভয়ানক চমকে উঠলেন বিশ্বাসবাবু।
বাড়িতে কেউ নেই, দরজা বন্ধ, এর মাঝখানে কোথা থেকে দুটো ছোকরা বারান্দায় এসে উপস্থিত। ঢুকলো কোথা দিয়ে?
বিশ্বাসবাবু এমনিতে বেশ সাহসী লোক। ভূতে বা মানুষে ভয় বিশেষ নেই। বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন “কে তোমরা? কি চাও?”
লোকদুটো অবশ্য ভদ্রলোক বলেই মনে হলো। রোগা মতো, ক্লিন শেভ করা। গায়ের জামা কাপড় বিদেশী বলেই মনে হয়। অন্তত এইরকম চকচকে জামাকাপড় কলকাতায় এখন অব্দি দেখা যায় না।
“ভয় পাবেন না স্যার। আমরা আসছি অনেক দূর থেকে।” প্রথম ছেলেটা বললো।
“আমার নাম দিগন্ত, স্যার। আর ওর নাম ঋক।” দ্বিতীয় ছেলেটা বলে উঠলো।
“আমরা আসছি মহাকাশ থেকে। আমাদের এই পৃথিবীর থেকে চল্লিশ আলোকবর্ষ দূরে একোয়ারিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জের ট্রাপিস্ট নক্ষত্রের সৌরমণ্ডল থেকে। আরও সঠিকভাবে বললে বলা উচিত ট্রাপিস্ট নক্ষত্রের সৌরমণ্ডলের দু নম্বর গ্রহ ট্রাপিস্ট সি - যার বাংলা নাম রক্তকরবী, সেখান থেকে।” বললো দিগন্ত।
বিশ্বাসবাবুর মাথা ঘুরতে থাকলো। “মানে? তুমি বলতে চাও কি মানুষ ওই ট্রাপিস্ট না কি গ্রহে গিয়ে বসবাস করছে? আর তুমি সেখান থেকে এসেছো? মস্করা করবার জায়গা পাও না?”
“না স্যার। মস্করা নয়।” বললো ঋক।
“মস্করা নয় তো কি? মহাকাশে মানুষ বাসা বেঁধেছে, এখবর সত্যি হলে আমার কানে নিশ্চয়ই আসতো। এই তো সবে চাঁদে পা রাখলো মানুষ – বছর দশেকের একটু আগে।” বললেন বিশ্বাসবাবু।
“আপনি খবর পান নি কারণ এই খবর আপনার সময়ের অনেক পরের কথা। ২০১৫ সালে ট্রাপিস্ট নক্ষত্রটি প্রথম দেখা যায়, ২০১৭ সালে তার চারপাশের এই সৌরমণ্ডল। সেখানে পৌঁছোবার প্রযুক্তি – যার প্রধান অবলম্বন হাইপার-স্পেসিয়াল জাম্প - সেটা আবিষ্কৃত হয় মোটামুটি একবিংশ শতকের শেষের দিকে। ২১১০ সালে ওখানে প্রথম ল্যান্ডিং হয় – আন-ম্যানড – মানে শুধু যন্ত্রপাতি। আর এখন ২১২৯ সালে আমরা ওখানে একটা ছোট বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরি বসিয়েছি। আমি আর দিগন্ত মিলে সেখানে কাজ করছি গত তিন মাস ধরে।” বললো ঋক।
“আমার সময়ের পরে মানে...”
“হ্যাঁ স্যার – ওই একবিংশ শতকের শেষের দিকেই টাইম ট্র্যাভেল-টাও আবিষ্কৃত হয়। তাই আমরা শুধু চল্লিশ আলোকবর্ষ পার হয়ে এসেছি শুধু নয়, দেড়শো বছর সময় পেরিয়েও এসেছি। মানে পিছিয়ে এসেছি আর কি।”
বিশ্বাসবাবু হাল ছেড়ে দিলেন। এরা যদি গুলবাজ হয়, তাহলে এরা রূপদর্শীর ব্রজদাকে টেক্কা দিতে পারে। তবে ভারী ভদ্র, তাই গাঁজাখুরি হলেও ছেলেগুলোর কথা শুনতে মন্দ লাগছে না।
“বেশ বেশ, খুব ভালো। তা তোমাদের ওই জায়গাটা কেমন একটু শুনি?” একটু ঠাট্টার সুরে বললেন বিশ্বাসবাবু।
ঋক কিন্তু খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো।
“রক্তকরবী প্রায় পৃথিবীর কাছাকাছি আকৃতির। কিন্তু সূর্যের (মানে ওখানকার সূর্য – অর্থাৎ ট্রাপিস্ট নক্ষত্রের) অনেকটাই কাছে। একেকটি বছর মাত্র আড়াই দিনের। পাথুরে গ্রহ, তবে ঈষৎ সবুজের আভা রয়েছে – অর্থাৎ প্রাণ আছে। প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় কিছু একটা। রক্তকরবীর একপাশে চির অন্ধকার, অন্য পাশে চির সূর্য। অনেকটা আমাদের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মতন।”
দিগন্ত ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো “আমাদের ল্যাবরেটরি হচ্ছে এই অন্ধকার আর আলোর মাঝের জায়গাটায় – যেটাকে বলে টারমিনেটার জোন। চারপাশে ঝড়ের মতো হাওয়া বয়। রক্ত আভায় রাঙ্গিয়ে ওঠা আকাশে দেখতে পাই অস্তগামী বিশাল রক্তিম সূর্য আর গোধূলির রঙের খেলা। সূর্য অস্ত যায় না, তাই এই খেলা নিরন্তর চলতে থাকে। এক ফাঁকে বিকেলের আকাশে দেখা দেয় রুপোলী চাঁদগুলো।”
“চাঁদগুলো?” চমকে উঠলেন বিশ্বাসবাবু। “একাধিক চাঁদ নাকি ওখানে?”
হাসল ঋক। “আসলে চাঁদ নয়, ওগুলো অন্য গ্রহ। রাজা, ফাল্গুনী, তপতী, শ্যামা, মায়া আর মালঞ্চ। এরা এতো কাছে যে চাঁদের মতন লাগে দেখতে। আমরা চাঁদই বলি এমনিতে।”
“অ,” বললেন বিশ্বাসবাবু। “তা এসব চাঁদ-তারা ফেলে আমার কাছে কি করতে বাপু?”
দিগন্ত হাসলো। “আমরা শুধু দুজনেই থাকি ওখানে। বাকি সবই রোবট। তাদের দিয়েই কাজ করাতে হয়। সারাদিন অসম্ভব ব্যস্ততায় কেটে যায়। শুধু সন্ধ্যা হলে ককপিটের বিশাল জানলাটা খুলে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। হাতে এক কাপ চা। দার্জিলিং, ফার্স্ট ফ্লাশ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে কামড় দিই সিঙাড়ায়। আর চালিয়ে দি গান। গান শুনতে শুনতে উপভোগ করি ওই অপার্থিব গোধূলির আলোছায়ার অপরিচিত দিগন্ত।”
“বাঃ==”
“কিন্তু একটা জিনিস হয় না স্যার। যতই আমাদের রোবটগুলো নিখুঁত ভাবে রেকর্ড বাজাক, সামনে বসে গান শোনার অনুভূতিটাই আলাদা। সেটা পাই না।”
মাথা নাড়লেন বিশ্বাসবাবু। “ঠিক। বিজ্ঞান যতই অগ্রসর করুক না কেন, গানের আসল অনুভূতি গায়কের সামনে বসে শুনলেই হয়। একাকী গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুই জনে। গাহিবে একজন ছাড়িয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে।”
“সেই জন্যেই এলাম স্যার। এই গানটা একটিবার গেয়ে শোনাবেন?” দিগন্ত একটা হলদে গানের বই এগিয়ে দিলো।
ফাঁপরে পড়লেন বিশ্বাসবাবু। “আজকাল আমি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। গলা ওঠে না ভাই। হাঁপানিটা বড্ড কষ্ট দেয়।”
“তবুও স্যার... আমরা অনেক দূর থেকে আসছি।”
“তাছাড়া এখন তো রাত হয়ে গেছে। এই সময় তো ওই গানটা...” বললেন বিশ্বাসবাবু।
“এই চশমাটা পরে নিন স্যার।” ঋক বললো। “এতে রক্তকরবীর দৃশ্য সেভ করা আছে। ওখানে তো আর রাত হয় না।”
ঋকের হাত থেকে চশমাটা নিতে নিতে বিশ্বাসবাবু দেখলেন দিগন্ত এক ফাঁকে হারমোনিয়ামটা টুক করে নিয়ে এসেছে।
বিশ্বাসবাবু চশমাটা পরলেন। পরতেই রাসবিহারী আভেনিউএর অন্ধকার রাত্রি মিলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠলো রক্তকরবীর অস্তসূর্যের গোধূলি। অপার্থিব আকাশে বর্ণময় মেঘের আনাগোনা। ভেসে এলো অনেক বসন্তের গান। যা উনি দিয়ে এসেছেন এতদিন ধরে।
জর্জ বিশ্বাস হারমোনিয়ামটা কোলে তুলে নিলেন। তারপর কলকাতার এবং রক্তকরবীর আকাশ ভরিয়ে দিলেন সেই গানটিতে, যেটি ওনার কণ্ঠ ছাড়া আর কারুর কণ্ঠে কল্পনা করা মুশকিল – “গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা।”
গল্পের 'রক্তকরবী'র প্রেরণা সম্প্রতি আবিষ্কৃত 'ট্রাপিস্ট' নক্ষত্র পরিমণ্ডল। এই গল্পে শ্রীরঞ্জন ঘোষালের "অসময়ের গান" গল্পের ছাপ রয়েছে। ।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দু'টি গল্পঃ 'সেই ছবিটা' ও 'করাল কুম্ভীর')
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)