পুলিশের চাকরি। দিনে ঘুমিয়ে রাতে জাগা অভ্যেস। কর্মদক্ষতা, সাহসিকতার পুরস্কার হিসাবে তিনবার পদক পাওয়া সরকারি কর্মচারী নিবারণ ঘোষালের গ্রামেগঞ্জে ঘুরতে আপত্তি নেই, কিন্তু জায়গাটা পুকুর, নদী দিঘি, বাঁওড়ে টইটুম্বুর হওয়া চাই। যেমন এবার এস পি সাহেবের আকস্মিক তলব টেলেক্স মারফত,
'জঙ্গীপুরের বর্ডার এলাকায় একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত ভীষণ উপদ্রব করছে। অবিলম্বে তাকে সায়েস্তা করা প্রয়োজন।'
বাহাত্তর ঘন্টার নোটিশে উনি বদলির আদেশ মেনে নিলেন যখন জানলেন, পুলিশ কোয়ার্টারসের পাশেই রয়েছে এক বিরাট পুষ্করিণী; অবগাহনযোগ্য। ছোটবেলা থেকেই জল তাঁর প্রিয়। জলের সবুজ নির্জনতা ও নৈঃস্তব্ধের মধ্যেই তিনি খুঁজে পান নিজের অস্তিত্ব। জল তাঁকে দেয় আশ্রয়, আত্মবিশ্বাস, জোগায় বেঁচে থাকার রসদ।
ভাল চাকরি, ভদ্রস্থ রোজগার। প্রথম যৌবনে অনেক মেয়েই তাঁকে চেয়েছিল, খুব কাছেও এসেহিল কেউ কেউ। কিন্তু নাগাল পায়নি। তিনি যাকে চান, তার শরীর হবে জলের মতোই গভীর। তাঁর কাঙ্খিতা জলকন্যা অবশ্য কোন দিনই তাঁকে ধরা দেয় নি, তাই এই মধ্য বয়সে এসেও অকৃতদারই রয়ে গেলেন ঘোষাল সাহেব। কিন্তু অপর দিকে তাঁর মানসিকতায় এসেছিল একটা দৃঢ়তা। কিছুটা রুক্ষতাও। খুব দাপুটে পুলিশ অফিসার এই নিবারণ ঘোষাল। প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা। গত চোদ্দ-পনেরো বছরে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় পাঁচটা থানায় ঘোরা হয়ে গেছে। যেখানেই গেছেন, সেখানেই ঘোষাল সাহেবের হম্বিতম্বিতে পুরো থানা তটস্থ। অঞ্চলগুলোও তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। অপরাধীরাও। লালগোলা, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, জলঙ্গী, জঙ্গীপুর — কিছু হলেই তাই ডাক পড়ে ওসি নিবারণ ঘোষালের।
ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ ডাকাত করিম। গোটা এলাকার মূর্তিমান ত্রাস। সাঙ্গোপাঙ্গো সমেত বহুকাল যাবৎ জঙ্গীপুরকে জ্বালিয়ে খাচ্ছিল। ওর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে একবার প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেছেন ঘোষাল সাহেব। শেষ অব্দি টানা তিন রাত জিপ ছুটিয়ে বাংলাদেশ বর্ডার থেকে ধরে ফেললেন করিমকে।
করিমকে লকআপে পুরে এস পি সাহেবকে খবর দিয়েই শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি টের পেলেন। টয়লেটে গিয়ে নির্ভার হতে গিয়ে টের পেলেন, শরীরটা একদম কষে গিয়েছে।
পরদিন জালঢাকা পুলিশের গাড়িতে হাতে হ্যাণ্ডকাফ পরা করিমকে বহরমপুর আদালতের কাঠগড়ায় তুলে দিয়ে নিজেও হাসপাতালে বন্দী হলেন।
খুব খারাপ রকমের জণ্ডিস। ডাক্তারবাবুরা বললেন দীর্ঘদিন অনিয়ম আর রাতজাগার ফলেই এই কামলা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ওসি সাহেব। টানা তিন মাস হাসপাতালেই পড়ে রইলেন নিবারণ ঘোষাল।
দীর্ঘদিনের ফাস্টলাইফে যেন ছেদ পড়ল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিগত জীবনের অনেক কথাই মনে পড়েছিল। স্মৃতির সরণি বেয়ে ছায়াছবির মতো ভেসে আসছিল বহুদূরের অতীত। উত্তর চব্বিশ পরগনার একটা সমৃদ্ধ গ্রাম — উত্তর দিকে বাঁশবাগানের ফাঁক ফোকরে দক্ষিণ মৌজায় আদিগন্ত মাঠ; আম কাঁঠাল লিচুর কুঞ্জ, মধ্যে ওলাইচণ্ডী থানের ধারে বিশাল তেঁতুল গাছ, ইতস্তত ছড়ানো তাল, সুপারী, নারিকেলবীথির সেই রম্যতার জগৎ। মাঠ, ঘাট, পুকুর, দিঘি পার হওয়া শৈশব কৈশোর।
ষাটের দশকের মাঝামাঝির কথা। নিমতা চৌধুরী পাড়ায় ঘোষালদের নিজস্ব ঘাটে দ্বিপ্রহরে মেয়ে-বৌদের মজলিশ বসেছে। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটের দুপাশে হাতলের মতো ঠেস দেওয়ার পাকা ব্যবস্থা। রসে বসে স্নান করার আর বায়ু সেবনের পরিপাটি আবহ। চৈত্রে পুকুরের ভাঙা ঘাটে হলুদ হলুস নিমফল। ঘাটের পাশে জলের ভিতর তেল ছাড়ানোর জন্য ভিজিয়ে রাখা কড়া, হাঁড়ি, চাটু। পাড়ের সামনে ঝাঁঝি কলমীদামে নেচে বেড়াচ্ছে চুনোপুঁটির ঝাঁক। স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাচ্ছে গাঙধারার দল। কানা মেঘের আবডালে ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে রোদ্দুর। এমনই এক চৈত্র দিনে ঘোষাল বাড়ির ছোটবৌয়ের গলারা হার পুকুরে হারিয়ে গেল। গলায় সাবান দেয়ার সময় কখন আলগা হয়ে গিয়েছিল টের পাননি নতুন বৌটি। টের পেতেই বুক জলে নেমে কত খোঁজাখুঁজি। দুপুর বেলাটা প্রধানত বাড়ির মেয়েরাই পুকুর ব্যবহার করত। বিপত্তি দেখে বাড়ির ছেলেরাও জলে নেমে খুঁজতে লাগল। জল ঘুলিয়ে দই। হারের আর পাত্তা নেই।
ঘোষাল বাড়ির ছোটদের মধ্যে তখন নিবারণ খুব ডাকাবুকো। তাকে পাঠান হল ডুবুরি ডাকতে। নিবারণ ছুটল। ইতস্তত ঘন জঙ্গল, ঝোপঝাড়ে তলিয়ে যাওয়া এক মানুষ উঁচু গাছপালা ঘেরা একটা পোড়ো বাড়ি। ভুল বানানে লেখা একটা সাইনবোর্ড বাড়ির দরজায় লটকান - 'ডুবুড়ী'। বাইরে থেকে ডাকতেই একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে এল, নিবারণেরই বয়সি। একমাথা কালো চুল, টেনে উলটে পিছন দিকে আঁচড়ান। বলল,
'বাবা ঘুমোচ্ছে। সাঁঝের বেলায় উঠবে।'
নিবারণ বলল — ডেকে দিয়ে বল, ঘোষালদের পুকুরে একটা সোনার হার তলিয়ে গেছে, তুলতে হবে।
একটু পরেই ডুবুরি এল, কাঁধে একটা বড় ঝুড়ি। এছাড়া সম্বল গোটা কয় হাতুড়ে অস্ত্রশস্ত্র। কালো রং, লালচে চোখ। ছোট ছেলেটাও সঙ্গে এসেছে। লাল টুকটুকে চোখ মেলে ডুবুরি একবার চারপাশ দেখে নিল। পুকুরের পাড়ে তখন বেশ ভীড়।
মানুষটি ঘাটলায় বসে কাপড়খানি রেখে কাঁধের গামছাখানি কোমরে জড়িয়ে ল্যাংগোটের মত করে কষে বেঁধে নিল। তারপর বাঁ হাতের চেটোখানি কোষ করে বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াল। ঘোষাল বাড়ি থেকে সর্ষের তেল এল। মেয়েরা একপলা তেল হাতে ঢেলে দিতেই, তা গায়ে মাথায় সপ সপ করে মেখে নিল লোকটি। মানুষটা এবার জলে নামল। সাঁতরে খানিকটা গিয়ে ডুব দিল প্রথমে। ঝুড়িটা ভাসিয়ে দিল জলে।
চৈত্রে জল কমে এসেছে, সে জলের রঙে সবুজের ছায়া। মানুষটা ডুব দিলেই বিস্মিত হচ্ছিল নিবারণ। সে বয়স তো বড় বিস্ময়ের। জলতলে না জানি কত কি আছে। নিবারণ তখনও দাদাদের মতো মাঝ পুকুরে ডুব দিয়ে পাঁক তুলতে পারে না, দম ফেটে আসে। জলের তলায় মাটির কাছাকাছি ঘোলা জলের অন্ধকার। কেমন যেন ভয়ভয় করে। তাছাড়া জলের চাপে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হয়।
মানুষটা নিচে। তার লুঙি, গায়ের শার্ট, হাতে রাখা লোহার খোঁচানি, বিড়ির কৌটো, সবই তার ছেলে সামলাচ্ছে। ছেলেটার নাম এর মধ্যে জানা হয়ে গেছে নিবারণের। কেমন ধারা ইংরাজি ইংরাজি নাম — লিটন।
ডুবুরি এবার তার ভাসান ঝুড়িটা ডুবিয়ে নিয়েছে। জলের গভীর থেকে ছাই, মাটি, কাদা, পাঁক, ইটের টুকরো, মাটির কলসি সব উঠে আসছিল তার ঝুড়িতে। কী অদ্ভুত জীবিকা, হারানো জিনিস খুঁজে দিলে তবেই মজুরি, নইলে খাটুনিই সার।
আবার ডুব, ভেসে ওঠা। বুকে কিছুটা বাতাস নিয়ে আবার ডুবে যাওয়া। পুকুর পাড়ে ভীড় বাড়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। মানুষটা এবারও ব্যর্থ হল। ঝুড়ির মধ্যে বাসন মাজা ছাই আর কাদামাটি ছাড়া এবারও কিছু উঠল না।
চোয়াল কষে বুকে কিছুটা অক্সিজেন নিয়ে মানুষটা আবার ডুব দিল আর উঠে এল রাজার মতো। হাতে তার সেই সোনার হার। তা তখনকার সময় ভরি পাঁচেক তো বটেই। গৃহস্থকে আশ্বস্ত করে, ছোট বৌ এর হাতে হারটি তুলে দিয়ে আড়াই-তিন ঘন্টার পরিশ্রমের বিনিময়ে মাত্র কুড়িটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে লিটনকে নিয়ে যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে গেল।
হাসপাতালের বিছানায় সুখ-রোমন্থনে ঘোষাল সাহেব যখন গভীর অন্যমনস্ক তখন সম্বিত ফেরাল থানার সাব-ইনস্পেক্টর হংসনারায়ণ চক্রবর্তীর বাজখাও কন্ঠস্বর,
'নমস্কার বড়বাবু।'
চমকে উনি ঘুরে শুলেন। সম্মুখের মানুষটাকে দেখে অবশ্য আশ্বস্ত হলেন, বললেন,
'কী খবর চক্রবর্তী।'
'আপনার জন্য একটা সুখবর আছে।'
'কী সুখবর।'
'আপনার বদলির আদেশ হয়েছে।'
'কোথায়? কোথায়?'
'বেলঘড়িয়া থানায়, সদর কোলকাতার কাছেই।'
সন্দিগ্ধ পুলিশী চিত্তে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অদৃশ্য খোঁচা।
'এটা পুরস্কার না শাস্তি, চক্রবর্তী?'
'না স্যার, পুরস্কার বটে। অনেক দিন গ্রামে গঞ্জে ঘুরছেন। উপরন্তু আপনার কাজের দৌলতে সমাজের শত্রুর সংখ্যাও সীমাহীন। কেন খামোখা ঝুটঝক্কি এলাকায় পড়ে থাকবেন। কোন করিম শেখ গুপ্ত রাগ পুষে সুযোগ খুঁজছে, বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। তাছাড়া আপনি তো পুকুর, নদী, ঝিল ভালোবাসেন। এই থানাটার পাশেই শুনেছি আনন্দনগরের বিখ্যাত ঝিল। গোটা এলাকাটাই ছোট-বড় ঝিলে ভরা। আপনার পৈতৃক বাড়ি নিমতা থেকেও জায়গাটা বেশি দূরে নয়।'
ঝিলের কথা শুনেই নিবারণ ঘোষাল বদলির আদেশ সানন্দে মেনে নিলেন।
প্রকাণ্ড ঝিল। বহুদূর পর্যন্ত জল আর জল। জলের বুকে কচুরিপানার গাদার মধ্যে মাঝে মাঝে রক্তকমল, রক্ত শাপলা। ঝিলের পাড়ে নানা রকম ঘাসের বুকে বিচিত্র রঙের ছোট ছোট ফুল ফুটে রয়েছে। কোনটা নীল, কোনটা বেগুনি, কোনটা বা ধবধবে সাদা। আকাশের গভীর নীলিমার বুকে সুর জাগিয়ে পাখির দল উড়ছে। ঝিলের চারিধারে দখলি জমি, তাতে খেটে খাওয়া মানুষের বসতিই বেশি — কুমোর পাড়া, নট্ট পাড়া, বাগদি পাড়া। এর মাঝেই হাল-ফ্যাশানের পাকা দোতলা বাড়ি। সঙ্গে রাধাগোবিন্দের মন্দির।
এই বিরাট ঝিলের প্রায় মধ্যিখানে এক জলটুঙি — জলের উপর তৈরি করা এক উঁচু ঘর, যেখান থেকে জেলেরা রাতের বেলায় মাছ পাহারা দেয়। ঝিলগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে। মৎসজীবী সমবায় সমিতি। মাছ চুরির অভিযোগ নিত্য নৈমিত্তিক। বড় ঝিলের প্রায় সমস্ত পাড়গুলো বাঁধানো। মধ্যে মধ্যে বসবার বেঞ্চি। যেগুলো কখনও খালি থাকে না। যুবক যুবতী, মধ্যবয়স্ক, পেনশনভোগী। ঝিলের দুই পাশে প্রচুর গাছ, আকাশের দিকে মাথা তোলা স্বাধীন সব বৃক্ষ, তাদের মধ্যে আছে কদম, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া। গাছগুলোতে যখন লাল, হলুদ ফুল ফোটে, বাতাসের দোলায় দোলায় ঝিলের জলে উড়ে উড়ে পড়ে তখন মনে হয় কলকাতা শহরের পোড়া মবিল ডিজেল আর পেট্রোলের ধোঁয়ায় আটকানো অস্বস্তির মধ্যে এ যেন এক মরুদ্যান।
বেলঘড়িয়া থানা অবশ্য খানিকটা দূরে। সেখানে নতুন ওসি নিবারণ ঘোষাল স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মেজবাবুকে বললেন,
'কি হচ্ছে? কমপ্লেনে যে জেরবার হয়ে যাচ্ছি। হল্লা ডিউটি কার?'
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গোড়ালি ঠুকে স্যালুট মেরে ভক্তিভরে মেজবাবু বললেন — 'আমার স্যার।'
'একবার বেরোন তা হলে। রানডাম চালান দিন। দেখবেন ঝিলের আশেপাশে যেন কোনো অসামাজিক কাজ না হয়। দেখতে পেলেই পেটি কেসে ঝোলাবেন। আর লক্ষ রাখবেন সন্ধ্যার পর কোনো কাপ্ল্ যেন ঝিলের পাড়ে না থাকে।'
'ইয়েস স্যার' বলে মেজবাবু দুপায়ের গোড়ালি এক সঙ্গে করে আরেকবার ঠুকলেন। মুখখানা হাসিতে ভরে ফেললেন। সব জায়গায় দাঁত নেই। ফুলপ্যান্টটা পায়জামা ধাঁচের। ইস্ত্রি সহ্য হয় না। ফুলশার্টের হাতা ন্যালব্যাল করে ঝুলছে। হাসিভরা মুখে মেজবাবু বললেন,
'বুঝেছি স্যার, আমি এখনই বের হচ্ছি।'
মেজবাবুর ভ্যান থানায় ফিরল রাত দশটা। বাইরে কুয়াশা। রাস্তায় লোকজন কম। থানার ভিতরে যেন বেলা দশটা। আলোয় ঝকমকে অফিস। বড় হাতার খাকি ইউনিফর্ম পরে দুজন এ এস আই কী যেন লিখছেন। ভ্যান থেকে মিছিল করে নেমে আসা লোকেদের একে একে লকআপে ঢোকানো চলছে। ওসির ঘরে বড় পর্দা। মেজবাবু পর্দা সরিয়ে ঢুকেই লম্বা সেলাম দিয়ে বললেন,
'ঝিলে একটা সুইসাইড কেস হয়েছে স্যার। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে একসঙ্গে জলে ঝাঁপ দিয়েছে। কেউ সাঁতার জানে না।'
ওসি নিবারণ ঘোষাল বললেন,
'জল থেকে তোলবার ব্যবস্থা করুন।'
'স্যার, আমাদের কোনো ডুবুরি নেই। মেসেজ পাঠালে আগামীকাল বিকেল নাগাদ হেডকোয়াটার্স থেকে ডুবুরি আসতে পারে।'
'কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এই এলাকার মানুষ খুব আবেগপ্রবণ। এদিকে ডিসি সাহেবও তলব করতে পারেন। আপনি ওদের তোলার ব্যবস্থা করুন।'
মেজবাবু চলে গেলেন ডুবুরি খুঁজতে।
রাত একটা নাগাদ ওসি সাহেবের ঘরের ফোন ঝন্ঝন্ করে উঠল। ঘোষাল সাহেব তখন ঘুমের উদ্যোগ করছিলেন। অপরপ্রান্তে মেজবাবুর গলা,
'ডুবুরি পাওয়া গেছে, স্যার।'
'কোথায় পেলেন?'
'রেলস্টেশনের চার নম্বর প্লাটফর্মে।'
'ওকে চেনেন?'
'হ্যাঁ স্যার, এর আগে দু-একবার আমাদের হয়ে কাজ করেছে।'
'কী ধরনের কাজ?'
'এই স্যার ঝিলের জলে অনেকে সদ্যোমৃত বাচ্চাটাচ্চা ফেলে যায়। রেল লাইনের দুধারে ঝুপড়ি — ওগুলো স্যার ওদেরই কাজ। তবে লোকটা ভীষণ লোভী। ঝিলে ডেডবডি পড়লেই ও রাতের অন্ধকারে জলে নেমে আংটি, ঘড়ি, গলার হার, পায়ের মল যা পাবে সব আগেভাগে তুলে নিয়ে গায়েব করে দেবে। সকালে লোকদেখানো জলে নামবে।'
'হাবিলদার পোস্টিং করে দিন। রাতে কেউ যেন জলে না নামে। কাল খুব ভোরেই লাস দুটো তোলা হবে।'
ওসি সাহেব এইবার ঘুমোতে গেলেন। কিন্তু ঘুম এল না। শৈশবের স্মৃতিময় গন্ধ নিয়ে ফিরে এল এক বর্ণময় জগৎ। তখন গাজনের ঢাকের শব্দে শিমূল তুলোর ফল ফাটো ফাটো। সজনে ডাঁটা ফেটে গেছে কোথাও কোথাও। রোদ ভীষণ কড়া। ঘোষাল বাড়ির ছোটবৌ হার হারিয়ে আর ঘরে ফিরতে পারছে না। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ ডানপিটে ছেলে নিবারণ ডুবুরি ডাকতে ছুটছে পাইক পাড়ায়। এইসব ভাবতে ভাবতে ওসি সাহেবের মনে হল এই তো সেদিন জীবনের ভোর হল।
ভোর না হতেই উঠে পড়লেন নিবারণ ঘোষাল। থানার লাগোয়া কোয়াটার্স থেকে দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে আনন্দনগরের দিকে জিপ ছোটালেন। ঝিলের কাছে পৌঁছে হাঁটতে লাগলেন। ঘন কুয়াশায় দূর থেকে মেজবাবুর চেহারাটা নজরে পড়ল। কাছে যেতেই দেখলেন একটা মানুষ জলে ডুব দিচ্ছে আবার কিছুক্ষণ পরে ভুস করে ভেসে উঠছে। মানুষটার পিঠে নেই অক্সিজেন সিলিণ্ডার, না আছে সাঁতারুর পোশাক। মেজবাবু পাড়ে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন। মানুষটা এবার ডুব দিয়ে উঠে এল। পাড়ের কাছে এসে বলল,
'ব্যাটাছেলেটা আর মেয়েছেলেটা দুজনের হাত একসঙ্গে বাঁধা। দুজনকে এক সঙ্গে তোলা যাবে না।'
মেজবাবু বললেন,
'আগে হাতের দড়িটা খুলে নে, তারপর একজন একজন করে তোল।'
মানুষটা বলল,
'সোমত্থু মেয়ে আর জোয়ান ছেলে। কাজটা বড় কঠিন বাবু।'
ঘোষাল সাহেবকে শুনিয়ে মেজবাবু বললেন,
'কষ্ট করে কাজটা করে দে ভাই, সাহেব তোকে পুষিয়ে দেবেন।'
মানুষটা এবার জলে ডুব দিল। প্রায় তিন মিনিট জলের তলায় রইল। বড় মাছ যেমন বুড়বুড়ি কাটে, তেমনই কিছু জল-বেলুন ভেসে উঠল। মানুষটা উঠে এল, বাঁ হাতে মেয়েটার চুলের গোছা। ডান হাতে সাঁতরে মেয়েটাকে ডাঙায় তুলল।
এরপর কিছুটা দম নিয়ে আবার ডুব। ছেলেটার কালো মাথাটা এবার দেখা গেল। মৃত ছেলেটা যেন নিজে থেকে সাঁতরে ল্যাণ্ডিংয়ের দিকে আসছে। জলের নিচ থেকে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে আসছে মানুষটা। সাবধানে ছেলেটিকে ডাঙায় তুলে নিজেও উঠে এল জল থেকে। তার সারা শরীর, মাথায় পাঁক। তার থেকে জল টোপাচ্ছে। কোন কথা না বলে সে লুঙি পরে গা মুছতে চাইছিল কোন আড়ালে গিয়ে। গা মুছে চুল আঁচড়িয়ে মানুষটি ওসি সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল। তার একমাথা কালো সাদা চুল টেনে উলটে পিছন দিকে আঁচড়ান। বয়স আন্দাজ ওসি সাহেবের মতনই।
ঘোষাল সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন,
'কী নাম তোমার?'
'আজ্ঞে, লিটন দাস।'
কেমনধারা ইংরাজী ইংরাজী নাম। ভীষণ চেনা ঠেকে ঘোষাল সাহেবের।
'তুমি কি ছোটবেলা থেকেই এ কাজ করছ?'
'আজ্ঞে না, একটা ঢালাই কারখানায় কাজ করতাম। কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল। বাড়িতে পাঁচটা মুখ। কি করি! শেষে এই কাজটা ধরলাম।'
'জলের তলে দমবন্ধ করে এতক্ষণ থাক, এই বিদ্যে তুমি কোথা থেকে শিখলে?'
'আজ্ঞে, আমার বাবা ডুবুরি ছিলেন। তেনার কাছেই হাতেখড়ি। বাকিটা পেটের দায়ে আয়ত্ত করেছি।'
'তোমার গ্রাম?'
'আজ্ঞে, নিমতে, পাইকপাড়া, এখন যাযাবর।'
ঘোষাল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। পকেট থেকে পার্স বার করে পাঁচশ টাকার একটা নোট ডুবুরির হাতে দিয়ে পিছন ফিরলেন। বিমূঢ়-বিস্মিত নিবারণ ঘোষাল ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন — ডুবুরির দিন, সেতো কবে শেষ হয়ে গেছে। তবে এ কি? একি জীবিকার পরম্পরা না জীবনের ঘোলাজল থেকে বাঁচবার রসদ তোলার জন্য এ এক ভিন্ন পথ, ভিন্ন সময়?