এখন, যাদের সঙ্গে পাহাড়ে চরে বেড়িয়েছি তাদের দু-চারজনের হাবভাব ছিল খুব সন্দেহজনক। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত হয়ে শিবির পাতার পর চাট্টি নাকেমুখে গুঁজেই তারা হাতে দূরবীন, ক্যামেরা আর একটা ঢাউস বই নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। তখন তাদের কথোপকথনও নিতান্ত দুর্বোধ্য হয়ে উঠত। একজন বলত ওটা স্ট্রিয়েটেড নয়। অন্যজন ততোধিক জোরের সঙ্গে বলত দূরবীনে আমি নিজের চোখে দেখেছি গলার নীচে লম্বা লম্বা দাগ। পরদিন আবার নিশুত রাত থাকতেই তারা বেরিয়ে পড়ত। আবার একটা তর্কবিতর্ক হত। কিছুদিন যাওয়ার পর মালুম হল ও হরি এরা পাখি দেখে। পাঠক, ভুল বুঝবেন না, পাখি মানে পাখি। মানে সেলিম আলির মতো করে দেখা। বা তাঁকে অনুসরণ করে দেখা। সম্বৎসর যারা পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় তারাও একটু খ্যাপাটেমার্কা হয়। কাজেই ও নিয়ে আর মাথা ঘামাতাম না। তারপর ভালো ছবি তোলার টোপ দিয়ে এরা আমাকেও ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে ফেলল। প্রথম প্রথম রথ দেখা কলা বেচার মতো পাহাড়ে হাঁটতে গিয়ে বেশ কিছু রঙচঙে পাখি চিনে ফেললাম। দিব্যি দেখতে তারা। ঝকমকে পালক আর ঝুঁটির বাহার, কারো ঝোলা লেজ, কেউ দীর্ঘচঞ্চু, মোটেও আমাদের কাক, চড়াই, শালিকের মতো দেখতে নয়। কিন্তু ট্রেক-এ বড়ো মালপত্র বইতে হয়। সেখানে ছোটো ছোটো পাখির ছবি তুলতে যে লম্বা লম্বা ভারী ভারী লেন্স নিয়ে যেতে হয় সেগুলো নিয়ে যাওয়া মুশকিল। তার মানে প্রকৃতি আপনাকে আপনার প্রকৃতির বিরুদ্ধে একনিষ্ঠ হওয়ার দিকে ঠেলে দেবে। হয় পাহাড়, নয় পাখি।
তো ঘোর শীতকালে ট্রেক বিশেষ করা যায় না বলে পাখি দেখার সবচে ভালো ঋতু এ-দেশে শীত। অন্তত আমাদের দলের কাছে। সেই থেকে রীতি হয়ে গেল ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে দেশের এ-কোনা ও-কোনা দাবড়ে বেরিয়ে দলবেঁধে পাখি দেখা। বাতিক ছাড়া কী-ই বা বলবেন একে! এ-দলে রয়েছে গোটা তিনেক প্রখর তরুণ-তরুণী। পাখিদের হাল হকিকত তাদের ঠোঁটস্থ। আর সে কি বাজপাখির নজর তাদের। ধূসর রঙের ঘাসের বনের মধ্যে আরও ধুসর একটা ছায়া দেখা গেলেই তারা গড়গড় করে সে-পাখির ঠিকুজি-কুলুজি সব আউড়ে দেয়। আমার কাছাকাছি বয়েসের আর যে দুজন আছে তারাও পটাপট তার ছবি তুলে ফেলে। সব হট্টগোল স্তিমিত হয়ে এলে আমি কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করি কোথায়? সঙ্গীরা অনেক ধৈর্য ধরে বোঝায়, ওই যে গাছের ডালের ছায়াটা ঘাসজমিটার ওপর এসে পড়েছে তার একদম শেষে চলে যাও, তারপর একটু ডানদিকে কোনা করে ওঠো, একটা হালকা নড়াচড়া দেখতে পাবে, ওটাকে ফলো করো। এই রকম পাখিপড়া করে আমাকে পাখি দেখাচ্ছে দল আজ বছর চারেক। দলের কেউ নতুন রাম-দা কিনেছে বলে জানি না।
পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বেরোনো হল রিসর্টের গাড়ির মাথায় র্যাফট বেঁধে। আজ আমরা অনেক্ষণ জিয়া ভরেলি নদীতে র্যাফটিং করতে করতে পাখিদের বিরক্ত করব। না, না আর কিছু না, সেরেফ দেখব, পারলে ছবি তুলব। কিন্তু ধরুন রোজ যদি কিছু উজবুক এসে আপনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বিরক্ত আপনি হবেন কি না। তবে কিছুর যদি দেখা নাও মেলে এমন নামের নদীতে নৌকাবিহার করেই তো আপনার জিয়া ভরে যাবে। যে অংশটায় আমদের ঘোরার অনুমতি আছে সেখানে নদী খরস্রোতা নয়। হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং-এর মতো সামাল সামাল নয় ব্যাপারটা। দু-একটা জায়গা শুধু বাড়তি স্রোতওয়ালা। মূলত রুডিশেল ডাক-এর ঝাঁক উড়িয়ে ভেসে চলল নৌকা। রয়েছে করমোরান্ট-রা। গ্রেটার করমোরান্ট-রাও ওড়াউড়ি করছে শিকারের খোঁজে। রয়েছে হোয়াইট ব্রেস্টেড কিংফিশার আর কমন কিংফিশারেরা। নদীর মধ্যে মধ্যে চরায় বা পারে রয়েছে কমন স্যান্ডপাইপার, উড স্যান্ডপাইপার, ব্রোঞ্জউইংড জাকানা। কেউ আমাদের নৌকা কাছাকাছি এলে বিরক্ত হয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে, কেউ আমাদের পাত্তা না দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের সন্ধানে। কিন্তু আমরাও আজ তাদের পাত্তা দিচ্ছি না। মানব বলে দিয়েছে আজ আমদের লক্ষ্য আইবিসবিল, আমাদের দলের কাছে যা অদৃষ্টপূর্ব। বড়ো লাজুক পাখি এই আইবিসবিল।
আমাদের মাঝিরা বুক বাজিয়ে বলেছিলেন আমাদের আইবিসবিল দেখাবেনই। কথাও রেখেছিলেন তঁরা। একটা বাঁক ঘুরে এক ঝলকের শুভদৃষ্টি, তারপরই বঁধুয়া উড়ে চলে গেল। ধূসর রঙের পিঠ, শাদা বুক, কাস্তের মতো লাল রঙের ঠোঁট। র্যাফট-এর একটা মুশকিল সে স্রোতের সঙ্গে চলে। আর এরা উড়ে গেছে আমাদের পিছন দিকে। তাহলে কি আর কোনো উপায় নেই? নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুই মাঝি লাফ দিয়ে নেমে পড়ল হাঁটুসমান জলে, তারপর একটু কোনাকুনি করে ঠেলে তারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে নৌকোটা বালি আর নুড়ির যে ছোট্ট জমির ফালিটা থেকে আইবিসবিলরা উড়ে গেছে সেখানে আমাদের র্যাফটটাকে ভেড়াতে। বেশ শক্ত কাজ। নৌকোর ওজন কমানোর জন্যে আমি আর মানবও নেমে পড়লাম। সম্মিলিত চেষ্টায় তরী তীরে উঠল। জমিটার শেষপ্রান্ত অবধি হেঁটে গিয়ে দেখা গেল তারপর আবার খরস্রোতা একফালি নদী, তার ওপারে আরও ছোটো এক ফালি চড়া। একটা নুড়ির ঢিবির ওপারে চলে গেছে পাখিগুলো। মাঝি দুজনের পিছু পিছু আমি আর মানব নেমে পড়লাম সেই হাঁটুজলের নদীতে। উদ্দেশ্য সন্তর্পণে জলটুকু পার হয়ে গিয়ে আরেকবার যদি আইবিসবিলদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
নদীতে গভীরতা নেই কিন্তু টান আছে। আর পায়ের তলায় বালি নয়, রয়েছে অসংখ্য নানা আকারের নুড়ি। তাদের কোনটি তীক্ষ্ণ, কোনটি মসৃণ এবং পিছল এদিকে হাতে ক্যামেরা। জলের মধ্যে দিয়ে আমার শম্বুকগতি দেখে সঙ্গীরা বিভিন্ন তির্যক মন্তব্য করে উৎসাহ দিতে থাকলেন। এটা একটা বাঙাল চরিত-লক্ষণ। ধরুন আপনার নিশুত রাতে সেরিব্রাল এটাক হয়েছে (সে আপনার শত্তুরের হোক) পাড়ার যে ছেলেরা আপনাকে তিন হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি করে বাড়ি ফিরিয়ে আনল তাদেরকেই আপনি ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বিপদে পড়বেন। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে আপনার স্বরে হয়ত সামান্য জড়িমা ছিল। ওই মিটমিটে শয়তানগুলো আপনাকে নিম্নস্বরে বলবে, মেসোমসাই, সকালবেলাই ছাইপাঁশ গিলেন না, আবার শরীর খারাপ অইব। রাগের চোটে আবার যদি মাথায় রক্ত উঠে না যায় তাহলে আপনি প্রকৃত বাঙাল নন। কিন্তু কসরত করে পরের চড়াটায় পৌঁছনো বৃথা গেল। সেখানে আমরা পদার্পণ করা মাত্র আইবিলবিসের দল আবার হুশ করে উড়ে দূরে মিলিয়ে গেল।
এবারে আমাদের এইরকম ফসকানোর কপাল। বিকেলে নদী পার হয়ে যখন হেঁটে বনের মধ্যে ঢুকলাম প্রথমেই মানব খোদায় মালুম কী করে এক লম্বাটে গাছে খুঁজে পেল এক পায়েড ফলকনকে, আমদের ক্ষুদ্রতম শিকারি পাখি। কিন্তু তারপর পরপর ওরিয়েন্টাল পায়েড হর্নবিল আর একটা রিদেড হর্নবিল আমদের প্রায় চোখের সামনে এক গাছের মাথা থেকে উড়ে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ডানার শাঁইশাঁই আওয়াজ শুধু শুনলাম আমরা। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি মঞ্চস্থ হল শেষ বিকেলে। গাইডের পিছনে পিছনে একটা শুঁড়িপথ ধরে এগোচ্ছিলাম আমরা। ইশারায় সে বলছিল যথাসম্ভব নিঃশব্দে আসতে। শ-খানেক গজ যাওয়ার পর আমরা দেখলাম একটু নীচে একটা জলা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল তিনটে শাদা-কালো বিদ্যুৎচমক। তিনটে হোয়াইট উড ডাক জল থেকে উঠে গভীরতর বনে মিলিয়ে গেল। সারা দুনিয়া নামেরি আসে এদের দেখার জন্যে। আমাদের তারা ক্যামেরা তোলার পর্যন্ত সময় দিল না। ফাটা কপাল জোড়ার কোন মলম জানা থাকলে একটু বলবেন প্লিজ।
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)