আজ অপরেশ উঠোনে পা দিতেই মঞ্জরী এক মালশা আগুন নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। মঞ্জরী বিনোদের বৌ। ওর বয়েস বেশি না। এই তো সেদিন সবার চাপে পড়ে আধবুড়ো বিনোদ ওকে বিয়ে করে ঘরে আনল। অথচ এই একরত্তি একটা মেয়ে দুদিন যেতে না যেতেই কেমন যেন গিন্নিবান্নি হয়ে উঠল! ওর ওই সরল সাদাসিধে মুখখানিই যেন এ বাড়ির একমাত্র গবাক্ষ। সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকালে নিমেষেই ওর ভেতর-বাইরের সবকিছু দেখে নেওয়া যায়, এমনই স্বচ্ছ! অথচ আজ কেমন যেন পাহাড়ি মেখলার মতো মুখখানি ভার। কালিপড়া চোখ চেপে যারা কান্নাটুকু লুকোবার চেষ্টা করে ঠিক সেইরকম চাহনি, আর শুকনো ঠোঁটের আগায় একটুখানি অবজ্ঞেয় হাসি! হাতের মালশাটি ঠক্ করে রেখে মঞ্জরী চলে যাচ্ছিল। অপরেশ জিজ্ঞাসা করল, “বিনোদ নেই?”
“আছে। বসেন, আসবে!”
“কোথায় গেছে ও?”
মঞ্জরী অকারণে আগুনে ফুঁ দিতে লাগল। এবার বাকি কথাটুকু নিজের গরজেই বলে যেতে লাগল অপরেশ, “কী আক্কেল বলো দিকিনি! একটা গল্প দেবে দেবে করে দুই সপ্তাহ ঝুলিয়ে রাখার কোনও মানে হয়? সেকেন্ড প্রুফ সেই কবেই রেডি করে আমি আটকে আছি! লিখতে এসে সব যেন একেবারে মাথা কিনে বসে আছে!” মাটির পাত্রটা থেকে ঘুরে ঘুরে ধোঁয়া উড়ে চলেছে। উঠোনের একপাশে একটি শিমুল গাছ চালের ওপর ডালপালা বিছিয়ে কাত হয়ে ঝুঁকে পড়েছে। কামানের গোলার মতো ওতে কালো কালো কুঁড়ি। অপরেশ দেখল মঞ্জরীর কী যেন এক ভয়ার্ত ভাবনা নিয়ে ওর দৃষ্টিটা ওই দিকেই নিবিষ্ট হয়ে আছে!
“এত আগুন কী হবে?”
“হুঁকোয় দিলে দেন।”
অপরেশ হাসল, “কী সাংঘাতিক! ছিলুম খাওয়া কবে ধরল?”
“গেল সপ্তায় মোমিনপুরের হাট থেকে নিয়ে এসেছে। এখন রোজ রাতে ওঠে আর হুঁকায় আগুন দিয়ে গুড়গুড় করে টান দেয়, ধোঁয়া ছাড়ে আর খুচখুচ করে গল্প করে!”
অপরেশ এঁটেসেঁটে বসল, “কার সাথে গল্প করে?”
“ও তো বলে মেয়েটার নাম নাকি রতি। আমি অবশ্য দুদিন ওর ছায়া দেখেছি। পরিষ্কার মুখ দেখতে পাইনি কোনোদিন!”
“বলো কী! রোজ রাতে আসে?”
“না। আগে মাড়ি কড়মড় করত। এখন তো তাও করেনা। তাই সবদিন হাতেনাতে ধরতেও পারিনে!”
অপরেশ আর কোনো প্রশ্ন করল না। খুঁটিতে ঝোলানো হুঁকাটাকে যতটা হাত বুলানোর অছিলায় পারল আদর করল!
মঞ্জরী আবারও বলল,“খুব তাড়া থাকলে ডেকে দিই?”
“কোথায় ও?”
“পেছনের পুকুরে।”
অপরেশ পায়ে পায়ে উঠে গেল। মঞ্জরীও কিছুটা গেল। অপরেশ আর বিনোদ সমবয়সি। অপরেশ শহরের নামি একটি স্কুলের শিক্ষক। অবসরে ছোট পত্রিকার সম্পাদক। বিনোদের সম্পদ বলতে কদম কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি একটা ঘর। ওটা খড়-বিচালিতে ছাওয়া। আর বাড়িলাগোয়া বিঘে খানেক বাগান। বাগানের মধ্যেই আছে একটা পুকুর। তবে বাগানের গাছ বলতে অধিকাংশই সজনে শিমুলে জাতীয় সস্তার বন-বিলাসিতা! স্নানের ঘাট বরাবর অনেকটা খুঁজল। কোথাও গল্পকার বিনোদকে দেখতে পেলনা। পুকুরের চারপাশে অসম্ভব রকমের আগাছা আর ফার্ন। একস্থানে দুটো পচা তালকাঠের গুঁড়ি মতো কী যে ফেলা আছে।
অপরেশের লালায় তিতো উঠে এল, “কোথায় বিনোদ?”
“ওই তো শুয়ে রয়েছে!”
“জলের ওপর শুয়ে রয়েছে?” খুব অবাক হল অপরেশ। হঠাৎ একটা মহিষ শিং ঝাঁকিয়ে ঠেলে উঠতেই অপরেশের চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম হল! মহিষের পিঠের ওপর টান টান হয়ে শুয়ে আছে একালের এক প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার! কিন্তু কেন? কোন হেতু? গরমও তো এখনো সেইভাবে জাঁকিয়ে পড়েনি! তাহলে? অনেকগুলো প্রশ্ন বলাকার সারির মতো উড়ে গেল অপরেশের মাথার ওপর দিয়ে!
আস্তে আস্তে আবছা অন্ধকার নেমে এল। বিনোদ উঠে বসেছে। অদূরেই একটি আমগাছ। ওর আগা অব্দি পান আর পান। মঞ্জরী ওর আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। এমন সময় একটি স্বর ভাঙা কোকিল হঠাৎ ডেকে উঠল কুহুউউউউউউউউ!
দুপুর গড়িয়ে গেলে দীপ্তি আসে। দীপ্তি বাদল মুচির বৌ। ইদানিং ও এঁটো বাসন মাজতে এলেও পাট ভাঙা শাড়ি পরে আসে! গেল হপ্তায় একগাদা লোক খেয়েছে ওর ঘরে। দিল্লি থেকে বড় বড় দাদারাও এসেছিল। ওঁরা সব পার্টির লোক। মুচি সমাজের মন পেতে দীপ্তির ঘরে পাত পাড়ার সুপারিশ করে দিয়েছিলেন স্থানীয় নেতা কর্মীরা। দীপ্তিরা মুচি হলেও ওদের হাব ভাব রুচি শুচি আর পাঁচজনের থেকে অনেকটাই আলাদা। রেঁধেবেড়ে খাওয়ানোর বিনিময়ে কাঁসার থালা বাসন পেয়েছে একগাদা! আজকাল রান্না হোক আর না হোক এঁটো মাখিয়ে রোজ সেগুলো পুকুরের ঘাটে নেওয়া চাই দীপ্তির। আজ মঞ্জরী আঁচলে করে একটা একটা করে সজনে ফুল কুড়াচ্ছিল। দীপ্তি ঘটির উলটো পিঠ দিয়ে কাঁচা তেঁতুল থেঁতো করছিল দেখে মঞ্জরী জানতে চাইল, “আজ কয় পদে রাঁধলে গো দীপ্তিদি?”
“তুমার ঠাকুরপো আজ বেলায় উঠেছে গো! বাজারে না গেলে ভাগে ভাগে রাঁধি কী করে বলো দিকিনি?” বলতে বলতে হাতের ঘটিটা সড়াৎ করে গড়িয়ে গেল। দীপ্তি চেঁচিয়ে উঠল, “এ মা! কী সব্বোনাশ! আমার হাত থেকে একে একে সবই সরে যাচ্ছে কেন কিছুই তো বুঝতে পারছিনে! পরশু একখান ভারী থালা তলিয়ে গেল। আজ আবার...!”
দীপ্তি কাঁচুমাচু করছে দেখে অনেকেই এগিয়ে এল। কেননা দীপ্তিদের এখন সমাজে অনেক দাম। রোজ সন্ধ্যায় বাদল এখন মিটিঙে যায়। কেউ ওকে ঘেন্না করেনা। মুচি চামার ইত্যাদি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেনা! মুখার্জিবাড়ির বড়পিসি হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে অনেকটা খুঁজল। ময়রাদের ছোট বৌ জলে ডুব দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি কাদা তুলে আনল, কিন্তু কিছুতেই ঘটিটার সন্ধান পাওয়া গেলনা!
খ্যাপলা জাল চেয়ে দীপ্তি ঘাটের সিঁড়িতে একপ্রকার হাত-পা ছড়িয়ে হাঁউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল!
এরই মধ্যে ময়রাদের ছোট বৌ মঞ্জরীকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এত বেলায় ফুল কুড়িয়ে কী করবা দি?”
“বাটব!”
“কী দিয়ে বাটো? পোস্ত আচে?” মঞ্জরী উত্তর দিতে ভুলে গেল!
বউটা এবার নিজের গরজেই হাজার কথা বলতে শুরু করল, “আমার শাশুড়িও বলে, সজনের ফুল করোনা হেলা। লেগে যাবে টানাটানির বেলা! কিন্তু তাইবলে ঘাসপাতার মতো নিত্য নিত্য নেওয়া যায়না নিশ্চই? সেদিন শাশুড়ি শিলে ফেলে বাটছিল। মাগো! দেখি সরু সরু শুঁয়োপোকা!...ওয়াক থুঃ!” মঞ্জরী কোনও কথার উত্তর দিলনা। আঁচল থেকে ফুলগুলো জলের ওপর ঢেলে দিয়ে ঘরে ফিরে এল।
এখন অনেক রাত। নিভু নিভু একটা আলোর কাছে কুঁজো হয়ে বসে আছে বিনোদ। মঞ্জরী খোঁপা থেকে কাঁটা খসিয়ে এলো চুলে বিনোদের কাছে এসে বলল, “আজ আসব?”
বিনোদ আজ আর বিরক্তি দেখাল না। মঞ্জরীকে তিরস্কারও করল না। শুধু বলল,“বলছি তো যাও! আমি আসছি!”
সাদা খাতার ওপর বিনোদ আবার খশখশ করে লিখতে শুরু করল। পাঁচ পাতা লেখার পর তিন পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিল! মোচড়ানো কাগজগুলো কুড়িয়ে মঞ্জরী ছায়া শরীরে হেঁটে এল, “ওই ঘটিটা খুঁজতে গা-ঘোর অন্ধকারে কারা কারা নেমেছে শুনেছ?”
সহসা মঞ্জরীকে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিয়ে অস্থির হয়ে উঠল, “বলো বলো বলো? কারা? কারা?”
মঞ্জরী বিনোদের বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে অভিমান করে বলল, “যারা বাদলকে বাদলের সমাজকে এতদিন ঘৃণা করে এসেছে তাঁরাই! বামুন কায়েত দাস বোস ময়রা মুদি ছাড়াও...!”
“কিন্তু দুঃখের কথা কী জানো এর মধ্যে আমার নিজের ঘরের লোকও আছে!”
হঠাৎ চালের ওপর মড়মড় আওয়াজ হতেই মঞ্জরী মাগো বলে আর্তনাদ করে উঠল! বিনোদ এক লাফে বাইরে বেরিয়ে এল। আলো হাতে মঞ্জরীও ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করল। দেখল ফুলভারে আনত একটি শিমুলের ডাল বাদুড়ের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে একেবারে ঘরের মটকায় আছড়ে পড়েছে!
বিনোদ উঠোনে মাথা ধরে বসে পড়ল। মঞ্জরী বিনোদের চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল, “বলছি তো কিছুটা অংশ বিক্রি করে দাও। ঘরটা ঝেড়েঝুড়ে ঠিকঠাক করে নিই।”
“এত সাজানো-গোছানো ঘরে আমার ওঁরা আসবেনা তো!”
“কেন আসবেনা? ওঁরা কি আধুনিকতার ধার ধারেনা?”
বিনোদের দুঃখ হচ্ছিল খুব! তবু সে না হেসে পারলনা, “না বলছি তো বেশি আলো বাতাসে ওঁরা আসেনা!”
“তাহলে কেমন ঘর চায় তোমার চরিত্ররা?”
“আজই দেখতে চাও? এসো তবে!”
মঞ্জরী বুঝতে পারল বিনোদ ওকে অতলের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে! অতএব মঞ্জরী রুখে দাঁড়াল, “দাঁড়াও। আজ আর কিছুতেই আমাকে ভোলাতে পারবেনা! কিছুই তো দিলেনা! এক কুটুরির ঘর দেবে, তাও পারবেনা?”
“ওঁরা যদি আমাকে ছেড়েই যাবে তাহলে এই যে এতটা পথ ত্যাগের আর কী মুল্য থাকল? তখন আমার উপায় কী হবে?”
মঞ্জরী বেণী ঝাঁকিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে অশনি সংকেতে বিনোদের সামনে উঠে দাঁড়াল, “তাহলে আমাকে নিয়ে লিখবে! আমার চোখের দিকে তাকাও! কী হল? আমি তোমার গল্পের নায়িকা হতে পারিনা?”
বিনোদ চোখ তুলে তাকাতেই মঞ্জরীর নিঃশ্বাসে আলোটা নিভে গেল।
ঠিক এক মাসের মাথায় অপরেশ আবার এল। কেউ লেখা দিক আর না দিক, ঢুঁ একবার মারাই চাই! এটা তার একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে! মঞ্জরী ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল শুকনো শুকনো মুখ নিয়ে তাদের প্রিয় সম্পাদক মশাই দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্জরী জিজ্ঞাসা করল, “সরাসরি স্কুল থেকে বুঝি?”
“ওই সেরকমই মনে করতে পারো!”
“জল দিই?”
“না থাক। বিনোদ কি লেখাটা রেখে গেছে?”
মঞ্জরী আবার ঘরে ঢুকল। একটা মুখবন্ধ খাম কাঁসার থালায় করে নিয়ে বাইরে এল। অপরেশ দেখল খামটার একপাশে একমুঠো আবীর!
মঞ্জরী তার বেণী থেকে একটা শ্বেতশুভ্র মালা খসাতে খসাতে খানিকটা শ্লাঘার সহিত বলে উঠল, “লিখিয়ে নিলাম! এবারের নায়িকা একটু অন্যরকম! কাটাছেঁড়া একদম বারণ! তবে কোথাও কিছু বুঝতে অসুবিধে হলে এই অধমের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে!”
থালাটা ধরতে গিয়েও অপরেশের কেমন যেন একটুখানি হাত কেঁপে উঠল! বিনোদকে এতদিন কেবল অখ্যাত গল্পকারদের তালিকায় রেখে দেখতে অভ্যস্ত সে। অথচ আজ সামান্য একটা গল্প তাও কিনা এতো ঝকঝকে দামি একটা কাঁসার থালায় ফাগের আবীরে রাঙিয়ে সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠাতে চাইছে! বড়ই অদ্ভুত!
“কোথায় বিনোদ?”
“কে জানে! হয়ত কয়লা কুঠিতে গেছে।”
“আমি তো কুঠি হয়েই এলাম। দেখলাম না তো!”
“তাহলে স্বরূপের মাশরুম ফার্মে ঢুকলেও ঢুকতে পারে!”
“কেন ওখানে কাজ নিয়েছে বুঝি?”
“না!”
“তাহলে? এত লুকিয়ে বেড়ানোর কী আছে?”
“আপনারা কেউই চান না ও মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকুক! চাকরি তো ও করতে চেয়েছিল। অথচ ফাতনা ধরে এমনভাবে ওকে টেনে নিয়ে গেলেন...!”
“আমিও কিন্তু ওকে একথা বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি, দেখো বিনোদ আর যাই করো লক্ষ্মীর আসন না স্পর্শ করলে কিন্তু কোনও লক্ষ্যই পূরণ হবার নয়!”
“হ্যাঁ! আর সেই জন্যেই তো আপনাদের কাছে গিয়ে জনে জনে দরবার করেছি! ওর যারা হিতাকাঙ্ক্ষী তাদের হাত ধরে ধরে কেঁদেছি, ছোটখাটো যাহোক একটা লেখার অফিসে ওর জন্যে কাজ খুঁজে দেন! ...দিয়েছেন? অতএব বলতে বাধ্য হলাম অনেক তো কালিঝুলি মাখলে, এবার কয়লা গুঁড়িয়ে দুটো রোজগার হয় যাতে তাই দেখোনা!”
অপরেশ খামটি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। মঞ্জরী ডাকল, “এই ফুলগুলো খোঁপায় গুঁজে সারাদিন ওর সামনে বসে ছিলাম। হয়ত সে কারণেই লেখাটা ও সম্পন্ন করে উঠতে পেরেছে। প্রুফ দেখতে লাগতে পারে, এগুলো নিয়ে যান!”
“আরে! এ তো শ্বেতপলাশ! এমন মহামূল্যবান বস্তু কোথায় ফুটেছে শুনি?”
এলোচুল পিঠের ওপর চেলে দিয়ে মঞ্জরী খিলখিল করে হেসে উঠল,“মাথা গেছে দেখছি! এগুলো সজনের ফুল মশাই!”
অপরেশ লজ্জা পেল খুব, “সত্যি? বেণীটা এতো সুন্দর! আমি কিন্তু সত্যি সত্যি...!”
এবার মঞ্জরী ওর গ্রীবাটাকে আরও খানিকটা উন্মুক্ত করে দিল, “দেখুন তো সবাই বলে এতে নাকি সাংঘাতিক শুঁয়োপোকা! কোথাও কাঁটাফাটা লেগেছে কিনা দেখতে পাচ্ছেন?”
সূর্য সবে অস্ত যেতে বসেছে। অপরেশ দেখল মঞ্জরীর মুখখানি আজ যেন খাপখোলা তরবারি। আর তার সমগ্র সত্তা জুড়ে লোহিত লাভার স্রোত!
এখন রাত হলেই মঞ্জরী কাঁচা তেঁতুল থেঁতো করে। থালাটা আচ্ছা করে ঘষা দেয়। নুড়োতে ছাই মাখিয়ে ধুয়ে ফেলে। কিন্তু নাহ! তাতেও গন্ধ যায়না! অদ্ভুত এক রাজকীয় গন্ধ বেরিয়ে আসে থালাটির আত্মা ফুঁড়ে! এমন রান্না দীপ্তি কোথায় শিখল? তবে কী দীপ্তি আর জনমে রাজবাড়ির রাঁধুনিটাঁধুনি ছিল?” হাজার কথা নিজের মধ্যেই আঁচের কয়লার মতো পুড়ে পুড়ে খাক করে ফেলে মঞ্জরী! এখন সে স্বপ্নের মধ্যে প্রতিদিন দেখতে পায় রোজ একটা করে থালা হাত ফস্কে যাচ্ছে দীপ্তির। আর সেটা সন্ধ্যার গা-ঘোর অন্ধকারে তুলে আনছে মঞ্জরী। ঠোকাই করা গ্লাস খুরো উঁচু ঘটি। ভাগে ভাগে রান্না করছে মঞ্জরী! উঠোনে রাখা আছে জলচৌকি। বারান্দায় পাতা আছে চন্দন কাঠের পিঁড়ি! রাজা মহারাজাদের যাতে কোমর ছ্যাও করে খেতে বসতে কষ্ট না হয় এর জন্যে মধুকামারকে মোটা মজুরি দিয়ে উচু উঁচু পিঁড়ি বানিয়ে এনেছে মঞ্জরী! এতকাল লিখে কোটি কোটি অক্ষর কুচি করেও যে সম্মান যে সমীহ বিনোদ পায়নি আজ মঞ্জীরার দৌলতে কড়ায়গণ্ডায় উশুল করে নিতে চলেছে ওরা!
দীপ্তির রান্নায় সন্তুষ্ট হয়ে সামান্য কয়খান থালাবাসন একখান ইটের ঘর আর বাজার থেকে বাড়ি অব্দি ঢালাই রাস্তা পেয়েছিল ওরা! কিন্তু মঞ্জরী? ওদের তো জাত-গোত্র যাবার ভয় নেই। যেটা বিকিয়ে যাচ্ছে সেটা হল পূর্বপুরুষের সঞ্চিত সম্ভ্রম! যে করেই হোক এটুকু ওকে ধরে রাখতেই হবে! মঞ্জরী নিজের মনেই আঁক কষে নেয়, প্রথমে ওদের ধসেপড়া পুকুর বাঁধানো হচ্ছে। ঘোষণা করা হয়েছে খুব শীঘ্রই ওদের পুকুরের জলে ছাড়া হবে নীল ডলফিন। আর সিঁড়িতে দুইধারে বসবে আরও দুটো বিলুপ্তপ্রায় শ্বেতপলাশ! ওদের বাড়িতে কেউ টোটো চেপে আসুক এটা মঞ্জরী চায়না। সে চায় তার লেখক-স্বামী রাজ-অতিথি অভ্যাগতদের ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে তাঁর নিজস্ব জগৎ দেখাতে দেখাতে ঘরে নিয়ে আসবে! শাহেনশাদের খাওয়া শেষ মিডিয়াম্যানেরা খায়। উঠোনের ঘোড়াগুলো সব একে একে চলে যায়। পাড়ার ছোট মেজ সেজ সকল নেতারা মঞ্জরীর বাড়ির চারপাশের প্রকৃতির অপরূপ শোভার তারিফ করে হাঁপিয়ে ওঠেন! একমাত্র মুখার্জিবাড়ির বড়পিসি হত্যে দিয়ে বসে থাকেন। মঞ্জরীর হাতের শুক্তো খেয়ে তবেই নাকি উনি স্বর্গে যাবেন! এখন এঁটো থালা কাঁচাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ইদানীং বিনোদও প্রয়োজনের চেয়ে অনেকটা আদর করে আগে আগে ঘুমিয়ে পড়ে! ওর চেতনার চাতাল জুড়ে ঘর উঠোন বারান্দা খাটের তলা সর্বত্রই যেন সেই রাজকীয় রান্নার গন্ধ ম-ম মনে হতে লাগল! মঞ্জরীর কেবলই যেন মনে হতে লাগল আরে আরে, অনেকটা খাবার এখনো উদ্বৃত্ত রয়েছে তো! এখনো অনেক লোক খাওয়ানো যেত! দীপ্তির সুনাম ছড়াতে একটু হলেও সময় লেগেছিল! কিন্তু মঞ্জরীর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসের আগে আগে! সহসা অপরেশের শুকনো মুখখানি ভেসে উঠল, “আহা রে বেচারা! কাগজ চালাতে গিয়ে আসল কাজটাই ওর করে ওঠা হলনা! বয়স পার হয়ে গেল তবু বউ বাচ্চার কথা ভাবার অবকাশই পেলেন না!” একটা নতুন থালায় কিছুটা খাবার তুলে নিয়ে এখন রোজ স্বপ্নের মধ্যে অভিসারে বেরিয়ে পড়ে মঞ্জরী!
বছরের প্রথম কালবৈশাখী। এই দিনটাকে প্রতি বছরই নিজেদের মতো করে উদযাপন করে বিনোদ! কিন্তু আজ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দেখে খুবই অবাক হল অপরেশ। বিনোদ ঘরের মটকায় উঠে ‘বিচালি আনো! বিচালি আনো’ বলে সমানে হাঁক পেড়ে চলেছে! আর মঞ্জরী হাতের কাছে তালপাতা খড়কুটো যা যেখানে পাচ্ছে জোগান দিয়ে চলেছে। ঝড় থামলেও দমকা তখনো রয়ে সয়ে বইছে। বিনোদ যেখানে বসে লেখে সেই বারান্দার অর্ধেকটাই আলগা হয়ে আছে। কদম কাঠের বাটামগুলো ভিজে লাল লাল দেখাচ্ছে! আজ আর অপরেশকে বসতে বলার ফুরসত পেলনা মঞ্জরী। ব্যাপারটা বোধগম্য করে নিতে অপরেশেরও বেশিক্ষণ লাগলনা। সেও হাতে হাতে হেল্প করতে লাগল। গোঁজাগাজা দিতে দিতেই কথা শুরু করল বিনোদ, “এই দুর্যোগে কী মনে করে সম্পাদক মশাই?”
“আমিও তো তাই বলি, বেড়াল আজ গাছে উঠল কী মনে করে?”
আসল কথাটা আসছেনা দেখে মঞ্জীরাই খোঁচা দিল, “নিশ্চই নায়িকার নাম অথবা সত্তা নিয়ে সংশয় জমেছে?”
অপরেশ হো হো করে হেসে উঠল, “তাই ভাবি, এ বাড়িতে আসল লেখক যে কয়জনা আমি বহুবার আন্দাজ করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো...!”
ঝড়ের সাথে অনেকটা ধস্তাধস্তি করে বিনোদ এখন ক্লান্ত। সে নতুন ছাউনি বুকে চেপে ধরে চালের ওপরেই ঝুঁকে পড়ল!
“সিরিয়াস বলছি বিনোদ, নায়িকার একচুয়াল আইডেনটিটি কিন্তু আমি কিছুতেই মূল কাহিনীর সাথে এটাচ করতে পারছিনা!”
“তাতে অসুবিধাটা কোথায়?”
“অসুবিধে না থাকলে আমি এই কালবৈশাখী মাথায় করে ছুটেছি? কতটা ঝড় বয়ে যায় একজন সম্পাদকের মাথার ওপর দিয়ে, তোমরা না বুঝলে আর কারা বুঝবে বলো? লেখাটা কালই প্রেসে যাবে। অথচ...!”
মাজাটা আরও এলিয়ে দিতে দিতে বিনোদ মঞ্জরীকে আদেশ করল, “যাও পারলে ওকে একটু স্বরূপের মাশরুম ফার্ম থেকে ঘুরিয়ে আনো!”
মঞ্জরী ডাকল, “আসেন!”
অপরেশ ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মতো হু-হু করে হেঁটে যেতে লাগল!
একটা গুমটি ঘর। চারদিক থেকে আলোবাতাস আটকানো সমস্ত রকম ব্যবস্থাই এখানে সর্বত্র বিদ্যমান। ঘরের মধ্যেখানে থরে থরে মাচা। একস্থানে কুচোনো খড়ের ঢিপি। কচুরিপানার ডাঁই। বিচালি সেদ্ধ করার বড় বড় আখা...এটাই নাকি স্বরূপের মাশরুম ফার্ম! আজকাল এখানে বসে বিনোদদা লেখালিখি করে বুঝি? কিন্তু বিনোদের লেখার ঘর কই? কোথাও তার চিহ্নমাত্র দেখা গেলনা। জায়গাটা কেমন যেন ভেজা ভেজা আর ভ্যাপসা ভাব! অথচ এই একটু আগেই ঝড় হয়ে গেল। তার সামান্যতম প্রভাব আঁচ এর গায়ে লাগেনি, এতটাই আঁটোসাটো! সামান্য একটুখানি হাঁটতেই দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করল অপরেশ। মাচার ওপরে বসতে গিয়েও কী এক দ্বিধা গ্রাস করে বসল,“ওই যে সেদিন বলছিলে রতির কথা, সে বুঝি এইখানেই থাকে?”
মঞ্জরী ঝংকার দিয়ে উঠল, “কে জানে কোন যমের গর্তে থাকে! একমাত্র ওই বলতে পারে!”
বাঁশ ও দড়ির মাচায় শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে এমন জৈব পোরা প্যাকেট ঝুলছে। আর তার গা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ছত্রাক জাতীয় অদ্ভুত সব প্রাণী! অপরেশ অবাক বিস্ময়ে প্রতিটি প্যাকেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। কোনওটা দেশলাই কাঠির মতো চিকানো, কেউবা ব্যাঙের ছাতার মতো চ্যাপটা, আবার কারো কারো আকৃতি মুক্ত পুরুষ-লিঙ্গের মতো মসৃণ! একটা স্থানে এসে কী জানি কী মনে হতেই অপরেশ বলে উঠল, “আরে এগুলো ব্যাগের মধ্যেই সাপের মতো দলা পাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে? মরে যাবেনা?”
এবার মঞ্জরী একটা হাত-স্প্রে’র বোতল তুলে নিয়ে প্লাস্টিকের পুঁটলিটার গায়ে খুব করে স্প্রে করল। তারপর অপরেশের হাতে একটা সরু শলা তুলে দিয়ে বলল, “এবার এই প্যাকেটার পেটে যত খুশি খোঁচা দেন!”
অপরেশ অবাক হল খুব, “কেন?”
“দেন না বলছি!”
অপরেশ জৈব ভর্তি প্যাকেটার গায়ে অনেকগুলো ফুটো করল।
মঞ্জরী বলল, “চলেন আজ যাই। দুদিন পরে আবার কিন্তু একটু কষ্ট করে আসতে হবে!”
“কেন?”
“গল্পের মুখ বার হবে। যেখানে যেখানে খোঁচা দিলেন ঠিক সেইখানে!”
“তারপর?”
মঞ্জরী মোহিনী হাসি হেসে উঠল, “তারপর? কালো চাইলে কালো পাবেন। ড্রাই চাইলে ড্রাই। এমনকি পিচ্ছিল চাইলেও...!”
সহসা মঞ্জরীর হাতখানা খপ করে ধরে ফেলল অপরেশ, “তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব দেবে?”
সাথে সাথে কেন্নোর মতো গটো হয়ে গেল মঞ্জরী, “আমি আবার কী দেব? আমার তেমন কোনও...!”
অপরেশের আবেগ বাঁধ ভাঙল, “আছে বলেই চাইছি!...দেবে?”
“মাদার বীজ চাইছেন বুঝি? এসব স্বরূপ ছাড়া কেউই পুঁততে পারেনা!”
“মাদার বীজ চাইছিনা। ঘরে চলো!” কথাটা এমনভাবে বলল মুহূর্তে বাকরহিত হয়ে পড়ল মঞ্জরী!
এবার সে আধ-শুকনো কাঠের মতো শরীরটা টেনে নিয়ে ঘরে এল। অপরেশও এল পিছু পিছু। ছিটকিনি খুলেই ‘বিনোদ বিনোদ’ করে বার কয়েক ডাকল। সাড়া পেল না! লেখার টেবিল থেকে কিছু কাগজ নিয়ে বাইরে এল।
অপরেশ জানিয়ে দিল, “এগুলোর আর দরকার নেই।”
দেওয়াল থেকে দুটো কমদামী মানপত্র খসিয়ে নিয়ে এল।
অপরেশ অস্ফুটে বলে ফেলল, “বোকা!”
এবার মঞ্জরী খাটের নিচ থেকে সেই ঝকঝকে কাঁসার থালাটা তুলে এনে অপরেশের সামনে ধরল, “এটা চাইছেন নিশ্চই?”
অপরেশের মুখে কথা নেই! কেবলমাত্র ভিজে কদম কাঠের বাতা বেয়ে দুফোঁটা উষ্ণ জল টপ টপ করে থালাটার খোলে ঝরে পড়ল!
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)