নীনা আর রাজু খুব ভালো বন্ধু। নীনার ক্লাস থ্রি আর রাজু ক্লাস টু-তে পড়ে। ওরা দুজনে থাকেও একই পাড়ায়, একদম কাছাকাছি, একই রাস্তার কেবল এধার আর ওধার। স্কুলবাসে পাশাপাশি বসে বকবকম করতে করতে সকালে দুটিতে একই স্কুলে যায়, বাড়িও ফেরে বিকেলে সেই একসাথে। দুই বাড়ির বাবা-মায়েদের মধ্যেও যথেষ্ট চেনাশোনা আছে আর এই দুই বাড়ির দরজা একে অপরের জন্য সদাই খোলা।
নীনা মেয়েটা খুব শান্তশিষ্ট গোছের, একটু ভীতু প্রকৃতির, বড়দের কথা সব সময় মেনে চলে। কারণ ওর মা বলে দিয়েছে যে এর অন্যথা হলেই হয়তো কোনো সাংঘাতিক বিপদ ঘটে যেতে পারে। নীনা যে খুব পড়াশুনায় তুখোড়, তা কিন্তু নয়। আসলে ওই পড়াশুনার চেয়ে ছবি আঁকা, প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে ফুল পাখি গাছপালা তৈরি করা, এই সবেতেই সে অনেক বেশি আনন্দ পায়। আর ওর হাতের এই সব কাজগুলো হয়ও অতি চমৎকার, সব যেন একদম জীবন্ত। রাজুর খুব গর্ব তাই বন্ধুকে নিয়ে। এদিকে আমাদের রাজুবাবু যাকে বলে চরম বিচ্ছু প্রকৃতির দামাল ছেলে। তবে তার মাথা কিন্তু একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। জিজ্ঞেস করে দেখই না ওকে, ২২ টাকা ৭৫ পয়সা গুনতে কটা পাঁচ টাকা, কটা এক টাকা, আর কটা চার আনা লাগবে, তুরন্ত জবাব দিয়ে দেবে সে, মিনিট তিনেকের চেয়ে এক পলকও বেশি সময় তার লাগবে না। অংকে মাথা ওর যেমন খাসা, তেমনি যে কোনো কবিতা এক দুই বার পড়লেই ওর মনে থেকে যায় বহু দিন। কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? তা কোরো না। নিজেই জিজ্ঞেস করো ওকে মদনমোহন তর্কালঙ্কার মশাইয়ের লেখা প্রার্থনা কবিতাটি। দেখবে কিরকম গড়গড় করে বলে যাবে, যাকে বলে এক নিঃশ্বাসে। নীনা তো এইজন্যই রাজুর প্রশংসায় সবসময় পঞ্চমুখ।
তা পড়ার বইয়ে রাজুরও বিশেষ মন নেই, কিন্তু সেটার কারণ আবার অন্য। তার মাথাটায় যে সবসময় গিজগিজ করে যত রাজ্যের আজগুবি বুদ্ধি। এই তো গত শনিবারেই তো সেই বদখত কাণ্ডটা ঘটল। কি জানি কি কারণে একটা বারোয়ারি ছুটির দিন ছিল সেটা। রাজুর তো ভারী মজা। যাক বাবা একদিন অন্তত দিদিমনিদের ক্যাঁচোড়ম্যাচোর থেকে কান, মাথা রক্ষা পাবে। ছুটির দিনের ভুরিভোজটি সেরে সোফায় গ্যাঁট হয়ে বসে সে তো একটা সাইন্স চ্যানেল খুলে বসল। সেখানে তখন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাতে কলমে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত অনুকরণের নমুনা দেখাচ্ছিল। দারুণ মজা পাচ্ছিল রাজু। দেখতে দেখতে বেদম উৎসাহিত হয়ে সে ঠিক করেই ফেলে, নাহ, পরের মুখের ঝাল আর সে খাবে না। যে ভাবেই হোক নিজের এলেমে একটা ছোট মতো আগ্নেয়গিরি আজ সে বানাবেই বানাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রাজুর মা মন্দিরা আর রান্নার মাসি সারাদিনের হুজ্জুতি শেষে, দুপুরের খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে, সবে যখন টিভির জমজমাট সিরিয়ালে চোখ সেঁটে, একটু আমোদআহ্লাদ করছে, ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে রাজু পা টিপে টিপে রান্না ঘরে পৌঁছে, সাদা ভিনেগার, বাসন মাজার তরল সাবান, বেকিং সোডা, আর এই এত্তোটুকু খাবারে দেবার কমলা হলুদ রং একে একে দারুণ ক্ষিপ্রতায় সরিয়ে ফেলে। ব্যাস, সব সরঞ্জাম মোটামুটি জোগাড় হয়ে গেছে, বাকি শুধু দুই লিটারের একটা খালি সোডার বোতল আর খানিকটা গরম জল। তা সোডার বোতলটা মায়ের ভাঁড়ার থেকে সহজেই মিলে গেল। গরম জল পাওয়াটা অবশ্য একটু সমস্যা সৃষ্টি করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি করে দাদুর জন্য রাখা ফ্লাস্কের জলটাই সরাতে হলো। এরপর বসার ঘরের ঝকঝকে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে, মাল মশলাগুলো সব সোডার বোতলে ভরে দেওয়া মাত্র, কেল্লা ফতে! হয়েছে হয়েছে। আনন্দে আত্মহারা রাজু। চোখ বড় বড় করে নিজের কেরামতি দেখে সে। হিসহিস করে কেমন জেগে উঠছে আগ্নেয়গিরি। দেখতে দেখতে ভুসভুসে কমলা হলুদ রঙের ফেনারা ফুলেফেঁপে সোডার বোতলের সরু গলা উপচে গলগলিয়ে বেরিয়ে এসে, মুহূর্তের মধ্যে পরিষ্কার মেঝে পয়মাল করে দিল। তাতেও কি তারা ক্ষান্ত হয়? মন্দিরার বড় সাধের পার্সিয়ান কার্পেট এখন তাদের লক্ষ্য, কলকলিয়ে ধেয়ে চলেছে সেদিকে তারা। হতচকিত রাজু এতক্ষণে ছুটে গিয়ে তাদের গতিরোধের চেষ্টা করে বটে, কিন্তু সে গুড়ে বালি! তারপর আর কি? রান্নার মাসি রে রে করে ছুটে আসে, তার পাড়া কাঁপানো চিল চিৎকারে মায়ের সাধের সিরিয়াল দেখার মজার পুরো দফারফা। অতঃপর রাজুর পিঠে মায়ের হাতের বেশ কিছু চড়চাপড়ের ধুন্দুমার ছাড়া আর কিই বা আশা করা যায়? রাজুর অবশ্য এসবের জন্য কোনো হেলদোল নেই। সে তখনও মনে মনে এই ভেবে পুলকিত যে, তার এক্সপেরিমেন্টটা একটুও মার খায়নি। একদম একশো ভাগ সফল।
ভাবছ বুঝি এখানেই সব শেষ? মোটেই নয়। রান্না করার তেল, চুলের শ্যাম্পু, বাবার শেভিং ক্রিম, মায়ের বিদেশী পারফিউম সব কিছুই রাজুর দরকার তার নিত্যি নতুন এক্সপেরিমেন্টের জন্য। দ্যাখ না দ্যাখ তলানিতে এসে ঠেকছে ঘরের এইসব জিনিসপত্র। ওকে নিয়ে ওর বাবা-মা তাই সদাই সন্ত্রস্ত। না জানি কখন কি অঘটন ঘটায় ওই হার্মাদ ছেলে!
মন্দিরার আবার নিজস্ব অন্য আরেক ঝামেলা আছে। তিনি নিত্যি ভোগেন পেটের রোগে, খাওয়াদাওয়ার একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই তার নাজুক পেট প্রবল বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আর পেট গড়বড় করলে মাথাও যে বেসামাল হয় তা কেই বা না জানে? ডাক্তার-বদ্যি সব ফেল মেরে গিয়েছে এই সমস্যার সমাধানে। উনি এখন তাই টোটকা-টাটকির দিকে ঝুঁকেছেন। তা উনি লক্ষ করেছেন যে ওই ঠান্ডা মেন্থল সবুজ লেবু চা খেলে ওর পেট একটু কম অশান্তি করে। তা প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ নিয়ে তিনি এই বিশেষ চা বানাচ্ছিলেন, বাজার থেকে টাটকা টাটকা সব কাঁচামাল--এই যেমন সবুজ চা পাতা, পুদিনা পাতা, গন্ধরাজ লেবু ইত্যাদি সংগ্রহ করে, যাকে বলে একদম স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করা। গভীর অধ্যবসায়ের সাথে মহৌষধি চা বানানোর এই পর্ব চললোও কদিন বেশ ভালো। চা খেয়ে মন্দিরার পেট মাথা সব যেন একেকটি সুবোধ বালক। কিন্তু সংসারের হাজারো হ্যাপা পুষিয়ে আর রাজুর মতো দুষ্টু ছেলের সাতসতেরো বায়নাক্কা সামলে মন্দিরার আর ফুরসত মেলে না, এত খেটে, এই বিশেষ চা টি বানাবার। অগত্যা উনি অ্যামাজনের শরণাপন্ন হলেন। ওদের ক্যাটালগ নেড়ে ঘেঁটে মোটামুটি একই ধরনের একটা চায়ের সন্ধান পেলেন। প্লাস্টিকের বোতলবন্দি প্রতি ৫০০ মিলিলিটার চায়ের দামটা যদিও বেশ গায়ে লাগার মতোই, তবু শরীর বলে কথা। সুতরাং এটাই একমাত্র বিকল্প উপায়। তা অনেক ভেবেচিনতে এই ব্যাপারে পয়সার একটু সাশ্রয়ের তাগিদে তিনি ঠিক করলেন যে ওরকম একটা দুটো বোতল না কিনে চল্লিশ বোতলের পুরো এক পেটি চা কিনে নিলে মন্দ হবে না। তাহলে দামেও যেমন একটু কম পড়বে তেমনি সারা মাসের জন্য নিশ্চিন্তও হওয়া যাবে। তো সেইমতো উনি অর্ডার করে দিলেন এবং বোতল ভর্তি কার্ডবোর্ডের ঢাউস পেটিটা ঘরে আসা মাত্র মন্দিরা সেটা সোজা চালান করে দিলেন গাবদা রেফ্রিজারেটরের অন্দরমহলে। এতে চাও বেশ ঠান্ডা থাকবে আর রাজুর চোখের কিছুটা আড়ালেই থাকবে। যথেষ্ট কিপ্টেমি করে মাত্র একটি করে বোতল তিনি ধার্য করে রেখেছেন নিজের সারা দিনের বরাদ্দ হিসেবে।
এদিকে সেদিন হলো কি, স্কুলে যাবার সময় নীনা বললো, জানিস রাজু, আমাদের আর্টের একজন নতুন দিদিমনি এসেছেন, তিনি বললেন এবার একটা একদম অন্য ধরনের প্রকল্প করানো হবে। রাজু বলল, সেটা কিরকম? আবর্জনা মনে করে যেসব জিনিস আমরা ফেলে দিই সেগুলোকেই নতুন করে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার পদ্ধতি। দিদিমনি বলল এই প্রকল্পটার নাম….
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রাজু বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি জানি, ওটাকে বলে রিসাইক্লিং। রাজুর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে নীনা বলে, তোর কি বুদ্ধি রে রাজু. তাই শুনে রাজুর বুক তো গর্বে ফুলে ঢোল।
কিন্তু জানিস তো, এই প্রকল্পের জন্য তিন দিনের মধ্যে আমার অনেক কটা প্লাস্টিকের বোতল চাই, এত তাড়াতাড়ি কোথায় পাই বল তো? নীনা কাঁচুমাচু মুখে বলে। রাজু বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বলে, কোনো চিন্তা নেই, আমি তোকে জোগাড় করে দেব। কটা চাই, সেটা শুধু বল। নীনা তবু আশ্বস্ত হয় না। সন্দেহভরে বলে, কিন্তু সেতো অনেকগুলো বোতল, অন্ততঃপক্ষে কুড়িটা প্লাস্টিকের বোতল। তুই অতগুলো পাবি কোথায়? রাজু ম্যাজিসিয়ানের মতো রহস্যের হাসি হেসে বলে, দেখ না সব কেমন এনে দিই তোর জন্য। তবে হ্যাঁ, এই বোতলের ব্যাপারটা বড়দের কাউকে কিছু বলা চলবে না। জানিস তো বাবা-মাগুলোর কেমন সন্দেহবাতিক হয়, সারাক্ষণ পিছে পিছে লেগে থাকে একেবারে। ওদের চোখ এড়িয়ে একটা ভালো কিছু কাজ যে করব তার কি কোনো উপায় আছে?
দুদিন পরেই স্কুল ফেরার পথে রাজু বলে, নীনা আজ সন্ধ্যের সময় তুই আমাদের একতলার পেছনদিকের ব্যালকনিতে চলে আসিস। খুব সাবধানে আসবি, কেউ যেন দেখে না ফেলে। নীনা তো খুব অবাক হয়। কিসের এত লুকোছাপা? কিন্তু রাজু আর স্পিকটি নট। সন্ধ্যের সময় নীনা আসতেই রাজু চোরের মতো চুপি চুপি একটা পলিথিনের ধুমসো ব্যাগ নীনার হাতে গছিয়ে দেয়। নীনা উঁকি দিয়ে দ্যাখে ব্যাগ ভর্তি তার বহু ইপ্সিত প্লাস্টিকের বোতল। নীনা তো রাজুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে লাফাতে থাকে, সে বলে কোথা থেকে পেলি এতগুলো বোতল? একটু বল প্লিজ। রাজু হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, সেটা বলি তোকে আর তুই গিয়ে জন্যে দিস সবাইকে! কেউ এসে পড়ার আগেই যা পালা এইবেলা এখান থেকে। নীনা অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে অদৃশ্য হয়।
পরদিন বিকালে বাড়ি ফেরার পথে নীনা ইতস্ততভাবে বলে, এই রাজু খুব খারাপ লাগছে তোকে আবার জ্বালাতে, কালকের ওই ব্যাগে না ১৯টা বোতল ছিল রে, ১টা এখনও কম আছে, এদিকে কালকেই বোতল জমা দেওয়ার শেষ দিন রে। রাজু বলে সে কি? আমি তো ভাবলাম ২০টাই আছে, তাহলে কি ভুল গুণলাম? বলতে বলতে রাজুর বাড়ি এসে যায়। তুই এই গেটের সামনে একটু দাঁড়া, আমি আসছি এখুনি, বলে রাজু ছুটে ভিতরে চলে যায়।
মন্দিরা তখন খুরপি হাতে সামনের বাগানে ফুলগাছগুলোর তদারকি করছিলেন, রাজু দেখল পাশেই ছোট্ট বেতের চেয়ারে শোভা পাচ্ছে একটা সবুজ চায়ের আধাশেষ প্লাস্টিক বোতল আর মায়ের এমব্রয়ডারির সরঞ্জাম। মা ওর দিক থেকে পিছন ঘুরে উবু হয়ে মাটি খুঁড়ছেন। টেরও পাননি কখন রাজু নিঃশব্দে বাগানে ঢুকে ওনার কাছাকাছি এসে হাজির হয়েছে। এ যেন সোনায় সোহাগা। রাজু টুক করে বোতলটা নিয়েই ছুটে বাইরে অপেক্ষমান নীনার কাছে এসে পড়ে।
আরে, এটা তো শেষই হয়নি এখনও, নীনা বোতলটা দেখে বলে। রাজু কোনো উত্তর না দিয়ে বোতলের ঢাকনা খুলে ভিতরের অবশিষ্ট চা মাটিতে ঢেলে ফেলে। তারপর খালি বোতলটা নীনার হাতে দিয়ে বলে, এই নে তোর রিসাইক্লিংয়ের জন্য বাকি আরেকটা বোতল।
নীনা চোখের সামনে এই কাণ্ড দেখে তো থ। আমতা আমতা করে সে বলে, হ্যাঁ রে রাজু, ওই আগের বোতলগুলো কি তাহলে সব ভর্তিই ছিল?
রাজু নীনার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বলে, তা নয়তো কি? বোতলের চা আমি সব টয়লেটে ঢেলে ফ্লাশ করে দিয়েছি। তবে না তোকে দিতে পারলাম বোতলগুলো! নীনা যেন আর সহ্য করতে পারেনা। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে, মুখে হাত চাপা দিয়ে, উদ্গত আর্ত চিৎকারটা ঠেকিয়ে সে শুধু প্রশ্ন করে, কেন করলি এরকম? জানিস কত দাম এসবের? মন্দিরামাসি জানলে তোকে আর আস্ত রাখবে?
রাজু বিজয়ীর হাসি হেসে বলে, বা রে, এতো আমাদের রিসাইক্লিং প্রকল্পের জন্য। পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে তো আমাদেরকেই, তাই না? নীনা ফ্যালফ্যাল করে রাজুর দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল।
(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)