Subscribe to Magazines





পরবাসে
পৃথা কুণ্ডুর

লেখা


ISSN 1563-8685




স্বর্গ হইতে

দেবরাজ শচীকান্ত নাসিকায় দিব্যগন্ধসুরভিত নস্য লইয়া কহিলেন, ‘ওহে বিশ্বাবসু, তুমি নাকি মর্ত্যবাসকালে অভিনয়কলায় নূতন ধারার প্রবর্তন করিয়াছ, তাহার কিঞ্চিৎ নমুনা প্রত্যক্ষ করিতে ইচ্ছা করি।’

বিশ্বাবসু জোড়হস্তে কহিলেন, ‘প্রভো, সে সকল অভিনয় কি আপনাদিগের রুচিকর হইবে? আর আমি ধীরললিত নায়ক সাজিবার উপযুক্ত নহি, একাকী সঙ সাজিয়া ঢং করিলে আপনার পেয়ারের অপ্সরাগণ অঙ্গে ধূলা দিবে। আরও অনেকেই তো ভূলোকবাস সম্পন্ন করিয়া আসিয়াছে, তাহাদিগকে ছাড়িয়া কেবল এই অধমের প্রতি এ হেন কৃপা কেন?’

পুরন্দর কহিলেন, ‘যাহাকে ইচ্ছা লও, তোমাকে কুশীলব নির্বাচনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হইল।’

গীতনায়ক সৌরসেন গন্ধর্বলোকে তাঁহার চতুর্থতলের আবাসে একটি স্বর্গীয় ইজিচেয়ারে অঙ্গ এলাইয়া মর্ত্যপানে চাহিয়া ‘আনমনা, আনমনা’ গাহিতেছিলেন, বিশ্বাবসু তথায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। গানটি শেষ হইতে না হইতেই হাততালি দিয়া উঠিলেন- ‘এই জন্যই তো আপনার কাছে আসা মশাই!’

সৌরসেন এখনও মর্ত্যের বাচনভঙ্গি বিস্মৃত হন নাই। পুরাতন সহপাপীগণের কেহ কাছে আসিয়া ‘দাদা’ বা ‘মশাই’ বা ‘...বাবু’ সম্বোধন করিলে তিনি আজিও পরমা প্রীতি লাভ করেন। বিশ্বাবসুকে দেখিয়া ‘আসুন, আসুন ...বাবু’ বলিয়া আলিঙ্গন করিলেন।

ইন্দ্রের হুকুম শুনিয়া সৌরসেন বলিলেন, ‘বেশ তো, প্লেব্যাকে কাদের লাগবে বলুন, আমি ব্যবস্থা করে দেব। তার আগে বলুন, কোন স্ক্রিপ্ট নামাবেন, সেটা ভেবেছেন?’

‘প্লেব্যাক লাগবে না। আপনাকে আর শ্যামলী, মাধবীদের দিয়ে কোরাস গাওয়াতে হবে না।’

সৌরসেন মধুর হাস্য করিলেন, ‘ওঃ, সেসব আপনি মনে রেখেছেন!’

‘রাখব না তো কি মশাই! যেভাবে আপনি বলেছিলেন, ‘আর তো কাউকে পেলাম না ভাল বাংলা উচ্চারণে কোরাস গাওয়াবার মত, তাই ওদের দিয়েই করিয়ে নিলাম।’ যেন পাড়ার শ্যামলী, মাধবীদের ডেকে বললেন আর তারা গেয়ে দিল। আপনি কী ভয়ঙ্কর লোক, সেদিন বুঝেছিলাম!’

একচোট হাসিয়া লইয়া সৌরসেন বলিলেন, ‘নিন, নিন, এখন কি করতে হবে বলুন।’

বিশ্বাবসু ঘোষণা করিলেন, ‘প্লেব্যাকের দরকার নেই। আপনাকে স্টেজে নামাব। আপনার চরিত্রের গান আপনিই গাইবেন।’

‘অ্যাঁ!’ সৌরসেন চমকিত হইলেন।

‘অ্যাঁ নয় হ্যাঁ। চিরকুমার সভা নামাব। সংক্ষিপ্ত নয়, পুরোটা। শ্রুতিনাটক নয় কিন্তু, ফুল অ্যাকটিং। আপনি অক্ষয়। আমি রসিক। দু-চারটে কচি বিদ্যাধরীকে শিখিয়েপড়িয়ে আপনার গিন্নি আর শালিদের রোলে দাঁড় করিয়ে দেব।’

‘মুশকিল করলেন! চিত্রসেনকে দিয়ে অক্ষয় করান না। ও অনেকদিন তো এসব করতে পায় নি, মানাবেও ভাল। আমি নাহয় পেছন থেকে...’

‘না, আপনাকেই সামনে থেকে করতে হবে। আপনাকে নায়ক বানিয়ে দেখবেন কি জিনিস নামাই! আপনার মত জামাইবাবু পাওয়ার জন্য দেখবেন রম্ভা উর্বশীগুলো সব বৈকুণ্ঠে গিয়ে রমার মাথায় জল ঢালতে লেগেছে!’

সৌরসেন সভয়ে কহিলেন, ‘এবার কিন্তু আমি দৌড় দেব।’

বিশ্বাবসু খপ করিয়া তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়া গর্জন ছাড়িলেন, ‘অত সোজা নয়। প্রয়োজন হইলে কোটাল হইয়া আপনার পশ্চাতে দৌড়াইব। রে বৃক্ষে উত্তোলনপূর্বক চরসোপান হরণকারী মহামহিম শালিবাহন, ভালো ভালো তুমি দেখব পালাও কোথা! কী ভাবিয়াছেন, প্রত্যেকদিন লাস্ট বাস ধরিবার জন্য দৌড়াইয়া আমাকে হারাইতেন, তৎপরে পাদানিতে ঝুলিয়া টানিয়া তুলিতেন - সে সব ভুলিয়া গিয়াছি! কড়ায়গণ্ডায় শোধ তুলিব।’

সৌরসেন কহিলেন, ‘আপনি পারেনও বাবা! আচ্ছা, করব।... অ্যাডভান্সটা দেবেন কিন্তু।’

‘কি চাই বলুন? বেশি পারব না মশাই।’

‘পারিজাত ফ্লেভারের রাবড়ি একটু এনে খাওয়াবেন।’ সৌরসেন মৃদুহাস্যে তাঁহার দাবি জ্ঞাপন করিলেন।

‘এই কথা? সানন্দে। তবে রাজি?’

‘রাজি। তবে পাঞ্জাবি পরাবেন না বলে দিলাম। আমি কিন্তু আমার জাতীয় পোশাকটা পরেই নামব। আমার মর্ত্যদেহের ফিফটিজের মুখটা চলবে তো? একটু পারফিউম নেব, একটা হালকা গোঁফ দিতে পারেন।’

‘ডায়লগগুলো মুখস্থ করতে হবে কিন্তু। মনে আছে না ভুলে মেরেছেন? আমি কিন্তু খুব কড়া ডিরেক্টর!’

‘সে হয়ে যাবে। আপনি বাকিদের ঠিক করুন তো আগে।...আজ এসেছেন যখন, খেয়ে যেতে হবে।... মুরগি না মটন?’

বিশ্বাবসু প্রবল উচ্ছ্বাসে তাঁহার হাত ঝাঁকাইয়া বলিলেন, ‘এই তো আমার অক্ষয়।’

সকল কুশীলব নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইল। বিশ্বাবসুর বড় সাধ ছিল, উদ্গাতাকে দিয়া চন্দ্রবাবুর চরিত্র রূপায়ন করাইবেন। সে প্রস্তাব শ্রবণ করিয়া উদ্গাতা মাত্রাবিবর্জিত অতিমন্দ্রনিনাদে কহিলেন, ‘আ-মি তো আ-গেই কইসি, স্ট্যা-জে আর উ-ঠুম না। বরং চৌকিতে বইস্যা আ-পনাগো না-টকের ম-ঙ্গল কামনায় সা-মগান করুম।’

‘তথাস্তু। কৃতার্থ হইলাম’, বলিয়া পরিচালক স্থানত্যাগ করিলেন। মহড়ার সময় বহিয়া যায়।

অভিনয় আরম্ভ হইয়াছে। ভরতমুনি সুদীর্ঘ দাড়ি নাড়িয়া কহিলেন, ‘এ কিরূপ নাট্য! নান্দী নাই, বিষ্কম্ভক প্রবেশক সন্ধি কিছুই নাই। নায়ক কিনা নায়িকাগণের ভগ্নীপতি! ইহা অনাচার!’

স্বর্গের জেমিনি সার্কাসের তাঁবু হইতে গলা বাড়াইয়া জৈমিনি বলিলেন, ‘উহা আপনার শ্মশ্রুকণ্ডূয়নধন্য শাস্ত্র হইতে অধিক বলবত্তরপ্রমাণ লোকাচার।’

প্রজাপতি গোঁফে তা দিয়া বলিলেন, ‘শুনিলে না, সঞ্চালকে কি বলিয়া গেল! ইহা নাকি পূর্বে আমারই নির্বন্ধ ছিল। আমার নাম তো করিয়াছে বাপু। উহাই নান্দী। সকল বিষয়ে দোষ ধরিও না।’

ভরত বিরক্তস্বরে বলিলেন, ‘ভগবন্, আপনি নির্বিকল্প পরমপুরুষ, তাহা বলিয়া আমার শাস্ত্রে এরূপ উলটপুরাণ আমাকে সহ্য করিতে বলিবেন না।’

নন্দিকেশ্বর ফুট কাটিলেন, ‘হে তপোধন, আপনি পুরাণীপ্রজ্ঞা লইয়া ব্যাড় ব্যাড় করিবেন না, ভাল না লাগিলে উঠিয়া যান। আমাদিগের বেশ লাগিতেছে।’

মনু বলিলেন, ‘কী দামি কথা!’

কুমারিলভট্ট মস্তক হেলাইলেন, ‘ভাবা যায় না!’

মঞ্চে তখন পুরবালা কহিতেছেন, ‘বাবা ভোলানাথের নন্দীভৃঙ্গীর অভাব ছিল না, আমাকে বুঝি তিনি দয়া করেছিলেন।’

অক্ষয় সায় দিতেছেন, ‘...সেইজন্যই কার্তিকটি পেয়েছ।’

‘আবার ঠাট্টা শুরু হল?’

‘কার্তিকের কথাটা বুঝি ঠাট্টা? গা ছুঁয়ে বলছি, ওটা আমার অন্তরের বিশ্বাস।’

কুমার কার্তিকেয় ফোঁস ফোঁস করিয়া বারংবার নিষ্ফল নিঃশ্বাস ফেলিতেছেন, আর ভাবিতেছেন, ‘আহা, এই রোলটি যদি পাইতাম! আজকাল কেহ পাত্তা দেয় না। অবশ্য গান গাহিতাম কীরূপে?’

অক্ষয়রূপী সৌরসেন ততক্ষণে এমন টপ্পাঙ্গের গান ধরিয়াছেন, যে স্বর্গীয় প্রেক্ষাগৃহের সর্বত্র অনুরণন উঠিতেছে। শব্দগ্রাহক ‘এ কি হইল’ ভাবিয়া বক্সটি নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে গিয়া হাতে স্পার্ক খাইয়া ছিটকাইয়া পড়িলেন। তাঁহার নাদব্রহ্মের অনুভব হইয়া গেল।

উইংসের ধার হইতে পরিচালক ফিসফিসাইয়া বলিলেন, ‘মশায়, এবার থামুন। আপনি যে সবই ‘একটু আধটু’ পারেন সেটা সবাই বুঝে গেছে।’

অক্ষয় উইংসের পানে দৃষ্টিপাত করিয়া মুচকি হাসিলেন।

গ্রিনরুমে বসিয়া ঘামিয়া নাহিয়া অঙ্গারপর্ণ ভাবিলেন, ‘পরিশ্রম করতে হবে, এমন কথা আর বলব না বাবা!’

নাটক চলিতেছে। মঞ্চোপরি অক্ষয় ও বিবাহেচ্ছুক কুলীন সন্তানদ্বয়ের যুগলবন্দিতে দর্শকাসনে মুহুর্মুহু হাস্যরোল উঠিতেছে। অক্ষয় গম্ভীর মুখে বলিতেছেন, ‘আরে মশায়, নাম শুনেই হাসি! তা হলে তো গন্ধে অজ্ঞান এবং পাতে পড়লে মারাই যাবেন।’

শুনিয়াই স্বর্গের গুটিকয় পাচক পড়িল আর মরিল – অর্থাৎ মর্ত্য অভিমুখে যাত্রা করিল।

রসিক প্রবেশ করিলেন। আসর জমিয়া ক্ষীর হইল। অক্ষয় রসিককে ‘দেখো দাম্পত্যতত্ত্বানভিজ্ঞ বৃদ্ধ’ বলিয়া সপ্রেমে সুমন্দ্র সুস্বরে গাল পাড়িলেন, রসিক খ্যাক খ্যাক করিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন।

অক্ষয় ছদ্মমন্দাক্রান্তায় উদাত্ত সংলাপ ঝাড়িলেন, ‘বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী বলেন, আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব, আমার এক দণ্ড এখানে থাকতে ইচ্ছা নেই - আমার হাড় কালি হল...’ তখন অলকাসুন্দরীগণের জন্য নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্টা এক তন্বী শ্যামার চক্ষে জল আসিল, ‘আহা, আমিও কতকাল বাপের বাড়ি যাই নাই!’

পিছনের সারি হইতে হতভাগ্য যক্ষ প্রিয়াকর্ণমূলের নিকট মুখ বাড়াইয়া গুঞ্জরিয়া উঠিল, ‘কি হইল, প্রাণবল্লভে পক্ববিম্বাধরোষ্ঠি...?

শিখরিদশনা ফুঁসিয়া উঠিল, ‘প্রবঞ্চক! হেঁড়ে গলায় ন্যাকামি করিতে আসিয়াছ? জীমূত ঠাকুরপোর হস্তে যে অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংটি পাঠাইয়াছিলে, তাহাতে তুমি যে কেবল লিপ দিয়াছিলে, তাহা যেন আমি বুঝি নাই!’

যক্ষ বেগতিক দেখিয়া আসনের নিম্নদেশে লুকাইল।

ওদিকে অপ্সরাগণ মুগ্ধনেত্রে অক্ষয়কে দেখিতেছে আর গান শুনিতেছে, কিন্নরগণের বুক জ্বলিতেছে। মঞ্চে তখন অক্ষয় কাশীবাসিনী পুরবালার উদ্দেশে পত্র লিখিবার জন্য উপযুক্ত অবসর খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন – ‘হা প্রিয়ে, তোমার ধ্যান থেকে যারা আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করেছে তারা মেনকা রম্ভা উর্বশী হলে আমার কোন খেদ ছিল না – মনের মত ধ্যানভঙ্গও অক্ষয়ের অদৃষ্টে নেই, কলিকালে ইন্দ্রদেবের বয়স বেশি হয়ে বেরসিক হয়ে উঠেছে।’

পাকশাসন হাঁকপাক করিয়া বেসুরো বজ্রনাদ ছাড়িয়া রাজাগিরি দেখাইতে উঠিলেন – ‘স্তব্ধ হও! এ রাজদ্রোহ চলিবে না। আমাকে নিয়া রসিকতা? অবিলম্বে এমত সংলাপ পরিবর্তন কর, নচেৎ...’

একটা বিকট গোলযোগ উপস্থিত হইল। অধিকাংশই পরমানন্দে দেখিতেছিল, তাহারা দেবরাজের প্রতি বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে চুপ করাইবার জন্য আওয়াজ তুলিল। কয়েকটি রাজভক্ত চামচ চিলচিৎকারে চিত্ত বিক্ষিপ্ত করিয়া তুলিল। হায়, বিশ্বাবসু কি সত্যই রসিকত্ব ভুলিয়া সোদ্বেগে গোলমাল থামাইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন? তাঁহাকে আগলাইয়া দাঁড়াইয়া অক্ষয়রূপী সৌরসেন দুই হস্ত উত্তোলন করিয়া আসর সামলাইবার ভঙ্গিতে বলিলেন, ‘শুনুন, শুনুন। শান্ত হয়ে বসুন। আপনি ইন্দ্র হতে পারেন, কিন্তু এ সংলাপ যিনি লিখেছেন তিনি রবীন্দ্র। আমার গুরু, পথপ্রদর্শক, দ্রষ্টা – যা বলেন। তাঁর কথা পরিবর্তন করতে আমি পারব না।’

‘রে অপ্রশিক্ষিত অর্বাচীন-জনচিত্তসংবেদী প্রাতিস্বিক গন্ধর্ব, তবে শাস্তি গ্রহণ কর! পুনরায় মর্ত্যে যাইবার জন্য প্রস্তুত হও!’ বলিয়া সুরপতি অসুরের ন্যায় লম্ফ দিয়া উঠিলেন।

অপ্সরা, কিন্নরী, বিদ্যাধরীগণ হাপুস নয়নে কাঁদিতে কাঁদিতে সৌরসেনের পাদমূলে পতিত হইল, সমস্বরে গাহিয়া উঠিল, ‘ছাড়িব না, ছাড়িব না...’

ইন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিলেন, ‘সুরাঙ্গনাগণ, উহাকে ছাড়িয়া দাও। নচেৎ তোমরাও অশেষ দুঃখ পাইবে।’

এতগুলি ভগ্নীসমা রমণীর বিপদ দেখিয়া, সৌরসেন তাঁহার অন্যতর অবতার স্মরণ করিয়া, কিঞ্চিৎ কঠোর সুরে গাহিলেন, ‘তবু ছাড়িবি না মোরে?’

অশনি বিকট শব্দে নিক্ষিপ্ত হইল। তখন এক অলৌকিক ব্যাপার - বিষ্ণুদেব বামনরূপে আসিয়া গোবর্ধন তুলিয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘যাহার কণ্ঠে “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে...” শুনিয়া স্বমুখনিসৃত বাণী সার্থক বোধ হইয়াছে, দেখি কোন হাজারচোখো তাহার গায়ে আঁচড় কাটে।’

ভূতনাথ গঞ্জিকাসেবন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া বরাভয় মুদ্রায় কলিকাকুসুম নাড়িয়া কহিলেন, ‘আঃ, ‘ব্যোম ব্যোম ভোলে’টা দারুণ দিয়েছিলি বাবা, কোন ভয় নেই!’

উদ্গাতা সবেগে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, ‘আ-মার সা-মগানে বি-ঘ্ন ঘটাইল কেডা? হালায় বে-তালে বাজ ফে-লাইয়া কোন বু-দ্ধিমানের কা-জডা হইল শুনি? এ-ই মূ-র্খের স্বর্গে আ-র আমি সাম গামু না।’

সকলে হাহাকার করিয়া উঠিল। ইন্দ্র বিপদ বুঝিয়া বলিলেন, ‘আমি অদ্য উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবন করি নাই, তাই মস্তিষ্ক উত্তপ্ত ছিল, সকলে মার্জনা করিবেন। কিন্তু সৌরসেনকে তো পুনর্বার মর্ত্যে প্রেরণের কথা উচ্চারণ করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার কি হইবে? দেববাক্য তো মিথ্যা হইবার নহে।’

দেবী ভারতী আসিয়া কহিলেন, ‘বাক্য, বচন, শিল্প সকলই আমার অধিকারে। সামগান নষ্ট হইয়াছে, শিল্পের অপমান ঘটিয়াছে। উত্তম, যে স্থানে আমার কৃপাধন্যের অসম্মান হয়, আমিও সেই স্থান ত্যাগ করিয়া চলিলাম। চল বৎসগণ।’

বিশ্বাবসু সৌরসেনের নিকটে আসিয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিলেন, ‘কেমন বুদ্ধিটা ছিল, বলুন! এখানে থাকতে আর ভাল লাগে?’

‘এ আপনার প্ল্যান? সত্যি, আপনার তুলনা নেই’, সৌরসেন হাস্য করিলেন।

‘আপনার বুঝি আছে?’

সরস্বতী অগ্রে চলিলেন, পশ্চাতে উদ্গাতা, কিঞ্চিৎ পরে বিশ্বাবসু ও সৌরসেন।

স্বর্গের অন্তিম তোরণের সম্মুখে আসিতেই কেহ একজন আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হইয়া, সৌরসেনের পদযুগল জড়াইয়া ধরিল, ‘দাদা, আমাকে ফেলে যাবেন না!’

সৌরসেন চিনিতে পারিলেন। হাসিয়া বলিলেন, ‘তুমিও যাবে, চিত্রসেন? এখানে সবাই যে কাঁদবে।’

‘কাঁদুক। কান্না ভাল, কিন্তু কান্নার একটা সীমা থাকা উচিত। আপনাকে আর ছাড়ছি না।’

ছায়াবৃতা রহস্যময়ী আর একটি প্রতিমা আসিয়া বলিল, ‘আমিও যাব, কিন্তু ও যেন আমাকে টাআচ না করে!’

মোক্ষম সময়ে এমন স্বর্গীয় স্বপ্নটি ভাঙ্গিয়া গেল। কী আর করি, দাঁত কড়মড় করিয়া নিদ্রাদেবীকে গাল পাড়িতে পাড়িতে স্বপ্নবৃত্তান্ত লিখিতে বসিলাম।

সুধী পাঠকবৃন্দ, দোষ দিও না আমায় বন্ধু। আমার এই যে লেখা, এ লেখা তো আমার নহে, যিনি লিখাইয়াছেন, তাঁহার। দেবী শ্বেতপদ্মাসনা আমার শিরা-উপশিরাগুলিকে বীণার তারের ন্যায় বাজাইয়াছেন, মুণ্ডটিকে তবলা জ্ঞান করিয়া চাঁটি মারিয়া গেছেন, আর তাঁহার বরপুত্র আমার হৃদয়টিকে হারমোনিয়ামের বেলোর ন্যায় আপন হাতের দোলে যথেচ্ছ দোলাইয়াছেন, আর আমি দরিদ্র ব্যক্তি কেবল লিখিয়া মরিয়াছি। অতএব দায় তাঁহাদের।



(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)


ছবিঃ বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়