Become a friend of Parabaas






Subscribe to Magazines







পরবাসে ছন্দার বিউট্রার
আরো লেখা
অনূদিত বই



ISSN 1563-8685




অতিথি সম্পাদকীয় - অকরুণ করোনা

ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা



ওপরের ছবিটা দেখে হয়তো অবাক হচ্ছেন। কমলালেবুর মধ্যে লবঙ্গ পুরে ওভেনে একটু গরম করে নিলে বেশ সুবাস বেরোয় আর পানীয়-পাত্রে ভাসিয়ে দিলে সুন্দর ডেকরেশনও হয়। এবার কাজের কথায় আসি।

এইটি আমাদের সবার চেনাজানা কোভিড ভাইরাস-এর প্রতীকী ছবি। কমলালেবুর খোসাটা ভাইরাসের বাইরের আচ্ছাদন, আর লবঙ্গগুলি খোসায় পোঁতা spike glycoprotein যার সাহায্যে ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে সংক্রমিত হয় ও তার ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে দেয়। এখন নতুন টিকায় (vaccination) এই ‘লবঙ্গ’-র বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি কাজে লাগানো হচ্ছে।

গত আট মাস ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে কোভিড বা করোনা ভাইরাসের প্রলয় তাণ্ডবের কথা আজ সকলেরই জানা। যখন এদেশে প্রথম ছড়িয়ে পড়ছিল, সবাই গৃহবন্দী হয়ে মুখে মাস্ক বাঁধতে আর কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে (মনে আছে?) ব্যস্ত, ‘দেশ’-এর সম্পাদকের নির্দেশে ‘অথ করোনা কথা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। (এপ্রিল ১৪, ই-দেশ, করোনা ক্রনিকলস)। ‘পরবাসে’র সম্পাদকের বার্তা পেয়ে পুরনো ফাইলটা খুলে লেখাটা আবার পড়লাম। কতো আশা ও আকাঙ্ক্ষা সেই লেখায়, যেন মাসখানেকের মধ্যেই অতিমারীর প্রকোপ কমতে থাকবে। কিন্তু তা তো হলই না বরং যেসব দেশগুলি একটু সেরে উঠছিল, এখন শীতের আগমনে আর স্কুলকলেজ খোলার পর আবার ভাইরাসের দ্বিতীয় আক্রমণের ধাক্কায় কাহিল। আমেরিকায় তো প্রথম থেকেই করোনার রোগ ও মৃত্যুর হার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। কী করে এমন ধনী ও শক্তিশালী দেশের এই দুর্দশা, সে রাজনৈতিক আলোচনায় যাব না। এখন নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন নির্বাচিত হয়েছেন। আশা করি তিনি ও অন্যান্য নির্বাচিত নেতারা আমাদের শিগগিরই এই অতিমারীর কবল থেকে রক্ষা করতে পারবেন।

ডাক্তার হিসেবে আমাদের তালিম দেওয়া অভ্যেস যে কোনো রোগ, মারী বা দুর্ঘটনায় আমরা চটপট সাহায্য করতে লেগে পড়ি। কিন্তু এই অতিমারীতে বয়স ও স্বাস্থ্যের কারণে আমাদের মত বুড়োদের এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এটা অবশ্যই আমাদের নিরাপত্তার জন্যই, কিন্তু একটু মন খারাপ লাগে বৈকি। কতো সহজেই আমরা বাতিল হয়ে গেলাম! আমাদের থেকে ছোট ডাক্তার-নার্সরা জান দিয়ে লড়ে যাচ্ছে আর আমরা অভিজ্ঞ ডাক্তাররা মুখ ঢেকে ঘরের কোণে বসে!

আমার বড়ো মেয়ে ও জামাই দুজনেই ডাক্তার। ওদের যখন করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি পড়ে (একসঙ্গে নয়), তখন সেইজনকে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচাবার জন্য বেসমেনটে একলা অস্পৃশ্যের মতো থাকতে হয়। থাকা-খাওয়া সব আলাদা। ওদের ছোটো দুটি ছেলেমেয়েদের সবথেকে বেশি কষ্ট ও ভয়। বাবা-মায়ের চিন্তায় তারা আকুল হয়। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে যে করোনা-দস্যু তাদের মারতে আসছে। তারপর সকালে মুখে পট্টি বেঁধে স্কুলে যাওয়া। সেখানেও বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপাটি করা, পাড়ায় এর-ওর বাড়ি যাওয়া, জন্মদিনের উৎসব সবকিছুই বন্ধ। বেচারাদের জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। সবথেকে খারাপ লাগে যে আমি ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারি না। কবে আবার পারব? কি আদৌ পারব তো?

‘পরবাসের’ পাঠকরা আমার এখানে-সেখানে বেড়ানোর কথা জানেন। ইদানীং বয়েস ও স্বাস্থ্যের কারণে বেড়ানোটা কমে গেছিল, করোনা ঠাকুরানী সেটা একেবারেই নাকচ করে দিলেন। একবার শেষ দূরপাল্লার ভ্রমণ মঙ্গোলিয়ায় যাব প্ল্যান করেছিলাম, আমার অনেকদিনের ইচ্ছা। সবকিছু রেডি, করোনাদেবী এসে বাড়া ভাতে ছাই ফেললেন। যাত্রা বাতিল, সঙ্গে পয়সাটাও। আবার কখনো যেতে পারবো কি না কে জানে।

এই গৃহবন্দী কোয়ারানটিনের সময় আমার একটা ‘হবি’ আশীর্বাদ হয়ে ফলেছে। আমার পাখি দেখার নেশা। পাখির অজুহাতে আমি একা একা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। সংরক্ষিত বন ও পার্কগুলি কোভিডের জন্য বন্ধ কিন্তু গেট খোলা থাকে। ভেতরে আরামসে ঘুরে বেড়ানো যায়। মানুষের ভিড় নেই বলে পাখিরাও খুব খুশি। এই গরমের ছুটিতে একটি বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। ওকে আমি পাখি দেখা শেখাচ্ছি। ও-ও ভীষণ উৎসাহী, ওর নজরও তীক্ষ্ণ। আশা করি শিগগিরই আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। এখন অবশ্য বেচারা স্কুল নিয়ে ব্যস্ত। প্ল্যান করছি এই শীতের ছুটিতে গরম টুপি দস্তানা পরেই বেরিয়ে পড়ব, প্রচুর পাখি শীতেও দেখা যায়। পাতা ঝরার জন্য দেখারও সুবিধে। আর আমার চোখে পুরনো হলেও আমার কিশোরী বন্ধুর চোখে সবই নতুন। তাই ওর সঙ্গে বেড়িয়ে মজা (অবশ্যই মাস্ক পরে ও ছয় ফুট দূরত্বে)।

আমার নিজের বাগানেও অনেক পাখি—ছোট্ট চড়ুই থেকে বিশাল বাজপাখি, সবারই অবাধ আনাগোনা। বাড়ি থেকে বেরোতে না পারলেও আমি শুধু জানালায় বসেই সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারি। আমার যত ভলান্টিয়ার কাজ ছিল—লাইব্রেরিতে, হাসপাতালে—সব বন্ধ। আমার রিটায়ার্ড স্বামী রান্নাবান্নার ভার নিয়েছেন, তাই আমার হাতে অনেক সময়। এই অতিমারীর সময় নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পাখি দেখার চেয়ে ভালো হবি আর নেই। সুধী পাঠকজন, এক্ষুনি দূরবীন নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।

কে জানে কবে এই অতিমারীর শেষ হবে। শেষ যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, ঐতিহাসিক দ্রুততার সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলিতে ব্যাপক ভাবে করোনার বিরুদ্ধে টিকার আয়োজন করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও টিকার ব্যবস্থা শুরু হচ্ছে। আশা করি এই সময় আসছে বছর করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে শুধু ইতিহাসের পাতাতেই টিঁকে থাকবে।

ছবিঃ লেখক



(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)