রাজপুত্র প্রণাম ক'রে নম্রমধুর স্বরে বললেন - আমায় স্মরণ করেছেন মহারাজ?
রাজা বাম করতলে কপোল ন্যস্ত ক'রে একটি ময়ূরাকৃতি বেদিকায় বসেছিলেন অলিন্দে। শ্বেতশুভ্র প্রাসাদের চতুর্দিক মনোরম উপবনে স্বপ্নময়। উপবনের প্রান্ত অতিক্রম ক'রে তাঁর চিন্তাকুল দৃষ্টি প্রসারিত সুদূর উত্তরে। যেখানে ঘননীল পর্বতমালার শিরে আসন্নবর্ষণ মেঘকুমারীরা তাদের মঙ্গলকলসগুলি উজাড় ক'রে দিতে নত হয়ে এসেছে। রাজপুত্রের প্রশ্নে সংবিৎ পেয়ে ফিরে তাকালেন। দৃষ্টি বিষণ্ণতার মধ্যেও প্রসন্ন হয়ে উঠলো। স্নিগ্ধ স্বরে বললেন - এসো কুমার! তোমারই প্রতীক্ষায় আছি।
ময়ূরবেদিকার দুই পাশে দুটি শিশু ময়ূর-বেদী। রাজা বললেন - আসন গ্রহণ করো।
কুমার বাম পাশের ময়ূরশিশুর পিঠে ব'সে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন। রাজা কয়েকমুহূর্ত পুর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন পুত্রের মুখে।
- কুমার! তোমার শাস্ত্র ও শস্ত্র শিক্ষা দুই-ই তো সম্পূর্ণ হয়েছে, তাই না?
কুমার সলজ্জ নম্রতায় বললেন - হ্যাঁ পিতা! বিগত পূর্ণিমাতেই তো আচার্যকুল আপনাকে সেকথা নিবেদন করেছেন।
- কিন্তু শাস্ত্র বা শস্ত্র, কোনোটারই তো পরীক্ষার এখনো অবকাশ হয়নি, তাই না!
কুমার সবিনয়ে বললেন - পরবর্তী পূর্ণিমায় হবে, আচার্যগণ এমন আভাসই দিয়েছেন।
রাজা কুমারের মুখ থেকে দৃষ্টি সরালেন না - কুমার! যদি তার আগেই পরীক্ষা দিতে হয়! যদি পরীক্ষার পরমলগ্ন এসে গিয়ে থাকে!
কুমার বললেন - যদি মহারাজের সেইরকমই ইচ্ছা এবং আদেশ হয়, তাই হবে। আপনি তো শুধুমাত্র আমার পিতা নন, এই রাজ্যের অধিরাজ। আপনার আদেশ অবশ্যপালনীয়। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণেই কি মহারাজ আজ ব্রাহ্মমুহূর্তে আমায় স্মরণ করেছেন?
রাজা ধীরস্বরে বললেন - তোমার অনুমান অভ্রান্ত।
কুমার একমুহূর্ত চুপ ক'রে পিতার মুখে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন - ধৃষ্টতা মার্জনা ক'রে যদি একটি প্রশ্নের উত্তর দেন।
রাজা বললেন - বলো!
- মহারাজকে আমি ইতিপূর্বে কোনো কারণে কখনো অধীর হতে দেখিনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, বুঝিবা এই প্রথম, মহারাজ চঞ্চল হয়েছেন। এর কারণ জানতে পারি কি?
- পারো। তুমি ইতিপূর্বে বলেছিলে না- আমি শুধুমাত্র তোমার পিতা নই, এই রাজ্যের অধিরাজ, তাই আমার আদেশ অবশ্য পালনীয়! যথাযথ হয়েছে। অপরদিকে আমি শুধু এই রাজ্যের অধিপতি নই, তোমার পিতাও বটে। তাই আজ আমি চঞ্চলই শুধু নয়, ব্যাকুল।
বিস্ময়াবিষ্ট কুমার বললেন - মহারাজ! আমায় অনুগ্রহ ক'রে সব খুলে বলুন। আমি আপনার এমন কী মনোকষ্টের কারণ হলাম, কীভাবে হলাম - তা জানতে আমি উৎসুক।
মহারাজ বললেন - আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে সুদূর উত্তরে ঐ যে মেঘমুকুট পর্বতমালা নীলবর্ণ বিভ্রম সৃষ্টি করছে, তাকে লক্ষ্য ক'রে দেখেছো কোনো দিন?
রাজপুত্র সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ক'রে রইলেন কয়েকমুহূর্ত। তারপর বললেন - ইতিপূর্বে বহুবার তার সুগম্ভীর শোভা নয়নকে তৃপ্তি দিয়েছে। কিন্তু আজ বিশেষভাবে লক্ষ্য করছি।
- ঐ পর্বতমালাই আমার কাহিনীর পটভূমি। ঐ পর্বতশ্রেণীর শীর্ষদেশ বৎসরের অধিকাংশ সময়ই নানাবর্ণ মেঘে আবৃত থাকে। পর্বতের নিম্নদেশ ঘোর অরণ্যে আচ্ছন্ন। পর্বতের সানুদেশে আছে দানবপুরী। পর্বতনিম্নে অরণ্য যেখানে শেষ পর্বে থমকে দাঁড়িয়েছে, তার সীমানায় এক স্রোতস্বিণী নদী। নদীর এপারে মহারাজ পদ্মনাভের রাজত্ব - পদ্মনাভপুর। পদ্মনাভপুর অতি সুন্দর রাজ্য। মহারাজ পদ্মনাভ নৃপতিশ্রেষ্ঠ। সেই রাজ্যের রাজকন্যার নাম - কমলিনী।
মহারাজের মুখে একখানি স্নিগ্ধ হাসি দেখা দিয়েই বিষণ্ণ গাম্ভীর্যে বিলীন হয়ে গেল - এই কমলিনীর তোমার সঙ্গে বিবাহ হবে, আমি ও মহারাজ পদ্মনাভ কমলিনীর কৈশোর উপস্থিত হতেই এই সিদ্ধান্ত নিই। তুমি তখন পূর্ণ মনোযোগে শস্ত্র ও শাস্ত্র শিক্ষা ক'রে চলেছো। এদিকে কমলিনীও সিদ্ধান্ত নেয় - চতুঃষষ্টী কলায় পারদর্শিনী না হয়ে সে বিবাহ করবে না। আমরা উভয় পিতা গণনা ক'রে দেখি যে তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার দুই পক্ষকাল পরেই কমলিনীর পাঠগ্রহণও পূর্ণ হবে। অতঃপর দুই রাজ্য উৎসবে মুখর হয়ে উঠবে - এই রকমই ছিল আমাদের অভিলাষ। যথা নিয়মে ঋতুচক্র আবর্তিত হতে হতে আজ সে সময় আগতপ্রায়। আর সপ্তদিবস পরে যে পূর্ণিমা, তাতে তোমার পরীক্ষা এবং কমলিনীর পাঠ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা। এ পর্যন্ত সবই ভারি সুশৃঙ্খলায় কাটছিল। কিন্তু আজই ঊষাকালে পদ্মনাভপুরের দূত এসে পৌঁছেছে বিশেষ বার্তা নিয়ে।
রাজা এক মুহূর্ত থামলেন। গভীর দৃষ্টিতে রাজপুত্রের উৎসুক করুণ মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীরলয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলেন - কুমার! তোমার বাগদত্তা বিপন্না। - ব'লে একখানি বিচিত্র লিপি এগিয়ে দিলেন কুমারের দিকে।
কুমার ত্বরিতবেগে লিপিখানি বিস্তৃত ক'রে ধরলেন। লিপি এইরকম -
রাজনন্দিনী কমলিনীকে নিয়ে গেলাম। যদি সাহস থাকে, থাকে মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা, বোধ; অনঙ্গদেবনন্দন কুমার সপ্তাশ্ববাহন যেন তাঁকে উদ্ধার করতে একাকী আসেন।। - দানবাধিপতি বজ্র
-লিপিখানি কমলিনীর শয়নমন্দিরে পাওয়া গিয়েছে। গত রজনীর প্রথম যামে। মহারাজ পদ্মনাভ ইতিকর্তব্য স্থির করার জন্য লিপিখানি আমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমি দূতকে বিশ্রাম করতে পাঠিয়ে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি ছৌবারিককে দিয়ে। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবিদ্যা। বলো, এ বিষয়ে তোমার কী মত?
যতক্ষণ অনঙ্গদেব মুখর ছিলেন, কুমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লিপিখানি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাঁর তরুণ প্রশস্ত ললাটে ক্ষণেক্ষণে বিস্ময় ও সংশয়ের মেঘ-রৌদ্র খেলা করছিল। মহারাজ নীরব হলে তিনি মুখ তুললেন। তাঁর অবয়ব আত্মপ্রত্যয় এবং দর্পে দীপ্ত হয়ে উঠেছে - মহারাজ! ক্ষত্রিয়তনয়কে আপনি নিশ্চয়ই এ কথা জানার জন্য আহ্বান করেননি যে সে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান স্বীকার করতে পশ্চাৎপদ কিনা? তাহলে সে কথার অবতারনা না ক'রে আমি সবিনয়ে যাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করি।
মহারাজের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো - কুমার! নিজের সন্তান হলেও তুমি রাজপুত্র। তুমি জানো নৃপতিরা শ্রবণযন্ত্র দিয়ে দর্শন করেন। ইতিপূর্বে আচার্যকুলের মুখে তোমার ধীশক্তির বিষয়ে বহু উচ্চমানের কথা শুনেছি। আজ এই মুহূর্তে তার কিছু প্রত্যক্ষ পরিচয় পেতে চাই। এই ঘটনা, এই লিপি পর্যালোচনা ক'রে তুমি কী পেলে, আমি জানতে উৎসুক।
কুমার বললেন - আচার্যেরা মহারাজের কাছে কী বলেছেন জানা নেই। কিন্তু আমার যে কথা অহরহ তাঁদের কাছে শুনতে হয়েছে, তা হলো - অন্যান্য বিষয়ে মোটামুটি সাফল্য লাভ করলেও ধনুর্বিদ্যায় এবং ধীশক্তিতে মহারাজ অনঙ্গদেব এবং নৃত্যে ও ধীশক্তিতে মহারাণী নীলিমাদেবীর যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে হলে আমার উচিত দীক্ষান্ত পরবর্তী সময়ে স্বয়ং তাঁদের কাছে ঐ বিষয়ের শিক্ষাগ্রহণ করা।
অনঙ্গদেব স্বাভাবিক স্থৈর্য্যে মৃদু হাসলেন - তাহলে দীক্ষা শেষের অনুষ্ঠানের আগেই তা শুরু হয়ে যাক। বল।
লিপিখানি বিস্তৃত ক'রে কুমার বললেন - মহারাজ! শৈশবাবধি শুনে আসছি - রাক্ষস, দৈত্য এবং দানবেরা বনচারী, অনাচারী, নরমাংসভোজী, কদাকার নিম্নবর্গের প্রাণী। এই লিপি সেই ধারণায় বিপুল আলোড়ন তোলে। অতি সূক্ষ্ম নেত লিপির আধার। সুনিপুণ সুসভ্য শিল্পী ভিন্ন এইরকম পট্টবস্ত্র বয়ন অসম্ভব। 'দানবাধিপতি বজ্র' কথাদুটি রক্তাক্ষরে লেখা। মনে হতে পারে লেখনী রক্তরঞ্জিত করে লেখা হয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে এর জন্য লাক্ষারস বা ঐ জাতীয় কিছু ব্যবহৃত হয়েছে।কারণ স্বাক্ষর অংশটুকু বাদে মূল লিপির বর্ণসমূহ হরিতাভ। যদি কেউ রক্তরঞ্জিত লিপি লিখতে চায়, তার পক্ষে তো সম্পূর্ণ লিপিটিই একভাবে লিখে যাওয়ার কথা। তা যখন হয়নি, রক্তবর্ণ মসীর বর্ণটুকুই রক্ত। অর্থাৎ লিপিকর শৌখীন বটে। এ ভিন্ন আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে মহারাজ অনঙ্গদেব আর মহারাণী নীলিমা ব্যতীত আর কারো এমন মুক্তাক্ষর দেখিনি। লিপিকর অসাধারণ সুঅধীতী। এর একটিও প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মেলেনা। আর, আশ্চর্য লিপির পৃষ্ঠাপট! অতি সূক্ষ্ম রেখায়, সুনিপুণ দক্ষতায়, আকাশনীল পটভূমিতে ধূসরনীল ঐ পর্বতমালা, তার মেঘমুকুট, অরণ্যমেখলা আরুপাদবেষ্টনকারিণী তটিনী যেন দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। আমি নিশ্চিত যে এই লিপিখানির লিপিকর, চিত্রকরও সেই। রেখার বিন্যাস, বর্ণের ব্যবহার - সব একই মনোভূমির সৃজন।
- কুমার! রাজার কণ্ঠ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। আমি স্বীকার, স্বীকার নয় - ঘোষণা করছি যে তোমার পিতা হিসাবে আমি গর্বিত।
- এবং মাতা হিসাবে আমি - মহারাণী নীলিমা রাজা এবং রাজপুত্রের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। রাজা সচকিতে বললেন - মহারাণী, তুমি !
নীলিমা মধুর স্বরে বললেন - মহারাজ কি বিস্মৃত হয়েছেন যে আমি প্রতিদিন রাত্রে গন্ধর্ববিদ্যায় অগ্রসর প্রজাকুমারীদের নিজে বিদ্যাদানের গুরুপরিশ্রম সত্ত্বেও ব্রাহ্মমুহূর্তে মহারাজ শয্যাত্যাগ করার পর-পরি শয্যাত্যাগ করি। আজ যখন ঊষার প্রথম বিহঙ্গকাকলির সঙ্গে শয়নমন্দিরের রুদ্ধদ্বারের অপরপ্রান্ত হতে মৃদুস্বরে গূঢ় সাংকেতিক ধ্বনি শোনা গেল, মহারাজের সঙ্গে আমিও সেই ধ্বনিতে জাগরিত হই। মহারাজ নিঃশব্দে শয্যাত্যাগ করে উঠে গেলেন, আমি স্থির হয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে লাগলাম। আমি শুধু মহারাজের গৃহলক্ষ্মী নই, রাজ্যলক্ষ্মীরও প্রতিনিধি; সর্ববিষয়ে অবহিত থাকা আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে - একথা স্বয়ং মহারাজের মুখে বারংবার শুনেছি। লক্ষণ মিলিয়ে দেখলাম - মহারাজ বহির্ভাগেই প্রক্ষালন সেরে নিয়েছেন এবং অলিন্দেই অবস্থান করছেন। আমিও নিঃশব্দে প্রস্তুত হয়ে এসে দেখি কুমার পিতৃপদে প্রণত হচ্ছে। বিষয় গুরুতর বুঝে বিস্মিত হয়ে দ্বারপ্রান্তেই দাঁড়িয়ে পড়ি এবং সমস্ত কিছু ছায়ানাটিকার মতো ঘটে যেতে দেখি-শুনি। কিন্তু কুমার! - সস্নেহে বাম হাতখানি কুমারের ললাটে রাখলেন রাণী - তোমার বিশ্লেষণ শুনে আত্মসংবরণ করতে পারলাম না। আমিও তো শুধুই রাণী নই, জননীও বটে।
রাজা লজ্জিত স্বরে বললেন - রাণী! সেই কারণেই আমি চাইনি অরুনোদয়ের পূর্বেই এমন বিপদসংকুল বার্তা তোমায় উদ্ভ্রান্ত করে তুলুক।
রাণীর মুখে মহিমার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়লো - মহারাজ! অপরপক্ষে আমিও শুধুই জননী নই, এই রাজ্যের মহারাণী। বার্তার যে অংশে বিপদ তাতে আমার মাতৃহৃদয় বিচলিত হতো কিনা জানি না কারণ বার্তার যে অংশ দায়িত্বপালনের আহবান জানায় সে অংশ রাজরাণী এবং প্রজামাতাকে দিয়ে কর্তব্য পালনের নির্দেহস দিইয়ে নেয়। অন্যকথা ভাবার সেখানে অবসর কোথায়? আজ যে শাস্ত্র এবং শস্ত্রের পাঠ পূর্ণ করেছে, আগামী দিনে যে যুবরাজ এবং ভাবীকালে রাজাসনে আরোহণ করে রাজ্যের কর্ণধার হবে, তাকে তো বিপদ - বাধার প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিপদে করতে করতে এগোতে হবে। স্পর্ধাপূর্ণ আহ্বান তো তার কাছে সঙ্গীতের ধ্বনি! এই তো সুযোগ নিজেকে পরখ করে নেওয়ার! - সস্নেহে বসলেন ময়ূরশিশুর দক্ষিণ স্কন্ধে। কুমারের পৃষ্ঠে, শিরে হস্তসঞ্চালন করে বললেন - কুমার! যে এমন স্পর্ধিত লিপি এমন সুরুচিপূর্ণভাবে রচনা করে পাঠাতে পারে, সে বীর না হয়ে পারে না। অহংকার বা আত্মবিশ্বাস যা থেকেই চিঠিটি সে লিখে থাকুক, হীনভাবে আক্রমণ করে নিজের অমর্যাদা করতে চাইবে না। একটু থেকে বললেন - লক্ষ্য করেছো, 'একাকী' যেতে বলেছে। অর্থাৎ দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান। নাহলে অনঙ্গপুরীর সৈন্যসামন্তই নয়, রাজা এবং রাণীও তোমার সঙ্গী হতেন।
অনঙ্গদেবের মুখমণ্ডল ভ্রুকুটিকুটিল এবং অবয়ব মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো প্রখর হয়ে উঠলো। কুমার! রাজকুলে যার জন্ম, বিপদ তার নিত্যসঙ্গী। কেশাগ্রে দোদুল্যমান খড়গের মতো তা প্রতিমুহূর্তে তার শিরে উদ্যত থাকে। সে কথা জেনেই তোমাকে যাত্রার অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু সেই দানব যদি অসৎভাবে তোমার ক্ষতিসাধন করে বা তার চেষ্টা করে, তাহলে অনঙ্গপুরীর মহাবল বাহিনী মেদিনী কম্পিত করে দানবরাজ্য অভিমুখে যাত্রা করবে, যার পুরোভাগে থাকবেন মহারাজ অনঙ্গদেব। দেব দৈত্য যখ রক্ষ কাউকেই সমীহ করা হবে না। সেকথা প্রথম সুযোগেই তাকে জানিয়ে দেবে।
শুধুমাত্র মহারাজ নন, মহারাণী নীলিমাও থাকবেন তাঁর বাম পার্শ্বে - বললেন রাণী। তোমার পিতার মতো আমি সাক্ষাৎ ধনুর্বেদ নই। ধনু ধারণই করিনি কখনো পিতৃরাজ্য হতে অনঙ্গপুরীতে আসার আগে। মহারাজের আগ্রহ ও যত্নেই প্রথম বীণার সঙ্গে ধনুকেও হাতে তুলে নিই। আজ মহারাজ কী ধারণা তাঁর রাজ্ঞী শিষ্যার সম্পর্কে পোষণ করেন জানিনা, কিন্তু মনে হয় তাঁর সযত্ন শিক্ষার অবমাননা হয়নি।
- রাণী! রাজা হাসলেন। আমার সমগ্র বাহিনীতে সেনাপতি ভিন্ন অল্প কয়েকজনই তোমার সমান ধনুর্বিদ্যায় অধিকারী।
কুমার পিতৃমাতৃপদে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন অনুমতি করুন। বৃথা কালক্ষেপ হলে বা কোনো অঘটন ঘটে। মৃদু হাসলেন - মহারাজ এবং মহারাণীর দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি একাকী যাব না। আমার প্রিয়সঙ্গীরা সঙ্গে থাকবে। খড়গ - মহাকাল, চর্ম - কূর্মাবতার, বর্ম - আয়ুষ্মান, ভল্ল - কৃতান্ত, গদা - বলদেব, ধনু - বিশ্বত্রাস, তূণ - অনন্ত, বাণসমূহ - প্রলয়, পাশ - বাসুকি, কিরীট - দেবাশিস, সহচর - তুরঙ্গপ্রধান। সর্বোপরি পিতৃমাতৃ আশীর্বাদ। সে আশিস অবশ্যই আমায় সাফল্য এনে দেবে। কারণ আমি যাচ্ছি কর্তব্যপালনে।
রাজা এবং রাণী শিরশ্চুম্বন করলেন। আশীর্বচন দিলেন। রাজা বললেন - দূত তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে পদ্মনাভপুর।