আব্দুল হালিম শরর
অনুবাদকের বয়ান:দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত ‘বাংলার গান’ (১৯০৬)-এ লখনউয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ রচিত কয়েকটি গান ঠাঁই পেয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বোধহয় ‘জব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’। আমরা জানি লখনউ ছেড়ে নবাব এসেছিলেন কলকাতার প্রান্তে – মেটিয়াবুরুজে। লখনউতে তাঁর শাসনকাল দশ বছরের কিছু কম সময়। আর রাজ্যচ্যুত বাদশাহ আমাদের এই শহরের পাশেই কাটিয়ে গেলেন জীবনের শেষ তিরিশটি বছর।
অযোধ্যার সদ্য-রাজ্যহারা নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কোম্পানির পেনশন নিয়ে লখনউয়ের কোনও প্রাসাদে নিশ্চিন্তে থাকতেই পারতেন। তা না করে ছুটলেন কলকাতা। তাঁর বাসনা গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কাউন্সিলের কর্তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সওয়াল করবেন সিংহাসন উদ্ধারের জন্য। সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, সেখানে পার্লামেণ্ট আর রানি ভিক্টোরিয়ার কানে তুলবেন ইংরেজ কর্তৃক তাঁর রাজত্ব অধিগ্রহণ কেন অন্যায়। অথচ ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি। কিন্তু বাদ সাধলেন অসুস্থ নবাবের হাকিমরা। তাঁরা মনে করছিলেন যে সমুদ্র যাত্রা নবাবের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। নবাব রইলেন কলকাতায়, তাঁর উত্তরাধিকারী, তাঁর মা এবং ভাই চললেন বিলেতে। ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ভাতা গ্রহণ করতে রাজি নন নবাব। অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর রাজমুকুট আর সিংহাসন। তিনি তা ফিরে পেতে চান। কিন্তু পাকেচক্রে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে এল না, পেনশন নিতে রাজি হয়ে কলকাতাতেই জীবনের বাকি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন ওয়াজেদ আলি।
উনিশ শতকে হুতোম লিখেছিলেন, ‘লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো।’ কেমন ছিল সে ‘গুলজার’ শহর? জানতে হলে পড়তেই হবে আব্দুল হালিম শরর-এর ‘গুজ়স্তা লখনউ’। কে এই আব্দুল হালিম শরর?
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লখনউতে বসবাস করতেন হাকিম তফজ্জুল হুসেন নামে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব, আরবি-ফারসিতে সুপণ্ডিত এক ব্যক্তি। তিনি নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের দরবারে কর্মরত মুনশি কামারউদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁদের পুত্র আব্দুল হালিমের জন্ম ১৮৬০-এ, যিনি পরবর্তীকালে ‘শরর’ (অর্থাৎ স্ফুলিঙ্গ) এই তখল্লুস্বা ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ‘মৌলানা’ উপাধি পান।
নবাব ওয়াজেদ আলি লখনউ ছেড়ে কলকাতায় এলেন ১৮৫৬-তে। আব্দুল হালিমের পিতা এর বছর ছয়েক পরে নির্বাসিত নবাবের দরবারে চাকরি নিয়ে এলেন। জীবনের প্রথম ন’বছর লখনউতে কাটিয়ে বালক শরর ১৮৬৯-এ পিতার সঙ্গে যোগ দেন মেটিয়াবুরুজে এবং ১৮৭৯ পর্যন্ত তিনি সেখানেই থেকে যান। খুব অল্প বয়সেই লখনউ থেকে প্রকাশিত ‘আওধ আখবার’-এ তিনি মেটিয়াবুরুজের সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। শরর উর্দু গদ্য লেখক হিসেবে পরবর্তীকালে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদের সাহায্য নিয়ে উর্দুতে ভাষান্তর করেছিলেন।
১৮৮৭-তে বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় আব্দুল হালিম লখনউ থেকে ১৬-পৃষ্ঠার পত্রিকা ‘দিল গুদাজ্’ এর প্রকাশনা শুরু করেন। এই পত্রিকাটি ক্রমশ তাঁর অস্তিত্বের অঙ্গ হয়ে ওঠে। উর্দু গদ্য সাহিত্যের এক নতুন ধারার সূচনার মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করাই ছিল তাঁর অভিপ্রায়। আরবি-ফার্সি-উর্দু সাহিত্য এবং ইসলাম ধর্মতত্ত্বে গভীর পাণ্ডিত্যসম্পন্ন উর্দু ভাষার পথিকৃৎ এই ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক-ঐতিহাসিক ‘দিল গুদাজ্’ পত্রিকায় ১৯১৩ থেকে ‘হিন্দুস্থান মেঁ মশরিকি তামাদ্দুন কা আখরি নমুনা’ (অর্থাৎ ভারতে প্রাচ্য সংস্কৃতির শেষ উদাহরণ) নামে একগুচ্ছ প্রবন্ধ ছাপতে শুরু করেন। এই প্রবন্ধগুলি পরবর্তীকালে লাহোর থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘মজ়ামিন-এ-শরর’ কেতাবে প্রকাশিত হয়। ক্রমশ এই প্রবন্ধগুলি নবাবী আওধের অন্তর্ভুক্ত তদানীন্তন লখনউ শহর সম্পর্কিত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মর্যাদা পায় এবং ১৯৬৫ সালে লখনউয়ের নাসিম বুক ডিপো থেকে ‘গুজ়স্তা লখনউ’ নামে প্রকাশিত হয়।
পুরোনো লখনউ সম্পর্কিত সেই বইয়ের একটি অধ্যায়ে শরর বর্ণনা করছেন স্বচক্ষে দেখা মেটিয়াবুরুজকে যা ওয়াজেদ আলি শাহের উদ্যোগে দ্বিতীয় লখনউ হিসেবে গড়ে উঠেছিল। নবাবী মেটিয়াবুরুজ নিয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও এত নিখুঁত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দ্বিতীয়টি মেলা ভার। আব্দুল হালিম শরর-এর সেই অনবদ্য ঐতিহাসিক দলিলের প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠাগুলি মূল উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হল এখানে।
কলকাতার তিন-চার মাইল দক্ষিণে ভাগীরথী (হুগলি)-র তীরে ‘গার্ডেনরিচ’ নামে একটি নিরিবিলি মহল্লা আছে। আর যেহেতু সেখানে একটা মাটির গম্বুজ ছিল, সাধারণ মানুষ সে এলাকাকে ‘মেটিয়াবুরুজ’ বলত। নদীর তীর ধরে প্রায় আড়াই মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় অনেক বিলাসবহুল কুঠিও ছিল। ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতায় পৌঁছোনোর পরে গভর্নমেণ্ট অব ইন্ডিয়া সেই সব কুঠিবাড়ি বাদশাহকে দেয়। দুটি বিশেষ বাসস্থান বাদশাহের জন্য, একটি নবাবের খাস মহল আর আরেকটি আলি নক্কি খানের বসবাসের জন্য, যিনি বাদশাহের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন। এর আশপাশে নদীর তীর বরাবর প্রায় দেড় মাইল ধরে ছড়িয়ে থাকা জমির একটা বড় অংশ, যা পরিধিতে ছ-সাত মাইলের কম হবে না, বাদশাহের নিজের এবং তাঁর কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল।
মিউনিসিপ্যালিটির সড়কটি সেই এলাকার মাঝখান দিয়ে যাওয়ায় তাকে দৈর্ঘ্য বরাবর দুটি ভাগে ভাগ করেছিল। বাদশাহকে দেওয়া দুটি কুঠির বাদশাহ প্রদত্ত নাম ছিল ‘সুলতানখানা’ আর ‘আসাদ মঞ্জিল’। আর বাদশাহ যখন নবাবের খাস মহলের কুঠিটিকেও নিজের কব্জায় নিলেন, তখন তার নাম রাখলেন ‘মুরাসা মঞ্জিল’। সেই ভবনটি তারপরে বাদশাহের সন্তানদের, বিশেষত নবাব আখতার মহলের অধিকারে ছিল। এই আখতার মহল আলি নক্কি খানের মেয়ে, বাদশাহের মুমতাজ বিবি আর বাদশাহের দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী মির্জা খুশ বখত বাহাদুরের মা।
সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজ ফৌজের বিদ্রোহী অফিসারেরা জানিয়েছিল যে যদি বাদশাহকে তাঁদের নিয়ামক নিযুক্ত করা হয়, তা হলে কলকাতাতেও বিদ্রোহের আগুন ছড়াবে। কিন্তু সিংহাসন আর রাজমুকুট চলে যাওয়ার পরে বাদশাহ গভর্নমেণ্ট অব ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে এহেন দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। আর তখন তা তাঁর পছন্দও ছিল না। তবে তিনি ওই অফিসারদের কুমতলব এবং অভিপ্রায় সম্পর্কে লাটসাহেবকে জানিয়েছিলেন। তার জন্য বাদশাহ ধন্যবাদও পেয়েছিলেন, যদিও এর দু-চার দিন পরেই বাদশাহকে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার অভ্যন্তরে রাখাই উপযুক্ত সাব্যস্ত হয় যাতে আর কখনও ফৌজের বিদ্রোহী অফিসারেরা তাঁর নাগাল না পায়। বাদশাহের তরফে লন্ডনে যে মোকদ্দমা চলছিল, তা এই হেতু মুলতুবি রাখা হয়েছিল যে দাবিকৃত অঞ্চলটি এই সময়ে ব্রিটিশদের আয়ত্তাধীন নয়। সে অঞ্চলের ওপর আবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিকার কায়েম হলে তা নিয়ে ভাবা যাবে।
বাদশাহ ব্রিটিশদের হেফাজতে থাকাকালীনই লখনউ এর বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে যায়। মসিহ্উদ্দিন খান, যিনি লন্ডনে নবাবের পক্ষে জেনারেল অ্যাটর্নি ছিলেন, পুনরায় দাবি পেশ করেন। তিনি সফল হওয়ার আশা করেছিলেন এবং বাদশাহের রাজত্ব ফিরে পাওয়ার সম্পূর্ণ প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে যারা কেল্লার ভেতরে বাদশাহের পরামর্শদাতা-মোসাহেব ছিল, তারা বাইরের প্ৰরোচনা অথবা নিজেদের লাভের আশায় ষড়যন্ত্র করেছিল। তাদের মনে হয়েছিল যদি মসিহ্উদ্দিন খান মোকদ্দমা জিতে যায়, তা হলে তাদের বাজার খারাপ হয়ে যাবে, তারা যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই থেকে যাবে। এই কারণে সকলে বাদশাহকে বোঝাতে শুরু করল যে ‘জাঁহাপনা, কেউ কখনও নিজের অধিকারে থাকা কোনও মুলুককে পরের হাতে তুলে দেয়? মসিহ্উদ্দিন খান হুজুরকে ধোঁকা দিচ্ছে। জাঁহাপনা শুধুই এই বিড়ম্বনা সহ্য করছেন। দেড়-দু বছর ধরে তিনি তনখা গ্রহণ করেননি। তিনি যেমন কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, তেমনি আমরা তাঁর কর্মচারীরাও দারিদ্রে দিন অতিবাহিত করছি। ভালো হয় যদি হুজুর ইংরেজ সরকারের পরামর্শ মেনে নেন এবং ভাতা গ্রহণ করে স্বাধীনভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ধার্মিক ও সমৃদ্ধ জীবন যাপন করেন।’
বাদশাহের কৃচ্ছ্রসাধন চলছিল, কিন্তু তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের দুঃখ হল বেশি। মোসাহেবদের বারংবার অনুরোধে হুজুর বিশেষ না ভেবেই ভাইসরয়-কে লিখলেন: ‘ইংরেজ সরকারের প্রস্তাবিত মাসোহারা নেওয়া আমার মঞ্জুর হবে। আমার এখন পর্যন্ত প্রাপ্য ভাতা দেওয়া হোক। লন্ডনে যে মামলা রুজু করা হয়েছে, তা তুলে নেওয়া হবে।’ উত্তর মিলল, ‘প্রথমত তো আপনাকে অতীতে প্রাপ্য মাসোহারা দেওয়া যাবে না, শুধু এখন থেকেই সে নির্দেশ জারি করা যাবে। দ্বিতীয়ত, বছরে কেবল বারো লাখ টাকাই দেওয়া যাবে, আর আপনার কর্মচারীদের জন্য বছরে যে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, এখন আর তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।’
এটা কল্পনা করা কঠিন নয় যে বাদশাহ হয়ত এই লোকসান বরদাস্ত করতেন না, কিন্তু মোসাহেবরা তাঁকে এই ব্যাপারে রাজি করাল। আর গভর্নমেণ্ট অব ইন্ডিয়া ইংল্যান্ডে খবর পাঠাল যে ওয়াজেদ আলি শাহ সরকারের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। অতএব তাঁর দায়ের করা মামলাটি খারিজ করে দেওয়া হোক। এই সব ঘটনা আমি খোদ আমার দাদু মুনশি কামারউদ্দিন সাহেবের মুখে শুনেছি, যিনি মহামান্য বাদশাহের সমর্থক, তাঁর দফতরের মির মুনশি এবং মৌলবি মসিহ্উদ্দিন খানের বিশেষ নায়েব ছিলেন এবং বাদশাহের প্রশাসনিক কাজকর্মের মূল দায়িত্ব সব তিনিই পালন করতেন। মাসোহারার ব্যাপারে বাদশাহের রাজি হয়ে যাওয়ার খবর লন্ডনে পৌঁছোতেই মসিহ্উদ্দিন খান প্রমাদ গুনলেন। বাদশাহের মা, তাঁর ভাই আর যুবরাজ বাদশাহের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেন। তাঁরা মনে করলেন এ কী সর্বনাশ হল! আফশোস এই কারণে যে সব কিছুই তো পুড়ে ছাই হয়ে গেল! শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে মসিহ্উদ্দিন খান একটা উপায় বার করলেন। পার্লামেণ্ট-এর কাছে এই আবেদন পেশ করা হল যে ‘বাদশাহ এই মুহূর্তে গভর্নমেণ্ট অব ইন্ডিয়ার হেফাজতে আছেন। তাঁর কোনও লিখিত আবেদনের ওপর প্রত্যয় রাখা যাবে না।’ এই দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে দাবি মেনে নেওয়া হল। গভর্নমেণ্ট অব ইন্ডিয়াকে বাদশাহের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত দাবির বিষয়েও জানানো হল। সেই সঙ্গে মসিহ্উদ্দিন খান এবং বাদশাহি খানদানের সদস্যরা বাদশাহকে লিখলেন যে, ‘এ আপনি কী সমস্যা সৃষ্টি করছেন! আমাদের মুলক-এ-আওধ ফিরে পাওয়ার সম্পূর্ণ আশা আছে।’
ততদিনে বিদ্রোহের আগুন নিবে গেছে। বাদশাহ সরকারি হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি খুশিতে ভরপুর হয়ে কেল্লা থেকে বেরিয়ে মেটিয়াবুরুজে পৌঁছেছেন। স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোসাহেবদের আর্জি এল, ‘হুজুর, লন্ডনে মসিহ্উদ্দিন খান বলছেন যে জাঁহাপনা আটক থাকার কারণেই মাসোহারা নিতে রাজি হয়েছেন।’ এটা শুনেই বাদশাহ ক্ষিপ্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ লিখে পাঠালেন, ‘আমি স্বাধীনভাবে এবং স্বেচ্ছায় গভর্নমেণ্টের প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। মসিহ্উদ্দিন খানের এই বক্তব্য একেবারেই ভ্রান্তিপ্রসূত যে আমি কয়েদ থাকার কারণে অথবা চাপে পড়ে বা ভয় পেয়ে আমার সম্মতি প্রদান করেছি। সুতরাং, আমি সেই আমমোক্তারনামাটি বাতিল করছি যার মাধ্যমে আমি তাঁকে জেনারেল অ্যাটর্নি নিয়োগ করেছিলাম।’
তা হলে আর কী বাকি রইল? কাজ যা করার ছিল সবই তো সারা হল। মেটিয়াবুরুজে বাদশাহের রঙ্গিবিরঙ্গী জীবনের সেই সূচনা। মোসাহেবদের ঘরে প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি, আর শাহী খানদানের হতভাগ্য শকটটি ইংল্যান্ডে পড়ে থেকে থেকেই নষ্ট হয়ে গেল। অধিকাংশ সহযাত্রী ছেড়ে গেল। জনাব-এ-আলিয়া, বাদশাহ-মাতা স্বয়ং সেই দুঃখে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিন্তু সেই অসুস্থ অবস্থায় ফরাসি মুলুক হয়ে মক্কা-কারবালার পুণ্যভূমি স্পর্শ করে তাঁর কলকাতায় ফেরার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মৃত্যু এসে তাঁকে প্যারিস-এর পরে আর এগোতে দিল না। সেখানে তাঁর ইন্তেকাল ঘটায় ফ্রান্সের ওসমানি দূতাবাস সংলগ্ন মুসলমানদের কবরস্থানে তাঁর দফন হয়। মায়ের মৃত্যুতে বাদশাহের ভাই মির্জা সিকান্দর হাশমত যে আঘাত পেলেন, তার পরিণামে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং মায়ের মৃত্যুর চোদ্দ-পনের দিন পরে তিনিও পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলে মায়ের পাশেই তাঁকে শেষ বিচারের দিনের অপেক্ষায় শায়িত রাখা হল। শুধু যুবরাজ একা কলকাতায় ফিরে তাঁর মা-বাপের সঙ্গে মিলিত হতে সক্ষম হন।
লোকে বলে যে মেটিয়াবুরুজে বসবাসের সূচনায় বাদশাহ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা এবং সতর্কতার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। এই দেখে পারিষদবর্গ কিছু বাদ্যযন্ত্র জোগাড় করে দিয়েছিল। অবিলম্বে সঙ্গীত-নৃত্যের প্রতি বাদশাহের পুরোনো প্রেম জাগরিত হয় এবং এখানেও রাজ দরবারে কলাকুশলীদের জমায়েত শুরু হয়। হিন্দুস্তানের তাবড় তাবড় গায়কেরা নিযুক্ত হন। ফলত, মেটিয়াবুরুজে সঙ্গীত পারদর্শী শিল্পীরা যেমন জড় হয়েছিলেন, তেমন ভূভারতে আর কোথাও হয়নি।
সুন্দরী নারীদের জমায়েত, সৌন্দর্য আর ভালোবাসার মোহিনী মায়াজালে মোহাবিষ্ট থাকার যে শখ লখনউতে শোনা যেত, তা এখানেও সঙ্গ ছাড়ল না। যদিও এই অভিলাষ চরিতার্থ করার সময় ধর্মীয় বিচার সম্পর্কে নবাব সচেতন ছিলেন। নবাব ইসলামের শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং শিয়া আইন অনুসারে অস্থায়ী বিবাহ বৈধ।
এই ধর্মীয় স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে নবাব প্রাণভরে তাঁর অন্তরের কামনা-বাসনা পূরণ করার প্রবণতা অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর বিধি ছিল কোনও মহিলাকে অন্তত সাময়িকভাবে বিবাহ না করে তাঁর দিকে না তাকানো এবং তিনি এই ধর্মীয় বিধিটির সীমা এতদূর বাড়িয়েছিলেন যে এমনকী অল্পবয়সী যুবতী ভিস্তি, যিনি তাঁর সামনে দিয়ে জেনানা মহলে জল নিয়ে যেতেন, তাঁর সঙ্গেও অস্থায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে নবাব আব রসান বেগম উপাধি দিয়েছিলেন অর্থাৎ পরম মহিমান্বিত জলবাহক! এক যুবতী ঝাড়ুদারনিও বাদশার সামনে আসত। তিনিও অস্থায়ীভাবে বিবাহিতদের তালিকায় যোগ দিয়েছিলেন এবং নবাব মুসাফা বেগম খেতাবে ভূষিত হন। একইভাবে, সংগীত উপভোগও বাদশাহের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ মহিলাদের সাহচর্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোনও তওয়ায়েফকে নবাবের সামনে মুজরা নাচতে দেখা যায়নি। এই অস্থায়ীভাবে বিবাহিত মহিলাদের নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী গঠন করা হয়েছিল এবং তাঁদের নানা ধরনের নাচ এবং গান শেখানো হয়েছিল। সেইসব গোষ্ঠীগুলোর নাম ছিল এই রকম: রাধা মঞ্জিল, সারদা মঞ্জিল, ঝুমার ('কানের দুল'), লটকান ('নথ'), নথ ('নাকছাবি'), ঘুংঘট ('ওড়না'), রাহস ('নৃত্য'), এবং নকল ('অনুকরণ')। এছাড়াও অনেক অনুরূপ গোষ্ঠী ছিল যাদের সেইসব নাচ ও গানে সেরা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যাতে নবাবকে আনন্দ দেওয়া যায়। নবাবও তাদের সবার সঙ্গে অস্থায়ী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাদেরকে বেগম বলা হত। কোনও কোনও গোষ্ঠীতে কয়েকজন অল্পবয়সী মেয়ে ছিল যারা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছোয়নি। তারা অস্থায়ী বিবাহের অবস্থায় ছিল না কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে অবিলম্বে শাদির ব্যবস্থা করা হত। এদের অধিকাংশ সুলতান খানায় নবাবের সঙ্গে বাস করতেন তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ অন্য বাড়িতে পৃথক মহিলাদের কুঠিতে থাকতেন। অস্থায়ীভাবে বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে যারা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তাদের 'মহল' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের থাকার জায়গার জন্য মহিলাদের পৃথক কুঠিবাড়ি দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা বর্ধিত ভাতা পেতেন এবং তাঁদের প্রচুর সম্মান ছিল।
ওপরে যা লেখা হল তার থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সংগীতানুরাগ বাদ দিলে বাদশাহ সব দিক থেকে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, সংযমী ছিলেন এবং মুসলিম ধর্মীয় আইন কঠোরভাবে পালন করতেন। নামাজ পড়া কখনও বাদ যেত না। তিনি রমজান মাসে ত্রিশ দিন পুরো রোজা পালন করেছিলেন। বাদশাহ আফিম, মদ এবং অন্যান্য নেশা থেকে আজীবন বিরত ছিলেন এবং মহরমের সময় তিনি শোকের অনুষ্ঠান আন্তরিক নিষ্ঠার সঙ্গে করেছিলেন।
বাদশাহের আরেকটি আগ্রহের বিষয় ছিল ইমারত অর্থাৎ ভবন নির্মাণ। সুলতান খানার চারদিকে মহিলাদের জন্য কয়েকটি মহল তৈরি করা হয়েছিল, মহিলাদের পৃথক বসবাসের স্থান সহ অনেক নতুন কুঠি নির্মিত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নবাব কেবল সুলতান খানা, আসাদ মঞ্জিল এবং মুরাসা মঞ্জিল পেয়েছিলেন, কিন্তু নিজের শখের জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাদশাহ আরও বেশ কয়েকটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন যা চারপাশে সুন্দর উদ্যান এবং মনোরম ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা ছিল। যে সময় আমি দেখেছি, সেই সময় দক্ষিণ থেকে উত্তরে বাদশাহের দখলে নিম্নলিখিত রাজকীয় কুঠি ছিল: সুলতান খানা, কসর-উল-বাইজ়া, গোশা-এ-সুলতানি, শাহিনশাহ মঞ্জিল, মুরাসা মঞ্জিল, আসাদ মঞ্জিল, শাহ মঞ্জিল, নুর মঞ্জিল, তফরিহ বকশ, বাদামি, আসমানি, তাহনিয়াত মঞ্জিল, হদ ই-সুলতানি, সাদ-ই-সুলতানি, আদালত মঞ্জিল। এগুলি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি কুঠি ছিল যার নাম আমার মনে পড়ে না।
এছাড়াও উদ্যানের অভ্যন্তরে পুকুরের ধারে অনেকগুলি একক কক্ষ, বাংলো এবং ছোটখাট প্রাসাদ ছিল। সেসব কুঠির মেঝেতে দাগহীন, অলঙ্কৃত কার্পেট বিছানো থাকত, রুপোর পালঙ্ক এবং বিছানা-বালিশের ব্যবস্থা ছিল। এই কুঠিগুলি ছবি এবং বিভিন্ন ধরনের সুন্দর আসবাবপত্রে সজ্জিত ছিল। আর মানুষের সহায়তার লক্ষ্যে কুঠির তত্ত্বাবধানের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গৃহকর্মী নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই কর্মীরা প্রতিদিন তাদের ঝাড়ামোছার কাজ করত এবং নিশ্চিত করত যাতে কুঠিগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। অর্থাৎ এইসব কুঠি, তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে এতই সাজানো-গোছানো থাকত যে কেউ তাদের প্রশংসা না করে থাকতে পারত না। কুঠিবাড়ির চারপাশে উদ্যান এবং ফুলের বাগানগুলি এমন জ্যামিতিক নকশা মেপে এবং এমন প্রকৌশলী দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ করা হয়েছিল যে দর্শকেরা বাদশাহের প্রতিভা এবং পরিমিতিবোধের পরিচয় পেয়ে তাজ্জব বনে যেত।
লখনউতে তো বাদশাহ কেবল কায়সার বাগ, আশপাশের কয়েকটি বাড়ি, একটি ইমামবাড়া এবং তাঁর মৃত পিতার জন্য একটি সমাধি নির্মাণ করেছিলেন, তবে মেটিয়াবুরুজে তিনি অপূর্ব কুঠিবাড়িতে সজ্জিত একটি সুন্দর শহরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নদীর ওপারে মেটিয়াবুরুজের ঠিক উল্টোদিকে কলকাতার বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন। তবে সেটি মেটিয়াবুরুজের পার্থিব স্বর্গ এবং তার আশ্চর্য শৈল্পিক নির্মাণের তুলনায় কিছুই ছিল না। এই সব ইমারত, বাগান, লতাবিতান এবং বিস্তৃত তৃণভূমিকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা একটি উঁচু প্রাচীর ছিল। পৌরসভার বড় রাস্তার ধারে প্রায় এক মাইল ধরে কিছু সুন্দর দোকান ছিল। সেগুলোতে সেইসব নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীর থাকার অধিকার ছিল যাদের কর্তব্যের কারণে সেখানে বাস করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যে সমস্ত প্রধান দরজায় পাহারাদার ছিল, কেবল সেই সব দরজা দিয়েই কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে; কোনও দোকানের ভেতর থেকে শহরে প্রবেশের উপায় ছিল না। খাস সুলতানখানা ফটকের কাছে একটি অনিন্দ্যসুন্দর নহবতখানা ছিল যেখানে ড্রামবাদক ড্রাম বাজাত আর পুরোনো প্রথা অনুযায়ী ঘণ্টা বাজিয়ে দিন এবং রাতের প্রহর ঘোষণা করা হত।
দুনিয়ায় স্থাপত্যকীর্তিতে আগ্রহী অনেক বাদশাহ ছিলেন কিন্তু নিজের দুর্ভাগা জীবন এবং তাঁর রাজত্বের স্বল্পকালীন সময়ে ওয়াজেদ আলি শাহের মত আর কেই বা এত ইমারত আর উদ্যান নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছেন? এ ব্যাপারে শাহজাহানের দ্বিতীয় আর যদি কেউ থাকেন, তাহলে তিনি হলেন দুর্ভাগা এই শাহ-এ-আওধ। তবে সেটা অন্য কথা যে শাহজাহানের নির্মিত সৌধগুলো শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর অন্যদের তৈরি শত শত ইমারত অল্প সময়েই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
স্থাপত্যকীর্তি ছাড়াও বাদশাহের পশুপাখির শখ ছিল এবং তাঁর এই আগ্রহটি অসাধারণ এবং অতুলনীয় ছিল। আর কেউ এই বিশেষ দিকটিতে এই বাদশাহের অর্ধেক প্রচেষ্টাও করেছেন বলে তো মনে হয় না। নুর মঞ্জিলের সামনে একটি বিশাল উন্মুক্ত জায়গা সুন্দর লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল যেখানে কয়েক’শ চিতল ও অন্য প্রজাতির হরিণ এবং অন্যান্য বন্য চতুষ্পদ ছেড়ে রাখা ছিল। সেই স্থানটির ঠিক মাঝখানে মর্মর বাঁধানো একটি সুনির্মিত পুকুর ছিল যা সর্বদা জলে ভরে থাকত। সেখানে তিতির, উটপাখি, টার্কি, সারস, রাজহাঁস, হেরন, বক, হাঁস, ময়ূর, ফ্ল্যামিংগো এবং শতাধিক অন্যান্য পাখি এবং কচ্ছপ ছাড়া হয়েছিল। পরিচ্ছন্নতার জন্য এমন যত্ন নেওয়া হয়েছিল যে কোনও পাখির বিষ্ঠা অথবা পালক কোথাও দেখা যেত না। পুকুরের এক দিকে ছিল বিশালাকৃতির বাঘের খাঁচা আর তার পাশেই ছিল লকড়ি দিয়ে তৈরি বড় বড় খাঁচা, যেখানে খোদায় মালুম কোথা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদর সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল। সেই সব বাঁদরেরা অদ্ভুত আচরণ করত আর মানুষকে তাদের খেলা না দেখে যেতে দিতে চাইত না।
বিভিন্ন জায়গায় চৌবাচ্চায় মাছ চাষ করা হত। মাছেরা ইঙ্গিত পেলেই এক জায়গায় জড় হয়ে যেত আর যদি কেউ তাদের দিকে খাবার ছুঁড়ে দিত, তাহলে তাদের লম্ফঝম্প দেখে সকলেই আশ্চর্য হত। সবার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল শাহেনশাহ মঞ্জিলের সামনে একটি বিশাল, দীর্ঘ এবং গভীর চৌবাচ্চা। সেই চৌবাচ্চার চারপাশ খুব পিছল ছিল আর তার মাঝখানে ছিল একটি কৃত্রিম পাহাড়, যার সামনের দিকটি ছিল ঢালু। সেখানে শত শত পাইপ লাগানো ছিল যার কয়েকটি উপর দিকে খোলা থাকায় ঝর্নার মত দেখাত। সেই পাহাড়ে ছয় থেকে নয় ফুট লম্বা হাজার হাজার বড়ো সাপ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যাদের সর্পিল চলন সেই পাহাড়ের গায়ে দেখা যেত। তারা একবার পাহাড়ের শীর্ষে চড়ে তো আবার নিচে নামে আর ব্যাঙ ধরে খায়। পাহাড়ের চারিদিকে এক ধরনের জলে ভরা পরিখা কাটা ছিল যেখানে সাপেরা সাঁতার কাটত আর ব্যাঙেদের তাড়া করত। লোকেরা ট্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ডরহীন হয়ে সেই খেলা দেখতে পেত। এই পাহাড়ের নীচে দুটি খাঁচা ছিল যেখানে দুটি বড়সড় চিতাবাঘ ছিল। তারা এমনিতে তো শান্ত থাকত, কিন্তু যখন মোরগ এনে খাঁচার মধ্যে ছাড়া হত তখন তারা লাফিয়ে পড়ে সেগুলোকে গোটা গিলে নিত। সাপকে বন্দি করে রাখার এমন ব্যবস্থা বোধহয় আগে কখনও করা হয়নি, ওয়াজেদ আলি শাহই প্রথম ব্যক্তি যিনি এমন ভাবতে পেরেছিলেন। ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা অবাক হয়ে সে দৃশ্য দেখতেন, ছবি তুলতেন আর বিশদ লিখে রাখতেন।
এইসব পশুপাখি ছাড়াও সুলতান খানাতেই চকচকে পিতলের পাখির খাঁচা ছিল কয়েক হাজার। সেখানে বেশ কয়েকটি বড় বড় হলঘর লোহার তারের জালে ঢেকে দেওয়া ছিল, যাকে কুঞ্জ বলা হত। বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য পাখি সেখানে রাখা হয়েছিল এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রজননের জন্য সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদশাহের ইচ্ছা ছিল বিভিন্ন প্রজাতির যত বেশি সম্ভব পশুপাখি সংগ্রহ করা। কোনও জীবন্ত যাদুঘরের এমন নিখুঁত উদাহরণ পৃথিবীতে হয়ত এর আগে কখনও পাওয়া যায়নি। এই সব পশুপাখি সংগ্রহে লাগামহীনভাবে অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল এবং কেউ যদি কোনও নতুন প্রজাতির পশুপাখি নিয়ে আসত, তাহলে সে যে দাম চাইত, বিনা বাক্যব্যয়ে তাই দিয়ে দেওয়া হত। কথিত আছে যে বাদশাহ এক জোড়া রেশমি পায়রার জন্য চব্বিশ হাজার টাকা আর এক জোড়া সাদা ময়ূরের জন্য এগারো হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। সেখানে আফ্রিকার খুব লম্বা এবং অদ্ভুতদর্শন প্রাণী জিরাফও একজোড়া ছিল। বাগদাদের ডবল কুঁজওয়ালা উট ভারতে কখনও দেখা যায়নি, তবে রাজা তাঁর চিড়িয়াখানায় তেমন একটি রেখেছিলেন। কলকাতায় হাতির দেখা পাওয়া যেত না, কিন্তু বাদশাহের এই ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম-এ একটা হাতিও ছিল। এমনকী একাধিক গাধা একটি চারণভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যেটা প্রমাণ করত যে সব ধরনের প্রাণীকে তাঁর চিড়িয়াখানায় রাখার ব্যাপারে বাদশাহ কতটা উৎসাহী ছিলেন। শিকারি পশুদের মধ্যে সিংহ, ভারতীয় বাঘ, চিতা, লেপার্ড ভালুক, বনবিড়াল, হায়েনা এবং নেকড়েদের ধরে বিভিন্ন খাঁচায় রাখা হয়েছিল এবং তাদের পরিচর্যা করা হত।
পায়রার ব্যবস্থা অন্যান্য পাখির চেয়ে আলাদা ছিল। তাঁর বিভিন্ন কুঠিতে বাদশাহ সব মিলিয়ে চব্বিশ-পঁচিশ হাজার পায়রা রেখেছিলেন আর তাদের ওড়ানোর জন্য কবুতরবাজেরা দুর্দান্ত দক্ষতা দেখাত। আট শতাধিক পরিচারক এবং প্রায় তিন শতাধিক কবুতরবাজের উপস্থিতি থেকে পশুপাখির জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হত সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা সম্ভব। প্রায় সমান সংখ্যক পরিচারক মাছের দেখাশোনা করতেন এবং সাপের জন্যও ত্রিশ বা চল্লিশ জন নিযুক্ত ছিলেন। এই পরিচারকরা বেতন হিসাবে মাসে ছয় থেকে দশ টাকা পর্যন্ত পেতেন। কর্মকর্তারা মাসিক বিশ থেকে তিরিশ টাকা বেতন পেতেন। কবুতর, সাপ এবং মাছ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর খাবারের জন্য মাসে প্রায় ন’হাজার টাকা খরচ হত। ভবন নির্মাণের দায়িত্ব মূলত মুনিস উদ দৌলা এবং রায়হান উদ দৌলার উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁদের মাসিক বেতন ছিল পঁচিশ হাজার টাকা।
প্রায় হাজার খানেক প্রহরী ছিল যাদের বেতন সাধারণত মাসে ছয় টাকা দেওয়া হত, যদিও কেউ কেউ আট বা দশ টাকা পর্যন্ত পেত। একই বেতন পাঁচশ'রও বেশি সংখ্যক গৃহকর্মীরা পেত। মালীরাও একই বেতন পেত এবং তাদের সংখ্যাও পাঁচশ’র বেশি ছিল। আশি'র মত বিদগ্ধ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহুরি ছিলেন যাঁরা মাসিক দশ থেকে ত্রিশ টাকা বেতন পেতেন। সম্মানীয় মোসাহেব এবং উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সংখ্যা সম্ভবত চল্লিশ বা পঞ্চাশের চেয়ে কম ছিল না এবং তাঁরা প্রত্যেকে মাসে আঠারো টাকা পেতেন। শতাধিক পালকিবাহক ছিল। এছাড়াও বহু ছোট ছোট বিভাগ ছিল যেমন বাবুর্চিখানা, আবদারখানা (জল ঠান্ডা রাখার জন্য), ভিণ্ডিখানা (সবজি রাখার জন্য), খসখানা (বাড়ি শীতল করার জন্য) - না জানি আরও কত কীই যে ছিল! এরপরে আবার অস্থায়ী স্ত্রীদের পরিবার এবং পুরুষ সদস্যরা ছিলেন, যাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের অবস্থানের অনুপাতে বেতন পেতেন।
এইসব মানুষেরা বাদশাহের আসল কুঠি এবং লাগোয়া জায়গার বাইরে নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি করে নিয়েছিল। এই নতুন বাড়িগুলির অধিকাংশ সেই জমির ওপর ছিল যা বাদশাহকে হস্তান্তর করা হয়েছিল, কিন্তু আরও অনেক বাড়ি আশপাশের জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। এইভাবে একটি শহর স্থাপিত হয়েছিল যার জনসংখ্যা চল্লিশ হাজারেরও বেশি। এঁদের সকলের জীবন এবং জীবিকা বাদশাহের মাসিক ভাতা এক লক্ষ টাকা থেকেই আসত। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী এত অল্প টাকায় কীভাবে বাঁচতে পারে তা কারও বোধগম্য হত না। এই কারণে বাংলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়েছিল যে বাদশাহের কাছে পরশ পাথর আছে, যখনই প্রয়োজন হয় তিনি লোহা বা পিতলে পাথর ঘষে সোনায় পরিণত করতে পারেন।
বাস্তব ছিল এটাই যে বাদশাহের বসবাসের কারণে কলকাতার পার্শ্ববর্তী এই স্থানটিতে একটি দ্বিতীয় লখনউয়ের জন্ম হয়েছিল। আসল লখনউয়ের সমাপ্তি ঘটেছিল, সে সংস্কৃতির পুরোটাই স্থানান্তরিত হল মেটিয়াবুরুজে। সত্যি কথাটা হল সেই দিনগুলিতে লখনউ আর লখনউ রইল না, মেটিয়াবুরুজই লখনউ হয়ে উঠল। সেই একই ব্যস্ততা আর আলোড়ন। সেই এক জবান, সেই শায়েরি, সেই কথোপকথন, সেই ধরনের শিক্ষিত এবং ধার্মিক মানুষ, সেই আভিজাত্য। সেই সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহোদয়, সেই আওয়াম, সেই সাধারণ মানুষ। কেউই কল্পনা করত না যে বাদশাহ বাংলার মাটিতে এসেছেন। সেই ঘুড়ি ওড়ানো, মোরগ আর পায়রার লড়াই, সেই আফিম-আসক্ত মানুষেরা সেই একই দাস্তান শোনায়, মহরমে সেই রকমই তাজিয়া বেরোয়, সেই শোকগাথা আর বিষাদগীতি, পুরোনো লখনউয়ের মত সেই ইমামবাড়া, সেই কারবালা। তবে যে চাকচিক্য ও আড়ম্বর নিয়ে, যে পরিস্থিতিতে এখানে বাদশাহের মহরমের জুলুসটি বেরোত, তা সম্ভবত তাঁর শাসনকালে লখনউয়ের আওধশাহীতে কখনও সম্ভব হত না। সিপাহী বিদ্রোহের পরে মহরমের তাজিয়ার শোভাযাত্রা কখনও পূর্বের গৌরব নিয়ে লখনউতে বের করা যেত না, তবে কলকাতার প্রান্তে মেটিয়াবুরুজে হাজার হাজার মানুষ এমনকী ব্রিটিশরাও সে তীর্থযাত্রায় শামিল হতেন।
বাদশাহ নিজে শিয়া গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাঁর কোনও ধরনের ধর্মীয় কুসংস্কার ছিল না। তিনি বলতেই পারতেন: 'আমার দুই নয়নের একটি শিয়া অপরটি সুন্নি।' একবার কোনও দু'জন লোকের মধ্যে কিছু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে মারপিট লেগেছিল। বাদশাহ আদেশ দিয়েছিলেন যে উভয়কেই বরখাস্ত করা হবে এবং তাঁদের পুনরায় চাকরিতে বহাল করতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, 'আমার কাছে এই ধরনের মানুষদের কোনও স্থান হবে না।' পরবর্তীকালে, বাদশাহের লেখা একটি বইতে কিছু অরুচিকর শব্দ ছাপা হয়েছিল যা কলকাতার সুন্নিদের মধ্যে অশান্তির কারণ ঘটিয়েছিল। কিন্তু কেউই জানত না যে এই শব্দগুলি বাদশাহের নিজের লেখা নয়, তিনি সেগুলো অন্য কোনও উৎস থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। বিষয়টি সম্পর্কে বাদশাহ যখন জানতে পারলেন, তখন তিনি বিনা অনুরোধে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত ছিলেন।
বাদশাহের ধর্মীয় পক্ষপাত অথবা কোনও সংস্কার না থাকার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে যখন দেখি যে তাঁর সম্পূর্ণ প্রশাসনটাই ছিল সুন্নিদের হাতে! প্রধান মন্ত্রী মুনসারিম উদ দৌলা বাহাদুর নিজে সুন্নি ছিলেন। মুখ্য সচিব মুন্সি উল সুলতান, যিনি এক সময় বাদশাহের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন এবং চিড়িয়াখানা, সচিবালয় এবং অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব সামলাতেন, তিনি সুন্নি ছিলেন। কোষাধ্যক্ষ আমানত উদ দৌলা বাহাদুর, যার কাছ থেকে সকল কর্মী এবং এমনকী বাদশাহের পরিবারের নারীরা এবং রাজপুত্ৰরা তাদের বেতন ও ভাতা পেতেন, তিনিও সুন্নি ছিলেন। আত্তার উদ দৌলা এবং সুপারিনটেনডেন্ট মোতাবর আলি খান, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে সব প্রতিষ্ঠানের জন্য দায়িত্বশীল সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁরাও দুজনেই সুন্নি ছিলেন। নিরপেক্ষতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ কী কেউ কল্পনা করতে পারে যে সিবতেনাবাদ ইমামবাড়া এবং মহলের খাস ইমামবাড়া যাকে বায়তুল বুকা অর্থাৎ বিলাপ ভবন বলা হয় তাদের পরিচালনার পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থার দায়িত্বেও ছিল সুন্নিরা। কে সুন্নি আর কে শিয়া তা কেউ ভেবেও দেখত না।
এমনকী মেটিয়াবুরুজের দোকানদার এবং মহাজনেরা লখনউয়ের বাসিন্দা ছিলেন এবং লখনউয়ের এমন কোনও পণ্য ছিল না যা সেখানে পাওয়া যেত না। যেদিকেই যান রাজকীয় জাঁকজমক আর ব্যস্ততা চোখে পড়বে। সকলেই তাদের আয়েশি ও সুন্দর জীবনে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে কারও ভবিষ্যতের কোনও চিন্তা ছিল না। লখনউয়ের জনগণ, সমস্ত রাজকর্মচারী এমনকী মেটিয়াবুরুজের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও প্রাসাদ এবং উন্মুক্ত প্রান্তরে অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকার ছিল। উদ্যানগুলিতে ঘুরে বেড়ানো, হাঁটার জন্য তার চেয়ে সুন্দর জায়গা আপনি কখনও পাননি। আপনি যদি নদীর তীরে দাঁড়ান, তাহলে চিত্তাকর্ষক দৃশ্য অবলোকন করবেন। কলকাতায় যে জাহাজগুলি আসা-যাওয়া করে, তারা আপনার সামনে দিয়ে চলে যাবে, ফোর্ট উইলিয়াম নজরে আসতেই তারা ঝাণ্ডা নামিয়ে সালাম জানাবে। সাধারণ মানুষ যদিও ভাববে যে তারা বাদশাহকেই অভিবাদন জানাচ্ছে। রাজপ্রাসাদের দেউড়ি অথবা জেনানা মহলের দরজায় দাঁড়ান, আপনার মন ভালোলাগার আবেগে ভরে যাবে। কখনও হয়ত বা কোনও সুন্দর মুখের ঝলক দেখবেন, এমন অলংকৃত আর আকর্ষণীয় জবান আপনার কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে. এমন মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনবেন, যে তার স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
আহ! সেই সুন্দর এবং চিত্তাকর্ষক দৃশ্যগুলো কী কখনও মুছে যেতে পারে? কিন্তু হায়, ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে তা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেল, যেন কখনও তার অস্তিত্বই ছিল না। মুহম্মদি ১৩১৬, ইংরেজি ১৮৮৭-তে বাদশাহ হঠাৎ চিরকালের জন্য চোখ বুজলেন। আর মনে হতে লাগল যা দেখা হয়েছিল তা কি খোয়াব ছিল, যা শোনা যেত তা কি শুধুই গল্পকথা? সবটাই হয়ত ছিল কল্পনা আর মায়া, একটা কল্পকাহিনী, যা সম্পূর্ণ মুছে গেল? যে সুন্দর স্থানটিতে ইউরোপীয় রাজারা এবং ভারতীয় শাসকেরা তীর্থ দর্শনে আসতেন, আজ তাকে এক বিশাল শূন্যতা ঘিরে ধরেছে। যিনি এর আগের রং ও রূপ কখনও দেখেছেন এবং এখন তাকে খাঁ খাঁ প্রান্তরে পরিণত হতে দেখছেন, তিনি গভীর দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেই পারেন, 'রহে নাম আল্লাহ্কা', একমাত্র ঈশ্বরই চিরন্তন। তাছাড়া আর কীই বা করার থাকে?
সূত্রোল্লেখ:
উর্দু:
১. হিন্দুস্তান মেঁ মশরিকি তামাদ্দুন কা আখরি নমুনা ইয়ানি গুজ়স্তা লখনউ; মৌলানা আব্দুল হালিম শরর লখনৌভি; সম্পাদনা: রশিদ হুসেন খান; মকতবা জামিয়া লিমিটেড; নতুন দিল্লি; পৃষ্ঠা ১০৯-১২০
ইংরেজি:
২. The Last King of India: Wajid Ali Shah; Rosie Llewellyn-Jones; Random House India
(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)
অলংকরণঃ আন্তর্জাল থেকে