১. বিবিধ পাণিনীয় প্রসঙ্গ
প্রসঙ্গ-সূচি: ১.১ অনুবৃত্তি; ১.২ গুণ ও বৃদ্ধি; ১.৩ প্রত্যাহার; ১.৪ পাণিনির কু; ১.৫ নির্দেশক ইৎ-বর্ণ; ১.৬ কী কী ইৎ-বর্ণ; ১.৭ ইৎ-এর স্থান ও পরিণাম |
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘চাচা’ প্রাশান কর্ণেল ডুটেন্হফারের কাছে যেভাবে গ্যোটে পড়া শুরু করেছিল, সেই ‘একটানা গ্যোটে, আবার গ্যোটে এবং পুনরপি গ্যোটে’, তার বিবরণ দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘তার অর্ধেক পরিশ্রমে পাণিনি কণ্ঠস্থ হয়, সিকি মেহন্নতে ফিরদৌসীকে ঘায়েল করা যায়।’ হঠাৎ পাণিনি কেন? যদিও এ-হেন টিপ্পনী আলীসাহেবের কাছে আদৌ অপ্রত্যাশিত নয়, তবু গল্পের এই জায়গাটা পড়লে মনে হয়, যাক, একজন বাঙালি সাহিত্যিক পাওয়া গেল যিনি জানেন পাণিনি অধ্যয়নের রস এবং তার কত ধানে কত চাল।
একথাটা বলতে হল এইজন্য যে, সাধারণ বাঙালির ভাষাশিক্ষার ইতিহাসে পাণিনির উপস্থিতি খুব উল্লেখযোগ্য বলা চলে না। বাঙালির যে বহু শতাব্দীর বিপুল সংস্কৃতচর্চা তাও অপাণিনীয় ব্যাকরণ, প্রধানত কলাপ ও মুগ্ধবোধ, দ্বারা লালিত। ১৯২০ সালে সারদারঞ্জন রায় ‘বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী’-র তৎকৃত ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় লিখছেন, “... scholarship of Bengali Pandits was at a discount outside Bengal and this was mainly because they did not study Panini’s grammar.” যেকালে একথা বলছেন সারদারঞ্জন তখনও স্কুল-কলেজ শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ ছিল সংস্কৃত। এখন সেটা কোন্ অবস্থায় পৌঁছেছে তা সকলেরই জানা। তবু সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই মন্তব্য চোখে পড়ে --- পাণিনি নাকি সংস্কৃতভাষাকে নিয়মকানুনে বেঁধে ফেলেন আর তার ফলে সংস্কৃত কৃত্রিম হয়ে পড়ে। এরকম এক বিশেষজ্ঞকে সেদিন জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, ‘আপনি কি পাণিনি পড়েছেন?’ তিনি জানালেন, ‘সরাসরি পড়ি নি, তবে পাণিনি বিষয়ে যে পণ্ডিতেরা লিখেছেন তাঁদের লেখা পড়েছি।’ একে পাণিনিবিষয়ক আলোচনা বাংলাভাষায় অপ্রতুল --- মনে হল এ বিষয়ে যে নির্ভরযোগ্য পণ্ডিতদের কোনো মন্তব্য বা লেখা সহজে ওই দেশান্তরের ফেসবুক বন্ধুর চোখে পড়তে পারে তাঁরা হলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও সৈয়দ মুজতবা আলী। কিন্তু তাঁরা তো এমন বালভোগ্য কথা বলবার লোক নন।
সকলেরই এ কথা জানা আছে যে আনুমানিক ৭০০ - ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পাণিনি সংস্কৃতভাষার একটি সুবিপুল ব্যাকরণ রচনা করেন। সেটি আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত, এবং তার নাম ‘অষ্টাধ্যায়ী’। প্রতিটি অধ্যায়ের চারটি বিভাগ, তাদের নাম ‘পাদ’। তৎকালপরিজ্ঞাত সংস্কৃতভাষার ব্যাপক ও সুগভীর সমীক্ষা চালিয়ে পাণিনি আবিষ্কার করেন সে ভাষার অন্তর্গত নিয়মগুলি। নিউটন যেমন অভিকর্ষ নামক কোনো নিয়ম বিশ্বপ্রকৃতির ওপর চাপিয়ে দেন নি, তিনি আবিষ্কার করেছেন প্রকৃতির এই ধর্ম, অনুসন্ধান করেছেন সেই ক্রিয়ার বিচিত্র প্রকাশ, ও সূত্রবদ্ধ করেছেন তার গাণিতিক সমীকরণ; পাণিনিও তেমনি কোনো আইন জারি করেন নি ভাষার ওপর, তিনিও একজন তন্নিষ্ঠ অন্বেষক আবিষ্কর্তা ও সূত্রকার। সংকীর্ণ অর্থে সাধু-অসাধু প্রয়োগ নির্ণয় পাণিনির লক্ষ্য নয়, ভাষার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ (description) পেশ করা তাঁর উদ্দেশ্য। এ জাতীয় ব্যাকরণ হল descriptive grammar বা বিবরণমূলক ব্যাকরণ। যাঁরা আমার পূর্বোল্লিখিত ব্যক্তির মতো মনে করেন পাণিনি নিয়মের জালে ভাষাকে বেঁধে ফেললেন তাঁরা ব্যাকরণ বলতে নিদানমূলক বা prescriptive ব্যাকরণের কথা ভাবেন। ভাষার তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারে ‘অমুকটা ঠিক, তমুকটা ভুল’ ঘোষণা করে আজকাল বিচিত্র বই বাংলায় লেখা হয়। তার ফলে ভাষায় কোনোকিছুতে দু’টি রূপ (form) প্রচলিত ও ব্যাকরণসিদ্ধ হলে অনেকের প্রাণ যায়-যায় করে, বলা হতে থাকে এসবের একটা ‘সমতা’ দরকার। এটা একটা একেলে প্রবণতা। পাণিনি ওসব পথে হাঁটেন নি, ভাষার প্রশস্ত মার্গ ধরে তাঁর চলাচল। ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানের আদি জন্মভূমি হল ভারতবর্ষ, এবং তার পূর্ণ পরিণতি পাণিনি। তিনি বৈদিক ভাষা ও তাঁর সমকালীন ভাষার সমীক্ষা করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি ভাষার গঠনতন্ত্র নির্দেশ করেছিলেন। এই গঠনতন্ত্র একটি বৈজ্ঞানিক নির্মাণ। বাংলাভাষা থেকে খুব সরল একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক, ‘হাতি’ ও ‘হাতির’ শব্দ দু’টি। এ দুটো তো ভাষার দু’টি আলাদা শব্দ হিসেবে থাকতে পারত। বস্তুত, শৈশবে হয়তো আমরা দু’টি পৃথক শব্দ হিসেবেই এদের শিখি। কিন্তু মানুষের সহজাত ব্যাকরণবোধ (native grammatical faculty) আমাদের বলে, মূল শব্দটা ‘হাতি’, ‘র’ তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্বন্ধের অর্থ গঠন করছে। সেই সহজাত বোধ থেকে আমরা নতুন-শেখা কোনো শব্দে, যেমন ‘বাড়ি’, ওই ‘র’ জুড়ে দিয়ে ‘বাড়ির’ এই সম্বন্ধপদ নির্মাণ করি। মানুষের এই সহজাত উপলব্ধিটিকেই সূত্রবদ্ধ করে ব্যাকরণ নামক বিজ্ঞান বলে, এই ‘র’ একটি রূপমূল, তার কাজ এইরকম, তার নাম ‘বিভক্তি’। এই গঠনতন্ত্রের অন্তর্গত একটি যুক্তিতন্ত্র (logic) আছে। আর সেখানে নিহিত আছে ভাষার উৎপাদনশীলতা বা productivity; ভাষায় যা অভূতপুর্ব তা তখন তার ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে ভাষার স্বাভাবিক প্রকৃতি মেনেই। এই উন্মোচনের কাজটাই করলেন পাণিনি, এবং তাঁর ব্যাকরণে যে descriptive ও generative চরিত্র দেখা দিল তা আজ পর্যন্ত সর্ববিশ্বে ভাষাবিজ্ঞানীদের প্রেরণাস্থল। সংস্কৃতের মতো প্রাচীন বিপুল ও অসমান ভাষায় এ কার্য সাধন করা পাণিনির বিস্ময়কর মেধার পরিচয়। তাঁর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা তিনি গ্রথিত করেন মোটামুটি ৩৯৮০ সূত্রে। একেকটি সূত্র একটি বা কয়েকটি মাত্র শব্দে প্রকাশিত; তারা ‘হিং টিং ছট’-এর মতোই রহস্যময়। যেমন, একটি সূত্র কেবল ‘চুটূ’ শব্দে, অথবা অন্য একটি কেবল ‘অস্য চ্বৌ’। কোনোটি হয়তো কিছু বড়ো, যেমন, ‘প্রত্যয়লোপে প্রত্যয়লক্ষণম্’। প্রত্যেক সূত্র একেকটি অণুবিশ্ব। কিন্তু এসব স্বল্পাক্ষরে গাঁথা সূত্র থেকে কিছুই বোঝা যায় না। তাদের মর্ম কিছুটা বোঝা যায় যখন তাদের পাণিনিকৃত অনুক্রম ধরে ধরে চলা যায়। এক সূত্রের বক্তব্যের জের পরের সূত্রে চলতে থাকে; তাকে বলে ‘অনুবৃত্তি’। কিন্তু ‘অনুবৃত্তি’ অনুক্ত থাকে। সূত্রের ক্রমানুসারী পাঠে এই অনুক্ত অংশ ‘গম্যমান’ (understood) হয়ে ওঠে। আর, এর মাধ্যমে যে বাক্সংক্ষেপ হয় তার দ্বারা ‘লাঘব’ (economy) সাধিত হয়, ‘গৌরব’ (prolixity) বর্জিত হয়। পাণিনির কালে লেখার প্রচলন ছিল না; সব শিক্ষাই মৌখিক পরম্পরায় চলত। নির্ভুল শিক্ষা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য স্বল্পবাক্ শাস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া প্রাচীন ভারতীয় মনীষার ঝোঁকও ছিল অল্প কথার দিকে।
তবে কেবল ‘অনুবৃত্তি’ দ্বারাই সব কাজ হতে পারে না। প্রতিটি সূত্রের জন্য উদাহরণ দরকার হয়; প্রয়োজন হয় সূত্রার্থের বিশদ ব্যাখ্যা। এই প্রয়োজন মেটাতে পতঞ্জলি রচনা করেন ‘মহাভাষ্য’ (আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক), কাত্যায়ন তাঁর ‘বার্ত্তিক’ (আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক), আর খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে জয়াদিত্য ও বামন তাঁদের ‘কাশিকাবৃত্তি’। আরও অনেক শতাব্দী পরে, খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতকে পাণিনির সূত্রানুক্রমকে বিষয়ানুসারে সাজিয়ে নতুন ভাষ্য সমেত ভট্টোজি দীক্ষিত সংকলন করলেন ‘বৈয়াকরণসিদ্ধান্তকৌমুদী’। সে এক নতুন ধারার সূচনা হল, তাকে বলা হয় ‘কৌমুদীপ্রস্থান’। এতে ব্যাকরণ শিক্ষা অনেক সহজতর হল, এবং পূর্বতন সূত্রানুক্রমিক পাঠের ধারা বা ‘অষ্টাধ্যায়ীপ্রস্থান’ জনপ্রিয়তা হারাল। এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে সংস্কৃত শিক্ষার্থীমাত্রেই কৌমুদীপ্রস্থানেরই ছাত্র; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাকরণ-কৌমুদী’-ও ওই ধারার পাঠ্যপুস্তক। বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাকরণ-কৌমুদী’-তে ও তাঁর মৃত্যুর পরে তার বহুবিধ সম্পাদিত নবতর সংস্করণে ব্যাকরণের সুগম্যতার খাতিরে কত অবশ্যজ্ঞাতব্য যুক্তি ও তথ্য অনুল্লিখিত থেকে গেল তা নিয়ে হয়তো কোনো যোগ্য ব্যক্তি কোনোদিন একটি critique লিখতে পারবেন।
আমার বর্তমান উদ্দেশ্য ‘অষ্টাধ্যায়ী’-র নানারকম প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যাওয়া --- এই ভাষাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত কিছু প্রকরণ, পদ্ধতি, অন্য টুকিটাকি --- সব মিলিয়ে একটা পাণিনীয় miscellany গেঁথে ফেলা। এই ব্যাকরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছাড়াও যে প্রসঙ্গটা প্রাথমিক ভাবে কিছুটা বোঝা যায় তা হল ‘অনুবৃত্তি’। সেটা দিয়েই শুরু করা যাক।
সামগ্রিক ভাবেই এ আলোচনা পাঠকের কোনো বিশেষজ্ঞতা দাবি করে না, সংস্কৃতজ্ঞানও দাবি করে না। বাংলাভাষায় প্রচুর সংস্কৃত শব্দ থাকার ফলে সংস্কৃতের একপ্রকার উত্তরাধিকার বহন করে যেকোনো বাঙালি। সংস্কৃতের দিকে বাংলাভাষার দরজাটিও সদাই খোলা; সংস্কৃত থেকে শব্দ সর্বদাই আসতে পারে ও আসছে, এবং বাংলায় বিদ্যমান সংস্কৃত শব্দ থেকে নূতনতর শব্দ সৃষ্টিও হয়ে চলেছে। সংস্কৃতের সঙ্গে আমাদের প্রধান পরিচয় সন্ধি সমাস ও প্রত্যয়ের সূত্রে। বর্তমান আলোচনার প্রয়োজনে পাঠকের পক্ষে কিছু প্রত্যয়ের নাম জানাই যথেষ্ট। আজকাল অভিধানে ও পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে প্রত্যয়ের নাম থাকে সেভাবে অবশ্য নয়। যেমন, আজকাল ‘কার্য’ ও ‘কৃত্য’ দুই শব্দেরই ব্যুৎপত্তি লেখা হয়, কৃ-ধাতু + য-প্রত্যয়। একই কৃ-ধাতু ও একই য-প্রত্যয় থেকে তাহলে আকারে প্রকারে আলাদা দু’টি শব্দ উৎপন্ন হল কেন? অতএব একটু সাবেকি রীতিতে ‘ণ্যৎ’/’ক্যপ্’ এভাবে প্রত্যয়ের নামগুলো জানতে হবে। অনেকেরই ব্যাকরণ পড়ার সূত্রে ‘ষ্ণ’ ‘ষ্ণিক’ ইত্যাদি অনেক প্রত্যয়-নামের সঙ্গে পরিচয় আছে। অর্থাৎ, যে নামে প্রত্যয়ের কার্যকর অংশের (য, অ, ইক এবং অন্যান্য) বাইরেও কয়েকটি বর্ণ আছে (ক্, ঞ্, ণ্, প্, ষ্ প্রভৃতি)। এইটুকু নিয়েই পথ-চলা শুরু করা যাবে।
১.১ অনুবৃত্তি
আগেই বলেছি, সংস্কৃত ব্যাকরণের
সূত্রগুলোকে মনে হয় যেন হিং-টিং-ছট জাতীয় ব্যাপার --- ‘কিতি চ’ বা ‘চুটূ’ বা ‘টেঃ’, এইরকম হল সূত্রের বয়ান। এর কারণ নানা আঁটোসাঁটো পরিভাষা, এবং 'প্রত্যাহার' ও 'অনুবৃত্তি' নামে দু'টি অতুলনীয় বাক্সংক্ষেপের কৌশল। সুতরাং এই সংক্ষিপ্ততা কেন ও কীভাবে
তা জানতে হয়,
এবং জানলে সূত্রগুলো
মোটেও অদ্ভুত লাগে না।
'অষ্টাধ্যায়ী'-র আরম্ভেই 'বৃদ্ধিরাদৈচ্' (সূত্রসংখ্যা ১|১|১, অধ্যায় ১ পাদ ১ সূত্র
১) ও 'অদেঙ্ গুণঃ' (সূত্রসংখ্যা ১|১|২) সূত্র দুটোর পরেই 'ইকো গুণবৃদ্ধী' (সূত্রসংখ্যা ১|১|৩)। তিনটির পরপর বাংলা করলে কী হয়? --- (১|১|১) আদৈচ্ অর্থাৎ আ ঐ ঔ হল বৃদ্ধি; (১|১|২) অদেঙ্ অর্থাৎ অ এ ও হল গুণ; (১|১|৩) ইক্ অর্থাৎ ই উ ঋ ৯-এর স্থানে গুণ ও বৃদ্ধি হয়
(‘গুণবৃদ্ধী’-র দীর্ঘ ঈ-কার দ্বন্দ্বসমাসে দ্বিবচনের বিভক্তি)। এদের সবর্ণ ঈ ঊ প্রভৃতি দীর্ঘস্বরগুলোকেও
ধরা হচ্ছে।
এরপরেই তাহলে
বলতে হবে কোন্
কোন্ জায়গায়
ইক্-এর গুণ ও বৃদ্ধি হয় না: অর্থাৎ, অমুকে নয়, তমুকে নয়। সেখানে আর 'ইকো গুণবৃদ্ধী' কথাটা ফিরিয়ে আনার দরকার কী?
তাই ১|১|৪ সূত্র হল 'ন ধাতুলোপে আর্ধধাতুকে'। ঠিক 'ইকো গুণবৃদ্ধী' সূত্রের পরেই এটাতে বলতে চাইছে, আর্ধধাতুকে ধাতুলোপে ইক্-এর স্থানে গুণ ও বৃদ্ধি নয়; অর্থাৎ, 'ন ধাতুলোপে আর্ধধাতুকে ইকো
গুণবৃদ্ধী'। আগের সূত্র থেকে 'ইকো গুণবৃদ্ধী'-র জের টেনে যে পরের সূত্র
বলা হল তারই নাম 'অনুবৃত্তি', এবং সেই সুযোগে 'ইকো গুণবৃদ্ধী' কথাগুলো বাদও দেওয়া গেল। কথা কমল, 'গৌরব' (prolixity) দূরীভূত হল।
এই জের এখন চলবে। পরের সূত্র, 'ক্ঙিতি চ' (১|১|৫)। এখানে আগের দুটো সূত্রেরই অনুবৃত্তি: 'ন' আনুন ৪নং থেকে, 'ইকো গুণবৃদ্ধী' আনুন ৩নং থেকে। তাহলে দাঁড়ায়, 'ক্ঙিতি চ ইকো গুণবৃদ্ধী ন'; মানে, গ্ ক্ ঙ্ ইৎ-এর স্থানেও গুণ ও বৃদ্ধি নয়।
তারপর সূত্র
১|১|৬: 'দীধীবেবীটাম্'। এখানেও ৩, ৪-এর অনুবৃত্তি: 'দীধীবেবীটাম্ ইকো গুণবৃদ্ধী ন' --- 'দীধী' 'বেবী' এবং ইট্-আগমে ইক্-এর স্থানে গুণ ও বৃদ্ধি নয়।
এখন ৩নং থেকে
৬নং যদি বাংলায় একটানা লিখি তাহলে পাই:
"ইক্-এর স্থানে গুণ ও বৃদ্ধি ঘটে। (কিন্তু) আর্ধধাতুকে ধাতুলোপে নয়। গ্ ক্ ঙ্ ইৎ-এও তা-ই। দীধী বেবী ও ইট্-আগমেও একইরকম।" --- ধারাবাহিক ভাবে চলছে বলে বুঝতে
কোনো অসুবিধে হল না।
৩নং থেকে যে 'অনুবৃত্তি' শুরু হয়েছিল, কথার যে জের টানা হচ্ছিল, তা শেষ হচ্ছে এখানে এসে। তারপরে যে 'হলোঽনন্তরাঃ সংযোগঃ' সূত্র আছে, যার দ্বারা যুক্তব্যঞ্জনের
নাম দেওয়া হচ্ছে 'সংযোগ', সেখানে তো প্রসঙ্গান্তরে চলে
গেলেন পাণিনি,
অতএব আগের অনুবৃত্তি
আর সেখানে নেই।
তবে এই যেটা
দিলাম সেটা নিতান্ত বাচ্চা অনুবৃত্তির নমুনা; আরও বড়ো বড়ো আছে, সেগুলো সূত্রের পর সূত্র ধরে
চলছে তো চলছেই। আর, এই যে 'অনুবৃত্তি' দিয়ে কিছু কথাকে পুনরুক্ত
না-করা হল, এটাও একপ্রকার ইৎ-এর খেলা বলে মনে করেন কোনো
কোনো লেখক। সে কথা পরে বিবৃত
হবে।
১.২ গুণ ও বৃদ্ধি
যদি বলতে হয় বাংলাভাষার ধ্বনিতন্ত্রে সবচেয়ে ব্যাপক phenomenon কী তাহলে বলা যায় ‘স্বরসংগতি’ (vowel harmony)। ঊর্ধ্বস্বরের নৈকট্যে নিম্নস্বর ওপর দিকে উঠছে, নিম্নস্বরের টানে উচ্চতর স্বর নীচের দিকে নামছে। ‘আমি ওকে চিনি, সেও ওকে চেনে’, এই বাক্যে একই ধাতুর রূপে যেখানে ‘চি’ (চিনি) সেখানে পাশেই ঊর্ধ্বস্বর ‘ই’ আছে, যেখানে ‘চে’ (চেনে) সেখানে নিম্নস্বর ‘এ’ আছে পাশে। ‘আমি করি, সে করে’ এখানে ‘ই’ পাশে থাকায় ‘করি’-র উচ্চারণ হল [কোরি], ‘অ’ হল উচ্চতর স্বর ‘ও’; ‘করে’-তে ‘অ’-ধ্বনি অবিকৃত রইল। ‘আমি দেখি, এটা তার দেখা আছে’ এই বাক্যে ‘দেখি’-র উচ্চারণে এ-কারের [এ]-ধ্বনি হল, কিন্তু ‘দেখা’-তে এ-কার উচ্চারিত হল [দ্যাখা]। তাহলে দেখা যাচ্ছে [এ-ই], [অ্যা-এ], [অ-ও] এই নিম্ন ও উচ্চ স্বরধ্বনিগুলি নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত জায়গা পালটে নিচ্ছে। এবং এ ঘটনা চলছে সমস্ত ভাষা জুড়ে।
পাণিনি সংস্কৃতভাষায় লক্ষ করেছিলেন যে: (১) ‘ই/ঈ’ ক্রমাগত হচ্ছে ‘এ’ (যেমন, বিদ্-ধাতু থেকে ‘বেদ’), ‘উ/ঊ’ হচ্ছে ‘ও’ (যেমন, সূর্য + উদয় = সূর্যোদয়), ‘ঋ’ হচ্ছে ‘অর্’ (যেমন, ধৃ-ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ ‘ধরতি’, মহা + ঋষি = মহর্ষি), ‘৯’ হচ্ছে ‘অল্’ (যেমন, ক্৯প্-ধাতু থেকে ‘কল্পনা’); (২) আবার অন্যত্র দেখেছিলেন, ‘অ’ হচ্ছে ‘আ’ (যেমন ‘মহেশ্বর’ থেকে ‘মাহেশ্বর’), ‘ই’ হচ্ছে ‘ঐ’ (যেমন, বেদ > বৈদিক), ‘উ’ হচ্ছে ‘ঔ’ (যেমন, পুরাণ > পৌরাণিক), ‘ঋ’ হচ্ছে ‘আর্’ (যেমন, কৃ-ধাতু থেকে ‘কার্য’), এবং ‘৯’ হচ্ছে ‘আল্’। এবং শব্দরূপ, ধাতুরূপ বা ক্রিয়াগঠন, প্রত্যয়, সন্ধি প্রভৃতি সর্বত্র এই পরিবর্তনগুলি সংস্কৃতভাষায় চলেছে।
পাণিনি ঠিক বিষয়ের গুরুত্ব অনুযায়ী তাঁর সূত্রগুলি পরপর সাজিয়েছিলেন একথা বলা চলে না, কিন্তু উপরোক্ত ঘটনাগুলিকে তাঁর এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল যে তিনি প্রথম অধ্যায়ের প্রথম দু’টি সূত্রেই তাঁদের সংজ্ঞা নির্দেশ করলেন। ই-এর স্থানে ‘এ’ ইত্যাদি ওপরের (১)-শ্রেণির পরিবর্তনগুলিকে তিনি বললেন ‘গুণ’। ই-এর স্থানে ‘ঐ’ প্রভৃতি (২)-শ্রেণির পরিবর্তনগুলির তিনি নাম দিলেন ‘বৃদ্ধি’।
‘গুণ’ বোঝায় {(ই > এ), (উ > ও), (ঋ > অর্), (৯ > অল্)}। ‘বৃদ্ধি’ বোঝায় {(অ > আ), (ই > ঐ), (উ > ঔ), (ঋ > আর্), (৯ > আল্)}। পাণিনি যে ‘গুণ’ ‘বৃদ্ধি’-র গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেন নি, সংস্কৃতভাষায় কত সর্বব্যাপী এই দু’টি ঘটনা, তা তাঁর ব্যাকরণ পরতে পরতে উন্মোচিত করে।
১.৩ প্রত্যাহার
‘অনুবৃত্তি’-র আলোচনায় ‘প্রত্যাহার’ কথাটা এসেছিল। পাণিনির আগে থেকেই ভাষার বর্ণগুলো একটা বিশেষ অনুক্রমে সাজানো ছিল, তার নাম ‘অক্ষরসমাম্নায়’। সেটা বর্ণমালা নয়, সেটা ভাষার phoneme বা ধ্বনিমূলগুলোর এক আশ্চর্য সারণি। কথিত আছে নটরাজ শিব নৃত্যাবসানে তাঁর ঢাকে এই ধ্বনিগুলি নিনাদিত করেন। যেভাবে এই ধ্বনিগুলি বিন্যস্ত হয় তার নাম ‘মাহেশ্বর সূত্র’। চোদ্দটি সূত্র আছে নিম্নরূপ।
অ
ই উ ণ্ /১/ ঋ ৯ ক্ /২/ এ ও ঙ্ /৩/ ঐ ঔ চ্ /৪/ হ য ব র ট্ /৫/ ল ণ্
/৬/
ঞ ম ঙ ণ ন ম্ /৭/ ঝ ভ ঞ্ /৮/ ঘ ঢ ধ ষ্ /৯/ জ ব গ ড দ
শ্ /১০/ খ ফ ছ ঠ থ চ ট ত ব্ /১১/
ক প য়্ /১২/ শ ষ স র্ /১৩/ হ ল্ /১৪/
এখানে লক্ষণীয়, সূত্র ১ থেকে ৪ পর্যন্ত স্বরবর্ণ। আ ঈ ঊ প্রভৃতি দীর্ঘস্বরের স্বতন্ত্র উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, কারণ ধ্বনিমূল হিসেবে তারা তাদের হ্রস্বধ্বনির সমান। সূত্র ৫ – ৬ হ বাদে অন্তঃস্থ বর্ণ। সূত্র ৭ অনুনাসিক বর্ণ। সূত্র ৮ – ১২ বর্গীয় স্পর্শবর্ণ। সূত্র ১৩ – ১৪ উষ্মবর্ণ। এই হল মাহেশ্বর সূত্রের বর্ণানুক্রম। তারপর লক্ষণীয়, প্রতিটি সূত্রের শেষ বর্ণটি একটি হসন্ত ব্যঞ্জন। এই অন্তিম বর্ণগুলির একটি বিশেষ ভূমিকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদের নাম ‘ইৎ’ বর্ণ। ই-ধাতু অর্থাৎ ‘যাওয়া’ থেকে ‘চলে যায় এমন’ অর্থে ‘ইৎ’। ‘চলে যায়’ অর্থ কী?
সূত্রস্থ যেকোনো বর্ণ এবং পরবর্তী যেকোনো ইৎ-বর্ণ যদি একসঙ্গে বলা হয়, যেমন ‘ইক্’, তাহলে বুঝতে হবে প্রথমোক্ত বর্ণ থেকে উক্ত ইৎ-বর্ণের আগের বর্ণ পর্যন্ত সমস্ত বর্ণের কথা বলা হচ্ছে। মধ্যবর্তী কোনো ইৎ-বর্ণ থাকলে তা বাদ দিয়ে ধরতে হবে। তাই ‘ইক্’ বোঝাবে {ই উ ঋ ৯} বর্ণগুলোর set-টি। ণ্ ও ক্ ইৎ-বর্ণ দু’টি ধরা হল না। ইক্-এর ক্ষেত্রে ক্-এর কাজ শুধু বর্ণসমষ্টির সীমা নির্দেশ করা; তার পরেই সে বিদায় নিচ্ছে। এই হল ‘ইৎ’ (চলে যায় এমন) নামের তাৎপর্য। এই ‘ইক্'–এর মতো বর্ণসংক্ষেপের পারিভাষিক নাম ‘প্রত্যাহার’। প্রত্যাহার ‘যণ্’ বোঝাবে {য ব র ল}। প্রত্যাহার ‘এঙ্’ হবে {এ ও}। প্রত্যাহার ‘ঐচ্’ হবে {ঐ ঔ}। পূর্বোক্ত ‘অদেঙ্ গুণঃ’ সূত্রে অদেঙ্ = অৎ + এঙ্ (এ ও); ‘বৃদ্ধিরাদৈচ্’ সূত্র ভাঙলে বৃদ্ধিঃ + আৎ + ঐচ্ (ঐ ঔ)। প্রত্যাহার ‘অচ্’ = {অ ই উ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ}, স্বরবর্ণের set; পাণিনি সর্বত্র ‘অচ্’ নামেই স্বরবর্ণসমষ্টি বোঝাবেন। ‘হল্’ বোঝাবে সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ। আর, ‘অল্’ যাবতীয় বর্ণ, প্রথম অ থেকে শেষ হ অবধি। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘অচ্’ না বলে ‘অঔ’, বা ‘অল্’ না বলে ‘অহ’ বললেও তো হত। কিন্তু মৌখিক পরম্পরায় প্রত্যাহারকে ব্যঞ্জনান্ত করাই নিরাপদ; অধিকন্তু তাতে শেষের একটি স্বরবর্ণও কমে। এবং মাহেশ্বর সূত্রের এই সহজ ইৎ-প্রকরণকে পাণিনি কী আশ্চর্যভাবে কাজে লাগালেন তা আমরা অচিরেই দেখতে পাব।
সম্ভাব্য প্রত্যাহার তাহলে ক’টা হতে পারে? প্রথম সূত্রে ৩টি বর্ণ, তাদের পরে ১৪টি ইৎ-বর্ণ। তাহলে সূত্র ১-এর বর্ণেরা গঠন করতে পারে ৩ × ১৪ = ৪২টি প্রত্যাহার। এইভাবে, মোট প্রত্যাহার সংখ্যা = ৩ × ১৪ + ২ × ১৩ + ২ × ১২ + ২ × ১১ + ৪ × ১০ + ১ × ৯ + ৫ × ৮ + ২ × ৭ + ৩ × ৬ + ৫ × ৫ + ৮ × ৪ + ২ × ৩ + ৩ × ২ + ১ × ১ = ৩০৫। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে মোট ৪৪টি প্রত্যাহার ব্যবহার করেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে দু’একটি গরমিল চোখে পড়বে সূত্রগুলিতে। যেমন, দু’বার হ, সূত্র ৫ ও ১৪। এর কারণ ব্যাকরণের operation বা ‘বিধি’-র প্রয়োজনে দু’রকম set প্রয়োজন। {অ ই উ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ হ য ব র} এবং {শ ষ স হ}। তাই এই দু’বার হ-এর ব্যবস্থা। আরেকটি হল, ইৎ-বর্ণ ণ্-এর দু’বার উপস্থিতি, সূত্র ১ ও ৬। কিন্তু সমগ্র ব্যাকরণে মাত্র একবার ‘অণ্’ বলতে দ্বিতীয় ণ্, অর্থাৎ {অ ই উ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ হ য ব র ল} এই set মাত্র একবার ধরা হয়েছে (সূত্র ১|১|৬৯, ‘অণুদিৎ সবর্ণস্য চাপ্রত্যয়ঃ’, যা পরবর্তী ‘পাণিনির কু’ উপভাগে আসবে)। অন্য সব জায়গায় ‘অণ্’ = {অ ই উ}।
এ প্রশ্নও জাগতে পারে, সূত্রস্থ যেকোনো বর্ণ থেকে শুরু করে ইৎ নয় এমন কোনো পরবর্তী বর্ণে কি কোনো প্রত্যাহার শেষ হতে পারে না? যেমন, ‘ইঋ’ এমন কোনো প্রত্যাহার কি সম্ভব নয়? না, নয়। আশ্চর্য ব্যাপার হল, ব্যাকরণে যে বর্ণসমষ্টিগুলোর প্রয়োজন হবে ঠিক সেভাবেই ইৎ-বর্ণের সীমা তৈরি করে বর্ণগুলো সাজানো আছে। ‘ইঋ’ অর্থাৎ {ই উ ঋ} এই বর্ণগুচ্ছটুকু নিয়ে ব্যাকরণে কোনো ঘটনাই ঘটে না।
১.৪ পাণিনির কু
চোদ্দটি মাহেশ্বর সূত্র থেকে দেখা
যাচ্ছে, ‘অল্’ প্রত্যাহার হল সমস্ত বর্ণ; তার subset ‘অচ্’ হল সমস্ত স্বরবর্ণ, ‘হল্’ সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ, ‘যণ্’
অন্তঃস্থ বর্ণ, ‘ঞম্’ অনুনাসিক বর্ণ, ‘ঝয়্’ পঞ্চম (অনুনাসিক) বর্ণ ভিন্ন সমস্ত
বর্গীয় বর্ণ, ‘ঝষ্’ বর্গের চতুর্থ বর্ণ, ‘জশ্’ বর্গের তৃতীয় বর্ণ, ‘খয়্’ বর্গের
প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ, ‘শর্’ তিনটি sibilants, ‘রণ্’ র ল, ‘ঝর্’
সমস্ত স্পর্শবর্ণ। কিন্তু যদি একেকটা বর্গের সমস্ত বর্ণের কথা বলতে চাই (যেমন,
ক-বর্গের কণ্ঠ্য বর্ণ ক খ গ ঘ ঙ) তাহলে কোনো প্রত্যাহার গঠন করবার উপায় নেই। এই
সমস্যা অতিক্রম করার জন্য পাণিনি কী উদ্ভাবন করলেন দেখা যাক।
উমাপতি কুমারকে
গোল করতে দেখে শিবরাম চক্রবর্তী নাকি বলেছিলেন, কুমারের শুধু কু-মার। পাণিনিও এখানে একপ্রকার কু-মার দিলেন। তিনি
বললেন, ক্-এর সঙ্গে একটি ‘উ’ যোগ করলে ‘কু’ বোঝাবে ‘ক্ খ্ গ্ ঘ্ ঙ্’
বর্ণগুলো। এই ‘উ’ এই উদ্দেশ্যে একটি ইৎ-বর্ণ, ক্-এর সঙ্গে যুক্ত হলে ক্-এর
প্রতিটি ‘সবর্ণ’ নির্দেশ করা তার কাজ। ইৎ-বর্ণকে নির্দেশক বর্ণ হিসেবে কাজে লাগিয়ে
পাণিনি কী অসামান্য একটি প্রকরণ গড়ে তুলবেন তা আমরা অচিরেই আলোচনা করব।
প্রত্যয়সংক্রান্ত পাণিনীয় সূত্র ১|৩|৮ 'লশক্বতদ্ধিতে' (ল শ কু অতদ্ধিতে) থেকে এই 'কু'-এর সঙ্গে আমার পরিচয়। এবং তার ঠিক আগেই ‘চুটূ’ (সূত্র ১|৩|৭)।
ইৎ-বর্ণ উ-এর ব্যাপারটা প্রথম বলা হচ্ছে পাণিনির ১|১|৬৯ নং সূত্রে: 'অণুদিৎ সবর্ণস্য চাপ্রত্যয়ঃ'। সন্ধি ভাঙলে, 'অণ্ উৎ + ইৎ সবর্ণস্য চ + অপ্রত্যয়ঃ'। এর অর্থ, পাণিনির ব্যাকরণে প্রত্যয়ের নাম ভিন্ন অন্যকিছুতে যদি 'অণ্'-প্রত্যাহারের কোনো বর্ণ থাকে অথবা যদি কোনো বর্ণে (বলা বাহুল্য, ব্যঞ্জন) 'উ' একটি নির্দেশক ইৎ-বর্ণ হিসেবে যুক্ত হয় তাহলে সেই সেই বর্ণ তার যাবতীয় 'সবর্ণ' বোঝাবে।
এই সূত্র ধরে পাণিনীয় ভাষার ভিতরে একটু
উঁকি মারা যেতে পারে।
প্রথমেই, 'সবর্ণ', একটি পারিভাষিক শব্দ। পাণিনি তা define করেছেন তাঁর মহাগ্রন্থের একেবারে
গোড়াতেই। সূত্র ১|১|৯, 'তুল্যাস্যপ্রযত্নং সবর্ণম্'। মুখের ভিতরে উচ্চারণস্থান স্পৃষ্ট-অস্পৃষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ যাদের
সমান তারা
'সবর্ণ'। এভাবে ই/ঈ সবর্ণ, একেকটা বর্গের সব ক'টি বর্ণ সবর্ণ। কিন্তু
‘নাজ্ঝলৌ’ (ন + অচ্ + হলৌ), সূত্র ১|১|১০, অচ্ (স্বরবর্ণ) ও হল্ (ব্যঞ্জন) কখনও সবর্ণ নয়।
তারপর 'অণ্'। এটি সেই ‘অণ্’ যার কথা আমরা 'প্রত্যাহার' অংশে উল্লেখ করেছি। প্রথম সূত্র 'অ ই উ ণ্' থেকেই 'অণ্' প্রত্যাহার হতে পারে, কিন্তু এটা তা নয়। ইৎ-বর্ণ ণ্ ষষ্ঠ সূত্রের শেষেও আছে, এই 'অণ্' সেই অবধি বোঝায়। সূত্রগুলো: (১) অ ই উ ণ্; (২) ঋ ৯ ক্; (৩) এ ও ঙ্; (৪) ঐ ঔ চ্; (৫) হ য ব র ট্; (৬) ল ণ্। সুতরাং এখানে 'অণ্' বোঝাবে 'অ ই উ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ হ য ব র
ল' এই বর্ণগুলো।
এবারে 'উৎ'। প্রত্যাহার রচনার যে প্রণালী দেখা
গেছে তা দিয়ে শুধু একটি বর্ণ, যেমন অ বা উ, বোঝানো যাবে কি? তার জন্য একটি প্রণালী হল বর্ণটির পিছনে
‘ৎ’ যোগ করা। এই উদ্দেশ্যে ৎ একটি
ইৎ-বর্ণ। সেভাবেই 'উৎ' বোঝাচ্ছে শুধু 'উ', দীর্ঘ-ঊ নয়। অষ্টাধ্যায়ী-র প্রথম
‘বৃদ্ধিরাদৈচ্’ (বৃদ্ধিঃ আৎ ঐচ্) সূত্রে ‘আৎ’ বোঝাচ্ছে কেবল ‘আ’, তার সবর্ণ ‘অ’
নয়। ৎ-এর উচ্চারণগত কিছু তাৎপর্যও
আছে (সূত্র: 'তপরস্তৎকালস্য', সূত্র ১|১|৭০), তার মধ্যে যাচ্ছি না। আমাদের আলোচ্য 'অণুদিৎ'-সূত্রে আছে ‘উদিৎ’ বা 'উৎ-ইৎ'। তার মানে 'উ'-কার ইৎ-সংজ্ঞক হয় এমন। নামকরণের এই রীতিটির সঙ্গে আমাদের
প্রায়ই দেখা হবে পরে।
আর আছে 'অপ্রত্যয়ঃ'। তাহলে সূত্রের অর্থ দাঁড়াল, প্রত্যয়-নাম নয় এমন জায়গায় 'অণ্' প্রত্যাহারের কোনো
বর্ণ অথবা ইৎ-বর্ণ 'উ'-যুক্ত কোনো বর্ণ সেই সেই বর্ণের যাবতীয় সবর্ণ
বোঝাবে।
এখন আমাদের ওই 'লশক্বতদ্ধিতে' একটি সূত্র, প্রত্যয়-নাম নয়, অর্থাৎ অপ্রত্যয়। এখানে আছে 'কু', ক্ + উ। সুতরাং 'উ' বর্ণ নির্দেশ করছে যে কেবল ক্ নয়, ক্-এর সবর্ণ খ্ গ্ ঘ্ ঙ্ সবই 'কু' বলতে বোঝানো হচ্ছে। তাই 'লশক্বতদ্ধিতে' সূত্রটি বোঝাচ্ছে যে অতদ্ধিত
প্রত্যয়ের নামে ল শ এবং কু (ক্ খ্ গ্ ঘ্ ঙ্) থাকলে তাদের কী হবে। তারা ইৎ-সংজ্ঞক হবে, অর্থাৎ লুপ্ত
হবে (দ্রষ্টব্য উপভাগ ১.৭)। অবশ্যই তারা একটা কিছু বোঝাবে যা পাণিনি তাদের কাজ হিসেবে নির্দিষ্ট
করেছেন, কিন্তু প্রত্যয়ের কার্যকালে
তারা লুপ্ত হবে। অতদ্ধিত কৃৎ-প্রত্যয় কয়েকটা আমরা মনে করতে
পারি ---
ক্ত, খচ্, ঘঞ্, সর্বত্রই কার্যকালে কু (ক্ খ্ গ্ ঘ্ ঙ্)-লোপ। যেমন, ‘কৃ + ক্ত = কৃত’। আর, যদি প্রত্যয়-নামের মধ্যেই ‘উ’ থাকে, যেমন কৃৎ-প্রত্যয় 'উ', তাহলে সে এই 'অণুদিৎ'-সূত্রের সবর্ণ-বোধক 'উ' নয়, তার লুপ্ত হবার কোনো প্রশ্ন
নেই। তাই ‘ভিক্ষ্-ধাতু + উ-প্রত্যয় = ভিক্ষু’।
কু যেমন হল, তেমনিভাবে চু (চ-বর্গের সকল বর্ণ), টু (ট-বর্গ), তু (ত-বর্গ), পু (প-বর্গ), সবই হতে পারে। পূর্বোদ্ধৃত ‘চুটূ’
সূত্রে চু = চ-বর্গ এবং টু = ট-বর্গের কথাই বলা হচ্ছে; 'চু' আর 'টু' মিলে দ্বিবচন 'চুটূ'।
আমরা সরল মনে প্রশ্ন করতে পারি, কণ্ঠ্য-বর্ণ তালব্য-বর্ণ এভাবেও তো বলা যেত। তা যেত, কিন্তু ‘উদিৎ’ রূপে কু চু ইত্যাদি নামে বলা প্রাচীন ভারতীয় সূত্রকারদের বাক্সংক্ষেপের তাগিদ ও সাংকেতিক algebraic spirit-এর সঙ্গে খাপ খায়। এই spirit যদি না থাকত তাহলে কত অনর্থক বাগ্বিস্তার করে ভাষাবিজ্ঞানকে জটিল করে তুলতে হত তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে ক্রমশ।
১.৫ নির্দেশক ইৎ-বর্ণ
এখন পর্যন্ত আমরা দেখলাম যে প্রত্যাহারের অন্তিম সীমা নির্ধারণ করা ইৎ-বর্ণের কাজ। ইৎ-বর্ণ দ্বাররক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে; তাকে টপকে পরবর্তী সূত্রে ঢুকে পড়া যাবে না। তৎকালীন বিদ্যার পরম্পরায় পাণিনি উত্তরাধিকার রূপে পেয়েছিলেন মাহেশ্বর সূত্র, প্রত্যাহার ও ইৎ-বর্ণের প্রকরণ। ইৎ-বর্ণ বা ‘ইৎ-সংজ্ঞা’ যেন তাঁর মস্তিষ্কে শত দীপ জ্বেলে দিল; তিনি তা ব্যবহার করলেন অভাবনীয় অস্ত্র রূপে। তাঁর হাতে ইৎ-বর্ণ হয়ে উঠল ‘নির্দেশক বর্ণ’ (indicatory letter)। কী নির্দেশ করে? সেকথায় প্রবেশ করছি।
ধরা যাক, পাণিনি ভাষার যে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তাতে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন দু’জোড়া শব্দ --- {কারক, স্মারক} এবং {নর্তক, খনক}। অর্থ থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা আসছে যথাক্রমে {√কৃ (করা),√স্মৃ (স্মরণ করা)} এবং {√নৃত্ (নৃত্য করা), √খন্ (খনন করা)} ধাতু থেকে। আর, আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে {কারক, স্মারক, নর্তক, খনক} সব শব্দেরই শেষ হচ্ছে ‘অক’ দিয়ে, যে ‘অক’-কে অর্থবোধক শব্দ বলা চলে না। এই ‘অক’-এর সাধারণ নাম হোক ‘প্রত্যয়’ (suffix)। কিন্তু ‘অক’ যুক্ত হয়ে কি ধাতুর একই রকম পরিবর্তন হয়েছে? {√কৃ, √স্মৃ} হয়েছে {কার্, স্মার্}, অর্থাৎ ‘ঋ’ হয়েছে ‘আর্’। এটা ঋ-স্বরের বৃদ্ধি। {√নৃত্, √খন্} হয়েছে {নর্ত্, খন্}। এখানে √নৃত্-এর ঋ-কার হয়েছে ‘অর্’; এটা ঋ-স্বরের গুণ। আর, √খন্-এর অ-কার অপরিবর্তিত। তাহলে কার্যকর প্রত্যয়াংশ ‘অক’ হলেও যে ধ্বনিগত পরিবর্তনগুলি হচ্ছে তা একপ্রকার নয়। সুতরাং এখানে বিচক্ষণ বৈয়াকরণের একটা দায় আছে ‘অক’ প্রত্যয়ের সঙ্গে এই সমস্ত কার্যের নির্দেশ দেবার। এই কাজেই পাণিনি ব্যবহার করলেন ইৎ-বর্ণ। সে বর্ণ যখন ইৎ-সংজ্ঞক তখন সে তো লুপ্ত হবেই (দ্র. উপভাগ ১.৭), কিন্তু সে ওইসব কার্যের নির্দেশ বহন করুক। তিনি ণ্-বর্ণকে নিয়োগ করলেন স্বরের বৃদ্ধি বোঝাতে। বস্তুত প্রত্যয়ের সমগ্র প্রকরণেই ‘ণ্ Þ স্বরের বৃদ্ধি’ (এই ‘ণিৎ’ প্রত্যয়ে ‘অঙ্গস্য বৃদ্ধি’-র কথা তিনি বলছেন ৭|২|১১৫ – ১১৭ সংখ্যক সূত্রে)। এই ‘অক’ প্রত্যয়ের নাম দেওয়া হল ‘ণক’ (ণ্ + অক)। তাহলে পর্যায়ক্রমে যা ঘটবে তা হল, √কৃ (ধাতু) + ণক (প্রত্যয়) = কার্ (ঋ-কারের বৃদ্ধি) + অক + [ইৎ-বর্ণ ণ্-এর লোপ] = কারক। ঋ-কারের বৃদ্ধি ঘটিয়ে ণ্-এর কাজ শেষ হল, ণ্ লুপ্ত হল, ‘কারক’ শব্দটা পাওয়া গেল। ‘অক’-এর সঙ্গে ইৎ-বর্ণ ণ্ না যোগ করলে এই বৃদ্ধির খবর দেওয়া যেত না।
অন্যদিকে √নৃত্ থেকে ‘নর্তক’, এখানে স্বর ঋ-এর বৃদ্ধি হচ্ছে না, গুণ হচ্ছে। √খন্ > খনক; অ-এর গুণ/বৃদ্ধি কিছুই হচ্ছে না। অ-এর কেবল বৃদ্ধি হয় (অ > আ), গুণ হয় না। অতএব যদি বলা হয় ‘নর্তক’ ‘খনক’ এই দুই শব্দে ধাতুর স্বরের গুণ হচ্ছে তাহলেও ভুল হয় না কারণ কার্যত ‘অ-এর গুণ = অ’। সে ক্ষেত্রে এই দু’টি শব্দে ‘অক’-প্রত্যয়ের জন্য গুণ-দ্যোতক কোনো ইৎ-বর্ণ ব্যবহার করতে পারতেন পাণিনি। কিন্তু ধাতুর সঙ্গে প্রযোজ্য প্রত্যয় অর্থাৎ কৃৎ-প্রত্যয়ের সামগ্রিক সমীক্ষায় তিনি দেখেছিলেন যে কৃৎ-প্রত্যয় যোগে ধাতুর স্বরের বৃদ্ধি বিশেষ ঘটনা, কিন্তু গুণ অন্য সর্বত্র সাধারণত ঘটে। তাহলে আর গুণ-দ্যোতক ইৎ-বর্ণের প্রয়োজন কী? সুতরাং গুণের ঘটনাটা কৃৎ-প্রত্যয়ের সাধারণ নিয়ম হিসেবে পাণিনি সূত্রবদ্ধ করে রাখলেন (সূত্র ৭|৩|৮৪ – ৮৬)। আর, ‘নর্তক’ ‘খনক’-এর ‘অক’-প্রত্যয়ের সঙ্গে জুড়লেন অন্য একটি নির্দেশক বর্ণ যার সঙ্গে গুণ/বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। তা হল ‘ষ্’। ষ্ কেন? পাণিনি দেখেছিলেন ভাষায় অ-কারান্ত শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ সাধারণত আ-কারান্ত হয়, কিন্তু কিছু অ-কারান্ত শব্দের স্ত্রীরূপ হয় ঈ-কারান্ত। ‘নর্তক’ থেকে স্ত্রীলিঙ্গে ‘নর্তকী’, ‘খনক’ থেকে ‘খনকী’। স্ত্রীলিঙ্গে আ-কারান্ত হলে বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু ঈ-কারান্ত হলে সেটা বিশেষ ভাবে বলে দেবার অপেক্ষা রাখে। ইৎ-বর্ণ ষ্ বোঝাবে ওই ঈ-কার। স্ত্রী-প্রত্যয়ের প্রকরণে তার নাম হবে ‘ঙীষ্’-প্রত্যয়। ষ্-ইৎ (বা ষিৎ) যেকোনো অস্ত্রীবাচক (non-feminine) প্রত্যয় বোঝাবে স্ত্রীলিঙ্গে সে শব্দে ঙীষ্-প্রত্যয় হবে। তাই ‘নর্তক’ ‘খনক’-এর জন্য ‘অক’ প্রত্যয়ের নাম হোক ‘ষক’। √নৃত্ + ষক = নর্ত্ (ঋ-কারের গুণ) + অক + [ইৎ-বর্ণ ষ্-এর লোপ] = নর্তক। এবং প্রত্যয়টি ষিৎ বলে স্ত্রীলিঙ্গে ‘নর্তক + ঙীষ্ (স্ত্রীপ্রত্যয়) = নর্তকী’।
তাহলে কি প্রত্যয় দুটো ‘ণক’ ও ‘ষক’? এখানে পাণিনি আরেকটু বীজগাণিতিক প্রণালী ব্যবহার করবেন। দু’টির সামান্য (common) অংশ ‘অক’-এর নাম দেবেন ‘বু’। বু = অক। আর, এরকমই নানা জায়গায় পাওয়া যায় এমন আরেকটি প্রত্যয় ‘অন’-এর নাম দেবেন ‘যু’; যু = অন। দু’টি মিলিয়ে একটি সূত্র প্রণয়ন করবেন ‘যুবোরনাকৌ’ (যুবোঃ অন + অকৌ), সূত্র ৭|১|১। এর অর্থই হল যু = অন, বু = অক; বা ব্যাকরণের পরিভাষায় ‘যু’ ‘বু’ স্থলে যথাক্রমে ‘অন’ ‘অক’ ‘আদেশ’ (substitution) হবে। তাহলে ‘বু = অক’ ব্যবহার করলে ‘ণক = ণ্ + বু = ণ্বু’; এবং ‘ষক = ষ্ + বু = ষ্বু’। এই ‘ণ্বু’ ও ‘ষ্বু’-তেই অবশ্য শেষ নয় পাণিনির কাজ। তিনি এ দু’টি প্রত্যয়ের নাম দেবেন ‘ণ্বুল্’ ও ‘ষ্বুন্’। সেখানে ‘ল্’ ও ‘ন্’ দু’টিও ইৎ-বর্ণ, তারা অন্যরকম কার্য নির্দেশ করছে। কিন্তু আপাতত তাদের ছেড়ে প্রসঙ্গান্তরে গেলে আমাদের আলোচনার ক্ষতি নেই।
{√কৃ, √স্মৃ} দু’টিই স্বরান্ত ধাতু ছিল। একটি ব্যঞ্জনান্ত ধাতু নেওয়া যাক, √পঠ্ (পাঠ করা)। তা থেকে ‘পাঠক’; সেই ‘অক’। এখানে দেখা যাচ্ছে ধাতুর উপধা (penultimate) স্বর অ-এর বৃদ্ধি (অ > আ)। আবার, √ছিদ্ (ছেদন করা); তা থেকে ‘ছেদক’, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে ‘ছেদকী’ হয় না। অতএব ‘পাঠক’ ‘ছেদক’ দু’টিতেই আছে ‘ণক’-প্রত্যয়, কিন্তু একটিতে উপধা অ-কারের বৃদ্ধি, অন্যটিতে উপধা ই-কারের গুণ (ই > এ) যা সব কৃৎ-প্রত্যয়েই সাধারণত হয়ে থাকে। তাহলে সাধারণ ভাবে বলা যায়, ‘কৃৎ-প্রত্যয়ে ইৎ-বর্ণ ণ্ বোঝাবে ধাতুর অন্ত্যস্বরের ও উপধা অ-কারের বৃদ্ধি’ (সূত্র ৭|২|১১৫ – ১১৭)।
কিন্তু ধাতুর স্বরের গুণ/বৃদ্ধি কোনোটাই যদি প্রত্যয় যোগে না হয়? যেমন আমরা জানি, √ভূ-ধাতু (হওয়া) থেকে ‘ভূত’, √কৃ-ধাতু (করা) থেকে ‘কৃত’। এখানে ধাতুর স্বর অবিকৃত রয়ে গেল, প্রত্যয়াংশ এসে জুড়ল ‘ত’। তাহলে কি প্রত্যয়টিকে ‘ত’ বলা যাবে? কিন্তু তাতে যে অগুণ অবৃদ্ধির খবরটা থাকবে না। তাই সেখানে একটি ইৎ-বর্ণ যোগ করা হল ‘ক্’; সেই ‘ক্’ বোঝাবে অগুণ অবৃদ্ধি (দ্রষ্টব্য ‘অনুবৃত্তি’ প্রসঙ্গে আলোচিত ‘ক্ঙিতি চ’, সূত্র ১|১|৫)। প্রত্যয়ের নাম দেওয়া হল ‘ক্ত’। এবং সাধারণ ভাবে ঘোষণা করা হল গ্-ইৎ ক্-ইৎ (কিৎ) এবং ঙ্-ইৎ প্রত্যয়ে ধাতুর স্বরের গুণ বা বৃদ্ধি হবে না। ‘ক্ঙিতি চ (গুণবৃদ্ধী ন)’। আগে ণ্-বর্ণ বোঝাচ্ছিল একটি কার্য (বৃদ্ধি), সাধারণ ভাবে কৃৎ-প্রত্যয় বোঝাচ্ছিল গুণ; আর ক্-বর্ণ বোঝাচ্ছে গুণ-বৃদ্ধির নাস্তি (negation)। এটা ইৎ-বর্ণের একটি অন্য ভূমিকা, অকার্য বা কার্যাভাব নির্দেশ করা। অর্থাৎ, ইৎ-বর্ণ প্রতিষেধকও হতে পারে।
যতটুকু দেখলাম তার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, ইৎ-বর্ণের ভূমিকা ক্রমশ অত্যন্ত কার্যকরী ও complex হয়ে উঠছে পাণিনির হাতে। মাহেশ্বর সূত্রে যা ছিল শুধুমাত্র সীমানির্দেশক বর্ণ তা এই ক’টি উদাহরণেই হয়ে উঠল কোথাও বৃদ্ধি (ণ্), কোথাও স্ত্রীপ্রত্যয় ঙীষ্ (ষ্), কোথাও গুণবৃদ্ধি-নিষেধের (ক্) নির্দেশক।
আরও লক্ষ করলাম, প্রত্যয়ের সাধারণ গঠন হল,
প্রত্যয় = ইৎ-বর্ণ + আকর অংশ (nucleus) + ইৎ-বর্ণ |
কেবল প্রত্যয় নয়, ইৎ-সংজ্ঞাকে পাণিনি ব্যবহার করবেন ভাষার অনেক ব্যাপকতর ক্ষেত্রে। তাঁর মতে ভাষায় ছ’টি মৌলিক category বা ‘ব্যবসিত’ আছে যা দিয়ে সমগ্র ভাষাকে ধরা যায়। সেই ব্যবসিতগুলো হল: ধাতু (verbal stem), প্রাতিপদিক (nominal stem), প্রত্যয় (suffix), আগম (augment), আদেশ (substitution), নিপাত (indeclinables)। পাণিনির মতে ‘বিভক্তি’-ও একপ্রকার প্রত্যয় কারণ সেটাও তো suffix, ধাতু বা প্রাতিপদিকের অন্তভাগে যুক্ত হয়। পাণিনি ‘প্রাতিপদিক’ ও ‘নিপাত’ ছাড়া বাকি সমস্ত ব্যবসিতের সঙ্গে বিভিন্ন নির্দেশবাহী ইৎ-বর্ণ জুড়েছেন। সমস্ত ইৎ-যুক্ত ব্যবসিতের আলোচনা এখানে করব না; কেবল ধাতুর দু’একটি ইৎ-বর্ণের উল্লেখ করব।
অষ্টাধ্যায়ী-র পরিশিষ্ট ‘ধাতুপাঠ’ অংশে সংস্কৃতভাষার সমস্ত ধাতুর তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেখানে এবং অষ্টাধ্যায়ী-র সূত্রে উল্লিখিত যাবতীয় ধাতু ইৎ-বর্ণযুক্ত। ব্যাকরণ-কৌমুদীনির্ভর আমাদের যে সংস্কৃতশিক্ষা সেখানে আমরা ধাতুগুলো পাই বিনা ইৎ-বর্ণে। যেমন, আমরা শিখি কৃ-ধাতু (করা)। ইৎ-বর্ণসমেত এই ধাতুটি কিন্তু ‘কৃঞ্’। এখানে ইৎ-বর্ণ ‘ঞ্’ বোঝাচ্ছে ধাতুটি উভয়পদী। পরস্মৈপদী রূপ ‘করোতি’, আত্মনেপদী ‘কুরুতে’। সব ধাতু তো উভয়পদী হয় না; তাই সে খবরটা ধাতুর নামের মধ্যেই রেখে দেওয়া প্রয়োজন হল। এই বন্দোবস্তে যেকোনো ঞিৎ-ধাতু দেখলেই তাকে উভয়পদী বুঝতে হবে। এ তো মস্ত সুবিধা ছাড়া কিছু নয়।
আবার, ‘ঞিধৃষা’ ধাতু। এ ধাতুকে আমরা চিনি ‘ধৃষ্’ রূপে। অর্থাৎ, ‘ঞি’ (ঞ্ + ই) এবং ‘আ’ এর ইৎ-বর্ণ। ক্ত-প্রত্যয় সাধারণত past participle বোঝায়, যেমন ‘মৃত’ (= √মৃ + ক্ত) হল ‘মরে গেছে এমন’। কিন্তু ওই √ধৃষ্ + ক্ত = ধৃষ্ট (bold), সেখানে তো বর্তমান কাল, অতীতের অর্থ নেই। তাই পাণিনি একটি সূত্রে বললেন, ‘ঞীতঃ ক্তঃ’ (সূত্র ৩|২|১৮৭)। এর অনুবৃত্তি-শব্দ ‘বর্তমানে’। অর্থাৎ, ‘ঞীতঃ ক্তঃ (বর্তমানে)’। ঞীতঃ = ঞি + ইতঃ। এভাবে এই সূত্র থেকে জানা গেল ‘ঞীৎ (ঞি + ইৎ)-ধাতুতে ক্ত-প্রত্যয় বর্তমানে হয়’। সুতরাং কোনো ধাতুতে ইৎ-বর্ণ ‘ঞি’ থাকলে কী হবে বোঝা গেল। আরও দু’টি ঞীৎ-ধাতু √ঞিমিদা, √ঞিক্ষিদা। ক্ত-প্রত্যয় যোগে তারা ‘মিন্ন’ (স্নেহপ্রবণ, স্নেহপদার্থ, চর্বি) এবং ‘ক্ষিণ্ণ’ (অস্ফুট শব্দকারী)। দু’টিতেই বর্তমান কালের অর্থ।
এখানে ধাতুর মধ্যে ইৎ স্বরবর্ণও দেখতে পেলাম, ‘আ’। বস্তুত, {অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৯ এ ও} এই প্রত্যেকটি স্বরবর্ণই ইৎ-বর্ণ রূপে ধাতুর রাজ্যে ব্যবহৃত হয়, তারা প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশকও বটে। বর্তমানে তার বিবরণে যাব না।
ইৎ-সমেত ধাতুর নমুনা থেকে দেখা গেল যে প্রত্যয়ের মতোই ধাতুর সাধারণ গঠন:
ধাতু = ইৎ-বর্ণ + আকর অংশ (nucleus) + ইৎ-বর্ণ |
বস্তুত, যেকোনো ব্যবসিতের সাধারণ গঠনই এভাবে দেখানো যায়:
ব্যবসিত = ইৎ-বর্ণ + আকর অংশ (nucleus) + ইৎ-বর্ণ |
এখানে ইৎ-বর্ণ থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ, ইৎ-বর্ণ = নির্দিষ্ট ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণ, অথবা ০ (শূন্য)।
১.৬ কী কী ইৎ-বর্ণ
প্রত্যয়, ধাতু ইত্যাদিতে যে ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণগুলো যুক্ত থাকে পাণিনি-পরবর্তী বৈয়াকরণেরা তাদের নাম দিয়েছিলেন ‘অনুবন্ধ’, যদিও পাণিনি তাদের ‘ইৎ’ ভিন্ন কিছু নাম দেন নি। যেমন, ‘ণ্বুল্’ প্রত্যয়ের অনুবন্ধ {ণ্, ল্}, ‘ষ্বুন্’ প্রত্যয়ের অনুবন্ধ {ষ্, ন্}।
আমরা দেখলাম, যেকোনো ব্যবসিতের একটা কেন্দ্রীয় আকর অনিৎ (ইৎ হয় না এমন) অংশের আগেও ইৎ-বর্ণ থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে; পরেও ইৎ-বর্ণ থাকতে পারে, এবং নাও থাকতে পারে। যেকোনো দিকেই এক বা একাধিক ইৎ-বর্ণ থাকতে পারে। কিন্তু কোন্ কোন্ বর্ণকে ইৎ রূপে ব্যবহার করা হয়ে থাকে?
প্রত্যয়, আগম ও আদেশের জন্য পাণিনির ইৎ-বর্ণেরা হল {ক্, খ্, গ্, ঘ্, ঙ্}, {চ্, ছ্ (ছ = ঈয়), জ্, ঝ্ (ঝ = অন্ত), ঞ্}, {ট্, ঠ্ (ঠ = ইক), ড্, ঢ্ (ঢ = এয়), ণ্}, {ত্, ন্}, {প্, ম্ (কেবল আগমে)}, {র্, ল্}, {শ্, ষ্, স্}। এখানে বর্ণের জাত অনুযায়ী তাদের আমি ব্র্যাকেটস্থ করেছি যা থেকে বোঝা যাচ্ছে কোন্ কোন্ বর্ণের ইৎ-শ্রেণিতে স্থান নেই। লক্ষণীয়, প্রত্যয়/আগম/আদেশের ইৎ-বর্ণগুলি কেবল ব্যঞ্জন। স্বরবর্ণ কদাচিৎ দেখা যায় (যেমন, বি-প্রত্যয়, তুক্-আগম); তারা কেবল উচ্চারণার্থে, অর্থাৎ, নাম উচ্চারণে সহায়তা করে।
আগমে কেবল ইৎ-বর্ণ ক্ ট্ ম্ ব্যবহার হয়; প্রত্যয়ে ম্ ভিন্ন বাকি সব। কিন্তু ইৎ-বর্ণগুলির প্রয়োগের পৌনঃপুনিকতায় (frequency) যথেষ্ট পার্থক্য আছে বলা বাহুল্য। কোনোটি বারবার পাওয়া যায়, কোনোটি হয়তো এক কি দু’বার। প্রত্যেক বর্ণ একেকটি নির্দিষ্ট কার্যের signal, সেই কার্য ভাষায় ক’বার ঘটছে তার ওপর ইৎ-বর্ণের পৌনঃপুনিকতা নির্ভর করবে।
কিন্তু একই ইৎ-বর্ণ দু’টি ভিন্ন ব্যবসিতে আছে সেই বর্ণ যে দুই ক্ষেত্রে একই কার্য নির্দেশ করবে তেমন কথা নেই। যেমন, প্রত্যয়ে ক্-ইৎ বোঝায় স্বরের গুণ/বৃদ্ধি হবে না (যথা, ক্ত-প্রত্যয়); অথচ আগমে (যথা, তুক্) ক্-ইৎ বোঝায় যে আগমটি বসবে ধাতুর পরে।
ধাতুতে পাণিনি ব্যবহার করেছেন প্রধানত ইৎ-স্বরবর্ণ {অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৯, এ, ও} এবং মাঝে মাঝে ইৎ- ব্যঞ্জন {ঙ্, ঞ্, ণ্, প্, ষ্}। সেই সঙ্গে আছে কিছু দ্বিবর্ণ ইৎ: ঞি, টু, ডু, ইর্। এই বর্ণদ্বয় একসঙ্গে ইৎ হয়। এর মধ্যে ইৎ ‘আ’ ‘ঞ্’ ‘ঞি’-এর দেখা আমরা আগেই ‘√কৃঞ্’, ‘√ঞিধৃষা’ প্রভৃতি ধাতুতে পেয়েছি।
ইৎ-বর্ণেরা কী কী কার্য নির্দেশ করে? প্রধানত এইগুলি: (১) স্বরের গুণ-বৃদ্ধি, (২) স্বরের গুণ-বৃদ্ধি নিষেধ, (৩) ব্যঞ্জনের পরিবর্তন, (৪) প্রত্যয়ান্ত ধাতুর কোনো অংশের লোপ, (৫) আগম ও আদেশের উপস্থিতি, (৬) আগমের স্থান, (৭) ধাতুর শ্রেণি (আত্মনেপদী/পরস্মৈপদী/উভয়পদী), (৮) বিভিন্ন কালে (tense) ও ভাবে (mood) ধাতুরূপের বৈশিষ্ট্য, (৯) সমরূপ প্রত্যয় বা ধাতুর মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি, (১০) উচ্চারণে সহায়তা, (১১) স্বর (accentuation) --- উদাত্ত (acute accent), অনুদাত্ত (grave accent), স্বরিত (circumflex accent)। এর সঙ্গে অবশ্যই ধরতে হবে, (১২) প্রত্যাহার-সংজ্ঞা, যার কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে (উপভাগ ১.৩)।
এখানে ১১-সংখ্যক পদ ‘স্বর (accentuation)’ একটি বিশিষ্ট বিষয়। প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতে স্বরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু পরবর্তী কালের সংস্কৃতভাষায় এর গুরুত্ব ক্রমশ কমে এল, প্রায় শূন্য হয়ে গেল। পাণিনি যেহেতু সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করেছিলেন তাঁর পূর্বকাল ও সমকালের ভাষা তাই তাঁর ভাষাবিজ্ঞানে স্বর পেয়েছিল একটি প্রধান স্থান, এবং সেই প্রয়োজনে তিনি বিন্যস্ত করেছিলেন নানাবিধ ইৎ-বর্ণ। তাঁর পরবর্তী বৈয়াকরণেরা ভাষায় স্বরের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় স্বরবোধক ইৎ-বর্ণগুলি ক্রমশ বর্জন করতে লাগলেন। কলাপ থেকে মুগ্ধবোধ, এই প্রায় এক হাজার বছরে সেই ভার অনেক হালকা হয়ে এল। সেই বর্জিতভার অবস্থায় আমরা অনেক প্রত্যয় ইত্যাদির নামের সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকি (যেমন, ণক, অনট্); সেগুলি পাণিনীয় নাম নয়। এই বিবর্তন একটি পৃথক আলোচনার প্রসঙ্গ হতে পারে।
১.৭ ইৎ-এর স্থান ও পরিণাম
ইৎ-বর্ণগুলি তো চেনা হল, কিন্তু কোনো ব্যবসিতের (ধাতু, প্রত্যয়, আগম, আদেশ) মধ্যে কোন্ কোন্ বর্ণ ইৎ তা চিনব কী করে? ধরা যাক, ‘ঘঞ্’-প্রত্যয়, ‘ইট্’-আগম, ‘ঞিধৃষা’-ধাতু। এগুলিতে ইৎ-বর্ণ শনাক্ত করে ‘আকর অংশ’ বা nucleus-টিকে চেনার উপায় কী?
ইৎ-বর্ণ চেনার উপায় অষ্টাধ্যায়ী-র প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম সূত্রে, সূত্র ১|৩|২ – ৮, পাণিনি বিবৃত করে গেছেন। আর, তার ঠিক পরেই বলেছেন ইৎ-এর পরিণাম কী হবে (সূত্র ১|৩|৯)।
সূত্র ১|৩|২, পাণিনি বলছেন, ‘উপদেশেঽজনুনাসিক ইৎ’। এই সূত্রের কোনো অনুবৃত্তি নেই; এটি একটি ‘সংজ্ঞা-সূত্র’। সূত্রের পদচ্ছেদ করলে পাই, ‘উপদেশে অজনুনাসিকঃ ইৎ’। প্রথম পদের অন্ত্য এ-কার ও দ্বিতীয় পদের আদ্য ‘অ’ থেকে সন্ধিতে ‘ঽ’ (লুপ্ত অ) হয়েছে। দ্বিতীয় পদের অন্ত্য বিসর্গের পরেই তৃতীয় পদের আদ্য ‘ই’ থাকাতে বিসর্গসন্ধির নিয়মে বিসর্গ লোপ হয়েছে। তাই সূত্রের বয়ান হয়েছে, ‘উপদেশেঽজনুনাসিক ইৎ’। ‘অজনুনাসিক’ সন্ধি ভাঙলে ‘অচ্ + অনুনাসিক’। ‘অচ্’ প্রত্যাহার যে সমস্ত স্বরবর্ণ বোঝায় তা আগেই বলেছি। তাহলে সূত্রের অর্থ দাঁড়াল, ‘উপদেশে অনুনাসিক স্বরবর্ণ ইৎ হয়।’
‘উপদেশ’ একটি বিশিষ্টার্থক শব্দ। এর অর্থ আমাদের পরিচিত advice নয়। কাশিকাবৃত্তি-তে এই সূত্রের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ‘উপদিশ্যতেঽনেনেতি উপদেশঃ, শাস্ত্রবাক্যানি সূত্রপাঠঃ খিলপাঠশ্চ। তত্র যোঽজনুনাসিকঃ স ইৎসংজ্ঞো ভবতি।’ বাংলায় ‘উপদিশ্’ বলে কোনো ধাতু নেই বলে প্রথমাংশ বঙ্গানুবাদে অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু এই ব্যাখ্যার অর্থ হল, ‘উপদেশ দেওয়া হয় যার দ্বারা, সেই শাস্ত্রবাক্যসমূহ, সূত্রপাঠ এবং খিলপাঠ, তা উপদেশ। সেখানে যে স্বরবর্ণ অনুনাসিক তা ইৎ-সংজ্ঞক হয়।’ এখান থেকে ‘উপদেশ’-এর একটা মানে পাওয়া যাচ্ছে। শাস্ত্রবাক্য, সূত্রপাঠ ও খিলপাঠ। ‘সূত্রপাঠ’ বলতে বোঝায় পাণিনির সূত্রগুলো। ‘খিলপাঠ’ বলতে বোঝায় ‘ধাতুপাঠ’ ‘গণপাঠ’ ইত্যাদি, ধাতুর তালিকা ও গণের (শব্দ-শ্রেণি) তালিকা যা সূত্রের সঙ্গে অবশ্যপাঠ্য। শাস্ত্রবাক্যের ‘শাস্ত্র’ বলতে এখানে ব্যাকরণ-শাস্ত্রই বোঝা উচিত। শাস্ত্রবাক্য সূত্রপাঠ ও খিলপাঠ ‘লৌকিক বাক্য’ নয়। তাদের মধ্যে যেকোনো ব্যাপারের original enunciation বা আদি উক্তি হয়। ধাতু, প্রত্যয়, আগম, আদেশ, এরা সে জাতীয় ব্যাপার। এরা ব্যাকরণের প্রকরণগত বিশিষ্ট শব্দ, technical words; তারা লৌকিক ভাষায় স্বাধীন স্বতন্ত্র ব্যবহারের জন্য নয়। তাই এই শব্দসমূহই হল ‘উপদেশ’। এবং মৌখিক আবৃত্তিতে, পাঠে তাদের মধ্যে যে স্বরবর্ণগুলো অনুনাসিক ভাবে উচ্চারণ করা হবে তারা ইৎ-সংজ্ঞক, ইৎ-এর পর্যায়ে পড়ে। ব্যাকরণ-শাস্ত্র যে সেকালের সমস্ত শাস্ত্রের মতো মৌখিক পরম্পরা ছিল এখানে সেই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, সূত্রপাঠ ও খিলপাঠে উপদেশের কোন্ স্বরবর্ণ অনুনাসিক তা স্পষ্ট করে বলা নেই। হয় পাণিনি তা কোনো সূত্রে স্পষ্ট করে বলেন অথবা তাঁর প্রকরণের মধ্যে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, আগে দেখেছি প্রত্যয়ে কোনো ইৎ-স্বরবর্ণের বালাই নেই। ধাতুতে আছে ‘ঞি’, তার পুরোটাই ইৎ হয় তা সূত্রে বলা আছে (সূত্র ১|৩|৫)।
পরের সূত্র ১|৩|৩, ‘হলন্ত্যম্’। এখানে পূর্বসূত্রের অনুবৃত্তি ‘উপদেশে ইৎ’। অর্থাৎ, ‘হলন্ত্যম্ (উপদেশে ইৎ)’। হলন্ত্যম্ = হল্ + অন্ত্যম্। ‘হল্’ প্রত্যাহার সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ বোঝায়। সূত্রের অর্থ দাঁড়াল, ‘উপদেশের অন্ত্য হল্ (ব্যঞ্জন) ইৎ-সংজ্ঞক হয়।’
সূত্র ১|৩|৪, ‘ন বিভক্তৌ তুস্মাঃ’। পূর্বসূত্রের অনুবৃত্তি সহ, ‘ন বিভক্তৌ তুস্মাঃ (উপদেশে ইৎ হল্ অন্ত্যম্)’। তু = ত-বর্গের সমস্ত বর্ণ, ত্ থ্ দ্ ধ্ ন্ (দ্রষ্টব্য ‘পাণিনির কু’, উপভাগ ১.৪)। তু (ত-বর্গ) স্ ম্ নিয়ে ‘তুস্মাঃ’, দ্বন্দ্বসমাসে বহুবচন। সূত্রের অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ‘উপদেশে বিভক্তির অন্ত্য তু (ত-বর্গ) স্ ম্ ইৎ-সংজ্ঞক হয় না।’ বলা বাহুল্য, এটি আগের সূত্রের প্রতিষেধ হল।
সূত্র ১|৩|৫, ‘আদির্ঞিটুডবঃ’। অনুবৃত্তি সহ, ‘আদির্ঞিটুডবঃ (উপদেশে ইৎ)’। সন্ধি ভেঙে, ‘আদিঃ ঞি-টু-ডবঃ’। অর্থ, ‘উপদেশের আদিতে স্থিত ঞি টু ডু ইৎ-সংজ্ঞক হয়।’ এই উপদেশ অবশ্য ধাতু। অন্য কোনো উপদেশে ঞি টু ডু পাওয়া যায় না। এখানে টু অর্থ ট-বর্গ (উপভাগ ১.৪) নয়; ট-বর্গ বোঝালে টু-এর পরেই আর ডু থাকত না। ঞি টু ডু এই প্রতিটি বর্ণদ্বয় (ব্যঞ্জন + স্বর) একযোগে ইৎ। ‘ঞিটুডু’ এরা দ্বন্দ্বসমাসে প্রথমা বিভক্তির বহুবচনে হয়েছে ‘ঞিটুডবঃ’, যেমন উ-কারান্ত শব্দ হয়ে থাকে।
সূত্র ১|৩|৬, ‘ষঃ প্রত্যয়স্য’। অনুবৃত্তি সমেত, ‘ষঃ প্রত্যয়স্য (উপদেশে ইৎ আদিঃ)’। অর্থ, ‘উপদেশে প্রত্যয়ের আদিস্থিত ষ্ ইৎ-সংজ্ঞক হয়।’ কেবল অন্ত্য হল্ (ব্যঞ্জন) নয়, ৫ ও ৬-সংখ্যক সূত্রে উপদেশের আদিস্থিত বিশেষ ব্যঞ্জনও ইৎ হচ্ছে।
সূত্র ১|৩|৭, ‘চুটূ’। অনুবৃত্তি সমেত, ‘চুটূ (উপদেশে ইৎ আদিঃ প্রত্যয়স্য)’। সূত্রার্থ, ‘উপদেশে প্রত্যয়ের আদিস্থিত চু (চ-বর্গের বর্ণ) এবং টু (ট-বর্গের বর্ণ) ইৎ-সংজ্ঞক হয়।’ এই সূত্রটি অবশ্য ‘নিত্য’ (universal) নয়; এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন, চুঞ্চুপ্/চণপ্ প্রত্যয় (বিদ্যাচুঞ্চু/বিদ্যাচণ)। এখানে চু/চ ইৎ নয়, প্রত্যয়ের আকর অংশই ‘চুঞ্চু’/’চণ’। এবং এই ‘অনিত্য’-ত্ব হেতুই এই সূত্রের বক্তব্য পূর্ব সূত্রে বলা হয় নি। তবে এই সূত্রও আগের দু’টি সূত্রের মতো উপদেশের আদিস্থিত ব্যঞ্জন ইৎ-এর কথা বলছে।
সূত্র ১|৩|৮, ‘লশক্বতদ্ধিতে’। অনুবৃত্তি ও পদচ্ছেদ সমেত, ‘ল-শ-কু-অতদ্ধিতে (উপদেশে ইৎ আদিঃ প্রত্যয়স্য)’। এই সূত্রটি নিয়ে আগে ‘পাণিনির কু’ উপভাগে (১.৪) আলোচনা করেছি। এর সূত্রার্থ, ‘উপদেশে অতদ্ধিত প্রত্যয়ের আদিস্থিত ল্ শ্ এবং কু (ক-বর্গের বর্ণ) ইৎ-সংজ্ঞক হয়।’
সূত্র ১|৩|২ – ৮ এই সাতটি সূত্রের বক্তব্য সংক্ষেপে এই:
(সূত্র ২) উপদেশে অনুনাসিক স্বরবর্ণ ইৎ হয়; (সূত্র ৩) উপদেশের অন্ত্য ব্যঞ্জন ইৎ হয়; (সূত্র ৪) উপদেশে বিভক্তির অন্তে ত-বর্গের বর্ণ, স্ এবং ম্ ইৎ হয় না; (সূত্র ৫) উপদেশের আদিস্থিত ঞি টু ডু ইৎ হয়; (সূত্র ৬) উপদেশে প্রত্যয়ের আদিস্থিত ষ্ ইৎ হয়; (সূত্র ৭) উপদেশে প্রত্যয়ের আদিস্থিত চ-বর্গের ও ট-বর্গের বর্ণ ইৎ হয়; (সূত্র ৮) উপদেশে অতদ্ধিত প্রত্যয়ের আদিস্থিত ল্ শ্ এবং ক-বর্গের বর্ণ ইৎ হয়। (‘উপদেশ’ শব্দটি বারবার এল কারণ বিভক্তি প্রত্যয় প্রভৃতি যখন ‘উপদেশ’ রূপে বিদ্যমান তখনই একমাত্র তাদের ইৎ-বর্ণের প্রশ্ন ওঠে, নচেৎ নয়।)
এই সপ্ত সূত্র থেকে আমরা হদিশ পেতে পারি একটি উপদেশ-এর মধ্যে কোন্গুলি ইৎ-বর্ণ। এবং এখানেও বলতে পারি, উপদেশের সাধারণ গঠন হল:
উপদেশ = ইৎ-বর্ণ + আকর অংশ (nucleus) + ইৎ-বর্ণ |
উপদেশে ইৎ-বর্ণের অবস্থান জানা গেল, তাদের চেনা গেল। এরপরেই পাণিনি বলবেন এই প্রকরণের আসল কথাটি --- সূত্র ১|৩|৯, ‘তস্য লোপঃ’। অনুবৃত্তি সহ, ‘তস্য লোপঃ (উপদেশে ইৎ)’। সূত্রার্থ, ‘উপদেশে ইৎ-সংজ্ঞক বর্ণের লোপ হয়।’ এই হল ইৎ-সংজ্ঞার পরিণাম। এইজন্যেই ইৎ-বর্ণসমূহ যুক্ত করা হয়েছিল উপদেশের সঙ্গে। তারা বিভিন্ন কার্যের নির্দেশ দিয়ে লোপ হবে। তা না হলে সেই বর্ণগুলো অনাবশ্যক হয়ে যেত।
এই ‘লোপ’ নামক phenomenon-এর সংজ্ঞা পাণিনি দিচ্ছেন অনেক আগে, ১|১|৬০-সংখ্যক সূত্রে, ‘অদর্শনং লোপঃ’। বাহ্যত এই সংজ্ঞা-সূত্রের অর্থ, ‘অদর্শনকে লোপ বলা হয়’। কিন্তু বাংলায় ‘লোপ’ যেমন আমরা উধাও হয়ে যাওয়া বা ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া অর্থে ধরি, পাণিনির ‘লোপ’-এর তাৎপর্য তার চেয়ে গূঢ়তর। কোনো বর্ণবিনাশ হয়ে যখন অদর্শন অনুচ্চারণ অনুপলব্ধি ও অভাব সৃষ্ট হয় অথচ কোনো অর্থান্তর ঘটে না, তখন সেই লুপ্ত বর্ণের স্থান নেয় লোপ। এই অর্থে ব্যাকরণের লোপ একটি substitution বা ‘আদেশ’। কোনো বর্ণের পরিবর্তে তার অর্থবাহী একটি শূন্যস্থানের উপস্থিতি।
এবার ফিরে আসছি প্রথমে নেওয়া উদাহরণগুলিতে। ‘ঘঞ্’ প্রত্যয়। এটি অতদ্ধিত প্রত্যয় কারণ এটি কৃৎ-প্রত্যয়। এর আদিস্থিত বর্ণটি ক-বর্গের। তাহলে সূত্র ‘লশক্বতদ্ধিতে’ (১|৩|৮) অনুসারে ঘ্ ইৎ-সংজ্ঞক হবে। ‘হলন্ত্যম্’ (সূত্র ১|৩|৩) অনুসারে অন্ত্য ব্যঞ্জন ঞ্ ইৎ-সংজ্ঞক হবে। সুতরাং, ঘঞ্ = ঘ্-ইৎ + অ (আকর অংশ, nucleus) + ঞ্-ইৎ। ইৎ-বর্ণ ঘ্ ঞ্ ব্যাকরণনির্দিষ্ট কার্যের সংকেত দেবে, এবং অবশেষে ‘তস্য লোপঃ’ (১|৩|৯) সূত্রানুসারে তাদের লোপ হবে। ধাতুতে প্রত্যয়ের ইৎ-বর্ণ নির্দেশিত পরিবর্তনের পরে তার সঙ্গে প্রত্যয়ের আকর অংশ (nucleus) ‘অ’ যুক্ত হবে। ঘঞ্-প্রত্যয়ের নমুনা: √পচ্ + ঘঞ্ = পচ্ + ঘ্-ইৎ + অ + ঞ্-ইৎ = পাক্ + ঘ্-লোপ + অ + ঞ্-লোপ = পাক্ + ০ (লোপ) + অ + ০ (লোপ) = পাক। এখানে ঘ্-ইৎ Þ চ্ > ক্ (সূত্র ৭|৩|৫২); ঞ্-ইৎ Þ (১) ধাতুর অন্ত্যস্বর ও উপধা অ-কারের বৃদ্ধি (সূত্র ৭|২|১১৫ - ১১৭), (২) আদ্যস্বরের উদাত্ততা (সূত্র ৬|১|১৯৭)।
‘ইট্’ আগম। ‘হলন্ত্যম্’ সূত্রানুসারে অন্ত্য হল্ ট্ ইৎ-সংজ্ঞক। ইট্ = ই (আকর অংশ, nucleus) + ট্-ইৎ। দৃষ্টান্ত: √লিখ্ + ইট্-আগম + ক্ত-প্রত্যয় = লিখ্ + ই + ট-ইৎ + ক-ইৎ + ত = লিখ্ + ই + ০ (লোপ) + ০ (লোপ) + ত = লিখিত। ব্যাকরণের পরিভাষায় ‘লিখ্’ একটি ‘সেট্’ (স + ইট্) ধাতু, তার অনেক কার্যে প্রত্যয়ের আগে একটি ‘ইট্’ আগম হয়। ইট্-এর ট্-ইৎ Þ নির্দিষ্ট উপদেশের (এখানে প্রত্যয়) আদিতে এই আগম বসবে এই নির্দেশ করে (সূত্র ১|১|৪৬)।
‘ঞিধৃষা’ ধাতু। প্রত্যয়ের দিক থেকে এই ধাতু সম্বন্ধে আমরা আগে আলোচনা করেছি ‘নির্দেশক ইৎ-বর্ণ’ উপভাগে (১.৫)। সূত্র ১|৩|৫ ‘আদির্ঞিটুডবঃ’ অনুসারে আদিস্থিত ‘ঞি’ ইৎ-সংজ্ঞক। আরেকটি সূত্র (সংখ্যা ৭|২|১৬) ‘আদিতশ্চ (অঙ্গস্য ন ইট্ নিষ্ঠায়াম্)’ অনুসারে ধাতুর ‘আৎ’ (কেবল আ-বর্ণ বোঝানোর জন্য প্রত্যাহার, দ্র. উপভাগ ১.৪) ইৎ-সংজ্ঞক হয় এবং ‘নিষ্ঠা’ (past participle) প্রত্যয়ে (ক্ত, ক্তবতু প্রত্যয়) ইট্-আগম গ্রহণ করে না। সুতরাং, ঞিধৃষা = ঞি-ইৎ + ধৃষ্ + আ-ইৎ। ধাতুর কার্যকালে (ক্ত- প্রত্যয় যোগে): √ঞিধৃষা + ক্ত-প্রত্যয় = ঞি-ইৎ + ধৃষ্ + আ-ইৎ + ক্-ইৎ + ত = ০ (লোপ) + ধৃষ্ + ০ (লোপ) + ০ (লোপ) + ত = ধৃষ্ট। এখানে ঞি-ইৎ Þ নিষ্ঠা-প্রত্যয়ে বর্তমানকালের অর্থ (সূত্র ৩|২|১৮৭); আ-ইৎ Þ নিষ্ঠা-প্রত্যয়ে ইট্-আগম নিষেধ (সূত্র ৭|২|১৬)।
*****
পাণিনির ব্যাকরণ সহস্র-এক আরব্য রজনীর চেয়েও রোমাঞ্চকর। একটা ভাষার প্রকৃতিগত শৃঙ্খলা কী উপায়ে তিনি আবিষ্কার করলেন তা এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা। আজকের আলোচনায় প্রাথমিক দ্বারোদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হল মাত্র। পর্বান্তরে আরও বিচিত্র প্রসঙ্গে প্রবেশ করবার আশা রাখি।
মূলগ্রন্থ: (১) ‘অষ্টাধ্যায়ী’, পাণিনি; (২) ‘কাশিকাবৃত্তি’, জয়াদিত্য ও বামন প্রণীত
বর্ণানুক্রমিক উল্লেখ-সূচি
(১) পরিভাষা/সংজ্ঞা: অনুবন্ধ, আগম, আদেশ, উপদেশ, ইৎ, গুণ, ধাতু, নিপাত, নিষ্ঠা, প্রত্যয়, প্রত্যাহার, প্রাতিপদিক, বিভক্তি, বৃদ্ধি, ব্যবসিত, মাহেশ্বর সূত্র, লোপ
(২) সূত্র: ১|১|১ – ৬; ১|১|৯ – ১০; ১|১|৪৬; ১|১|৬০; ১|১|৬৯ – ৭০; ১|৩|২ – ৯; ৩|২|১৮৭; ৬|১|১৯৭; ৭|১|১; ৭|২|১৬; ৭|২|১১৫ – ১৭; ৭|৩|৫২; ৭|৩|৮৪ – ৮৬
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
শ্রী প্রতাপ দে, শ্রী অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য, শ্রী অমিতাভ প্রামাণিক, শ্রী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)