দেখেছ, তোমার নামটাই এখনো জানা হয়নি!
স্টিয়ারিংএ হাত রেখেই মেঘনা বলে, পাশের সিটে পাথরের মতো থম মেরে বসে থাকা মেয়েটির দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে। এক নম্বর গেট পেরোনোর পর সামনে ফাঁকা যশোর রোড। লকডাউনের খাঁ খাঁ দুপুরে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে।
— সুরমা। জবাব দেয় মেয়েটির মা। পেছনের সিট থেকে।
রিয়ার মিরারে পেছনে কোনো গাড়ি নেই দেখে নিয়ে তবু আরেকবার পাশের সিটের মেয়েটার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু তাকায় মেঘনা।
— সুরমা মিত্র। মেয়েটি এবার সামনের রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দেয়।
— সুরমা? আজকাল তো এমন নাম শোনাই যায় না!
— নদীর নাম। বাংলাদেশের। আসলে ওনার চেতনায় ছেয়ে ছিল বাংলাদেশ। টানটা অবশ্য নদীর দিকেই ছিল বেশি। পেছনের সিট থেকে ভদ্রমহিলা আবার উত্তর দেন। বলতে বলতে গলা আবেগে কেঁপে ওঠে।
'মেঘনা-সুরমা', বিড়বিড় করে দুটো নাম একসঙ্গে ক'বার উচ্চারণ করে মেঘনা। এবং জোরে হর্ণ দেয়। প্রায় মাঝ রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা সাইকেল আরোহী চমকে হুড়মুড় করে ধারে সরে যায়। পাশে বসে থাকা বছর তেরো-চোদ্দোর মেয়েটির দিকে মেঘনা আবার তাকায়। একই রকম শ্যামলা রঙ, সরু চিবুক, ঢেউ খেলানো নাক, ফুল্ল ঠোঁট। একদম যেন তেরো বছরের মেঘনার প্রোফাইল। আসলে একজন উনত্রিশ জানে তেরোতে তাকে কেমন দেখতে ছিল, তেরোর পক্ষে উনত্রিশে তাকে কেমন দেখতে হবে কল্পনা করাও মুশকিল।
মেঘনা আজ এসেছিল পলাশের কাছে। পলাশের নার্সিংহোমে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পলাশ ওর সঙ্গেই পড়েছে। এক কলেজ, এক কোচিংক্লাশ। জয়েন্টও দিয়েছিল একসঙ্গে। পলাশ আরজিকর থেকে এমবিবিএস। তারপর এমডি। ক'বছর গ্রামে-ট্রামে চাকরি করে এখন এখানেই থিতু। ডাক্তার হিসাবে সুনাম আছে। অকারণে রুগিদের পকেট কাটার বদনাম নেই। বরং লোকে তাকে আড়ালে গরীবের ডাক্তার বলে। আর জয়েন্টে ভালো নম্বর পেয়েও মেঘনা দুম করে ভর্তি হয়েছিল প্রেসিডেন্সিতে। হিস্ট্রি অনার্স। তারপর এমএ, বিএড। এখন রাজারহাটের একটা স্কুলে। আজকাল অবশ্য স্কুলে নিয়মিত যেতে হচ্ছে না, অনলাইনে ক্লাশ নিতে হয়।
— এই আমার না দুদিন ধরে গলাটা খুব খুসখুস করছে। করোনার টেস্ট করিয়ে দিবি? গতকাল ফোনে পলাশকে বলেছিল। এমন সব উদ্ভট ইচ্ছা হলেই ওর পলাশের কথা মনে পড়ে। শুধু রোগ-ব্যাধি বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণেই নয়, কলকাতায় বসে উটের মাংস খাওয়ার অথবা হিব্রু ভাষা শেখার শখ হলেও। মেঘনার সব অদ্ভুত ইচ্ছাপূরণের একমাত্র সহকারী হলো পলাশ।
— জ্বর আছে? দুর্বলতা? অন্য আর কোনো উপসর্গ?
— না।
— তবে?
— তুই করিয়ে দিবি কি না বল? আমি কাল সকাল এগারোটা নাগাদ আসছি। মেঘনা ফোন রেখে দিয়েছিল। পলাশ মেঘনাকে চেনে। জানে ওর যখন একবার মাথায় ঢুকেছে তখন টেস্ট না করিয়ে ছাড়বে না। সুরক্ষায় বলে রেখেছিল। নার্সিংহোমে একজন রুগীরও ন্যাসোফেরিঙ্গাল সোয়াব নিতে হবে। সঙ্গে মেঘনারও।
নার্সিংহোমের সামনে রাস্তার ধার ঘেষে গাড়ি পার্ক করার সময়েই মেঘনার নজরে আসে জটলাটা। চার পাঁচজন যুবক চাপা গলায় কথা বলছে। দেখেই নিম্নবিত্ত বলে চেনা যায়। দুজনের মুখে মাস্ক পর্যন্ত নেই। কোনো মহিলাকে আগে কখনো গাড়ি চালাতেও দেখেনি বোধহয়, কথা থামিয়ে হাঁ করে মেঘনার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘনা বুঝতে পারে কোনো শলা পরামর্শ চলছিল। হয় ওদের পেশেন্টের সিরিয়াস কন্ডিশন নয়তো মারা গেছে। ও সিঁড়ি ভেঙে ফার্স্টফ্লোরের রিসেপশনে পৌঁছয়। ফেস-শিল্ড পরা রিসেপশনিষ্ট মেয়েটি মেঘনাকে বলে, স্যারের কেবিনে পেশেন্ট পার্টি আছে। একটু অপেক্ষা করতে হবে ম্যাডাম। আপনি কোভিড টেস্ট করাবেন তো? স্যার বলে রেখেছেন। মেঘনা একদিকের খালি চেয়ারে বসে। আর তখনই ওর চোখ যায় ঠিক উল্টোদিকের দুটো চেয়ারে বসে থাকা মা ও মেয়ের দিকে। ভদ্রমহিলার থুতনির কাছে নামানো মাস্ক। মেয়েটির মাস্ক হাতে ধরা। মায়ের কাঁধে ক্লান্ত মাথা রেখে বসে আছে মেয়ে। দুজনের চোখ-মুখে শোকের চিহ্ন। মেয়েটির মুখ যেন অবিকল মেঘনার অল্প বয়সের মুখ।
কিছুক্ষণ পরে মেঘনাকে ডান দিকের একটা ঘর দেখিয়ে রিসেপশনিষ্ট বলে, ম্যাডাম, আপনি ঐ ঘরে যান। ওখানে সুরক্ষা থেকে সোয়াব কালেক্ট করতে এসেছে। মেঘনা সোয়াব দিয়ে ফিরে এসেও দেখে মা আর মেয়ে তেমনি বসে আছে।
— কি রে, মুড খারাপ মনে হচ্ছে? ডাক্তারদের নাকি এখন দম ফেলার সময় নেই, আর তোর তো দেখছি চেম্বারই ফাঁকা। একটু প্রাক্টিশে মন দে! পলাশের কেবিনে ওর মুখোমুখি বসতে বসতে মেঘনা বলে।
— আমি বলে রেখেছিলাম। তোমার সোয়াব দেওয়া হয়ে গেছে?
— আবার তুমি করে বলছিস? তুই না ইনকরিজেবল! কতবার বলেছি তুই আমাকে তুমি করে বললে আমার হাসি পায়!
পলাশ ম্লান হাসে। তারপর বলে, কাল দুপুরে একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিল, বাঁচাতে পারলাম না!
— করোনা?
— জানি না। টেস্ট করানোর সুযোগই তো পেলাম না! আজ ভোরেই মারা গেলেন।
— ওহ! ভেরি স্যাড। মানুষ এমন পটাপট মরে যাচ্ছে আজকাল! আচ্ছা ওর বাড়ির লোকদেরই বোধহয় নার্সিংহোমের বাইরে দেখলাম। বাই দ্য বাই, রিসেপশনে এক মহিলা আর একটি ছোটো মেয়েকে বসে থাকতে দেখলাম, ওরাও কি...?
— ঐ পেশেন্টের স্ত্রী ও মেয়ে। আর বাইরে পেশেন্টের পাড়ার কিছু ছেলে-ছোকরা আছে। ওরাই গাড়ি ভাড়া করে শ্মশানে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন এমন অবস্থা, অ্যামবুলেন্স পাওয়া যায় না সময় মত, এমনকি মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার গাড়িও। এই ভদ্রমহিলাও মেয়েকে নিয়ে কী করে যে ফিরবেন! লকডাউনে গাড়িও তো পাওয়া মুশকিল।
— তুই কী রে? কোন পেশেন্টের পরিবার কী করে বাড়ি ফিরবে সেটাও তোর চিন্তার বিষয়? এখানে নার্সিংহোম না খুলে সুন্দরবনে গিয়ে আরোগ্যনিকেতন খুলতে পারতিস।
— তাহলে কি আর এই রয়াল বেঙ্গল টাইগ্রেসটির সঙ্গে যোগাযোগ থাকতো?
— ছাড়! বাজে কথা বলিস না। আচ্ছা, পেশেন্টের নাম কী রে?
— সজল মিত্র। কেন?
উত্তর না দিয়ে পলাশের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে মেঘনা। পলাশ ওর হাতের ওপর হাত রাখে। মৃদু চাপ দিয়ে বলে, কী হলো?
কিছু না, উঠব এবার। তুই পিপিটি কিট না পরে রুগি দেখছিস কেন?
— ঠিক আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। ভাববাচ্যে উত্তর দেয় পলাশ।
—উঠলাম। রাতে ফোন করিস। মেঘনা বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে। আবার সঙ্গে সঙ্গেই কেবিনে ঢুকে প্রশ্ন করে, কোথায় থাকে?
— কে?
—সজল মিত্র। মানে ওঁর পরিবার। কাছেপিঠে হলে আমি পৌঁছে দিতে পারি।
— পাগলামি করতে হবে না। ডেডবডি নিয়ে যাওয়ার পরে ওই ছেলেরাই নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করবে।
— কোথায় থাকে বল। মেঘনা আবার একই প্রশ্ন করে।
— নিউ ব্যারাকপুরের আশেপাশে কোনো কলোনি।
— ওদের ডেকে বলে দে যে আমি অপেক্ষা করছি, এখানকার কাজ মিটলে আমিই ওদের পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরব।
পলাশ বুঝতে পারে এর আর অন্যথা হবে না।
সাজিরহাটের আগে একটা সরু গলি দিয়ে বেশ কয়েকবার ডাইনে-বাঁয়ে করে খাল পাড়ের একটা উদ্বাস্তু কলোনিতে এসে ওরা পৌঁছায়। নেহাৎ ছোটো গাড়ি তাই, বড় কোনো গাড়ি হলে এখানে ঢুকতোই না। অপরিসর রাস্তা। কাঁচা-পাকা নিচু বাড়ির সারি। টালি বা টিনের চালই বেশি। রাস্তার ধারে ধারে কলাগাছ। পেঁপে ও কুল গাছ। আকন্দের ঝোপ। আর গা ঘেঁষাঘেষি করা বিবর্ণ বাড়িগুলোর পেছনেই হেজে যাওয়া নোয়াই খাল। গাড়িটা দাঁড়াতেই আশপাশের বাড়ি থেকে এসে জড়ো হয় কিছু ছেলেপুলে, নারীপুরুষ। সবার মুখেই উদ্বেগ, শোকের চিহ্ন।
— যাক্! বাড়ির সামনে একটু উঠোন আছে। গাড়ি ঘোরাতে সুবিধা হবে, মেঘনা বলে।
— আপনার খুব কষ্ট হলো। ডাক্তার বাবু বললেন তাই..., ভদ্রমহিলার বিব্রত স্বর।
— না না ঠিক আছে। আমি নিজেই পলাশকে বলেছিলাম। আপনারা আগে নেমে যান। তারপর আমি এখানে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যাব। মেঘনা ঝুঁকে সুরমার দিকের দরজা খুলে দেয়। পেছনের দরজা খুলে নামতে নামতে সুরমার মা বলেন,
— কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব! এখন আপ্যায়ন করতে পারব না, তবু যদি একটু ভেতরে আসেন ভালো লাগবে।
সকালে যার স্বামী মারা গেছেন তার এই স্থৈর্য ও সৌজন্যবোধ দেখে মেঘনা অবাক হয়। গাড়িতেও যেটুকু কথা হয়েছে তাতে ভদ্রমহিলাকে বেশ ব্যক্তিত্বময়ী বলে মনে হয়েছে। কথার মধ্যে দিয়ে যেটুকু জেনেছে, ভদ্র মহিলা বারাসাতের কাছে একটা প্রাইমারী স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা। আর সুরমা পড়ে ক্লাশ এইটে। মেঘনা সুরমার দিকে তাকায়। চোখাচোখি হয়। মেঘনার মনে হয় সেই মেঘলা চোখেও যেন নীরব অনুরোধ। মেঘনা ঘড়ি দেখে, প্রায় দেড়টা বাজে।
— আপনারা ভেতরে যান, আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে ধার ঘেষে পার্ক করে আসছি।
— আচ্ছা। তাই আসুন। সুরমা, তুই ওনাকে নিয়ে আয়, আমি ভেতরে যাচ্ছি।
প্রতিবেশীদের নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ভদ্রমহিলা প্লাস্টার না করা বাড়িটার দরজার তালা খুলে একা ভেতরে ঢুকে যান।
খুব সাধারণ আসবাবে সাজানো নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘর। বোধহয় একটিই ঘর। তবে বেশ বড়। পেছনদিকের দরজা দিয়ে রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে।
— কতদিন ধরে আছেন এখানে? মেঘনা জানতে চায়।
— আমি? তা পনেরো বছর, মানে বিয়ের পর থেকেই। তবে শুনেছি উনি নাকি ছেলেবেলাতেই বাংলাদেশ থেকে সোজা এখানেই এসেছিলেন। পাশেই কোনো জ্ঞাতি ছিল। তারাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। অবশ্য তারা নিজেরাই পরে মধ্যমগ্রামে ভালো বাড়ি করে চলে গেছে।
— আপনারা গেলেন না? সুরমার জন্য এই কলোনির পরিবেশ তো ঠিক...!
— উনি রাজি হলে তো! মাত্র আট-দশ বছর বয়সে বিধবা মায়ের সঙ্গে প্রায় একবস্ত্রে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসে এই নদীর পাড়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন। মায়ের স্মৃতিও এই বাড়িতে। তাই ছাড়তে রাজি হতেন না। তাছাড়াও এই যে পেছনের খালটা দেখছেন, নোয়াই। উনি বলতেন, এটা নাকি একসময় ভাগীরথীর শাখা নদী ছিল। লাবণ্যবতী। বলতেন, এক সময় এ নদীর ধারে নাকি মানুষ জনপদ গড়ে তুলেছিল এমন উর্বর ছিল এর দুই ধার।
— হ্যাঁ, ইংরেজরা এসে সেই সব জমিতে জোর করে নীলচাষ করাতো। এমনকি চৈতন্যচরিতামৃতেও নাকি লাবণ্যবতীর উল্লেখ আছে। সুরমা বলে ওঠে। এই প্রথম একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে ও।
— বাবা, তুমি তো দেখছি অনেককিছু জানো!
— বাবা গল্প করেছে। আমার বাবা খুব পড়াশোনা করত। অনেক কিছু জানতো। বাবার ঘরে গেলে দেখবেন কত্ত বই। আর খুব বড় মন ছিল আমার বাবার। মায়ার শরীর। অন্য মানুষদের জন্য সবসময় ভাবত। সবাইকে ভালোবাসতো। বলতে বলতে উত্তেজনায়, গর্বে সুরমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারপরই দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে।
— চলো তোমার বাবার ঘরে যাই। সুরমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেঘনা বলে।
— ওনার ঘর বলতে ঐ রান্না ঘরের লাগোয়া একটা ছোটো ঢাকা-বারান্দা। সুরমার মা বিব্রত হয়ে বলে ওঠেন।
— আচ্ছা, হঠাৎ কী ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন উনি? বয়স তো বেশি হয়নি! কোনো ক্রণিক রোগ ছিল? মানে হার্টের বা সুগারের?
— মাত্র আটান্ন। না, রোগ কিছু ছিল না। তবে শরীরের ওপর খুব অত্যাচার করতেন। খাওয়া দাওয়ার কোনো সময় ছিল না। সারাদিন পরিবেশ বা নদী বাঁচানোর কাজে ঘুরে বেড়াতেন। যশোর রোডে গাছ কাটার প্রতিবাদে সাতদিন তো রাস্তাতেই ছিলেন। না হলে মানুষের বিপদে সাহায্য করতে ব্যস্ত। আর খুব সিগারেট খেতেন। সুরমার মা বলেন। ওর স্বর ক্রমশঃ ভারী হয়ে ওঠে স্বামীর কথা বলতে গিয়ে। আঁচল দিয়ে মুখ কপাল মুছে নেন। চোখও।
— আমপানের পর কটা ছেলে জোগাড় করে চলে গেলেন সুলকুনী দ্বীপে। চণ্ডীতলা না কি আরো সব কোন গ্রামে। আমি তো সব চিনিও না, ইছামতী, কালিন্দী, ডাঁসা নদী, ছোটোখালি এসব নাম শুনতাম যখন যাওয়ার আগে ছেলেদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিন চার দিন ওখানে থেকে ঘুরে ঘুরে রিলিফের কাজ করে যখন পরশুর আগের রাতে ফিরে এলেন গায়ে ধুম জ্বর।
— আপনি বাধা দিতেন না?
— না! প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছিলাম। তারপর বুঝলাম এই পরোপকারী, বাউন্ডুলে, বিরাট মনের মানুষটাকেই তো ভালোবেসেছিলাম, তাকে নিজের প্রয়োজনে জোর করে বদলানোর চেষ্টা করবো কেন? ম্লান হাসলেন ভদ্রমহিলা।
— এবার আমাকে উঠতেই হবে। একবার ওঁর ঘরটা দেখে যাব? মেঘনা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
সুরমাও ওদের পেছন পেছন আসে। সত্যিই ছোট্টো একটা ঘর বা ঢাকা-বারান্দা। পেছনের জানলা দিয়ে দেখা যায় নোয়াই খাল। তার ধারে অজস্র কলাফুল, মোরগঝুঁটি আর গাঁদা ফুল ফুটে আছে। ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে একটা সস্তার কাঠের টেবিল ও তিনদিকে তিনটে চেয়ার। দেওয়াল জুড়ে তাক এবং তাতে অসংখ্য বই। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য। বাংলা ও ইংরাজী দুইই। পাশাপাশি রয়েছে 'চিলেকোঠার সেপাই' এবং 'মাই নেম ইজ রেড'। রঙ চটে যাওয়া রবীন্দ্ররচনাবলীর পাশেই রয়েছে রম্যাঁ রলাঁর 'শিল্পীর নবজন্ম'। অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'লালন ও তাঁর গান' এবং জ্যোতি ভট্টাচার্যের 'পরিপ্রশ্ন'। আর দেওয়ালে ঝুলছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ফটো। ছ'টি ছবির কোলাজ। বালিকা সুরমার দুটো রঙিন ছবি, এক বৃদ্ধার সঙ্গে তরুণ সজল মিত্রের একটি সাদাকালো ছবি। ঠাকুমা, তাই না? মেঘনার প্রশ্নে সুরমা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। দুটো ছবি ওঁর মধ্যবয়সের, সুরমার মায়ের সঙ্গে। সেও রঙিন। বোধহয় বিয়ের পরপরেই কোথাও বেড়াতে গিয়ে তোলা।
— অমরকন্টক। নর্মদার উৎপত্তি। একবারই বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা বলেন।
— আর এই ছবিটা? একটি বছর খানেকের শিশুকে কোলে নেওয়া যুবক সজল মিত্র।
— ওঁরই ছবি। কোলে ওঁর এক আত্মীয়ার মেয়ে।
যশোর রোড দিয়ে ফেরার সময়ই ভাইব্রেশন মোডে রাখা মোবাইলটা ড্যাশবোর্ডে কাঁপতে থাকে। গাড়িটা সাইড করে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে, মা কলিং। বাপীর দুটো মিসড্ কল।
— আড়াইটে বাজে, তুই কোথায়? তোর বাপীও ফোন করেছিল, তুলিসনি কেন? না খেয়ে সবাই বসে আছি।
— সাইলেন্ট ছিল। ব্যাগে। টের পাইনি। আরো আধঘন্টা লাগবে। তোমরা খেয়ে নাও।
— একটা ফোন করতে পারিস না? দুঃশ্চিন্তা হয় না? তোকে নিয়ে টেনশন আর আমার এ জীবনে ঘুচল না।
— রাখলাম। ফোন কেটে দেয় মেঘনা। ফাঁকা রাস্তার পাশে একটা ঝাঁকড়া মাথা অমলতাসের নিচে গাড়িটা দাঁড় করায়। ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে একটা ধরিয়ে বাঁদিকের কাচটা নামিয়ে দেয়।
— খবরদার নীচে নামবি না। দরজা খুলবি না। তোকে ধরে নিয়ে গেলে আর কিন্তু আমার কাছে আসতে দেবে না। ওর কানে ভাসে মায়ের তীক্ষ্ণ স্বর। তখন থেকেই ওকে নিয়ে মায়ের টেনশন! প্রায় পঁাচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের কথা। তিন বছরের মেঘনা দোতলার ঘরের দরজা একটু ফাঁক করে শুনতো একতলায় একজন অচেনা মানুষ সমানে অনুরোধ করছে তার মেয়েকে একবার চোখে দেখার জন্য। আর মা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, তোমার মেয়ে? কোথায় ছিল মেয়ের জন্য দরদ যখন বন্যায় আমাদের ঐ বস্তির ঘরে ফেলে রেখে সারাদিনরাত কলার ভেলায় চেপে দল বেঁধে সমাজসেবা করে বেড়াচ্ছিলে?
— তোমরা তো নিরাপদে ছিলে, মায়া।
— থাক্, এক কথা আমি আর শুনতে চাই না। নিরাপদে ছিলাম! বন্যায় খাল থেকে সাপ ব্যাঙ ঢুকে পড়ত ঘরে। আর উনি ঘুরছেন অন্যদের সেবা করতে! তুমি ওই অন্যদের নিয়েই থাক। তোমার মতো দায়িত্বহীন এক অসামাজিককে সবার অমতে বিয়ে করাই আমার ভুল হয়েছিল। যাও যাও, আমি এক মুহূর্তের জন্যও তোমার কাছে মেয়েকে আনব না। মেঘনাকে ভুলে যাও।
— এই চকলেটগুলো অন্ততঃ ওকে দিও। মেঘনা ওপর থেকে শুনতে পেত সেই কম্বুস্বরের আকুতি। একদিন নয়, অনেকদিন। কিন্তু মা কখনোই দেখা করতে দেয়নি মানুষটার সঙ্গে। মানুষটা নাকি স্বর্থপর, খালি নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। উচ্চাশাহীন! এক আইডিয়ালিস্ট ভবঘুরে, রিয়ালিস্ট নয় মোটেই। মায়ের মুখেই শোনা। এসবের মানেও পরিস্কার করে বুঝত না তখন। তখনও দিদু বেঁচে। ষষ্ঠীতলায় দাদুর ঐ দোতলা বাড়িটিতেই মা ফিরে এসেছিল মেঘনাকে কোলে নিয়ে।
— বুঝি না বাপু, তোমার সবকিছুই চটজলদি! বিয়েও যেমন, বিয়ে ভাঙাও তেমন। সেই ফিরেই আসবে যদি তো এতো কাণ্ড করে বিয়ে করার দরকার কি ছিল! শান্ত স্বভাবের দিদু তার বাড়িতে এ সব চেঁচামেচি পছন্দ করত না। বিরক্ত হত।
— আমি কি জানতাম যে ওর সঙ্গে কোনো সুস্থ মানুষের থাকা সম্ভব নয়! জানলে বিয়ে করতাম? মায়েরও স্বরে বিরক্তি। মা তখন সবার ওপরে, সবকিছুতেই বিরক্ত।
— কেন থাকা সম্ভব নয়? নেশা করে না, বাইরের মেয়েছেলের রোগ নেই, গায়ে হাত তোলে না... মেয়েমানুষের একটু মানিয়ে নিতে হয়।
— থাক! তোমার আর ওকালতি করতে হবে না। রাগে নিজের ঘরে ঢুকে আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করে দিত মা।
তারপর একসময় বন্ধ হয়ে যায় ঐ মানুষটারই আসা। মেঘনাও ভুলে যায় প্রায় না দেখা মানুষটার অস্তিত্ব। ওর যখন সাত বছর বয়স মা আবার বিয়ে করে। বাপীকে। হ্যাঁ, বাবা নয়, রতন সরকারকে মেঘনা বাপীই ডাকে। নিপাট ভদ্র মানুষ। মেঘনাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। একটা ভাইও হয় ওর। মনোজ। ভাইয়ের বয়স এখন কুড়ি। একদম মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। মেঘনার মতো শ্যামলা, সাধারণ নয়। মেঘনার এই সাধারণ দেখা নিয়েও মায়ের কী টেনশন। পাতলা চুল ঘন করতে নিয়ম করে জবাফু্লের রস, গায়ের শ্যামলা রঙ উজ্জ্বল করতে কাঁচা হলুদ বাটা। তাও কী লাভ হলো! যেখানেই গেছে শুনতে হয়েছে মেয়ে মায়ের মতো সুন্দরী হয়নি। মায়া সত্যিই সুন্দরী! এই ছাপ্পান্নতেও যেন যুবতী। কিন্তু মেঘনা যে মেধাবী, কোনো বছর ফার্স্ট না হয়ে ক্লাশে ওঠেনি তার যেন কোনো মূল্যই ছিল না মায়ের কাছে। রাত জেগে পড়াশোনা করলেও মায়ের টেনশন চোখের তলায় কালি পড়ে যাবে। বা চোখ খারাপ হয়ে চশমা নিতে হবে।
গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে মেঘনা যখন কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়ায় তখন ঠিক তিনটে। মায়াই দরজা খোলে। উদ্বিগ্ন মুখ।
— এই লকডাউনে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস? মানুষ এখন ভয়ে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত যাচ্ছে না!
মেঘনা মায়ের চোখের দিকে তাকায়। সে চোখে চিরকালের টেনশন।
— যা আমি আর তোর বাপী এখনও খাইনি। একসঙ্গে খাব। চেঞ্জ করে হাত-মুখ ভালো করে সাবানে ধুয়ে আয়। কুড়ি সেকেণ্ড ধরে সাবানের ফেনায় হাত ঘষবি কিন্তু। দরজা বন্ধ করতে করতে মায়া বলে।
— ভাত তো বাড়ো, পাঁচ মিনিটে আসছি। মেঘনা বলে।
— বেশি দেরি করিস না, তোর পছন্দের প্রিপারেশন করেছি, মাংস। খাসির। এখন সবার বেশি করে প্রোটিন খাওয়া দরকার।
খেতে বসে, ডাল, পটল ভাজা আর মোচার তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই মেঘনা হঠাৎ উঠে পরে।
— কী হলো মামণি, শরীর খারাপ? রতনবাবু বলেন।
— এ কি, মাংস খাবি না? মনোজ বলল আজ নাকি দারুণ রান্না হয়েছে। তুই মুখেই ছোঁয়াবি না?
— না। খিদে নেই।
— খিদের আর কী দোষ! এতো বেলা, পিত্তি পড়ে খিদে মরে গেছে। মায়ার রুষ্ট স্বর।
মেঘনা কোনো উত্তর না দিয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে সোজা নিজের ঘরে এসে বসে।
একটু পরেই মায়া আসে। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলে, কী হয়েছে, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? এসময়ে কেন বাইরে যাস বল তো! আমার টেনশন হয়।
— কাল রাতে বাবা মারা গেছে?
— কে?
— আমার বাবা। সজল মিত্র। মায়ার বিহ্বল চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে মেঘনা কথাগুলো উচ্চারণ করে।
— তুই কী করে জানলি? মায়া প্রায় ফিসফিস করে বলে।
— আমি খালপাড়ের সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম, যেখানে আমার জন্ম।
— ও! তাই মাংস মুখে তোলা হলো না? অশৌচ মানা হচ্ছে? মায়া সম্বিত ফিরে পেয়ে ফোঁস করে।
— বাবা কী ভাবে মারা গেছে জানো?
— আমি কী করে জানবো! করোনা?
— আমপানে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সাহায্য করতে গিয়ে। তিনদিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার বাবার মনটা খুব বড় ছিল, তাই না, মা? সজল, নদীর মতো...
— জানি না! এসব নিয়ে আর কথা বাড়িও না। মায়া বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে মেঘনা। তারপর মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপ খুলতে প্রথমেই দেখে পলাশের মেসেজ।
'কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ওদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য অতদূর যাওয়ার কোনো দরকার ছিল কি? তুমিও কিছু কম পাগলামি করো না। তোমার রিপোর্টটা সুরক্ষা থেকে আগামী কাল সন্ধায় তোমার মোবাইলেই সরাসরি পাঠিয়ে দেবে।' মেঘনা দুবার মেসেজটা পড়ে। তারপর পলাশকে ফোন করে,
— হ্যালো, ডক্টর পলাশ গুহ, গরীবের ডাক্তার, আপনি কি অনুগ্রহ করে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
— কী ব্যাপার, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? পলাশের গলায় উদ্বেগ।
— এই শোন্, তুই আমাকে সারাজীবন তুমি বলতে পারবি? আমার সব পাগলামি সহ্য করতে পারবি? মেঘনার গলায় এমন কিছু ছিল, পলাশ হতবম্ব হয়ে যায়। উত্তর দেয় না।
— কী হলো, বলো? মেঘনার গলার স্বর উতলে ওঠা দুধের মতো ঘন হয়ে ওঠে।
— পারবো। পলাশ অস্ফুটে বলে।
— তাহলে আজ সন্ধ্যায় তোমার রুগিটুগি দেখা হলে একবার এসো, দরকারি কথা আছে। করোনা সংক্রান্ত নয় অবশ্য, বুঝলেন হাঁদুরাম। ফোন কেটে দেয় মেঘনা।
প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। পলাশের আসার কথাটা মাকে বলতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশে মায়ের ঘরে উঁকি মারে। মা নেই, বাপী একা পাশবালিশ আঁকড়ে ভাতঘুম দিচ্ছে। মনোজের ঘর বন্ধ। রান্না ঘরে গিয়ে সেখানেও মাকে দেখতে পায় না। কোথায় গেল মা! মেঘনা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে ছাতে উঠে আসে। সাদা টাইলস বসানো পরিস্কার ছাতের ঠিক মধ্যেখানে মায়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। একমাথা কালো কুঁচকানো চুল মাথা ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছে যেন হঠাৎ আঘাতে শান্ত পানাপুকুরে ওঠা তরঙ্গ-বলয়। পিঠের ওঠা-নামা দেখে ফোঁপানি টের পাওয়া যাচ্ছে। মেঘনা আবার পা টিপে টিপে নেমে আসে নিজের ঘরে।
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)