আকাশে তখনো আলো ফোটেনি, ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই যেসব পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে দেয় তারাও তখনো পুরোপুরি ঘুম থেকে ওঠেনি। মঙ্গলের ঘুমটা আজ এই অসময়ে ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসল মঙ্গল আর তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল সদ্য দেখা স্বপ্নটার কথা। সাধারণত ঘুম ভেঙে গেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোর কথা মনে পড়ে না, বড়জোর তার রেশটা কিছু সময় পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রাখে মনটাকে, তারপর আসতে আসতে ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু আজকের শেষরাতে দেখা স্বপ্নটা রীতিমত ঘামিয়ে দিয়েছে মঙ্গলকে, মুহূর্তের জন্য হলেও গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল, গলার কাছে একটা কী যেন চেপে বসেছিল, পাশেই দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোনো সুমতিকে ডাকতে গিয়েও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। খানিক ধাতস্ত হবার পর বিছানা থেকে নেমে এক গেলাস জল খেল মঙ্গল, তারপর আবার বিছানায় ফিরে শুয়ে পড়ল কিন্তু দু-চোখের পাতা আর এক করতে পারল না কিছুতেই।
অলস ভাবে এপাশ-ওপাশ করতে করতে কত কথা মনে পড়ে। এই কটা মাস আগেও হইহই করে জমিয়ে বেঁচে ছিল যে মানুষটা সে আজ অতীত। বড্ড তাড়াহুড়ো করে যেন চলে গেল সব কিছু ফেলে রেখে। বাবার চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে কষ্ট হয় মঙ্গলের। বাবা মারা যাবার পর কয়েক দিন একটু-আধটু গা ছমছম করত বইকি তবে কোনদিন সেই অর্থে ভয় পায়নি মঙ্গল। পাড়া গ্রামে তো ছোটো থেকে এমনিতেই গা-ছমছমে পরিবেশে বড় হওয়া, বাঁশঝাড়, মাঠ ঘাট আর শ্মশানের পাশ দিয়ে চলাফেরা করে করে ভয়ডর মঙ্গলের খুব কিছু নেই। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর অনেকেই সাবধান করেছে, “একটা বছর খুব সাবধানে থাকিস বাপ, এই সময় কিন্তু টানে।” এত দিন পরে স্বপ্ন দেখে খানিক ভয় পেয়েছে মঙ্গল। এখনো স্পষ্ট কানে লেগে আছে বাবার ধমকটা, “হতভাগা মেনিমুখো; আর কত দিন বউয়ের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকবি? যদি সুমতি আবার তোর মায়ের সাথে ঝামেলা করে আর তুই মুখরা সুমতির পক্ষ নিস, তাহলে তোর মজা দেখাব বলে রাখলাম।” মঙ্গল বলতে চেষ্টা করছিল যে ও তো এসবের মধ্যে থাকে না আর মনে মনে মায়েরই পক্ষ নেয়, যদিও সুমতির ভয়ে মুখ খুলে অশান্তি বাড়ায় না, কিন্তু সেটা বলার আগেই যে বাবা চলে গেলেন, যেন সিনেমার পর্দা পড়ে গেল আর ঘুমটা ভেঙে গেল। তাছাড়া, কথা বলার চেষ্টা করতেই গলার কাছে যেন কী চেপে বসল, বোবায় ধরলে যেমন হয় আর কি। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরত মঙ্গলকে। চণ্ডীমণ্ডপের ঠাকুরমশাইয়ের কাছ থেকে একটা তাবিজ এনে পরিয়ে দিয়েছিল বাবা। মন্ত্রপূত সেই তামার তাবিজের তেজ-গুণে, মঙ্গল বোবায় ধরা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু সুমতিকে বিয়ে করার পর থেকে প্রায়ই বোবা সেজে থাকতে হয় মঙ্গলকে, গৃহশান্তি বজায় রাখার এর চাইতে ভালো উপায় আর কিই বা হতে পারে! তবে স্বপ্নে বাবা যে ধমকানিটা দিয়ে গেল, সেটা মঙ্গলকে কিছুটা চাঙ্গা করেছে বলেই মনে হল ওর, মনে যেন একটা অতিরিক্ত জোর অনুভূত হচ্ছে এখন, মনে হচ্ছে মা আর সুমতির মাঝখানে বট গাছের মতো দাঁড়িয়ে দুই বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের দাপটকে সামাল দিতে পারবে এবার দৃঢ়ভাবে।
সাত পাড়ার লোক খাইয়ে, প্রচুর খরচ-খরচা করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিল লক্ষ্মীকান্ত। এক ছেলে, তায় রমরমিয়ে চলা সারের ব্যবসা, আর জমিজমা নেহাতই কম না। হতচ্ছাড়া মঙ্গল বেশিদূর লেখাপড়াটাও করল না, লক্ষ্মীর বড় আশা ছিল মঙ্গল বিয়ে পাশটা অন্তত দেবে আর সেই সাথে বংশে প্রথম গ্রাজুয়েট হয়ে রেকর্ড করবে। কিন্তু সে-ছেলে বাপের সব আশায় জল ঢেলে লেখাপড়ায় ইতি টানল স্কুলের গণ্ডিটুকু পেরিয়েই। বিচক্ষণ লক্ষ্মীকান্ত আর বেশি কালক্ষেপ না করে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দিল মঙ্গলকে। বাপের কারবার মোটামুটি সামলে নিল মঙ্গল, আবার বিঘাকয়েক জমিতে চাষ করে ভালো পয়সা করার কায়দাকানুনও মোটামুটি ভালোই রপ্ত করল সেই সঙ্গে। চব্বিশ পেরোতেই সানাই বাজল আর ঘর আলো করে এল সুমতি। সম্পন্ন পরিবারের লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে দেখে পছন্দ করেছিল লক্ষ্মীকান্ত। প্রথম দিকটায় বেশ শান্ত স্বভাবের পুতুল-পুতুল হাবভাব নিয়ে সংসার শুরু করল সুমতি। কিন্তু বছর না ঘুরতেই বোঝা গেল, এই মেয়ের মধ্যে আর যে গুণই থাক না কেন, নামের সাথে তার স্বভাবের মিল একেবারেই নেই, সে সব ব্যপারেই শাশুড়ির বিপরীতে থাকতে অভ্যস্ত আর সর্বদাই খড়্গহস্ত। অন্যদিকে শাশুড়ি হরিমত,ও নেহাত কম যায় না, তার এতদিনের সাজানো বাগানে অন্য কেউ এসে ইচ্ছেমত ছড়ি ঘোরাবে, তাই বা সে মেনে নেয় কী করে? সমানে সমানে তাই টক্কর চলতেই থাকে এই বাড়িতে, আর বেচারা মঙ্গল সব দেখে শুনে বিয়ের এক বছরের মধ্যেই দিল্লি কা লাড্ডু খেয়ে বদহজমের ঠেলায় দিশাহারা। লক্ষ্মীকান্ত হঠাৎ মারা যাবার পর কিছুদিন হরিমতি খুব মনমরা হয়ে পড়ল, হাজার হোক, স্বামীর জোর থাকা আর না থাকার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক তা বঙ্গদেশের মেয়েদের থেকে আর কে ভালো জানে! অন্যদিকে সুমতিও কটা দিন ঠান্ডা মেরে থাকল আর শাশুড়ির হাতে হাতে ঘরের কাজ কর্ম করতে দেখে মঙ্গল ভাবল সুমতির বুঝি সুমতি ফিরেছে। কিন্তু সে ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। মঙ্গলকে নিয়ে অধিকারের লড়াই দুই নারীর মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করার আগেই মঙ্গল সহজ পথ বেছে নিল, দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটিয়ে রাতে ঘরে ফিরে কোন ক্রমে দুটি নাকে-মুখে গুঁজে শয্যা নিতে শুরু করল। মা-বউয়ের চুলোচুলি যখন থামানো যাবে না, তখন তার থেকে পালিয়ে বাঁচাই শ্রেয় বুঝে নিল মঙ্গল।
আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শরীর মনে একটা অতিরিক্ত বল অনুভব করল নির্ঝঞ্ঝাট স্বভাবের মঙ্গল। স্বপ্নে বাবার আবির্ভাব আর ধমকটা তো আর অবহেলা করা যায় না, কিছু একটা করতে হবে যাতে বাবা শান্ত থাকে। রোজের মতোই সকাল সকাল খানকয়েক রুটি আর বাটিচচ্চড়ি সাবড়ে মঙ্গল বেরিয়ে পড়ল। নৃপেন বাউরির সাথে মকরামপুর মৌজার তিন ছটাক জমি নিয়ে বিবাদ লক্ষ্মী বেঁচে থাকতেই আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল। ভোলা নস্কর কেস জিতিয়ে দেবে বলে হাজার কয়েক টাকা হাতিয়েও নিয়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু মামলাও শেষ হয় না আর শুনানি থাকলেই ভোলার হাতে টাকা গুঁজে দিতে হয় নিয়ম করে। এসব নিয়ে এমনিতেই জেরবার হয়ে আছে মঙ্গল, তার ওপর ঘরে নিত্য অশান্তি। রাতে ঘরে ফিরতেই সুমতি শুরু করল, তোমার মা এই বলেছে সেই বলেছে দিয়ে। চুপচাপ খানিক শোনার পর, মঙ্গল হঠাৎ বলে বসল, “আর এসবের মধ্যে আমাকে জড়িয়ো না, আমি বাবার নির্দেশ পেয়ে গেছি, এবার অনেক দুরের পথে বেরোতে হবে। তোমরা ভালোভাবে থেকো, যা কিছু থাকল, সেসব তো তোমাকেই দেখে রাখতে হবে।“
সুমতি একটু ধাক্কা খেল, হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবে তুমি? বাবা যে আর নেই, তুমি কি পাগল হলে?”
“বাবা স্বপ্নে আদেশ দিলেন যে, এই সংসার, ঘরদোর আমার জন্যে নয়, হিমালয়ে যেতে হবে আমাকে, সন্ন্যাসেই আমার মুক্তি, আমি দুদিন পরেই বেরিয়ে পড়ব ভাবছি। মাকে দেখো, বুড়ির যে আর কেউ থাকল না গো সংসারে।” একটু ফুঁপিয়ে উঠল মঙ্গল।
প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সুমতি, “কী বলছ তুমি? আমার কী হবে তাহলে? আমাকে একা রেখে তুমি কোথায় যাবে গো?” বিলাপের সুরে কান্নাকাটি জুড়ে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধাল সুমতি। সব শুনে হরিমতিও তারস্বরে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। সে রাতে আর কারো খাওয়া হল না। মঙ্গল খুব একটা কিছু না ভেবেই সন্ন্যাসের গল্পটা বলে ফেলেছিল সুমতিকে, সেটা যে যুযুধান দু-পক্ষই সমানভাবে খাবে সেটা ছিল ওর ধারণার বাইরে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশ খুশিই হল মঙ্গল। মাথার ওপর বাবা তো আছেন, তিনিই পথ দেখাবেন।
সকালে বেশ খানিকটা দেরি করেই উঠল মঙ্গল। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি বটে, তবুও খুব কিছু অবসন্নতা আছে মনে হল না শরীরে। আশেপাশে সুমতিকে না দেখে হরিমতির ঘরের দিকে গেল মঙ্গল। বাইরে উঁকি দিয়ে যা দেখল তা যে কখনো হতে পারে সেটা ভাবনার বাইরে ছিল মঙ্গলের। হরিমতির সামনে একটা জামবাটিতে দুধ রাখা আছে আর তাতে রুটি ভিজিয়ে দিচ্ছে সুমতি। মিনতি করে শাশুড়িকে খাওয়ার জন্য বলছে, “রাতে কিছু খেলেন না, এবারে যে পিত্তি পড়বে, আপনি না খেলে আমি খাই কেমনে? ওদিকে মানুষটা কী করে কে জানে!!” হরিমতি কিছুটা অবিশ্বাস আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই সুমতির দিকে। মঙ্গল চুপিসাড়ে ফিরে এল নিজের ঘরে, বিস্মিত সেও কম হয়নি এই ঘটনাক্রমে। কোন্ জাদুতে সুমতির এই সু-মতি ফিরল সেটা ভাবতে ভাবতেই সুমতি ঘরে এল, মঙ্গলের পাশটিতে বসে খুব ক্ষীণ গলায় বলল, “তিনি কাল এসেছিলেন, আমি পষ্ট দেখলুম।”
“কী বলছ কী? কে এসেছিল, বাবা?” বিস্ময় ঝরে পড়ে মঙ্গলের গলায়।
ঢোক গিলে সুমতি বলল, “হ্যাঁ গো হ্যাঁ, শ্বশুরমশাই বটে, স্বপ্ন হলে কী হবে, যেন পষ্ট দেখলুম, বারান্দার কোনটিতে মোড়ায় বসে আছেন, আমাকে কত কিছু বলছেন কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। আমি প্রণাম করতে গেলাম আর তিনি আমার মাথায় আশীর্বাদ করে হাত রাখলেন, অমনি ঘুম ভেঙে গেল। তিনি যখন দেখা দিয়েছেন, নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে, আমার গায়ে যেন কাঁটা দিচ্ছে এখনও।” গলাটা ধরে এল যেন সুমতির, বললে, “ওগো তুমি আমাদের ছেড়ে কোথাও যেও না, আমরা দুটি মেয়েমানুষ কেমন করে বাঁচব তোমাকে ছেড়ে? কথা দিচ্ছি আর কোনদিন অশান্তি করব না, এই আমি তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলুম।” মঙ্গল লক্ষ করল, সুমতির দুচোখের পাতা ভিজে উঠেছে।
মঙ্গল সুমতির মাথায় আলতো করে হাত রাখল, আদুরে গলায় বলল, “আমার মা কি তোমার মা নয়? বাবা তোমাকে সেটাই বলেছিলেন বটে, তুমি বোঝোনি।” সুমতি কিছু বলার আগেই মঙ্গল উঠে পড়ল, মিটকেসের ওপর যত্নে রাখা ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করল, মঙ্গল জানে, তিনি না থেকেও আছেন, খুব বেশি করে আছেন।
অনেকদিন পর মঙ্গল খুব তৃপ্তি করে খেল, গরম ভাত আর মুসুর ডাল, সাথে একটু আচার আর বেগুন ভাজা। হরিমতি আর সুমতি দুজনেই সামনে বসে খাওয়ালো মঙ্গলকে। খাওয়া শেষ করে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েও পড়ল মঙ্গল, আজ মকরামপুরের জমি মামলার রায় বেরোবে বলেছিল নস্কর উকিল। রায় যে ওর দিকেই যাবে তা এখন নিশ্চিত মঙ্গল, মামলা তো আর মঙ্গল একা লড়ছে না, সঙ্গে যে তিনিও আছেন, মাথার ওপর, সবার অলক্ষ্যে।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)