• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | রম্যরচনা
    Share
  • স্বপ্নধূসর : দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

    ॥"দিন আর রাত্রির মাঝখানে পাখিওড়া ছায়া ..."॥

    অনেকদিন পর তোকে লিখছি । কেন জানি না, আজকাল আর কাউকে চিঠি লেখা হয় না । লিখতে বড় আলস্য লাগে । ছোটোবেলায় স্কুল ছুটি হলেই বন্ধুদের চিঠি লিখতাম ; আমাদের আবার পোস্টবক্স ছিল না বাড়িতে । সুতরাং, হাতে হাতে চিঠি বিলির ব্যবস্থা । যেদিন পিওন এসে ডেকে নাম ধরে চিঠি দিয়ে যেত, সেদিন সব পড়াশুনা মাথায় উঠে যেত । যতক্ষণ না তার উত্তর লিখে ফেলতে পারতাম, ততক্ষণ শান্তি নেই । এখন তো আর তোর চিঠি আসে না । দূরত্বের জন্যেই হয়তো । এখন মাঝেমধ্যে পুরানো চিঠিগুলো পড়তে ইচ্ছা করে, কিন্তু সেগুলো তো রেখে দেওয়া হয়নি । কতবার বাড়ি বদলেছি আমরা, বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে এমনি কত ছোটো ছোটো ভালোলাগার জিনিষ হারিয়ে গেছে ।

    তুই জানতে চেয়েছিলি কেমন আছি আমি । সত্যি যদি বলতে বসি কেমন আছি আমি, তোর কেমন লাগবে ? আমাদের সময় তো ত্রক্রমশই কমছে, খুব কমে আসছে ধীরে ধীরে । একটা সময় বলার মতো অনেক কথা ছিল, ফুলঝুরি ছড়িয়ে থাকত ঘাসে পাতায়, পাখির ডানায় ডানায় তখন সদ্য উড়তে শেখার আরাম, পালকের বুনটে তেজ -- । এখন মাত্র পাঁচটা বছর পরে সেই সময়টাকে ঘুরে দেখি, পিছনে তাকিয়ে সেই আমাকে দেখি । বুঝি, এই আমার ভিতরে সেই মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে । শীতঘুম ? জানি না । তোকে একটা কথা বলব বলে ভাবছি অনেক দিন থেকে । বলতে পারিস সাহস পাচ্ছি না । ছোটোবেলায় একবার পরস্পরকে দেখার স্মৃতিটা এতদিন যে আমার বুকের ভিতরে কেমন করে লুকিয়ে ছিল.. তোকে যেদিন প্রথম দেখলাম, মনে হল কতকালের চেনা -- ! ঠিক লিখে, বলে কোনোভাবেই বোধহয় বোঝানো যায় না সেই মুহুর্তটা । আমার আত্মার গহনে একটা ছোট্ট চারার মতো বেড়ে উঠছিলি তুই । আমি তো জল দিইনি, আলো দিইনি, এক টুকরো বাতাসও দিইনি কখনও ভুলেও । মনে হল তোকে দেখার জন্যেই আমার এতদূর আসা । যাক সেসব -- । সে সব যদিও পুরানো কথা, আমার এখনও ভাবতে গেলে নতুন লাগে । সেই কবে না চেয়েও তোকে হারিয়েছিলাম, তখন হারানোর মানে বুঝিনি । আজ আর একবার সেই পথে হাঁটতে বড় ভয় লাগছে । ভালোবাসতে তো সাহস লাগে না, সে তো ঢেউয়ের ফেনা -- ; তীরে দাঁড়িয়ে দেখতে বড় ভালো লাগে, স্বর্গীয় রঙের স্পর্শে জলের রূপ বদলে যায় ! কিন্তু কাছে এলে চমক ভাঙে । ফাঁকা বুদ্বুদের এমন সম্মোহন -- তবু দাঁড়িয়ে থাকি যদি গোড়ালিটুকুও ডুবিয়ে রাখতে পারি ! গোড়ালি বারবার ডোবে আর ভিজে ভিজে যায়, ওদিকে ত্রক্রমশ: পায়ের নিচের বালি সরে যেতে থাকে । গেঁথে যেতে থাকি আরো ভিতরে, গভীরে । তীর দূরে সরে যায়, তবু চলে আসতে পারি না মুখ ফিরিয়ে, পা সরিয়ে নেওয়া হয় না কিছুতেই । একে ঠিক কেমন থাকা বলে ? আজকাল স্বপ্নে মাঝে মধ্যে তোকে দেখতে পাই । কিন্তু তার সঙ্গে আরো একটা মুখ ভেসে আসে । শুধু তোর মুখ দেখতে চাই, কিন্তু সেই অন্য মুখটা ছাড়ে না কিছুতেই ; কেবলই তোর আরো কাছে , কাছাকাছি সরে সরে আসে । একসময় একেবারে মিলে মিশে যায় তোর চোখের পাতায়, ঠোঁটে -- তার পরে সব অন্ধকার ছাপিয়ে প্রবল বৃষ্টি আসে । বৃষ্টি ছঁংউতে চেয়ে হাত বাড়াই, এক টুকরো বৃষ্টিও এসে জমে না আমার মুঠিতে, কেবল চারপাশে বৃষ্টি পড়ে । দৌড়ে বেরোই বৃষ্টিতে, আমাকে ঘিরে জলের প্রেতাত্মাগুলো নাচানাচি করে -- মুখ, শুধু দুটো মুখ ভিজে একশা হয়ে বৃষ্টিপথে উধাও হয়ে যায়, আমি একা দাঁড়িয়েই থাকি ।

    কাল রাত্রি থেকে হঠাৎ তুমুল তুষারঝড় শুরু হয়েছে । এখনই তো লনের ওপর গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে স্বচ্ছন্দে, অথচ, পরশু দিনও প্রায় বিয়াল্লিশ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছিল বাইরের তাপমান । আশাই করিনি যে এবার বড়দিনে বরফ পড়বে । আশা করিনি বলছি বটে, কিন্তু, মনের কোণে একটা অদ্ভূত বিশ্বাস ছিল যে বরফ ছাড়া বড়দিন এমনি এমনি চলে যেতেই পারে না ! জানিসই তো, সব উত্সবের সঙ্গেই এমন কিছু বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে, যার তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই । তেমনই, এখানে একটা কিংবদন্তী আছে যে বাকি দিনগুলোয় বরফ পড়ুক কিংবা না পড়ুক, বড়দিনে ঘরের ছাতে স্ট্যালাকটাইট জমিয়ে দিতে তুষার ঝড় আসবেই ! আমি অবশ্য বলছি এ দেশের উত্তর দিকটার কথা । কানাডা থেকে একটা উত্তুরে হাওয়া প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বয়ে নিয়ে এসে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগিয়ে দেয় । ঠাণ্ডাটা সহ্য করা যায়, কিন্তু হাওয়াটা চোখেমুখে ঝাপটা মারলেই বরফের অণুকণিকাগুলো মুখে লেগে জমে যায় । জমেই থাকে যতক্ষণ না উষ্ণ স্পর্শ পায় । ছোটোবেলায় বরফ দেখলে ভীষণ ভালো লাগত, না ? আমার একদিন দুপুরবেলার কথা মনে পড়ছে । সেবার বড়দিনের ছুটিতে দেশের বাড়িতে বিরাট পারিবারিক জমায়েত । কারণটা বেশ মজার ! ঠাকুমা রেগে গিয়ে ঠাকুর্দামশাইকে বলেছেন, "খেজুরের গাছগুলি পৈড়যা পৈড়যা নষ্ট হৈতাসে গিয়্যা, কেউ রসও খাওনের নাই, খেজুরের কথা তো ছাইড়যাই দেই । নিজেরা খাইয়্যা, বিলাইয়াও এত্ত পৈড়যা থাকে, আমার বড় কষ্ট হয় । ত্যাগো আর ডাইক্যা কাম নাই, বেইচ্যা -- বুইচ্যা দেন গিয়া । গাছ আমি আর রাখুম না -- " ত্যাগো অর্থে বাবা-জ্যাঠা-কাকা এবং তাঁদের পরিবারবর্গ, পোলাপানের দল । গরমের ছুটিতে যদি বা মাঝেসাঝে গ্রামে যাওয়া হয়, পূজার সময় কিংবা বড়দিনের ছুটিতে তো গ্রামে যাওয়ার প্রশ্নটাই ওঠে না কখনও । কি করে যাব ? পূজা আসতে না আসতে তো কেনাকাটা শেষ করে সদলবলে কেটে পড়ি কলকাতার বাইরে, বিশেষত: অন্য রাজ্যে কোথাও । আর, বড়দিনের ছুটিতে ব্ল্যাক ফরেস্ট কিংবা প্লাম কেকের কলকাতা ছেড়ে অত দূরে কে যাবে ! আর, দূর বলে দূর ? কলকাতা থেকে পাঁচ ঘন্টার ট্রেনজার্নির ধকল সামলে উঠতে না উঠতে আবার বাসে তিন ঘন্টা । তারপর, হাঁটাপথে আধঘন্টা । আমাদের অবশ্য খুব ভালো লাগত দুপাশে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এক টুকরো রাঙামাটির পথ, কোথাও কোথাও আকাশমণি আর ইউক্যালিপটাসের রোদ-ছায়ার লুকোচুরি ; এক দঙ্গল খেজুর গাছ, রস বার করে নেওয়া হয়েছে গত শীতেও, সারা দেহে তারই চিহ্ন নিয়ে ঋজু, কখনও ক্ষেতের দিকে বেঁকে দাঁড়িয়ে থাকে, মনে হয় এবারের কালবৈশাখীটা আর সামলাতে পারবে না । কিন্তু, অমনিই আছে, থাকে, দিব্যি সামলে দেয় জীবনের প্রতিটি দিন, যাবতীয় ঝড়-ঝাপটা ।

    যাইহোক, ঠাকুমা'র হুমকি শুনে তো সকলে নড়ে-চড়ে বসলেন । ঠাকুমা'র যেই কথা, সেই কাজ । এদিকে অত সাধের গাছগুলি বিক্রি হয়ে যাক, তাও কেউ চায় না । যতই হোক, ঐ গাছগুলির একটা থেকে পড়েই তো কাকুমণির পা ভেঙেছিল । কি হয়েছিল জানিস ? দাদার মুখে যা শুনেছি, আমরা, মানে আমি আর দাদা তখন খুব ছোটো । কাকুমণির সদ্য বিয়ে হয়েছে মাস খানেক হয়েছে কি হয়নি । কাকিমা শহরের মেয়ে । ডানপিটে, খেলুড়ে কাকুর প্রতি সমীহের রসটা বেশ ধীরে সুস্থে চারাচ্ছে । তার আমেজটা জিইয়ে রাখার জন্যে কাকুমণি ঠিক করলেন নিজে খেজুর গাছ থেকে রস পেড়ে সবাইকে লুকিয়ে নতুন বৌয়ের সঙ্গে পিছনের বাগানে পুকুরের ধারে আম গাছের নিচে বসে খাবেন । খুবই সৎ ইচ্ছা ! তো, একদিন ভোর সাড়ে-চারটেয় উঠেছেন খেজুর রস পাড়বেন বলে । দিনকয়েক আগে এসে মোহিয়া হাঁড়ি লাগিয়ে দিয়ে গেছে গাছে । সেদিন নামাতে আসবে । ও আসার আগেই হাঁডিটা সরাতে হবে । কাকিমা বাইরে আসেননি, নিজের ঘরের জানলা থেকে দেখছেন ঘোমটা মাথায় দিয়ে । স্বামীরত্নটি গাছ থেকে নামলেই তিনি দরজা ভেজিয়ে সোজা বাগানে যাবেন । এদিকে কাকুমণি অর্ধেকটা উঠেছেন কি ওঠেননি, নিচে থেকে একটা গরু হঠাৎ তারস্বরে চিত্কার করে উঠেছে । সঙ্গে সঙ্গে পাশের বেলগাছ থেকে একঝাঁক কাক ঝটাপটি, হুড়োহুড়ি লাগিয়ে বেরিয়ে এসে কথা নেই, বার্তা নেই, কাকুমণির হাতে এক ঠোক্কর । কাকুমণিও গাছের গলায় জড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে কাক তাড়াতে গিয়ে ধপাত করে সোজা গরুর লেজের ডগায় ! গরুটা তো চেঁচিয়েছিল খেজুর রসের গন্ধ পেয়ে । তার বদলে একটি আদ্যোপান্ত মানবসন্তান অমন টুপ করে গাছ থেকে খসে পড়ায় পাওনাটা বেশি হয়ে গেছে ভেবেই সম্ভবত: দে-দৌড় ! ওদিকে কাকিমার চিত্কারে তখন সকলে উঠে পড়েছে । তারপরে ডাক্তার বদ্যি আর পথ্যি । খেজুর রস খাওয়া মাথায় ! বেশ কয়েকদিন পর, বাবাদের এক পিসে বৌ দেখতে এসে এই কাণ্ড দেখে কাকুকে বললেন, "এ কি হইল ? নূতন কইন্যা বাসায় ঢোকসে কি ঢোকে নাই, তুমি গাস থিক্যা বানরের মতো খইস্যা গেলা গিয়া ? রাহু রাহু !" আসলে ইচ্ছা ছিল নারায়ণের নাম করেন । কিন্তু, বললেন রাহু ! কাকিমাকে লক্ষ করে কথাটা বলা হয়েছে ভেবে কাকুমণি তো চটে আগুন । পরে আবার জ্যাঠা তাঁকে বোঝাতে তবে ঠাণ্ডা হলেন । আসলে পিসের মুদ্রাদোষই ছিল নারায়ণের বদলে রাহুর নাম স্মরণ করা ! যাইহোক, সেই গাছ কখনও অদরকারে বেচে দিতে ইচ্ছা করে ? অগত্যা, দিন কয়েক ফোন চালাচালি হল, মা-জেঠিমারা ভুটিয়া বাজারে গিয়ে রাশিরাশি গরম চাদর, সোয়েটার, মাফলার ইত্যাদির দরদাম করে মাত্র গুটিকয় কিনে ফেরত এলেন । জেঠু তো একদিন থাকতে না পেরে বাবাকে বলেই ফেললেন, "এদের কাণ্ড দেখসস পাঞ্জা ? কার সাধ্য আসে যে বোঁচা মাথায় হক কথাটা ঢুকাইয়্যা দ্যায় ! মুখ দ্যাখলে মনে হইব য্যান যুদ্ধ জয় কইর্যা আসছে । আসলে যে ঠৈক্যাঠুইক্যা একশেষ হইয়্যা আসছে, বুঝাইয়্যা পারি না । আরে, দোকানদার কি ত্যাগো হ্যার ক্ষতি কইর্যা বেইচ্যা দিব ?" বাবা অবশ্য আর বোঝানোর মধ্যে যান নি । কারণ, ভুটিয়া বাজার থেকে আনা চাদরটা গায়ে দিতে বেশ আরামই লাগছিল তাঁর । এর পর বড়দিনের ছুটিটা পড়তে সকলে পৌঁছলাম গ্রামের বাড়িতে ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছে ।

    একদিন দুপুরবেলায় খেয়েদেয়ে ঠাকু'মা রোদে মাদুর পেতে শুয়েছেন । শীতের রোদে সহজেই ঝিমুনি এসে গেছে । ধুনিদা'ও ধারে কাছে নেই । ঠাকুমার ডানহাত সে । খাঁটি বাঙাল ব্রাহ্মণের সন্তান । কাজেই রেগে গেলে চোখা চোখা বাঙাল বাণে প্রতিপক্ষ সহজেই বিধ্বস্ত হয় । খুঁজতে গিয়ে দেখি সে সামনের বারান্দায় দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগিয়েছে । সেই তালে আমি আর দাদাও ঠাকু'মার আচারের ভাণ্ডার থেকে একটা বয়াম হাতিয়ে, বসে বসে তেঁতুলের ঝালমিষ্টি আচার আঙুল দিয়ে তুলে তুলে খাচ্ছি আর টি.ংইভ.তে একটা ফিল্ম দেখছি । সেই যে রে, প্রাণ ভিলেন ছিল না ? সেই ফিল্মটাতেও বরফ দেখিয়েছিল অনেক । তখন বরফ দেখলে কি যে ভালো লাগত ! ঝাল আচারের সঙ্গে বরফের কম্বিনেশনের কথাটা ভাব । উহহ ! জিভে জল এসে যাচ্ছে ! ঠিক যেন ডালপুরি আর ধনেপাতার ঝাল চাটনির সঙ্গে কাঁচা আমের টকমিষ্টি চাটনি । খেতে খেতে আচারের শিশি অর্ধেকের বেশি খালি হয়ে এসেছে, এমন সময় মূর্তিমান শয়তানের মতো ধুনিদার আবির্ভাব, এক হাতে বুলিদি'র (??) হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে । আমাদের আচার খেতে দেখেই ধুনিদা দৌড়ে গেল রান্নাঘরে, আর আমরাও আচারের শিশি ফেলে রেখে আঙুল মুখে পুরে এক দৌড়ে পগার পার । পোড়ো শিবমন্দিরের চাতালে বসে সারা দুপুর রোদ পোয়াতে পোয়াতে গল্প -- সে আর শেষ হয় না । বুলিদি' আমার থেকে বড় ছিল, আবার দাদার থেকে ছোটো । ভালো ছাত্রী ছিল । প্রেসিডেন্সিতে সেটাই ওর প্রথম বছর । এদিকে দাদা শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে একটা চাকরিতে ঢুকেছে । কাজেই দিব্যি গল্পে জমে গেল দু'জনে । রোদ ত্রক্রমশ: চাতাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে বটের ঝুরির নিচে শিকড়ের জঙ্গলের ভিতর সেঁধিয়ে গেল । এবার ঘরে ফেরার পালা । পরের দিন আবার আসবে বলে চলে গেল বুলিদি । আমরাও ফেরার পথ ধরলাম । পরের দিন আবার এসেছিল বুলিদি', তার পরের দিন, তার পরের দিনও । রোজই এসেছিল যে ক'দিন আমরা ছিলাম ।

    ঠাকু'মার ব্যবসা সেবারের মতো স্থগিত করে সপ্তাহ দু'যেকের ছুটি শেষে আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম । তারপর আমার সঙ্গে সরাসরি বুলিদি'র আর তেমন যোগাযোগ ছিল না । তবে, দাদার সঙ্গে ছিল । দাদা প্রায়শ:ই কলেজস্ট্রীট যেত । আর গেলেই একবার প্রেসিডেন্সিতে ঢঁংউ মারতে ভুলত না । বোট্যানিক্যাল গার্ডেনেও প্রায়শ:ই ঘুরতে যেত ওরা । এইভাবে ওদের দেখাশোনা বাড়ছিল । আমাদের বাড়িতেও এসেছে বেশ কয়েকবার । বাবা-মা' বুলিদি'কে খুব পছন্দ করতেন, জেঠিমাও । বইমেলা থেকে শুরু করে হস্তশিল্পমেলা, কিংবা নন্দনের ফিল্ম রেট্রোসপেকটিভ -- কত জায়গায় যে মা-জেঠিমার সঙ্গে গেছে ও । আমিই কখনও নিজের মা'র সঙ্গে অত ঘুরিনি । অথচ, ওর খুব ভালো লাগত । গড়িয়াহাট থেকে কেনাকাটা করবে, মা'র যাওয়া চাই । মা'র সময় নেই, তো জেঠিকে যেতেই হবে, নইলে চলবে না । মাঝেমধ্যেই হস্টেল ছেড়ে চলে আসত আমাদের বাড়িতে, থেকে যেত দু'তিন দিন । সেই ক'দিন দাদারও প্রবল আনাগোনা এখানে । মা-বাবা বুঝতেন সব কিছু । আসলে ভীষণ প্রাণোচ্ছ্বল ছিল তো । চেনাজানার গণ্ডির ভিতর এবং বাইরের সব কিছুতেই ওর অপরিসীম উত্সাহ ছিল । সেলাইফোঁড়াই থেকে শুরু করে হাতের কাজের নকশা -- অনেক কিছু শিখেছি বুলিদি'র কাছে । শহরের মেয়েদের পড়াশুনার শেষে অন্য কাজের জন্যে সচরাচর এত ধৈর্য থাকে না । আমারও ছিল না । তাই ওকে দেখে অবাক হতাম । একদিন দেখি, দাদার আঁকা কয়েকটা নকশা ওর কাছে । দাদার খুব ভাল আঁকার হাত ছিল জানিসই তো । জিজ্ঞাসা করলাম, কি করবে এগুলো দিয়ে । লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলল । খুব মৃদুস্বরে বলল, আমার সেলাই করতে খুব ভালো লাগে । আসলে, দাদা ওকে নকশা এঁংএক দিত, আর সেই সব নকশা ও আসনে সেলাই করত । আমাদের ঠাকুরঘরের জন্যে এই রকম দুটো আসন তৈরি করে দিয়েছিল মা'কে । সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু আমার মনের ভিতরে একটা কাঁটা ফুটত সব সময় । বোনেরা কখনও দাদার সম্পর্কে কোনো মেয়ের মানসিকতাকে বুঝতে ভুল করে না, জানিস । আমার মনে হত, বুলিদি দাদাকে চায়, ভীষণ ভাবে চায় । আমি তো নিজেও ভাবতাম, এই রকম একটা বৌদি পেলে দারুণ হয় । আমার একটা দাদা থাকতে, দাদার সঙ্গে ওর এত ভাব থাকতে এই মেয়েটা কেন অন্য ঘরে যাবে ? একদিন জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম কথাটা ।
    -- বুলিদি, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, সত্যি উত্তর দেবে ?
    -- কি কথা, বল না ?
    -- আমার দাদাকে তোমার কেমন লাগে ?
    -- কেমন লাগে মানে ? আমি স্পষ্ট দেখলাম বুলিদি হাসি চাপতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে , আর তার চাপে ওর ফর্সা গাল ঈষৎ লাল ।
    -- মানে আমি বলব না । তুমি বুঝতেই পারছ ।
    -- তুই তো পেকে ঝুনো হয়ে গেছিস রে । হেসে ফেলল বুলিদি' ।
    -- তুমি কিন্তু উত্তর দিলে না --


    বুলিদি হাসি থামিয়ে তাকাল আমার দিকে । অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল । আমার দিকেই চেয়ে ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে, আমার চেহারাকে ক্যানভাস করে ওর ভিতরে তখন অন্য কোনো কথার তোলপাড় ।
    -- ছাতে যাবি মৌ ?
    -- চলো ।
    ছাতে এসে একবার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে দেখে নিলাম । রোজই ছাত থেকে নিচের পৃথিবীটাকে দেখি, রোজই তবু নতুন লাগে । আমাদের বাড়িটা বড় রাস্তার ঠিক ওপরে নয় বলে পাশেই বেশ বড় একটা ফাঁকা মাঠ আছে, সঙ্গে বিরাট পুকুর । বিকেলবেলা মাঠে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলে, অনেকে সময় ক্রিকেটও চলে এবং প্রায়ই ছক্কার বলগুলো আর পিটুনি খাবে না প্রতিজ্ঞা করে আমাদের ছাতে এসে আশ্রয় নেয়, নয়তো সোজা পুকুরে ডুব দেয় । অনেকখানি জল ছড়িয়ে পড়ে রাশি রাশি ঢেউবিন্দু তুলে, অনেক দূর পর্যন্ত ছঁংউয়ে ছঁংউয়ে যায় হাওয়া, শালুক, শ্যামাঘাসের আঙুল । তারপর, সব শান্ত হয়ে আসে । শীতের রাত্রিতে নেট বেঁধে ব্যাডমিন্টন খেলাও চলে মাঝেসাঝে । আপাতত মাঠ ফাঁকা । পুকুরের জলে আয়েসি স্রোত কাটছে হাওয়া । হাঁসেদের একটা ছোট্ট দল এতক্ষণ পাড়ে দাঁড়িয়ে পালক খঁংউটছিল । এক্ষুণি আবার নেমে গেল জলে । এমন অদ্ভূত তালজ্ঞানহীন ভাবে জলে ভাসে যে মনে হয় ঐ মুহূর্তে ওইখানে জলের তারল্যটুকু না থাকলে অবশ্যই পড়ে যেত ওরা । কিন্তু পড়ে না কখনওই । ভেসে থাকে, পায়ে পায়ে তাল রেখে দোলে, ডানা ঝাড়ে, ডুব দেয় ; এপার-ওপার করে । এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায় । হাঁসেদের পালকে আঁচলের বাড়তি রঙটুকু মুছে নিচ্ছে সূর্য । ওদের চলার বেগ বেড়েছে । রোজই বাড়ে । সূর্যাস্তের সময়টুকু কি দ্রুততায় এপার-ওপার করে ওরা, মনে হয় নিয়ম আছে কোনো ! দলের একেবারে শেষে একটা বাচ্চা, শুধু তারই এইসব নিয়ম জানা নেই । তাই সে অলস পায়ে জল কাটতে কাটতে এদিক-ওদিক দেখছে, ঘাড় নামিয়ে ডুবও দিল একবার । এবার ঘাটে উঠে আসছে ওরা । কয়েকটা ভাঙাচোরা সিঁড়ি আছে এপাশের ঘাটে । ওরা অন্য ঘাট থেকে জলে নামে, ওঠে । সেখানে শুধুই শ্যাওলার আস্তরণ, দূর্বার ঝোপ । সবুজ পরতে দিনান্তের শেষ আলোয় কালচে আভা.. অল্প অল্প করে এই কালো রঙ ছড়িয়ে যাবে পটে ।
    -- তোদের এখানে কেন আসি জানিস ? বুলিদি'র কথায় চমক ভাঙল আমার ।
    -- কেন আসো ?
    -- তোর মা'র কাছে থেকে নিজের মায়ের কাছে না থাকার দু:খটা ভুলতে পারি বলে ।
    -- শুধু এই ?
    -- ভালো লাগে ।
    -- কি ?
    -- তুই যা জিজ্ঞাসা করেছিলি । প্রায় স্বগতোক্তির মতো শোনাল কথাটা ; কিন্তু আমি তো আমার উত্তর পেয়ে গেছি ।
    -- আমি জানতাম । দাদা জানে ?
    -- কি জানি ; জানে বোধহয় ।
    -- ওকে কি তুমি বলেছ ?
    -- সব কথা কি বলে দিতে হয় রে ? মানুষ নিজের থেকেই অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে যদি বোঝার ইচ্ছা থাকে ।
    -- তোমরা তো একসঙ্গে ঘোরাঘুরি কর --
    -- সে তো করি; কিন্তু আমি শমীকদা'কে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলাম না এখনও ।


    চুপ করে রইলাম । এর আর কি উত্তর দেব ? এসব কথা একান্তই ব্যক্তিগত । আমরা দু'জনেই এত আস্তে কথা বলছি যে পুরো কথোপকথনটাই স্বগতোক্তির মতো শোনাচ্ছে । নেহাৎ কান আছে বলেই পরস্পরের কথা শুনে নিচ্ছি । মা'কে বলা যায় কিনা ভাবছিলাম, কিন্তু বুলিদি' সে রাস্তাটা আগেই বন্ধ করে রাখল --
    -- তোর মা'কে এখনই বলিস না, কেমন ? আগে আমার পড়াশুনা শেষ হোক ।
    পড়ার চাপে মাসখানেক আর মাথা তোলার সময় পাইনি । সারা বছর হাতের তালুতে বইয়ের নামগন্ধ না থাকলে পরীক্ষার সময় যা হয় ! একদিন রাত ন'টার সময় বাড়ি ফিরে দেখি তুলকালাম চলছে বাড়িতে । জেঠুর তর্জনগর্জনে কান পাতা দায় । মা দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে আছেন জেঠিমার সঙ্গে । বাবা জেঠুকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন কিছু একটা, এবং তাতে জেঠুর চিত্কার উত্তরোত্তর বাড়ছে বৈ কমছে না । কথাবার্তা থেকে যা বোঝা গেল, তা মোটামুটি এই -- দাদা একদিন অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওর ব্যাগ থেকে ওর অজান্তেই একটা খাম পড়ে যায় । জেঠু সেটা কুড়িয়ে নেন ও যথারীতি খোলেন । সেটাতে বুলিদি'র এমন কয়েক গোছা চিঠি ছিল যা জেঠুর পক্ষে ওদের সম্পর্ক বুঝে নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট । কিন্তু এ বিষয়ে দাদাকে কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদ করার কোনো প্রয়োজনই বোধ করেন নি তিনি । সোজা এসেছেন আমাদের বাড়িতে বাবার কাছে জবাবদিহি চাইতে যেহেতু বুলিদি'র সঙ্গে আমাদের মিলমিশের ব্যাপারটা অবিদিত ছিল না তাঁর কাছে । এদিকে বাবাও পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে বুলিদি'কে এ বাড়িতে নিজের মেয়ের মতো দেখা হয় ।
    -- নিজের সন্তান হইলে তুই এ কথাটা কইতে পারতি না । জেঠুর চিত্কার কানে এল ।
    -- অবশ্যই পারতাম । তোর জায়গায় নিজেরে বসানের লগে আমার বক্তব্য বদলাইতে হয়, এত খেলো কথা আমি কই না ।
    -- মিথ্যা কথা কওনের জায়গা পাও নাই ? বুলির সঙ্গে তুই তোর ছেলের বিয়া দিতি ?
    -- দিতাম । বুলির মতো মাইয়্যা খঁংউইজলে কয়টা পাওন যায় ? ও যেমন পড়াশুনায়, তেমনি ওর হাতের কাজ, স্বভাব-চরিত্র । আমার মাইয়্যারেও আমি এত পার্ফেক্ট কইর্যা তৈয়ারী করতে পারি নাই । বাবার স্বর শান্ত গম্ভীর । জেঠিমা আর থাকতে না পেরে ঘরে ঢুকে থামাতে চেষ্টা করলেন জেঠুকে ;
    -- শুনতাসো, শমুরে একবার জিজ্ঞাসা করনের দরকার আসিল না ? ওর মতটাও তো জানন দরকার । তাছাড়া, মাইয়্যাটা সত্যিই বড় ভালো ;
    আমার তো খুব মনে লাগসে । তুমি একদিন দেখলাই না হয় --
    -- চুপ কর তুমি । শমুরে জিজ্ঞাসা করন লাগব, কেন আমি কি মইর্যা গেসি ? তোমার আপত্তি থাক বা না থাক, আমার আপত্তি আসে । আমি আমার ছাওয়ালরে বড় ঘরের মাইয়্যার লগে বিয়া দিমু, ঘর আমার ঠিক করাই আসে । তাসাড়া, তোমরা কি মনে কর বাবা এসব মাইন্যা নিবেন ?
    -- বাবা মাইন্যা নিবেন কিনা হেইডা বাবারে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয় । তাছাড়া, ঘর বড় হইলেই মানুষ বড় হয় না । বাবা আগের মতোই শান্ত ।
    -- ঘর ঠিক করাই আসে ? আমি তো কিসু জানি না ? তুমি আমারে না জানাইয়্যাই ঘর ঠিক কৈর্যা ফালাইলা ? জেঠু বাবার কথাটার একটা লাগসই উত্তর দেওয়ার আগেই জেঠীর প্রশ্নটা উঠে এসে ঝুলতে থাকল ।

    যদিও এই ঘটনাটা জেঠুকে বুঝিয়ে ইতিবাচক উত্তর পাওয়ার জন্যে যে কোনো সময়ই অসময়, তবু আমার মনে হচ্ছিল যে, এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ওদের গোচরে না এলেই ভালো হত । দাদার ওপর রাগ হচ্ছিল ; সামলাতে পারিস না যখন চিঠিগুলো আমায় রাখতে দিলেই হত । আমি কি পড়ে ফেলতাম ? না হয় পড়লামই একটু , কিন্তু তাতে আর এমন কি এসে গেল ? ভাবছি, দাদাটা এখন না এসে হাজির হলে বাঁচি, তা হলে জেঠু আর আস্ত রাখবেন না ওকে । কিন্তু কথায় বলে না, যেখানে বাঘের ভয়... আমার সাতপাঁচ ভাবার মধ্যেই মূর্তিমান এসে ঢুকল । ও ঢুকতেই সমস্ত চিত্কার-চেঁচামেচির মুখে যেন হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দিল কেউ । অবশ্য সেটা মুহূর্তের জন্যে । -- আসো রাজপুত্তুর, প্রেমিকপ্রবর -- জেঠুর চিত্কার শুনে স্পষ্টই বোঝা গেল যে রাগের চোটে একেবারে কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে । দাদাও এই রকম সম্ভাষণ আশা করেনি বলে হতভম্ব হয়ে ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়েই রইল চুপচাপ ।
    -- কই, এইসব কি ? চিঠির গোছাটা দাদার দিকে ছঁংউড়ে ফেললেন জেঠু ।
    -- কি ? বুলির চিঠি । দাদার নির্লিপ্ত স্বর শুনে এবার বাকি সকলের অবাক হওয়ার পালা ।
    -- সে তো দেখতেই পাইতেয়াসি । আমার বাসায় এসব আপদ ক্যান ? এরপর কি কালীঘাটে কাজ সাইর্যা বাসায় আইন্যা উঠাইবা ?
    -- চিঠিগুলো বুলি লিখেছে, আমি তো লিখিনি । বিয়ে করার প্রশ্নটাই আসছে কোথা থেকে !

    আমার বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করছিল জানিস । দাদা এসব কি বলছে ?

    -- কিন্তু তোমরা তো ঘোরাফেরা করতা একসঙ্গে । আমি তো ভাবসিলাম -- বাবা বুঝতে চেষ্টা করেন বিষয়টা ।
    -- হঁযা, কিন্তু তেমন কিছু নয় এ ব্যাপারটা । এইসব নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই ।
    -- প্রয়োজন নাই তো সিঠিগুলি রাইখ্যা দিসিলা ক্যান ? ফালাইয়া থোও নাই ক্যান ? আর, কিসুই কিসু না তো তোমারে লোকে সিঠি ল্যাখেই বা ক্যান ?

    অকাট্য প্রশ্ন ! এর আর কি উত্তর দেবে ? আমি ভেবেছিলাম এবার অন্তত: রেগে গিয়েও দাদা স্বীকার করে নেবে বুলিদি'র সঙ্গে ওর সম্পর্কটা । কিন্তু ও সেসব কিছুই না করে চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে ।

    এত সহজে এ ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, কেউ বোধহয় ভাবেনি । তাই, সকলেই চুপচাপ । তাহলে কি বুলিদি' ওকে বুঝতে একেবারেই ভুল করেছিল ? দাদার দিক থেকে যেটা একেবারেই বন্ধুত্ব ছিল, সেটাকেই ও অন্য কিছু ভেবে ভুল করেছে ? কিন্তু দাদার তো আরো অনেক বন্ধু আছে । সবাইকে বাদ দিয়ে যখন ও একা শুধু বুলিদি'কে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যায়, তখন তো আর ব্যাপারটা শুধুই বন্ধুত্বের পর্যায়ে আটকে থাকতে পারে না । আমিও দাদার আচরণ দেখে অবাক হয়ে গেছি । কারণ যদ্দুর জানি, বাবা-মা'র জেরার সামনে পড়লে লোকে রেগে গিয়েও বলে দেয় সত্যি কথাটা । সপ্তাহখানেক আগেই তো অন্তরার মা' ওর পড়ার টেবিল থেকে বৌধায়নের একটা চিঠি পেয়ে গিয়েছিলেন । সেই নিয়ে কি ঝামেলা ! অন্তরার কলেজে আসাই বন্ধ হওয়ার যোগাড় । তারপর যদি বা শুরু হল তো ওর মা রোজ নিয়ে যান । ভালো ঝামেলাতেই পড়েছে দু'জনে ! আসলে অন্তরা তো কাকিমা'র বকাবকিতে রেগে গিয়ে বলেই দিয়েছিল, "মেয়েকে কোএড স্কুলে পড়াতে অসুবিধা নেই, ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে যেতে দিতে আপত্তি নেই, একসাথে নাটক, আঁকার স্কুল, হ্যানত্যান করতে দিতে আপত্তি নেই, যত ঝামেলা শুধু প্রেম করলেই ? কেন, দোষটা কি করেছি শুনি ?" আমিও দাদার কাছ থেকে এই রকমই একটা প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম । কিন্তু, সেটা না দেখেই অবাক হয়েছি বেশি ।

    এরপর বেশ ক'টা দিন গেছে । কোনো কাজে মন লাগাতে পারছিলাম না । বুলিদি'র মুখটা বার বার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে । দাদা কলকাতায় নেই যে ওকে ধরব, দিল্লী গেছে কাজে । অগত্যা, সময় করে একবার গেলাম বুলিদি'র হস্টেলে । ও ছিল না । রুমমেট তনুদি বলল যে বুলিদি পরীক্ষা শেষে বাড়ি গেছে, সপ্তাহ দু'য়েক পরে ফিরবে । অন্যান্য দিন বুলিদি ঘরে না থাকলেও তনুদি ধরে বসিয়ে গল্প করত, অথচ আজ একবারও বসতেও বলল না । খুব ক্লান্ত ছিলাম, এদিকে বসতে না বললে বসাও যায় না; চলে যাব কি না ভাবছি, তনুদি জিজ্ঞাসা করল,
    -- কেন এসেছিস ?
    -- বুলিদি'র সঙ্গে দেখা করতে । অনেকদিন দেখা হয়নি । অবাক হয়ে উত্তর দিলাম । এর আগে কখনও এমন প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়নি ।
    -- আর দেখা করে কি হবে ? দরকারই বা কি আছে ?
    -- মানে ?
    -- মানেটা তোর গুণধর দাদাকেই জিজ্ঞাসা করিস । এমন ভাব করছিস যেন কিছুই জানিস না । মেয়েটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দে, আর আসিস না এখানে ।

    অপমানে মাথার ভিতরে আগুন জ্বলে উঠল । কিন্তু না জেনেশুনে রাগ দেখানোর কোনো মানে হয় না । তাছাড়া, আমার রাগের তোয়াক্কাই বা কে করে ! তাই অতি কষ্টে মাথা ঠাণ্ডা রেখে জিজ্ঞাসা করলাম,
    -- তুমি কি বলছ আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না ।
    -- আর বোঝার বাকি আছে কিছু ? প্রেম করার সময় মনে ছিল না, বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সময়ও মনে ছিল না যে বুলবুল মুসলমান ? নাকি এই ভেবে শমীক সন্তুষ্ট ছিল যে বুলবুলই বিয়ে করতে চাইবে না ওকে ? যেই বুলবুল তোর দাদার কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে বন্ধু -- বান্ধবদের বিয়ের ব্যাপারটা বলল, কি সিন ক্রিয়েটটাই করল শমীক সেদিন কফি হাউসে । সারারাত বালিশে মুখ গঁংউজে কেঁদেছে মেয়েটা । একবারের জন্যেও মাথা তোলাতে পারি নি ; কি অমানুষ শমীকটা, মুখের ওপর বলে কি, ভুল কি মানুষে করেনা ? তোমাকে ভালোবাসা দেখিয়ে ভুল করেছি আমি ! কি ভাষা ! বুলবুলের মুখ দেখানোর আর জায়গা রেখেছে ? তুই চলে যা প্লিজ, আমার আর সহ্য হচ্ছে না ।

    একটানা কথা বলে হাঁফাচ্ছিল তনুদি । আমার মনে হচ্ছিল মাথার ভিতরটা জমে শক্ত হয়ে গেছে ; কোনো রকম অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতাই লোপ পেয়েছিল । অবাক হচ্ছিস নিশ্চয়ই ? মুসলমানই বুলিদি' । ওর পুরো নাম বুলবুল রহমান । কিন্তু সেটা তো আমার জানাই ছিল । জানতাম না শুধু দাদার বুলিদি'কে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা ! যন্ত্রের মতো হেঁটে বেরিয়ে এলাম হস্টেল থেকে । আসার সময় বুলিদি'র ঘরের জানলার ঠিক নিচে চোখ পড়ল । অপরাজিতার ঝাড়টায় আর গাঁদা গাছগুলোয় ফুল এসেছে । স্বপ্নের রঙ বুঝি এমন গভীর নীল হয় ! গাঁদার লালচে -- হলুদাভায় সায়াহ্নের রোদ দুলছে অল্প হাওয়ার টানে । আগাছা পরিষ্কার করে চারাগুলো লাগিয়েছিল বুলিদি । বলেছিল, আমি এই ঘরটায় থাকি কিংবা না থাকি, ওরা আমার হাতের ছোঁয়া নিয়ে বেড়ে উঠবে । স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত বুলিদি, ওর স্বপ্ন সত্যি হল না । আমার মনে হল, ও দুই সপ্তাহের জন্যে যায় নি, আর কখনো ফিরবে না বলেই গেছে ।

    দিন কয়েক পর দিল্লী থেকে ফিরে দাদা এল আমাদের বাড়িতে । বাড়ির পরিবেশ দেখে কিছুটা অনুমান করে নিয়ে থাকবে । আসলে কারোরই তো মন ভালো ছিল না । বুলিদি'কে আমার মতো করেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন বাবা মা । দাদা যদি ওকে বিয়ে করতে চাইত, জেঠুর অমত সত্ত্বেও বাবা -- মা'র পূর্ণ সমর্থন পেত ও । ওঁরা কোনোদিনই জাতপাত কিংবা ধর্মের বিভেদে বিশ্বাসী নন । তাই, দাদার এ হেন মন্তব্য ওঁংএদর কষ্ট দিয়েছিল যদিও কিছুই বলেন নি । যতই আপন হোক, কিছু কথা বুঝি নিজের সন্তান ছাড়া আর কাউকে বলা যায় না । আমার ঘরে বসে আছি দু'জনে । উত্তরের জানলায় এক টুকরো ধূসর আকাশ গেঁথে আছে ছবির মতো; ক্যানভাস জুড়ে নিমগাছের ডালপালা অল্প দুলছে চোরা হাওয়ায় । কেউ কোনো কথা বলছি না ।
    -- কথা বলবি না ? অনেকক্ষণ পর কেমন কঠিন মুখে প্রশ্নটা করল দাদা । মনে হল, আমার প্রশ্নটা কি হবে সেটা ও জানে, এবং উত্তরটাও
    আগে থেকেই ঠিক আছে ।
    -- তুই বল, আমি শুনি ।
    -- কি বলব ?
    -- কি হচ্ছে এ'সব ? তোর আর বুলিদি'র মধ্যে কি হয়েছে ?
    -- হয়নি তো কিছু ।

    এমন নির্বিকার মুখ করে বলল দাদা, রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল আমার ।
    -- তার মানে সেদিন তনুদি' যা বলল, সেসব সত্যি ?
    -- তনু'র সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল ?
    -- ওদের হস্টেলে গেছিলাম ।
    -- কি বলেছে তনু ?
    -- বলেছে যে তুই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও পিছিয়ে গেছিস, কফি হাউসে সকলের সামনে অপমান করেছিস বুলিদি'কে । -- বিয়ের প্রস্তাব আমি দিইনি । ওই বলেছিল কথাটা । আমি হঁযা বা না কিছুই বলিনি, চুপ করে ছিলাম । পরে ভাবতে গিয়ে দেখেছি যে এটা অসম্ভব ! তাই বুলি'র কাছে ক্ষমাও চেয়েছি আমি । কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না । কেবলই বলে, আমি শুধু ওর সঙ্গে থাকলেই নাকি ওর আর কোনো ভয় নেই । আর তোর নেই, নেই, আমার তো আছে । আমার পরিবার-পরিজন সব বিসর্জন দেব নাকি আমি ওর জন্যে ? তাই, কফি হাউসে সকলের সামনে ঐ রকম হুট করে 'শমীককে বিয়ে করছি' বলতে শুনে রাগ হয়ে গেছিল আমার ।
    -- পরিবার তো ভাঙে-গড়ে । এই খেলার মধ্যে দিয়েই জীবনের রূপরেখা বদলায় । তাছাড়া, সে ভাবনাটা না হয় পরে ভাবতিস । এত রাগ হল যে ধর্ম নিয়ে কথা বলবি ?
    -- ভুল তো বলিনি । আমাদের সমাজে এই ব্যাপারটা কতখানি অসম্ভব এখনো পর্যন্ত বল তো ? কফি হাউসে সেদিন সবাই হঠাৎ বুলিকে সাপোর্ট করতে আরম্ভ করল । মৈনাক শালা বলে কিনা, তোর ওকে বিয়ে করা উচিত শমীক, এতদিন একসঙ্গে ঘুরে শেষে -- ; ভাব একবার । চড়াৎ করে রক্ত উঠে গেল আমার মাথায় । আমি কাকে বিয়ে করব না করব তুই বলে দিবি নাকি ?
    -- তাহলে ওর সঙ্গে ঘুরলি কেন তুই ? মৈনাকদা' তো ভুল বলেনি । প্রেম বিষয়টা কি ঘোরাঘুরিতে শুরু হয়ে সেখানেই শেষ নাকি ? এ'সব তো তোর আগে ভাবা উচিত ছিল । আর অসম্ভবের কথাই যদি বলিস, অনেকেই আজকাল অন্য ধর্মে বিয়ে করছেন । অনীশদা'ও তো করেছেন ।
    -- অনীশদা'র কথা ছাড়, তিনকূলে কেউ নেই । আমার তো তা নয় ।
    -- তোর ভয়টা আসলে কিসের বলতো ? জেঠুকে না অন্য কিছুর ?
    -- ভয় আমি কাউকে পাই না । তবে বাবার স্বাস্থ্যের কথাটা তো ভাবতেই হয় ।
    -- বাজে বকিস না । তুই যখন জবরদস্তি ডাক্তারির পরীক্ষাগুলো দিচ্ছিলি, তখন তো জেঠুর বেশি শরীর খারাপ হয়েছিল । উনি তো চান নি যে তুই ওই লাইনে যাস । তখন তো ওঁর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে পিছিয়ে যাস নি ? ভয় অবশ্যই পাস । আমার প্রশ্ন, সেটা কিসের ?
    -- না, পাই না । যেটাকে তুই ভয় বলে ভুল ভাবছিস, সেটা আসলে ব্যক্তিবিশেষের জীবনে বোধের প্রাধান্য ; কে কোনো বিষয়টাকে কতটা প্রাধান্য দেয় । আমি আমার ধর্ম, আমার সমাজকে প্রাধান্য দিই । আমি হিন্দু, সেটা আমার পরিচয় । হিন্দু সমাজের অংশ আমি । ধর্ম বাদ দিয়ে মানুষের পরিচয় হয় নাকি ?
    -- না, হয় না । কিন্তু, ধর্মের ব্যাখ্যাটা কি বল তো ?
    -- মানে ?
    -- মানে, ধর্ম বলতে তুই কি বুঝিস ?
    -- তোর সঙ্গে কি এখন দর্শন আলোচনা করতে হবে নাকি ?
    -- দর্শন আর ধর্ম দুটো আলাদা বিষয় । আমি ভেবেছিলাম তুই কোন পূজায় অঞ্জলি দিতে ভুলিস না, নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে জাহির করিস, সুতরাং এইটুকু অন্তত: জানবি ।
    -- ধর্ম মানে এই যা দেখি চারপাশে, পূজা-পাঠ ইত্যাদি ।
    -- পূজা-পাঠ, মন্দির-মসজিদ, বিশেষ তিথির উপবাস -- এই সব কিসের জন্যে ?
    -- ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে ।
    -- ঈশ্বর কি বা কে ?
    -- কে মানে ? যাঁদের আমরা পূজা করি --
    -- এটা খুব স্থূল উত্তর । তোর নিজের ভাবনায় ঈশ্বর কি ?
    -- এসব ফালতু কথা ভাবার সময় আছে আমার ?
    -- তুই ভাবিস নি বলেই কথাটা ফালতু হয়ে যায় না । আমার কাছে ঈশ্বর একটা পবিত্রতম অনূভূতি ; যাঁর ওপর নি:সঙ্কোচে ভরসা করা যায়, যাঁকে জীবন্ত বলে কল্পনা করে অনায়াসে অতি কাছের করে নেওয়া যায়, যাঁকে ভয় পাই না বরং ভালোবাসি, এবং যাঁর কাছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের একই মূল্য, তিনিই ঈশ্বর । তাঁর অনেকগুলো নাম; কখনও শিব, কখনো বিষ্ণু, কোথাও তিনি যীশু, কারুর কাছে আল্লা । আলোর বিন্দু একটাই । মানুষের চিন্তায় সেই বিন্দুর প্রতিফলন এই সমস্ত নাম এবং ধর্ম ।
    -- তাহলে তো আদপে ধর্মের অস্তিত্বই অর্থহীন ।
    -- না তো ; মানুষ নিজের মতো করে অজানাকে ছঁংউতে চায় । তাই, মত তো কিছু থাকতেই হবে, আছেও । এক্ষেত্রে সেটা অনেক । মূল বিষয় হল যে, কারুর মতটাই অর্থহীন নয় এবং আলাদা মতে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে মানুষের প্রকৃতিও আলাদা নয় । মানুষ মানুষই । ধর্মভিত্তিক সমাজ পরস্পরকে অগ্নিবন্ধনে বাঁধতে পারে না, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নই আমি । এই তত্ত্বের কোনো যুক্তিও দেখি না ।
    -- এত লোক মরছে দেশে মুসলমানদের জন্যে, তবুও এই সব বলছিস ?
    -- এটা বলতে পারলি তুই ? মুসলমানরা মরছে না ? বাবরি মসজিদের ঘটনাটার পর থেকেই তো সব শুরু হয়েছে ।
    -- ওদের এখানে থাকতে কে বলেছে ? চলেও তো যেতে পারে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে এখানে যখন এত অত্যাচার হচ্ছে । আর, একটা মসজিদ ভাঙা হয়েছে তো কি এমন হল ? ওখানে যখন রামের ওপর ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া গেছে --
    -- ঐতিহাসিক তথ্য ? রাম বলে কেউ কোনোকালে ছিল কি না, সন্দেহ আছে । তাহলে তো পৃথিবীর যাবতীয় মহাকাব্যের প্রতিটি চরিত্রই বাস্তব বলে মেনে নিতে হয় । আর, ওরা কেন অন্য কোথাও যাবে ? আমরা কি মরে গেছি যে নিজের দেশের মাটি ভাগ করে নিতে পারব না একসঙ্গে ? এটা ওদেরও দেশ, কেন যাবে ওরা ?
    -- কি বলছিস তুই ?
    -- ভুল বলছি নাকি ?
    -- এত করসেবক মরল ...
    -- কে মরতে বলেছিল ওদের ? আর, তার আগে যে পাড়া-প্রতিবেশিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বাড়ি থেকে টেনে বার করে এনে জীবন্ত পুড়িয়ে, খঁংউচিয়ে মারল, শিশুদেরও ছাড়ল না, সেটা তো দেখছিস না ? এরা কি মানুষ ? এরা যে ধর্মকে মেনে চলে, সেই ধর্মের ছাপ জন্মসূত্রে আমার পরিচয় বলে ঘৃণা হয় আমার নিজের উপর, এই মেরুদণ্ডহীন সমাজের উপর । তাছাড়া, তোর যদি এত বিতৃষ্ণা মুসলিম সমাজের উপর, তুই কেন বুলিদি'র সঙ্গে মেলামেশা করলি ?
    -- করেছি ওকে ভালো লাগত বলে । কিন্তু, আমি তো বিয়ে করব বলে মিথ্যা ভড়ং দেখাইনি । পরিষ্কার বলে দিয়েছি যে বিয়ে করতে পারব না ।
    -- অবশ্যই বলেছিস, কিন্তু নিজে আনন্দ করার পরে, যখন আর একটা মানুষের খুশীর দায়িত্বটুকু কাঁধে তুলে নেওয়ার সময় হয়েছে তখন । কবে থেকে এত স্বার্থপর হয়ে গেলি তুই ?

    আমার কথা শুনে এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল দাদা যেন আমাকে চেনে না, দেখেইনি কোনোদিন ! একটাও তো সঠিক যুক্তি দিতে পারেনি এ পর্যন্ত, এবার নিজের ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে লুকাতে না পেরে পালিয়েই গেল । যাবার আগে কি বলে গেল জানিস ? -- তুই যাই বলিস আর ভাবিস, একটা মুসলিম মেয়েকে নিজের ঘরে ঠাঁই দিতে পারব না আমি । বুলবুলের সঙ্গে মেশা আমার উচিত হয় নি, নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি ।

    খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন । হওয়া উচিত ছিল না জানি । কিন্তু, সেই মুহূর্তে বুঝলাম যে আমাদের সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকবে না কোনোভাবেই । ওর দ্বিচারিতা দেখে, নিজের শিক্ষা -- দীক্ষার প্রতি ওর নির্লজ্জ অসম্মান প্রদর্শনের বহর দেখে, এবং সর্বোপরি ওর কাপুরুষতা দেখেও কি করে আগের মতোই ভালোবাসব ওকে ? ও হিন্দু বলে যে মেয়েটা ওকে দূরে সরিয়ে রাখেনি, তাকে শুধু ধর্মের কারণে এত নোংরা ভাবে ছোটো করতে ওর বাধল না ? বুলিদি'কে ছোটো করতে গিয়ে যে ও নিজেই কত ছোটো হয়ে গেল, সেটাও একটু বুঝল না ? রাখী পরিয়ে, ভাইফোঁটা দিয়ে এতকাল ধরে যার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করে এসেছি, তার প্রতি ঘৃণায়, বিদ্বেষে ভরে গেল মনটা । ভাইয়ের প্রতি ভালবাসাটা একটা ঝড়ের ধাক্কায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল, মনের ভিতর তার আর রেশমাত্রও খঁংউজে পেলাম না । বুঝতে পারলাম ওকে যে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম, তা ছিঁড়ে কুটিপাটি হয়ে গেছে । এত ছোটো মনের মানুষকে দাদা বলে মেনে নিতে পারব না আর কখনও । রক্তমাংসের বৈজ্ঞানিক হিসাবে ও মানুষ; কিন্তু, মনুষ্যত্বের বিচারেও কি ও মানুষ ?

    তুই হয়তো ভাবছিস যে তোকে এত কথা বললাম কেন হঠাৎ । বললাম, কারণ তুই ওকে নিজের দাদার মতো দেখিস, সব বিষয়ে ওর পরামর্শ নিতে আসিস । আমিও নিতাম আগে; এই ঘটনার পর থেকে সম্পর্কটা শুকিয়ে গেছে অনেকটাই । যাইহোক, আমার আর তোর মেলামেশার বয়সকালও কিছু কম হল না । বছরখানেক সময়টা আদপে তেমন কিছু না হলেও আসলে অনেকখানিই । ইদানীং, একটা ব্যাপার বেশ ভাবাচ্ছে আমায় । তোকে আজকাল অনেক সময়ই মেঘার সঙ্গে দেখতে পাওয়া যায় । অনেকেই দেখেছে । শৌভিকও সেদিন বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মুখে দেখা হতে এ'কথা সে'কথার পর জিজ্ঞাসা করল,
    -- কি রে, মেঘার খবর কি ? কি করছে আজকাল ?
    -- মেঘা তো দিল্লীতে ।
    -- দিল্লীতেই বটে । পরশুও দেখলাম ও আর প্রাঞ্জল গড়িয়াহাটে ফুচকা খাচ্ছে । কালে কালে কত দেখব মা ! একবিংশ শতকের বিবর্তনে ছেলেরাও আজকাল ফুচকা খায় ! এইসব বলেটলে একগাল হাসতে গিয়েও পারল না বোধহয় আমার মুখ দেখেই । ও ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে যে মেঘার দিল্লী থেকে ফেরার খবরটা আমি জানি না । জানলে কিছুতেই বলত না এইভাবে, বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে মজা দেখার মানসিকতা ওর কোনো কালেই ছিল না । বলেও ফেলল সেটা ।
    -- তুই জানতি না ? আমি তো জানতাম না আসলে.. মানে তুই, প্রাঞ্জল আর মেঘা সব সময় --
    -- না, জানতাম না । আসি রে, একদিন আয় বাড়িতে নয়তো ফোন করিস । আজ চলি, দেরী হয়ে যাচ্ছে ।
    ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আবোলতাবোল বলে কেটে পড়লাম ওখান থেকে । কি করব ? মেঘা আমার ছোটোবেলার বন্ধু । দিল্লীতে পড়তে গেছে বছর দেড়েক হয়েছে । এর মধ্যে একবারও এই রকম হয়নি যে ও কলকাতায় এসেছে, আর নিজের বাড়িতে পা রেখেই আমাকে ফোন করে নি । এত ব্যস্ততার মধ্যেও মাসে দশখানা করে চিঠি লিখতে ভুলত না । গত মাস ছয়েক ধরেই ওর চিঠি আসা কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । এবার এসে আমাকে খবরও দিল না, আমি ভাবতে পারছি না । তোকে আর কি বলব ! তোকে জিজ্ঞাসা করতেও খারাপ লাগছে খুব, অপমান বোধ হচ্ছে, তবু বলি, তোদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকলে আমাকে জানালি না কেন ? এতদিন আমার সঙ্গে মিশেও চিনতে পারিস নি ? আমি জোর করে কাছে আসায় বিশ্বাসী নই রে । ভালবাসা বিষয়টা ভীষণ সহজ, স্বচ্ছন্দ; হৃত্স্পন্দনের মতো । ভালোবাসলে অধিকারবোধ আসে সত্যিই ; কিন্তু একতরফা অধিকারবোধের জোরে কাছে আসা যায় না । তাই, কষ্ট হলেও আমি আটকাতাম না তোদের । কিন্তু, এইভাবে গল্পটা এগোনোতে আমার শুধু ভয় হচ্ছে যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে না তো ? দাদা যা করেছিল বুলিদি'র সঙ্গে, তুইও মেঘার সঙ্গে সেটাই করতে যাচ্ছিস না তো ? বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে ওদের পাড়ায় এত উত্তাল হাঙ্গামা হয়েছিল, যে মা' ওকে আমাদের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন । ওদের পাড়াটার মতো মিশ্র সমাজ নয় আমাদের এখানে । তাছাড়া, এ পাড়ার লোকের অত সময় নেই পরের বাড়িতে উঁংইক দেওয়ার ; যে যার নিজের ফ্ল্যাটে ব্যস্ত । মেঘা সে'কদিন ভালো করে খায়নি, ঘুমায়নি, ঘুমালেই বারবার চিত্কার করে জেগে উঠত রাতে দূ:স্বপ্ন দেখে । নিজের বাড়ির জানলা থেকে ওদের গলির মোড়ের পানের দোকানী ভুবনচাচাকে গলার শিরা কেটে খুন হতে দেখেছিল তো । হিন্দু ভুবনকাকা মেঘার কাছে হয়ে গেছিলেন ভুবনচাচা ; বড় নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন । ভাবতে পারেননি যে কেউ তাঁর গায়ে হাত তুলবে । ভুল ভেবেছিলেন, কিন্তু ভুল শোধরানোর আর সময় ছিল না । দোকান থেকে টেনে নামিয়ে সুপারি কাটার জাঁতি দিয়েই গলার নলি কেটে দিয়েছিল বস্তির মানুষগুলো । এর শোধ নিতে সেই রাত্রেই বস্তির এগারোটা বাড়ি পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যায়, পুড়ে মরেছিল আমিনা আর ওর বাচ্চাটা । আমিনা বড় গরীব ছিল, ওর বর নিত না ওকে । বাচ্চাটাকে নিয়ে একা থাকত । লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে খেত । মসজিদের আগুন ওকেও খেল । এইরকম আরো অনেক আমিনা, ভুবনচাচারা মরেছিলেন সেই আগুনে । এইসব ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে মেঘা প্রবল মানসিক আঘাত পেয়েছিল । কিছুতেই ফিরে যেতে পারে নি পুরানো বাসায় । আমাদের সঙ্গে যে ক'দিন ছিল, বেশির ভাগ সময়টাই নামাজ পড়ত । মাথায় দোপাট্টা জড়িয়ে হাত দুটো খোলা বইয়ের মতো সামনে জড়ো করে যখন ও নামাজ পড়ত, কি সুন্দর লাগত ওকে দেখতে, তোকে কি বলব । এমনিতেই মুসলিম মেয়েরা খুব সুন্দরী হয় দেখেছি । মেঘার তখন আরো ফুটফুটে রঙ ছিল । রক্তারক্তি কমে আসার পর, ওর বাবা -- মা' বাসা বদলে দুই -- তিন সপ্তাহ পর ওকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান । সেই মেঘার সঙ্গে মিশছিস তুই । কি সম্পর্কের ভিত্তিতে মিশছিস জানি না, কিন্তু লুকিয়ে মিশছিস যখন, তখন অনুমান করে নিতে কষ্ট হচ্ছে না যে লুকানোর মতো কিছু একটা আছে । তোকে শুধু অনুরোধ যে, দাদা যা করেছিল তুই সেই ভুলটাই করিস না । মেঘাকে সেই একই ভাবে আঘাত দিস না । যদি ভাললেগে থাকে, তবে সহজেই ভালবাসতে পারবি; আর, ভালোবাসলে স্বীকার করার ক্ষমতা রাখিস । আমাকে যেন কখনও ভাবতে না হয় যে আমি কোনো পলায়নপরকে ভালোবেসেছি । নিজের কাছে নিজেকে ছোটো হতে দিস না কখনও, অন্যের কাছেও না ।

    লিখিস তোর দিন কেমন কাটছে । আমার দিনগুলো আলতো পায়ে পেরিয়ে যায় সময় -- অসময় । আর, শুকিয়ে যাওয়ার আগেই নি:শব্দে শান্তির শীতঘুমে ঢুকে পড়ে । আমার প্রতিটি বিগত দিন তাই এক-একটা অদৃশ্য ঠাণ্ডা হিমের গোলক, যার ভিতর উষ্ণ ওম জুড়ে আমার যাবতীয় স্মৃতিবিস্মৃতি । ওরা আমার চারপাশে হাওয়ায় ওড়ে, ওড়ে আমার ঘরের ভিতরেবাইরে, আমার স্থায়ীত্বের অণুতন্তুতে । হাত বাড়াই । ভিজে মুঠি আলগা হয়ে এলে দেখি কেউ কোথ্থাও নেই, শুধু তরল শিশির তালু থেকে আঙুলে গড়িয়ে যায় । যাইহোক, ভালো থাকিস । সকলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিকরিস না ; কারণ, সব পরিচিতিই সম্পর্কের সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত হয় না । তাই, যে ক'টা সম্পর্ক তৈরি করবি, সেগুলোর বিষয়ে যত্নবান হোস ।

    ইতি- --
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments