(একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)
ক্লাস ফোরে আমাদের আরও কিছু উন্নতি হল। ভোক্যাবুলারি বাড়ল। ইংরেজি বাংলা তো বটেই, বিশেষ করে প্রাকৃত শব্দের ভাণ্ডারে। এতদিন আগের ভাণ্ড অনেক সীমিত ছিল, যার উৎস ছিল পার্কসার্কাস পাড়ার ও বাজারের বড়দের কিছু আর্ষপ্রয়োগ।
যেমন একটি বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে আমাদের বারোয়ারি ফ্ল্যাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠত। তার নাম ছিল সুলতানি। সম্ভবতঃ ওরা ছিল বিহারি মুসলমান। কারণ, বাংলা বলত না। ওর মা পাশের কোন একটি ফ্ল্যাটে কাজের মাসি ছিলেন। আমরা বাচ্চাটিকে একা পেলেই দুহাত ছড়িয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াতাম। ও হাতের ফাঁক গলে যেতে না পারলে চ্যাঁ-ভ্যাঁ করে উঠত। সেটা ওর মায়ের কানে গেলেই ও তাড়াতাড়ি এসে মেয়েকে উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে গাল পেড়ে আমাদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করত। কিন্তু সেগুলো মাছ-মাংস গোছের নয়। বড়জোর পোল্ট্রির ডিমের মত। আর আমরা তাতেই বেজায় আমোদ পেতাম। সবচেয়ে চড়া সুরেরটি ছিল—হারামী কা পানা, শুয়ার কা বাচ্চা!
তবে স্কুলে এবং মণিমেলার মাঠে এল প্রাকৃত শব্দের জোয়ার। ব-জাত যে চার-পাঁচটা প্রচলিত এবং নারীপুরুষের অ্যানাটমি-ফিজিওলজি সম্পর্কিত যতগুলি।
কিন্তু আমার একেবারে শব্দকল্পদ্রুম হয়ে গেল। আজও যেমন ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধান গুলিয়ে যায়, সেদিনও কোথায় চন্দ্রবিন্দু লাগবে কোথায় লাগবে না—এটা ভুল হয়ে যেত। এমনকি কোন শব্দবিশেষ শরীরের কোন অঙ্গবিশেষের বিশেষ্য, তাও গুলিয়ে ফেলে সঙ্গীসাথীদের মধ্যে ক্যালানে উপাধি জুটল।
কিন্তু সবচেয়ে ধাঁধায় ফেলল মানুষের জন্মরহস্য। আমরা সব নারীর যোনিপথে নির্গত মানবক? না, না। এ মেনে নেওয়া যায় না। নিশ্চয়ই কোথাও কোন ভুল হচ্ছে।
ইচ্ছে হত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকেই জিগ্যেস করি—এমন কেন করলেন? কী উদ্দেশ্য?
শেষে এক জ্ঞানবৃদ্ধ মাথাটাথা চুলকে বলল—কর্পোরেশনের মেথরদের দেখেছিস? কেমন একটা বড় বাঁশের মত ঝাড়ু ঢুকিয়ে বদ্ধ নালীর মধ্যে গোঁত্তা মারে? তারপর জ্যাম সরে গিয়ে হড়হড় করে জল বেরিয়ে আসে?
পুরুষেরা হল মেথরের মতন। যোনিদ্বারে গুঁতো মেরে বাচ্চাটার বেরনোর পথ খুলে দেয়, এই আর কি!
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি কক্ষনো মেথর বা ঝাড়ুদার হব না। যদিও কিশলয়ে তখন সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের মেথর কবিতাটা পড়ানো হচ্ছে—কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য অশুচি? শুচিতা ফিরিছে সদা তোমারি পিছনে।
আসলে কবিতাটা পড়ে আমি আরও কনভিন্স্ড হয়েছিলাম যে মেথর অবশ্যই অস্পৃশ্য ও অশুচি।
ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে লিঙ্গবোধ। না, যৌনচেতনা নয়। দুটোকে গুলিয়ে ফেলা ভুল। ছেলে মেয়ে প্রভেদ আমাদের চোখে স্পষ্ট হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে পাড়ার অন্য ছেলেদের চেয়ে শিশুবিদ্যাপীঠের ছেলেরা কেন আলাদা হবে? মেয়েদের স্কুলে পড়ে বলে?
না, আমরা আমরা; ওরা ওরা। আমরা কিছুতেই ওদের মত হব না। নিজেদের আইডেনটিটি বজায় রাখব।
এবার সেলাই ক্লাসে উলবোনা শেখানো শুরু হল। আমরাও পটাপট শিখে ফেললাম—সোজা ঘর উল্টো ঘর তোলা; এককাঁটা সোজা এককাঁটা উল্টো বোনা; আবার দরকার মতো ঘর ছেড়ে দেওয়া বা ফেলে দেওয়া।
কিন্তু এর বেশি শিখব না। ছোট বাচ্চার মোজা ও টুপি বোনা শিখব না। সেগুলো বাড়ি থেকে মা-কাকিমা-মাসিপিসিদের দিয়ে করিয়ে আনব। আমাদের টিচাররা এই বিদ্রোহ হাসিমুখে মেনে নিলেন। মেয়েদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা, নাম-পাতাপাতি (আয় তো রে আমার টিয়েপাখি, বা কানের দুল!) এসব খেলব না। বরং ওই ছোট্ট উঠানের মধ্যে লাট্টু, হাত লেত্তি, ইয়ো-ইয়ো, আর মার্বেল নিয়ে গাইপার, সাইপার এইসব খেলব।
প্রেমমাসিমার ব্রতচারীর নেচে নেচে গান, (যেমন 'হল মাটিতে চাঁদের উদয়, কে দেখবি আয়। এমন যুগল চাঁদ কেউ দেখিস নাই, দেখসে নদীয়ায়।) চলবে না। কিন্তু 'আমরা বাঙালি সবাই বাঙলা মার সন্তান' চলবে।
আমরা এখন থেকে এক বেঞ্চে পাশাপাশি বসব না। ছেলের দল একসারি বেঞ্চে টিচারের মুখোমুখি বসবে। মেয়েরা ওদের দিকে পারপেন্ডিকুলার পঙ্ক্তি বানিয়ে আলাদা সারিতে।
গোল বাঁধল গানের ক্লাসে।
একটা ন্যাকা ন্যাকা গান হচ্ছিল।
"ধীরে ধীরে বায়ু বহিতেছে,ধ্যেৎ, কি সব আজে বাজে গান। আমি শিখব না।
অঙ্গে ভঙ্গে তরঙ্গ নাচিতেছে।
কুন্ঠিত সুললিত ভোমরা ফুলে,
সুন্দর মধুকর আইল রে।
তাল্লা-লা-লা, তাল্লা-লা-লা, তাল্লা-লা-লা, লা-লা-লা।"
শোভা মাসিমার সামনে এই বেয়াদপি! ওঁর হাতের চড় লিঙ্গভেদ জানে না।
কিন্তু উনি মারলেন না। বড় বড় চোখ করে বেশ শান্ত গলায় বললেন—তুমি কি একটু বড়দের মত গান শিখতে চাও? এরমধ্যেই গানের বেসিক শেখা হয়ে গেছে? বেশ।
আমি অবোধ বোদা মুখে চুপ করে রইলাম।
উনি সে বছর শেখালেন—তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!
শেষে একটি নজরুলগীতি—
"আজি প্রভাতী তারা পূর্বাচলে,বেশ চলছিল। কিন্তু এত সুখ কপালে সইবে কেন? আমাদের হেডমিস্ট্রেস হাসিমাসিমা, শান্ত সৌম্য স্নেহপ্রবণ মহিলা, রিটায়ার হলেন। ওঁর জায়গায় এলেন অমিয়ামাসিমা। ভারীক্কি গম্ভীর, নো ননসেন্স অ্যাটিচুড। অনেকটা অপর্ণা সেনের "৩৬ চৌরঙ্গী লেন" সিনেমার নতুন হেডমিস্ট্রেস মিসেস স্বামীনাথনের মতো দেখতে। উনি জয়েন করার প্রথম সপ্তাহের মাথায় আমাকে ডেকে পাঠালেন।
আশাপ্রদীপ আমি নিশির শীষমহলে।
রাতের কপোলে আমি ছলছল অশ্রুর জল,
আমি ধরণীতে হিমকণা নবদূর্বাদলে।"
আমার বাড়িতে চিঠি যাবে। আমি নাকি এত বখে গেছি যে মেয়েদের পোশাকের ছবি আঁকি, এই বয়সেই!
ক্লাসে একদিন বেজায় হল্লা! নতুন ভর্তি হওয়া মেয়ে সুমিতা নাকি রঞ্জনবাবুকে বিয়ে করবে বলেছে। সবার খ্যাপানোর চোটে বাবু নাজেহাল।
'রঞ্জন রায়,বাড়ি ফিরে ছুটির দিনে ছাদে লাট্টু ঘোরাতে ঘোরাতে নীচের তলার নিলোফার বলে মেয়েটির হাসি হাসি লজ্জা-লজ্জা মুখে শুনল—অ্যাই শোন, তোর বৌয়ের নাম জেনে গেছি,—সুমিতা।
পালকি চড়ে যায়,
পালকি থেকে বউ পালালো
হায়! হায়! হায়!'
বেজার মুখে পরের দিন ক্লাসে গিয়ে সুমিতাকে ধরল—এসব কী শুনছি রে? তুই কী সব বলে বেড়াচ্ছিস?
—ধেৎ, ওসব কিস্যু নয়। ড্রইং খাতায় বরবৌয়ের ছবি এঁকেছিলাম। তা নূপুর আমার মাথা খাচ্ছিল,—বৌটা কে রে? তো বললাম আমি আবার কে। তখন বলল —তুই কাকে বিয়ে করবি রে, বল না?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম—রঞ্জনকে। ব্যস্। সব ঝামেলা ও পাকিয়েছে, আমি না।
—আমার নাম নিলি কেন?
—কেন আবার? তুই তখন ক্লাসে ঢুকছিস, তাই তোর নাম মাথায় এল। নইলে কে তোর মত কাগতাড়ুয়াকে বিয়ে করবে?
ও এবার নূপুরের পেছনে লাগা শুরু করল।
—কী রে কুমড়োপটাশ?
—বাজে কথা বলবি না বলছি।
—আয়নায় নিজের চেহারা দ্যাখ, সোয়েটার মাফলার জড়িয়ে জুজুবুড়ি সেজেছিস, হি-হি!
নূপুর রাগে ফুলছিল।
রঞ্জন একটা চক নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে দুটো লাইন টেনে বলল—এই দ্যাখ তোর সোয়েটার, এই দ্যাখ তোর মাফলার। এই তোর কুমড়োপটাশ ফ্রক!
—কী হচ্ছে এসব?
ভারী গলার আওয়াজে সবাই চমকে উঠল।
ক্লাসে ঢুকছেন বাসনামাসিমা ও একজন ভারীক্কি চেহারার নতুন মহিলা।
—দেখুন না মাসিমা! এই ছেলেটা আমাকে ভ্যাঙাচ্ছে! আমার জামাকাপড় বোর্ডে এঁকে সবাইকে দেখাচ্ছে।
নতুন হেডমিস্ট্রেস অমিয়াদির চেম্বারে ঠিক হল যে স্কুলে ছেলেটার গার্জেনকে ডেকে পাঠাতে হবে। এই বয়সেই যে ছেলেমেয়েদের পরনের পোশাক নিয়ে ছবি আঁকে সে আজ নয় কাল স্কুলের পরিবেশ নোংরা করতে পারে।
কিন্তু বাসনামাসিমা আমাকে ভাল বাসতেন। উনি আমার সঙ্গে কথা বলে আমাকে দিয়ে ক্ষমা চাইতে বলে রেহাইয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। ব্যাপারটা আর আগে গড়ায় নি।
কিন্তু এত ভয় আমি আর কখনও পাই নি।
আজ বুঝি, এই অবস্থা ভয়ানক। ডিফেন্ড করা মুশকিল।
সাধু সাবধান।
ফির কহি কর অবধান।
—এই ছবিগুলো তুমি এঁকেছ?
—হ্যাঁ।
—এসব মাফলার সোয়েটার স্কার্ফের ছবি?
—হ্যাঁ।
—মেয়েদের মাফলার স্কার্ফের ছবি?
—হ্যাঁ।
—তার মানে তুমি মেয়েদের পোশাকের ছবি আঁকো?
—মানে—?
—সত্যি কথা বলো। —হ্যাঁ কি না, বলো?
—মানে—হ্যাঁ।
কী ডেঞ্জারাস ছেলে! নিজের মুখেই সব স্বীকার করছে। কোন লজ্জা, ভয়-ডর নেই?
[বুখারিন-জিনোভিয়েভ-কামেনেভরাও কি মস্কো-ট্রায়ালে এভাবেই দোষ স্বীকার করেছিলেন?
স্তালিনের সমালোচনা, ট্রটস্কির সমর্থন—মানে সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরোধিতা এবং শত্রুদের সঙ্গে গুপ্ত ষড়যন্ত্র?]
মাইরি! বল্লে পেত্যয় হবে না যে রঞ্জন গোটা লাইফে ওই একবারই মন দিয়ে পড়াশুনো করেছিল। ইংরেজি-বাংলা-ইতিহাস-ভূগোল মায় অংক পর্যন্ত। ফলে জীবনে সেই প্রথম ও শেষবার বাবু কেলাসে ফার্স্ট হল ও কাকার থেকে একটা ক্যারম খেলার প্র্যাকটিস বোর্ড উপহার পেল।
কিন্তু মার্কশীটে একটা পয়েন্ট থাকে 'স্বভাব-চরিত্র', তাতে লেখা রইল—"একপ্রকার"।
দাদু চটে লাল। ক্লাস ফোরের বাচ্চাছেলে, ওর ক্যারেকটার গুড হবে, তার বদলে কি না "একপ্রকার"—সো সো?
নিঘ্ঘাৎ ক্লাসে পাইজ্যামি করে! এটাও রঞ্জন ডিফেন্ড করতে পারল না, শুধু উকিল দাদুর সামনে প্লীড করল—নট গিল্টি!
বড়বেলায় অনেক পেজোমি করেও কলেজ-ইউনি লেভেলে ক্যারেকটার কলামে সবসময় গুড পেয়েছে। আর চাকরি করতে গিয়ে জেনেছে যে কারও সিআর লিখতে গেলেও ট্রেনিং লাগে। কোন শব্দের কতখানি ওজন আর সেটা কোন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে অনেক শিক্ষিত লোকই অজ্ঞ।
কিন্তু ফাইভে ওর বেশ কিছু বন্ধু গার্লস্ স্কুল ছেড়ে বয়েজ স্কুলে চলে গেল, যেমন মডার্ন হাই, জগবন্ধু, তীর্থপতি, রামচন্দ্র। দু একজন যোধপুর পার্ক বয়েজ। একজন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট। ওর বাড়িতে বলা হল—আর একটি বছর অপেক্ষা কর। ততদিনে আমরা ঠিক করে ফেলি তুমি কোথায় যাবে। তুই হইলি জয়েন্ট ফ্যামিলির নতুন জেনারেশনের প্রথম সন্তান। তরে দেইখ্যাই ছূটরা পথ লইব। নইলে 'ঘর নষ্ট, বড় ভাই পাগল'। কাজেই—! এবার ডে সেকশন, দুপুর বেলা। শুধু ক্লাস ফাইভে ছেলেদের রাখা হয়। বছরটা কাটল ভালই। কিন্তু শুরু হল যা তা ভাবে। দুদিন আগে মর্নিং সেকশনের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। আজ ডে-সেকশনের পালা। বন্ধুরা হল—চল, দুপুরে হাসি-কান্নার প্লে দেখবি?
—সে আবার কী?
—আরে দুপুরে ১১টা নাগাদ বড়দের রেজাল্ট বেরোবে। দেখবি কেউ হাসতে হাসতে বেরোচ্ছে, আর কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে। আমরা গতবছরও দেখেছি।
অদম্য কৌতূহলে ওদের সঙ্গী হই। একটু দেরি করেই স্কুলে পৌঁছেছিলাম। সে কী সিন!
বিভিন্ন ক্লাস থেকে সিনিয়র মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে বেরোচ্ছে। কেউ কেউ ফোঁপাচ্ছে, কেউ তারস্বরে বিলাপ করতে করতে। অনেকে নিজের টিচারের হাত ধরে বা বুকে মাথা রেখে কাঁদছে।
—ও দিদি গো! আমি কী করে মুখ দেখাব? কী করে বাড়ি ফিরব? আমার ভাল লাগছে না।
এবার ক্লাস এইটের মেয়েরা বেরোল। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ফিস ফিস করছে—জানিস, প্রীতি দত্তও ফেল করেছে!
চমকে উঠি—প্রীতি দত্ত যে আমাদের পাশের বাড়ির টুনিদি!
চুপচাপ কেটে পড়ি, একাই বাড়ি ফিরে আসি।
আমাদের মূল বিল্ডিং-এর পেছনে একটা টিনের চালের চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া নতুন ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অনেক স্বাধীনতা। সামনে বড় আঙিনা। সেখানে মার্বেল ডান্ডাগুলি খেলতে পারি। বন্ধুর লাট্টুর গায়ে গচ্চা মেরে ফুটো করে দিতে পারি। আবার জল জমলে কাগজের নৌকো ভাসাতে পারি।
আর পেয়েছিলাম কিছু বেশ ভালো টিচার। ইতিহাসের প্রতিমাদি, অংক ও অন্য সাবজেক্টের অপর্ণাদি এবং ইংরেজির দু'জন।
একজন; লাবণ্যপ্রভা দাশ, কয়েকবছর আগে প্রয়াত কবি জীবনানন্দের স্ত্রী, আর আমাদের হেডমিস্ট্রেস শৈল সেন, আমাদের শৈলদি।
প্রবাদপ্রতিম শৈল সেন তখন প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির লীডার ও ভালো বক্তা; একসময় নাকি নেতাজির সহযোগী ছিলেন। আমাদের ইংলিশ র্যাপিড রীডার পড়াতেন। ছিপছিপে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের শৈলদিকে কখনও হাসতে দেখিনি। কিন্তু ক্লাসে সবাই একাগ্র।
লাবণ্যদি ঢাকার মেয়ে, অথচ বিশুদ্ধ ঘটি উচ্চারণে থেমে থেমে কথা বলতেন। সাদা সিল্কের পাড়হীন শাড়িতে একধরনের পিউরিটান হাওয়া নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন। শুনেছি উনি একসময় রঙমহলে "ঘরে বাইরে" নাটকে মেজবৌরানির ভূমিকা করেছিলেন।
একদিন উনি ক্লাসে এসে চুপ করে বসে রইলেন। বললেন—আজকে আমি পড়াতে পারব না। এই দিনেই উনি চলে গিয়েছিলেন। উনিও ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন।
ক্লাসে নোটিস নিয়ে ঢুকত কালো মোটাসোটা শ্যামভাই, যতক্ষণ টিচার নোটিস পড়ে দস্তখত করতেন ততক্ষণ শ্যামভাই শব্দ করে নাক টিপে আঙুল দিয়ে সবার দিকে নাকের পোঁটা দেবার অ্যাক্টিং করত। সবাই ছি-ছি করত, ভয় ও পেত, কিন্তু "শ্যামভাই আমাকে, শ্যামভাই আমাকে," করে চেঁচাত।
ক্লাস ফাইভে এসব মজা বন্ধ হয়ে গেল।
কেমন করে যেন আমাদের ক্লাসে দুজন মনিটর হল। ছেলেদের প্রতিনিধি আমি আর মেয়েদের ফুলকপিপাতার মতো ঝাঁকড়াচুলো সুপ্তি।
আমরা বসি প্রথম পাঁচটি বেঞ্চ দখল করে, টিচারের সামনে সোজাসুজি। সুপ্তিরা বসে আমাদের সঙ্গে একটি সমকোণ তৈরি করে চারটি বেঞ্চে। অবশ্যি আমাদের লাইনের লাস্ট বেঞ্চটিতে বসে জনা চারেক মেয়ে, যারা বয়সে একটু বড় বা গতবছর ফেল করে আমাদের সঙ্গী হয়েছে। ওদের মধ্যে কেমন যেন দিদি দিদি ভাব।
ততদিনে মালঞ্চ পড়ে ফেলেছি। কোন কাকার বিয়েতে পাওয়া উপহার। সেইসব দিনে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিদের বিয়েতে রবি ঠাকুরের বই, সুবোধ ঘোষের ভারত প্রেমকথা আর আঁতলেমি দেখাতে বিনয় ঘোষের কলকাতা কালচার জাতীয় বই উপহার দেওয়ার বেশ চল ছিল। আর ছিল ফুলদানি ও টেবিল ল্যাম্প।
সে যাকগে, রবি ঠাকুর শিখিয়ে দিলেন যে নারীদের দুটো জাত—স্নেহশীলা মা-বোনের জাত, অথবা আধেকঘুমে নয়নচুমে গোছের প্রিয়া জাত।
তা পেছনের রিজার্ভ বেঞ্চের ওরা প্রথম জাতের। ওদের সঙ্গে কোন রেষারেষি নেই। ওরা পরম স্নেহে আমাদের দুয়েকজনের সেলাইয়ের হোমটাস্ক, যেমন বাচ্চার উলের টুপির গায়ে একটা ফুলফুল সুতলি মতো পরিয়ে দেওয়া, যেটা ধরে টানলেই খোকনের টুপিটা একটু টাইট হবে ইত্যাদি। বদলে আমরাও ওদের অংক ইংরেজির হোমটাস্ক করে দিতাম।
কিন্তু সমকোণে বসা ওদের মানে সুপ্তির ব্যাটেলিয়নের সংগে চরম জেদাজেদি। ওদের কেউ পড়া না পারলে আমাদের দাঁত বেরিয়ে পড়ত, খালি হাততালি দেওয়াটাই বাকি থাকত। একই ব্যাপার ঘটত ওদের শিবিরেও।
ঘুম থেকে জেগে উঠছে লিঙ্গবোধ। ওরা-আমরা বোধ।
আমরা নিজেদের মধ্যেই ওদের ভাগাভাগি করে নিয়েছি। সুপ্তি ও রাত্রি আমার। কেতকী ও গায়ত্রী প্রদীপের, দীপ্তি ও জয়তী সুদীপের। বলা বাহুল্য যে এব্যাপারে মেয়েদের কোন মতামত নেওয়া হয় নি। প্রশ্নই ওঠেনি।
তবে কি পিতৃতন্ত্র, ক্ষমতা ইত্যাদির ব্যাগেজের বীজ তখন থেকেই কিশোর মনের উর্বর ভূমিতে পোঁতা হচ্ছিল?
যেমন শীতের পর বসন্ত আসে, তেমনি এল লিঙ্গবোধের পর যৌনতার গা শিরশিরে হাওয়া। আমাদের দিকেও ছিল ফেল করে দুক্লাস নীচে সহপাঠী হওয়া জনাদুই। তাদের একজনকে হিংসে করতাম অসম্ভব সুন্দর হাতের লেখার জন্যে। আর বড় ভাল গান গাইত। একদিন টিফিনের সময় পেছনের বেঞ্চে বসে "এই রাত তোমার আমার, শুধু দুজনে" শুনিয়ে আমার মনখারাপ করে দিয়েছিল। সে কবিতাও আবৃত্তি করত ভাল। পাড়ার ফাংশনে প্রাইজ পেত।
ও একদিন মিচকে হেসে একটা লাইন শোনাল—"খাজুরাহ কোনারক বুকের উঠানে"।
না বুঝে ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো তাকিয়ে আছি দেখে সস্নেহে টীকা করে দিল। উদাহরণ দিল দীপ্তির পুরন্ত শরীরের। আমরা হেসে ফেললাম, ওকে শকার-বকার শোনালাম। তারপর সুদীপকে কংগ্রাচুলেট করলাম গার্লফ্রেন্ড সৌভাগ্যের জন্যে। সুদীপ প্রথমে আত্মতৃপ্তিতে মোরগের মত ফুলে উঠল। তারপর কারও মুখে 'দারুণ মাল রে!' বাক্যবন্ধ শুনে হিংস্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আমরা তখনও নষ্টফল হয়ে যাইনি।
ষোলোআনা বাঙালিয়ানা—একটা খাবারের দোকানের নাম।
বাঙালিয়ানা তো বুঝলাম—ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন, বাইরে কোঁচার পত্তন!
কিন্তু ওই ব্যাটা ষোলোআনা! আমি যে শিশুবিদ্যাপীঠ স্কুলে ক্লাস ফোর অব্দি এই শিখেছিলাম যে চার পয়সায় এক আনা আর ষোলো আনায় একটা গোটা টাকা! তখন এক পয়সা দুপয়সা হত তামার, দুপয়সার মাঝখানে একটা ফুটো থাকত। সেটা কালো সুতো গালিয়ে ন্যাংটো-পুঁটো বাচ্চাদের কোমরে বেঁধে দেওয়া হত, যাতে নজর না লাগে।
আর চার আনাকে বলা হত সিকি, আট আনাকে আধুলি।
তামার এক পয়সায় একটা ঘোড়ার ছাপ থাকত আর আধুলি টাকায় কোন বিলেতি রাজা বা রানির মুকুট পরা ছাপ। তাহলে ষোলো আনা= ৬৪ পয়সা= ১ টাকা।
তবে ক্লাস ফাইভে পৌঁছেই হোঁচট! সরকার বাহাদুর নয়া পয়সা বলে এক আজব বস্তু চালু করেছেন, দস্তায় তৈরি, ছোট ও অনেক হালকা।
এবার একটা দশপয়সা আর একটা দু'পয়সা মিলে দু'আনা। কিন্তু চার আনার সময় আরো এক পয়সা বেড়ে যাবে, অর্থাৎ বারো+ বারো= ২৪ পয়সায় চার আনা নয়, হবে ২৫ পয়সা।
মামাবাড়ির আবদার!
তাই এখন থেকে ৬৪ নয়, একটাকা= ১০০ পয়সা।
মনে হত কেমন যেন ঠকানো হচ্ছে।
অংকের বই পাল্টে গেল। অংকের প্রশ্নগুলোয় ২৫ পয়সা না লিখে লেখা হতে লাগল ২৫ ন প। এই নয়া পয়সা বা ন প'র অত্যাচার বেশ কয় বছর সহ্য করতে হল।
আগে একটা তামার পয়সা দিলে স্কুলের ছোট্ট ক্যান্টিন থেকে একটা টকঝাল ত্রিফলা লজেন্স পাওয়া যেত আর চারটি পয়সা দিলে স্কুলের বাউন্ডারির টিনের বেড়ার ফাঁকে রাস্তা থেকে একটা দুধের আইসক্রিম কেনা যেত। এখন ছোট ছোট হজমি গুলি কিনতেও দু'নয়াপয়সা লাগে।
রঞ্জনের যে কি হল! এইসব অবিচার অত্যাচারের কথা ভাবতে ভাবতে ও নয়াপয়সা দিয়ে তৈরি অংকগুলো কষতে গিয়ে সমানে ভুল করতে লাগল।
ওকে বোঝানো হল—এখন থেকে চলবে মেট্রিক সিস্টেম। দশ আর একশ'র নামতা সবচেয়ে দরকারি। কিন্তু ও যে বুঝেও —বোঝে-না কেস।
সেন্টি-মিলি-ডেসি আর ডেকা-হেক্টো-কিলো ওর কাছে যেন কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো! ওকে শেখানো হল ফর্মুলাঃ ডেকে-হেঁকে-কিল-মারো বললে মনে যেন পড়ে ডেকা-হেক্টো-কিলো-মিলিরা! কিন্তু ভবি ভোলে না।
আজও বাবু ফুট-পাউন্ড-সেকেন্ডের জগতে আটকে আছেন। বউ নিজের হাইট ১৬৪ সেমি বলে ওনার হাইট জানতে চাওয়ায় উনি ভির্মি খেয়েছিলেন।
টিচাররা ওর অংকে দুর্দশা দেখে বলতে লাগলেন ছেলেটা বখে যাচ্ছে। ওর আর দোষ কি! ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়লে যা হয়! হেডমিস্ট্রেসকে বলতে হবে আগামী বছর থেকে যেন ছেলেদের না নেওয়া হয়।
হ্যাঁ, এই কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। দিনে দিনে বাড়ে। এই শেষ, আর নয়। গার্লস স্কুলে ছেলেদের নেওয়ার কোন মানে হয়? ওরা পড়াশুনো করেই না, খালি উৎপাত করে।
মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে যায়। আমরাই যত আপদ। শিশুবিদ্যাপীঠের নন্দনকাননে রাক্ষস খোক্কসের দল! বলে কিনা পড়াশুনো করি না। একদিনও হোমটাস্ক না করে ক্লাসে আসি? তবে হ্যাঁ, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে দু'একজন—। সে তো ব্যতিক্রম! মেয়েরাই কি সব ফার্স্ট হয় নাকি? বল্লে হবে। এমনি ওরা-আমরা তো আমাদের পাড়ায় বাঙাল/ঘটি নিয়েও শুনে থাকি।
যাকগে, আগামী বছর তো চলেই যাবো। বেশ হবে। কোন বয়েজ স্কুলের মাঠে ফুটবল ক্রিকেট ডাংগুলি খেলা যাবে। এখানে কী হয়? এক্কাদোক্কা? নাম-পাতাপাতি? আয়রে আমার বকুলফুল! দূর! দূর! চলুক রাজিয়া সুলতানের রাজত্বি।
প্রদীপ শুনিয়ে দিল ফিল্মি গানের বাজারচলতি প্যারডিঃ
মেয়েরাই মন্ত্রী, মেয়েরাই পুলিশ,আমাদের দন্তরুচিকৌমুদী কেলাসিত।
মেয়েরাই সব পকেটমার।
মেয়েদের দুনিয়া লও ভাই জানিয়া,
ছেলেদের দুনিয়া থাকবে না আর।
তবু কোথাও যেন একটু বেসুর বাজে। আমার যে ওই কপিপাতা চুলের সুপ্তি, ওই যে মনিটর, ওর চুল ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করে। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যাওয়ায় বখা ছেলেটা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠলঃ
ইচ্ছা করে - ও পরাণডারে গামছা দিয়া বান্ধি,ইদানীং কাছেই গুরুসদয় দত্ত রোডের কোনায় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের মাঠের উল্টোদিকে একটা পেল্লায় বাড়িতে খুলে গেছে বিড়লা মিউজিয়ম অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। একদিন ক্লাস টিচারের সঙ্গে সারি বেঁধে আমরা, মানে ক্লাস ফোর থেকে সিক্স, চললাম মিউজিয়ম দেখতে।
আইরন বাইরন কইলজাডারে মশলা দিয়া রান্ধি।
দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগা্ছ!
কল খুলতে হয় না, নীচে হাত পাতলেই জল পড়ে, হাত সরলেই বন্ধ। একটা ঘরের দরজার সামনে গুড মর্নিং বললেই দরজাটা আপনা থেকে খুলে যায়, ভেতরে পা রাখলে লাইট জ্বলে ওঠে আর চেয়ারে বসলেই জ্বলে টেবিল ল্যাম্প। তারপর বেরিয়ে আসতে আসতে আপনা আপনি সব একে একে বন্ধ হতে থাকে! এতো আলাদিনের জিনের কাণ্ড!
এসব দেখে আমাদের বিজ্ঞানচেতনা কতদূর এগোলো তা জানিনে তবে ভূতে বা পৌরাণিক জগতের অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল তা হলপ করে বলতে পারি।
এর পর টেলিভিশন? ১৯৬০ সালে? স্পষ্ট দেখছি একগাদা উজ্বল আলোর সামনে দাঁড়িয়ে সুপ্তি গাইছে 'আগুনের পরশমণি' বা সিক্সের বীণাদি গাইছে "ঝিকমিক জোনাকির দীপ জ্বলে শিয়রে", কিন্তু আমরা একটা বাক্সমতো তার গায়ে ঝিলমিলে পর্দায় ওদের দেখতে পাচ্ছি, ওদের গান শুনতে পাচ্ছি।
এও সম্ভব!
গুরু কাঙাল জানিয়া পার করো।
তারপর আমরা আবার লেফট রাইট করে স্কুলে ফিরে এলাম।
সবার সামনে টেলিভিশনে না ঘাবড়িয়ে ভালো গাইতে পেরে সুপ্তি গোটা স্কুলে বিখ্যাত হয়ে গেল। গানের টিচার শোভাদি পর্য্যন্ত জিজ্ঞেস করলেন—বাড়িতে গান শিখছ? কার কাছে? তোমার গলায় ভালো দানা আছে। নষ্ট কোরো না।
গলায় দানা? সে আবার কি? হ্যাঁ, কপিপাতা মেয়েটির গলায় একটা পুঁতির দানাওলা মালা দোলে বটে।
—অ্যাই, কেমন লাগছিল রে? ভয় পাসনি?
—বেশ ভয় পেয়েছিলাম। অত চড়া আলো চোখে পড়ছিল। হাত দিয়ে আড়াল করতেই লোকটা বকে দিল। সোজা হয়ে দাঁড়াও খুকি, হাত নামাও।
কিন্তু উল্টোদিকের ফুটপাতেই যে সুপ্তির বাড়ি, দোতলা থেকে ওই সময়টায় ওর রেওয়াজের গলা ও গানের শিক্ষিকার চাপা ধমক ভেসে আসে।
কখনও "তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!", নইলে সলিল চৌধুরির নতুন হিট পুজোর গান—"যারে, যারে উড়ে যারে পাখি!"
ও উদাস হয়ে যায় আর লোপ্পা ক্যাচ মিস করে ফিরদৌসের গালাগাল শোনে। এরপর একটা সোজা রান আউট মিস করলে ফিরদৌস বলটা সজোরে ওর গায়ে ছুঁড়ে মারে—এই বাচ্চাগুলিরে কাইল থেইক্যা খেলায় নিমু না! তুই বাড়িত যা!"
ও বাড়িতে যায় না। সূর্যডোবার মুখে করপোরেশন স্কুলের সিঁড়ির ধাপে ক্লান্ত প্লেয়ারদের পার্লামেন্ট বসে। সেইখানে এককোণে রোগা প্যাংলা হরিদাস জায়গা করে নেয়।
তখন ওদের মধ্যে সদ্য কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হওয়া, সম্ভবতঃ আই কম, ঝন্টুদা নিজের নতুন প্রেমে পড়ার গল্প শোনায়। লালটু-বিল্টুরা মুগ্ধ হয়ে শোনে। ঝন্টুদা পাড়ারই বন্ধুর বোনের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটির বাবা বাইরে কাজ করেন। তো ওর মার মৌন প্রশ্রয়ে ঝন্টুদাই এবছর ওকে সঙ্গে নিয়ে শিশু বিদ্যাপীঠের ক্লাস টেনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। পরশু বোর্ড পরীক্ষার (স্কুল ফাইনাল) ফর্ম ও ফীস জমা করিয়ে দিয়েছে।
কী আশ্চর্য! প্রেমে পড়ে তো উত্তমকুমার! তাহলে কন্ঠার হাড় বেরনো খ্যাংরা কাঠি দাঁত উঁচু ঝন্টুদা প্রেমে পড়ল কী করে? তবে কি আমিও?
চারমিনারে উদাস টান দিতে দিতে ঝন্টুদা বলে—ওর প্রেমে পড়ার পর আমি আর কোন মেয়ের দিকে তাকাই না।
সবাই চুপ।
শুধু ফাইভে পড়া রঞ্জন ভাবে প্রেমে পড়লে আর কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না? এটাই রীতি? তাহলে আমার আর প্রেমে পড়ে কাজ নেই।
কিন্তু সুপ্তিদের বারান্দা থেকে ভেসে আসে সন্ধ্যা মুখুজ্জের গান—
মালার শপথ লাগি ভুলো না আমারে,আর ওর গলার কাছে কি যেন গলা পাকিয়ে ওঠে!
কাঁদাও কেন যে শুধু ভালো বাসো যারে!
এমন সময় আড্ডায় এসে হাজির হলেন চিত্রেশ দাস। নৃত্যভারতী স্কুলের কত্থক শিক্ষক গুরু প্রহ্লাদ দাসের ছেলে। টি শার্টের ফাঁক দিয়ে হাতের গুলো গুলো বাইসেপ দেখা যাচ্ছে।
উনি এসেছেন অন্য পাড়ার সঙ্গে এপাড়ার সদ্য ঘটে যাওয়া মারপিটের নেগোসিয়েশন করাতে। ওঁর হাসি হাসি বড়বড় দাঁতের ফাঁকে কিছু শব্দ, আস্তে আস্তে পারা চড়তে থাকে।
ওর এসবে কোন উৎসাহ নেই। কোন পাড়ামার্কা সেন্টু নেই। আর দোতলা থেকে গানের আওয়াজ থেমে গেছে। সুপ্তি হয়ত পড়তে বসেছে।
ও বাড়ি ফেরে।
কপিপাতা সুপ্তির সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে যায়। ওরা কথা বলে। আশকথা, পাশকথা। রঞ্জন ওর বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে বকবক করে যায়, ও হেসে যোগ দেয়। কখনও জানায় নতুন কী রাগ বা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছে। ওরা তিনবোন। কিন্তু গানের টিচার ওকেই নানা ছোটখাট প্রোগ্রামে প্রোমোট করছেন। ওর গলার ন্যাচারাল জোয়ারি নাকি খুব ভাল।
ও এসব বোঝে না। খালি ওর কথা শুনে চোখের কোনায় ঝিলিক দেখে মুগ্ধ হয়। আশপাশে বসা মেয়ের দল মুচকি হাসে, ওদের তাতে বয়েই যায়।
দুজনেই মনিটর যে! ক্লাসের ডিসিপ্লিন রক্ষার দায় তো ওদেরই ওপর!
এদিকে আনারকলির দিন শেষ। নতুন সিনেমা এসেছে মুঘল-এ-আজম। এদের জিভে মোগলে আজম। মোগলাই পরোটা? ওর বাড়িতে সিনেমার গান গাওয়া মানা, ওসব বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের কাজ!
কিন্তু সেদিন সুপ্তি বলল—এই, ওই সিনেমার একটা গান শুনবি? দারুণ সুর। আমি তুলেছি, গারা ধুনে তৈরি। ও গুনগুন করে —'মোহে পানঘট পে নন্দলালা ছেড় গয়ো রে!'
শেষে সুপ্তিও বখে গেল! ওর কেমন কষ্ট হয়। তবে সুরটা সত্যি দারুণ। বিব্রত রঞ্জন সামনে সরস্বতী পুজোর জন্যে কী কী প্রোগ্রাম হবে তা নিয়ে নীচু গলায় পরামর্শ করতে থাকে।
হঠাৎ খেয়াল হয় ক্লাসরুম যেন অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ।
কখন অপর্ণাদি এসে চেয়ারে বসেছেন ওরা বুঝতেই পারে নি। পড়ানো শুরু হয়ে গেছে মিনিট দশেক। রঞ্জনের নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু ওর পা যেন অঙ্গদের পা হয়ে মাটিতে সেঁটে গেছে।
কেন? খিল্লির ভয়? বকুনির ভয়? অথবা কোন অপরাধবোধ? আজও জানে না।
ফলং?
অপর্ণাদি পড়িয়ে চললেন--যেন ওরা দুজন ক্লাসে নেই।
ওরা দুজন ফিসফিসিয়ে কথা বলেই চলল--যেন ওরা ক্লাসের বাইরে।
ঘন্টা বাজল, অপর্ণাদি উঠে বেরিয়ে গেলেন। ওর দুঃসাহসে স্তম্ভিত বন্ধুর দল একনিমেষে শত্রু হয়ে গেল।
—এটা অসভ্যতা! নিজেকে কী ভাবিস? গতবার ফার্স্ট হয়ে সবার মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি?
—তুই অপর্ণাদিকে অপমান করেছিস। এতবড় বেয়াদপি? শিগ্গির স্টাফরুমে গিয়ে ক্ষমা চা, নইলে?
—নইলে কী?
—আমরা গিয়ে বড়দিকে বলব—রঞ্জন আমাদের মনিটর নয়।
—হ্যাঁ,অমন অসভ্য ছেলে আমাদের ক্লাস মনিটর হতে পারে না।
মানে? সুপ্তি মনিটর থাকবে, থাকবে না ও। ওর জায়গা নেবে অন্য কেউ?
ওর মাথার ভেতরে শর্ট সার্কিট!
মারামারিতে সদা বীতরাগ রঞ্জন ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা ছেলের ওপর। দুজনে মিলে মাটিতে গড়াগড়ি। ও মারল কম, খেল বেশি।
ইতিমধ্যে ক্লাসে এসেছেন আর একজন টিচার। আর ওঁর পেছন পেছন সরস্বতী পুজোর নোটিস হাতে নিয়ে চাপরাশি শ্যামভাই।
ও দুজনকে ভূমিশয্যা থেকে টেনে তুলল।
খানিকক্ষণ পর খবর এল যে বড়দি ওঁর চেম্বারে ওদের দুজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মুহূর্তে রাজনৈতিক পরিদৃশ্য বদলে গেল। ও বেশি ঠ্যাঙানি খেয়েছে, তাও মেয়েদের সামনে। ছেলের দল ভাবল যথেষ্ট হয়েছে।
আবার সবাই বন্ধু। দুজনের কেউ যেন পানিশমেন্ট না পায়। সবাই জানে বড়দি শৈল সেন জেলখাটা বিপ্লবী, বিয়ে করেন নি। খুব কড়া। হয়ত টিসি ধরিয়ে দেবেন।
এসব আটকাতে স্ট্র্যাটেজি চাই। সবাই মিলে ঠিক হল যে ওরা বলবে কোন ঝগড়া/মারামারি হয়নি। ওরা স্পোর্টিংলি কুস্তি লড়ছিল। শ্যামভাই ভুল বুঝেছে।
এবং গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে রঞ্জন বন্ধুটির কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বড়দির চেম্বারে ঢুকবে।
যেমন কথা তেমনি কাজ।
ওর দাঁত কেলিয়ে বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ঢোকা দেখে বড়দির খানিকক্ষণ বাক্যি হরে গেল। তারপর উনি সিংহিনীর মতো গর্জে উঠলেন—গেট আউট! স্কুলছুটির পর একঘন্টা অফিস রুমে ডিটেন থাকবে।
তারপর জনান্তিকে বললেন—এনাফ ইজ এনাফ! নেকস্ট ইয়ার থেকে ওনলি গার্লস!
দুইবন্ধুর প্যান্ট ভিজে গেছল।
বৃষ্টি নেমেছে। অঝোর ধারায়। বাজ পড়ছে—দাঁত কিড়মিড়িয়ে। ক্লাস ফাইভের সামনে উঠোনটায় জল জমে গেল। টিনের চাল থেকে ড্রাম বাজিয়ে বৃষ্টি ঝরছে।
স্টাফরুম থেকে কোনও টিচারের এই বৃষ্টিধারার মাঝে উঠোনের গোড়ালি অবধি জমা জল ভেঙে পড়াতে আসা সম্ভব হল না। ছেলের দল মহা উৎসাহে কাগজের নৌকো বানিয়ে ভাসাতে লাগল।
দুটো মেয়ের দাদারা ইংলিশ মিডিয়মে পড়ে।
ওরা সুর করে চেঁচাচ্ছে—রেইনি ডে! রেইনি ডে!
এটা আবার কী জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?
আরে, বোকা, খুব বৃষ্টি পড়লে স্কুল ছুটি দেয়। সেটাই।
কে বলেছে? দাদাদের স্কুলে তো হয়।
কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেল। তাহলে? হতে পারে। তোরা কয়জন যদি একটু বৃষ্টিতে ভিজে যাস তো হবে। আর অন্ততঃ সেই কয়জনের তো হবেই।
কী রে? রাজি? ভেবে দেখ।
ও জন্মেছেই বার খেয়ে ক্ষুদিরাম হবার জন্যে। ও টিনের চালার থেকে ঝরে পড়া জলের নীচে দাঁড়িয়ে ভেজার চেষ্টা করতে লাগল। অতটা হল না। কিন্তু পেছন থেকে এক ঠ্যালার চোটে হুমড়ি খেয়ে জমা জলে পড়ে সত্যি বেশ ভিজে গেল।
ও রাগে গজগজ করে ঘুসি পাকাচ্ছে কি ইতিহাসের প্রতিমাদি ঢুকলেন। ফর্সা মুখে বসন্তের দাগ, পান খাওয়া অভ্যেস, কাউকে বকেন না। খুব হাসিখুশি।
—এ কী?
—দিদি, আজ রেইনি ডে। ছুটি?
একচোট হাসলেন। ওসব চালাকি চলবে না, সামনে অ্যানুয়াল। কোর্স কমপ্লিট করতে হবে না? আর রেইনি ডের পারমিশন আমি দিতে পারি না। তোমাদের সাহস থাকে তো বড়দিকে গিয়ে বল।
কারো সাহস নেই। সবাই গুটিগুটি নিজের নিজের ডেস্কে।
শুরু হল মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ।
কিন্তু ও যে সত্যিই ভিজে গেছে, কাকভিজে।
পেছনের বেঞ্চের বড় মেয়েটি দাঁড়িয়ে উঠেছে।
—দিদি ওকে বাড়ি যেতে দিন, নইলে ওর জ্বর হতে পারে। সামনে অ্যানুয়াল। ওর চোখে নীরব কৃতজ্ঞতা।
প্রতিমাদি গোল গোল চোখ করে ওকে দেখলেন। —কাছে এস।
ও আনন্দিত পদক্ষেপে পৌঁছে গেল। বন্ধুরা হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে।
উনি ওর মাথা, কপাল বুক পিঠ ছুঁয়ে দেখলেন।
—এতো সপসপে ভিজে! জ্বর আসতেই পারে।
ওর চেহারায় বিজয়ীর হাসি।
—এবার খুলে ফেল।
—কী? কী খুলব?
—আরে, ভিজে জামা গেঞ্জি সব খুলবে। খুলে জানলায় মেলে দাও। পাখার হাওয়ায় শুকিয়ে যাবে।
সভা হল নিস্তব্ধ। তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল গোটা ক্লাস, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে।
—না দিদি, আমি খুলব না। আমাকে বাড়ি যেতে দিন।
—না, তা হয় না। তুমি ক্লাস করবে, আদুল গায়ে। জ্বর হলে? আমার দায়িত্ব আছে না। খোল বলছি।
গোটা ক্লাস সার্কাস বা মাদারী কা খেল দেখার আনন্দে মাতোয়ারা। ওর স্ট্রিপটিজ শুরু হল বলে।
অতিকষ্টে ভিজে শার্ট খুলে জানলায় টাঙিয়ে দিল। যাক বাবা!
কিন্তু ফাঁসি হওয়ার এখনও বাকি।
—কী হল, গেঞ্জিটাও খোল, তবে তো! নইলে জ্বর হবে যে!
ও এখন স্ট্যাচু।
প্রতিমাদি হাসছেন।
—কী হল? খুলছ না কেন? তোমার কী আছে যে দেখাতে লজ্জা পাচ্ছ?
এবার সম্মিলিত হাসি ও টিটকিরির ফোয়ারার মাঝে রঞ্জন সারাক্ষণ পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল—যদি কোথাও মেঝে ফেটে গিয়ে একটু ফাঁকফোকর দেখা যায়?
একটা ঠিকঠাক বয়েজ স্কুল আর কতদূর? এই মেয়েদের স্কুলে আর না।
আসিতেছে, আসিতেছে শীঘ্রই আসিতেছে— করতে করতে এসে গেল সেই পরমলগন। ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে আজ। সকাল থেকে মন নিজের বশে নেই। আর মাত্তর কয়েক ঘন্টা। তারপরেই স্কুল শুরু হলে রেজাল্ট বেরিয়ে যাবে। হলুদ রঙা মার্কশীট নিয়ে বাড়ি আসবে। তার আগে শেষবারের মতো বন্ধুদের ও স্কুলবাড়িটাকে টা টা করে দেবে। বিশেষ করে আঁকাবাঁকা কুঁজো টগর গাছটাকে।
তারপর শুরু হবে নয়ী জিন্দগি! অল বয়েজ স্কুলে, থুড়ি হোস্টেলে। ওর টোটো করে এপাড়া-সেপাড়া, ঝাউতলা রোড, বালু হক্কাক লেন, নাসিরুদ্দিন বা দিলখুসা রোড ঘুরে বেড়ানো দেখে অভিভাবকরা ঠিক করেছেন যে ওকে হোস্টেলে দেওয়াই সমীচীন। বিশেষ করে কোন রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে। নরেন্দ্রপুর ও রহড়া অভিজাত, কিন্তু কোন বাঁশবনে অজ পাড়াগাঁয়ে! খারিজ।
ইতিমধ্যে সরিষা ও বরানগর মিশনে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে পাশ করে গেল। আর সে বছরেই অমিতাভ বাগচী নামক কোন শ্রুতিধর বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হায়ার সেকন্ডারি পরীক্ষায় সমস্ত নামজাদা স্কুলের ছাত্রদের হারিয়ে ফার্স্ট হল, অতএব বরানগর।
বিছানাপত্তর, তোরঙ্গ, জামাকাপড় সব লিস্টি মিলিয়ে কেনা হয়ে গেছে—বাকি শুধু শিশুবিদ্যাপীঠ গার্লস স্কুলের থেকে পাশ হওয়ার মার্কশীট ও ট্রান্সফার সার্টিফিকেট।
বেলা এগারোটা নাগাদ ক্লাসে নতুন ক্লাসটিচার সান্ত্বনাদি এলেন। সবাইকে নাম ধরে ডেকে হাতে হাতে মার্কশীট ধরিয়ে দেবেন।
প্রথমে মেরিট লিস্টের নাম। তারপরে যথাক্রমে ফার্স্ট, সেকন্ড ও থার্ড ডিভিশন।
হলুদ, নীল ও গোলাপি কার্ড। শেষে যারা ফেল, অর্থাৎ সাদা কার্ড।
নাম ডাকা হতে থাকল। না, ও নয়, ফার্স্ট হয়েছে নতুন একটি মেয়ে। আস্তে আস্তে মেরিট লিস্ট শেষ, ওর নাম নেই।
সবাই ওকে দেখছে, বিশেষ করে বন্ধুরা। ফার্স্ট ডিভিশনের পালা শেষ, এবার সেকন্ড ডিভিশন। পিঠ বেয়ে বরফগলা জল নামছে। সেটাও শেষ, এবার গোলাপি কার্ডের দল।
ও বিমুঢ়। না, না। এ হতে পারে না। ও এত খারাপ পরীক্ষা দেয় নি। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল হয়েছে। ও কি শুনতে ভুল করল?
অনেক সাহস করে চিঁ চিঁ গলায় বলল—দিদি, কিছু ভুল হয়েছে।
সান্ত্বনাদি অবাক। চোখের চশমা ঠিক করে ওকে দেখলেন।
—কী হয়েছে?
—দিদি আমার নাম বলেন নি তো!
—মানে? নাম আসলে তো বলবো। এর পরে আসবে হয়তো। এতটুকু ধৈর্য নেই কেন?
এবার বন্ধুরা গলা তুলল। —দিদি, ওর যে সেকন্ড ডিভিশনেও নাম নেই।
—তো?
—ও ভাল ছেলে, দিদি।
—হুঁ:, ছেলেরা আবার পড়াশুনো করে নাকি? বেশ, নামটা বলো। আচ্ছা, দেখছি। এই নাও।
ও হাত বাড়াল। একী? সাদা কার্ড?
—হ্যাঁ, তুমি তো ফেল করেছ। এই ক্লাসে রিপিট। এ বছরে মন দিয়ে পড়াশুনো করতে হবে, বুঝলে?
আর বুঝেছে! ওর চোখে তখন হাওড়ের পানি।
ওর মুক্তি হল না! আবার ওকে গার্লস্ স্কুলে একবছর থাকতে হবে? বন্ধুরা অন্য স্কুলে যাবে? সুপ্তি ওর থেকে একক্লাস উঁচুতে পড়বে? আর ওকে ওর ছোটভায়ের সঙ্গে একক্লাসে পড়তে হবে?
কর্নেল বিশ্বাস রোড থেকে সার্কাস মার্কেট প্লেস—পথ ফুরোয় না। এমন কী করে হতে পারে?
নিশ্চয় সরস্বতী ঠাকুর রাগ করেছেন। কেন? এবার অন্য বন্ধুদের মত বইয়ের ভেতর প্রসাদী ফুলবেলপাতা রাখিনি বলে? না, না। আসলে সেই যে গতবছর বড়দিদিদের পরীক্ষায় ফেল করে কাঁদতে দেখে বন্ধুদের সঙ্গে হেসেছিল। ঠাকুর তার জন্যে শাস্তি দিচ্ছেন।
আর কক্ষনো অন্যদের রেজাল্ট দেখে হাসব না, ঠাকুর!
বাড়ি ফিরে ও কথা বলতে পারছে না। একী, কান্দস ক্যারে? কী হইছে?
—আরে হের কি কান্দনের কোন কারণ লাগে? মাইগ্যা স্বভাব। কথায় কথায় প্যান্দায় (ফোঁপায়)।
—আমি ফেইল!
—কী? কী কইলি? কুন বিষয়ে?
বড়রা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় সেই বিধবা কাগজ। খুঁটিয়ে দেখে।
—নাঃ, টোটাল তো ফার্স্ট ডিভিশনের। একটা নম্বরও তো খারাপ না! তাইলে কিসে ফেইল করল?
—আরে, এই দ্যাহো, ইংরাজিতে a, মানে অ্যাবসেন্ট। তাই ফেইল।
—কীরে? তুই ইংরাজি পরীক্ষার দিন স্কুলে যাস নাই?
—গেছি ত।
মা এগিয়ে আসেন। গেছল, কোশ্চেন পেপারও নিয়া আইসে।
এবার কোমর বেঁধে এগিয়ে আসেন ছোটপিসি। কলেজে স্টুডেন্ট ফেডারেশনের ইউনিট সেক্রেটারি।
—চল তো আমার লগে! দেখি কেমনে তরে অ্যাবসেন্ট দিছে। আরে, আমিই তো পরীক্ষার দিন সঙ্গে কইর্যা ছাড়তে গেছি। চল। আমরা বাঙাল তো! আমাদের পুলাপানের ভাল রেজাল্ট ঘটিদের সহ্য হয় না।
স্কুলে গিয়ে পিসি অফিসঘরে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিল। বলল—সেদিনের অ্যাটেন্ডান্স আনুন। দেখান, ও অ্যাবসেন্ট ছিল। তখন ক্ষমা চেয়ে নেব।
দুই যুযুধান পক্ষ রাজি হওয়ায় সেটা আনা হল। দেখা গেল, আমার নামের জায়গায় P.
রাখে কেষ্ট মারে কে!
ব্যস্, পিসি তুবড়ির মত জ্বলে উঠে স্কুল অথরিটি ও টিচারদের গুষ্টির তুষ্টি করে দিল।
—ওর ইংরেজি পরীক্ষার খাতাটা খুঁজে বের করুন, আধঘন্টা সময় দিলাম। নইলে কড়েয়া থানায় গিয়ে ক্লাস টিচার ও হেড মিস্ট্রেসের নামে ডাইরি করব।
পনেরো মিনিটের ভেতর খাতা উদ্ধার হল আলমারির কোনায় ডাঁই করে রাখা সাদা কিছু উত্তরপত্রের বান্ডিলের ভেতর থেকে। নম্বর বিরাশি। যোগ করে দেখা গেল সেকন্ড হয়েছি।
এবার নতুন করে হলুদ রঙা মার্কশীটে সব তোলা হল। আমাকে যেতে হল ক্লাস সিক্সে ইংরেজির টিচারের কাছ থেকে ওটা সাইন করিয়ে নিয়ে আসতে।
ক্লাস নিচ্ছেন—লাবণ্যদি। লাবণ্যপ্রভা দাশ, কবি জীবনানন্দের স্ত্রী। দফতরি শ্যামভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে ওনার হাত থেকে মার্কশীট নেওয়ার সময় উনি আমাকে বরফশীতল দৃষ্টিতে মেপে নিয়ে বললেন—তোমার সঙ্গে যিনি এসেছিলেন উনি কে হন?
—পিসি ( মিনমিনে গলায়)।
—কোন স্কুল থেকে পাশ করেছেন?
—এই—এই স্কুল। (বোজা গলায়)।
—আমাদের স্কুল থেকে পড়াশুনো করে আজ আমাদের সঙ্গে এই ব্যবহার? আমার নিজের মেয়ে হলে জন্মের পর মুখে নুন দিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতুম।
(মা সরস্বতী! আমাকে আবার ফেল করিয়ে দাও।)
এভাবেই শেষ হল স্কুলের সঙ্গে বিদায়পর্ব। ভাবি এক, ঠাকুর করেন আর!
এর পরের বছর থেকে ছেলেদের নেওয়া পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে গেল। বহুবছর পরে গিয়ে দেখি সে স্কুল এখন তিনতলা, কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা "স্বর্গীয় জহর নন্দী গার্লস হাইস্কুল"। কিন্তু লোহার বর্শামুখো গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে তেমনি রয়ে গেছে সুপুরি আর টগর গাছটি।
হারিয়ে গেছে শিশু বিদ্যাপীঠ গার্লস হাইস্কুল। এখন গুগল সার্চ করেও এই নামে কোলকাতায় কোন স্কুল খুঁজে পাওয়া যায় না।
না, এটা বোধহয় অর্ধসত্য। শিশুবিদ্যাপীঠ-এর টগর গাছ রয়ে গেছে আমার স্বপ্নে, আমার সত্তায়।
যখন অন্যের দুঃখে অপমানে কাঁদতে লজ্জা পাই না, তখন টের পাই বুকের মধ্যে সেই গার্লস্ স্কুল।
স্বপ্নে দেখি—ঝাঁঝাঁ দুপুরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে জল খেতে টিফিন রুমের দিকে সিমেন্টবাঁধানো গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ক্লাস এইটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। শোভাদি গানের ক্লাস নিচ্ছেন। তেত্রিশটি মেয়ে একসুরে গলা মিলিয়ে গাইছে আর তাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে বিষণ্ণ দুপুরঃ
ব্যক্ত হোক, জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক - তোমা মাঝে অসীমের চির বিস্ময়।
(ক্রমশ)
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)