Subscribe to Magazines






পরবাসে সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের
লেখা

এবং বই



ISSN 1563-8685




মধুপুরের পাঁচালি

ফাইন্ডার




র! মর, মর...

সুপরিচিত কাংস্যনিন্দিত কণ্ঠে ভরদুপুরে এই সুমধুর অভিসম্পাতের মর্মরধ্বনি শুনে একটু চমকে উঠে আগের দিনের স্টেটসম্যান ফেলে রেখে লাফিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দেখি একটা ছোট বাতাবি লেবু নিয়ে পাশের বাড়ির পাঁচিল টপকে পালাচ্ছে আমাদের অতি আদরের বন্ধু ফাইন্ডার। চাদর একখানা জড়ানো ছিলো বটে কিন্ত তাও আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলো না, কেন না চাদরটাও যে আমার চেনা!

ফাইন্ডার? দাঁড়ান দাঁড়ান পাঠিকা, বুঝিয়ে বলছি। ক্রিকেট খেলেছেন তো? ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া করে? তাহলে তো খুব সহজ ব্যাপার। ওই ডীপ মিড অন আর স্কোয়্যার লেগের ঠিক মাঝখানের পোজিশনটার নাম হলো ফাইন্ডার। ছোটনাগপুরী জংলী ক্রিকেটে। কেন, তা জিগ্যেস করবেন না। তবে ও অঞ্চলে অনেক জায়গাতেই ওই পোজিশনটি আর ওই কথাটি দেখেছি। ওই ফীল্ডারদের কাছে একটা লাঠি থাকতো।

অনেক ব্যাটসম্যানদের সহজাতভাবেই ওই দিকে বল পাঠানোর প্রবণতা থাকে। ঝোপঝাড়ও ছোটনাগপুর এলাকায় প্রচুর। সাপখোপ তো থাকবেই। হয়তো এই সব কারণেই ওই লাঠিওয়ালা ফীল্ড পোজিশনটি সৃষ্ট হয়েছিলো। কে জানে।

যাকগে যা বলছিলাম। ফাইন্ডার তো বাতাবি লেবু নিয়ে সটকালো। মধুর অভিসম্পাতবর্ষী ওবাড়ির দিদার তীক্ষ্ণ নজর এড়াতে পারলাম না মাঝখান থেকে আমি।

ড্যাকরাটা কে রে দাদু? তুই নিশ্চয় চিনিস? — এই সহজ প্রশ্নের উত্তরে আমার ইচ্ছে হলো একটু খেলতে। মাসটা, যদ্দুর মনে পড়ছে, ছিলো আপনাদের ওই পচা ভাদ্দর। অতএব...

ওই যে তোমরা বলো না গো, দুপুরে যারা ঢেলা মারে, ওরাই বোধ হয় দিনের বেলা নষ্টচন্দর করছে গো। ঢেলা মেরে লেবু পেড়েছে। আর কে হবে বলো।

রাম রাম কান তোর আমি রাম রাম ছিঁড়ে দেবো রাম রাম একদিন - বলতে বলতে দিদা তো ওনাদের খিড়কির দরজা দিয়ে পিছু হটে শামুকের মতো ঘরে ঢুকে গেলেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ওনার সাক্ষাৎ পূর্বপুরুষ ছিলেন কিনা, তাই ব্যাসদেবের মহাভারত ডিক্টেশনের মতো উনিও একসঙ্গে অনেকগুলি বাক্য বলতে পারতেন।

আর নানা রকম সমস্যা নিয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের প্রজেক্ট।

ধীমতী পাঠিকা এতক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই যে এটি আসলে বাতাবি লেবুর কেচ্ছা। এতসব বললাম তার কারণ শব্দসংখ্যা না বাড়ালে ভবিষ্যতে কোনো অশিক্ষিত সম্পাদক বা কিপটে প্রকাশক ঘ্যানঘ্যান করতে পারেন।

ভালো প্লেয়ারদের যেমন স্পোর্টস স্যারেরা প্রোমোশন দিতে চান না, তেমনি ফাইন্ডার আর উইকেট-কীপারদেরও ব্যাটের মালিক, মানে ক্যাপ্টেনরা ব্যাটিঙের ন্যায্য ভাগ দিতে চায় না। ঠিক এই কারণেই আমাদের ফাইন্ডারের কিছুদিন যাবৎ ফাইন্ডিং করতে ভালো লাগছিলো না। আমি তাই ভাবলুম যে ও বোধ হয় ফুটবলের আয়োজন শুরু করবার জন্য বাতাবি লেবু ন্যাশানালাইজ করছে।

অনেক পাঠিকা অনেক কিছুই জানেন, তাও মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে প্রমাণ সাইজের পাকা বাতাবি লেবু সাধারণত আট রকমের হতে পারে। লাল কিম্বা শাদা। মিষ্টি অথবা তেতো। আর গোল হতেও পারে, নাও হতে পারে। মানে দুই টু দি পাওয়ার তিন ইকোয়াল টু আট।

(জামাইবাবুদের মতন তেলা বা ছোটকাকাদের মতন খসখসে চেহারা হওয়ার ব্যাপারটা না হয় বাদই দিলাম।)

বুঝতে পারলেন না তো? আপনাদের দ্বারা আর কিসু হবে না। ফোনটাকে রিমোট ভেবে নিয়ে সিরিয়াল দেখার চেষ্টা করুন।

লাল আর মিষ্টি হলে লেবুটার কোয়া কটার ঝুরিগুলো নুন আর মরিচগুঁড়ো মেখে দারুণ জমে। ঠিকমতো গোল হলে ফুটবলও খেলা যায়।

তা আমি ভাবলুম লেবুটা একটু দেখা দরকার। রাহীলাল (ফাইন্ডারের আসল পিতামহীদত্ত নামটা মনে পড়ে গেল) একাই ওটা মেরে দেবে?

হাঁপাতে হাঁপাতে তক্ষুণি ওদের বাড়ি পৌঁছে রাহীর বোন মনমতীয়ার কাছে শুনলাম ওর নাকি রাত থেকে ধুম জ্বর, বিছানায় পড়ে আছে। সত্যিই দেখি তাই। আর নো বাতাবি লেবু এনিহোয়্যার।

মনুটাকে আমার দিদার কাছে জ্বরের বড়ি নিতে আসতে বলে দিয়ে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফিরছি, দলের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা। একজনের হাতে চুরি করা শালিখের ডিম, আরেকজনের হাতে সেই লেবুটা! কাছেই মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছে।

দাঁতে করে একটু খোসা ছুলে নিয়ে দেখা গেলো ভেতরটা লাল। চেহারাটা তো একটু চ্যাপ্টাপানা ছিলোই, কাজেই নিঃসন্দেহে পাশের বাড়ির গাছের লেবু। মিঠে হওয়াই উচিত।

ভদ্রভাবে যে-কোনো বাড়ি থেকে একটা কাঁসিতে এক চিমটি নুন আর চাট্টি গুঁড়ো মরিচ চেয়ে আনাই যেতো, কিন্ত তাতে স্বাদ ঠিক খুলতো না। কাজেই ও সব বস্তু চুপিসাড়ে ম্যানেজ করা হলো।

কেচ্ছার শেষটা একটু দুঃখের। আমার চাদর-না-চেনা চোরের ফেলে যাওয়া ওই সুস্বাদু অথচ রহস্যময় লেবু খেলাম আমরা জনচারেক। তারপর সকলেই কয়েকদিন বিচ্ছিরি জ্বরে ভুগলাম। খেলাধুলো বন্ধ।

আর লেবুর মালকিন ও বাড়ির কোন্দলিনী দিদা গজগজ করতে লাগলেন - হবে না? দুপুরবেলা রাম রাম যত সব রাম রাম...



(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)