তিরিশ বছর আগে এমনই একদিন দুর্যো বাবুর রাজনৈতিক গুরু ধৃতদেশ বাবু বাবুঘাটে দাঁড়িয়ে গঙ্গায় ভেসে ওঠা ডলফিন দেখিয়ে বলেছিলেন==
“দেখ্ দুর্যো, রাজনীতি হচ্ছে একদম এই ডলফিনের মতো। বেশিরভাগটাই আন্ডারওয়াটার গেম। কিন্তু পু্রোটা নয়। মাঝে মাঝে নাক উঁচু করে জলের উপর উঠে শ্বাস নিতে হয়। নিজের বেঁচে থাকার জন্য আর জনসাধারণকে খেলা দেখানোর জন্য। সাবমেরিন যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বুঝলি, তাকেও একসময় না একসময় নাকটা জলের উপর তুলে শ্বাস নিতে হয়। না হলে... ।”
দুর্যো বাবু গুরুর বাক্য বেদবাক্যের মতোই ফলো করেছেন। এই তিরিশ বছরে ওঁর যা কুখ্যাতি, সুখ্যাতি তার চেয়ে কিছু কম না। আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্ল্ড ওঁকে বস মানে—চোরা কারবারি, অবৈধ প্রমোটিং, মেয়ে পাচার, ড্রাগস কোনটাই বাদ নেই। কিন্তু জনগণ ওঁকে জানে রবিনহুড হিসাবে। হিমশৈলের চূড়াটার পুরোটাই জনগণের জন্য নিবেদিত। আর বোকা জনগণ তাতেই খুশি।
আজকাল অবশ্য দুর্যো বাবু একটু চাপে আছেন। ওঁর মা মাগো পার্টিকে ছাপিয়ে উঠে আসছে জয় মা পার্টির তরুণ তুর্কী অর্জুন রায়। কী আন্ডারগ্রাউন্ড কী ওভার গ্রাউন্ড, প্রত্যেকটা ফ্রন্টে সেয়ানে সেয়ানে টেক্কা দিচ্ছে অর্জুন রায়। সাথে আবার ধর্মের সুড়সুড়িটাও এখন শুরু করেছেন ওঁরা।
“স্যার! অর্জুন রায় আবার অপপ্রচার করছে--” ঠিক এই সময়ই ফোন করে জানাল দুর্যো বাবুর ডান হাত উলুক। আর ঠিক সেই সময়ই ঘরে ঢুকল দুর্যো বাবুর শালা শকুন্ত বাবু, বড়ো জামাই চিরঞ্জীবী আর ছোট জামাই দুশ সেন। দুর্যো বাবুর কোর টিম।
“কেন কী বলছে অর্জুন?” ইশারায় সবাইকে বসতে বলে মোবাইলের স্পীকারটা অন করলেন দুর্যো বাবু।
“স্যার, অর্জুন আবার প্রচার করছে যে গোবিন্দের হাট, মনসা পল্লী, থাক দাঁড়ি ব্লকে আমরা লোক বেছে বেছে চাল গম রেশনে দিচ্ছি। তাও আবার যা আপনি ঘোষণা করেছেন তার থেকে কম।”
“হুমম্। তার মানে ও বুঝে ফেলেছে খেলাটা। কিন্তু কোন ব্লকে কী হচ্ছে খবরটা পাচ্ছে কী করে ছোকরা। আচ্ছা তুই একটা কাজ কর। প্রচার করে দে যে আমি নিজে আসছি আজ বেলা দশটায়। রেশন ডিলারদের টাইট করতে।”
“ঠিক আছে স্যার। কিন্তু ডিলাররা তো আমাদেরই কথায়... ”
“ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই বরং তপন সাহা, বলরাম বসাক, মাখন মিদ্দা, গদাধর ঘোষ সবাইকে বলে দে যে আজ ওদের দোকানগুলোয় তোরা একটু হামলা হামলা খেলবি আমার নেতৃত্বে। ওরা যেন অভিনয়টা চালিয়ে যায়।”
“ঠিক আছে স্যার।”
“আর তারপর আমার মাস্টার স্ট্রোক! ফ্রী-তে চাল সবাইকে!” দুর্যো বাবুর ঘোষণা কানে ঢুকতেই বিরক্ত হয়ে উঠে গেল কর্ণ।
“দারুণ। দারুণ স্যার।”
“ঠিক আছে। এবার কাজে লেগে পড়ো।” উলুকের ফোনটা কেটে দুর্যো বাবু স্মিত হাস্যে তাঁর কোর টিমের দিকে তাকালেন। সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে লেগে পড়ল নতুন প্ল্যানের খুঁটিনাটি তৈরি করতে। তারপর সবাই বেরিয়ে গেলে আবার একবার টিভির পর্দায় দেখে নিলেন আজকের ব্রেকিং নিউজ। ডলফিনের ফিরে আসা। মনটা আবার খুশিতে ভরে গেল।
এর কিছুক্ষণ পরেই একটা ফোন গেল অর্জুন রায়ের কাছে।
“অর্জুন বাবু, একটা ভালো খবর আছে। রেশনে ফ্রী-তে চাল। আজই ঘোষণা হতে চলেছে... ।”
------------------------------*------------------------------
আজ ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০। গত দু দিনের ফুরফুরে মেজাজটা হঠাৎ করে বিগড়ে গেছে দুর্যো বাবুর গত রাত থেকে।
এমনিতে সময়টা ভালোই কাটছিল। এই করোনার জাদুকাঠিতে যখন প্রকৃতি নতুন করে ধরা দিচ্ছে মানুষের কাছে, আকাশটা নীল আরও নীল হয়ে যাচ্ছে, কত দিন পরে শোনা যাচ্ছে পাখিদের ডাক, এমনকী প্রজাপতিরা এসেও ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে জানলার গ্রিল কিংবা ব্যালকনির রেলিং, তখন দুর্যো বাবু ঠিক করলেন যে তিনিও একটু প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করবেন। প্রকৃতির অনাবিল হাওয়ার মাঝে কয়েকদিন বুক ভরে শ্বাস নেবেন।
দোতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। চারপাশে অনেকটা জায়গা। সামনে সবুজ লন। বেশ কিছু লম্বা পাম ট্রি তার সাথে কেয়ারি করা সবুজ ঝাউ গাছ। সবুজ মেক্সিকান ঘাসের কার্পেট সমস্ত লনটা জুড়ে। মাঝে মাঝে রঙিন নুড়ি পাথর। তার ভিতর থেকে উঁকি মারছে থাই রেইন লিলি ও সাকুলেন্ট। আইসপ্ল্যান্টও আছে কয়েকটি এদিক ওদিক ছড়িয়ে। পিছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে শুধু ফুলের বাগান। আর তার মধ্যে সাদা দোতলা বাড়িটা একটা আলাদা আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা জানলা খুলে দিলেই হাওয়ার স্রোত খেলে যাচ্ছে ঘরগুলোর মধ্যে। আর অদ্ভুত ভাবে দারুণ স্নিগ্ধ, শীতল একটা ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে বাতাস। সেই ছোটবেলার পর আবার চোখ বুজে ব্যালকনিতে আরাম কেদারায় বসে বাড়ির সমস্ত দরজা জানলা খুলে সকাল সন্ধ্যা হাওয়া খাচ্ছিলেন দুর্যো বাবু। রেশনের গোলমালটা এমনভাবে সমাধান করে দিয়েছেন যে লোকে রেশনের ডিলারদের উপর খেপে গেছে। আর তাঁর জয়ধ্বনি করছে। তবে একটা জিনিস তাঁর মনের মধ্যে খচ্ খচ্ করছে। তিনি সবার জন্য ফ্রী রেশনের ঘোষণাটা করার আগেই অর্জুন রায় মঙ্গলপুরের জনসভায় এই দাবিটা করে বসল। তাই তার ঘোষণাটা জনগণ সোৎসাহে নিলেও জয় মা পার্টি দাবি করেছে যে তাদের চাপেই এটা করতে বাধ্য হয়েছে দুর্যো বাবু। ফলে প্রচারের ঝাঁঝটা যেন ঠিক কাসুন্দির মতো হলো না। কিন্তু খবরটা অর্জুন রায়কে দিল কে। একটা সন্দেহের ঘুণপোকা মাথার মাঝে ডিগবাজি খাচ্ছে।
তারপরও সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। গোল বাঁধাল একটা ধেড়ে ইঁদুর, কাল রাতে। করোনার কল্যাণে মুম্বাইতে ময়ূর, নয়ডাতে নীল গাই, তিরুপতিতে চিতল হরিণ, গৌহাটিতে গন্ডার, ওড়িশায় কচ্ছপ, ব্যাঙ্গালুরুতে ভাম বিড়াল বেরোনোর পর শেষ পর্যন্ত কলকাতায় বেরোলো কী না একটা ধেড়ে ইঁদুর! সে শুধু বাড়িতেই ঢোকেনি, সারা রাত তাণ্ডব চালিয়েছে ড্রয়িংরুমে, বেডরুমে, কিচেনে। এমনকী বাথরুমও বাদ যায় নি! ঘুমটা মোটেও সন্তোজনক হয়নি দুর্যো বাবুর। তার উপর গিন্নি বিদেহী দেবী অভিযোগ করছেন যে এই কাণ্ডটা ঘটেছে দুর্যো বাবুর জন্যই। ওঁর সব দরজা জানলা খুলে হাওয়া খাওয়ার জন্যই বাইরের প্রাণীরা এমন ভাবে ঘরে ঢুকে পড়ছে। তাতে মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল।
ডাকলেন সবাইকে ড্রয়িংরুমে। কীভাবে উচ্ছেদ করা যায় ইঁদুর বাবাজীবনকে তার একটা মাস্টার প্ল্যান বানাতে হবে। এতো যে গাল মন্দ করছিলেন গিন্নি তিনিই প্রথম প্রতিবাদ করে উঠলেন--
“শোনো আর যাই করো মেরো না ইঁদুরটাকে। ও নিশ্চয় এমনি এমনি এই বাড়িতে আসেনি। বাইরে খাবারের টান পড়েছে নিশ্চয়ই। তাই এই বাড়িতে ঢুকেছে। লকডাউন উঠে গেলে দোকানপত্র, বাজারহাট চালু হলে ও দেখবে ঠিক ফিরে যাবে। তোমার বাড়িতে স্বেচ্ছায় কে কবে ঢুকেছে!” শেষ কথাটাই সুগার মনিটরের পিনের মতোই খচ্ করে আঙুলে ঢুকে গেল দুর্যো বাবুর। মনে পড়ল বিদেহীও তাঁকে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। তিনি বিদেহীর বাবাকে ট্র্যাপে ফেলে সর্বস্বান্ত করে প্রায় জোর করে বিয়ে করেছিলেন বিদেহীকে।
“না না জামাইবাবু। এইসব ইঁদুরকে একদম বিশ্বাস নেই। চাইনিজ ইঁদুর হতে পারে। গলায় হয়তো লুকোনো ক্যাম রেকর্ডার আছে। ওই জয় মা পার্টির কারসাজি হতে পারে। আপনার সব প্ল্যান হয়তো এভাবে জোগাড় করছে অর্জুন রায়। শত্রুকে রাখতে নেই। মূলেই নির্মূল করুন ওকে।” শালা বাবু শকুন্তর বুদ্ধিটা একেবারে ইঁদুরের মতোই। সারাক্ষণ ষড়যন্ত্র দেখছে সব কিছুর মধ্যে। তবে কী ধান্দায় যে সে দিদির শ্বশুরবাড়িতে পড়ে আছে সেটা নিয়ে বেশ ধন্দেই থাকেন দুর্যো বাবু।
বড়ো মেয়ে পাঞ্চালী আবার মা অন্ত প্রাণ। সে মাকেই সাপোর্ট করলো—“ঠিক বলেছ মা। অবলা জীব। মারা ঠিক হবে না। আর গুণ্ডাগুলোকে সামলাতে সামলাতে বাবার মুখের যা ভাষা হয়েছে তাতে দেখো ইঁদুর হয়ে ঢুকেছে শেষে ঠিক রোদ্দুর হয়ে বেরোবে।” এই এক স্বভাব বড়ো মেয়ের। খোঁচা দেওয়ার সুযোগ পেলে আর ছাড়ে না। তবে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও দুর্যো বাবুর চামড়া এখন গর্বিত মোটা।
বড়ো জামাই চিরঞ্জীবী অবশ্য শ্বশুরমশায়ের খুব আস্থাভাজন। সমস্ত কর্মে-অপকর্মে যোগ্য উত্তরসূরি। তিনি বাবার ইগো মালিশ করার জন্য এক পায়ে খাড়া—“বাবা, এই ছোট্ট ব্যাপারস্যাপারগুলো আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আপনার এখন অনেক দায়িত্ব। করোনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে একটা ক্ষুরধার প্ল্যান করতে হবে।”
“ওটা নিয়ে তুমি ভেব না। ও ব্যাপারে অ্যাকশান আমি অলরেডি নিয়েছি। কিন্তু ইঁদুরটা কাল আমার সারা রাতের ঘুম নষ্ট করেছে। ওকে আমি ছাড়ব না।” বড়ো জামাইকে থামিয়ে দিলেন দুর্যো বাবু।
“আচ্ছা ওকে একটা পুরিয়া দিলেই তো হয় বাবা। গোপন কুঠি থেকে আনি? খাবে আর ঘুমোবে ঠিক বিরোধী দলের মতো।” ছোট জামাই দুশ সেনের সবার সামনে এই পুরিয়া আর গোপন কুঠি বলাটা দুর্যো বাবুর একদমই পছন্দ হলো না। ড্রাগসের এই গোপন ব্যবসাটা ছোট জামাইই দেখে। অ্যাসপিরেটিং। দুর্যো বাবুর গদিটা পাখির চোখ করেছে। আজকাল বড্ড আগ বাড়িয়ে খেলছে। গোপন ব্যবসাটা নিয়ে মাঝে মাঝেই দুর্যো বাবুর আর্ম টুইস্ট করে। ছোট মেয়ে যাজ্ঞসেনীর সাথে দুশের একদম বনিবনা হয় না। কিন্তু দুশ খুব করিতকর্মা ছেলে। তাই ওকে বেশি ঘাঁটান না উনি। কিন্তু একটা চাপা টেনশন কাজ করে।
“যাই করো। আগে থাকতে বলো। আমাকে আবার পিছনের বাগানে কবর খুঁড়তে হবে। রক্ত গোলাপ গাছ রেডি করতে হবে। কবরের উপর পোঁতার জন্য। বাগানটা তো রক্ত গোলাপে ভরে গেল।” বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক পরিচারক কঙ্কদার কথায় দুর্যো বাবু নিমেষে চোখ নামিয়ে ফেলেন। প্রাণপণ হাতে হাত ঘষতে থাকেন লাল দাগগুলো তোলার জন্য।
“আমার মনে হয় বন্যরা বনে সুন্দর, আর মস্তানরা নেতার কোলে।” এতক্ষণ চুপ চাপ থাকা কর্ণ শ্লেষ আর বিষণ্নতা জড়ানো গলায় বলে ওঠে, “ইঁদুর ধরার কল নিয়ে এসো। ওকে আজ রাতে ধরে কাল সকালে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসব।”
চারদিক থেকে যেভাবে একের পর এক বাণ আছড়ে পড়ছে সেটা দেখে দুর্যো বাবু আর সুতো ছাড়তে চাইলেন না। উনি রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় । কী করবেন সেটা মনে মনে ঠিক করাই ছিল। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মুখোশ শেষ। এবার উনি ঘোষণা করে দিলেন-–“শোনো কাউকে কিছু করতে হবে না। আমি র্যাট কিলার কেক নিয়ে এসেছি। আজ রাতেই ওর খেল খতম। খাবে আর মরবে।”
এর মধ্যেই আবার উলুকের ফোন—“স্যার ভালো খবর আছে।”
“আরে দেরি করছিস কেন? বলে ফেল। ডাক্তারকে ম্যানেজ করা গেছে? করোনায় কো-মর্বিডিটি থিয়োরি খাওয়ানো যাবে তো?”
“সেটাই তো বলছি স্যার। একদম পাক্কা কথা হয়ে গেছে। বেশিটাই কো-মর্বিডিটির কেস দেবে। দু একটা করোনা।”
“গুড গুড।”
“তবে স্যার...”
“আবার তবে কী?”
“স্যার প্রতিটি কো-মর্বিডিটির কেসে কিন্তু কুড়ি করে লাগবে। এক পয়সাও কম নেবে না বলেছে ডাক্তার।”
“শালা হায়নার দল। বলে দিস দুর্যো ব্যানার্জির সাথে যেন পাঁয়তাড়া করতে না আসে। দশ বলেছি। প্রত্যেকটা কো-মর্বিডিটি কেসে ওই দশই দেব। না মানলে আমার বাগানে রক্ত গোলাপের সংখ্যা বাড়বে।”
“কী বলছেন স্যার!” বলে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দেয় উলুক। বিড়বিড় করে দুটো গালি দেয় তার বসের উদ্দেশ্যে।
“শকুন্ত, তোমার এই কো-মর্বিডিটির থিয়োরিটা কিন্তু খাসা বানিয়েছ।” সবার সামনেই শালা বাবুর পিঠ চাপড়ে দেন দুর্যো বাবু।
শকুন্ত মৃদু হেসে উঠে পড়েন। বড়ো জামাই চিরঞ্জীবীর আবার দুর্যো বাবুর এই শালাপ্রীতি মোটেও ভালো লাগে না। ভিতরে ভিতরে গর্জায় কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। শ্বশুরমশায়ের অবর্তমানে সিংহাসনটা তাঁর চাইই। সব ব্যাপারে শকুন্তের পরামর্শটা মেনে চললে তাঁর গুরুত্ব যে কমে যাবে তা বিলক্ষণ জানে চিরঞ্জীবী। অস্থির চিত্তে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে পড়েন তিনি।
চিরঞ্জীবীর অস্বস্তিটা বেশ বুঝতে পারে দুশ সেন। একটা তির্যক হাসি খেলে যায় ওঁর মুখে। এই সিংহাসনটা পেতে আসল খেলাটা সেইই খেলবে, মনে মনে ভাবে দুশ।
এর কিছুক্ষণ পর সেই রহস্যময় কন্ঠস্বর ফোন করে অর্জুন রায়কে—
“অর্জুন বাবু?”
“হ্যাঁ, বলুন।”
“একটা ভালো লিড দিচ্ছি। দেখুন শোরগোল ফেলতে পারেন কি না!”
“আরে লিড-টা কী বলবেন তো!”
“বলছি, বলছি।” রহস্যময় লোকটা একটু দম নেয়। মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। তারপর সিগারেটে একটা সুখ টান দিয়ে চোখটা ছোট করে মুখটা একেবারে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে লাগিয়ে ফিসফিস করে বলে—“হসপিটালটা আজ সন্ধ্যায় কভার করুন। ওখানে করোনা কেলেংকারি পেয়ে যাবেন। অনেক এক্সক্লুসিভ করোনা কেস কো-মর্বিডিটি বলে চালিয়ে দিচ্ছে দুর্যো বাবু ...।”
সান গ্লাসের পিছনেও অর্জুন রায়ের চোখটা চকচক করে ওঠে। বলিষ্ঠ হাতের মুঠি শক্ত হয়ে ওঠে। গাড়িটা ঘুরিয়ে সোজা হাসপাতাল। এবার দুর্যোদাকে বাগে পেয়েছে। কফিনে শেষ পেরেকটা পুততে হবে।
------------------------------*------------------------------
আজ ২৫শে এপ্রিল, ২০২০। দুর্যো বাবুর মেজাজটা একদম তিরিক্ষে হয়ে আছে। গতকালের রাতটা যে এমন ব্যর্থতায় ভরা হবে, সমালোচনায় জর্জরিত হবেন স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি উনি। কী ঘরে কী বাইরে সব জায়গায় উনি পর্যুদস্ত হয়েছেন। কিছুতেই মানতে পারছেন না তাঁর পরাজয়। ঘনঘন সিগারেট খাচ্ছেন আর ড্রয়িং রুমে পায়চারি করছেন। ছোট জামাই দুশ সেন কিছু বলতে এসেছিলেন কিন্তু ওঁর মেজাজ দেখে কিছু বলতে সাহস পেলেন না। সবাই তটস্থ । শুধু ভ্রূক্ষেপ নেই কর্ণের। ব্যালকনিতে বসে আনমনে বেহালায় বাজিয়ে চলেছে কোন এক অজানা সুর। এই সুরগুলো শুনলে আগে কেমন ভয় ভয় করত দুর্যো বাবুর। কিন্তু আজ রাগটা আরও বেড়ে গেল। তবু ছেলেকে কেন জানি কিছু বলতে পারেন না উনি।
সহসা মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। সর্ষের মধ্যেই ভূত না তো। ভাবলেন দুর্যো বাবু। হাঁক পাড়লেন--“শকুন্ত! শকুন্ত!”
“হ্যাঁ, বলুন দাদা।” তড়িঘড়ি এসে ঘরে ঢুকলেন শালা বাবু।
“কালকে রাতে ড্রয়িংরুমের লাগোয়া বাথরুমের দরজা কে খোলা রেখেছিল?”
“সেটা তো ঠিক বলতে পারছি না দাদা। তবে বাচ্চারা কেউ করে থাকবে ভুল করে।”
“বাচ্চারা নয়। বাচ্চারা নয়।” ভয়ংকর রাগতভাবে মাথা ঝাঁকালেন দুর্যো বাবু। “বড়োরাই কেউ করেছে। আমি কাল বারবার বলেছিলাম যে এই র্যাট কিলিং কেক খেলে ইঁদুরটার ভয়ংকর জল তেষ্টা পাবে আর সে জল তেষ্টায় সমস্ত জলের পাত্রের দিকে দৌড়বে। আর একবার জল খেয়ে ফেললে আর সে মারা যাবে না।”
“হ্যাঁ ঠিকই তো। আপনি এই কথাগুলোই বলেছিলেন।”
“আর আজ সকালে উঠে দেখি ইঁদুরটা র্যাট কিলিং কেক খেয়েও বহাল তবিয়তে বাথরুমে রয়েছে। সমস্ত বাথরুম লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ড্রয়িং রুমের বেসিনের ওয়েস্ট পাইপ যার আউট লেট বাথরুমের ভিতর দিয়ে গেছে তাকে কুচি কুচি করে কেটেছে। আর সকালে তাকে বাথরুম থেকে বের তো করাই গেল না উল্টে সে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ড্রেন পাইপের মুখের পুরনো জালিটা ভেঙে পাইপের ভিতর দিয়ে কোথায় যে গেল সেটাই কেউ খুঁজে পেল না। কঙ্কদা পাইপের ভিতর প্রচুর জল ঢালল। তাতেও কিছু হলো না দেখে পুরো এক বোতল অ্যাসিড ঢেলে দিল। তাতে ভাবলাম এবার হয়তো ইঁদু্রটা মরল। কিন্তু একটু আগেই আবার সোফার পিছনে সে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে। ওদিকে ড্রয়িংরুমের বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে ইঁদুরে কাটা ওয়েস্ট পাইপ দিয়ে সমস্ত জল পড়ে সারা ড্রয়িংরুম জলে থইথই। ভাবুন। ভাবুন। কী বেইজ্জত না করছে ঐ ছোট্ট ইঁদুরটা।” দুর্যো বাবু এক নিঃশ্বাসে সমস্ত রাগটা ঝড়ের বেগে বের করলেন।
“সত্যি ইঁদুরটা ভালো খেল দেখাচ্ছে। বাচ্চাগুলোর জন্য এমন নাস্তানাবুদ হতে হলো।” শকুন্ত চুরুটে টান দিতে দিতে তালে তাল মেলালেন।
“আবার ভুল করছ। বাচ্চারা নয়। বাথরুমে আজ আমি চুরুটের ছাই পেয়েছি। এ বাড়িতে তুমি ছাড়া..”
“ইঁদুরটা ছাড়ুন দাদা। ওটাকে আমরা দেখে নেব। আপনি গতকাল সন্ধ্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে কী বলছিলেন?” শকুন্ত তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে দেয় বাড়ির বাইরে।
“হ্যাঁ। সেটা নিয়েও কথা আছে। আমার সমস্ত স্ট্রাটেজির খবর আগাম কী করে অর্জুন রায়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে? সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে।”
“আপনি এতো সিওর কী করে হচ্ছেন যে অর্জুন রায়কে আমাদের ভিতর থেকেই কেউ খবর দিচ্ছে?”
“আমাদের ভিতরে কেউ না দিলে অর্জুন কী করে হঠাৎ হাসপাতালে চলে গেল। আর তারপর করোনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল। মিডিয়ায় হাসপাতালের লাইভ ভিডিও শেয়ার করেছে। আমার বিরুদ্ধে তো পুরো জনবিদ্বেষ তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ওঁদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ভীষ্মদাকে ধরে ওকে চুপ করিয়েছি। আর তারপর আমাদের হাইকমান্ডকে ধরে মদের দোকান খুলে দিয়েছি। আর তাতেই জনক্ষোভ ঘুরে গেছে মদ কেনার লাইনে।”
“এই চালটা কিন্তু আপনি দারুণ দিয়েছেন দাদা।” শকুন্ত জামাইবাবুর মন রাখতে বললেন বটে কথাটা। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে ওঁনার চোখে একটা রহস্যময় হাসি খেলে গেল।
“প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হলো সর্ষের মধ্যে ভূতটা কে?” আবার রাগ উগরে দিলেন দুর্যো বাবু।” “তবে আমি আন্দাজ করতে পারছি। খুব কাছের একজন কিন্তু আগুন নিয়ে খেলছে।”
চমকে উঠলেন শকুন্ত।
এই কথা বলতে বলতেই দুর্যো বাবুর ফোন বেজে উঠল। উলুক ফোন করেছে।
“স্যার এই অর্জুন রায়কে নিয়ে পারা যাচ্ছে না। আবার প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠনকে নিয়ে মদের দোকান খোলার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। অর্জুন রায় কিন্তু ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে স্যার। ওঁর জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করুন।”
“হুমম। ওঁর ব্যবস্থা করছি। সুপারি কিলারকে খবর দে। কালকেই নিকেশ করে দেব।” চাপা গলায় হিসহিস করে বললেন দুর্যো বাবু।
“ঠিক বলেছেন স্যার। আমি আজি খবর দিচ্ছি।”
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু ইঁদুরটাকে নিয়ে কী করি বল তো উলুক।”
“হুমম। স্যার একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে।”
“কী আইডিয়া?” নড়ে চড়ে বসলেন দুর্যো বাবু।
“স্যার, ওই একই ট্রিটমেন্ট এখানেও।”
“মানে!”
“মানে স্যার, সুপারি কিলার এখানেও লাগিয়ে দিচ্ছি!”
“কী বলছিস কী উলুক। তোর মাথা কী খারাপ হলো না কি! উলুক থেকে তো দিন দিন উল্লুক হয়ে যাচ্ছিস।”
“আগে শুনুন না স্যার।” উলুক বিশদে শুরু করে। ততক্ষণে দুর্যো বাবুর কোর কমিটিও হাজির ড্রয়িং রুমে। দুর্যো বাবু স্পীকারটা অন করেন যাতে সবাই শুনতে পায়।
“স্যার, ইঁদুরটা যখন বিষে মরল না তখন সুপারি কিলার হিসাবে একটা শক্তপোক্ত হুলোবিড়াল নিয়ে আসি। রাতের বেলায় এনে আপনাদের ড্রয়িংরুমে ছেড়ে দেব। তারপর দেখবেন নাটক কেমন জমবে। লকডাউনের বাজারে একদম হাতে গরম টম এন্ড জেরি শো। তবে এই টম একেবারে কোণার থেকে জেরিকে বের করে এনে একদম কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নেবে। মিলিয়ে নেবেন স্যার।”
“ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া উলুক।” দুর্যো বাবু লাফিয়ে উঠলেন সোফার থেকে। একটা কিলার ইনসটিংক্ট বিদ্যুতচমকের মতো ঝলসে উঠল মাথার মধ্যে। অনেকগুলো বাদুড় একসাথে রক্ত খেতে চাইছে বুকটা চিরে। “কুরুক্ষেত্রটা তাহলে আমাদের বাড়িতে করলে কেমন হয় শকুন্ত?” প্রশ্নটা করে সজোরে তাকালেন তাঁর শালা বাবুর দিকে।
“দাদা, আমি যা ভাবছিলাম আপনিও তাই বললেন।” একটা ক্রূর হাসি খেলে গেল শকুন্তের মুখে। অনেকদিন পর একটা যুতসই সুযোগ পাওয়া গেছে, ভাবল শকুন্ত, তার নিজস্ব সমীকরণ এই প্রথম শিরায় শিরায় জানান দিচ্ছে তারা তৈরি।
“স্যার, একটু খোলসা করে বলুন মাস্টার প্ল্যানটা।” উলুক বুঝেও না বোঝার ভান করল।
“শোন। তোর দুটো কাজ। এক—হুলো বিড়ালটাকে ঠিক সময়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবি। আর অর্জুন রায়কেও। তার আগে আমি নিজে তাকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানাব। কিন্তু রাজি করানোর কাজটা কিন্তু তোর আর তোর বাবার।” দুর্যো বাবু সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন প্ল্যানটা।
“কিন্তু স্যার, যদিও এখন লকডাউনের জন্য রাতের বেলায় চারিদিক একদম ফাঁকা। কিন্তু কাল থেকে মদের দোকান খুলে দেওয়ায় চারিদিকে লোক জনের হইচই খুব বেড়ে গেছে। এতে গুলি চললে লোকজন বুঝে ফেলবে না তো। তাছাড়া অর্জুন রায় আপনার বাড়িতে ঢোকার সময় মাতালগুলো যদি দেখে ফেলে!” খুঁটিনাটি জেনে নিতে চাইছে উলুক।
“মদ তো বন্ধ করা যাবে না। তাতে ইকনমির যা হাল বেকাররা আবার বিদ্রোহ করবে। তার চেয়ে আর একটা কাজ কর। একটা ঘোষণা করে দে যে শিক্ষক সংগঠনের প্রতিবাদ ও মতামতকে সম্মান করে জনদরদী নেতা দুর্যো ব্যানার্জি আজ থেকে প্রকাশ্যে মদ বিক্রি বা পান বন্ধ করে দিয়েছে। তার বদলে অনলাইনে মদ কেনা যাবে। ডেলিভারি বয়-রা দিনের বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে মদ পৌঁছে দেবে। তাতে রাতের বেলার যুদ্ধটা গোপন রাখা যাবে।” শকুন্ত নিজের দিকে ফোনটা টেনে নিয়ে বলল উলুককে।
দুর্যো বাবু শকুন্তের রাজনীতির চালকে চিরকালই প্রশংসা করেছেন। আজও করলেন। কিন্তু তার মাথায় খেলা করছে অন্য খেলা। টার্গেট তিনি ঠিক করে নিয়েছেন। শত্রু এবং সর্ষের মধ্যে ভূত সবাইকেই তিনি কাল একসাথে নক ডাউন করবেন। লক ডাউনের এমন সুযোগ আর আসবে না। সবাই মাস্ক পরে। দেখে বোঝার উপায় নেই মাস্কের পিছনের মানুষটাকে। কাল গুলি একটা নয় দুটো চলবে।
শকুন্ত উঠে পড়লেন। তার ঘুঁটি সাজানো হয়ে গেছে। কাল অন্ধকারের আড়ালে তার পরিবার, তার দিদিকে অপমান করার প্রতিশোধ নেবেন তিনি। কাল গুলি একটা নয় দুটো চলবে।
ফোনটা কেটেই দ্রুত ভেবে নেয় উলুক। এটাই সুবর্ণ সুযোগ। অনেক দিন ডান হাত হয়েই কাটিয়ে দিয়েছে সে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সমস্ত খুঁটিনাটি তার জানা। মা মাগো পার্টির রাজনৈতিক সংগঠন তার হাত ধরেই চলে। এবার আসল ডন হবে সে। ডন। দুই বড়ো নেতার কাউকেই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। আর যদি দুজন দুজনকে না মারতে পারে তাহলে তার হাতের পিস্তল তো আছেই। তবে আর একজনকেও মেরে ফেলতে হবে এই সুযোগে। যুবরাজ হতে সে জন্মায় নি। বাবাকেও ছাড়বে না সে। তাই কাল একটা নয় তিনটে গুলি চলবে রাতে। কিন্তু অর্জুন রায় না আসতে চাইলেই সমস্ত প্ল্যান বানচাল হয়ে যাবে। আনতেই হবে ওঁকে।
আরিব্বাস! দারুণ প্ল্যান তো। মনে মনে ভাবে দুশ। এ তো সুবর্ণ সুযোগ। রাতের অন্ধকারে সবকটা প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিকেশ করে দেওয়া যায়। লকলক করে ওঠে জিভ। এমন সুযোগ ছাড়বে না দুশ।
পুরো প্ল্যানটা মোটেও ভালো লাগে না চিরঞ্জীবীর। বড্ড রিস্ক নিয়ে ফেলছেন বাবা। কিন্তু এখন আর কারো কথা শুনবেন না তিনি। নাহ্। তৈরি থাকতে হবে। দুই নেতা যদি পরস্পরকে খতম করে ফেলে সেও তখন পিছিয়ে থাকবে না। বাকি সবাইকে খতম সে একাই করে দেবে।
খবরটা অর্জুন রায়ের কাছে পৌঁছতে একটুও সময় লাগে না।
“অর্জুন বাবু, একটা দারুণ খবর আছে। দুর্দান্ত সুযোগ। এমন সুযোগ আর দ্বিতীয় বার আসবে না। এই অঞ্চলের গদি আপনার পাক্কা!”
“আপনার লিড সবসময়ই খুব ভালো হয়। বলে ফেলুন। দেখি আমার জন্য কী সুযোগ অপেক্ষা করছে।” হাসতে হাসতে বলে অর্জুন রায়। ওর এত তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক উত্থান আর ক্ষুরধার রাজনীতির পিছনে এত বড়ো একটা স্পাইয়ের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা আর কেউ না জানুক তিনি নিজে তা জানেন। তাই ওঁকে খুব ভরসা করে অর্জুন। কিন্তু স্পাই স্পাইই হয়। সেটাও মাথায় রাখে অর্জুন।
“এটা একটু রিস্কি কেস। কিন্তু সাহস করে যদি সুযোগ নিতে পারেন তাহলে কাল থেকে আপনিই হবেন শাহেনশা।”
“খুলে বলুন।”
সেই অজানা কন্ঠস্বর খুলে বলে দুর্যো বাবুর প্ল্যান। টম এন্ড জেরির শোয়ের আমন্ত্রণ। অন্ধকারে কীভাবে গুলি করা হবে অর্জুনকে। কোথায় পোঁতা হয় লাশ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর বলে--
“আর একটু পরেই দুর্যো বাবুর ফোন আসবে আপনার কাছে। আপনি একটু কিন্তু কিন্তু করে গ্রহণ করে নেবেন নিমন্ত্রণটা। তারপর প্ল্যান তো আপনার জানা। কালকের ঘটনার কোনও সাক্ষী রাখবেন না বলে দুর্যো বাবু বাড়ির লোকদের ছাড়া কাউকে রাখছেন না বাড়ির ত্রিসীমানায়। এটাই সুযোগ। আপনি যেহেতু প্ল্যানটা আগের থেকেই জানেন তাই অন্ধকারে গুলিটা আপনিই প্রথম চালিয়ে দেবেন। আর রাজার পতন হলে বাকি সবাই আপনার অনুগত হয়ে যাবে। আর আমি তো আছিই আপনার গোপন হাত।”
“হুমম। একটু ভেবে নিই।” বলে ফোনটা কেটে দিল অর্জুন রায়। মাথার কম্পিউটারে আর্ট অব ওয়ারের অ্যালগোরিদিমটা চালু হয়ে গেল। সুযোগটা মন্দ নয়। লকডাউন, মাস্ক, অন্ধকার, বিশ্বাসঘাতক সব মিলিয়ে রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সুবর্ণ সুযোগ। শুধু কয়েকটা প্রোটেকশন নিতে হবে। কৃষ্ণদাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে যিনি গাড়িতেই ওয়েট করবেন। বাড়ির লাইট নেবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে অর্জুন না বেরোলে উনি একে ফর্টি সেভেন-টা নিয়ে ঢুকে যাবেন। একটা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও পরে নিতে হবে। আজকাল ইজরায়েল থেকে খুব পাতলা কিন্তু অত্যন্ত স্ট্রং বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এসেছে। আর গুলি চলবে একটা নয়। তিনটে। বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। বিশ্বাসঘাতকের বাবাকেও নয়। একটু রিস্কি গেম। কিন্তু রিস্ক না নিলে শাহেনশা হওয়া যায় না।
------------------------------*------------------------------
২৬শে এপ্রিল, ২০২০। রাত নটা। সময়টা আর কাটতেই চাইছে না দুর্যো বাবুর। হার্ট বিট-টা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে করতে ভাবছেন, শেষ পর্যন্ত অর্জুন আসবে তো। রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় তিনি। আগে কয়েকবার অর্জুনকে নিজের বাড়িতে ডেকে মিটিং করেছেন। কিন্তু ডিনারে নিমন্ত্রণ, এই প্রথম। এবং নিমন্ত্রণের ভিত্তিটাও বেশ চমকপ্রদ। টম এন্ড জেরি লাইভ শো।
এ যেন প্রাচীন রোমের গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ। হিংস্র বাঘের সামনে ফেলে দেওয়া হলো ক্রীতদাস গ্ল্যাডিয়েটরকে। এ যেন প্রাচীন কালের রাজাদের একসাথে মৃগয়া শিকার। এ যেন অভিমন্যুকে চক্রব্যূহে ঘিরে ধরে সপ্তরথীর হত্যা-উল্লাস। না, শেষেরটা আর বলেননি অর্জুনকে। তার আগের পর্যন্ত বলেছেন। বলেছেন —
“দেখো অর্জুন, এই অঞ্চলের আমি যেমন রাজা। তুমিও রাজা। গ্রাউন্ড লেভেলে যাই হোক না কেন টপ লেভেলে আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। এতো সম্পদ আমাদের মিলে মিশে লুঠতে হবে। আজ আমি পাওয়ারে আছি। কাল হয়তো তুমি থাকবে। কিন্তু পাওয়ারে যেই থাকি না কেন আমরা দুজনে মিলে মিশে লুঠতরাজটা চালালে কোন থার্ড পার্টি ঢুকতে পারবে না। গ্রাউন্ড লেভেলে আকচাআকচিটা আমরা তীব্র করে দেব কিন্তু উপরে অলিখিত চুক্তি। একদম আমেরিকান ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মতো। আর এই শুরুটা আমরা লাইভ টম এন্ড জেরি শো দিয়ে করি।”
অর্জুন চুপ করে শুনেছেন। কিছু বলেননি। দুর্যো বাবু তারপরও বললেন-
“কী কিছু বলো। তাহলে আসছ তো। ডিনার আমাদের এখানেই করবে। ঠিক রাত ৯.৩০ টায় তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
“আপনার প্রস্তাবটা আমারও মনের কথা। তার উপর আপনি এমন একটা লাইভ শো-এর আয়োজন করেছেন যে না গেলে খুব মিস করব। তবু...”
“তবু কী অর্জুন। তবু কী। এতো ভাবছ কেন। আরে বাবা বেইমানির ধান্দায় বিশ্বাসটা সবচেয়ে বেশি দরকার।”
অর্জুন নীরবে হো হো করে হেসে ওঠে। আপনমনে বিড়বিড় করে-–“শালা শয়তানের বাপ্। তোকে আমি ছাড়ব না।”
“কিছু বললে অর্জুন?”
“না, ভাবছি। আপনাকে পরে জানিয়ে দেব।” এই বলে ফোনটা নামিয়ে রাখে অর্জুন।
এরপর গতকাল পুরো দিন গেল। আজও রাত নটা বেজে গেল। কিন্তু অর্জুন ফোন করেনি। যদিও বিশ্বস্ত সূত্রে খবর হলো অর্জুন রায় আজকে আসবে। কিন্তু দুর্যো বাবু নিশ্চিত হতে পারছেন না।
এদিকে আয়োজন সব হয়ে গেছে। ড্রয়িং রুমে ঢোকার জন্য আটটা দরজা আছে। সাতটা লাগোয়া রুম থেকে ড্রয়িং রুমে ঢোকা যায়। আর রয়েছে মূল দরজা। ঠিক হয়েছে প্রত্যেকে এক একটা রুমের দরজার সামনে দাঁড়াবেন পর্দার আড়ালে যাতে ড্রয়িং রুমের বিড়াল-ইঁদুরের দ্বৈরথটায় প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেন মানুষের উপস্থিতি টের না পায়। লেআউট বানিয়ে ফেলেছেন শকুন্ত বাবু। ড্রয়িং রুমে ঢোকার মূল দরজায় থাকবেন দুর্যো বাবু। তাঁর বাঁ পাশের প্রথম দরজায় অর্জুন রায়। বাঁ পাশের দ্বিতীয় দরজায় উলুক। তার বাঁ পাশে ছোট জামাই দুশ। দুর্যো বাবুর ঠিক উল্টো দিকের দরজায় শকুন্ত বাবু। দুর্যো বাবুর ডানদিকে প্রথম দরজায় থাকবে ছেলে কর্ণ। ডানদিকে দ্বিতীয় দরজায় থাকবে বড়ো জামাই চিরঞ্জীবী। আর তাঁর ডান পাশে থাকবে কঙ্কদা। বাড়ির মহিলারা কেউ এই নৃশংস হত্যালীলায় থাকতে রাজি হননি।
প্রথমে লাইট জ্বালা থাকবে। তারপর শুধু নাইট ল্যাম্প। তারপর পুরো অন্ধকার। শুধু চোখ জ্বলবে ক্ষুধার্ত বিড়ালের আর প্রাণভয়ে ভীত ইঁদুরের। পুরো অন্ধকার হয়ে গেলে দর্শকরা সবাই নিঃশব্দে তাদের রুমের দরজা বন্ধ করে ড্রয়িংরুমের ভিতরে ঢুকে আসবে যাতে প্রাণভয়ে ভীত ইঁদুর অন্য ঘরে আশ্রয় নিতে না পারে। একদম করোনাকালে রেড জোনের কনটেইনমেন্ট এলাকা।
আজও সন্ধ্যার পর থেকে ইঁদুর বাবাজির মুভমেন্ট ড্রয়িংরুমে টের পাওয়া গেছে। উলুকও শিকারি বিড়ালকে নিয়ে চলে আসল বলে। কিন্তু তাতেও দুর্যো বাবুর অস্থিরতা যাচ্ছে না। অর্জুন না আসলে এই চমৎকার প্ল্যানটাই বরবাদ হয়ে যাবে।
-------------------------------*-----------------------------
২৬ শে এপ্রিল, ২০২০। রাত সাড়ে দশটা। এই সবে পানপর্ব শেষ হলো। লকডাউনের বাজারে সিঙ্গল মল্টে গলা ভেজাতে পেরে সবার দিল খুশ। সাথে চিকেন হরিয়ালি কাবাব, তন্দুরি ফ্রায়েড ভেটকি উইথ গ্রীন স্যালাড। কঙ্কদার হাতের জাদুতে স্টার্টারগুলো আরও লোভনীয় হয়ে উঠেছিল। সবাই নিমেষে তিন চার পেগ নিয়ে নিল। কর্ণ অবশ্য পরে যোগ দেওয়ায় শুধু স্টার্টারটাই চেখে দেখেছে।
সবারই অল্প বিস্তর নেশা হয়েছে। কিন্তু সবাই ধূর্ত চোখে নজর রেখেছে অন্যদের গ্লাসের উপর। কেউ যেন আন্ডার প্লে না করে। এরমধ্যেও সবার নজর এড়িয়ে অর্জুন রায় দুটো পেগ টেবিলের তলায় চালান করে দিয়েছে। বেশি নেশা হয়ে গেলে নিশানা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। দুর্যো বাবুর অবশ্য এতে কোন হেলদোল নেই। উনি আট পেগেও স্থির অচঞ্চল থাকেন। বরং এসব দিনে তাঁর হাত দুটো তাঁর নিজের চোখে এমন ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত দেখায় যে ওঁনাকে এসব ভুলতে একটু বেশিই মদ্যপান করতে হয়। ওদিকে শকুন্ত বাবুকে এতো পান করার পরও বরফ শীতল লাগে। তিনি লক্ষ্যে অবিচল। কারণ এমন সুযোগ তাঁর জীবনে আবার আসবে কী না সন্দেহ। উলুক, দুশ সেন আর চিরঞ্জীবী একটু বেশিই টেনে ফেলেছে মনে হচ্ছে।
এখন রাত এগারোটা পঁচিশ। মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার আকাশ যেন ভয়ে মুখ ঢাকা দিয়েছে। একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কোনও অজানা আশঙ্কায় তিরতির করে কাঁপছে ল্যাম্পপোস্টের বিবর্ণ হলুদ আলোগুলো। আর বাড়িগুলোর লম্বা লম্বা ছায়া যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে দুর্যো ম্যানসনের দিকে। রাস্তায় কেউ নেই। শুধু অন্ধকার ফুঁড়ে বাড়ির পিছনের গেট থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো একটা ছায়ামূর্তি। চাদরে সম্পূর্ণ ঢাকা তার মাথা। মুখটাও ঢাকা চাদরে। শুধু চোখটা জ্বলছে। ধূর্ত শ্বাপদের মতো তার নিঃশব্দ চলন। ল্যাম্পপোস্টের স্বল্প আলোয় তাঁর হাতে ধরা ভোজালিটা চকচক করে উঠল।
ওদিকে প্রথম দিকে তেমন পাত্তা না দিলেও বাড়ির লাইট সব নিবিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালাতেই হুলোর আচরণে যেন মুহূর্তে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। চোখটা যেন জ্বলে উঠল। শোয়া অবস্থা থেকে লাফিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। টানটান করে নিলো পুরো শরীর। লেজটা গোটানো অবস্থা থেকে স্প্রিং এর মতো খুলে একেবারে খাড়া ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। ধারালো নখগুলোকে এখন দেখা যাচ্ছে লাল মাংসল থাবা থেকে বেরিয়ে আসছে। তারপর ওর গলা দিয়ে একটা গরগর আওয়াজ বেরতে লাগল। যেন সে এবার তার শিকারের গন্ধ পেয়েছে। সোফার তলায় একটা স্পষ্ট ছটফটানির আওয়াজ। ভীত সন্ত্রস্ত একটা কীঁচ কীঁচ শব্দ। হুলোটা এক পা এক পা করে এগোচ্ছে আর মাঝে মাঝে নাকটা নামিয়ে মেঝে থেকে গন্ধ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ইঁদুরটার অবস্থান।
সপ্তরথী সবাই উত্তেজনায় ফুটছে। কী হয় কী হয়। দুর্যো বাবু পকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরলেন পিস্তলটা, অর্জুন রায় অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষায় কখন নেবানো হবে সম্পূর্ণ লাইট। সময় ঠিক করা আছে রাত সাড়ে এগারোটা। উলুক দু-পকেটে হাত ঢোকাল। দুটো পিস্তল এনেছে ও। শকুন্ত বাবু পজিশন নিলেন। পকেট থেকে নীরবে পিস্তল বার করে দাঁড়াল দুশ ও চিরঞ্জীবী। উলুক ফিসফিস করে বলল -–“রেডি সবাই? লাইট নিভাচ্ছি।”
মুহূর্তে সারা বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। সবাই সতর্ক পায়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলেন ড্রয়িং রুমের মধ্যে। হুলোর চোখ তীব্র ভাবে জ্বলে উঠল। ভয়ঙ্কর একটা আওয়াজ করে হুলো লাফাল ইঁদুরের দিকে। একটা অসম হুটোপাটি। একটা প্রাণীর মর্মান্তিক মৃত্যুর আর্তনাদের সাথে ঘরটা নিমেষে ভরে গেল গুলির আওয়াজ আর মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণায়। একটা রক্তের স্রোত বয়ে গেল মেঝের উপর দিয়ে।
------------------------------*------------------------------
“উফফ। এই এক কাজ হয়েছে আমার। সকাল সকাল কবর খোঁড়া। সাতটা কবর। সময় লাগবে। উলুক আর তার বাবা শকুন্তকে পাশাপাশি কবর দিতে হবে। তবে অনেক দিন পর ভালো লাগছে, রক্ত গোলাপের বদলে সাদা বেল ফুল গাছ লাগাতে হবে। নতুন রাজার নির্দেশ। তাঁর নির্দেশেই কাল বাড়ির বাইরে দাঁড় করানো গাড়ির ড্রাইভার কৃষ্ণদাকেও মারতে হলো। ভোজালিটা চালানোর সময় মনে কষ্ট হলো। কিন্তু কৃষ্ণদা কেন কী জানি, মরে যাওয়ার সময় হাসছিলেন। মৃত্যুযন্ত্রণা চেপে রেখে বলছিলেন—“নতুন রাজার আসার সময় হলো। নতুন পৃথিবীরও।” মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বিড়বিড় করছিল কঙ্কদা।
উলুকের বডিটা কবরের গর্তে নামানোর সময় মোবাইলটা ওর প্যান্টের পকেট থেকে ঠক করে মাঠিতে পড়ে গেল। এখনো তাকে পাঠানো অর্জুন রায়ের মেসেজটা খোলা অবস্থায়ই পড়ে আছে--“উলুক, আপনার দেওয়া প্রত্যেকটা ইনফরমেশনই আমার রাজনৈতিক জীবনের এমন উত্থানের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আজও এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি। নতুন রাজা হওয়ার। আর তাতেও আপনার দেওয়া প্রত্যেকটা তথ্যের অপরিসীম গুরুত্ব। আমি আসছি ঠিক রাত সাড়ে নটায়। আপনি থাকবেন। আজ অপারেশন শেষ হওয়ার পর আপনাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করব আমি।...” মেসেজটা দেখে কঙ্কদা একদলা থুথু ছেটাল উলুকের গায়ে। তারপর মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল গর্তের মধ্যে। সূর্য উঠতে আর বেশি দেরি নেই। তাড়াতাড়ি হাত চালাল কঙ্কদা।
------------------------------*------------------------------
সূর্যের প্রথম আলো গঙ্গার জলে পড়তেই কেমন অদ্ভুত মায়াময় হয়ে উঠল চারিদিক। এতো স্নিগ্ধ বাতাস যেন অনেকদিন পর বয়ে যাচ্ছে গঙ্গার বুক দিয়ে। আকাশটা ঘুমন্ত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে আছে। দিগন্তরেখায় পৃথিবীর স্নেহচুম্বন পেয়েই শিশুর মতো খিল খিল করে উঠল সূর্য। উচ্ছ্বাসে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে গঙ্গার স্রোত পা জড়িয়ে ধরল এক নতুন মানুষের। তিনি ততক্ষণে নেমে এসেছেন কোমর জলে। অপেক্ষা করছেন সেই অনির্বচণীয় দৃশ্যের। তিরিশ বছর পর আবার যা ফিরে এসেছে গঙ্গায় নতুন সময়ের বার্তা নিয়ে, নতুন সকালের বার্তা নিয়ে। নতুন পৃথিবীর বার্তা নিয়ে। আবার নতুন করে লিখতে হবে জীবনের, সমাজের সব সমীকরণ। ওই তো। ওই তো। ডুব দিয়েই ভেসে উঠল। আবার ডুব দিল। আবার ভাসল। একটা, দুটো, তিনটে....অনেক অনেক...শয়ে শয়ে...। ডলফিনরা ফিরে এসেছে। হাত জোড় করে প্রণাম করলেন তাঁদের। ভাসিয়ে দিলেন অস্ত্র গঙ্গার জলে। প্রয়োজন ফুরিয়েছে এদের। আর দরকার নেই। তারপর আস্তে আস্তে ঘুরলেন ঘাটের দিকে।
গঙ্গার ঘাটে তখন একপাশে দাঁড়িয়ে কঙ্কদা। সাথে পাঁচটা সাইকেল টিকিট ঘরটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো। সাইকেল করেই সবাই এসেছেন। সাইকেল করেই সবাই ফিরবেন।
নতুন রাজাকে বরণ করবে বলে ঘাটে তখন দাঁড়িয়ে বিদেহী, পাঞ্চালী ও যাজ্ঞসেনী বরণডালা হাতে। কাল রাতে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব হতো না সময়কে পাল্টে দেওয়ার। পিছন থেকে তাঁদের নিখুঁত নিশানায় একে একে লুটিয়ে পড়েছিল তাঁদের স্বামীরা। আর বাকিদের নড়ার সুযোগ দেয়নি তাঁর গর্জে ওঠা পিস্তল। নিখুঁত নিশানায় বুলেটগুলো খুঁজে নিয়েছিল ওঁদের মস্তিস্ক।
সূর্য প্রণাম করে ঘাটে উঠলেন তিনি, সূর্যপুত্র।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)