গ্রন্থ-সমালোচনাঃ 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরা’

রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরা— সংকলন ও সম্পাদনা: সুমিতা চক্রবর্তী ও সৈয়দ বসিরুদ্দোজা; প্রচ্ছদ: সুব্রত চৌধুরী; কারিগর; কলকাতা; প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০১৫; ৩৯৮ পৃষ্ঠা; ISBN: 93-81640-53-X

রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে ‘উত্তরা’ কাশী থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় মহালয়ার পুণ্য তিথি ১৩২২ বঙ্গাব্দের ১-লা আশ্বিন (ইং ১৯২৫)। এর শেষ সংখ্যার প্রকাশ ১৯৬৬-তে। ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ ইত্যাদি পত্রিকা বিষয়ে গবেষকদের আগ্রহ ও আলোচনা নিতান্ত অপ্রতুল নয়, অথচ প্রায় সমসাময়িক ‘উত্তরা’র সাহিত্যসম্ভার বিদ্বজ্জনের দৃষ্টির অগোচরে থেকে গেছে। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত বহির্বঙ্গে ‘উত্তরা’র প্রকাশ, ফলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ গ্রন্থাগারে এই পত্রিকার সংখ্যাগুলি পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রজীবন, ব্যক্তিত্ব এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের নানামুখী আলোচনায় ঋদ্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরা’ প্রবন্ধ সংকলনটি তাই রবীন্দ্রচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

চল্লিশ বছরে 'উত্তরা'তে রবীন্দ্র-বিষয়ে লেখার পরিমাণ অনেক, তাই সূচনায় অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী সঙ্কলনের পরিকল্পনাটি জানিয়েছেন--রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীর বছরটিকে মনে রেখে তার পূর্ববর্তী দশ বছরে, অর্থাৎ ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত ‘উত্তরা’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক যত প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তারই নির্বাচিত সংকলন এই বইটি।

দশ-পৃষ্ঠার 'উত্তরা-কথা'য় সম্পাদকদ্বয় 'উত্তরা'র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও সমকালীন বাংলাসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘শনিবারের চিঠি’ (১৯২৪), ‘কালিকলম’ (১৯২৬), ‘ধূপছায়া’ (১৯২৭) প্রভৃতি অন্যান্য পত্রিকার তুলনায় ‘উত্তরা’র অবস্থানটি আলোচনা করেছেন। 'উত্তরা'তে জগদীশ গুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেন্দ্র দেব, মানিক বন্দোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, আশালতা দেবী, বাণী রায়, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখের অনেক রচনাই প্রকাশিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মুজুমদার, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, রাধারানী দেবী, বুদ্ধদেব বসু এবং অজিত দত্তও ‘উত্তরা’য় কবিতা লিখেছেন। ‘উত্তরা’র প্রবন্ধের বিভাগটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রাবন্ধিক হিসাবে গোপীনাথ কবিরাজ, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায়, বিনয় কুমার সরকার, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, ফণীভূষণ অধিকারী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে ‘উত্তরা’র প্রধান অবলম্বন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রবাসী বাঙালিদের সংস্কৃতিচর্চার প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন বঙ্গীয় সংস্কৃতি তথা বিশ্বসংস্কৃতির পরিপূর্ণ প্রতিনিধি ও ধারক। তাঁদের প্রবাস-বাসের সাংস্কৃতিক অসম্পূর্ণতার অবসান হতো রবীন্দ্র-অবগাহনে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘উত্তরা’য় লিখেছেন কম নয়।

‘উত্তরা’ সম্পর্কে আরও দুটি কথা বলবার অপেক্ষা রাখে। প্রথমত, পত্রিকাটির রবীন্দ্র-নিষ্ঠা সমকালের অন্য কোনো পত্রিকায় এত ‘স্থিরলক্ষ্যভাবে’ দেখা যায়নি, এবং দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরেও ‘উত্তরা’-র রবীন্দ্রচর্চায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। রবীন্দ্রপ্রয়াণ উপলক্ষ্যে ১৩৪৮-এর আশ্বিন সংখ্যাটি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে যেমন প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনি ১৯৬১-তে রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকীতে ‘উত্তরা’-র আরও একটি বিশেষ রবীন্দ্রসংখ্যা প্রকাশিত হয়।

গ্রন্থটিতে মোট ৪৪-টি রচনা সঙ্কলিত হয়েছে প্রকাশকাল অনুসারে। একই সংখ্যা (বৈশাখ, ১৩৫৮) থেকে নেওয়া সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের ‘রবি-কবি’ ও অমিতা মজুমদারের 'পঁচিশে বৈশাখ' দু'টি কবিতা দিয়ে সংকলনের শুরু। পরে কিশোরদের জন্যে রচিত কাজী নজরুলের একটি কবিতা ছাড়া বাকি সব লেখাই প্রবন্ধ বা প্রবন্ধ-ধর্মী—ব্যতিক্রম শুধু অতুলপ্রসাদের স্মৃতিচারণা। দুটি লেখা সঙ্কলিত হয়েছে যেখানে লেখকের নাম নেই—একটি রবীন্দ্র বাণী চয়ন, ও অন্যটি ‘আমেরিকান রিপোর্টার’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দুটিকথা’ শিরোনামে কবির সঙ্গে ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকার সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরোর আলাপের কাহিনি। উপসংহারে দু'টি মূল্যবান সংযোজন হোল 'উত্তরা'তে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের লেখার সূচি (প্রায় তিন পৃষ্ঠা) এবং রবীন্দ্রনাথের উপরে ‘উত্তরা’তে প্রকাশিত লেখার সার্বিক তালিকা (প্রায় ৫ পৃষ্ঠার)। গ্রন্থের শেষে আছে রচনাকারদের (এবং 'উত্তরা-কথা'য় উল্লিখিত ব্যক্তিদের) মোটামুটি বিশদ পরিচয়।

প্রথম প্রবন্ধ বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘রবীন্দ্র-জয়ন্তী’ [বৈশাখ, ১৩৫৯], এটি আসলে বড়িশা রবীন্দ্রোৎসবে প্রদত্ত প্রধান অতিথির ভাষণ। পরবর্তী প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্র-শিল্প প্রসঙ্গে’ [বৈশাখ, ১৩৫৯]--লেখক পরিমল গোস্বামী। প্রথমে ‘আর্ট’ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার পর রবীন্দ্র-শিল্পের আলোচনায় প্রবেশ করেছেন প্রাবন্ধিক এবং সেখানে ‘প্রকৃতির সৃষ্টি-রীতির ছায়াপাত’ প্রত্যক্ষ করেছেন। এই প্রবন্ধের প্রায় পরিপূরকের মতো গ্রন্থে স্থান পেয়েছে অসিতকুমার হালদারের--‘চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ’ (কার্তিক, ১৩৫৯)। অসিতকুমার হালদারের সঙ্গে পত্র-বিনিময়ে ‘আর্ট’, মূলত চিত্রশিল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। এছাড়া আছে অন্য কিছু চিঠিপত্রও। শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের চিত্রশিল্পী অসিতকুমার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়। কবির দিদি শরৎকুমারী দেবীর কন্যা সুপ্রভার পুত্র। একটি পত্রে অসিতকুমার হালদারকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন--‘তোর ছবি আঁকার চর্চা কি রকম চলছে। কুঁড়েমি করিসনে। নিয়ত সাধনা না করলে সরস্বতী সদয় হন না ...।’ আবার কোনো পত্রে নতুন ছবি আঁকার ফরমাশ--‘কল্যাণীয়েষু, - অসিত, ... তোকে একটা ছবির বিষয় দিচ্ছি, এঁকে শীঘ্র পাঠিয়ে দিস্‌। অন্ধকার পথ--একটি মেয়ে চলেছিল, বিপরীত দিক থেকে পুরুষ এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে--মেয়েটি তার অবগুন্ঠন দুই হাতে তুলে ধরেচে--পুরুষ মশালের আলোয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে। আকাশে ধ্রুবতারা ...।' কখনো বা অসিতের গড়া শিল্পের প্রশস্তিতে কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলা বাহুল্য, অসিতকুমার হালদারের সংকলিত এই পত্রগুলি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথের চমৎকার যুগলবন্দী। অসিতকুমার হালদারের আর একটি মৌলিক প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে বর্তমান গ্রন্থে--‘রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ও সংগীতে চিত্রাভাস’ [ফাল্গুন, ১৩৬৮]। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, ‘মহাকবি রবীন্দ্রনাথ তার কাব্য-কলায় ... ভূমারই অবিশ্রান্ত চিত্রাভাস দিয়ে গেছেন আজীবন। ... ভূমা অপ্রকাশ কিন্তু কবির হাতে চিত্রাভাসে ভাবরসে স্ফুট হয়ে ওঠে।’

গ্রন্থে রবীন্দ্র-ভাবনায় জন্মদিন এবং জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত চারটি প্রবন্ধ আছে। উমা দেবীর ‘জন্মদিনে’ [বৈশাখ, ১৩৬৩] প্রবন্ধে সাধারণভাবে জন্মদিন সম্পর্কে রবীন্দ্র-চিন্তাধারার পরিচয় যেমন আছে, তেমনি নিজের জন্মদিন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি বিশ্লেষিত হয়েছে। উমা দেবীর আর একটি প্রবন্ধ ‘শেষ সপ্তকে মৃত্যুর রূপ’ [বৈশাখ, ১৩৬৪]-এ মৃত্যু সম্পর্কে রবীন্দ্র-উপলব্ধির পরিচয় আছে। ‘শেষ সপ্তক’ কাব্যগ্রন্থে মৃত্যুর স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করলেও উমা দেবীর বিশ্লেষণে মৃত্যু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির সামগ্রিক ও চূড়ান্ত রূপেরই প্রকাশ ঘটেছে। সম্পাদক প্রবন্ধগুলি নির্বাচনের সময় সামঞ্জস্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই কবির জন্মদিন-ভাবনার পাশাপাশি মৃত্যু বিষয়ক প্রবন্ধও বর্তমান গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধ দুটি আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতমুখী বিষয়কেন্দ্রিক হলেও রবীন্দ্র-ভাবনায় পরস্পর বিরোধী নয়।

সত্যেন দে-র ‘রবীন্দ্র-মানসে জীবন ও মৃত্যু’-তে জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধীয় ভাবনা উপনিষদের আলোকে বিশ্লেষিত হয়েছে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘রবীন্দ্র-জন্ম-উৎসব’ [বৈশাখ, ১৩৬৪] প্রবন্ধটি রবীন্দ্র-জন্মোৎসব উদ্‌যাপনের তাৎপর্য সম্বন্ধে মূল্যবান এবং স্বতন্ত্র কিছু ভাবনার প্রকাশ। জ্যোতির্ময়ী দেবীর বক্তব্যের পরিপূরক হিসাবে ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র-পূজা’ [শ্রাবণ, ১৩৬৭] প্রবন্ধের অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করতে পারি--‘... রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ সংগীত, নাট্য পরিবেশন বা সাহিত্য প্রকাশমাত্র নয়। এই সবগুলির মধ্য দিয়ে যদি তাঁর সংস্কৃতির ধর্মটিকে তাঁর ঐক্যবোধ এবং প্রেমের আহ্বানকে বিশ্বজনীন ক্রিয়ায় পরিণত করা যায় তবেই রবীন্দ্রপূজা সার্থক হবে।’

রবীন্দ্র সংগীত বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ আছে। এর মধ্যে নন্দগোপাল সেনগুপ্ত ‘রবীন্দ্র-সংগীত পরিচয়’ [বৈশাখ, ১৩৫৯] প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ আদতে বাংলার ঐতিহ্য অনুসারী গীতিকার এবং সুরকার দুইই (যেমন চণ্ডীদাস, রামপ্রসাদ, ও প্রে রজনীকান্ত, দ্বিজেন্স্রলাল, নজরুল, অতুলপ্রসাদ)। বেঠোফেন, মোজার্ট, বার্ট, শোঁপা, হায়েনে, লাফেঁয়ৎ, বার্নস, ম্যুর এবং তানসেন, বৈজুবাওরা, কবীর, রজ্জব প্রমুখ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সঙ্গীত-সাধকরা কিন্তু, ‘... কেউ কেউ গীতাবলী রচনা করেন, সুর সংযোজন করেন না; কেউ কেউ আবার শুধুই সুরস্রষ্টা।’ কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ [আষাঢ়, ১৩৬৮] শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রসংগীতের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে গিয়ে কবির গানে প্রকৃতি, চলমান জীবন, গভীর জীবনানুভূতি, আত্মিক অনুভব, সুরের বৈচিত্র্য, তীক্ষ্ণ সত্যদৃষ্টি--ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের নানা দিক নিয়ে তাঁর মন্তব্যগুলি লক্ষ্য করার মতো। দুটি প্রবন্ধের প্রায় সমধর্মী আর একটি প্রবন্ধ হোলো সুধীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘রবীন্দ্র প্রতিভায় সংগীতের ভূমিকা’ [বৈশাখ, ১৩৬৪]--এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সাঙ্গীতিক প্রতিভায় উচ্চাঙ্গ সংগীত, লোকসংগীত ইত্যাদির প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে প্রাবন্ধিক তাঁর একটি মৌলিক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণে যন্ত্রযুগের নগর সভ্যতার প্রভাবজাত সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সচেতন ছিলেন এবং তাঁর সংগীতের ক্ষেত্রেও সেই যুগচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে।

মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায়ের ‘বিদেশীর চোখে শান্তিনিকেতন’ [বৈশাখ, ১৩৬৫] রচনাটি উইলিয়ম কিল্‌প্যাট্রিকের একটি লেখা [১৯৩০] থেকে নেওয়া। প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্র-জীবন যে সমন্বয়ের সাধনা, তা তাঁর শিক্ষা-ভাবনার মধ্যেও মূর্ত হয়েছিল। এই সমন্বয়-সাধক রবীন্দ্রনাথের পুন:পরিচয় পাওয়া যায় ইন্দুমাধব দাসের ‘প্রতীচ্য ও রবীন্দ্রনাথ’ [চৈত্র, ১৩৬৮] প্রবন্ধে। প্রাবন্ধিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ‘প্রতীচ্য ও রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়টি আলোচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, চেতনাকে বুদ্ধদেব ও তাঁর আদর্শ যে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু ঋষি অরবিন্দের আদর্শ ও দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্র-কাব্যদর্শনের যে নিবিড় সাযুজ্য আছে ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘শ্রী অরবিন্দের ও রবীন্দ্রনাথ’ [বৈশাখ ১৩৬৪] প্রবন্ধে সেটাই আলোচ্য বিষয়। এঁদের দুজনেরই ভাবনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল মানুষ। সেই মানুষ, যারা বাধা-বিপত্তি বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলেছে, এক মহান লক্ষ্যাভিমুখে। এ যাত্রা অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে। অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধচিন্তা’ [বৈশাখ, ১৩৬৫]-র লেখক সন্তোষ কুমার অধিকারী বুদ্ধ এবং খ্রীষ্টের জীবনবাদের মূলে বেদনার ভূমিকার কথা বলেছেন, আর রবীন্দ্র-সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই বেদনার গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন। কারণ, ‘মহৎ শিল্পের প্রেরণা মহৎ বেদনাবোধ থেকেই আসে ... ’ এবং ‘এই বেদনাবোধের কারণ কবির জীবনজিজ্ঞাসা।’

সুধাংশুমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি-স্মরণে’ [বৈশাখ, ১৩৬৩] এবং ‘কোন রবীন্দ্রনাথ’ [বৈশাখ, ১৩৬৫] বিষয়বস্তুর দিক থেকে একটু ভিন্নধর্মী রচনা। প্রাবন্ধিকের বিচারে রবীন্দ্রনাথ ‘বিস্ময়পুরুষ’। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে স্মরণ করতে চেয়েছেন। তিনি শুধু কবি বা শিল্পী নন, তিনি মানুষ ; যিনি মানব ও মানবতার কথা বলেন, যিনি আমাদেরও প্রতিদিনের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে স্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনচর্চায় কতবার স্মরণ করি তাঁকে? তাঁর আদর্শ কতখানি অনুসরণ করি? সুধাংশুমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কোন রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে কিছুটা আলাপচারিতার ভঙ্গিতে এই প্রশ্নই রেখেছেন। যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা জন্মোৎসবের আয়োজন ও কোলাহলের মধ্যে খুঁজি, তিনি কোন্ রবীন্দ্রনাথ? এই প্রবন্ধের চটুল ভাষার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষণীয়।

নির্বাচিত কিছহু প্রবন্ধে আছে রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক সামগ্রিক আলোচনা--যেখানে কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, নাট্যকার, কর্মী, শিক্ষাব্রতী, আলাপচারী, মানবতাবাদী ইত্যাদি পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই। আবার কিছু প্রবন্ধ নির্দিষ্ট বিষয়-কেন্দ্রিক--রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সৃষ্টির বিশেষ কোনো দিক বা বিষয়ের আলোচনা। যেমন, ‘রবীন্দ্রনাথ বা ধনঞ্জয় বৈরাগী’ [বৈশাখ, ১৩৬৩], লেখক-- আনন্দ দে। মিহিরকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ও ঋতুবসন্ত’ [বৈশাখ, ১৩৬৫], দূর্গাদাস সরকারের ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পথ-চিন্তা [বৈশাখ ১৩৬৫], শ্রী অবনীনাথ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে’ [শ্রাবণ ১৩৬৭] ইত্যাদি। এই গ্রন্থে রবীন্দ্র-বিরোধিতা বিষয়ক প্রবন্ধ স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও অরুণ ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক মন’ [কার্তিক, ১৩৬৪] প্রবন্ধে রবীন্দ্র-বিরোধিতা ও রবীন্দ্র-স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি যথাযথ তথ্য ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রাবন্ধিক শুধু ‘শেষের কবিতা’ নয়, ১৯৩৪-এ লেখা ‘চার অধ্যায়ের’ও উল্লেখ করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যতটা আধুনিকতা ছিল, আধুনিক কালে জন্মগ্রহণ করেও অনেক প্রতিভাধর শিল্পী ততটা আধুনিক ছিলেন না। আসলে আধুনিকতা তো শুধু ভাষা ও আঙ্গিকের নয়, আধুনিকতার মূল থাকে গভীর মননশীলতায়।

সংকলনে একান্তভাবে রবীন্দ্রনাথের কাব্য নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ আছে--অবনীনাথ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথের কাব্য’ [বৈশাখ, ১৩৬৬], রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র-কবি-কৃতির আলোচনা’ [আষাঢ়, ১৩৬৬] এবং সুধাংশুমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রকাব্যে শেষ যুগে ঋতু পরিবর্তন’ [বৈশাখ, ১৩৬৭]। মিহিরকুমার মুখোপাধ্যায় ‘মিষ্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ’ [বৈশাখ, ১৩৬৬] প্রবন্ধে বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে রবীন্দ্রভাবনার তুলনা মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত করেছেন। বৈষ্ণব কবির সকল উপলব্ধির নিয়ন্ত্রক মধুর রস, আর রবীন্দ্রনাথে ‘এ-রস চেতনা সৌন্দর্যের আঙ্গিক।’ ‘বৈষ্ণব সাধনায় আনন্দচেতনা মাধুর্যের। আত্মনিবেদনই মিষ্টিসিজম। রবীন্দ্রনাথে রসচেতনা সৌন্দর্যের, তিনি জীবনরসের সাধক, তাঁর নব অনুরাগই মিষ্টিসিজম।’ নরেন্দ্র দেবের ‘সৌন্দর্যসাধক রবীন্দ্রনাথ’ [বৈশাখ, ১৩৬৫] প্রবন্ধে কবির সৌন্দর্যসাধনা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার অনুভবে কীভাবে সার্থক হয়েছে, তা যেমন বিশ্লেষিত হয়েছে, তেমনি সেই বিশ্লেষণে মানব-অর্ন্তলোকের একান্ত উপলব্ধি এবং অতীন্দ্রিয়লোকের জ্যোতির্ময় ঐশ্বর্যের প্রসঙ্গও এসেছে।

রবীন্দ্রসাহিত্য গ্রহণের মাধ্যমে পাশ্চাত্য যে কতভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, তার পরিচয় আছে সুরেশ চক্রবর্তীর ‘সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ [মাঘ ১৩৬৩] প্রবন্ধে। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রসাহিত্যের সমাদরের বিষয়টিই বর্তমান প্রবন্ধের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। রুশ ভাষায় রবীন্দ্রসাহিত্য অনুবাদের প্রসঙ্গও এই প্রবন্ধে উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু পড়ে মনে হয় বক্তব্যটি কোনো রাশিয়ানের, এবং সুরেশ চক্রবর্তী বোধহয় তার অনুলিখন বা অনুবাদ করেছেন। শিশির কুমার মৈত্রর ‘বিশ্বযুগের কবি রবীন্দ্রনাথ’ [বৈশাখ, ১৩৬৪], নারায়ণ চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথ’ [বৈশাখ, ১৩৬৭], এবং শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র প্রতিভার আর এক দিক’ [বৈশাখ, ১৩৬৭] প্রবন্ধে মূলত কর্মী রবীন্দ্রনাথই মুখ্য আলোচ্য বিষয়। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে মানবতাকে বিশ্বসত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দেখেছেন, পাশ্চাত্যের মনোভঙ্গি ঠিক তার বিপরীত।

রবীন্দ্র প্রতিভার বহুমুখী ধারার উৎস হচ্ছে সৃষ্টি-সুখের উল্লাস। রবীন্দ্র-কাব্যে দর্শনে এই মূল কথাই ব্যাপ্ত হয়ে আছে--এই মন্তব্য শুধু ‘জীবন-সাধক রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ’ [জ্যৈষ্ঠ ১৩৬০] প্রবন্ধের রচয়িতা নবেন্দু চক্রবর্তীর নয়, এই অভিমত যাঁরা রবীন্দ্রচর্চায় ব্যাপৃত, তাঁদের সকলেরই।

প্রবোধচন্দ্র সেনের ‘রাবীন্দ্রিক ছন্দ’ [বৈশাখ, ১৩৬০] আর একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এই গ্রন্থে শৈলীগত আলোচনার এটিই একমাত্র প্রবন্ধ এবং রবীন্দ্রকাব্যে ছন্দ-বৈশিষ্ট্যের পর্যালোচনা নি:সন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ও।

‘রবীন্দ্রনাথের রেকর্ড’ [বৈশাখ, ১৩৬০] একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ রচনা। রচয়িতা-- সন্তোষকুমার দে। এই জাতীয় রচনা গ্রন্থে আর একটিও নেই। অথচ এই তথ্যগুলির ঐতিহাসিক মূল্য আছে। লেখক শুধু রেকর্ডগুলির উল্লেখ করেননি, ঐ রেকর্ডের সমসাময়িক এবং নেপথ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণও দিয়েছেন। সম্পাদকের সাধুবাদ, এই সংকলনগ্রন্থে এমন একটি রচনার অন্তর্ভুক্তি ঘটানোর জন্য।

শিশিরকুমার মৈত্রর ‘রবীন্দ্ররচনায় মানবতার স্থান’ [বৈশাখ, ১৩৬৩] প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের মানব-ভাবনার পরিচয়ই শুধু নয়, ‘মানবতা’ শব্দটির বিস্তৃত বিশ্লেষণও।

এই সংকলনগ্রন্থের প্রবন্ধগুলির আলোচনায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ‘উত্তরা’ র রবীন্দ্রচর্চায় মৌলিকতা ও নিরপেক্ষতার অভাব ছিল না। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি নেই এখানে। রবীন্দ্র-প্রতিভা এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের নানা দিকের আলোচনায় দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা এখানে প্রকাশিত। আর এই স্বচ্ছতার কারণেই প্রাবন্ধিক অবনীনাথ রায় সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ (১৯১৬) উপন্যাসের আলোচনা করেন [প্রবন্ধ – রবীন্দ্রনাথের “ঘরে বাইরে”, শ্রাবণ (১৩৬৭)] এবং নির্দ্বিধায় বলেন - ‘রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছেন ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস শিল্পকাজ হিসাবেও বইখানি সার্থক হয়েছে, কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। রবীন্দ্রনাথের বিরাট বৈদগ্ধ্য (intellectuality) এর মধ্যে আছে সত্য কিন্তু উপন্যাসের প্রাণ বৈদগ্ধ্য নয়, উপন্যাসের প্রাণ হইল রস। এর মধ্যে রসের অভাব আছে। ... তাই মনে হয় ‘ঘরে-বাইরে’ রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতম সাহিত্যকীর্তি’। একথা ঠিকই যে, প্রাবন্ধিকের এই মন্তব্য খণ্ডন করার মতো যুক্তি আমাদের অবশ্যই আছে। তাঁর অভিমত আমরা সমর্থন করতে পারি, আবার নাও পারি। কিন্তু সমর্থন-অসমর্থনের বিষয়টি এখানে অবান্তর। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চায় যে মুক্ত বাতাসের চলাচল পছন্দ করতেন, ‘উত্তরা’ র রবীন্দ্রচর্চায় তা-ই সম্ভব হয়েছিল।

এই গ্রন্থে একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন অতুলপ্রসাদ সেনের ‘আমার কয়েকটি রবীন্দ্রস্মৃতি’ [বৈশাখ, ১৩৬৮] রচনাটি। এই স্মৃতিচারণে কবির ব্যক্তিজীবন ও পরিবারজীবনের নানা প্রসঙ্গ, ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতিচর্চা, খামখেয়ালী সভা, ঠাকুরবাড়ির সারল্য, বলেন্দ্রনাথ প্রমুখ এবং ঠাকুরবাড়ির বা রবীন্দ্রনাথের বন্ধু-স্বজনদের কথাও নানাভাবে উত্থাপিত হয়েছে। কবির স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশসঙ্গীত রচনার প্রেক্ষাপটেরও উল্লেখ করেছেন লেখক। বলেছেন রামগড়ে রবীন্দ্র-আতিথ্যধন্য দিনগুলির কথা। সেখানে কবির ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’ গানটি রচনার অনুপম অভিজ্ঞতাও স্মৃতিচারণসূত্রে ব্যক্ত করেছেন অতুলপ্রসাদ। সদ্য রচিত এই সঙ্গীতের সুরলহরী ছড়িয়ে পড়েছিল শৈলকুসুম, গিরিশ্রেণী, তুষার মালায়। সে এক স্বর্গীয় অনুভব! এমনি ভাবেই আরও একদিন ঊষার অরুণোদয়কে সাক্ষী করে রচিত হয়েছিল ‘ফুল ফুটেছে, মোর আসনের ডাইনে বাঁয়ে পূজার ছায়ে’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার দিনটি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা পরম যত্নে স্মৃতির সিন্দুকে তুলে রেখেছিলেন অতুলপ্রসাদ। তিনি নিজেও গায়ক গীতিকার। তাই তাঁর স্মৃতিচারণ একজন শিল্পী কর্তৃক আর এক শিল্পীর স্মরণ। বর্তমান রচনাটি প্রকাশিত হওয়ার আগে দিল্লীর রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে সভাপতির অভিভাষণে এটি পঠিত হয়েছিল। বর্তমান গ্রন্থের ‘উত্তরা-কথা’ অংশে ‘উত্তরা’ প্রকাশের ইতিবৃত্তে অতুলপ্রসাদ লখনউ-এর সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার। এই পত্রিকার প্রকাশে তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। তাঁরই প্রস্তাবে পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে আশীর্বাণী চাওয়া হয়। কাজেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক এই রচনাটির নি:সন্দেহে স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে।

‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরা’ গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর বিষয় বৈচিত্র্য। গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধগুলি আজ থেকে প্রায় ষাট বৎসর পূর্বে বহির্বঙ্গে বাঙালির রবীন্দ্রচর্চার নিদর্শনস্বরূপ এবং প্রবন্ধের বিষয়গুলি নতুন নতুন গবেষণার উপাদানে ঋদ্ধ। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরা’ গ্রন্থে যেমন প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে, তেমনি চয়ন করা হয়েছে রবীন্দ্রবাণী। মনে হয়, অতীতে ‘উত্তরা’য় রবীন্দ্রবাণী চয়নের যে রীতি ছিল, সম্পাদকদ্বয় সেই ঐতিহ্যের নির্যাসটুকু যেন আজকের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।

উপসংহারে আছে ‘উত্তরা’ য় প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনার কালানুক্রমিক তালিকা এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত রচনার সার্বিক তালিকা। এছাড়া আছে ব্যক্তি পরিচিতি। গ্রন্থের প্রবন্ধগুলিতে গবেষণার সূত্র-সন্ধান তো আছেই, সেই সঙ্গে এর বিষয়সজ্জা থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-রচনা, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত রচনা ও ব্যক্তিপরিচয় পর্যন্ত যে বিন্যাস তাতে গবেষণার রীতি ও পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসৃত হয়েছে। এত উন্নত মানের প্রবন্ধের একত্র সংকলনে সম্পাদকের বিচক্ষণ বিবেচনার কথা বলতেই হয়। গ্রন্থের প্রচ্ছদে সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রপ্রতিকৃতিটি লক্ষ করার মতো। এমন একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য ‘কারিগরে’র কর্ণধার শ্রী দেবাশিস সাউ-এর। বইটি খুব সঙ্গতভাবেই উৎসর্গ করা হয়েছে বহির্বঙ্গের বাঙালিদের উদ্দেশে, রবীন্দ্রানুরাগীদের উদ্দেশে।