রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন ও প্রসঙ্গকথা
এখন থেকে ষাট বছর আগে মার্চ মাসে ক্ষিতিমোহন সেন আমাদের ছেড়ে চলে যান। ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিশ্বভারতী এই দীর্ঘ জটিল পথ পরিক্রমায় ক্ষিতিমোহন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রধান সহযোগী, আলাপ আলোচনায় নিত্য সহচর, বিশ্বভারতীর গুণিজনসভায় প্রধান সভাসদ। রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছিলেন — 'একা নব রতন ক্ষিতিমোহন / ভকতি-রসের রসিক। / কবীর-কাম-ধেনু করি দোহন / তোষেণ তৃষিত পথিক।' রবীন্দ্রনাথের নবরত্নসভার অন্যতম ক্ষিতিমোহন ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, মধ্যযুগের সন্তধর্মের প্রচারক, রবীন্দ্রসাহিত্যের রসজ্ঞ আলোচক, বৌদ্ধধর্মের গবেষক, বাউল ফকির গানের তত্ত্বসন্ধানী সংগ্রাহক, শব্দতাত্ত্বিক, বৈদিক প্রথানুসারী পুরোহিত, উৎসব অনুষ্ঠানে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় নিষ্ঠাব্রতী, সতত জিজ্ঞাসু পর্যটক, ছাত্রদরদী শিক্ষক, আকর্ষণীয় বাগ্মী। সংগীত নাটক অভিনয় ও অলংকার শাস্ত্রে পরিমাপহীন অনুরাগী, আয়ুর্বেদ চিকিৎসা থেকে রন্ধনবিদ্যা সব কিছুতে তিনি অনায়াস, শান্তিনিকেতনী প্রশাসনে, ছাত্র অধ্যাপক ও অন্যান্যদের পরিচালনায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিরল মানুষ। ক্ষিতিমোহন ও বিধুশেখর দুজনেই কাশী থেকে আগত সংস্কৃত পণ্ডিত, বুদ্ধদেবের যেমন দুই প্রধান শিষ্য সারিপুত্ত এবং মৌদ্গল্যায়ন, রবীন্দ্রনাথেরও তেমনি দুই প্রধান সহযোগী - বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেন। বলেছেন পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন — 'ক্ষিতিমোহন যেমন রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার, রবীন্দ্রনাথও তেমনি ক্ষিতিমোহনের কাছে দেখা দিয়েছিলেন অকস্মাৎ এবং অজ্ঞাতপূর্ব মহাদেশ আবিষ্কারের বিস্ময়রূপে।' ক্ষিতিমোহন বলতেন — 'দেখ, আমরা ছিলাম মাটির তাল, গুরুদেব আমাদের হাতে ধ'রে গড়ে পিটে তৈরি করে নিয়েছেন।' তবে পারদর্শিতার বহুমুখিতা বিচারে তিনি মাটির তাল নন, সোনার তাল। মুজতবা আলী একটা সুন্দর কথা বলেছেন। তা হল রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর মাঝখানে সেতুর কাজ করেছেন এ্যান্ড্রুজ। ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ ও বিধুশেখরের মাঝে সেতু ছিলেন ক্ষিতিমোহন। রবীন্দ্রনাথ কিভাবে মাটির তালকে অর্থাৎ ক্ষিতিমোহনকে কাজে লাগিয়েছিলেন সে ব্যাপারটা প্রথমে দেখা যাক। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন হল ১৯০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর, যদিও তপোবন-আদর্শ নির্ভর প্রাচীন ও আধুনিক বিদ্যার সম্মিলনকেন্দ্র-বিষয়ক ভাবনা লালিত হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। জগদীশচন্দ্র বসুকে চিঠিতে বলছেন (আগস্ট ১৯০১) ব্রহ্মচর্যপ্রাণিত বিলাসিতা বর্জিত গুরুগৃহপ্রতিম আবহের উপযুক্ত শিক্ষক প্রয়োজন। ১৯০৭এর ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে আমন্ত্রণ জানান। ক্ষিতিমোহন এ-আমন্ত্রণ গৌরবজনক, কাজ প্রার্থনীয় মনে করলেও দ্বিধান্বিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পুনরায় চিঠি (১২ ফাল্গুন ১৩১৪) লেখেন। ক্ষিতিমোহন সম্মতি জানালেও দ্বিধান্বিত ছিলেন। ৭ দিন পরে রবীন্দ্রনাথ আবার চিঠি লেখেন, এবার সতীর্থ বিধুশেখরের অনুরোধ করা চিঠি, তবু অপেক্ষা চলতেই থাকে। আর্থিকতাই দ্বিধার কারণ। শেষপর্যন্ত ক্ষিতিমোহন বিদ্যালয়ে যোগদান করলেন ১৯০৮ সালের আষাঢ় মাসে। অল্পদিন পর শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ বলেন — ছাত্রদের পেয়ে আমাদের অবহেলা করবেন না। রসচক্রের সঙ্গী চাই, তবে মৌচাক মধুময় হবে। বিদ্যালয় ব্যাপারে আস্থা রেখে বলেন যেরকম ব্যবস্থা করতে ইচ্ছে হয় করবেন, তবে আপনার কাজের পথ আপনার নিজেকেই কেটে নিতে হবে। অধ্যাপকদের সঙ্গে ঐক্য রচনার অনুরোধও করা হয়। অজিত কুমার চক্রবর্তীকে বলেন ক্ষিতিমোহনকে পেয়েই বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাধনা অগ্রসর হবে সার্থকতার পথে। শারদোৎসব রচিত হল, পাঠ হল, ক্ষিতিমোহন হবেন সন্ন্যাসী ঠাকুর। ক্ষিতিমোহন কাশীর কাল থেকে শান্তিনিকেতনে এসেও ঠাকুর্দা হয়ে উঠলেন। এই নাটকের পাণ্ডুলিপি তাঁকে উপহার দেন রবীন্দ্রনাথ। দুজনের সম্পর্ক ছিল তাই ভাবের জগতে, কাজের জগতেও। চিঠিতে কবি তাঁকে সম্বোধন করছেন সন্ন্যাসী ঠাকুর বলে। রবীন্দ্রনাথের মতে যাবতীয় দীনতার মধ্যেও মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল ক্ষিতিমোহনের। রসের ভোজে তাঁকে কাছে পেতে চান বলে ক্ষিতিবাবু যখন দূরে, কবি লেখেন — 'আপনাদের দর্শন কবে পাইব' বা 'ছুটির শেষে আপনাদের সকলের সঙ্গে মিলিবার জন্য উৎসুক হইয়া আছি' বা 'আপনার সঙ্গে মিলনের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিলাম।' অভিমান করে কবি লেখেন — 'আপনার পার্শ্বে বসিবার জন্য আমি বারম্বার চেষ্টা করিয়াছি কিন্তু আপনি আমাকে দূরে ঠেকাইয়া রাখিয়াছেন। .... আপনাদের প্রসাদ পাইবার জন্য আমার মন ব্যাকুল থাকে।' 'আপনার প্রেম যে আমার কি রূপ পথ্য ও পাথেয়, তাহা ও মনে রাখিবেন।' গুরুদেব গান গাইতে গাইতে ক্ষিতিকে গাইবার জন্যে ভীষণ ভাবে ধরতেন। রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি চিঠিতে আশ্রমবিদ্যালয় পরিচালন ও সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে দায়িত্ব অর্পণের কথা আছে। বুদ্ধ খৃষ্ট মহম্মদ চৈতন্য নানক কবীর রামমোহন বিষয়ক উৎসবে তাঁদের জীবনী ও উপদেশ ব্যাখ্যা, রচনা পাঠের নির্দেশ দেন। বৃক্ষরোপণ, প্রকৃতি পরিচর্যা, পাখি কাঠবিড়ালীকে পোষ মানানোয় ছাত্রদের প্রাণিত করার নির্দেশও আছে। মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা, নতুন ছাত্রদের জন্য ঘর তৈরি, দ্বিজেন্দ্রলালের ইংরেজি শিক্ষার বই প্রচলন, পাঠ্যবই নির্বাচন, নিজ কন্যা মীরাকে তাঁর অধীনে সংস্কৃত পড়ানো, অনঙ্গকে পত্রবাহক নিযুক্ত করা, বিদ্যাভবনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব-অর্পণ প্রভৃতি নানা ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সহযোগী হিসেবে পেতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন চারুচন্দ্রকে — 'তাকে আমি হাতছাড়া করতে চাইনে।' ১৯১২তে ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকা পরিক্রমা কালে রবীন্দ্রনাথ একাধিক পত্র লেখেন ক্ষিতিমোহনকে। ক্ষিতিবাবুকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া, বস্টনে তাঁর জন্য হোমিওপ্যাথি পড়ানোর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন কবি। চাইছেন মধ্যযুগের ভারতীয় মিস্টিকদের সম্বন্ধে যা কিছু জ্ঞাতব্য আছে তা জোগাড় করে, দাদূ, কবীর, মীরাবাইয়ের রচনা নিয়ে বাউল গান নিয়ে ইংরেজি ভাষারাজত্বে আসুন তিনি। আদি ব্রাহ্মসমাজের কলকাতার অনুষ্ঠানে (২৭ চৈত্র ১৩২০) আচার্যের কাজ করলেন রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতিমোহন যৌথভাবে। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই ব্রাহ্ম পরিবারে, ব্রাহ্মভাবাপন্ন পরিবারে বিবাহ শ্রাদ্ধ প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্ষিতিবাবুকে আচার্যপদে ডাকা হয়। বসুবিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসে (৩০ নভেম্বর, ১৯১৭) তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কয়েকটি বৈদিক মন্ত্র নিয়ে অনুষ্ঠানে যান। গান্ধীজীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ যখন গুজরাত যান তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন অ্যাণ্ডরুজ, ক্ষিতিমোহন, সন্তোষ মজুমদার ও প্রমথনাথ বিশী। এ বছরই পু্নেতে বিশ্বভারতীর আদর্শ ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব তাঁকে দিলেন রবীন্দ্রনাথ (২৮ এপ্রিল, ১৯২০)। প্রাচ্যবিদ্যাবিদ্ সিলভ্যাঁ লেভি, অধ্যাপক Finot, Goloubew প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পত্রে বলেন — 'যদি আমি কোনো উপায়ে আপনাকে এঁদের সাহচর্যে নিযুক্ত করতে পারি তাহলে আপনি এই ভার গ্রহণ করতে পারেন? আপনি ওঁদের সঙ্গে থাকলে ওঁদেরও উপকার হবে।' এ সময় ক্ষিতিমোহনের প্রতি নানা অবিচারের কারণেই সম্ভবতঃ তিনি বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়েন এবং রবীন্দ্রনাথকে জানান তিনি বাইরে থেকে মুক্তভাবে আশ্রমের সঙ্গে যোগ রাখবেন। ১৯২৩ মার্চে কবির সঙ্গে তিনি কাশী ও অন্যান্য স্থানে যান। যাওয়া হল করাচীতে যেখানে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর আদর্শের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যা করেন। তারপর ১৯২৪এ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চীন ভ্রমণ করেন। ক্ষিতিমোহনের বিবরণ রবীন্দ্রনাথের Talks in China-র সঙ্গে পঠিতব্য বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে প্রাতঃভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ নানা অধ্যাপকদের গৃহে যেতেন, একদিন ক্ষিতিমোহনের গৃহে হরিচরণ সহ রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন — 'ঊষা সমাগত / রবির উদয় হয়েছে / ক্ষিতির দ্বারের সম্মুখে / ক্ষিতি কি জাগ্রত নন।' ক্ষিতিমোহন শান্তিনিকেতনে আসার পর চারুচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে বন্ধুর বাউলগান সংগ্রহ বিষয়ে বলেন। রবীন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্রের আগ্রহে 'প্রবাসী'তে মাসে মাসে 'হারামণি' শিরোনামে ১৯১৫ তে এগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। অনেক পরে একটি বক্তৃতায় (The Philosophy of our people) রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫এ বাউল গানের গভীর আধ্যাত্মিক জীবনদর্শন এবং ক্ষিতিমোহনের বাউল গান সংগ্রহের উল্লেখ করেন। এই বক্তৃতা লেখার সময় একটি বাউল গানের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মূল পদটি তাঁর কাছে জানতে চান, তাছাড়া 'নিঠুর গরজী, তুই কি মানস মুকুল ভাজবি আগুনে' এবং 'হৃদয় কমল চলতেছে ফুটে' গান দুটিও ইংরেজি অনুবাদে ব্যবহার করেন, প্রথমটি 'অরবিন্দ ঘোষ' প্রবন্ধেও আবার ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ লেখেন 'বন্ধু ক্ষিতিমোহন সেনের দুর্লভ বাক্যরত্নের ঝুলি থেকে একদিন এক পুরাতন বাউলের গান পেয়েছিলুম।' মহম্মদ মনসুরউদ্দীনের বাউল গান সংগ্রহ গ্রন্থের আলোচনায় (বিশ্বভারতী কোয়াটার্লি, এপ্রিল ১৯২৮) রবীন্দ্রনাথ বলেন 'ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না।' ক্ষিতিমোহনের 'ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা' বইটির ইংরেজি অনুবাদ Medieval Mysticism of India নামে প্রকাশিত হয়। মূল বাংলা বইটির ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের The Religion of Man গ্রন্থের পরিশিষ্টে Bauls and their cult of Man নামে যে লেখাটি আছে তা ক্ষিতিমোহনের, রবীন্দ্রনাথ তা উল্লেখ করেছেন। The Fugitive বইতে যে বাউলগানের অনুবাদ তাও ক্ষিতিবাবু সংগৃহীত। ক্ষিতিমোহন রচিত 'দাদূ' গ্রন্থের ভূমিকায় (যা 'মরমিয়া' নামে স্বতন্ত্র প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত) রবীন্দ্রনাথ বলেন — 'ক্ষিতিবাবুর কল্যাণে ক্রমে হিন্দুস্থানের আরো কোনো কোনো সাধক কবির সঙ্গে আমার কিছু কিছু পরিচয় হল। ..... ক্ষিতিমোহনবাবু ভার নিয়েছেন বাংলা দেশে সেই লুপ্ত স্রোতকে উদ্ধার করে আনবার।' কখনও আবেদন আসে চিরকুটে — 'অয়মহং ভোঃ — আপনার শ্লোক ভাণ্ডারদ্বারে বসন্তের কবি সমাগত। বাসনা পূর্ণ করবেন।' কখনও জানান — '৭ই পৌষের বক্তৃতাটি আপনার কলমের অগ্রে যদি উদ্ধার না করেন তবে সে ডুবল।' এবার বলি ক্ষিতিমোহনের রবীন্দ্র-আবিষ্কারের কিছু কথা। লিখেছেন তিনি কাশীতে এক রবীন্দ্রভক্তের মুখে একটি রবীন্দ্র কবিতা শুনে মনে হল এ-বাণীর সঙ্গে তার পরিচয় আছে। মধ্যযুগীয় সন্তবাণীর আলোয় তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিনলেন আর রবীন্দ্র-আলোয় চিনলেন সন্তদের। ঠাট্টা করে বলেছিলেন — 'এতকাল খেয়েছি আমসি, এতদিনে পেলাম টাটকা আমের স্বাদ।' যেহেতু রবীন্দ্রকাব্যের মধ্যে চির পরিচিত উপনিষদ ও সন্ত কবিদের ভাব তাই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন তাঁর 'পরম আত্মীয়'। আগ্রহী ক্ষিতিমোহন কলকাতার এক সভায় দূর থেকে দেখলেন কবিকে। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। তারপর রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে শান্তিনিকেতনে আসা, বিদ্যালয় কাজে প্রবৃত্ত হওয়া। ডায়েরীতে লিখে রাখতেন রবীন্দ্রনাথের মুখের কথা। শান্তিনিকেতনে বর্ষা উৎসব, প্রথম 'শারদোৎসব' নাটক অভিনয়ের স্মৃতি, সংগীতমুখর ঠাকুর্দা চরিত্রে অভিনয় স্মৃতি হয়ে থাকে অক্ষয়। ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত শিখভজন অনুসারেই 'বাজে বাজে রম্যবীণা', 'এ হরি সুন্দর', 'আজি নাহি নাহি নিদ্রা আঁখিপাতে' গানগুলি রচনা করেন কবি। শান্তিনিকেতন ভাষণমালা ১ম খণ্ড উপনিষদ বাণীর নব তাৎপর্যে রচিত, যার প্রকাশনার কাজে ক্ষিতিমোহন উদ্যোগী ও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। পারস্পরিক দেওয়া নেওয়ার নিজস্ব ছন্দেই বিকশিত হয়েছে এই দুজনের সম্পর্ক। শান্তিনিকেতন ভাবনার রূপায়ণে ক্ষিতিবাবুকে বন্ধু ও সহযোগীর ভূমিকায় সুযোগ্য ও কর্মঠ করে তুলতে অবশ্য পথনির্দেশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। একসময়ে এসে পড়েছিল বিদ্যাভবনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব-ও। ১৯০৮-এ গজিয়ে ওঠা বালিকা বিভাগের দায়িত্ব-ও নিয়েছেন, আলপনা রচনা, হলকর্ষণ উৎসবে বৈদিক আবহ নির্মাণ, কিছু বৈদিক মন্ত্রের অনুবাদ, শারদোৎসব নাটকের যজুর্বেদীয় শরৎবর্ণনার অনুবাদ, রবীন্দ্রসমক্ষে সাহিত্য আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ, রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে আচার্যের আসন গ্রহণ, বলাকা কাব্যের রবীন্দ্রউচ্চারিত ব্যাখ্যান লিখে রাখা, আশ্রম পরিচালনায় ছাত্রদের অংশগ্রহণে উদ্যোগ, 'রাজা ও রাণী' নাটকে দেবদত্তের ভূমিকা গ্রহণ, ফাল্গুণীতে চন্দ্রহাস উপনিষদ বেদান্ত ভাষ্য পাশ্চাত্যে প্রচারের পরিবর্তে মধ্যযুগীয় সাধকদের বাউলগান, বৈষ্ণবকাব্য, চৈতন্যজীবনী প্রচার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করা, অসংখ্য বিদেশী অতিথিকে শান্তিনিকেতন স্বাগত ও বিদায় সম্ভাষণ কতো কি যে করেছেন রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে, রবীন্দ্রসৃষ্ট শান্তিনিকেতন অনুষঙ্গে, তার ইয়ত্তা নেই। রবীন্দ্রনাথ চাইছেন বিদ্যালয়কে ভরে তুলতে গরীবের ধনে, 'সহজ আনন্দের পুষ্পমধুতে', আর ক্ষিতিমোহন ও তাঁর 'লক্ষ্মীছাড়ার দল' তা কার্যকরী করতে সতত উৎসুক। গান্ধী অভ্যর্থনায় আশ্রমের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনায় নায়কত্বের ভার নিয়েছিলেন তিনি। ক্ষিতিমোহনের শিক্ষতার কথা আলাদা ভাবেই উল্লেখ্য। পড়াবার সময় নিজে খাটতেন, ছাত্রদের খাটিয়ে নিতেন। সন্তোষালয়-এর উত্তরের বারান্দায় বসে পড়ালেন চয়নিকা, গোরা, সমাজ। মাত্র একবছরেই রবীন্দ্রসাহিত্যের ও বাংলাভাষার বুনিয়াদ গড়ে দিলেন, 'পূর্বপশ্চিম' প্রবন্ধটির বিশ্লেষণ মারফৎ বিবেকানন্দকে ছাত্রদের কাছে আদর্শ প্রতিভূরূপে হাজির করলেন, রবীন্দ্র প্রবন্ধগুলি পাঠদানের পর সপ্তাহান্তে ভাবার্থ রচনা করে দেখাতে হত। তাঁর একাধিক লিখিত প্রবন্ধে আছে রবীন্দ্রসাহিত্যের তুলনামূলক উপস্থাপন। রবীন্দ্রনাথের মতই স্বদেশী চিত্তসম্পদকে বিশ্বগোচরে আনা, এশিয়া মহাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিগুলির সম্যক পরিচয় জ্ঞাপন ও সম্মিলিত উপস্থাপনে তাঁর আগ্রহ ছিল সবিশেষ। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন প্রাচীন হিন্দী সাহিত্যের কিছু অসামান্য সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছে ক্ষিতিমোহনের মাধ্যমে। রবীন্দ্রকন্যা মীরার সুযোগ হয়েছে ক্ষিতিবাবুর কাছে পিতার খেয়া কাব্যআলোচনা শুনবার। ১৯২৯ জুলাই মাসে যখন রবীন্দ্র পরিচয় সভা গঠিত হল তখন তার সভাপতি ঠিক করা হল বিধুশেখর ভট্টাচার্য এবং ক্ষিতিমোহন সেনকে। এ সভায় একবার তিনি আলোচনা করেছিলেন 'রবীন্দ্রনাথ ও বাউল' বিষয়ে। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন রবীন্দ্রনাথের মন্দির ভাষণ সন্তোষচন্দ্র মজুমদার এবং ক্ষিতিমোহন লিখে না রাখলে 'রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক মনকে জানা যেত না'। রবীন্দ্র মন্দিরভাষণে প্রধান উপাদান ছিল — উপনিষদ, গীতা, বুদ্ধবাণী, ক্ষিতিমোহনের নির্ভর ছিল বৈদিক মন্ত্র, বিশেষতঃ অর্থব বেদ, তার সঙ্গে থাকত দাদূ, কবীর, নানক, তুকারাম প্রভৃতি সাধক সন্তদের বাণী, পারস্য সুফিদের বাণী, সঙ্গে মিশত বাংলা বাউলগান, নানা লৌকিক গল্প — পারস্যের, হিন্দী, গুজরাতি সাহিত্যের, কখনও তাতে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, রান্নাঘর বা পাকপ্রণালী কথা। ১৯৩৩, ১০ মার্চ শ্রীনিকেতন বিনুরি মেলার উদ্বোধনে টেনে আনেন নানা গ্রাম্য মজার প্রসঙ্গ। এক সময় আম্রকুঞ্জে প্রত্যেক বৃহস্পতি, শনি, সোমবার বেলা তিনটের সময় বক্তৃতা দিয়েছেন রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে। মীরা দেবীর মেয়ে নন্দিতার সঙ্গে কৃষ্ণ কৃপালনীর বিবাহ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় মতো পৌরোহিত্য করেছিলেন ক্ষিতিমোহন। ভুবনডাঙায় সদ্যসংস্কৃত পুকুরধারে বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানে তরুশিশুদের বৈদিকমন্ত্রে অভিনন্দিত করলেন ক্ষিতিমোহন, জলসিঞ্চন করলেন রবীন্দ্রনাথ। চীনা ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠানে ঋগবেদ মন্ত্র উচ্চারিত হল ক্ষিতিমোহন কণ্ঠে, রবীন্দ্রনাথ গাইলেন বুদ্ধস্তূতিমূলক স্বরচিত একটি গান, ভাষণও দিলেন। হিন্দিভবন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে (১৬ জানুয়ারী, ১৯৩৮) পৌরোহিত্য করলেন অ্যাণ্ড্রুজ, স্বাগত ভাষণ দিলেন ক্ষিতিমোহন। ক্ষিতিমোহন গুজরাতে 'প্রান্তিক' কাব্যের ৪, ৬ থেকে ১৪ সংখ্যক কবিতার ব্যাখ্যা করলেন ১৯৩৮-এ। ১৯৩৯-এ উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে রবীন্দ্র জন্মদিনে ক্ষিতিমোহন প্রাচীন সংস্কৃতগ্রন্থাদি থেকে কবিবন্দনা-সূচক মন্ত্র পাঠ করলেন। ক্ষিতিমোহনের কবীরচর্চা রবীন্দ্রনাথকে উদ্দীপিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ, অজিত চক্রবর্তী কবীর দোহাঁর ইংরেজি অনুবাদে প্রবৃত্ত হন, অন্তঃপ্রেরণা ছিল ক্ষিতিমোহনের। দাদূর কোনো কোনো কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্র কবিতার মিল লক্ষ্য করেছিলেন বিধুশেখর (ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে) আর রবীন্দ্রনাথ বলেন ওই কবিতাটি ক্ষিতিমোহন মারফৎ দাদূ বিষয়ে পরিচয়ের আগেই লেখা। বিদ্যাভবন এবং চীনাভবনে যখন প্রাচ্যদেশীয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত হয় তখন দুজন ছিলেন সারথি — ক্ষিতিমোহন ও তান ইয়ুন সান। ১৯৪০, ১৯ জুলাই বুদ্ধের নির্বাণ ধর্ম প্রচার উপলক্ষে অনুষ্ঠানে আচার্যের কাজ করেন ক্ষিতিবাবু, এবছরই শ্রীনিকেতন মেলাপ্রাঙ্গণে হলকর্ষণ উৎসবের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ যেদিন 'ল্যাবরেটরি' গল্পটি পাঠ করেন সেদিন আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন তিনি। ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০ আশ্রমে গান্ধীজয়ন্তীতে তিনিই সভাপতি ছিলেন। ১৩৪৮, ১ বৈশাখ তাঁর অশীতিতম জন্মদিনে উদয়ন প্রাঙ্গণের সভায় ভাষণ রচনা করলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু পাঠ করলেন ক্ষিতিমোহন। আশ্রম থেকে কবির শেষ বিদায়ে ক্ষিতিমোহন যে বিচলিত বোধ করবেন তা স্বাভাবিক। মহাপ্রয়াণের পর মন্দিরে ক্ষিতিমোহন প্রার্থনা করেছিলেন মহান সেই আত্মার শান্তিকামনা। ১৯৪১, ১৭ আগস্ট শ্রাদ্ধবাসরের যুগ্ম পৌরোহিত্যের দায়িত্ব পড়ে বিধুশেখর ও ক্ষিতিমোহনের ওপর। কয়েকদিন পর কারা যেন এসেছিলেন শান্তিনিকেতন দেখতে। ক্ষিতিমোহন বেদনার্ত কণ্ঠে বলেছিলেন — 'এখন আর কী দেখতে এলেন। নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার'। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরও রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্লাস নিয়েছেন। অমিতাভ চৌধুরী লেখেন - রবীন্দ্র প্রয়াণের পর প্রশাসন শীর্ষে রথীন্দ্রনাথ, আশ্রমগুরুর ভূমিকায় ক্ষিতিমোহন। 'রবীন্দ্রনাথের অভাব অনুভব করেনি ছাত্ররা। উপাসনায় তিনি আচার্য, ঋতু উৎসবে তিনি পরিচালক, যে কোনো সমস্যায় তিনি প্রধান পরামর্শদাতা।' এই দুই দশকে তিনি বারংবার রবীন্দ্র আদর্শকে স্থাপন করেছেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে--সতত সেই আদর্শ রক্ষায় সতর্ক করেছেন সবাইকে। ১৯৫৪তে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্যও হয়েছিলেন, সেসময়ের বিবৃতিতেও বলেন — 'বিশ্বভারতী, যা গুরুদেবের আদর্শগুলির পূত ভাণ্ডার বলতে পারি, তার চেয়ে প্রিয় আমার কাছে কিছু নেই।' ১৯৫৯ সালে বসন্তোৎসবে শান্তিনিকেতন তাঁকে শেষবার দেখে আম্রকুঞ্জে। রবীন্দ্র পরিচয় সভায় প্রবন্ধ পড়েন - রবীন্দ্রনাথ ও বাউল। মধ্যযুগীয় সাধকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভারসাম্য বিষয়ে একটি গবেষণার কাজ বিশ্বভারতী কর্তৃক ন্যস্ত হয়েছিল তাঁর ওপর। সে কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি ক্ষিতিমোহন। সবশেষে দুটি কথা — রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে চিঠিতে লিখেছিলেন - আপনার প্রেম আমার কাছে পথ্য ও পাথেয়। আমার মনে হয় একথা ক্ষিতিমোহনের ক্ষেত্রে আরও প্রযোজ্য। দ্বিতীয় কথাটি হল - শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যকে জানতে হলে, বুঝতে হলে কাছাকাছির ও দূরের এই সব ব্যক্তিত্ব-চর্চার খুব দরকার আছে।
ক্ষিতিমোহন সেনও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, তাঁরও জিজ্ঞাসা নতুন পথে প্রবাহিত হল— মধ্যযুগীয় সাধুসন্তদের বাণী সংগ্রহ করে ভারতীয় জীবন সাধনার বিস্মৃতপ্রায় এক অধ্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করলেন। এ সমস্তই সম্ভব হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায়। তিনি দাবি করেছেন, এঁরা প্রাণপণে সেই দাবি পূরণ করেছেন। দাবি পূরণ করতে গিয়ে এঁদের শক্তি দিনে দিনে বিকাশ লাভ করেছে। ক্ষিতিমোহনবাবু বলতেন, গুরুদেব নিজ হাতে আমাদের গড়ে নিয়েছেন, নইলে যে বিদ্যা শিখে এসেছিলাম, তাও ঠিকমত ব্যবহার করা আমাদের সাধ্যে কুলোতো না। শান্তিনিকেতনের এক যুগ - হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ.৫৪
সমাবর্তন উৎসব ছাড়াও শান্তিনিকেতনের অন্যান্য উৎসব পার্বণের অনুষ্ঠান পদ্ধতি রচনায় শাস্ত্রীমশায় হাত মিলিয়েছেন ক্ষিতিমোহনবাবুর সঙ্গে। ঐ, পৃ.৭৬
ক্ষিতিমোহন যেমন রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার, রবীন্দ্রনাথ ও তেমনি ক্ষিতিমোহনের কাছে দেখা দিয়েছিলেন অকস্মাৎ এক অজ্ঞাতপূর্ব মহাদেশ আবিষ্কারের বিস্ময়রূপে। ঐ, পৃ.৭৭
ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহ ভাণ্ডার থেকে নানা সন্তবাণী এবং বাউল সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'মানুষের ধর্ম' নামক গ্রন্থে এবং নানা প্রবন্ধে, ভাষণে ব্যবহার করেছেন এবং প্রতিক্ষেত্রেই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা উল্লেখ করেছেন। ঐ, পৃ.৮০
শান্তিনিকেতনের বাণী এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ক্ষিতিমোহনবাবু এক সময়ে যেভাবে দেশময় প্রচার করেছেন এমন আর কেউ নয়। ঐ, পৃ.৮৩
প্রমথনাথ বিশীর মতে রবীন্দ্রনাথ যে তাঁকে শ্রদ্ধা ও আদর করতেন তার ৪টি কারণ — ক) আগন্তুক নন, ঘরের লোকের মত নানা অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন খ) তাঁর মধ্যে ছিল সামাজিকতা গুণ গ) ভারত সংস্কৃতির মধ্যে তিনি মানুষ, কেবল বাংলা নয় ঘ) রাজপুতানা গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলের প্রাদেশিক ভাষা তাঁর ২য় মাতৃভাষা। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন, পৃ. ১২৫
'শাস্ত্র এবং রসালোচনায় রবীন্দ্রনাথের দুই বাহু ছিলেন বিধুশেখর এবং ক্ষিতিমোহন। তিনি সংস্কৃত চর্চায় যশস্বী হয়েও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করে দিলেন বাঙলার 'জনবৈদগ্ধ্য' চর্চায়। গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন, ক্ষিতিমোহন সেন, পৃ. ৯৩, ৯৫, ৯৬
রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনের সন্তধর্ম ও বাউলতত্ত্ব চর্চায় আকৃষ্ট ও প্রভাবিত হয়েছিলেন। অবশ্য লোকধর্ম ও সাহিত্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথই প্রধান প্রেরণাদাতা। আবার ক্ষিতিমোহনের সাহায্যেই রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন মধ্যযুগের সাধুসন্তদের জীবন সাধনা বৃত্তান্ত - বাউল গানের দার্শনিক তত্ত্ব। রবীন্দ্রনাথই ১৯১৪ উদ্যোগী হয়ে ক্ষিতিমোহন, অজিত চক্রবর্তী ও নিজের কবীর এর ইংরেজি অনুবাদ One Hundred Poems of Kabir সংকলন প্রকাশ করেন, ইভলীন আণ্ডারহিল ভূমিকায় দেখান কবীরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম চিন্তার সাদৃশ্য। তবে, রবীন্দ্রনাথ একজন আশ্চর্য পাঠক হিসেবে, ভারতীয় হিসেবে কবীরের নাম মাহাত্ম্য জানতেন না - একথা গুজব মাত্র। ভারতীয় মরমীয়া সাধকদের পাশ্চাত্যে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ক্ষিতিমোহনকে কবি পশ্চিমে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তবে কবীরের দোঁহার ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা আণ্ডারহিলকে লিখতে দেওয়াটা ক্ষিতিমোহন বা অজিত চক্রবর্তী পছন্দ করেন নি। কবীর প্রমুখ মধ্যযুগীয় সন্তদের ওপর খৃষ্টীয় প্রভাব ছিল একথা প্রতিবাদযোগ্য মনে করেছিলেন এই দুইজন। এখানে উল্লেখ্য পূর্বোক্ত ইংরেজি অনুবাদের পূর্বেই ক্ষিতিবাবুর 'কবীর' গ্রন্থটির লেখাগুলি বেরিয়ে যায়। তাঁর 'ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা' (১৯২৯) বইতে আছে কতিপয় সাধকের কথা যাঁরা শাস্ত্রশাসিত ধর্মচেতনার বাইরে ভেবেছিলেন। তাঁর 'দাদূ' (১৯৩৫) বইটির বিষয় মধ্যযুগীয় এক সাধকের কথা, রবীন্দ্রনাথ ভূমিকায় বলেন — 'এঁদের কাছে আসে সত্যের বাইরের মূর্তি নয়, তার মর্মের স্বরূপ।' রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে স্বীকার করেন - 'দাদুর সঙ্গে আমার পরিচয় আপনাদের ঠাকুর্দ্দাদুর সঙ্গে পরিচয়ের পরে।' উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ক্ষিতিবাবু। ভারতবর্ষের ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের পরিচয় আছে 'ভারতের সংস্কৃতি' ও 'হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ', 'প্রাচীন ভারতে নারী' ও 'জাতিভেদ' প্রভৃতি ছোট ছোট বইগুলিতে। ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা বক্তৃতার গ্রন্থরূপ 'বাংলার বাউল'। বঙ্গদেশীয় সাধনা-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর যে বইগুলি আছে তা হল - বাংলার সাধনা, চিন্ময় বঙ্গ। Hinduism বইটি প্রকাশ পায় লেখকের মৃত্যুর পরে, রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে, ১৯৬১ সালে। এ বইয়ের তিনটি অংশ - হিন্দুত্বের প্রকৃতি ও প্রণালী, হিন্দুত্বের ঐতিহাসিক বিবর্তন, হিন্দুশাস্ত্রের কিছু উদ্ধৃতি। সৌভাগ্যের কথা, ক্ষিতিমোহনের বইগুলি ক্রমশঃ পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে। এগুলি চর্চার নির্ভরযোগ্য সহায়ক হবে। তবে, আজকের পাঠকের কাছে কিঞ্চিৎ সীমাবদ্ধ দৃষ্টিপ্রাণিত মনে হতে পারে।
(বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রভবন আয়োজিত রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে (২১-২৪ মার্চ, ২০১৪) পঠিত।)
পরবাস, ২৫-শে বৈশাখ, ২০১৪ |