সেস্টিনা: জীবনপাখি
কবি হয়ে জীবনকে পুষে রেখে শব্দের খাঁচায়
সে ভারি নিশ্চিন্ত থাকা। বারান্দার তারেতে ঝুলিয়ে
ছায়াময় ঢাকা দেওয়া খাঁচাখানি, আমি কেদারায়
গা এলাই। অতিথিরা যদি কেউ আসে এইবারে
দেখে যাবে গালভরা হাসি নিয়ে বিস্ময় মাখানো—
কতো কথা শিখে গেছে জীবন এ-খাঁচার দাঁড়ে বসে!
দেখুক নাহয়, আমি এত দিন বন্ধ ঘরে বসে
কতো কথা শিখিয়েছি ঢাকা চাপা দিয়ে এ-খাঁচায়
দৃষ্টির আড়ালে যতো বোঝাপড়া সোহাগ মাখানো—
আমিই রোমিও যেন, যেন সে আমার জুলিয়েট
ঝুলবারান্দায়। সেই বুলি বকে জীবন সবারে
তাজ্জব বানাবে। খুশি হয়ে বাদশাহী কেদারায়
শরীর এলিয়ে রাখি। এখন আর উঠে কে দাঁড়ায়
এ দরবার ছেড়ে? ঘণ্টা বাজলেও গ্যাঁট হয়ে বসে
অগ্রাহ্য করবো সব; গা বাঁচিয়ে থাকলে এবারে,
ঝামেলা রইবে না। কেউ জরুরি সঙ্কটে যদি চায়,
ফোনে ফোনে মোলাকাতগুলো সব রাখবো ঝুলিয়ে।
দাঁত-ছ্যাৎরানো যত আদিখ্যেতা, আখ্যান-ব্যাখ্যানও
আমল দেবো না: যাক গোল্লায়। বসতে একখানও
চেয়ার দেবো না। মিহি সারেঙ্গী বাজিয়ে কেদারায়
জীবনের সঙ্গতিয়া হবো। সেও ঘাঘরা দুলিয়ে
ঘুঙুরিয়া নেচে কিম্বা পা গুটিয়ে ম্যায়ফিলে বসে
গাইবে জীবনগীতি কানে হাত চেপে। কে না চায়,
নিজের পছন্দপোষা জীবন? অবশ্য এই বারে
কেমন আশঙ্কা হচ্ছে, ইদানীং আমার দরবারে
নতুন গাওনা আরো মনোহারী বিনোদ মাখানো
গাওয়ানো যাচ্ছে না কেন? রয়েছে তো জীবন খাঁচায়!
নব গীতিকাব্যকথা হবে না কি আমার দ্বারায়?
সেই একই কথা ফিরে ইনিয়ে বিনিয়ে রসে বশে
ভিজিয়ে আউড়ে যাবো ঠাকুমার বাড়ন্ত ঝুলি এ?
কোনখানে ভুল হলো খুঁজে দেখি মিলিয়ে-জুলিয়ে—
চান-খাওয়া ঠিকই আছে, ছুটি আছে শনি-রবিবারে;
তেমন কিছুই নেই অগোছালো, নেই যা স্ববশে;
বাড়ি ঘর নিরাপদ নিরুত্তাপ স্নেহেতে মাখানো।
শুধু সারেঙ্গীর তার নেমে গেছে কোন্ উদারায়।
সাবধানে ঢাকা তুলি: জীবন কি রয়েছে খাঁচায়?
তাহলে ঝুলিয়ে রাখা আছে কাকে শব্দের খাঁচায়?
কী কথা এবারে বাঁধি গানে এ রাগিণী কেদারায়?
সময় বসে যে নেই, শূন্য খাঁচা বিদ্রূপ মাখানো।
বেহালাবন্ধন
বেহালা পড়েই থাকে; পড়ে থাকে। তার ছিঁড়ে যায়
সূর্যের দোলক করে উত্তরে দক্ষিণে চংক্রমণ;
অভাবী বাতাস ঢোকে ঘরে, ধুলো ঢেলে দিয়ে যায়,
বেহালা মলিন হয়, এককোণে মুখ ঢেকে কাঁদে।
আমি থাকি বন্ধ্যা দেশে; জানি না এ কোন্ নির্যাতন,
কোন্ দুরদৃষ্ট এসে সমস্ত আশায় বাদ সাধে।
যত সুর, ছন্দ ছিল, গতি ছিল বেহালার তারে,
যত ওঠানামা ছিল, সবই এসে শূন্যয় দাঁড়ালো;
তা নিয়ে আক্ষেপ নেই। সে কি কষ্ট? এধারে ওধারে
ভাঙাচোরা টুক্রো সুর পড়ে থাকে। তাদের সাক্ষাতে
মনে পড়ে ফুল্ল দিন, শীতসন্ধ্যা, ঝড়ে নেভা আলো,
সমুদ্রজোয়ারস্মৃতি, ভাঙা বাড়ি বিষম দৈবাতে।
সে-সমস্ত দিন নেই, উন্মাদনা নেই, তবু আমি
আক্ষেপ করি না আর লগ্নভ্রষ্ট সুখের সন্ধানে,
বলি না, ‘অদৃষ্টক্রমে যা পাওয়া তা সমস্ত বেনামী,
নিরাশা আমার প্রাপ্য।’ দুঃখ আছে, সে-কথা সত্যিই;
তা ছাড়া যা এলো, সে তো এসে গেছে বন্ধুত্বের টানে—
সে-উপরিটুকুর জন্য বলো, কাকে ধন্যবাদ দিই?
আশা-নিরাশার মাঝে স্থান আছে: আমাকে কুলায়।
টানাপোড়েনের চাপ সে-বিন্দুতে নেই। সেই সুখ,
সে-নির্মোহ কম কিসে? সবই সে ভুলিয়ে না-ভোলায়।
স্মৃতির তুষারস্তূপ: হাওয়া আছে, তরঙ্গ ওঠে না,
তবু তাতে জল আছে; সে-বরফে চিরে গেলে বুক
শুখো মন ভিজে যায়—শোধ করি আনন্দের দেনা!
বেহালা পড়েই থাকে; ছেঁড়ে তার; আমি পুনর্বার
তার বাঁধি, ছড় টানি, সুর আসে অস্থির গুঞ্জনে,
এই যাওয়া ভালো লাগে, এই ফিরে আসা বারবার—
তার ছেঁড়ে, ছিঁড়ে যাক্—বেহালা তো অটুট এখনও!
তুমি আমি মূল্যহীন, বাঁধা শুধু বন্ধুত্ববন্ধনে—
বেহালা কি রোজ বাজে? মাঝে মাঝে বাজে, তুমি শোনো।
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)