Subscribe to Magazines



পরবাসে
স্বপন ভট্টাচার্যের

লেখা


ISSN 1563-8685




একশো বছরে লোরকার কবিতা
স্বপন ভট্টাচার্য



[ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬) সম্ভবত এখনও স্পেনের সবচেয়ে প্রিয় কবির আসনটি ধরে রেখেছেন। সবচেয়ে প্রিয় আধুনিক কবির আসনটিও, যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। ‘বুক অফ পোয়েমস’ ছাপা হয়েছিল তাঁর বাবার অর্থানুকূল্যে ১৯২১’এ। সে বছরেরই নভেম্বর মাসে লোরকা লিখে ফেলেন তাঁর পরবর্তী সংকলন ‘পোয়েম অফ দ্য ডিপ সঙস’–এর কবিতাগুলি। এই লেখায় একশো বছর আগে লিখিত বা প্রকাশিত ছয়টি কবিতার অনুবাদ সংকলিত হয়েছে। স্প্যানিশ না জানার আক্ষেপ নিয়েই ইংরাজি অনুবাদের আশ্রয় নিয়েছি। অর্ধশতাব্দীকাল লোরকায় মজে আছি ওই ইংরেজি অনুবাদ সম্বল করেই। এই বিশেষ কবিতাগুলি পেঙ্গুইন মডার্ন ক্ল্যাসিক্স সিরিজের ‘সিলেক্টেড পোয়েমস অফ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’ (২০০১ সংস্করণ) থেকে নেওয়া হয়েছে। আমার অনুবাদে স্তবকবিন্যাস, যতি বা মাত্রা একটি দুটি প্রয়োজনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া মূলানুগ রাখার চেষ্টা করেছি।]


তারার প্রহর (১৯২০)

রাত্রির নীরবতা বর্তুলসদৃশ
নিটোল অক্টেভ এক
অসীমের স্বরলিপি লিখে রাখা খাতার পাতায়।

হারানো কবিতাগুলি পূর্ণতা এনে দিল আজ
পা রেখেছি রাস্তায় নগ্ন, তিলমাত্র আবরণহীন।
দেখছি গাঢ় অন্ধকারকে ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে
ঝিঁঝিঁপোকাদের গানঃ
শব্দ
যা মৃত আলেয়ার
শব্দ যা আলোর মতন
অশরীরী আত্মারা যে আলোকে চিনে নিতে পারে।

আমার এ ঘরটার প্রতিটি দেয়ালে
হাজারো প্রজাপতির কঙ্কাল
তারা ঘুমিয়েছে আমারই সঙ্গী হয়ে।

মত্ত ভিড়ের মত একঝাঁক নবীন বাতাস
নদীর উপরে বহে এল।

(কবিতাঃ Hour of Stars, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)


নতুন হৃদয় (১৯২০)

সাপের মতই আজ হৃদয়ের ত্বক
বাসি খোলস যেন, খসে পড়ে গেছে।
আমি সেটা হাতে নিয়ে দেখি
কিছুটা আঘাত আর কিছু তাতে মধু ভরা আছে।

খোলসের ভাঁজে ভাঁজে বোনা যে মন
এখন কোথায় তারা, কোথায় এখন?
যে গন্ধে যীশু মাতোয়ারা হন এবং শয়তানও
বল সেই সুগন্ধী গোলাপ কোথায়?

খুবই কোমল আর ভঙ্গুর সেই আবরণী
যা দিয়ে ভিজিয়ে রাখি আমার অলীক যত তারা
প্রিয় ছিল একদিন, হয়ত বাসি না আর ভালো
ধূসর সে শোকগাথাগুলি, আজ তারা কোথায় হারালো!


গর্ভের ভিতর এক ভ্রুণের স্ফুরণ দেখি তাতে
দেখি মমি করে রাখা আছে আমার কবিতা
আমার গোপনকথা প্রণয়কঙ্কাল, আর
বহুদূরে ফেলে আসা আমার সঙ্গী সরলতা।

আবেগের জাদুঘরে ফ্রেমবন্দি করে
দেওয়ালে টাঙাবো নাকি তাকে?
আঁধারশীতল এই অশুভ চোখের
ঘুমন্ত কনীনিকা দু'খানার পাশে?

নাকি তোমাকে বিছিয়ে দেব পাইনের বনে চাঁদোয়ায়
- অবিরত বিদ্ধ হতে থাকা প্রেমের এ বই কবিতার -
যাতে তুমি সেই সুর তুলে নাও নিজের গলায়
যে সুরে নাইটঅ্যাঙ্গেল পাখি আসন্ন ভোরকে ভোলায়?

(কবিতাঃ New Heart, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)


সূর্য ওঠার আগে (১৯২১)

অথচ তীরন্দাজের দল
ভালোবাসার মতই
দৃষ্টিহীন।

সবুজ রাত্রির উপর
জ্যা মুক্ত তীর
যেতে যেতে রেখে গেছে
প্রস্ফুট লিলির উত্তাপ।

চাঁদের সাম্পান
ময়ূরপঙ্খি মেঘে গাঢ় বিঁধে গেলে
মেঘের শরীর কেঁপে ওঠে
সে কাঁপনে উড়ে যায় শিশির-কিংখাব।

তবু হায়
তীরন্দাজের দল
ভালবাসার মতই তারা দৃষ্টিহীন

(কবিতাঃ Before Dawn, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Cola Franzen)


ল্যান্ডস্কেপ (১৯২১)

জলপাই গাছের সারি
কখনো চোখে পড়ে, কখনো মিলিয়ে যায়
যেমন খোলে বা গুটিয়ে বন্ধ রাখে কেউ
হাতপাখাও।
জলপাই বাগিচার মাথায়
একটা গোটা আকাশ ডুবে আছে
শীতল তারার দল সেই বাগিচায়
আঁধার-বর্ষা হয়ে নেমে এল আজ।
নদীটির পাড়ে
চাঁদের উপচ্ছায়া বুনো ঘাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
ধূসর বাতাস আনে লহরীর মত শিহরণ।
জলপাই গাছের শরীর ঢাকা পড়ে
কান্না জড়ানো আলোয়ানে।
একদল পাখি
ফাঁদে পড়া পাখি তারা
অতিদীর্ঘ পুচ্ছপালক
মরে আসা আলোতে দোলায়।

(কবিতাঃ Landscape, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Cola Franzen)


পথ (১৯২১)

জানোই তো,
তোমার ধূসর তরবারি
বিঁধবে না দিকচক্রবাল,
পাহাড় তখন ঢাল হবে।

স্বপ্নেও ভেবো না চাঁদের কথা,
ভেবো না চাঁদের রক্তে ভিজে যাবে ফলা
বরং জিরোও চুপচাপ।
তবে, শোনো পথ,
আমার পায়ের দুটি পাতা
তোমার শিশিরে যার গোপন শৃঙ্গার
তাদের ভুলো না যেন তুমি।

তুমি নাকি ভবিষ্যত দেখতে পাও!
তোমার নগ্ন পিঠে উল্কি তুলে
তোমাকেই ভুলে গেল যারা
তাদের আত্মা তুমি
অনায়াসে পড়ে নিতে পারো?
অনন্তে পায়ের শব্দ শুনতে পায় যারা
যদি তেমন গণক হও তুমি,
তাহলে নিশ্চিত
তুমি গাধাদের প্রেমে মজে আছো
তোমার আহত দেহে, যারা শুশ্রূষার মত
নরম ভ্রমণ রেখে
ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেছে!
কেবল তারাই জানে তোমার দীর্ঘ তরবারি
কাকে বিদ্ধ করে, কোথায় পৌছায়।
পশুদের মধ্যে তারা অবলোকিতেশ্বর
শুধু গাধারাই
আঘাতে দীর্ণ হয়ে অবসর নিলে
লিপিহীন তোমার সাদা পুঁথি
অবিরত পাঠ করে যায়।

চারপাশে গ্রামের কুটির
তবু কত একা হয়ে আছো!
পুণ্য বিচ্ছুরিত যেন তোমার প্রভায়!
দায় নিয়ে নিয়েছো সবার
চারটে ঝিম মেরে পড়ে থাকা ওয়াগন,
খান'দুই বাবলার ঝোপ,
পুরাণপ্রাচীন এক কুয়ো
যার মধ্যে একফোঁটা জলও পড়ে নেই আর।

সারা পৃথিবী বেড় দিয়ে ঘুরে এলে
তবু যা নিজের বলে, থাকে লোকে
যথার্থ তেমন কোন বাসা নেই আজও তোমার,
কাফন নেই, গোরস্থান নেই;
প্রেমের বার্তাবাহী এই যে বাতাস
তারও ক্ষমতা নেই
তোমাকে নতুন করে জাগাবে আবার।

তবে, ফসলের ক্ষেত ছেড়ে উঠে আসো যদি,
যদি অসীমের দিকে চলে যাও,
যদি তমসার বুক চিরে তোমার এ শ্বেত তরবারি
নিজের প্রতিচ্ছায়া এঁকে দিতে পারে
তাহলে হে পথ!
সান্তা ক্লারা ব্রিজ
তুমিও তো পার হতে পারো।

(কবিতাঃ The Road, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)



গাছ (১৯১৯)

গাছ !
তোমরা কি কোনদিন আকাশের নীল থেকে
মাটিতে বিদ্ধ হয়েছিলে?
কার সেই প্রবল গাণ্ডীব
তোমাদের গেঁথে দিয়ে গেল? আকাশের তারা নাকি সে?

তোমাদের গান
যেন পাখির আত্মা থেকে সুর ভেসে এলো,
এলো ঈশ্বরের দৃষ্টি থেকে,
এলো অকৃত্রিম বাসনা থেকেও।
গাছ!
কঠিন শিকড় তোমার জানবে কি কোনদিন
মাটিতে কতটা নীচে প্রোথিত রেখেছি এই হৃদয় আমার?

(কবিতাঃ Trees, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)





(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)