পরবাস ৭৮-এ প্রকাশিত দেবদত্ত জোয়ারদারের প্রবন্ধ ‘বাংলা শব্দের পক্ষে ও বিকল্পে’ পাঠককে ঋদ্ধ করবে। তিনি তৎসম শব্দের হ্রস্ব-ই ও দীর্ঘ ঈ-কারান্ত বিকল্প বানানের তালিকা থেকে দীর্ঘ ঈ-কারান্ত বানানসমূহের সামূহিক নির্বাসনের বিষয়ে সহমত হতে পারেন নি এবং যুক্তিসহকারে তার কারণ জানিয়েছেন। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মকানুন উল্লেখ করে তিনি বেশ কয়েকটি তৎসম শব্দের বিকল্প বানানবিধির উৎস বিষয়ে আমাদের অবহিত করেছেন, এবং কালিদাসের রচনাছত্রের উদ্ধৃতিতে তা মনোজ্ঞ হয়েছে। বয়সের হিসাবে আমি পুরানো প্রজন্মের প্রতিনিধি। স্কুলের সিলেবাসে চার বছর সংস্কৃত পড়েছি, এবং তা আমার বাংলাভাষায় রচনার ভিত্তিকে অবশ্যই অনেকখানি দৃঢ় করেছে। তবু সেটা সমুদ্র-সৈকতে নুড়ি কুড়ানোর সামিল। সুবিপুল সংস্কৃত সাহিত্যের কিছুই অধিগত হয় নি, ব্যাকরণও তদৃশ। পরবর্তী প্রজন্মে, এবং তারও পরবর্তী সাম্প্রতিক পর্যায়ে, সেই ধারা তো ক্রমশ ক্ষীয়মান। এই পরিপ্রেক্ষিতে একই শব্দের নানা বানানে সাধারণ পাঠকের মনে বিভ্রান্তি ঘটা স্বাভাবিক। এটা যে একান্ত সাম্প্রতিক সমস্যা তা নয়, এই বিভ্রান্তি নিরসনের প্রচেষ্টা ১৯৩৫ সাল থেকেই শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কার সমিতির উদ্যোগে।
আমরা অবগত আছি এই উদ্যোগ ‘কেক ওয়াকিং’ হয় নি। নানা তরফ থেকে সমর্থন, সমালোচনা এবং আপত্তি এসেছে। সেটাই স্বাভাবিক। এর নৈষ্ঠিক বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে নেপাল মজুমদার সম্পাদিত ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত ‘বানান বিতর্ক’ পুস্তকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াসে সহযোগী হয়েছেন অনেক প্রথিতযশা লেখক এবং প্রকাশনা ও সংবাদ প্রতিষ্ঠান। তারই সুবাদে তৎসম শব্দে রেফের তলায় দ্বিত্ব বর্জন, তদ্ভব শব্দে হ্রস্ব ধ্বনির ব্যবহার, বিদেশি শব্দে ণত্ব-ষত্ব বিধি পরিহার প্রায় সর্বজনসম্মত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে সেইসব তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে যেখানে বিকল্প বানানের নির্দেশ আছে।
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গৃহীত বাংলা বানানের নিয়মাবলিতে তদ্ভব শব্দের বিকল্প বানান বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র সন্ধিতে ঙ স্থানে অনুস্বার প্রয়োগের ক্ষেত্রে। বলা হয়েছে, “যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম স্থানে অনুস্বার অথবা বিকল্পে ঙ বিধেয় – যথা, অহংকার, ভয়ংকর, শুভংকর, সংখ্যা, সংগম, হৃদয়ংগম, সংঘটন অথবা অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর ইত্যাদি।’’ এ বিষয়ে আরো স্পষ্টীকরণ করা হয়েছে, “সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে বর্গীয় বর্ণ পরে থাকিলে পদের অন্তস্থিত ম স্থানে অনুস্বার বা পরবর্তী বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয়, যথা – সংজাত, স্বয়ংভূ, অথবা সঞ্জাত, স্বয়ম্ভূ। বাংলায় সর্বত্র এই নিয়ম অনুসারে অনুস্বার দিলে উচ্চারণে বাধিতে পারে, কিন্তু ক-বর্গের পূর্বে অনুস্বার ব্যবহার করিলে বাধিবে না, বরং বানান সহজ হইবে।’’ নির্দেশিত এই সব বানান ব্যবহারে আমরা স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছি, যদিও আমাদের প্রতিবেশী হিন্দিতে ‘সংজাত, স্বয়ংভূ’ চালু।
১৯৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ‘বাংলা বানান নিয়ম সমিতি’ প্রকাশিত প্রস্তাবে অনুস্বারের প্রয়োগ বিষয়ে দীর্ঘতর একটি তালিকা সংযুক্ত হয়েছে। যেটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হল এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “সংস্কৃত শব্দে দীর্ঘস্বরের বিকল্পে হ্রস্বস্বর থাকলে হ্রস্বস্বর ব্যবহার বাঞ্ছনীয়।” উদাহরণ হিসাবে সেই তালিকায় রয়েছে অবনি অবন্তি আবলি কাকলি কুটির তরণি তরি দম্পতি ধমনি নালি নাড়ি নিরস পল্লি পাটি (পাটিগণিত) বল্লরি বেণি যুবতি রজনি শচি শেফালি সরণি সূরি স্বাতি ইত্যাদি। বানান সমিতির প্রস্তাব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের মতামত সংগ্রহ করে এক বিধিবদ্ধ ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রকাশের উদ্দেশ্যে। এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ হতে পারে নি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আর এক অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাসের অনুচিত আপত্তির ভিত্তিতে।
সংস্কারের উদ্যোগ অবশ্য থেমে থাকেনি। ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে কয়েকজন সাহিত্যিক অধ্যাপক ভাষাতত্ত্ববিদ প্রবন্ধ বা বই লিখেছেন, কিন্তু বহুমান্যতা পেতে গেলে সংস্কার-প্রস্তাবের যে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি থাকা প্রয়োজন সেটা তাঁদের ছিল না। বিষয়টি গুরুত্ব পেল ১৯৯২ সালে ঢাকা বাংলা একাডেমি থেকে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হবার পরে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গৃহীত বানানবিধি প্রকাশিত হল ১৯৯৭ সালে।
এই দুই বুধসমিতির প্রস্তাবিত নিয়মকানুন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। বহুক্ষেত্রেই সেগুলো সদৃশ। বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষিতে যেটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেটা হল তৎসম শব্দের বিকল্প বানান বিষয়ে নির্দেশনা। দুটিতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বানান নিয়ম সমিতি’র ১৯৭৯ সালের প্রস্তাব অনুসৃত হয়েছে। ঢাকা বাংলা একাডেমির নির্দেশঃ “যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয় শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তার কার-চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। যেমন—কিংবদন্তি খঞ্জনি চিৎকার চুল্লি তরণি ধমনি ধরণি নাড়ি পঞ্জি পদবি পল্লি ভঙ্গি মঞ্জরি মসি যুবতি রচনাবলি লহরি শ্রেণি সরণি সূচিপত্র ঊর্ণা ঊষা (নিয়ম ১.২)”। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সুপারিশঃ “তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে যেখানে হ্রস্ব ই উ/ই-কার উ-কার এবং দীর্ঘ ঈ ঊ/ ঈ-কার ঊ-কার দুটি রূপই প্রচলিত ও গৃহীত, সেখানে হ্রস্ব বিকল্পটিকেই আমরা গ্রহণ করেছি। অঙ্গুরি–অঙ্গুরী, অন্তরিক্ষ-অন্তরীক্ষ, কুটির-কুটীর বা উর্ণনাভ–ঊর্ণনাভ, ভ্রু-ভ্রূ ইত্যাদি উদাহরণযুগ্মকের প্রথম বিকল্পটি বাংলায় একমাত্ররূপে গৃহীত হোক এই আমাদের প্রস্তাব। এইরকম একটি তালিকা নীচে দেওয়া হচ্ছেঃ অঙ্গুরি অঙ্গুলি অবনি আবলি আবির উষসী উষা ঔষধি কটি কাশি (নগরী) কুশারি কুশি কেলি কোটি ক্ষৌণি গাগরি চিৎকার চুল্লি তরণি ত্রুটি দরি দীপাবলি দ্রোণি ধমনি ধরণি ধূলি নাড়ি নেমি পঞ্জি পদবি পরিপাটি পর্কটি পল্লি পাটি পুত্তলি পুরন্ধ্রি পেশি প্রসূতি বদরি বলি বাজি বারি (হাতি বাঁধবার জায়গা) বেদি বেলি ভৃঙ্গি ভেরি মহি যুবতি শরণি সরণি সুরভি (নিয়ম ১.১০)।’’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘আকাদেমি বানান অভিধানে’ এই তালিকায় ২৬৫ টি শব্দযুগ্ম সন্নিবেশিত হয়েছে।
এই তালিকাভুক্ত অধিকাংশ শব্দের হ্রস্ব বিকল্পরূপই এখন প্রচলিত সংবাদপত্রে এবং সাহিত্যে, এবং সেগুলো দেখতে দেখতে আমাদের চোখও অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আমাদের অর্থে আমাদের প্রজন্মের মানুষদের, যারা তরী তরণী অবনী ধরণী যুবতী রজনী রচনাবলী দেখে বড়ো হয়েছি। তবু, লেখায় তরি বা রচনাবলি দেখলে ‘সোনার তরী’ কিংবা ‘রবীন্দ্র রচনাবলীর’ প্রচ্ছদ আমাদের মানসপটে উদিত হয়ে অস্বস্তি ঘটায়। শ্রী জোয়ারদার যেমনটি লিখেছেন, ‘যুবতি’ দেখলেই অনেকে ‘ভুল ভুল’ বলে উঠছে। ‘বৌ’-এর জায়গায় ‘বউ’ বানান প্রস্তাবে সুনীতিকুমারও মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ কেমন বৌ? মাথায় ঘোমটা নেই!’ তবু আমাদের মেনে নিতে হবে বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য একটিমাত্র বানান প্রচলনের প্রয়োজন রয়েছে। নতুন প্রজন্ম এই বানান শিখবে এবং পাঠে ও ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তারা জানবে পূর্ববর্তীদের রচনায় দীর্ঘস্বর প্রয়োগ কিছু ভুল ছিল না, এখন কেউ লিখলেও সেটাকে ভুল বলা চলবে না, তবু বানানের সরলীকরণ আর সমতাবিধানের প্রয়োজনে তাদের হ্রস্বস্বর ব্যবহার করতে হবে। আর মেয়েদের নামের ক্ষেত্রে কী হবে, যেটা শ্রী জোয়ারদার ‘অবন্তি/অবন্তী’ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন? স্বাতি বল্লরি রত্নাবলি শেফালি পছন্দ না হলে স্বাতী বল্লরী রত্নাবলী শেফালী ব্যবহারে বাধা কোথায়? নাম ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ‘আশীষ’-এর মতো অশুদ্ধ বানান এবং অনেক অর্থহীন শব্দ আজকাল নাম হিসাবে যদি চলতে পারে তাহলে ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ এইসব বিকল্প শব্দগুলো কেন চলবে না! এই নামের সূত্র ধরেই স্থাননাম হিসাবে ‘কাশী’র বদলে ‘কাশি’ বানানের প্রস্তাব বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক স্থান বা ব্যক্তিনামের ক্ষেত্রে যেখানে বিকল্পবিধান আছে, সেখানে অধিকতর প্রচলিত রূপটিকে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত নয় কি? এই যুক্তিতেই আকাদেমি প্রস্তাবিত কৌশল্যা (কৌসল্যা নয়), কৌশিক (কৌষিক নয়), অম্বরীশ (অম্বরীষ নয়, যদিও ষত্ব-বিধান অনুসারে এটাই ঠিক) সমর্থনযোগ্য, কিন্তু ‘কাশী’ র জায়গায় ‘কাশি’ নয়, ‘সূর্পণখা’ ‘কংসের’ জায়গায় ‘শূর্পণখা’ ‘কংশ’ নয়।
এই একই যুক্তিতে আরো প্রশ্ন উঠতে পারে কোষ-এর বদলে কোশ, কলস-এর বদলে কলশ, মুষল-এর বদলে মুশল গ্রহণ করার প্রস্তাবে। যেহেতু শ ষ স তিনটিই স্বমহিমায় বাংলাভাষায় অধিষ্ঠিত, সেখানে মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের বহুপ্রচলিত রূপকে অগ্রাহ্য করে শ-কে প্রাধান্য দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে? এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, যেমনটি ঘটেছে ‘সরণি’র ক্ষেত্রে – আকাদেমি প্রস্তাবিত ‘শরণি’ মান্যতা পায় নি। অতৎসম শব্দ ‘কাহিনী’তে ‘প্রচলনগত কারণে’ আকাদেমি ঈ-কার মেনে নিয়েছেন (নিয়ম ৭.১১); ‘কোষ’ ‘সরণি’ র ক্ষেত্রে ব্যত্যয় কেন?
শব্দান্তে ও-কার
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভিন্নতা বোঝাবার জন্য অতিরিক্ত ও-কার যথাসম্ভব বর্জনীয় এই মত পোষণ করে বিকল্পবিধান দিয়েছিলেন কাল/কালো, ভাল/ভালো, মত/মতো-র ক্ষেত্রে। এই নির্দেশ বিভ্রান্তিকর। সমস্যাটা উচ্চারণের দিক থেকে। কালসাপ কালরাত্রি একাল সেকাল আগামীকালে ‘কাল’ উচ্চারিত হয় হসন্ত সহযোগে ‘কাল্’ হিসাবে, এবং এইসব শব্দে সেটি কোনমতেই কৃষ্ণবর্ণ বোঝায় না। তেমনই ‘ভাল’ যখন কপাল তার উচ্চারণ ‘ভাল্’, মন্দের বিপরীত বোঝাতে ‘ভালো’ উচ্চারণই করতে হবে। মত (উচ্চারণ, মত্) আর ‘মতো’ (উচ্চারণ, মোতো) উচ্চারণবৈষম্যে আলাদা অর্থ প্রকাশ করে। অর্থবিভ্রাট এড়াতে প্রয়োজন দুটি আলাদা বানানের। তাই আকাদেমির সুপারিশ ‘কালো ভালো মতো’ বানান লেখার, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘খাটো ছোটো বড়ো’ এবং সংখ্যাবাচক এগারো বারো থেকে আঠারো পর্যন্ত শব্দগুলি (নিয়ম ৯)। রবীন্দ্ররচনায় আমরা এই বানানগুলি পেয়েছি এবং এখন সাধারণভাবে এগুলিই প্রচলিত।
সমস্যা রয়েছে ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ক্রিয়াপদের অতীতকালের সাধু রূপ উঠিল/ উঠিতেছিল/উঠিত, করিল/করিতেছিল/করিত, বলিল/বলিতেছিল/বলিত চলিত বাংলায় শব্দান্তে ও-কারান্ত উচ্চারিত হলেও সেগুলোর লিখিত রূপ উঠল/উঠছিল/উঠত, করল/করছিল/করত, বলল/বলছিল/বলত এখন প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য। ব্যতিক্রম শুধু বাংলা হ-ধাতুর ক্ষেত্রে। একই শব্দের পাঁচ রকম বানানের – হল হ’ল হলো হোলো হোল এবং হত হ’ত হতো হোতো হোত – যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের চোখে পড়ছে। অন্যান্য ধাতুদের সঙ্গে সংগতি রেখে পশ্চি্মবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানান প্রস্তাবঃ হল (<হইল) হত (<হইত) (নিয়ম ৯.৫১)। এই বানান প্রস্তাবে বিভ্রান্তির অবকাশ আছে। ভাল কাল মত –র মতোই ‘হল’র উচ্চারণ দু রকম — হল্ এবং হোলো। প্রথম উচ্চারণে বোঝায় ‘লাঙল’, দ্বিতীয় উচ্চারণে ‘হইল’। সেইমতো ‘হত’ অ-কারান্ত উচ্চারণে বোঝায় ‘নিহত’, আর ও-কারান্ত উচ্চারণে ‘হইত’। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বাংলা একাডেমি অনুমোদিত ‘হলো’ এবং ‘হতো’ বানান যুক্তিসংগত। প্রচলিত উচ্চারণকে মান্যতা দিয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি অনুজ্ঞায় ‘হোন’ এবং ‘হোক’ বানান অনুমোদন করেছেন (ঢাকা বাংলা একাডেমিও তাই), তখন ‘হলো’ এবং ‘হতো’র অনুমোদন পেতে বাধা কোথায়?
হয়, Zানতি পার না
তারিণী কবিরাজের উচ্চারণকে যথাযথভাবে প্রকাশ করার জন্য ‘চিকিৎসা সংকটে’ পরশুরামকে Zানতি লিখতে হয়েছিল। উক্তিটি প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেলেও ইংরেজি Z- এর উচ্চারণ বাংলা শব্দে প্রকাশের সমস্যা রয়ে গেছে, কারণ Z উচ্চারণ সমন্বিত কোন শব্দ ঐতিহ্যগতভাবে বাংলায় নেই। তাই Z উচ্চারণের জন্য কোন বর্ণের উদ্ভব হয় নি। তবে Z উচ্চারণ বিশিষ্ট বেশ কিছু শব্দ বাংলায় এসেছে আরবি ফারসি থেকে, যেমন বাজার নজর নাজির উজির হাজির জুলুম ইত্যাদি। এগুলোকে বাঙালি নিজের মতো করে উচ্চারণ করেছে এবং লিখেছে জ ব্যবহার করে। ইংরেজি থেকে আগত জেব্রা জু রেজার এনজাইমের ক্ষেত্রেও তাই। আরবি নাম হZরত, নZর-উল-ইসলাম, আনিস-উ Z- Zামান বাংলা উচ্চারণে ও লেখায় সাবলীলভাবে হজরত, নজরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান হয়ে গেছে। উর্দু ‘গZল্’ আমরা স্বচ্ছন্দে ‘গজল’ করে নিয়েছি। সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান জমানায় ইসলামি নাম ও ধর্ম-সংক্রান্ত শব্দগুলোর বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণ বজায় রাখার প্রয়াসে এইসব শব্দে জ-য়ের জায়গায় ‘য’ ব্যবহারের প্রবণতার ফলে।
ঢাকা বাংলা একাডেমি এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেনঃ “ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে ‘যে’ ‘যাল’ ‘যোয়াদ’ ‘যোই’ রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি Z- এর মতো, সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলির জন্য য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত। যেমন, আযান এযিন অযু কাযা নামায মুয়াযযিন যোহর রমযান।” অর্থাৎ এক বিকল্প বানানবিধি। কিন্তু য-এর উপর Z - এর উচ্চারণ আরোপ বাংলা তথা উত্তর ভারতীয় ভাষায় য-এর ঐতিহ্যগত উচ্চারণের পরিপন্থী। বাংলায় য উচ্চারিত হয়ে এসেছে জ-এর মতো— যখন যদি যাত্রা যজ্ঞ যুধিষ্ঠির ইত্যাদি। সংস্কৃত এবং উত্তর ভারতীয় ভাষায় য-এর উচ্চারণ ‘ইয়’ – ইয়াত্রা ইয়গ্ন য়ুধিষ্ঠির ইত্যাদি। অর্থাৎ কোন ক্ষেত্রেই ইংরেজি Z- এর উচ্চারণ নয়। য-এর উপর এই আরোপিত উচ্চারণ অন্যান্য বাংলা শব্দের ক্ষেত্রে অনুসৃত হলে (যদিও তার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত) উপরে লিখিত বাংলা শব্দগুলির উচ্চারণ হয়ে দাঁড়াবে Zখন Zদি Zাত্রা। Z- এর উচ্চারণ নির্দেশ করতে আনন্দবাজার পত্রিকা সম্প্রতি জ-এর তলায় ফুটকি দিয়ে এক নতুন হরফের প্রবর্তন করেছেন। বাংলা বর্ণমালায় এই সংযোজন কিছু বিদেশি শব্দের যথাযথ উচ্চারণে সহায়ক হবে অবশ্যই, তবু প্রশ্ন থেকেই যায় অন্যান্য সব বিদেশি শব্দের যথাযথ উচ্চারণ বাঙালি করে কি? আর আনন্দবাজারে নব উদ্ভাবনের উৎসাহে পজিটিভ প্লাজমা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও যে জ-এর নীচে ফুটকি দেওয়া হচ্ছে সেটার যৌক্তিকতার বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
নতুন স্বরচিহ্নের সন্ধানে
বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের ভাণ্ডার বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় স্বরবর্ণ যেখানে পাঁচটি, বাংলায় সেখানে এগারোটি। তবু একটি স্বরবর্ণ এবং স্বরচিহ্নের অভাব রয়ে গেছে – সেটি হল ‘অ্যা’ ধ্বনি প্রকাশের জন্য বর্ণ এবং চিহ্ন। অথচ ‘অ্যা’ উচ্চারণ বিশিষ্ট মেলা শব্দ রয়েছে বাংলা ভাষায়। বিস্তর বা অনেক, বিছিয়ে দেওয়া (কাপড় মেলা) অথবা জনসমাবেশ অর্থে ‘মেলা’ উচ্চারিত হয় ‘ম্যালা’ হিসাবে। চোখ মেলার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু ‘আমি চোখ মেললুম আকাশে’ – এখানে ‘ম্যাললুম’ উচ্চারণ করি না (যদিও আঞ্চলিকভাবে তেমনটা ঘটে থাকে)। তেমনই রয়েছে খেলা বেলা কেমন খেমটা যেমন তেমন (কিন্তু ‘তেম্নি’র বেলায় নয়) দেখা (কিন্তু ‘দেখতে’র বেলায় নয়), হেলাফেলা ইত্যাদি। এইসব শব্দে শুরুতে এ-কার উচ্চারিত হচ্ছে ‘অ্যা’ হিসাবে। ‘এ’ দিয়ে শুরু কয়েকটি শব্দের ‘অ্যা’ও একই বিভ্রাট। এক একা একলা একাকী একান্ত এত এখন এখনই এমন এমনই এগারো একষট্টি – এগুলোর ক্ষেত্রে এ-র উচ্চারণ ‘অ্যা’, কিন্তু একটি একটু একক একদা একনিষ্ঠ একনায়ক একুশ একবিংশতি একপঞ্চাশত এখানে এখুনি এম্নি – এইসব ক্ষেত্রে নয়। একই স্বরচিহ্নের (এ-কার) এই উচ্চারণবৈষম্য নিরসনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘অ্যা’ উচ্চারণ বোঝাতে এ-কারের মাত্রাটি বাঁ দিকে বিস্তৃত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটি গীতবিতানে অনুসৃত হয়েছে যাতে গান করার সময় শব্দের যথাযথ উচ্চারণ বজায় থাকে। ‘আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে/ তখন কে তুমি তা কে জানত’ – খেলা এবং কে এই দুটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি ভিন্ন স্বরচিহ্ন (চিত্র দ্রষ্টব্য)। তবে এই পার্থক্য এত সূক্ষ্ম যে তা অদীক্ষিত পাঠকের নজর এড়িয়ে যায়। তাই স্বাভাবিক কারণেই এর ব্যবহার বিস্তৃত হতে পারে নি। ‘অ্যা’ উচ্চারণ বোঝাতে য-ফলায় আ-কার দিয়ে লিখেছেন কেউ কেউ (যেমন, জগন্নাথ চক্রবর্তী)—খ্যালা দ্যাখা অ্যাকা অ্যাকলা অ্যাত ক্যামন য্যামন ইত্যাদি। এটিও সাধারণ্যে গৃহীত হয় নি। তবে ‘অ্যা’ ধ্বনি দিয়ে শুরু বিদেশি শব্দের বাংলা লিপ্যন্তরে এখন ‘অ্যা’র ব্যবহার সর্বজনগ্রাহ্য। যেমন, অ্যাকাউন্ট অ্যাডভোকেট অ্যালকোহল অ্যালুমিনিয়াম (এ-তে য-ফলা দিয়ে নয়) ইত্যাদি। তেমনই, ক্যাবলা খ্যাংরা জ্যাঠা ন্যাকড়া ফ্যান(ভাতের) ব্যাং শ্যাওলা এইসব এবং আরও অনেক শব্দের ক্ষেত্রেও এ-কার নয়।
সদ্যঃপ্রয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ভাষাচিন্তক আনিসুজ্জামান বানান-সংক্রান্ত একটি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “উচ্চারণ আর বানানের যোগ অনেক ভাষাতেই থাকে না। বার্নার্ড শ’র সেই বিখ্যাত উদাহরণের কথা অনেকেরই জানা আছেঃ GHOTI র উচ্চারণ FISH হবে না কেন, তার যোগ্য জবাব নেই।” অনেক বাংলা শব্দের উচ্চারণে তার পরিচয় মিলবে – যেমন, অতি (ওতি) অরুণ (ওরুণ) গতি (গোতি) কল্যাণ (কোল্যাণ) মঙ্গল (মোঙ্গল) ইত্যাদি। সুতরাং অনুশীলনগত কারণেই ‘খেলা দেখা’ আর ‘খেলতে যাওয়া’য় উচ্চারণবিভ্রাট ঘটার সম্ভাবনা কম। তবু ‘অ্যা’ উচ্চারণ নির্দিষ্ট করার জন্য পলাশ বরন পালের প্রস্তাব প্রণিধানযোগ্য। তাঁর প্রস্তাব,‘অ্যা’ উচ্চারণ বোঝাতে এ অথবা এ-কারের পেট কাটতে হবে, যেমনটা রয়েছে পাউন্ড স্টার্লিং অথবা ভারতীয় রুপিয়ার প্রতীক চিহ্নে (চিত্র দ্রষ্টব্য)।
গ্রন্থ সহায়তাঃ
১। বানান বিতর্ক – নেপাল মজুমদার সম্পাদিত (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা), তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৭
২। আকাদেমি বানান অভিধান – পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ, ২০০৫
৩। বাংলা বানানের নিয়ম – মাহবুবুল হক (সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা), ১৯৯১
৪। বাংলা লেখার নিয়মকানুন – হায়াৎ মামুদ (প্রতীক, ঢাকা), তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৩
৫। আ মরি বাংলা ভাষা – পলাশ বরন পাল (অনুষ্টুপ, কলকাতা), ২০১১
৬। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম – বাংলা একাদেমি, ঢাকা, পরিমার্জিত সংস্করণ, ২০১৫
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)
অলংকরণঃ অনন্যা দাশ