নন্দা বসে আছে ঠায় সেই জানলার ধারটিতেই। একবার জানলার ধার পেয়েছে, আর ছাড়ে? নড়া নেই চড়া নেই, হিসু করতে ওঠা নেই, সেই ট্রেনে উঠে থেকে জানলার কাঁচে মাথা হেলিয়ে দিব্যি নাক ডাকাচ্ছে।
আমি ও’পাশের গুঁপো বুড়োর লাঠি টপ্কে, মুটি দিদির পা-মাড়িয়ে নন্দার পাশ-ঘেঁষে টুপ্করে বসে পড়তেই ঘুম ভেঙে খেঁকিয়ে উঠলো আমাদের আদি ও অকৃত্রিম নন্দমাধব সিংগী, “দিলি তো, দিলি তো কাঁচা ঘুমখানা চট্কে?"
কাঁচা ঘুম? ট্রেনে উঠে থেকেই তো ঠেসেচ বাপু ওই জানলার ধারটিতে গিয়ে! পকেটে আমার বোলপুর স্টেশন থেকে কেনা পুরি খচ্খচ্ করছিল। ঠাণ্ডা। তাই বের করে বললুম, “খাবে?” আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে বলল নন্দদা, “ঠাণ্ডা? খেলেই অম্বল।” তা’সত্ত্বেও হাত বাড়িয়ে নিতে ভুলল না, বলল, “হ্যাঁ রে, আলুদ্দম বেঁচে নেই?”
খেতেও পারে বটে! সারা দিনে কক্ষনো কোনো খাবারে ‘না’ বলতে শুনিনি নন্দদাকে। গতবছর আমাদের ‘ডুমুরদহ থাণ্ডার্স ক্লাব’-এর কালীপুজোর মাঝরাতে উঠে বেঁচে যাওয়া ডেড় কেজি ‘নিরিমিষ্যি’ পাঠাঁর ঝোল দু’চুমুকে উড়িয়ে দিয়েছিল!
আমারও চোখের পাতা একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ গম্ভীর গলায় “টিকিট? কৈ, টিকিটটা দেখাও তো খোকা। কোথায় যাবে?”—শুনে খচ্মচ্করে বেঞ্চি থেকে পড়েই যাচ্ছিলুম প্রায়!
অন্ধকারে কামরায় ঠাহর হল না কিছু। গোড়ার দিকে লেট করে মাঝরাতে প্রবল গতিতে মেক-আপ করছে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। এর মধ্যে চেকার? চুপচাপ চোখ বুজে ফেললুম। আর চেকার নেই!
পাশ থেকে কে যেন এক্কেবার যাকে বলে কর্ণকুহরে ফিস্ফিস্ করে বলে উঠল, “ম্যাপ? ম্যাপের বাকি অর্ধেকখান আছে তো? পুঁট্লির মধ্যে?” ভয়ে চমকে উঠলুম ফের! আশ্চর্য! হঠাৎ একটা উট্কো লোক এ’কথা বলে কী করে? কী করে জানল? লোকটা কে? কোথায়?
ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের চলন্ত ট্রেনের আলোতে দেখলুম, কখন পাশে এক রোগা-সিড়িঙ্গে আধবুড়ো টেকোপানা লোক এসে বসেছে। গায়ে পান্সে-রঙা ডোরা পুলওভার । এতো রাত্রেও কচ্কচ্ করে পান চিবুচ্ছে। গলায় রুমাল বাঁধা।
এবার বাঁ কনুইয়ের খোঁচা নন্দার পেটে। তিনবার দিতে বলে, “উঁ”? তারপর চোখ খুলতে আমি আঙুল দিয়ে পাশের লোকটাকে দেখিয়ে দিলুম। লোকটা তখনও তেমনই দেঁতো হাসছে।
“কী?” নন্দদা এবার পষ্টো । আমি ইঙ্গিতে হাওয়ায় আঙুল দিয়ে চৌখুপ্পি কেটে ‘ম্যাপ’ বোঝানোর চেষ্টা করি। মুখে কিছু বলিনা, আমাদের প্ল্যান ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে।
নন্দদা গোঁয়ার হলে কী হবে, চট্করে ঠিক বুঝে নিয়েছে। এবার চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে ইঙ্গিতে জানতে চায়, ‘কোথায় ’? বলে কোলের পুঁটলিটা আরও ঠেসে চেপে ধরে।
“বাকি হাফটা কার কাছে আছে জানি!” ফের আমার কানের কাছে তেমনই ফিস্ফিসিয়ে বলে তেমনই সবজান্তা হাসতে লাগলো সেই গলায় রুমাল।
শিউরে উঠলুম! বলে কী লোকটা? জানলো কী করে এত সব? বিন্দা হাসানের চর নয় তো? তা-ই বা হয় কী করে? তাহলে গায়ে পড়ে আমাদের সঙ্গেই বা এত কথা বলতে আসবে কেন?
“তোমার কুম্ভ রাশি, রাক্ষস গণ? মামা হকি খেলতেন আর ভাই পোষে খরগোশ? বাঘকে ভয় পাওনা তুমি? বেশ, সাহস যদি থাকে আর বক্ষে থাকে বল... ”, লোকটা তার লিক্লিকে ডান হাতখানা মুঠি পাকিয়ে এগিয়ে ধরল আমার দিকে, “তাহলে এ’ই ধরে নাও চন্দ্রযোগ! সোনার সুযোগ! এখনই আমাদের একশনে নেমে পড়তে হবে। কুইক! মালটাল গুছিয়ে নাও, বাবাসোনারা। ট্রেন ঢুকছে।”
ঘুমন্ত স্টেশনটাতে ভ্যাবাচাকা আমরা তিনটে প্রাণী যখন নামলুম, রাত আড়াইটে! মাসটা অঘ্রান। ইতোমধ্যেই এ’দিকে ব্যাপক শীত। নন্দা বলল, “কম্ফর্টারখানা বেশ করে পেঁচিয়ে নে না কম্পাস!”
সদর দরোজা বরাবর বাড়ির মাঝের মস্ত উঠোনটাতে দাঁড়িয়ে সেই গলায় রুমাল ফটাস ফটাস করে দু’বার হাততালি দিল। ঐ রোগা হাতে কী জোর! অমনি ভোজবাজির মতো দু’পাশের দু’টো ঘর থেকে দু’টো মুস্কো জোয়ান বেরিয়ে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালো, সামনে একটু ঝুঁকে। ভাবখানা, “কী আদেশ, প্রভু।”
“এনারা আমাদের মেহ্মান। দেখিস্, এঁদের যত্ন-আত্তির কোনো ত্রুটি যেন না হয়,“ বলেই সামনের আধো-অন্ধকার ঘরটির দিকে উধাও হয়ে গেল। আর যেতে যেতে আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে গেল, “আমাকে সবাই রফি কাপ্তেন বলে ডাকে। তোমরাও তাই ডাকবে”। এরপর ক্রমে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। পরোটা-কোর্মায় আমাদের আপ্যায়ন যদিও মন্দ হয়নি, কিন্তু কোথায় গেল সেই রফি কাপ্তেন আর কোথায়ই বা তার সেই বাকি অর্ধ-ম্যাপ!
নন্দা বলে, “কোত্থেকে কী হয়ে গেল বল্তো রে নন্তে? কোথায় আমরা যাচ্ছিলুম মালদা, কুম্ভীরার জঙ্গলে। আর কোথায় কোন্ এক উট্কো লোকের খপ্পরে পড়ে এক অচেনা-অজানা পুরীতে ঠেলে এসে উঠলুম! এ’ জায়গাটা কি জিলা মালদহ, না মুর্শিদাবাদ? আচ্ছা, আমরা কি এদের হাতে বন্দী?
বন্দী? হাসি পেল। দোতলার যে পেল্লায় ঘরখানায় আমরা রয়েছি, তার না আছে কোনো জানলা-দরজা, না দ্বিতীয় আর কোনো মনিষ্যি নজরে পড়ছে। এক মস্ত তেপায়া পোকাধরা ইজিচেয়ার ছাড়া ঘরে অন্য কোনো আসবাব বলতেও নেই কিছু। দেয়ালে এক কালো ছবি, কিসের বোঝা দায়। রাতে শোবো কোথায়? এই ঠাণ্ডার রাত!
“লোকটা আমাদের হিপ্নোটিক করেছে র্যা নন্তে, নির্ঘাৎ হিপ্নোটিক করেছে...”
“হিপ্নোটাইজ।“ আমি শুধরোতে ছাড়ি না।
“হ্যা, রাখ্ তোর...”, খিঁচোতে ছাড়ে না নন্দা, “তার চে’ খোল্তো বাপ আমাদের সবেধন নীলমণিখানা। অর্ধ অর্ধই সই। পাত তো ফের ম্যাপখানা, দেখি....কোন্ হাফটা নেই?” তারপর বিড়্বিড়্ করতে থাকে, “ হুঃ, নন্দ সিংগিকে হিপ্নোটিক করবে, তেমন বান্দা......”
হঠাৎ নিচের বাগান থেকে ‘গ্যাঁ...এঁ...এঁইয়া...’ করে কী একটা জানোয়ার তারস্বরে ডেকে উঠতে “ওরে বাবা রে মা রে ... পশু ...পশু...” বলে লাফ দিয়ে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে নন্দদা। আমিও যে প্রথমটায় ঘাবড়ে যাইনি বলব না। আমিও নন্দদার গলাটা জড়িয়ে ধরেছিলুম ভয়ে, কিন্তু ওর জড়ানিটা অধিক হয়ে পড়ায় প্রাণভয়ে কোনক্রমে হাত ছাড়িয়ে জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি এক ধাড়ি শুয়োর ও মোষের মাঝামাঝি সাইজের নিরীহ প্রাণী ঘাস শুঁকছে আর পেল্লায় মোটা এক আধ-বুড়ি তার গলায় হাত বুলিয়ে দিতেই আরামে অমন পরিত্রাহি ডেকে উঠছে। ঐ আবার ডাকলো, ‘গ্যাঁ...এঁইয়া...এঁইয়া...’
এ’সব ফালতুমি ছেড়ে আমাদের ট্রেজার-ম্যাপখানির ওপর কনসেন্ট্রেট করতে যাবো, আর এমনই ভাগ্য, হঠাৎ ছাদ থেকে এক টিকটিকি না চামচিকে প্যাৎ করে তার বিকেলের কোষ্ঠটি সাফ করে ফেলল ঠিক ম্যাপটির ওপরেই ।
“হায় হায় হায় হায়!” বারবার কপালে করাঘাত করতে লাগল নন্দ সিংগি, “আজ লাখটাকা ফেললেও এ’জিনিস আর পাওয়া যাবে না রে বাপ! এ হে হে হে হে......” ভেউ ভেউ কান্না জুড়ে দেয় সে। আমি সান্ত্বনা দিই, “কেঁদোনা, কেঁদোনা নন্দা, এসো, যে-টুকু আছে, সে-টুকু কে বাঁচাই। চলো, নিচের কুয়োর জল তুলে নোংরাটুকু ধুয়ে ফেলি।” বলে ম্যাপটা গুটোতে যাই আমি।
এবার ধড়াম করে আমার পিঠে এক কিল বসিয়ে দেয় নন্দা, “ওরে নিন্কম্পুপ, তোর মাথাতেই তো এটা আছে রে! জলে ধুলে এর কালিও কি ধুয়ে বেরিয়ে যাবে না? এ কি ছাপা ম্যাপ? আড়াইশ’ বছরের পুরনো হাতে আঁকা.......”
“ওঃ, তোদেরই তা’লে কব্জায় ফেলেছে ড্যাক্রাটা?” গম্ভীর নারী কণ্ঠ শুনে পেছনে ফিরে দেখি কখন সেই গজকচ্ছপ বুড়ি দোতলায় উঠে এসে আমাদের পেছন এসে দাঁড়িয়েছে কোমরে হাত দিয়ে ।
নন্দদা তাড়াতাড়ি ম্যাপটা গুটোতে গিয়ে আরও মাখামাখি করে ফেললো ইয়েটা।
“হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা” করে অঙ্গ দুলিয়ে বেজায় হেসে বুড়ি বললে, “ও’ আর আমার কাছে থেকে কী নুকুচ্ছিস র্যা? এ’ হল আমার বাপের বাড়ির সম্পত্তি, আর আমিই জানিনা?” বলে মিটিমিটি হাসিহাসি মুখ করে আমাদের ঘাবড়া হাট, যাকে বলে, বেশ উপভোগ করতে লাগলো। আমরা বেকুব!
“তবে এ’ও জানিয়ে রাখি তোদের,” বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে বুড়ি, “আমার মাজায় বাত বলে দোতলা চড়তে পারি না বটে, কিন্তু আমায় বাদ দিয়ে গুপ্তধনের বখরা যদি কিছু হয়, কুরুক্ষেত্তর বাধিয়ে ছাড়ব আমি, এই বলে দিলুম, হ্যাঁ!” তারপর অবশ্য গলাটা একটু নরম করে বলে, “তার যদিও কোনো উপায়ও নেই, কারণ ফাইনাল চাবিটা তো......” বলে রহস্যময় হাসতে হাসতে নিজের ট্যাঁক থেকে এক কালচে চাবি বের করে আমাদের নাকের ডগায় দু’বার নাচিয়ে ফের যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর হঠাৎ থতমত খেয়ে কী যেন কান পেতে শুনে হঠাৎ ভয় পেয়ে দুদ্দাড় করে মেদিনী কাঁপিয়ে নিচে নেমে চলে গেল বুড়িটা!
আমরা থ’!
“এ’ কোথায় এসে পড়লুম গো নন্দা? ” ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি আমি।
“রফিদা, তুমি সারা দিন কোথায় ছিলে? আমাদের জরুরি আলোচনা........” টগবগ করে বলতে যাই আমি।
“রফি কাপ্তেন,” লুঙ্গির কষি টাইট করতে করতে শুধরে দিল সেই রহস্যময় বান্দা। তারপর কিছুক্ষণ চোখ দুটো ছোটছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল পড়ন্ত সুর্যের আলোয়! ক্রূর হেসে বলল, “অত্যাচার সইতে পারো, রাধামাধব? চারিদিকে অঘোর জঙ্গল.....বিচুটি লতা আর ডেঁয়ো ডেঁয়ো জোঁক! এই হেঁটেচ, কি এই চেপে বসল ডিমেতে, এই হেঁটেচ, কি এই চেপে বসল ডিমেতে। তারই মাঝে পটাশ কালীর পোড়ো মন্দির। দু’শো বছর আগে নরবলি দিত ঘট্টি কাপালিক! তার সেই খড়্গ আজও আছে। গায়ে তার রক্তের দাগ। কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাতে রক্তলোলুপ হয়ে ওঠে সে-খাঁড়া! ....মূর্তির পাটা সরিয়ে ন’ধাপ সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। সেথায়.....সেথায়..........” বাকি কথা রহস্যে রেখে ‘হাঃ হাঃ’ করে হেসে ওঠে রফি কাপ্তেন! আর আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! উঃ মাগো!
এবার হাল্কা গলায় নন্দদার দিকে ফিরে পোছে রফি কাপ্তেন, “হ্যাঁ রে, মদিনা কী বলে গেল রে?”
“মদিনা কে?”
পায়ে ডিঙি মেরে উঠে আর কনুই ভেঙে দু’হাত ছড়িয়ে ‘মোটাত্ব’ বুঝিয়ে এবার মাথার ওপর ডালবড়ি খোঁপার নুটিটি ইঙ্গিতে দেখায় রফি। ওঃ, সেই মোটা বুড়িটা, যে একটু আগেই আমাদের চম্কে গেল? তার নাম মদিনা বুঝি?
ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে নন্দদা বলল, “ বলে গেল যে এ’ সম্পত্তিতে তারও বখরা আছে কারণ এ’তার বাপের বাড়ির দিকের..........”
“এঃ, ইল্লি আর কী! তোদের বালখিল্য পেয়ে.........”
কথা শেষ হল না, দূর বাগানে তীব্র হুইস্ল শোনা গেল! একবার, দু’বার, তিনবার!!!
পুলিশ!!!
বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদের দু’টোকে বগলদাবা করে তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে বাগানের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল রফি কাপ্তেন! আমি অবশ্য এত দুঃখেও ম্যাপগাছা সাপ্টে নিতে ভুলিনি।
পুলিশের মস্ত মস্ত টর্চের আলোয় পষ্ট দেখলুম আমাদের থাণ্ডার্স ক্লাবের ক্ষিতীশদা, পতিদা, নবিমামা আরও কে কে যেন সব গুচ্ছের লোক এক দঙ্গল পুলিশের সঙ্গে গেটে জটোলা পাকাচ্ছে! দু’টো হাফ প্যান্ট পেয়াদা দোতলা থেকে নেমে এসে ঘোষণা করল, “কেউ নেই স্যর । পাখি পালিয়েছে।” আরেক পেয়াদা দেখি বন্দুকের ডগায় সেই জগদ্দল বুড়িকে তাড়িয়ে ফুলপ্যান্ট পরা অফিসরের সামনে এনে ফেলল। তার তখন কী করুণ অবস্থা! একবার ও.সি.-র গোড়ে পড়ছে, তো আরেকবার হোমরা-চোমরা ঠাউরে ক্ষিতীশদার। “আমি স্যার কিছুই নিইনি। যাবজ্জীবন যদি কুটোটি ভেঙে দু’টুকরো করেচি স্যার! আমার ছেলের বাপটাই যত নষ্টের গোড়া..........” ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন এদের তম্বি দেখে কে? দারোগা বলে, “সব কটাকে বাঁধ্। সদরে যদি চালান এদের না করেছি........” । আমি গাছের মাথায় মশার কামড় চুলকোতে চুলকোতে বলতে গেলুম, ‘সবকটা আবার কোথায় পেলে? একটাই তো মাত্তর বুড়ি!’ তা, ‘শ্-শ্-শ্-শ্’ করে আমায় চুপ করিয়ে দিয়ে বাঁ হাঁটুতে এত্তো জোর এক চিমটি কেটে দিল নন্দা যে ফুলে ডাঁই! মশার কামড় তো ছিলই। পাশ থেকে রফি কাপ্তেন বলে উঠল, “যাক্না, নিয়ে যাক্না বুড়িকে । বেশ হয় তা’লে । তারা বুঝবে ঠেলাটা, হুঃ!”
এমন সময়, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ “মাসাক্কলি মাসাক্কলি” করে মোবাইলটি আমার পকেটে গেয়ে উঠলো।
আর যায় কোথায়? “কে রে? কে রে ওখানে? ” বলতে বলতে বেজে উঠল পুলিশের হুইশ্ল! আর বড় বড় টর্চের আলো এসে পড়তে লাগল এই গাছটাতে।
আর কি বসে থাকা যায়? একেই একটা ডেয়ো পিঁপড়ে ঘাড়ে কামড়ে ঢ্যাপ করে দিয়েছে, চুলকোচ্ছে বেজায়!
“এই তো, এই তো স্যর, পেয়েছি কালপ্রিটের দলটাকে! এই এই এক্কেরে পালাবার চেষ্টা করবি না। খবর্দার!!” পুলিশের বন্দুকের ডগায় আমাদের তিনজনকে লাইন করে দাঁড়াতে হল। উপায় নেই! ক্ষিতীশদাই সর্বাগ্রে এগিয়ে এসে আমার ঝুলপি টেনে বলল, “হতভাগা, আমার ম্যাপ চুরি করে পালিয়েছিস?”
“তোমার ম্যাপ? রামঃ! ও ম্যাপের আবিষ্কর্তা এই শর্মা নয়?” তেজের সঙ্গে বলি। আমার দিকে মস্ত এক চড় তুলেও থমকে গেল ক্ষিতীশদা, কারণ বুড়ি ও’পাশ থেকে কোমল গলায় বলে উঠেছে, “বাবা নব! অবোধ শিশুকে মেরো না। চাবি ওর কাছে নেই।”
থতমত খেয়ে ক্ষিতীশদা বলল, “তুমি মানে, আপনি আমাকে চেনেন? তবে কি চাবি তোমার কাছে?”
“জী হাঁ। ইনিই হলেন মরহুম হাসান সর্দারের দৌত্তুরীর দিকের বংশধর, পটাশ কালীর গুপ্তধনের একমাত্রে জীবিতা ওয়ারিশন!” রফি কাপ্তেনের নির্বিকার ঘোষণা!
কনফিউজড দারোগা সাহেব এবার অসহায় গলায় বলে উঠলেন, “এ’সব নিজ নিজ মামলা স্যর আপনারা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিন। আই.জি. সাহেবকে তাহলে আমি সেই মোতাবেক রিপোর্ট পাঠিয়ে দি’?” বলতে বলতে ও.সি.র মোবাইলে “মাআআ গোওও আনন্দময়ী নিরানন্দ কোরোনা আ আ......” বলে একটা কল এসে গেল ও তিনি একটু সরে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন।
এরপরের ঘটনা অতি নাটকীয়!
টর্চের আলোটা একটু ঢিমে হয়ে আসাতে রফি কাপ্তেন আমাদের কানে একবার মাত্র বলল, “কুইক!” তারপর......!!! তারপর অবশ্য পুলিশ দলের তীব্র হুইশ্ল বাজানো ছাড়া আর কিছুই করার রইল না কারণ এ’ তল্লাটের পথঘাট তারা তো আর রফি কাপ্তেনের চেয়ে ভালো চেনে না। দোষের মধ্যে আঁধারে দৌড়ুতে গিয়ে কোন্ বেঘাটে ঠ্যাং পড়ে আমার কুঁচকিতে এক বেমক্কা টান লেগে গেল! তাই নিয়েই অবিশ্যি দৌড়েছি, ছাড়িনি!
এই সময়ে উত্তরবঙ্গের রঙপুরে এক দিশি ডাকাতের বড় বাড়বাড়ন্ত হয়। নটে মিঞা বা হাসান সর্দার নামে পরিচিত ছিল সে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করত নটে--- হিন্দু-মুসলিম বাছ-বিচার ছিল না। সহজেই তাই সে গরীব মানুষের চোখের মণি হয়ে ওঠে। তাই বারবার পল্টন পাঠিয়েও তাকে কব্জা করতে পারছিল না ইংরেজ শাসক। শেষে তারই এক সাকরেদ সামান্য পয়সার লোভে বেইমানি করে তার সঙ্গে, ও নটেকে ধরিয়ে দেয়। রঙপুরের জঙ্গলেই নটে ও তার বিশজন বিশ্বস্ত সহচরকে ফাঁসিতে লটকে দিল ইংরেজ। শেষে কাক-শকুনে ঠুকরে খেয়েছে তাদের শরীর, দফনাতেও দেয়নি সাহেবরা!
ধনীর লুটে এই নটে মিঞা জমিয়েছিল তিন ঘড়া মোহর--- এক্কেবারে বাদশাহি আসরফি! চাঁদির টাকা! সে-খবর লর্ড ক্লাইভ পর্যন্ত পৌঁচেছিল, কিন্তু ঢের খুঁজেও তার হদিশ করতে পারেনি ইংরেজরা। তারা হাল ছড়ে দেবার পরে স্থানীয় মানুষও কম ঢোঁড়েনি। শোনা যায়, কোন্এক ডাকাতে কালীমন্দিরে নটের বিশ্বস্ত এক কাপালিক যক করে দিয়ে গেছে সে সম্পত্তি। উর্দু না ফার্সি ভাষায় লেখা এক ম্যাপ পুরনো কাগজওলার কাছে বাই চান্স আবিষ্কার করে ফেলি আমি। বেশ রঙচঙে পুরনো তালপাতা দেখে নিনিকে খেলতে দোব ভেবে পকেটস্থ করেছিলুম। ছোট্ট ভাইঝি তার ওপর কুলকুচি করা প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছে দেখে তাকে একটা পুরনো মোবাইল ঘুষ দিয়ে ম্যাপটা ফেরৎ নিয়ে নিই। ক্লাবে বড়দের আসরে গেরম্ভারি করে বড়াই করতে গিয়েই না ফাঁসলাম! ক্ষিতীশদা কলেজে ইতিহাস পড়ায়। বলল, “আরে এটা তো ফার্সি ভাষা। দে, আমাদের কলেজের রমজান সাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নোব।”
সেইতক ম্যাপখান আমার হাতছাড়া। শেষটায় মুশকিল আসান নন্দাকে ধরি। কী ভাবে সে ম্যাপখানাকে হাতিয়ে নিয়েছে ফের, বাকি অর্ধেকটাই বা কোথায় গেল--- জানিনা সে-সব। শুধু জানি, গুরু নন্দার কথায় ঘর ছেড়েছি। অর্ধেক ম্যাপ দিয়ে যদি তিনের জায়গায় ডেড় ঘড়া মোহরও পাওয়া যায়, বাকি জীবন বড়দের আর মাস্টারদের ধ্যাতানি খেতে হবে না--- এইটুকু মাত্তর আশা। নন্দার অবশ্য একমাত্র দাবি তাকে এক থ্রিজি মোবাইল কিনে দিতে হবে। আর সোমবারের পরের সোমবার থেকে অবশ্য আমার ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা। আশা ছিল, তারই মধ্যে গুপ্তধন উদ্ধার করে ফিরে আসব। এর মাঝে এই ফ্যাসাদ! ভাবো!
এখন এই মাঝরাতে রফি কাপ্তেনের হাত ধরে আর কোন্ এক অজানা ডেরায় এসে উঠেছি আমরা মানিকজোড়ে কে জানে! এটা একটা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয়, আধাখ্যাঁচড়া, দেয়ালে পুলটিশ পড়েনি---লম্পর ক্ষয়াটে আলোয় দেখলুম। জায়গাটাও শহরের হাতার বাইরে মনে হয়। কুপ কু্প করছে অন্ধকা্র। “রাত দু’প্রহরে ‘নানা’ আসবে। তোমরা তৈরি থেকো," বলে নাঙ্গা মেঝেতে লম্বা হল রফি কাপ্তেন। তার দেখা দেখি নন্দাও। এ’দিকে হঠাৎ শুনি আকাশে অকালের গুরুগুরু। বিদ্যুৎও চমকালো বার কয়েক। বিষ্টি নামবে নাকি? একে গোলেমালে মাফলারখান গাছের মাথায় ফেলে এসেছি।
এমন সময় পরপর দু’বার তুমুল বাজ প’ড়ে ঝমাঝম্ বিষ্টি শুরু হয়ে গেল। অসময়ের বিষ্টি, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া ও প্রবল শীত! ‘ঘর’-এর জানলা-দরজা লাগেনি এখনও, ব্যাপক ছাঁট আসছে জলের। মাঝ-বরাবর বসে ঠক্ঠক্ কাঁপছি। এমন সময় ছপ্ছপ্ করে ছাতা-মাথায় এক দশাসই মূর্তি ঘরে ঢুকে গোঁফ থেকে জল চুমড়ে ফেলতে লাগল।
রফি কাপ্তেন হুঁশিয়ার আদমি। কখন নিঃসাড়ে ঘুম ভেঙে উঠে একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেলেছে। একটা আলগোছে অফারও করল আগন্তুককে। সে-লোকটা অসম্ভব মিহি স্বরে বলল, “মানচিত্রখানি অক্ষত আছে তো?”
ওই স্ট্রাকচারে এই আওয়াজ? আমার অভক্তি হল। বললুম, “রফিদা, উট্কো লোকজনের হাতে ম্যাপটা ছাড়া কি ভালো দেখাবে?”
“উট্কো লোক? উট্কো লোক?” বলতে বলতে সেই মিহি গলাতেও হুহুংকার ছেড়ে ফস্করে আমার নাকের ডগায় প্রমাণ সাইজের এক ড্যাগার ধরল লোকটা! অন্ধকারেও তার ধার চক্চক্ করে উঠলো! আর জ্বলে উঠলো মুস্কোর হিংস্র চোখ জোড়া!
আমি অবিশ্যি ভয় পাইনি, কারণ ততক্ষণে ঘুম ভেঙে উঠে হাঁ---আ করে হাই তুলতে তুলতে নন্দা জানিয়ে দিয়েছে, “সেই ম্যাপ আধখান্ আছে জারুল গাছের কোটরে।”
লেড়ো দিয়ে পেট ভরিয়ে ছাঁচি পান চিবুতে চিবুতে পরবর্তী একশন প্ল্যান ছকে নেওয়া গেল। নতুন কথা শোনালে নানা, “নটে মিঞার গুপ্তধন তোমাদের এই মালদা জেলায় নেই গ’। সে আছে ভুটান পাহাড়ের কোলে, গভীর জঙ্গলের মাঝে তে-জোড়া কাঁটাল বিক্ষের নিচোয় । পটাশ কালীর মন্দির যদিও আজ ভেঙেচুরে পয়নট্ট, তবে দেবীমূর্তির পাটাখানি আজও অক্ষত আছে!” পরম নিশ্চিন্ত গলায় জানিয়ে, সেই কোন সুদূরবর্তী মা কালীর উদ্দেশ্যে ভক্তিভরে প্রণাম জানায় নানা।
“তোমার ইয়ে আপনার কোনো ভুল হচ্ছে না তো? কারণ ম্যাপে পষ্টো কুম্ভীরার জঙ্গলের কথা উল্লেখ আছে।” হাত কচ্লে নানাকে পোছে নন্দা।
“তোমার মুণ্ডু। ফার্সি ভাষা কী তোমরা মোতিবিবির চে’ বেশি বোঝো নাকি? সে-ই হবে আমাদের পথপ্রদর্শক।”
“আবার মেয়েছেলে সঙ্গে নেওয়া কেন বাপু? শাস্ত্রে বলেছে.........” ঠোক্ পাড়ে নন্দা।
খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে গড়িয়ে পড়ে নানা, বলে, “সে নামেই বিবি। আসলে আমার চেয়েও আধহাত ঢ্যাঙা, সা-জওয়ান!”
“তাহলে অকারণ তাকে বিবি বলা কেন?” নন্দার খট্কাটা কাটতে চায় না।
পরম নিশ্চিন্তে সেই বিড়িটা ধরাতে ধরাতে নানা জানালো, “ডাকনাম মোতি, ভালো নাম বিনোদবিহারী, সেই থেকে বিবি, এটুকু বুঝলে না খোকা?” নন্দদাকে খোকা বলল!
বিষ্টিটা ফের ঝেঁপে এলো আর কাছ থেকেই হুক্কা হুয়া হুয়া হুয়া করে শিয়ালের দল ডেকে উঠল ।
কোত্থেকে পট্লা এক এঁটুলি ঘা জোগাড় করে এনেছে। সারাক্ষণ মাথাটা বাঁয়ে হেলিয়ে হেলিয়েই হাঁটছে। বড্ড দুর্বল, নিজের লেজটাও কামড়াতে পারে না। সকালের বরাদ্দ কিস্মিস্ ক’টাও না-খাওয়া পড়ে আছে, শুধু চা পিয়েই ফের গুটুলি পাকিয়ে টেবিলের তলায় ঢুকে শুয়ে পড়ল। এই করলে শরীর থাকবে? কাল লাঞ্চে হর পালোয়ান ছাতু গুলে ডাকলেও কাছে যায়নি। নাঃ, পাল্সেটিলা থার্টিতে আর কাজ হচ্চে না। সদরে একদিন নিয়ে গিয়ে সেই নুরু বদ্যির হীরাভস্মচূর্ণ বটিকা এক ডোজ সেবন করিয়ে না আনলেই নয়।
সবে রোববার সকালের ‘বর্তমান’ খবরের কাগজখানি শেষ করে এফ এম রেডিওর চাবি ঘোরাতে যাবেন নিমু দারোগা, হুড়মুড় করে জনা সাতেক লোক ঢুকে এক সিড়িঙ্গে আদমির কলার পাকড়ে ধড়াম করে থানার ফ্লোরে এনে ফেলল। সঙ্গে মেলা হৈ হল্লা হট্টগোল। ‘টংটংটং’ করে বেলটা বাজিয়ে নিমু হাজরা ঢালাও হুকুম দেন, “জমাদার, সবকো অন্দর চালান দো!”
“না স্যর, মানে, অধমের নাম সত্যব্রত সমাজপতি। আমি এক প্রাচীন পুঁথির সন্ধানে কলেজ লাইব্রেরিতে.........।”
“চোপরও, ইউ লায়ার। তুমি আমাদের তিনতলার চিলেকোঠায় চড়োনি বলতে চাও?” প্রাক্তন জমিদার কালাম সাহেবের ভাইপো নাড়ু ফুঁসে ওঠে।
“সে তো কলেজ লাইব্রেরির ছাদের লাগোয়া বলে........” সাফাই গাইবার চেষ্টা করে সিড়িঙ্গে ছোঁড়া, বলে, “বাবলা গাছের ডাল এ’বাড়ি ও’বাড়ির ছাদে ছাদে.......”
রহস্যের গন্ধ পান অভিজ্ঞ দারোগা নিমাইব্রত হাজরা। গতকালই ভর সন্ধেবেলা আই.জি. সাহেবের বন্ধুদের সঙ্গে মদন হাড়ির ভগ্ন প্রাসাদে অভিযান চালাতে গিয়ে এক প্রাচীন পুঁথি না ম্যাপ নিয়ে ঘোরতর ঝামটা খাওয়া গেছে। এই সত্যব্রত ছোঁড়া কোনো মামুলি সিঁদেল চোর নয়। এ’ও কোন প্রাচীন পুঁথির কথা বলছে। কান খাড়া হয়ে ওঠে দারোগার। বাকিদের ভাগিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে পড়েন দারোগা সায়েব। ভাগ্যিস আজ নিম্নচাপের বাজারে ভিড়ভাট্টা কম ছিল। কাল রাত থেকে নিঝর বিষ্টি শুরু হয়ে গেছে। খবরে বলছে চব্বিশ ঘন্টার পূর্বে কাটার আশা নেই। দুপুরের মধ্যে যে তথ্য উদ্ধার হল তা এই প্রকারঃ
ইতিহাসের রিসার্চ স্কলার সত্যব্রত সমাজপতি উত্তরবঙ্গে এসেছে এক প্রাচীন পুঁথির সন্ধানে--- দু’শো বছরেরও আগে ফার্সি ভাষায় লেখা সে ভূর্জপত্রের পুঁথিতে পলাশী-পরবর্তী উত্তরবঙ্গের ইতিহাস বিধৃত আছে, আর আছে একখান মানচিত্র, যাতে কোন্ নটে ডাকাতের ভুঁয়ে গাড়া গুপ্তধনের হদিশ আছে।
দারোগার কানের চুল খাড়া হয়ে উঠল! আরে, কালই কলকাতা থেকে আসা আই.জি.সাহেবের বন্ধু আরেক ইতিহাসের প্রোফেসর ক্ষিতীশ পাকড়াশীও এই নটে ডাকাতের মানচিত্রের কথা বলছিল না? চোখদুটো ছোট ছোট করে নিমু দারোগা বলেন, “তার মানে স্কলারবাবু, ও’সব প্রাচীন পুঁথিটুঁথি সব ফক্কিকারি। আসল হচ্ছে গুপ্তধন! খোল্সা করে বলুনই না মহায় আপনি এসেচেন সেই নটে মিঞার গুপ্তধনের খোঁজে।” চিবিয়ে চিবিয়ে কথা ক’টি বলে বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন নিমাই দারোগা।
এই ফাঁকে ভৃত্য স্বপ্নিল কখন দু’কাপ ধূমায়িত চা রেখে গেছে। সত্যব্রত ছোক্রা প্যাংলা হলেও সহজে ঘাবড়াবার পাত্র নয়। কাষ্ঠ হেসে সে সটান প্রস্তাব পাড়ে, “নিন্ স্যর, হাত মেলান। আমার বুদ্ধি আপনার ফোর্স! নটে মিঞার তিন জালার আধা ডেড় জালা আসরফি পেলেই আপনাকেও আর বাকি জীবনে ওই উর্দি পরে উদয়াস্ত উপরওয়ালার জো-হুজুরি করতে হবে না, আর আমিও এই কলেজের থাউকো চাকরি ছেড়ে বিলেতের ফুটবল টিম কেনার বিড দোব। আরও শুনুন স্যর, দু’জন দাগী ডাকাত অলরেডি এই নটে সর্দারের ম্যাপের অর্ধেক নিয়ে এ’ অঞ্চলে ঘুরঘুর করছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের কাছে খবর আছে। আবার তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নটেবংশীয় নাতজামাই । নাম তার রফি কাপ্তান!”
“আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, দাঁড়াও হে ছোক্রা। নটে সর্দার, রফি কাপ্তেন......নামদু’টো হালে যেন কোথায় শুনেছি কোথায় শুনেছি.....” বলতে বলতে টংটং করে ফের পেতলের ঘন্টিটা বাজান দারোগা। সেজবাবু জয়ন্ত হালদার এসে বুট ঠুকে সেলাম বাজান। “বলি হ্যাঁ হে জয়ন্ত, কালরাতে মদন হাড়ির সেই ভগ্ন প্রাসাদ রেড করতে গিয়ে........”
“আপনার অনুমান নির্ভুল, স্যর। সে রফি কাপ্তেন নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ।” জয়ন্ত হালদার বাঙলায় এম.এ. করে পুলিশে ঢুকেছে।
“আর নটে সর্দার নামটা যেন.......”
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর। নটে সর্দার ছিল কোম্পানীর আমলে এ’তল্লাটের এক রবিনহুড। তাদের বংশে এক রবিনহুডত্বের ধারা বজায় আছে বলে খবরে প্রকাশ। কারণ.........”
“হুর্রে এ এ এ, পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে। মিসিং লিঙ্ক পাওয়া গেছে," বলে লম্ফ দিয়ে উঠে দু’পাক আনন্দে নেচে নেয় সত্যব্রত স্কলার, “এই তো মিসিং লিঙ্ক জুড়ে গেল। নিন দারোগা সাহেব এবার হাতটা মেলান?”
এতক্ষণে ফের মেঘ গর্জে আরেক পশলা বৃষ্টি ঝেঁপে এলো। পাশের ঘর থেকে এফ.এম.-এ ভেসে এলো পুরনো দিনের গানের কলি, ‘সর পে লাল টোপি রুশি, ফির ভী দিল হৈ হিন্দোস্তানি.....’
এর এক সপ্তাহের মধ্যে পুলটির জঙ্গলে যে নৈশ-অভিযানটি চলেছিল তার ইতিহাস কেউ লিখে রাখেনি। রাখলে পলাশী আর পুলটি--- এই দুই টোয়াইন মিলে যেত। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে যেটুকু জানতে পেরেছি, নিবেদন করিঃ
সবার পেছন ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে চলেছি আমি। সেই যে দ্বিতীয়দিন পুলিশের হাত থেকে পালাতে গিয়ে এক গত্তে পা পড়ে গেস্লো, কুঁচ্কির টানটা আর গেল না। তার ওপর পা চুলকোচ্ছে প্রচণ্ড। বিচুটি লেগেছে। চুলকোনোর খ্যাঁস্খ্যাঁস্ শব্দে বিরক্ত হয়ে লিডার মোতিবিবি বলল, “এ’সব কাজ খুব স্তিল্দিলি করতে হয়, শত্রুতে যেন তেরও না পায়!” লোকটার ‘ট’ ‘ড’-এর দোষ আছে, বলে ‘তাকা’ ‘দাকাত’!
হঠাৎ ‘ক্যাঁ ক্যাঁ’ করে এক পেঁচার ছানা কেঁদে উঠলো, আর বললে বিশ্বাস করবে না, আমি সড়াৎ করে এক মস্ত গাছে উঠে গেলুম! কী ঘটে গেল বোঝার আগেই মাথায় এক বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছি।
কতক্ষণ পরে জানিনা, জ্ঞান যখন ফিরলো, দেখি এক মস্ত ঘরে বসে আছি। কুলুঙ্গিতে এক গোল ঘিয়ের পিদিম জ্বলছে, তাতে ঘরের চোদ্দআনাই আঁধারে রয়ে গেছে। কানের লতিতে এক মশা কামড়াচ্ছে তো কামড়াচ্ছেই। মারতে তো পারছিই না, চুলকোতেও না, কারণ আমার হাত দু’টো টাইট করে পিছমোড়া বাঁধা, পদযুগলও! এবার অনুভব করলুম, ক্ষিদেয় পেটের ভেতরটা কেমন যেন কৌটো নাড়ার মত হচ্ছে!
কী যে আমার সঙ্গে ঘটে গেল, আমার সঙ্গেই বা কেন, আমার সঙ্গীত্রয়ের কী হাল --- এ’সব ভাবতে ভাবতে এতো দুঃখের মধ্যেও একটু ঢুলুনি মত এসে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হল, ম্যাপ? আমাদের সেই অভাগার ধন বহুমূল্য মানচিত্রখানা কোথায় গেল? শেষবার শহর ছাড়ার আগে আমায় জারুল গাছে ফের চড়িয়ে সে-সম্পদ নামানো হয়েছিল। এক প্ল্যাস্টিকের ঠোঙায় ভরে আমার পেট-কাপড়ে রাখা হয়েছিল। হাতবাঁধা অবস্থায়ই একটু পেট-টেট নাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করলুম খড়্খড়্ করছে কিনা। করছে না । মানে, গেছে! কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে-মহা দুঃখও আর যেন কোনো মানে রাখল না আমার কাছে। হঠাৎ মনে হতে লাগল, সেই যে সেদিন আমাদের থাণ্ডার্স ক্লাব থেকে আসা ক্ষিতীশদা-নবিমামাদের দেখলুম, তারা এলো কী করে আর গেলই বা কোথায়? বাড়ি থেকে এ’দ্দিন হাওয়া হয়ে আছি, ফিরে কী অভ্যর্থনাটা অপেক্ষা করে আছে, সেটা ভেবেও কোনো দুশ্চিন্তা হল না, ক্ষুধার এমনই কামড়! হঠাৎ মইয়ের মচ্মচ্ আওয়াজ শুনে দেখি বড় জাহাজী ল্যান্টার্ন হাতে এক বুড়ো লোক নেমে আসছে এই ঘরে। তাহলে কি এই ঘরখানা মাটির নিচে? বুড়োটাকে দেখতে অনেকটা সেই ‘আবোল তাবোল’-এর ‘বাপ্রে কী ডানপিটে ছেলে’-র বুড়োটার মত। গায়ে চৌখুপ্পি চৌখুপ্পি ওভারকোট, চোখে প্যাস্নে।
এ-ই কি গাছ থেকে দড়ির ল্যাসো মেরে আমায় তুলে এনেছে? এরই হাতেই কি আমি বন্দী? খুব একটা বিশ্বাস হল না, কারণ বুড়োটা নিরীহ প্যাটার্নের। আর সে আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ঘরের ও’দিক পানে গিয়ে ফস্ফস্ করে এক পেতলের প্রাইমাস স্টোভ জ্বালিয়ে সস্প্যানে কী যেন গরম করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্ধটা ফুটন্ত খিচুড়ির বেরতে লাগল। শুঁকে আমার ভয়ঙ্কর ক্ষিদে পেয়ে গেল । একবার ভাবলুম ডাকি, ডেকে একটু খেতে চাই । অনেক করে চাইলে একটুও কি দেবে না? পরে ভাবলুম, সেটা ভালো দেখাবে না। কারণ, আমি যদি এর হাতেই বন্দী হই বা এ’ তাদের দলেরই কেউ হয়, তবে দু’ঘা লাগিয়ে দিলে বা ঝুলপি ধরে টানাটানি করলে অকারণ কষ্ট পাবো। হঠাৎ আমার পোষা ছাগল নিশিপ্রদীপের কথা মনে প’ড়ে কষ্ট হতে লাগল। মা আমায় আম কেটে পাতে দিলে সে-বেচারি কেমন জুলজুল তাকায়!
কিন্তু কী আর বলব তোমাদের, এর পরেই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে আমার পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হল না। দেখি, বুড়োটা ডান দিকের এক মস্ত কাঠের সিন্দুক খুলে তা থেকে একে একে বের করে করে এক ধুচুনিতে ঠং ঠং করে মোহর গুনে গুনে ফেলছে। লন্ঠনের ম্লান আলোতেও মোহরগুলো চক্চক্করে উঠছে! হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি আমি। আমরা যে টাকা-আধুলি ব্যবহার করি, তার থেকে বেশ বড় বড় সাইজের; আর রঙটাও রূপোলি নয়, হল্দেটে।
উত্তেজনায় আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। এ’-ই কি সেই নটে সর্দারের যকের ধন যার সন্ধানে বিগত সাত-দশদিন কী নাটা-ঝাম্টাটাই না খাচ্ছি। কিন্তু সে তো পোঁতা আছে কোন্ পটাশ কালীর মন্দিরের পাটাতনের নিচে, তে-কাঁটাল গাছের নিকট। তবে?
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত আমার মাথায় খেলে গেল, এ’-ই সেই পটাশ কালীর মন্দিরের নিচের গুমঘর নয়তো, যেখানে আজ আমি বন্দী? কিন্তু এরা কারা? কেনই বা শুধু আমাকেই বন্দী করল? বাকিদের কী হাল?
শেষটায় আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলুম, “ও’ ভাই, দাদা, মানে কাকু, না জ্যেঠু, আমি এ’দিকে আছি, ডুমুরদ’র অভিমন্যু দস্তিদার।”
লোকটা কোনো আমলই দিলো না, ঘাড়ও ফেরালো না । মোহরভরা ধুচুনি মাটিতে নামিয়ে রেখে ফের নিবিষ্টি মনে সস্প্যানের খিচুড়িতে হাতা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ‘হয়েছে’ কিনা দেখতে লাগল। আরও একবার চেঁচিয়ে বললুম, “কাকু,আমার বড্ড ক্ষিদে পেয়েচে। আমি ক্লাস এইটে পড়ি।” নো উত্তর। এবার আমি স্থিরনিশ্চিত হলুম যে লোকটা বদ্ধ কালা । ওরা এক বদ্ধ কালাকে আমার পাহারায় ছেড়ে গেছে?
এমন সময় ‘ঘেউ ঘেউ কেঁউ কেঁউ’ শুনে পিছন ফিরে দেখি কোত্থেকে এক ফেতি কুত্তা এসে জুটেছে আর আমার পকেটে বিস্কুটের গন্ধ পেয়ে ‘কুঁই কুঁই’ করছে। এ’পাতালপুরীতে কুকুর আবার এসে ঢুকলো কোন্ পথে? যাক্, একে কাজে লাগানো যাক্। কায়দা করে পকেট থেকে দু’টো বিস্কুট বের করে দিয়ে ওর ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে টেনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাতের বাঁধন কাটিয়ে নেওয়া গেল। আমার হাতেও কি দাঁত ক’টা পড়েনি? পড়েছে, পড়েছে। তাতে কী? বাড়িতে আমার প্রিয় বাঁটলোও কি আদর করে আমায় কম দাঁত বসায়? আমার পকেটের মোবাইল ফোনটি হাওয়া।
এবার পায়ের বাঁধন খুলে সে-সস্প্যান বুড়োর কাছে উঠে গিয়ে তার পিঠে টোকা দিতে সে অবাক চোখে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে রইল! তার পর কান থেকে মোবাইলের তার খুলে গান শোনা বন্ধ করে ফোক্লা দাঁতে এক গাল হেসে খুব আন্তরিক গলায় বলল, “ও’মা! নন্দ তুই! এখানে হঠাৎ কী মনে করে রে?” আমি অবাক! লোকটা নন্দদাকে চেনে নাকি? কিন্তু নন্দদার সঙ্গে আমি দেখতেও তো একপ্রকার নই। তবে? বললুম, “আমি অভিমন্যু। ভালো গুলতি ছুঁড়তে পারি।” লোকটা তাও বেশ পরিতৃপ্ত গলায় বলল, “তা হোক্, তুই বোস্।” তারপর বেশ ধীরেসুস্থে সস্প্যানটা নামিয়ে স্টোভটা নেবালো। আমার বুক খেতে পাবার আশায় দুরুদুরু করে উঠলো। পেছনের সেই কুকুরটা প্যানটা একবার শুঁকে বিরসবদনে এসে আমার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। কুকুরটার বাঁ-কানে কিছু হয়েছে। বেচারি মাথাটা সারাক্ষণ বাঁ-দিকে হেলিয়ে রেখেছে। আর ঠিক এমন সময়ে ওপর থেকে যেন মৃদুস্বরে শুনতে পেলুম লম্বা হুইস্ল---একবার, দু’বার তারপর টেনে টেনে বেজেই যেতে লাগল। পুলিশ নাকি? ভালোই হল। আমার আর এখন ভয়ের কী আছে? এখন আমি নিজেই তো বন্দী! পুলিশ এসে উদ্ধার করুক আমাকে। তার আগেই খিচুড়ি কিছুটা সাঁটিয়ে দোব কিনা ভাবছি। কুকুরটা দেখি হুইস্লের ডাক কান খাড়া করে শুনে আনন্দে ভৌ ভৌ ভৌ ভৌ করে উঠল। আর সে-লণ্ঠনীবুড়ো সস্প্যানট্যান ফেলে ধড়মড় করে মই বেয়ে উপরে উঠে গেল, লন্ঠন সহ। আর এ’ ঘরখানা ফের অন্ধকারে ডুবে গেল। শুধু সেই এঁটুলিওলা কুকুর, আমি ও সস্প্যানের খিচুড়ি রয়ে গেলুম ঘরে। তাকে শুধোলুম, “তুই এখানে কী করে ঢুকলি রে?”
পরের দিন ট্রেনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সারাদিনে ক্ষিতীশদা আর তার বন্ধু পুলিশের এস.পি.-র কথোপকথনের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা জুড়ে জুড়ে এই খাড়া করা গেলঃ
নটে সর্দারের গুপ্তধন বলে আসলে কিছু নেই। এটা একটা বহু প্রাচীন লোককথা মাত্র। আর এই এল ডোরাডো খানি দেখিয়েই সি.আই.ডি.-র এস.পি. সত্যব্রত সমাজপতি ওরফে ক্ষিতীশদার এই কলেজী বন্ধু মিঃ পুণ্যব্রত আচার্য আই.পি.এস., এক প্ল্যান ছকেন মালদহ-বাঙলাদেশ সীমান্তবর্তী মাদক পাচারকারী এক চক্রকে ধরতে। “দিল্লি থেকে বেঙ্গলে ফিরে প্রথম বি.এস.এফ.-এর কাছ থেকে কমপ্লেইনটা পাই, বুঝলি ক্ষিতী। ওই ম্যাপখানা আঁকাতে নগদ সাড়ে সাতশ’ খসেছে---চাঁদনি চকের এক বুড়ো কার্টোগ্রাফার বিন্দা হাসান! আমরা জানতাম, নটে সর্দারের গুপ্তধনের মানচিত্রের নাম শুনলে এ’ অঞ্চলের অনেক ঘাগু ক্রিমিন্যালেরই নোলা সক্সক্ করে উঠবে আর সেই ফাঁকে আমরাও ওদের গোপন ডেরাটার হদিশ পেয়ে যাবো, কারণ আমাদের অনুমানে যেখানে ওদের ডেরা, সেখানেই পটাশ কালীমন্দিরের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল মানচিত্রে। আমার প্ল্যান ছিল ইতিহাসের গবেষক সেজে মালদায় এসে ওই ম্যাপের ধুয়ো তুলে কাজ সারবো। মাঝখান থেকে অচানক পুরনো খবরের কাগজওলার হাতে পড়ে ম্যাপখানি দু’ভাগ হয়ে গিয়েই জটলাটা পাকায়। ভাগ্যিস আমার হাত-নুড়কুৎ রফি ছিল । ওরা এ’তল্লাটের সাত পুরুষের বাসিন্দে। আর রফি যে আসলে সি.আই.ডি.-তে চাকরি করে সেটা তো ওর বিবিও জানে না। মাঝখান থেকে কনফিউজড হল বেচারি নিমু দারোগা। তাড়াহুড়োয় সে-বেচারিকে কনফিডেন্সে নেওয়া হয়ে ওঠেনি। রফিকে নির্দেশ দেওয়া ছিল না। তাই সে-সন্ধেয় নিমুকে দেখে রফি ছেলেদুটোকে বগলদাবা করে পালায়।”
“হ্যাঁ” ক্ষিতীশদা বলে, “সে-দিন কলেজের এলামনি-মিটে তোর কাছে এ হেন এক ম্যাপের গল্প শুনে চার দিন পরেই ক্লাবে এই নন্তে ওরফে অভিমন্যুর কাছে এক অর্ধ ম্যাপ দেখে ফার্সি পড়িয়ে নেওয়ার নাম করে চেয়েনি’।”
“আর, ক্ষিতীশদা, আমি এমনই গাড়োল যে ওই অর্ধ-ম্যাপ তোমার কাছ থেকে ফের হাত-সাফাই করে নিয়ে নন্তেকে সাথি করে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে চড়ে বসি গুপ্তধন উদ্ধারের আশায়,” নন্দদার গলায় হায়-হায়ের সুর। কপাল চাপড়াতে থাকে নন্দমাধব সিংহ, সেটা অবশ্য কতটা নিজের বেকুবিতে আর কতটা গুপ্তধন ফসকানোর আফশোসে --- সেটা ধরা মুশকিল।
ক্ষিতীশদা বলে, “ইয়েস, মিঃ নন্দলাল। আমার কাছে থেকে ম্যাপ চুরি যাওয়ায় তোকেই সন্দেহ করেই পুণ্যকে জানাই । সে-ও রফিকে পাঠায় ট্রেনে তোদের ফলো করতে। মাঝখান থেকে পুণ্য হঠাৎ ছদ্মবেশ ধরে বেরিয়ে পড়াতেই উত্তরবঙ্গের আই.জি. প্রতাপ কাকাকে ধরে নিমু দারোগাকে দিয়ে কালিয়াচকের ওই মদন হাড়ি না কার বাড়িতে রেড করাই।”
এস.পি. পুণ্যব্রত আচার্য আরও বলেন, “হ্যাঁ, এই নানা, মোতি আর গয়াপ্রসাদ,---যে শেষে অভিমন্যুকে পাকড়েই কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতল---এরা এক আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্রের অংশ। ইন্টারপোলের হেল্পও আমরা চেয়েছি এ’ব্যাপারে কারণ মাথাগুলো দুবাই থেকে অপারেট করে বলে অনুমান।”
কিন্তু শেষাবধি একটা খট্কা আমার কিছুতেই কাটতে চায় না, বলি, “কিন্তু এস.পি.সাহেব, সেই মোহর! সেই মোহরগুলো কোথায় গেল? আমি যে ওদের ডেরায় সেই বুড়োকে দিব্যি ঠং ঠং করে মোহর গুনতে দেখে এসেছি নিজ চক্ষে!”
এবার এস.পি. পুণ্যব্রত আচার্যের হাঃ হাঃ করে হাসার পালা। বলেন, “মোহর? ওগুলো মোহর? ছোঃ! ও’ তো দেখলাম স্টেট ব্যাঙ্কের পেমেন্ট টোকেন! পেতলের চাকতি বই কিছু নয়। সেগুলোকে চকচকে করে মেজেঘষে রেখেছিল কোন্ধান্ধায় , সেটা বুঝে নিতে হবে।”
বলতে বলতে ট্রেন দক্ষিণেশ্বর ঢুকছে। মা-কালীর উদ্দেশ্যে পেন্নাম ঠুকে বললুম, “মা, আর সোমবার থেকে তো পরীক্ষা। বই তো ছুঁইনি। এ’বারের মত যদি উৎরে দাও তো পরের বার থেকে তুমুল পড়াশুনো করব, ও পরে যখন সত্যি সত্যি নটে মিঞার গুপ্তধন আমি উদ্ধার করব তার আধা তোমার জন্য এখন থেকে মানত করে রাখলুম।”
জয় হো!!!
(পরবাস-৪৮, মে, ২০১১)